
ছন্দ
রবীন্দ্রপ্রতিভার উৎসমূলের সন্ধানে যদি ব্যাপৃত হই তবে দেখতে পাই তিনি বিচিত্রের দূত৷ তাঁর নিজেরই গানের ভাষায় –“জয় তব বিচিত্র আনন্দ কবি”।
সাহিত্যের সব শাখায় নিরলসভাবে অবিরল ধারায় একের পর কাজ করে গিয়েছেন৷ অলোকসাধারণ সেই হাত থেকে ঝরণাধারার মতো অফুরন্ত ধারায় বেরিয়ে এসেছে — কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস,প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, ভাষাতত্ত্ব, সংগীতচিন্তা, পত্রসাহিত্য, অজস্র নাটক ; সেই নাটকের আবার বহুবিধ ধারায় তিনি লিখেছেন রূপকনাটক, কাব্যনাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য৷ অক্লান্তভাবে বাংলা সাহিত্যে তিনি বহুবিধ ধারায় তার ভার্সেটাইল সাহিত্যপ্রতিভার অভিঘাতে একের পর এক নিরীক্ষাধর্মী কাজে নিয়োজিত রেখেছিলেন নিজেকে৷ তৃষ্ণা ছিল অতল৷ তাই তৃপ্তিবোধ ছিল না৷ আর শিল্পে অতৃপ্তিবোধই চালিত করে সৃষ্টির আনন্দে মাদল বাজানোর জন্য৷ এই শ্রাবণ এলে দহনের টুপটাপ বৃষ্টি ঝরে আমার ব্যক্তিগত নিবাসে৷ শ্রাবণের আগুন রূপ তো তিনিই শিখিয়েছিলেন৷ গানে –‘এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে ‘
তাই বাইশে শ্রাবণে শুধু তাঁর নশ্বর দেহ হয়তো মায়ার বাঁধন ছিঁড়েছিল, কিন্তু তিনি তো রয়েই গেলেন আদিম কার্নিভালের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া একটি ফুলেল নৌকার মতো৷
সবারই ‘আমার রবীন্দ্রনাথ ‘ বলতে একটা গহন অনুভূতি থাকে৷ আমারও আছে সেই শৈশব থেকে৷ তাঁকে ভালবেসেছিলাম, ভালবাসতে শিখেছিলাম! সংবেদনশীলতা, সূক্ষ্মতম বোধের জাগৃতি, সৌন্দর্যবোধ, রোমান্টিকতা, মানবিকতা, নিসর্গপ্রেম এবং তাঁর সেই জন্ম-রোমান্টিক সত্ত্বার প্রতি মুগ্ধতা থেকে তাঁকে চিনেছিলাম৷ একদিনে কালটিভেটেড হয় নি৷ দীর্ঘদিনের পথ চলায়, জীবনের ক্ষত,আঘাত, আনন্দ সহ বিবিধ বোধের মুখোমুখি হয়ে তাঁকে প্রতিদিনের সকালে আবার নতুন করে পাই৷
বিশ্বমানবের দিকে নিজেকে উন্নীত করা, লিঙ্গপরিচয়, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মের বেড়াজাল থেকে বের হয়ে ব্যক্তিমানুষের ‘গহন আমি’ কে খুঁজে বেড়ানোর তাগিদ থেকে তাঁকে নিজের করে পেয়েছিলাম৷
আর্ট ফ্রেম থেকে তিনি নিজেই নিজেকে বের করেছেন মৃত্যুর আগ অবধি৷ বিশেষ করে শেষ দশ বছরে তিনি আর থামতেই পারেন নি৷ নিজেকেই দেখেছেন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী৷ তাঁর সর্বগ্রাসী প্রতিভার ছাপ পড়েছে শুধুমাত্র মহাকাব্য ছাড়া সাহিত্যের বাদবাকি সব শাখায়৷ এমনকি চিত্রকলাতেও অভিনিবেশ করেছিলেন শেষ জীবনে৷ তবে সব লেখকই নিজের সময়ের সন্তান৷ রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য৷ ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় সাহিত্য, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির সাথে তাঁর যে নৈকট্য ও স্থিতথী প্রজ্ঞার মিশেল ছিল,একই সাথে তৃষ্ণার্তের মতো পাশ্চাত্য থেকেও অকাতরে নিয়েছেন তিনি।
