সীমাবদ্ধতা

অরণ্যরাত্রি

সুমির কথা,

আমাদের বাসায় একটি মাত্র আয়না রয়েছে। সেটা হল মায়ের ড্রেসিং টেবিলের আয়না। আমি যখন ছোট ছিলাম, তিন কি চার বছর বয়স, তখন এই আয়নাটা আমার একটা খেলনার মত ছিল। কিছুক্ষণ পর পর আয়নায় নিজেকে দেখতাম।ছোট বেলায় আমি মনে হয় খুব নারসিসিস্ট ছিলাম। কিন্তু যখন স্কুলে ভর্তি হলাম তখন প্রথম শোনা শুরু করলাম 

  • তুমি তো কালো। 

স্কুলে বুলিং এর শিকার হতে শুরু করলাম। আমার গায়ের রঙ কালো দেখে অনেক মেয়ে আমার সাথে মিশতো না। সরাসরি বলতো, 

  • তোর সাথে মিশলে আমরাও কালো হয়ে যাবো!

তখন প্রথম জানতে পারলাম গায়ের রঙ কালো হওয়াটা খুব বড় একটা অপরাধ। বাসায় যেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে কাঁদতাম। তখন মা বলতো 

  • তুই তো কৃষ্ণকলি। আয়না দেখ তোর চোখ গুলো । কী অপূর্ব মায়া সে দু’চোখে জুড়ে ! তাকা তোর  চুলের দিকে। কি সুন্দর  কালো চুল কিছুদিন পর কোমর ছুঁয়ে দিবে। 
  • কিন্তু সবাই যে বলে আমি কুৎসিত। 
  • সবাই তোকে হিংসে করে, তাই এমন বলে। 

মায়ের কথায় তখন সহজেই আশ্বস্ত হতাম। সাজগোঁজ আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি বাসাতেও সেজে গুজে থাকতাম। হাতে রেশমি চুড়ি। কপালে টিপ আর চোখ ভর্তি কাজল। চুল গুলো খোলা রাখতাম।কিন্তু এক সময় বুঝলাম সাজ আমার জন্য নয়। আমার বাবা কে আমি খুব কমই হাসতে দেখেছি। বরং আমাকে দেখলেই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে যেত। একদিন শুনলাম বাবা, মা কে বলছে

  • তোমার মেয়ে কে যে এত সাজগোঁজ করাও, কী লাভ হচ্ছে তাতে । এই মেয়ের বিয়ে কিভাবে আমি দিবো ? মেয়ে মানুষের গায়ের রঙ এত  কালো হয়! 
  • নিজের মেয়ে সম্পর্কে এমন বল কেন। সে কি নিজে কালো হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা তাকে এভাবে তৈরি করেছেন।
  • সেতো বুঝলাম কিন্তু আমার তো আরও দুইটা মেয়ে আছে। বড় মেয়ের বিয়ে যে না হলে ছোট মেয়ে দুইটা কে তো বিয়ে দিতে পারবো না। আল্লাহ আমাকে এ কি পরীক্ষায় ফেললো!

সেদিন বুঝলাম আমি কৃষ্ণকলি না ছাই। আমি কালো । আমি কালো মেয়ে । আমি কুৎসিত। সাজগোঁজ বন্ধ করে দিলাম। আমার সৃষ্টিকর্তার উপর খুব অভিমান হল। কেন তিনি আমার বাকি দুই বোনের মত আমাকে সুন্দর করে পাঠালেন না। আমি পড়াশোনায় মন দিলাম। আমি  এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি পরীক্ষায় খুব ভাল ফলাফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। হঠাৎ জীবন বাঁক নিল অন্য দিকে। আমার বাবা তখন থেকেই শুরু করলেন আমার জন্য পাত্র দেখা। কতবার কতভাবে সেজে পাত্র পক্ষের সামনে বসেছি তা আর নাই বললাম। কিন্তু কেউ পছন্দ করে না। সে যে কি অপমানের। কেউ পছন্দ করলে চাইতো মোটা অঙ্কের যৌতুক। আমাদের মত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এত যৌতুক দেয়া সম্ভব হল না। আমার গ্রাজুয়েশন হল। মাস্টার্স হল । চাকুরী হল। কিন্তু তারপরও আমার বিয়ে হল না। আমার বাবা পাঁচ বছরে কম চেষ্টা করেন নি। সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা তৈরি হল, আমার বাকি দুই বোনের বিয়ের বয়সটা তততোদিনে তৈরি হয়ে গেছে। আমার জন্য তাদের প্রেমের বিয়ে আটকে আছে। বাবা একদিন বলল, 

