একটু আলাদা

আজিজুল হক

নাজিম বিকেলে হাঁটতে বের হল। হাঁটতে বের হলেই সে দেখতে পায় অনেক রকমের দৃশ্য; দেখতে পায় তার বয়সী কয়েকজন দাপিয়ে ফুটবল খেলছে তার বাড়ির পাশের মাঠে; আবার মাঠের আরেক পাশে খেলা হচ্ছে ক্রিকেট। ওদিকে দেখতে পায় মেয়েরা মাঠের কোণের দোলনার দিকে দাঁড়িয়ে গল্প আর খুনসুটি করছে। এসব দেখে নাজিমের মনে হয় ওরা সবাই কত মজা করছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি নাজিমের বিকাল বেলা বের হতে একটুও ভালো লাগে না। সে মানুষজনের সামনে কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করে। সে সবসময় একটা ভয়ে থাকে; কখন যেন কেউ একজন তার হাঁটাচলা অথবা ভাবভঙ্গির দিকে আঙ্গুল তুলে। নাজিম তাই খুব সাবধানে হাঁটে; একটুও যেন তার কোমরে বাঁক না দেখা যায় কিংবা পায়ের চলাটা যেন একটুও ব্যাঁকা না হয়। 

নাজিম যখন ক্লাস থ্রি-ফোর এ পড়তো, তখন থেকেই সে তার সহপাঠীদের কাছ থেকে শুনে আসছে ‘হাফলেডিস’ সম্মোধনটি। তাছাড়াও তাকে শুনতে  হয়েছে  নানান ধরনের খোঁটা  আর অপমান শুধুমাত্র তার এই হাঁটা চলা এবং ভাবভঙ্গীর জন্য। নাজিম কিছুতেই বুঝতে পারল না যে, তার দোষটা কোথায়। যার জন্য তাকে এত অপমান এবং খোঁটা শুনতে হচ্ছে। একবার ক্লাস নাইনে যখন সে একটা স্কুলে নতুন ভর্তি হলো ঠিক তার কয়েকদিন পরেই একটা বখাটে ছেলে তার খাতার উপরে ‘Shemale’ লিখে দিয়েছিল। সেই ঘটনায় নাজিম ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল।

নাজিম হাঁটতে হাঁটতে আরও ভাবে সে তার আশেপাশে যত মানুষজনকে দেখছে তার থেকে কি সে অনেকটা আলাদা? তবে অনেকটা আলাদা না হলেও নাজিম একটু হলেও সবার থেকে আলাদা। আর এটা সে খুব ছোট বয়স থেকেই বুঝতে পেরেছে কারণ তার আশেপাশের মানুষজন এবং পার্শ্ববর্তী পরিমণ্ডল  তাকে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে খুব ভালোভাবেই। নাজিম ভাবে সে কেন এরকম হল; সে কেন একটু আলাদা সবার থেকে। সে কি সবার মত হতে পারত না? তাহলে হয়তো বিকেলবেলা হাঁটতে বের হলে তার এই অস্বস্তিতে থাকতে হতো  না; বিকালবেলা হাঁটতে বের হলে হয়তো বারবার তার কোমর আর পায়ের দিকে নজর রাখতে হতো না। তার এই আলাদা হওয়াটা তো কোন দোষের না। আর যদি এরকম আলাদা হওয়া টা দোষের নাই হয়, তাহলে কেন সবসময় নাজিমকে হেয় করা হয়? আর এত অপমান সহ্য করতে হয়? এসব কিছুর জন্য নাজিম শুধুমাত্র ধর্মকে দোষারোপ করে না। এর জন্য দায়ী তো এই সমাজ এবং সমাজের মানুষের মন-মানসিকতা। কারণ সমাজে প্রতিনিয়তই এমন অনেক কাজ হচ্ছে, যা স্ব-ধর্ম বিরোধী কিন্তু সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। 

নাজিমের মাথায় প্রায়ই ঘোরে তার মত যারা একটু আলাদা তাদের কি কি সমস্যা আর অসুবিধা পোহাতে হয় । কারন সে নিজে যে একটু আলাদা তার চারপাশের মানুষের থেকে, তার জন্য যে কেবল  তাকে অনেক রকমের সমস্যা আর অসুবিধাই পোহাতে হয়েছে এমনটি নয়! কত অপমান আর লাঞ্ছনা সহ্য করেছে নাজিম। নাজিমের জীবনের সকল ঘৃণা অপমান তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য তাকে সে ইতিবাচক শক্তি এবং আভাতে পরিণত করেছে। আর এই শক্তিটাই নাজিমকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার এই শক্তির মাধ্যমে সে এখন প্রাণ খুলে ছবি আঁকে, প্রাণ খুলে গান গায় আর প্রাণখুলে কবিতা লেখে। তার এই ছবি আঁকা, গান গাওয়া আর কবিতা লেখা কে সে অনুভব করে, উপভোগ করে। আর তার মাথার মধ্যেও কল্পনা, ভাবনা আর সম্ভাবনার একটি জগত সে নিজেই তৈরি করে নিয়েছে যেখানে সে আছে রাজোচিত রূপে। তাই এখন সে আর হাঁটার সময় তার কোমর আর পায়ের দিকে নজর দেয় না; গটগট করে হেঁটে চলে।

আমার ছদ্ম নাম আজিজুল হক। লেখালেখি পছন্দ করি। আমার কল্পনার রাজ্য থেকে টুকরো টুকরো ছবি নিয়ে, আমার লেখার মধ্যে জুড়ে দিতে ভালোবাসি। আশা করি একদিন আমার এই লেখা লেখিই আমাকে পৌছে নিয়ে যাবে আমার স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে। 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.