প্রথাগত শিক্ষায় তাঁর আস্থা ছিল না এটা সর্বজনবিদিত৷ তবে ছেলেবেলা, জীবনস্মৃতি, আত্মপরিচয় বই তিনটিতে দেখতে পাই খুব শিশু অবস্থাতেই তিনি যাদের কাছে লালিত পালিত হয়েছেন – তাদের কাছেই ঝিল্লীমুখর সন্ধ্যায় তিনি মহাভারত ও রামায়ণের গল্প শুনে শুনে নিজের কল্পনার ডানা মেলেছেন৷
পিতৃদেব ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী, সেই সূত্রে উপনিষদ এবং বেদ তার ভিত্তিতে কিছুটা প্রভাব রেখেছিল, সঙ্গে তাঁর মিস্টিসিজমের সংযোগে আলাদা এক মাত্রা সৃষ্টি করলো তাঁর সাহিত্যে। তবে ব্যক্তিগত গুঞ্জরণকে রোমান্টিক প্রেরণায় তিনি নীলিমায় উন্নীত করেছিলেন৷ চৈতালী’ কাব্যগ্রন্থের ‘পুণ্যের হিসাব’ কবিতার স্বগতোক্তি —
‘যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা’
একই সাথে তিনি প্রাচীন বাংলাসাহিত্য চর্যাপদ থেকে শুরু করে বড়ু চন্ডীদাস, কালিদাসের মেঘদূত, বিদ্যাপতি; মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী এবং কীর্তনের দ্বারেও গেছেন৷ মুগ্ধতা ছিল ফারসী সাহিত্যে; হাফিজ, রুমি, গালিবের স্পিরিচুয়ালিটি এবং বাংলার লোকজ বাউল দর্শনেও নিবিড় সংযোগ ছিল৷
আবার ইউরোপ থেকে, পশ্চিম থেকে অকাতরে কীটস, শেলী, বায়রন পড়েছেন, বলাবাহুল্য তিনি মর্মে মর্মে রোমান্টিক, তাঁর নিজেরই কথায়- ‘আমি জন্ম-রোমান্টিক’ ; বুদ্ধদেব বসু এই থিওলজিকাল কনসেপ্ট পেয়েছিলেন ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থে৷ সেই রোমান্টিকতাই আমাদের সাহিত্যে সবচেয়ে স্বর্ণালি ফসল ফলিয়ে গেছে এক রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে৷ তবে এসবই রবীন্দ্রপ্রতিভার কালোত্তীর্ণ গুণে তাঁর একান্ত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে আমাদের বাংলা সাহিত্যে৷ এসব বোঝাটা জরুরী, নতুবা রবীন্দ্রনাথকে খণ্ডভাবে দেখা হয়৷এভাবে অনায়াসে বিশ্বমানবে তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন; বিশেষত শেষ দশ বছরের কীর্তিতে চোখ ফেললে নির্মোহভাবে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়৷ তাঁর সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর একটি উক্তি বলি–
‘তিনি (রবীন্দ্রনাথ) সৃষ্টি করলেন ভাষা, গদ্য এবং পদ্য।’
আশি বছর তিন মাসের সাহিত্যজীবনে তিনি লিখছেন ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩ টি উপন্যাস, ৩৮ টি নাটক, ২২০০ গান, অজস্র প্রবন্ধগ্রন্থ, ভ্রমণকাহিনী, ৩টি গীতিনাট্য, ৪টি নৃত্যনাট্য৷ দুইটি আত্মজীবনী, ৯৪ টি ছোটগল্প গল্পগুচ্ছে, এছাড়া সে, গল্পসল্প, তিনসঙ্গী গল্পগ্রন্থের গল্পগুলি৷ ভ্রমণকাহিনী,সমালোচনা সাহিত্য৷
বিশ্বভারতী থেকে রেক্সিন বাঁধাইয়ে ২৯ খণ্ড+ ২ খণ্ড অপ্রচলিত মোট ৩১ খণ্ডের রচনাবলী৷ ১৯ খণ্ডের চিঠিপত্র। এছাড়াও পত্রধারার ৩ বিশিষ্ট পর্বের চিঠিপত্রাবলী সাহিত্য যা ছিন্নপত্র, ভানুসিংহ ঠাকুরের পত্রাবলী এবং পথের সঞ্চয় হিসেবে সন্নিবেশিত।
