কৃত্তিবাসী রামায়ণের দুই সমকামী নারীর উপাখ্যান

লিখেছেন- সুমন দাস

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমন খুব কম সংখ্যক লোকেই পাওয়া যাবে, যাদের কাছে ‘সমকামী’ ( Homosexual ) শব্দটি পরিচিত নয়। এই প্রবন্ধে পৌরাণিক যুগের দুই ‘সমকামী নারী’র ( Lesbian )  উপাখ্যান সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এই আখ্যান সবচাইতে ভালো ভাবে বর্ণিত হয়েছে ” কৃত্তীবাস ওঝার রামায়ণ পাঁচালিতে”।

পৌরাণিক যুগে সূর্যবংশের একজন বিখ্যাত রাজা ছিলেন সগর। সগর রাজার রাজধানী ছিলো বিখ্যাত অযোধ্যা নগর। দেবাদিদেব মহাদেবের বরে এই সগর রাজের ৬০,০০১ টি পুত্রের জন্ম হয়। কিন্তু অশ্বমেধ যজ্ঞকালে যজ্ঞের ঘোড়াকে কেন্দ্র করে মহর্ষি কপিল মুনির শাপে সগর রাজার ৬০,০০০ পুত্র ভস্মীভূত হয়ে যায় । শুধু অসমঞ্জ নামে এক পুত্র জীবিত থাকেম। অতঃপর সগর রাজের অনুনয়-বিনয়ের ফলে মহর্ষি কপিলমুনি এই উপদেশ দেন যে, যদি দেবী গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে কখনো মর্ত্যে এনে এই ৬০,০০০ ভস্মীভূত স্তূপের উপর প্রবাহিত করা যায় তাহলেই সগর বংশ মুক্তি পাবে ; অন্যথায় নয়।

অতঃপর এই অসম্ভব কার্যকে সম্ভব করার উদ্দেশ্যে সগর রাজা স্তব শুরু করেন। কিন্তু তিনি এই অসম্ভব কার্যকে সম্ভব করতে পারলেন না। আর পারবেনই বা কী করে? দেবী গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আনা কি চারটে খানি কথা! অবশেষে সগর রাজার মৃত্যু হলো। এমনকি এই দুঃসাধ্য কার্যে ব্রতী হয়ে সগর রাজার পুত্র অসমঞ্জ, তৎপরে অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান, তৎপরে অংশুমানের পুত্র রাজা দিলীপও নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। এইভাবে সূর্যবংশ একরকম নির্মূল হলো।

এইবার প্রজাপতি ব্রহ্মা পড়লেন মহা বিপাকে। যেহেতু এই সূর্যবংশেই পরবর্তীকালে ভগবান বিষ্ণু “শ্রী রামচন্দ্র” রূপে অবতার নেওয়ার কথা, তাই এরূপে সূর্যবংশ নির্বংশ হলে সে কার্য সিদ্ধি হবে কী করে? তাই প্রজাপতি ব্রহ্মা কোনো বুদ্ধি বের করতে না পেরে গেলেন শিবের কাছে। শিবকে তিনি কোনো না কোনো উপায় বের করতে বললেন। শিব তখন ভেবে চিন্তে একটি উপায় বের করলেন।

 রাজা দিলীপের দুই বিধবা পত্নী ছিলেন, ‘চন্দ্রা ও মালা’। ব্রহ্মার সঙ্গে পরামর্শ করে শিব এই দুই বিধবাকে এসে দর্শন দিলেন। তখন চন্দ্রা ও মালা শিবের কাছে তাদের দুর্দশার কথা ও সূর্যবংশ নির্বংশ হওয়ার কথা মনঃকষ্টে ব্যক্ত করেন। শিব তখন তাদের দুজনকে পুত্রলাভের বর দিলেন। কিন্তু বর শুনে চন্দ্রা ও মালা দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারা শিবকে প্রশ্ন করলেন যে, দুই বিধবার কী করে পুত্রলাভ সম্ভব ? তখন শিব তাদের দুজনকে বললেন, তারা দুজনে পরস্পর প্রেমিক-প্রেমিকা ভাবে রতিক্রিয়া করলে তাদের মধ্যে  অবশ্যই একজনের গর্ভধারণ ঘটবে। রাজা দিলীপের দুই বিধবা রানি চন্দ্রা ও মালাকে এই বর দিয়ে শিব বিদায় নিলেন।

