একজন জুবেরীর কথা

আরন্যক

সেদিনের  কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, ২০০৯ সালের কথা। ফেইসবুকে আমার ফেইক একাউন্ট দিয়ে কোন একজনের সাথে কথা চলছিলো বেশ কয়েকদিন ধরে। লোকটার বয়স তখন ৩৮ কি ৩৯ হবে। একদিন সে আমাকে দেখা করার কথা বললো আইডিবি তে।সেদিন আমিও ফ্রি ছিলাম। হুট করেই চলে গেলাম। পরে দেখলাম ল্যাপটপ সার্ভিসিং করাতে এসেছেন সাথে বোনাস হিসেবে আমার সাথে দেখা। কাজ শেষ হতে না হতেই ঝুম বৃষ্টি, উপায় না পেয়ে এক রিক্সা নিয়ে সোজা ওর বাসা অব্দি। শুরুতে সবকিছু ঘোলাটে লাগলেও পুরোটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। দুই হাতে গরম চা নিয়ে বললো চলো ছাদে বসে গল্প করি। আজ তোমাকে আমার না বলা কিছু গল্প শোনাবো। আমি চুপচাপ ওকে অনুসরন করে ছাদে চলে গেলাম। কথা শুরু হল – 

ও বলছিলো সালটা তখন ২০০০ তখন সবেমাত্র সে লন্ডনে পোষ্ট -গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। তখন লন্ডনে পার্ট টাইম চাকুরী পাওয়াটা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিলো ছাত্রদের জন্য। দেখা যেত ও সোসাইটির বেশ পরিচিত মুখ হওয়াতে জবের ব্যাপারে অনেকেই ওর সহয়োগিতা চাইতো। সবকিছু ভালোই যাচ্ছিলো। ওর পাশের ভবনে কিছু নতুন মেয়ে পড়াশোনার জন্য আসলো। সবাই চাকুরীর জন্য হেল্প চাইলেও একটা মেয়ে কখনোই আসে নি। শুধু সকালে আর সন্ধ্যায় সেই মেয়েটি নুপুর পায়ে শব্দ করে ওর রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতো। শুরুতে ব্যাপারটা কারো চোখে না লাগলেও দিন দিন সবার চোখে পড়তে লাগলো। মেয়েটি ঠিক প্রতিদিন একই সময়ে নূপুর পরে শব্দ করে হেঁটে চলে যাবে।  প্রায় দেড় বছর পর , একদিন জুবেরী বললো সে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে আসলে ব্যাপারটা কি?

সেদিন সন্ধায় জুবেরী রুমের বাইরে ছিলো মেয়েটি বরাবরের মত করেই শব্দ করে যাচ্ছিলো। জুবেরী হাতে-নাতে ধরে ফেললো, ব্যাপার টা জানার চেষ্টা করলো। কিন্তু মেয়েটি কিছু না বলে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো। 

সালটা ছিলো  ২০০৩, সবে মাত্র শুরু হয়েছে। জুবেরীর বাসা থেকে ফোন ; জুবেরীর বাবা খুব অসুস্থ দ্রুত দেশে ফেরা জরুরী। উপায় না পেয়ে সে দেশে ফিরলো। ফিরে সে হতবাক!  দেখে তার পরিবার মিথ্যে অযুহাত দিয়ে বিয়ে করানোর জন্য দেশে নিয়ে এসেছে। সে জেনে আরও অবাক যে সেই নূপুর পরা মেয়ের সাথেই তার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। অনেকটা পারিবারিক চাপে পড়েই তাকে বিয়ে করতে হলো। 

বিয়ের ১৫ দিনের মধ্যে তাদের আবার লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হলো। লন্ডনে গিয়ে শুরু হলো অশান্তি। জুবেরী নিজে একজন পুরুষ হলেও নিজেকে মেয়ে ভাবতে পছন্দ করে। মেয়েদের মত বেশভূষা, অঙ্গভঙ্গি এগুলো তার নিজের মধ্যে ভাবতে পছন্দ করে। সেখানে একজন মেয়ের সাথে এক বিছানায় ঘুমানো, সংসার করা এসব ভেবে সে দিশাহীন হয়ে যায়। শুরু হলো ঝগড়া ; স্ত্রীর হাতে নিগৃহীত হতে হত প্রতিদিনই। শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের স্বীকার হতে হতে একদিন তার নিজ সত্তার কথাটা প্রকাশ করে দেয় তার স্ত্রীর কাছে। 

এটা শুনে অত্যাচারের পরিমাণ আরো বেড়ে গেলো। দিনের পর দিন জুবেরীর হাত পা বেঁধে পাশবিক নির্যাতন করে ভোগবাসনা মিটিয়েছে ওর স্ত্রী। একপর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে জুবেরীর স্ত্রী।

সাল ২০০৪ এর মার্চ ১০ জুবেরীর যমজ শিশু হলো। ঝগড়া বিবাদ তখন ও চলছে। জুবেরীর স্ত্রী আলাদা ভাবে সন্তান লালন করতে লাগলো। তার ধারনা জুবেরীর ছোঁয়া পেলে তারাও তার মত হয়ে যাবে। তাঁরা একই বাড়িতে থাকে কিন্তু জুবেরীরে এক কোণে কোণঠাসা করে রেখেছে।

২০০৮ এর ডিসেম্বর জুবেরীর সন্তানেরা পোক্তভাবেই হাঁটে এখন, আর মুখেও বুলি ফুটেছে বেশ। হটাৎ একদিন বাগানে জুবেরী হাঁটছিলো তার ছোট ছেলে দৌঁড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো, সে দৌড়ে গিয়ে তুলতে গেলে দূর থেকে তার স্ত্রী এসে বলল থামো এবং সাথে সাথেই ছেলের হাত ধরে টান দিলো। 

ছেলে বললো,

Mom Who’s He? My Dad?  He seems very gentlemen.

উত্তরে জুবেরীর স্ত্রী বললো,

My Dear Son He is a Gay, a Gay Couldn’t be someone’s Dad.

Leave Him, I will bring you a Better one.

উত্তরটা জুবেরী স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি। তাই কাউকে কিছু না বলে সেদিনের রাতের ফ্লাইটেই দেশে চলে আসে। 

কথাগুলো শেষ করার পর জুবেরী চোখ মুছছিলো। তার চশমা ঘোলা হয়ে আসছিলো বার বার। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আমি জানিনা জুবেরী এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, বেঁচে আছে কি না? ওর নাম্বার টা ও বন্ধ পাই……এভাবে অনেক কথাই চাপা থেকে যায় স্মৃতির অতল গহ্বরে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.