শুধুমাত্র মহাকাব্য ছাড়া এমন কোন শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রপ্রতিভার স্পর্শ লাগে নি৷ এছাড়াও শান্তিনিকেতন তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী সাহিত্য সাধনার বাস্তবায়নের স্মারক হিসেবে আছেই যেখানে শিল্পকলার সমস্ত দিক নিয়ে পড়ানো হয়৷
তবে তাঁর সমগ্র সৃষ্টিশীলতার মূলে ছিল কবিসত্ত্বা৷ বুদ্ধদেব বসু যেটাকে বলেছেন মর্মে মর্মে কবি৷ এখন আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের কবিসত্ত্বার দিকে তাকাই তবে তাঁর বিপুল কবিতা আমাদের বিপর্যস্ত করে সুন্দরের মুখোমুখি দাঁড় করায়৷ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ধারা থেকে শুরু করে, মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্য, পশ্চিমের রোমান্টিকতা এবং তাঁর অতিন্দ্রীয় ব্যক্তিগত গুঞ্জরণ তাঁর কবিতার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে৷ বলাবাহুল্য আমাদের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় কবি তিনি, রোমান্টিকতাকেই তিনি তাঁর সুদীর্ঘকালের কাব্যসাধনার পথে চালিত করেছেন যেখানে তিনি নিজেই বলেছেন আমি মর্মে মর্মে কবি৷
এখানে আমি বলার চেষ্টা করবো প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি কতটা নিবেদিত ছিলেন, কতটা submissive ছিলেন, কতটা উদারভাবে শুদ্ধভাবে টক্সিক মেইল ইগোকে খারিজ করেছেন। উল্লেখ্য, আমার আলোচনা শুধুমাত্র ‘গীতবিতান’ কে উপজীব্য করে আবর্তিত হবে এইখানে৷ অর্থাৎ তাঁর গানই এই পোস্টে আসবে প্রসঙ্গের দাবিতে৷ অন্য সব শাখা নিয়ে এই পোস্টে আলোচনাটা রাখলাম না কারণ পোস্টটা অনেক বেশি দীর্ঘ হয়ে যাবে৷ তাঁর ২২০০ গান যে বইয়ে আছে সেটিই ‘গীতবিতান’৷ রেফারেন্স হিসেবে পোস্টে তাই গানগুলিই আনব আমি৷
রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব প্রেমের ধারায় নিজেকে উজাড় করেছেন প্রেমাস্পদের কাছে৷ তাঁর প্রথাগত কোন ঈশ্বর ছিল না, ছিল ব্যক্তিগত ঈশ্বর৷ যাঁকে তিনি ডেকেছেন পরানসখা, জীবনদেবতা বলে৷ যাঁর সাথে তিনি মিলতে চেয়েছেন মর্ষকামী ভূমিকায়৷ এমনকি তাঁর পায়ের চিহ্ন রাখতে চেয়েছেন হৃদয়ে৷ এহেন প্রেমবোধ বাংলাসাহিত্যে কেন সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে পাওয়া দুষ্কর৷
এখন আমরা দেখার চেষ্টা করবো কিছু রেফারেন্স টেনে এই বিষয়টি। মোদ্দাকথা, তাঁর ব্যক্তিগত ঈশ্বরের সাথে তাঁর যে সম্পর্ক তিনি পেতেছিলেন সেটা নারীভাবের অর্থাৎ তিনি নিজের জেন্ডার ইগো এখানে অস্বীকার করেছেন৷ হোক ব্যক্তিগত ফিলসফিক্যাল গড, হোক মানসী, হোক নারী, হোক প্রকৃতি ; রবীন্দ্রনাথ সংবেদনশীল একজন মানুষ হিসেবে বাইনারী সীমা অতিক্রম করে গেছেন৷
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া গানের শেষের দিকে একটি লাইন আছে —
‘তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া ‘