              ” দুই নারী কহে শুনি শিবের বচন।

              বিধবা আমরা কিসে হইবে নন্দন।।

               শঙ্কর বলেন দুই জনে করো রতি।

                মম বরে একের হইবে সুসন্ততি।। “

                    (  – কৃত্তিবাসী রামায়ণ  )

অতঃপর রানি চন্দ্রা প্রেমিকভাবে রানি মালার সাথে ঘনিষ্ঠ কামক্রিয়ায় লিপ্ত হতে থাকেন। এরপর উপযুক্ত সময়ে রানি মালা গর্ভবতী হয়ে উঠেন।

           ” সম্প্রীতিতে আছিলেন সে দুই যুবতী।

              কত দিনে এক জন হলো ঋতুমতী।।

             দোঁহেতে জানিল যদি দোঁহায় সন্দর্ভ।

            দোঁহে কেলি করিতে একের হলো গর্ভ।। “

                     ( – কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এরপর দশ মাস পূর্ণ হলে রানি মালা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। কিন্তু যেহেতু এই সন্তান ধারণে কোনো পুরুষের বীর্য ছিলো না, তাই সদ্যজাত শিশুর দেহে কোনো অস্থি বা হাড় ছিলো না। রানি মালা কেবল মাত্র মাংসপিণ্ড দিয়ে গঠিত এক পুত্রসন্তান প্রসব করেছিলেন। এই অদ্ভুত পুত্র প্রসব করে দুই রাণি মনঃকষ্টে সদ্যজাত শিশুকে একটি চুপড়ির মধ্যে পুরে সরযূ নদীতে বিসর্জন দিতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় পথে বশিষ্ঠ মুনিকে দেখতে পেয়ে দুই রানি সমস্ত ঘটনা ঋষি বশিষ্ঠ মুনিকে জানান। বশিষ্ঠ মুনি সদ্যজাত শিশুকে জলে বিসর্জন না দিয়ে পথিপার্শ্বে রেখে যাবার পরামর্শ দেন। চন্দ্রা ও মালা ঋষি বশিষ্ঠের কথা মতো তাই করেন। এরপর সবাই সদ্যজাত শিশুটিকে চুপড়ির মধ্যে পথের ধারে রেখে চলে আসেন। কিছুক্ষণ পর সেই পথ দিয়ে ঋষি অষ্টাবক্র মুনি (এই মুনির দেহের আটটি অংশ বাঁকা ছিলো ) স্নান করতে যাচ্ছিলেন। পথিপার্শ্বে চুপড়ির ভিতর সেই অস্থিহীন এমন অদ্ভুত শিশুকে দেখে তিনি ভাবলেন ঐ শিশু নিশ্চয়ই তাকে উপহাস করার জন্য এমন বেশ ধরে পথের ধারে পড়ে আছেন। তিনি ক্রোধে সেই শিশুকে শাপ দিলেন যে, সে যদি তাকে  উপহাস করে থাকে তাহলে যেন সত্যিই সে ঐ রূপেই চিরকাল থাকে।  আর সত্যিই যদি সেই শিশুটি অমন অদ্ভুত হয়ে থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই যেন সুদর্শন রূপলাভ করে!ব্যাস, এরপর সদ্যজাত অস্থিহীন অমন অদ্ভুত শিশুটি দেখতে দেখতেই অস্থিপূর্ণ হয়ে, সুস্থ-সুদর্শন শিশুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

