
সুমন দাস
(এই প্রবন্ধের প্রথমেই একটা কথা বলে রাখা ভালো, পৌরাণিক বলতেই ঐতিহাসিক বোঝায় না। কিন্তু পুরাণ যে একেবারেই ইতিহাস শূণ্য তাও বলা যায় না। তাই পৌরাণিক কাহিনী পুরোটাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য, সে কথা যেমন জোর দিয়ে বলা যায় না।ঠিক তেমনি পৌরাণিক কাহিনীতে কিছুমাত্র ইতিহাস নেই সে কথাও বলা চলে না। সবশেষে এই কথা বলতেই হয় যে, পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম বা শাস্ত্রগ্রন্থ নেই, যার মধ্যে অলৌকিকতা বা অতিপ্রাকৃতিক কোনো বিষয়ের বর্ণনা নেই। সুতরাং ‘হিন্দু পুরাণ’ গ্রন্থগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই যারা পৌরাণিক কাহিনীর প্রতি অনৈতিহাসিকতার দরুণ অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেন, তারা না হয় এই কাহিনী কেবলমাত্র ‘গল্প’ হিসেবেই পড়লেন। )
বাংলায় ‘মান্ধাতার আমল’ বলে একটা প্রবাদ আছে। যা দিয়ে ‘পুরনো কাল’ বা ‘অনেক প্রাচীনকাল’কে বোঝানো হয়ে থাকে। তবে এই ‘মান্ধাতা’ কেবলমাত্র একটি শব্দবিশেষ নয় ; এই ‘মান্ধাতা’ হলো পৌরাণিক যুগের ভারতবর্ষের একজন বিশিষ্ট রাজা। এই ‘মান্ধাতা’র উপাখ্যান বিভিন্ন পুরাণগ্রন্থে তথা মহাভারত, রামায়ণ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থেও বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। যদিও এক একটি গ্রন্থে এই ‘মান্ধাতা’র উপাখ্যানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে, তবে মূল কাহিনীটি প্রায় সব গ্রন্থে একই।
এই ‘মান্ধাতা’ ছিলেন ভারতবর্ষের একজন সূর্যবংশীয় বিখ্যাত রাজা, যার রাজধানী ছিলো অযোধ্যায়। পরবর্তীকালে ভগবান রামচন্দ্র এনার বংশধর রূপে দশরথের গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এনারা সকলেই ছিলেন সূর্যবংশীয়। সূর্যের পুত্র মনু, মনুর পুত্র সুষেণ, সুষেণের পুত্র প্রসন্ন, প্রসন্নের পুত্র যুবনাশ্ব ; আর এই যুবনাশ্বেরই পুত্র ছিলেন ‘মান্ধাতা’। এইভাবেই সূর্যবংশের বিস্তারলাভ ঘটতে থাকে রামচন্দ্রের পরবর্তী সময়কালেও।
সূর্যবংশীয় রাজা যুবনাশ্বের বিয়ে হয়েছিলো কন্দকরাজার কন্যা কালনেমির সঙ্গে। কিন্তু রাজা যুবনাশ্ব বিয়ে করলেও, পত্নীর সঙ্গে রতিক্রিয়া করতেন না। কারণ রাজা যুবনাশ্বের কামক্রিয়ার প্রতি ছিলো প্রবল অনীহা।
” বিবাহ করিল মাত্র সম্ভায় না করে।
লজ্জা ঘুচাইয়া কন্যা বলিল পিতারে।।
( – কৃত্তিবাসী রামায়ণ)
তখন কন্দকরাজ রুষ্ট হয়ে জামাতাকে এই বলে অভিশাপ দিলেন যে – আমার কন্যার সঙ্গে রতিক্রিয়ায় তোমার যখন এতই অনীহা, তখন নিজের সন্তান যেন তুমি নিজেই প্রসব করো। ফলে রাজা যুবনাশ্বের কোনো সন্তান হলো না। মনঃদুঃখে রাজা তখন বনে গিয়ে মুনিদের আশ্রমে কঠোর তপস্যায় মগ্ন হলেন। রাজা যুবনাশ্বের তপস্যায় মুনিগণ সন্তুষ্ট হলেন। তখন রাজা যুবনাশ্বকে তাঁরা ‘পুত্রেষ্টি যজ্ঞ’ করার পরামর্শ দিলেন। মহাধুমধামে রাজা যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞ-প্রসাদ স্বরূপ ‘এক কলস মন্ত্রপূত জল’ উত্থিত হলো, যজ্ঞ শেষ হতে মধ্যরাত হয়ে গেলো। তখন মুনিগণ রাজাকে বললেন এই মন্ত্রপূত জল আজ রাতে ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে দিতে,কাল সকালে রানিকে এই জল পান করালে অবশ্যই তিনি সন্তানসম্ভবা হবেন।
অতঃপর মুনিগণের আদেশ মতো রাজা যুবনাশ্ব সেই মন্ত্রপূত জলের কলস নিজ শয়ন কক্ষে নিয়ে গিয়ে, শয্যার পাশে রেখে সেই রাতে শয়ন করলেন। সারাদিন পরিশ্রমে ও ক্লান্তির ফলে রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে রাজা যুবনাশ্বের খুব জল তেষ্টা পেল। জলের জন্য দাসদাসীদের ডেকেও কোনো সাড়া না পেয়ে, নিরূপায় হয়ে তখন তিনি সেই মন্ত্রপূত জলের কলস থেকে কিছু জল পান করলেন।
” তৃষ্ণায় পীড়িত রাজা আকুল হইলো।
পুংসবন -জল ছিলো মুখেতে ঢালিলো।। “
( – কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