  • তোর জন্য আমার বাকি দুই মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। তুই অপয়া!

কথা টা শুনে বুক টা কেঁপে উঠলো। নিজের বাবা এই কথা বলল ! কিন্তু কাঁদতে পারতাম না। কারণ এক মাত্র আমার কান্না আর দুঃখ আমার মা বুঝে। এমনিতে আমাকে নিয়ে তিনি খুব কষ্টে আছেন। আর আমি যদি কাঁদি , মন খারাপ করি, তাহলে আমার মায়ের কষ্ট বাড়বে । ধীরে ধীরে বাড়ি তে আমি কেমন যেন বিচ্ছিন্ন হতে থাকলাম। আমার বোনরা আমার সাথে কথা বলে না। আমার বাবা আমাকে দেখলে বিরক্তি তে কপাল কুঁচকে ফেলে। শুধু মাত্র যখন আমার বেতনের টাকা তার হাতে তুলে দেই তখন আমি তার মুখে এক চিলতে হাসি দেখি। বুঝেছি বাবারাও স্বার্থপর হয়! 

হঠাৎ একটা বিয়ের প্রস্তাব আসলো। ছেলে ভাল চাকুরী করে , হ্যান্ডসাম। ছেলেটি আমাকে পছন্দ করেছে। আমি খুব অবাক হলাম। কেন আমাকে পছন্দ করবে।যাই হোক এত কিছু চিন্তা করার মত অবস্থা নেই আমার। আমার বোন দের বিয়ে হবে, বাবার  দায় ঘুচবে। আবার সংসারে শান্তি ফিরে আসবে। না, বিয়ে টা হতেই হবে। যে কোন মূল্যে। আর সেই মূল্য আমি দিলাম। পাত্রপক্ষ চায় যে আমি চাকুরী করবো না। কারণ পাত্রর চাকুরীজীবী মেয়ে পছন্দ নয়। আমি চাকুরী ছেঁড়ে দিলাম। আমার বিয়ের বাদ্য বাজলো।

আজকালকার মেকাপের যুগে কালো মেয়ে কে ফর্সা করা কঠিন না। আমার বিয়ের দিন আমাকে ভারী মেকাপ দিয়ে সাজানো হল। আমি নিজেকে  নিজে চিনতে পারলাম না। তাতে এই একটা উপকার হল বিয়ের স্টেজে অন্তত মানুষের কাছে শুনতে হল না আমি কালো।কিন্তু এই কথা শুনলাম বাসর ঘরে।নিজের স্বামীর মুখে। সে বাসর ঘরে যখন কাপড় চোপড় পালটে আমার কাছে আসলো তখন শুনলাম সেই কথা টি। সে বলল,

  • তুমি তো কালো । তোমার বিয়ে হচ্ছিলো না। সবই আমি জানি। তাই বিয়েটা এক অর্থে আমি তোমাকে করুনা করে করেছি। যাই হোক তুমি তোমার মত থাকবে। বাসার ভিতরে যা খুশি কর। কিন্তু আমার কোন ব্যাপারে নাক গলাবে না। আর বাসায় আমার এক বন্ধু থাকে । খুব ভাল বন্ধু।এছাড়া কেউ না। তাই তুমি স্বাধীন ভাবে বাসায় থাকতে পারবে। কিন্তু বাসা থেকে আমার অনুমতি ছাড়া বের হবে না।