             ” অষ্টাবক্র মুনি সে যে বিষ্ণুর সমান।

               যারে বর শাপ দেন কভু নহে আন।।

                 অষ্টাবক্র মুনির মহিমা চমৎকার।

                 উঠিয়া দাঁড়ান সে রাজার কুমার।।”

                        ( – কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

অতঃপর ঋষি অষ্টাবক্র ধ্যানযোগে এই শিশুর সম্বন্ধে সবটা জানতে পেরে রানি চন্দ্রা ও মালার কাছে সমর্পণ করেন। যেহেতু দুই ভগের (যোনি) মিলনের ফলে এই শিশুর জন্ম হয়েছে, তাই শিশুর নাম রাখা হলো ভগীরথ। এই ভগীরথই পরবর্তীকালে দেবী গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এনে সগর রাজার ৬০,০০০ পুত্রকে মুক্তি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

পুরাণের এই উপাখ্যানে আমরা স্পষ্টতই আধুনিক নারী সমকামী (Lesbian ) সম্পর্কে একটি চিত্র দেখতে পাই। যেখানে চন্দ্রা ও মালা দুজন নারী হয়েও পরস্পর রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তা সমাজে প্রশংসার সঙ্গে গ্রহণীয়ও হয়েছিলো। এই উপাখ্যান সবচেয়ে ভালো বর্ণিত হয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে। এমনকি ‘চরক সংহিতা’ নামের গ্রন্থটিতেও বলা হয়েছে যে, দুই নারীর মিলনের দ্বারাও সন্তান উৎপাদন সম্ভব। অতএব যারা মনে করেন ‘সমকামে’র ধারণাটি ভারতীয় উপমহাদেশ বিদেশ থেকে রপ্তানি করেছে, তাদের কৃত্তিবাসী রামায়ণ তথা পুরাণ গ্রন্থের এমন উপাখ্যানগুলো পড়ে দেখার আনুরোধ রইলো।

তথ্যসূত্রঃ
১। কৃত্তিবাসী রামায়ণ – আনুমানিক রচনাকাল খ্রিস্টীয় ১৪শ-১৫শ শতাব্দী

২। চরক সংহিতা- আনুমানিক রচনাকাল ১০০ খ্রীষ্ট পূর্ব থেকে ১০০ খ্রীষ্টাব্দে মতান্তরে গুপ্ত যুগ বা ৩০০র থেকে ৫০০ খ্রীষ্টাব্দে

আমি সুমন ; ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর শহরের বাসিন্দা। পেশায় একজন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার অনেকগুলো শখের মধ্যে আন্যতম একটি বিশেষ শখ হলো লেখালেখি। যদিও এখনো পুরোদস্তুর লেখক হয়ে উঠতে পারি নি, চেষ্টা চলছে মাত্র। একে তো আমি প্রচণ্ড অলস, তার উপর আবার মোবাইলপোকা; কাজেই বুঝতেই পারছেন লেখার ক্ষেত্রে উন্নতির আশা খুব একটা আমার নেই। তবে  মাঝে মাঝে ভালোলাগার মতো কোনো তথ্য পেলে, সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে লেখার মাধ্যমে বলার চেষ্টা করি এই যা। এভাবেই আমার লেখনি ধীর-মন্থর গতিতে চলতে চলতে প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার একটা নাড়ীর যোগ আছে। আমার পূর্বপুরুষদের আদিনিবাস ছিলো পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর ঢাকার নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের চাপাতলী গ্রামে। আমার বাবার জন্মও সেখানেই। তবে ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ঠাকুরদাকে বাধ্য হয়ে সপরিবারে ভিটেমাটি ত্যাগ করে ভারতের আসামে চলে আসতে হয় উদাস্তু হয়ে। তারপর থেকে আমার পরিবার এখানেই স্থিত। তবে পূর্ব বাঙলার সেই ভূখণ্ডের সঙ্গে এখনো আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.