আঝা ন’পুরেলো / অপূর্ণতা

আর্টিস্ট- রুহ

চিত্তি চাঙমা

আজ ১৭ই নভেম্বর। দিনটি পহরের জন্যে বিভীষিকাময় হয়ে আছে। জীবনের প্রতি অনীহা, জগতের প্রতি ক্ষোভ, সৃষ্টিকর্তার নিকট অভিযোগ নিয়ে, তবুও চলতে হচ্ছে সময়ের চক্রবূহ্যে আবদ্ধ হয়ে। পদে পদে অপূর্ণতা, সবকিছু যেন অপ্রাপ্য। তারপর বসে থাকে হিজিং- এর ফেরার পথ চেয়ে। এই এলো বলে! টুং একটা শব্দে হারিয়ে যাওয়া অবচেতন থেকে ফিরে আসে সে। কিছুক্ষণ পর আবার হারিয়ে গেলো কষ্টে ভরা প্রাত্যহিক জীবনে। এ যেন শেষ হবার নয়। চিন্তায় বিভোর হয়ে ভাবে, এ বুঝি তারই নিয়তি! কেউ কি নিয়মের বাইরে যাবার নয়? সবকিছু কি তাহলে আগে থেকে এই কষ্টের সমাহার। বেঁধে দেয়া হয়েছে জীবনচক্রে? বয়ে চলেছে পহর এই কষ্টের ঝুলিটা। ঝুলিটা খালি হতে হতে কে যেন আবার পূরণ করে যাচ্ছে।

গতকাল থেকে লক্ষ্য করতেছি পহরের হালচাল কেমন যেন। মেজাজটা ঠিক যেন ঠাউর করা যাচ্ছে না। তার যেসবে ভালো লাগা, সেসবে যেন মন উঠে গেছে। মনে হচ্ছে যেন পছন্দের জিনিসের সাথে খুব অভিমান করছে সে। যে মানুষটা সকাল হতে না হতেই ছাঁদে গিয়ে ফুল গাছে জল দিতো সে আজ গোমড়া মুখ করে বসে আছে। আমি ডাক দেওয়ায় তার হুঁশ ফিরলো- ‘বলে, খোলা আকাশের নিচে গিয়ে জোরে শোরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।’

বলতে না বলতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। আমি জেনেও না জানার ভান করে বললাম- ‘কি হয়েছে পহর?’

সে কিছু না বলে উঠে চলে গেলো! দরজাটা জোরে শব্দ করায় আমিও উঠে ওর পিছু নিই। দরজাটা ভিতর থেকে আটকানো। আমার ডাকাতে বিরক্ত হয়ে বললো- ‘তুমি চলে যাও! আমি একাই ভালো আছি।’

আমি আর জোর করলাম না। কারণ ছেলেটা বড্ড জেদি। আমি হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম নদীর পাড়ে বসবো বলে। রবীন্দ্র সংগীত গুনগুন করতে করতে কখন বেলা হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। পহরের কলে ফিরে পেলাম চেতনা। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সে সরি বলে জিজ্ঞেস করলো,- ‘আমি কোথায়?’


বললাম- ‘নদীর পাড়ে বসে আছি। একা ভাবনার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে। তুমি আসবে, পহর?’
আমি এখুনি আসতেছি বলে ফোন রেখে দিলো। আমি আবারও রবীন্দ্র সংগীত গুনগুন করা শুরু করলাম। কখন সে আমার পাশে এসে চুপচাপ বসে আছে খেয়াল করিনি। তার কাশির শব্দে চমকিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,’ কখন এলে?’


সে কোনো উত্তর দিলো না।মিনিট পাঁচেক পর বললো কাল হিজিঙের মৃত্যুবার্ষিকী। হিজিং, পহরের ছোটবেলা থেকে কৈশোরের খেলার সাথী। ছোটকাল হতে একই স্কুল, একই কলেজে পড়াশোনা করেছে তারা। কথা হচ্ছে, কেউ কাউকে ছাড়া একমুহূর্তও চিন্তা করতে পারতো না। সম্পর্কটা ঠিক যেন বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কিছু, দুষ্টুমিতে ভরা। তবে পহরের তুলনায় হিজিং একটু শান্ত। সবকিছু তাকে সামলাতে হতো। আর পহর ছিলো দুরন্ত আর বড্ড আবেগী। সবকিছু হিজিঙের উপর চাপিয়ে দিয়ে গা ছাড়া ভাবে চলতো বেশ! অল্প কথায় হাসতে-হাসতে গড়াগড়ি করতো পহর। তার দিকে সবাই ঠাট্টার চোখে তাকালেও, সে চলতো তার নিজের মতো করে। হিজিঙের এসব ভালো না লাগলেও ঠিক মানিয়ে নিয়েছে একান্ত নিজের বলে। আহা, কি দারুণ দেখতে তাদের আনন্দে ভরা খুনসুটি। কি সুন্দর আর সাবলীল তাদের স্বপ্নে ভরা পথচলার ভঙ্গিমা। এ যেন কারুকার্যে শোভিত তাদের জীবনটা। মনে হয় যেন কোনো কারিগর এসে বুঝি বানিয়ে দিয়ে গেছে তাদের এমন সুন্দর জুটি! সারাক্ষণই চলতে থাকে তাদের মান অভিমান। সব অভিযোগ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতো হিজিঙ। মাঝে মাঝে চিন্তা করি সে বুঝি যন্ত্র মানব! কোনো রাগ নেই, নেই কোনো অভিযোগ। নাকি থাকলেও পহর কষ্ট পাবে ভেবে বলে না কে জানে।