বাসর রাতে এমন কথা শুনতে হবে আমি ভাবি নাই। বাসর ঘরে মেয়েরা স্বামীর কাছে কত সুন্দর সুন্দর কথা শুনে। আর আমার কিনা শুনতে হল আমি কালো। আমাকে করুণা করা হয়েছে। কিন্তু আসলেই তো আমাকে করুণা করেছে বলেই তো আমার বিয়ে হল। আমার বাবা কন্যাদায় থেকে মুক্ত হলেন। আমার বোন গুলোর  খুব ভালভাবেই এখন বিয়ে হবে। আমাকে করুণা করেছে বলেই তো আমি নিজের পরিবার কে আজ থেকে  সুখী দেখতে পারবো ।এটাও তো একটা সুখ । এসব ভাবছিলাম। দেখলাম আমার পাশে আমার স্বামী সৌম্য নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। 

সৌম্যর কথা,

আমি সংসার করতে চাই কিন্তু বিয়ে করতে চাই না। খুব অদ্ভুত শুনাচ্ছে । তাই না? আসলে আমি একটা ছেলে হয়ে একটা ছেলের সাথে সংসার করছিলাম। নিজের মত থাকতাম আমরা। কিন্তু আমার বাসা থেকে বিয়ের চাপ আসতে থাকলো। আমরা একে অপরকে ভালবাসি। কিন্তু সমাজ , পরিবার কেউই আমাদের এই  ভালবাসা মেনে নিতে রাজি নয়।শুধু ছেলে- মেয়ে তে ভালবাসা হবে এ কেমন নীতি,বলো? এ কেমন নিয়ম? কেন বিয়ে করতে হবে? কেন তিনটা মানুষের জীবন নষ্ট হবে? 

আমি যখন কৈশোরে তখন আমি খুব ভাল ভাবে বুঝেছিলাম আমি সমকামী ( Homosexual )। স্কুলে একটা ছেলের সাথে প্রেমও হয়েছিল। কিন্তু এস.এস.সি এর পর আমি চলে আসলাম ঢাকায়। তারপর তার সাথে যোগাযোগ কমতে কমতে এক সময় প্রেমটাই শেষ হয়ে গেল।আসলে তখন ছোট ছিলাম তো ভালবাসা কাকে বলে তাই বুঝি নি। 

 তারপর  ইন্টারনেটের কল্যাণে বিভিন্ন সমকামী প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হলাম। পরিচয় হল সুমনের সাথে। অনেক ভাল লাগলো তাকে। কোন মেসে না থেকে দু’জন মিলে একটা ফ্ল্যাটে উঠলাম বন্ধু হিসেবে। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব এক সময় রূপ নিল ভালবাসায়। কখন যে সে আমার ফ্ল্যাটমেট থেকে সংসারের সঙ্গী হয়ে গেল নিজেই জানলাম না। আমাদের দু’জনের কাছেই জীবনের এই সময়টুকু জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। কিন্তু বারংবার বিয়ের চাপ আসার পর আমার পক্ষে সম্ভব হল না, বিয়ে না করে থাকতে পারা। কারণ আমি আমার বংশের এক মাত্র ছেলে সন্তান। আর আমি পুরোপুরি স্বাবলম্বী নই। আমার কাজ হল ঢাকায় বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করা। এজন্য আমার বাবা আমাকে মোটা অংকের টাকা হাত খরচ দেন। 

