সনাতন গ্রন্থের দুই সমকামী দেবতা!

সুমন দাস

সনাতন-হিন্দুদের  প্রথম ধর্মীয় (শাস্ত্রীয়) গ্রন্থ হলো বেদ। চার বেদের মধ্য সর্বপ্রাচীন বেদটি হলো ‘ঋগ্বেদ’ । এটির রচনাকাল মোটামুটি ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ। এই ঋগ্বেদে সাধারণত দেবতাদের প্রতিপত্তি দেখা যায়। এখানে বিভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশ্য করে স্তুতি তথা গান (সাধারণ ভাষায় “মন্ত্র”) রচিত হয়েছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো যে, এই বেদে প্রধান দেবতা কিন্তু ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর নন ; বরঞ্চ এখানে আমরা প্রধান দেবতারূপে দেখতে পাই – ইন্দ্রকে, অতঃপর অগ্নি-বরুণ-সূর্য আদিকে। 

ঋগ্বেদের ২ মণ্ডলের ২৭ সূক্তে ছয় জন আদিত্যের (দেবতা) নাম পাওয়া যায় – মিত্র, বরুণ, অর্যমা, ভগ, দক্ষ এবং অংশ। ঋষি কশ্যপের ঔরসে অদিতির গর্ভে এদের জন্ম। এদের মধ্যে প্রথম দুজন দেবতা অর্থাৎ মিত্র ও বরুণ দেব হচ্ছেন আমাদের এই প্রবন্ধের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ঋগ্বেদে মিত্রকে বলা হয়েছে “দিনের প্রহরী ও সূর্যের সহযোগী দেবতা” । অন্যদিকে বরুণকে বলা হয়েছে “রাতের প্রহরী ও জল তথা সাগরের দেবতা ” । দ্যূতিমান সূর্য হলো মিত্র ও বরুণ দেবের চক্ষুস্বরূপ। 

দেবতা হিসেবে ঋগ্বেদে মিত্র দেবের উল্লেখ প্রায় ক্ষেত্রেই বরুণ দেবের সঙ্গে সংযুক্ত। এমনকি অনেক জায়গায় দুজনকে একত্রে ‘মিত্রবরুণ’ বলে স্তুতি করা হয়েছে। দুজনের একত্র স্তুতি যেমন আছে, আবার স্বতন্ত্র বরুণ দেবের স্তুতিও অনেক রয়েছে। কিন্তু ঋগ্বেদের মাত্র একটি সূক্তে ( ৩/৫৯ ) মিত্রদেবকে পৃথকভাবে স্তুতি করা হয়েছে। ‘মিত্র’ শব্দের অর্থ হচ্ছে বন্ধু।  কিন্তু ঋগ্বেদে স্পষ্টরূপেই মিত্রকে বরুণের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেই চিত্রিত করা হয়েছে। দুজনের মধ্যেই খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্তে। যা আমাদের আধুনিক পুরুষ-সমকামী ভাবনাকেই চিত্রিত করেছে অনেকাংশে। দুজনকে একে অন্যের সহযোগী রূপে ঘনিষ্ঠ-কার্য করতে দেখা যায়। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের দ্বিতীয় সূক্তে মিত্র-বরুণ যুগলের উল্লেখ পাওয়া যায় এভাবে –

       ঋতেন মিত্রাবরুণাবৃতাবৃধাবৃতস্পৃশা ক্রতুং

                            বৃহন্তমাশাথে।।

সায়নাচার্য্যের ভাষ্যমতে – 

মিত্রবরুণৌ যুবাং ক্রতুং 

প্রবর্তমানমিমং সোমযাগ”। অর্থাৎ মিত্র এবং বরুণ নামক দুইজন যুবক (দেবতা), যারা সোমযাগ প্রবর্তন করে বা অনুষ্ঠান করে থাকে। বিভিন্ন টীকাকারগণের নির্দেশমর্মে আমাদের দেহের নিঃশ্বাসে বরুণদেব এবং প্রশ্বাসে মিত্রদেব অবস্থান করেন। 

 এ প্রসঙ্গে আমরা সবচাইতে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন দেখতে পাই ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’। এখানে মিত্র ও বরুণ দেবের মধ্যে সরাসরি দুজন পুরুষ-সমকামীর সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। এই ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’র একটি সূক্তে বলা হয়েছে যে বরুণ ও মিত্র দেব হলেন পরস্পর অর্ধচন্দ্র স্বরূপ। পূর্ণিমার রাতে এরা পরস্পর মিলিত হন এবং এক পূর্ণিমার রাতে বরুণ দেবের বীর্য মিত্র দেব ধারণ করেন ও দ্বিতীয় পূর্ণিমার রাতে মিত্র দেবের বীর্য বরুণ দেব ধারণ করেন ( ২.৪.৪.১৯ – ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ )। 

স্বর্গে দুজনের জন্য মিলনস্থানের ভবনটি সহস্র স্তম্ভের দ্বারা নির্মিত। 

অন্যদিকে ‘ভাগবত পুরাণে’ও বরুণ ও মিত্র দেবকে নিয়ে কিছুটা সমকামী সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। 