এরপর প্রাতঃকালে মুনিগণ এসে কলসীতে জলের পরিমাণ কম দেখে রাজাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে, রাজা পূর্বরাতের ঘটনা আনুপূর্বিক বলে গেলেন। এসব শুনে মুণিগণ জানান যে, যেহেতু সেই জল মন্ত্রপূত ছিলো তাই এখন রাজা নিজেই গর্ভবতী হবেন। আর হলোও তাই, রাজা যুবনাশ্ব পুরুষ হয়েও মন্ত্রপূত জল পান করার ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। এরপর যথা সময়ে রাজা যুবনাশ্বের প্রসব বেদনা শুরু হলে, রাজার পেটের বাম অংশ ( কোনো কোনো গ্রন্থে বাম জঙ্ঘা বলা হয়েছে) চিরে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হলো এবং প্রসববেদনা সহ্য করতে না পেরে রাজা যুবনাশ্ব প্রাণত্যাগ করলেন।
” দশ মাস গর্ভ পূর্ণ হইলো রাজার।
বাহির হইলো পেট চিরিয়া কুমার।। “
( – কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
এইভাবে সূর্যবংশ রক্ষা হলো।
সে যাই হোক এবার সন্তানের জন্ম হয়ে বংশ তো রক্ষা হলো, কিন্তু দেখা দিলো আর এক বৃহৎ সমস্যা। যেহেতু এই সন্তান পিতার গর্ভজাত, অর্থাৎ যেহেতু কোনো নারী এই শিশুটিকে গর্ভে ধারণ করেনি, তাই এই সদ্যজাত সন্তান মায়ের বুকের দুধ কোথায় পাবে ? আর মায়ের বুকের দুধ ছাড়া এই সন্তান বাঁচবেই বা কী করে? তখন এর সমাধান কল্পে স্বয়ং ইন্দ্রদেব এলেন। ইন্দ্রদেবের হাতের তর্জনী দিয়ে অমৃত ঝরতো। তিনি সেই আঙুল সদ্যজাত শিশুর মুখে পুরে দিয়ে বললেন – “মাম্ ধাস্যতি! ” অর্থাৎ আমাকে পান করো। এইভাবে শিশুর প্রাণরক্ষা হলো। নির্দিষ্ট দিনে স্বয়ং ব্রহ্মা এসে সেই ‘মাম্ ধাস্যতি!’ শব্দটিকে মনে রেখে, শিশুর নামকরণ করলেন “মান্ধাতা”। পরবর্তীকালে এই মান্ধাতা রাজা হয়ে অযোধ্যার সিংহাসনে বসেছিলেন এবং সপ্তদ্বীপ-অধিপতি ধার্মিক পুণ্যশীল দাতা হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
এইভাবে সূর্যবংশের এই বিখ্যাত সন্তান মায়ের নয়, বরং পিতার গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। যা ছিলো একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। যাই হোক এই ঘটনাতে এখনকার সময়ের ‘Single Father’এর ধারণা যে কিছুটা হলেও স্পষ্টরূপে বিদ্যমান তা মানতেই হয়। আর এখানেই পুরাণ কাহিনীর অন্তর্নিহীত গুরুত্ব ও তাৎপর্য লুকায়িত।
তথ্যসূত্রঃ
১.কৃত্তিবাসী রামায়ণ- আনুমানিক রচনাকাল খ্রিস্টীয় ১৪শ-১৫শ শতাব্দী
২. মহাভারত- আনুমানিক রচনাকাল ৩১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
আমি সুমন ; ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর শহরের বাসিন্দা। পেশায় একজন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার অনেকগুলো শখের মধ্যে আন্যতম একটি বিশেষ শখ হলো লেখালেখি। যদিও এখনো পুরোদস্তুর লেখক হয়ে উঠতে পারি নি, চেষ্টা চলছে মাত্র। একে তো আমি প্রচণ্ড অলস, তার উপর আবার মোবাইলপোকা; কাজেই বুঝতেই পারছেন লেখার ক্ষেত্রে উন্নতির আশা খুব একটা আমার নেই। তবে মাঝে মাঝে ভালোলাগার মতো কোনো তথ্য পেলে, সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে লেখার মাধ্যমে বলার চেষ্টা করি এই যা। এভাবেই আমার লেখনি ধীর-মন্থর গতিতে চলতে চলতে প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার একটা নাড়ীর যোগ আছে। আমার পূর্বপুরুষদের আদিনিবাস ছিলো পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর ঢাকার নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের চাপাতলী গ্রামে। আমার বাবার জন্মও সেখানেই। তবে ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ঠাকুরদাকে বাধ্য হয়ে সপরিবারে ভিটেমাটি ত্যাগ করে ভারতের আসামে চলে আসতে হয় উদাস্তু হয়ে। তারপর থেকে আমার পরিবার এখানেই স্থিত। তবে পূর্ব বাঙলার সেই ভূখণ্ডের সঙ্গে এখনো আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রয়েছে।