তখুনি আমার মাথায় একটা চিন্তা ঘুরছিল। জানি চিন্তাটা বিবেক বর্জিত ।কিন্তু আমাদের ভালবাসা টিকিয়ে রাখতে হলে আমাকে এই কাজ করতেই হবে। বিবেকের সকল তাড়না কে ছুঁড়ে ফেলে সিদ্ধান্ত নিলাম এমন কাউকে বিয়ে করতে হবে যে  আমাকে বিয়ে করেই ধন্য হয়ে যাবে এবং আমার উপর  সম্পূর্ণ নির্ভর করবে। আমাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেও পারবে না। আবার আমাকে কোন কাজে বাধাও দিবে না।কিন্তু এত মন্দ মানুষ আমি কিভাবে হলাম! তবে এটুকু জানি, সবকিছুই করা যায় ভালবাসা টিকিয়ে রাখার জন্য কিংবা যুদ্ধে জয়ের জন্য । ( “Everything is fair in love and war” – John Lyly)

আমি কম্যুনিটি তে জানালাম আমি বিয়ে করেছি। এটাও বললাম  আমার স্ত্রী আমার আর সুমনের সম্পর্ক জেনেই বিয়ে করেছে। ডাহা মিথ্যা কথা। কিন্তু এই কথাটুকু আমার কম্যুনিটিতে টিকে থাকার জন্য বলতেই হল। সবাই জানে আমি খুব আদর্শবাদী , এক্টিভিস্ট , নরম মনের ভাল মানুষ। এখন যদি সবাই জানতে পারে যে আমি আমার সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনের কথা না জানিয়ে বিয়ে করেছি তখন আমার ইমেজ টা কই যাবে??

কিন্তু এইবার পড়লাম মহা বিপদে ।কম্যুনিটির বন্ধুবান্ধবরা আমার স্ত্রী কে দেখবে। তারা আমার কোন অজুহাতই শুনলো না। লরা বিশেষ ভাবে আগ্রহী আমার স্ত্রী কে দেখার জন্য। কে সেই মহীয়সী নারী যে কিনা আমার জন্য এত স্যাক্রিফাইস করেছে। লরা লেসবিয়ান । আমার কম্যুনিটির খুব ভাল একজন বন্ধু। সে এক্টিভিস্ট। চাকুরী করে একটা এন.জি.ও তে, যারা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করে। তার মত এত শক্ত মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। সে বাসায় কামিং আউট করার পর বাসা থেকে চলে এসেছে। এখন সে তার ভালবাসার মানুষের সাথে একই ফ্ল্যাটে থাকে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমারও লরার মত কামিং আউট করা উচিৎ ছিল। তা না করে কাপুরুষের মত বিয়ে করলাম। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করলাম।

আমি মন্দ মানুষ কিন্তু তারপরও  আমার বিবেকে একটা চিন্তা বার বার হানা দেয়। আমি সুমির জীবন নষ্ট করেছি। আমার মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু মেয়েটা খালি অধিকার খাঁটাতে চায়। জানতে চায়, “কই গিয়েছি? এত রাত পর্যন্ত কই থাকি? এত বাইরের খাবার কেন খাই ? ইত্যাদি ইত্যাদি”।এত কৈফিয়ত দিতে আমার ইচ্ছে করে না । তারপরও একই কথা বার বার জিজ্ঞেস করতেই থাকে। তখন মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ক্ষেপে গিয়ে এমন সব কথা বলি যা কোন মেয়ে কে বলা উচিৎ নয়। আর স্ত্রী কে তো আরও নয়। 

এখন আমার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে,আগামীকালের অনুষ্ঠানটা কিভাবে ম্যানেজ করা যায়। আমি সুমি কে বললাম,

  • সুমি শোন কাল কিছু বন্ধু-বান্ধব আসবে দাওয়াত খেতে। তুমি ভাল কাপড় পরে থেকো । ওরা হয়তো তোমার সাথে কথা বলতে চাইবে। তুমি বলবে যে, তোমার একটু বিশ্রাম নিতে হবে ;কারণ তুমি অসুস্থ। 