এমন নিবেদিত প্রেমের উদাহরণ আমাদের সাহিত্যে অন্তত খুব একটা দেখা মেলে না৷
রবীন্দ্রনাথ যে গানগুলিকে পূজা পর্যায়ে সাজিয়েছেন গীতবিতানে সেগুলিতে তিনি তার ব্যক্তিগত ঈশ্বরের সাথে মেতেছেন একজন নারীর ভূমিকায়৷ তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রেমিককে শুধু মোহন প্রেমিক হিসেবেই দেখতেন না, তাঁর কাছ থেকে চাইতেন নিষ্ঠুরতাও৷ তবে মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর কোন প্রথাগত ঈশ্বর না যাঁর সাথে রবীন্দ্রনাথ মেতেছেন মর্ষকামী ভূমিকায়, এমনকি পীড়নেও তিনি আনন্দ পান৷ এক প্রকার মর্ষকামী সুখ এবং পুলকের সঞ্চারের হয় এতে৷ এই পরমসখার সাথে তিনি একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক পাতিয়েছিলেন যাতে স্বর্গ নরক নেই, নেই কোন আচার আচার-প্রথা৷
এখন আমি কিছু উদাহরণ টানি —
১. আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, সেথায় চরণ পড়ে তোমায় সেথায় চরণ পড়ে
২. সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে।
যাক -না গো সুখ জ্বলে৷
৩.ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর,
তোমার প্রেম তোমারে এমন ক’রে করেছে নিষ্ঠুর
৪.ও নিষ্ঠুর,আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে
তুমি মর্মে আমায় মারবে হিয়ার মাঝে
৫.আঘাত করে নিলে জিনে
কাড়িলে মন দিনে দিনে
৬.ভয়েরে মোর আঘাত করো ভীষণ, হে ভীষণ
৭. এই করেছ ভালো, নিঠুর হে, নিঠুর হে এই করেছ ভালো
৮.আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো
আরো কঠিন তারে জীবন তারে ঝংকারো
৯. আরো আরো, প্রভু, আরো আরো
এমনি ক’রে আমায় মারো
১০. তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ দুঃখের অশ্রুধার
১১. নয় এ মধুর খেলা—
— ওগো রুদ্র,দুঃখে সুখে এই কথাটি বাজল বুকে
তোমার প্রেমে আঘাত আছে নাইকো অবহেলা
১২. আনন্দ তুমি স্বামী, মঙ্গল তুমি
১৩. তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি ওই গো বাজে হৃদয় মাঝে
১৪. ভোরের বেলা কখন এসে পরশ করে চলে গেছ
১৫. আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে গো ফুল ফুটবে
আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে
উপরোক্ত গানগুলি পূজা পর্যায়ের ( কোন প্রথাগত পুরুষ না তিনি এইসব গানের ক্ষেত্রে (সামাজিক সংজ্ঞায়নের নিরিখে) , যেখানে তিনি চূড়ান্ত অর্থে নিজেকে মর্ষকামী ভূমিকায় রেখেছেন৷ টক্সিক মেইল ইগো বিসর্জন না দিতে পারলে এমন কাতরতার গান তিনি লিখতে পারতেন না৷ submissive role play করেছেন ব্যক্তিগত ঈশ্বরের সাথে অর্থাৎ নন বাইনারী মানুষ হিসেবে, সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে তিনি সৃষ্টি করেছেন ভিতর থেকে৷ এমন কাতরতা, এমন আত্মনিবেদন বিশ্বসাহিত্যে বিরল৷ এখন একটা প্রশ্ন সহজাত ভাবেই আসে যে একজন নাস্তিবাদী মানুষ রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান কিভাবে গ্রহণ করে?? এর রস আস্বাদন করে কিভাবে?