একবার বরুণ ও মিত্রদেবের রতিক্রিয়ার সময় তাদের বীর্য স্খলিত হয়ে সরোবরে পড়ে। সেই সরোবরে তখন স্বর্গের অপ্সরা উর্বশী জলক্রীড়া করছিলেন। অতঃপর বরুণ ও মিত্র দেবের স্খলিত বীর্য উর্বশী গ্রহণ করলে তা থেকে ঋষি অগ্যস্ত ও ঋষি বশিষ্ঠের জন্ম হয় ( ভাগবত পুরাণ – ৬.১৮.৩)। আবার এ কাহিনীর কিছু অন্যরূপও দেখতে পাওয়া যায় –

           অগ্যস্তশ্চ বশিষ্ঠশ্চ মিত্রাবরুণয়োর্ঋষী। 

      রেতঃ সিষিচতুঃ কুম্ভে ঊর্ব্বশ্যাঃ সন্নিধৌ দ্রুতম্।।

-( ৬.১৮.৫ – ‘শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ’ )

শ্রীধরস্বামী কৃত ভাগবত ভাষ্য মোটামুটি সর্বজনমান্য। তিনি এই শ্লোকের ভাষ্য বলেছেন – “অগ্যস্তশ্চ বলিষ্ঠশ্চ ঋষি মিত্রাবরুণয়োরভবতাম্। উভাবপি কুম্ভে রেতঃ সিষিচতুঃ।।” অর্থাৎ ঋষি অগ্যস্ত ও বশিষ্ঠ হলেন মিত্র ও বরুণের সন্তান, উভয়ে মিলিতভাবে কুম্ভে বীর্যস্খলন করেছেন।অর্থাৎ বরুণ ও মিত্র দেব অযোনি-রতিক্রিয়ার ( Non-vaginal Sex )দ্বারা দুই পুত্র লাভ করতে সক্ষম হন।  যা আধুনিক কালের পুরুষ-সমকামী দম্পতিদের সন্তান লাভের ক্ষেত্রে ‘Surrogate Mother’ এর প্রক্রিয়াকেই মনে করিয়ে দেয়।  

এর থেকে সহজেই বোঝা যেতে পারে যে ‘সমকামে’র ধারণা পাশ্চাত্য থেকে ভারতবর্ষে আসেনি।বরং ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ আগে থেকেই আমাদের ঋষি-মুনি তথা বেদকারদের ও পুরাণকারের মধ্যে ‘সমকামে’র ধারণা যথেষ্টরূপেই ছিলো। যা খুব ভালো করেই তাদের সনাতন-সাহিত্যের মধ্যে ফুটে উঠেছে। আর তার চেয়েও বড়ো কথা এই ‘সমকাম’ (ভক্তির মোড়কে) তখন সমাজেও স্বীকৃত ছিলো (অন্তত  হীন মনোভাব তো ছিলই না ),তা না হলে বেদকার ও পুরাণকারেরা তাদের আরাধ্য দেবতাদের মধ্যে এমন সম্পর্ক দেখাতে সাহস করতেন না কখনোই।

তথ্যসূত্রঃ

১.ঋগ্বেদ- আনুমানিক রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১২০০ অব্দ

২.শতপথ ব্রাহ্মণ- রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে

৩.ভাগবত পুরাণ /শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ-  এই পুরাণ প্রথমে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। এর বর্তমান রূপটি খ্রিস্টীয় ৪র্থ থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে লিপিবদ্ধ হয়

আমি সুমন ; ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর শহরের বাসিন্দা। পেশায় একজন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার অনেকগুলো শখের মধ্যে আন্যতম একটি বিশেষ শখ হলো লেখালেখি। যদিও এখনো পুরোদস্তুর লেখক হয়ে উঠতে পারি নি, চেষ্টা চলছে মাত্র। একে তো আমি প্রচণ্ড অলস, তার উপর আবার মোবাইলপোকা; কাজেই বুঝতেই পারছেন লেখার ক্ষেত্রে উন্নতির আশা খুব একটা আমার নেই। তবে  মাঝে মাঝে ভালোলাগার মতো কোনো তথ্য পেলে, সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে লেখার মাধ্যমে বলার চেষ্টা করি এই যা। এভাবেই আমার লেখনি ধীর-মন্থর গতিতে চলতে চলতে প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার একটা নাড়ীর যোগ আছে। আমার পূর্বপুরুষদের আদিনিবাস ছিলো পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর ঢাকার নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের চাপাতলী গ্রামে। আমার বাবার জন্মও সেখানেই। তবে ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ঠাকুরদাকে বাধ্য হয়ে সপরিবারে ভিটেমাটি ত্যাগ করে ভারতের আসামে চলে আসতে হয় উদাস্তু হয়ে। তারপর থেকে আমার পরিবার এখানেই স্থিত। তবে পূর্ব বাঙলার সেই ভূখণ্ডের সঙ্গে এখনো আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.