এই কথা শুনে সুমি কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল এক দৃষ্টিতে। তারপর মাথা ঝাঁকালো । তার মানে সে রাজি। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। 

সুমির কথা,

আজকে সৌম্যর বন্ধুরা আসবে। সৌম্য বলছিল বাইরে থেকে খাবার আনবে। কিন্তু আমি বললাম রান্না করে দিচ্ছি। আমার একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগছে। সৌম্য আমাকে মিথ্যা কথা বলতে বলেছে। আমি বুঝেছি। আমি কালো বলে সে হয়তো তার বন্ধু বান্ধবের সাথে বেশিক্ষণ থাকতে দিতে চায় না। আমিও ঠিক করেছি থাকবো না। সে তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করুক। 

আমি রান্না করলাম সারা দিন। তারপর  বহু দিন পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম। কি কালোই না আমি।কেউ কেন আমাকে পছন্দ করবে? তাও একটা জামদানি পরলাম জাম রঙের। চোখে কাজল দিলাম। চুলে খোঁপা করলাম। দিলাম বেলি ফুলের মালা। আবার আয়না তাকালাম। কী কুৎসিত লাগছে নিজেকে ! মনে হচ্ছে আসলে কাক হয়ে কি সেজে গুজে ময়ূর হওয়া যায়! 

ইতিমধ্য সৌম্যর বন্ধুরা চলে এসেছে। আমি গেলাম তাদের সাথে দেখা করতে। সবার সাথে পরিচিত হলাম। লরা নামের একটা মেয়ে এসেছে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল 

  • খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তোমাকে ।  তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। এখন থেকে তুমিও আমাদের কম্যুনিটির অংশ।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম 

  • কিসের কম্যুনিটি ?
  • কেন তুমি জানো  না? 
  • কি জানবো । 

কিন্তু লরা কিছুর বলার আগেই কিসের একটা ভাঙ্গার শব্দ পেলাম। কিছুই হয় নি সৌম্যর হাত থেকে গ্লাস পরে ভেঙ্গে গিয়েছে। আমি বললাম,

  • আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি

সৌম্য তখন তারাতাড়ি বলল,

  • না না, তুমি অসুস্থ। বিশ্রাম নাও। আমি পরিষ্কার করে নিচ্ছি।

বুঝলাম সৌম্য ইঙ্গিত দিচ্ছে এখান থেকে চলে যাবার। আমি চলে গেলাম বিদায় নিয়ে। লরার বাকি কথা টা শোনা হল না। 

আমি বিছানায় শুয়ে মোবাইলে গান শুনছি । হঠাৎ দেখি লরা আমার ঘরে ঢুকেছে। তোমার বিদায় নিতে আসলাম সুমি। আচ্ছা আমার একটা কার্ড দিচ্ছি,রাখতে পারো। এখানে আমার মোবাইল নম্বর আছে। দরকার লাগলে ফোন দিও। আমি কার্ড হাতে নিয়ে ভাবলাম, কি এমন দরকার লাগবে। তাও ভালবেসে দিয়েছে। ব্যাগে ভরে রাখলাম। 

সৌম্যর কথা,

সুমন আবার বাসায় ফিরেছে। এই ফ্ল্যাটে  দুটো বেডরুম। একটাতে সুমন থাকে। আরেকটায় আমি আর সুমি। অবশ্য আমি ঘুমানোর সময় শুধু এই ঘরে আসি। বাকি সময় টুকু অফিস আর অফিসের পরে সুমনের ঘরে। 

আগের মত সংসার করতে না পারলেও ভালবাসা পুরোদমে চলছে। আমি যখন সুমনের ঘরে থাকি তখন দরজা লক করে রাখি। যাতে সুমি নক না করে কখনো এই ঘরে ঢুকে আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক না দেখে ফেলে। কিন্তু মানুষ মাত্র ভুল হয়। সেদিন দরজা লক না করে সুমন কে কাছে টানলাম। আর মরার উপর খাঁড়ার ঘা,  সে দরজা লক না দেখে নক করার প্রয়োজনবোধ না করেই ঘরে ঢুকে গেল।