খুব সুন্দর একটা পয়েন্ট৷ আগেই বলা হয়েছে এই ঈশ্বর কোন নির্দিষ্ট ধর্মের নন৷ রবীন্দ্রনাথের অতুলনীয় ভাষাগত সৌন্দর্য, আবেগের স্ফুরণ,সৌন্দর্যবোধ, অতুলস্পর্শ মানবিক চেতনা, সংবেদনশীল মনের কাতরতাই এই গানের নিকটে বারবার নিয়ে যায় সাহিত্য রসিকদের৷ ডক্টর আহমদ শরীফ, আবু সয়ীদ আইউব এবং ডক্টর হুমায়ুন আজাদ সহ নাস্তিকবাদী সৃষ্টিশীল মানুষেরাও রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান উপেক্ষা করতে পারেন নি কাব্যবোধ এবং সুরলোকের তীব্রতার কারণে৷
এখন আমি দেখাবো রবীন্দ্রনাথের রাঁধাভাব৷ তিনি নিজেকে রাধা (নারীস্বভাব, সোশ্যাল নর্মস যেভাবে দেখে) হিসেবেও উপস্থাপিত করেছেন৷ এটা এসেছে তাঁর বৈষ্ণবপ্রীতি থেকে। শ্যামের সাথে প্রেম, অভিসার,হাহাকার,মিলনের তীব্র আকাঙ্খা ব্যক্ত হয়েছে যে সকল গানে- সেসবের কিছু দৃষ্টান্ত তুলে আনি৷
১.বসন্ত আওল রে!
মধুকর গুণ গুণ, অমুয়ামঞ্জরী কানন ছাওল রে।
শুন শুন সখী, হৃদয় প্রাণ মম হরখে আকুল ভেল৷
২. শুন লো শুন লো বালিকা রাখ কুসুমমালিকা,
কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরণু সখি,শ্যামচন্দ্র নাহি রে।।
৩.শ্যাম রে, কঠিন মন তোর!
বিরহ সাথী করি দুঃখিনী রাধা রজনী করত হি ভোর।
৪. সজনী সজনী রাধিকা লো, দেখ অবহুঁ চাহিয়া
মৃদুল গমন আওয়ে মৃদুল গান গাহিয়া
৫. গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে মৃদুল বংশি বাজে
৬. বজাও রে মোহন বাঁশি
সারা দিবসক বিরহদহনদুখ
৭.আজু সখি, মুহু মুহু গাহে পিক কুহু কুহু
৮. আজ আসবে শ্যাম গোকূলে ফিরে
৯.বাঁশরি বাজাতে চাহিব,বাঁশরি বাজিল কই
১০. আমি নিশি নিশি কত রচিব শয়ন আকুল নয়ন রে
১১. আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি
১২.মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে।।
ভেবেছিলেম ঘরে রব, কোথাও যাব না —
ওই-যে বাহিরে বাজিল বাঁশি,বলো কী করি।
উপরোক্ত গানগুলিতে রাধা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করেছেন৷ কখনো শ্যামের বিরহে তিনি দিন রাত এক করে ফেলছেন! কখনো উতল হয়ে উঠছেন৷ কখনো তাঁর সর্বশরীরে ঢেউ খেলে যাচ্ছে৷ শ্যামের বাঁশির ধ্বনি তাঁকে অভিসারে ডাকছে৷ এখানেও রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত পুরুষের ভূমিকা থেকে অনেক দূরের মানুষ কেননা তিনি জানতেন -যাঁর রাধাভাব বেশি তাঁর ভিতরে ক্রিয়েটিভিটিও বেশি৷ টক্সিক মেইল ইগো কিংবা বাইনারী ডেফিনেশনের জায়গা থেকে তিনি এই ক্ষেত্রেও অনন্য৷
তিনি এও বলেছেন —
জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয়৷