সময়ের পরিক্রমায় পহর আর হিজিঙের পথ আলাদা হতে বসেছে আজ। পথ আলাদা বলতে ঠিক আলাদা হয়ে যাওয়া নয়। হিজিঙ মেডিক্যালে চান্সে পেয়েছে। সেই সুদূর জাপানের একটা মেডিক্যাল স্কুলে। তাকে যে এবার যেতেই হবে নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত স্বপ্নের বীজটা বপন করবে বলে। এসব বলাবলি করতে করতে পহর আর হিজিঙ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতো আর বলতো দেখ না ভাগ্যের কি লিখন! আমাদেরকে যে এবার আলাদাভাবে থাকতে হবে। দেখা হবে হয়তো কত যুগের পর। এসব ভাবতে ভাবতে পহর চোখ রাঙা করতো। আর হিজিঙ ছিলো খুব চাপা স্বভাবের। এত সহজে নিজের কষ্টগুলো প্রকাশ করতো না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ডুকরে মরতো। পহরের কষ্ট ভুলানোর জন্যে হাসিমুখে রসিকতার ছলে বলতো দেখো পহর, আমি ঠিকই তোমায় ভুলে থাকতে পারবো। আর তুমিও পারবে ভুলে যেতে আমাদের প্রতিটি মুহূর্তে কাটানো দিন এবং আলাপগুলো। হয়তো আমার স্মৃতিগুলো কোনো একটা ডাস্টবিনে ফেলে রেখে দিব্যি চলবে। পহর অভিমান করে বলতো সত্যি তোমাকে ভুলে যাবো একদিন। তখন কিন্তু চাইলেও ফিরে পাবে না হারিয়ে যাওয়া এই আমাকে। ধরতে গেলে আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঠিক বেরিয়ে যাবো। এসব আলাপ করতে করতে কখন যে রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো তাদের খেয়াল নেই। সেদিন রাতটা তারা নির্ঘুমে কাটিয়ে দিয়েছিল বেশ! তারা একে অপরের হাত ধরে শুয়ে আছে। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় বিভোর হয়ে।

সেদিন ছিলো শুক্রবার। হিজিঙ মন খারাপ করে জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছে স্বপ্ন গড়ার লক্ষ্যে হাঁটবে বলে! কালই তার ঢাকা যাওয়ার দিন। আগামী সোমবারেই তার ফ্লাইট।এখন গেলে হয়তো আসবে পরের বছর কিংবা আরো পরে! পহর চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে আর ভাবছে, হিজিঙ না থাকলে আমি একা থাকবো কি করে! কার হাত ধরে আবদার করবো। হিজিঙ সত্যি সত্যি হারিয়ে যাবে না তো আমার জীবন থেকে? নাকি আমায় ভুলে গিয়ে অন্য কারোর হাত ধরে চলতে থাকবে তার মনে গড়া স্বপ্নের দিকে! পহরের এই ভাবনা যে সত্যি হবে তা কে জানতো! জানতো না সে নিজেও। যে ফ্লাইটে হিজিঙ জাপানের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলো, মাঝপথে দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় তার সর্বস্ব। ভেঙে দেয় তার মনে বুনে রাখা স্বপ্নের আলপনা। অপূর্ণ থেকে যায় পহর-হিজিঙের ভালোবাসায় গড়ে তোলা মিষ্টি সম্পর্ক।
ভালোবাসা কি অপূর্ণই থেকে যায় এভাবে?

তারা-শঙ্করের সৃষ্টি নিতাইয়ের মতো পহরও জপে-

এই খেদ মোর মনে,
ভালবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এ জীবনে।
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?

লুডুঙ- আদিবাসী কুইয়ার ঝুলি,আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আদিবাসী লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষের লেখা নিয়ে বিশেষ সংকলন।

চিত্তি চাকমা: ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা খাগড়াছড়ি জেলাধীন দীঘিনালা উপজেলায়। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিষয় নিয়ে স্নাতকে অধ্যয়নরত। ভিনদেশে পাড়ি জমিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পুরো বিশ্ব ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রবল। নিজেকে গে হিসেবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.