সেদিন আমি দেখছিলাম সুমির চোখ। এত রাগ , এত ক্ষোভ । পারলে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেয়। সুমি দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি কোন রকমে কাপড় পরে পিছন পিছন আসলাম।কিন্তু সুমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি খুব ভয় পাচ্ছি। যদি আত্মহত্যা করে , যদি পুলিশ কেস হয় , যদি সবাই কে বলে দেয়। কি হবে!আমি বার বার নক করছি দরজায় কিন্তু দরজা খুলছে না সুমি। প্রায় তিন ঘন্টা পর সুমি  দরজা খুলল, তার হাতে একটা সুটকেস। সে জ্বলন্ত চোখে আবার আমাকে দেখলো । তারপর বলল, 

  • এত দিন ভেবেছি আমি কালো। তাই  তুমি আমার সাথে এমন করেছো । আমার উপকার করার জন্য আমাকে বিয়ে করেছো । কিন্তু না। তুমি আমকে ঠকিয়েছ, আমার সাথে প্রতারণা করেছো ।আমাকে ব্যবহার করেছো নিজের সমকামী আইডেন্টিটি ঢাকতে। তোমাকে কোন দিন আমি ক্ষমা করবো না। এই বাড়িতে আমি আর আসবো না। তোমার কথা এখনই কাউকে বলছি না। এত টা নিষ্ঠুর আমি নই। কিন্তু তুমি যে কাজ করেছো তার জন্য তোমার এটাই উপযুক্ত শাস্তি ছিল। আমি বাড়িতে যাচ্ছি না। যাচ্ছি লরার বাসায়। সেখান থেকে ডিভোর্স লেটার পাঠাবো । তুমি সাইন করে দিবে।

সুমি এত গুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলল । তারপর মুহূর্তের মধ্য দরজা খুলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো । আমাকে আর একটা কথা বলারও সুযোগ দিল না। কিন্তু আমার ভয় একটু কমেছে। সুমি বলেছে সে আমার সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনের কথা বলবে না। কিন্তু নিজের বাপের বাসায় না যেয়ে লরার বাসায় কেন? কেন ? কেন?  

সুমির কথা,

আমি এখন লরার বাসায়। লরা সৌম্যর বন্ধু হলেও তাকে সাপোর্ট করে নি। বরং যেটা আদর্শ সেটাকেই সে বেছে নিয়েছে। লরা সেদিনই নাকি বুঝতে পেরেছিল সৌম্য মিথ্যা বলছে। তাই সে আমার হাতে তার কার্ডটি দিয়ে গিয়েছিল। 

কেন বাপের বাসায় না যেয়ে লরার বাসায় গেলাম? ফোন দিয়েছিলাম বাবা কে। সে স্পষ্ট বলে দিয়েছে

  • এই ব্যাপারটা এডজাস্ট কর। তুমি নিজে কি বিশ্বসুন্দরি?কালো  মেয়ে। তুমি সৌম্য কে ডিভোর্স দিলে আমি বসে বসে তোমাকে খাওয়া তে পারবো না। আরেকটা বিয়ে দেয়াও সম্ভব নয়। আজকে তোমার ছোট বোন কে পাত্রর বাড়ি থেকে পাত্রর মা , বাবা আসবে দেখতে। তুমি খবরদার বাসায় আসবা না। তুমি এইভাবে চলে আসলে তারা তোমার বোনের বিয়ে ভেঙ্গে দেবে।

আমি পুরো ভেঙ্গে পরলাম। আমার চাকুরী নেই। তেমন কোন বন্ধু নেই। আত্মীয় স্বজন জায়গা দিবে না। ইতিমধ্য মামাও না করে দিয়েছে আসতে। হঠাৎ আমার লরার কথা মনে পড়লো । সে বলেছিল দরকার হলে ফোন করতে। আমি ফোন দিলাম লরা কে । সে সরাসরি সুটকেস সহ  আমাকে তার বাসায় চলে আসতে বলল।  