একজন নারীর ভূমিকায় গিয়ে পরম পুরুষের সামনে তিনি এমন আকুতিও শুনিয়েছেন গানে৷
আবার তিনি বলেছেন —
‘লুকিয়ে আসো আঁধার রাতে তুমিই আমার বন্ধু’
এখানেও তাঁর সখা পুরুষ৷ পরমপুরুষ সেই ব্যক্তিগত ঈশ্বর৷
গীতবিতান থেকে আরো দুইটি গানের উদাহরণ টানি যেখানে ছেলের প্রসঙ্গ এসেছে–
১. ওগো সাওতালী ছেলে
২. দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে
এই যে নিউট্রালি সুন্দরের প্রশংসা করেছেন সেই যুগে নিউট্রালি।সুন্দরের কোন জেন্ডার বা লিঙ্গ পরিচয় নেই৷ অথচ আজকের দিনেও ভাবা হয় একজন ছেলে একজন নারীর দেহগত সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে পারবে, সমলিঙ্গের ক্ষেত্রে এই প্রশংসাকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়৷ এই যে দীক্ষা তিনি দিয়েছেন; সেটার আরো বিস্তৃত রূপ দেখতে পাই গীতবিতানের নৃত্যনাট্য অধ্যায়পর্বের ‘চিত্রাঙ্গদা ‘ নৃত্যনাট্যে৷ ডান্স ড্রামাটির আখ্যানটি খুব সংক্ষেপে এমন যে চিত্রাঙ্গদা নারী হয়ে জন্মালেও তার দেহসৌষ্ঠব, আচার, বেড়ে উঠা পুরুষালী( সমাজ যেভাবে আর কী নারীত্ব, পুরুষত্বের সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছে সেই নিরিখে)। তো অর্জুনকে যখন দেখলো তখন তার ইচ্ছে হলো নারীসুলভ নমনীয়তা, পেলবতা যেন তার হয়৷ কারণ অর্জুন তাকে প্রত্যাখ্যাত করেছিল প্রথম দর্শনে৷ তো চিত্রাঙ্গদা প্রেম এবং কামের দেব মদনের কাছে বর ভিক্ষা চেয়ে সেই প্রথাগত নারীরূপ পেল৷ এক সময় মোহভঙ্গ হলো এবং শেষে রবীন্দ্রনাথ জেন্ডার আইডেন্টিটির বাইরে মানুষরূপে চিত্রাঙ্গদাকে পৌঁছে দিলেন মানবিক মর্যাদায়। ডান্স ড্রামার একটি লাইনই বলে দেয় মূল থিমটি —
‘রূপের অতীত রূপ দেখে যেন প্রেমিকের চোখ’
রবীন্দ্রনাথ এভাবেই মানুষের জয়গান গেয়েছেন৷
শুদ্ধ মানুষ হওয়ার যাবতীয় উপাদান তাঁর বিশাল সাহিত্যকীর্তিতে রয়ে গেছে৷ তাই তো বলেছিলেন গানেই–
“আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে
———- দেহ মনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে”
ছন্দ, গাজীপুর থাকে, কবিতা লিখে৷ সাহিত্যপ্রেমী৷ সংগীত, কবিতা, সাহিত্য, চিত্রকলা সহ শিল্পকলার সাথে নিবিড়তর সম্পর্ক৷ অবসর সময়ের বেশিরভাগ বই পড়ে, গান শুনে, বাগান করে, সিনেমা দেখে কাটানো হয়৷ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের প্রতি অফুরন্ত মুগ্ধতা৷ পড়াশুনা করেছে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে৷ নিজেকে নন বাইনারী মানুষ পরিচয়ে ভাবতেই পছন্দ করে৷