লরা কে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলাম । আসলে কাঁদলে হাল্কা লাগে। কতদিন কেউ এইভাবে স্নেহ দিয়ে জড়িয়ে ধরে নি। লরা বলল  ,

  • বোকা মেয়ে। কাঁদছো কেন? তোমাকে শক্ত হতে হবে। নিজেকে  দাঁড়াতে হবে। সমাজে সম্মানের জায়গা তৈরি করতে হবে। আর কাল মানে সৌন্দর্য কম এটা একদম একটি ভুয়া কথা। তাহলে নাইজেরিয় সহ বিভিন্ন আফ্রিকান কান্ট্রি তে অনেকেই মিস ওয়ার্ল্ড এবং মিস ইউনিভার্স হয়েছে। কিভাবে?সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে তুমি কিভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করছো । তোমার পার্সোনালিটি , বুদ্ধিমত্তা, আর আত্মবিশ্বাস তোমার সৌন্দর্য কে বাড়িয়ে দিবে বহু গুন।আর একটি কথা মনে রেখো, বিয়ে মানুষের জীবনের এক মাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ নয়। 

তাই তো এখন আমার বোন দের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাবা মায়ের দায় শেষ। তারা নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কাঁটিয়ে দিতে পারবে। আমি কেন সৌম্যর স্ত্রী এর রোল সারা জীবন পালন করবো? আমি চাকুরী করে নিজের জীবন নিজেই চালাবো। লরা বলেছে সে আমাকে তার এনজিও তে চাকুরী যোগাড় করে দিবে। 

পাঁচ বছর পর…

আমি এখন কক্সবাজারে। এখানে হোটেল সায়মনের সি সাইড রুমে বসে আছি। আর ভাবছি।পাঁচ বছর আগে আমি কতটা অসহায় ছিলাম । আর এখন আমি একটা বড় এনজিও এর ডিরেক্টর। এজন্য আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। নিজের ভিতরের যে আত্মবিশ্বাস,একদম ছোট বেলায় ছিল তাকে জাগিয়ে তুলেছি। নিজের ব্যক্তিত্ব করেছি অনন্য। নিজের বুদ্ধিতে দিয়েছি শান। আমি যখন হাঁটি এখন আর কেউ বলবে না , “ এই দেখো কালি আসছে।“ এখন অনেকেই আমার মত হতে চায়। এখন অনেক ছেলে আমাকে প্রপোজ করে। কিন্তু আমার লক্ষ্য শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছে যাওয়া । এখন ফিরে তাকানোর সময় নেই। 

সৌম্যর কথা,

সেদিনের পর থেকে আমি আর আমার মুখ বন্ধু বান্ধব দের দেখাতে পারি নাই। আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভুলটা কে। অনেকবার আমি সুমির কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছি। কিন্তু সুযোগ পাই নি কথা বলার। সুমন আমার সাথে আছে। এখনো ছেড়ে যায় নি। আমি জানি আমাদের কম্যুনিটিতে অনেক মানুষ আছে যারা আমার মতই। আবার লরার মত মেয়েরাও রয়েছে। আমার মত কীটপতঙ্গ  হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে লরার মত মানুষ হয়ে বাঁচা উচিৎ। আমি নিজেকে শুদ্ধ করেছি এই পাঁচ বছরে। কিন্তু দেশের কম্যুনিটিতে আবার ঢুকার মুখ আমার নেই। তাই চলে যাচ্ছি বিদেশ বিভূয়ে! সাথে যাচ্ছে সুমন। আর ফিরবো না  দেশে। 

লরার ডাইরির পাতা থেকে,

২০/৪/২০২৬ 

আসলে আমরা মানুষরা নিজেরাই নিজেদের সীমাবদ্ধতা ঠিক করে নেই। অথচ এই সীমাবদ্ধতা গুলো আমাদের নিজেদের কে  পুরোপুরি প্রকাশ করতে দেয় না। একটা ,মানুষের অনেক কিছু করার ক্ষমতা থাকে। এই সীমাবদ্ধতা কে অতিক্রম করতে পারলে আমরা হয়তো আরও বেশি আমাদের ক্ষমতা কে কাজে লাগাতে পারবো। যেমন, 

  • একটা মেয়ে কালো হলে অসুন্দর! 
  • একটা ছেলে অথবা মেয়ে কে বিয়ে করতেই হবে সমাজে থাকতে হলে! 
  • সমকামী মানেই শুধু ছেলে- ছেলে অথবা মেয়ে – মেয়ে যৌন সম্পর্ক! 

এই রকম অসংখ্য জায়গায় আমাদের চিন্তা গুলো  সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। আমরা পারছি না নিজের সীমাবদ্ধ চিন্তা কে অতিক্রম করতে।কিন্ত যারা অতিক্রম করতে পেয়েছে তারাই সত্যিকারের সফল ব্যক্তি।

 তাই তো সুমি নিজের গায়ের রঙ কালো  বলে থেমে থাকে নি। নিজের সৌন্দর্য কে সে ঠিক প্রকাশ করতে পেরেছে। আমি নিজে বিয়ে করি নি। কারণ এই দেশে সমকামী বিয়ে আইনগত না। কিন্তু তাই বলে আমি আমার প্রেমিকা কে ভালবাসবো না তাতো তো সম্ভব না। তাই বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি ; থাকছি তাকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে। সেদিন আমার মা আমার বাসায় এসেছিল। সে এখন মন থেকে আমাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে। সে বুঝেছে সমকামিতা মানে কেবল শুধু দু’জন মানুষের মধ্যকার যৌনতা নয় ; বরং যৌনতা থেকে শুরু করে ভালবাসা, শ্রদ্ধা,বিশ্বাস, নির্ভরশীলতার মতো বিষয়ের  মিথষ্ক্রিয়া। 

পৃথিবী আধুনিক হচ্ছে। এই সকল সীমাবদ্ধ  চিন্তা-ভাবনা দূর হচ্ছে। সৌম্যর মত ছেলেরা অন্য কে প্রতারনা করে বিয়ে করার প্রবণতা কমাচ্ছে। কারণ সচেতনতা বাড়ছে। আবার এটাও ঠিক, সীমাবদ্ধতা  কে যেমন অতিক্রম করতে হবে, তেমনি কোথায় যেয়ে থামতে হবে সেটিও জানতে হবে। নিজের জীবন সুন্দর করার দায়ভার আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে। এমন কি বাবা-মা কেও সেই দায়ে দায়বদ্ধ করা ঠিক হবে না।

অরণ্য রাত্রি: নিজেকে লেখক বলবো না। এই যোগ্যতা আমার নেই। বলবো স্বপ্নচারী। আমার স্বপ্ন গুলো, কল্পনা গুলো নানা রঙে রাঙানো। কখনো নীল বেদনা আমাকে বেদনার্ত করে। কখনো লাল রঙের ভালবাসায় আবদ্ধ করে। কখনো রংধনু রঙে নিজের পরিচয় কে তুলে ধরি। আবার যখন কল্পনার জগৎ ছেড়ে এই বাস্তবতায় ফিরে আসি তখন মানুষের মন নিয়ে কাজ করি। আমি পেশায় চিকিৎসক এবং উচ্চশিক্ষা করছি মনঃচিকিৎসায়। বিচিত্র মানুষের মন।এই বৈচিত্র্য এবং কল্পনার মিশেলে তৈরি করি আমার খেরোখাতা।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.