ইজোর কথা

আর্টিস্ট- রুহ

ইনজেব চাকমা

শহরের পাহাড় ঘেরা এক সরু রাস্তা বরাবর গাছপালা, লতা-পাতা, ফুল-ফলের সাথে কথা বলতে-বলতে হাঁটছে ইজোর। বড়ই প্রকৃতি-প্রেমী মন তার। পাহাড় ও সবুজে ঘেরা চট্টগ্রাম শহর। অথচ আষাঢ়ের আগমনেও গ্রীষ্মের তাপ-দাহ কমেনি। প্রচণ্ড গরমের মাঝে আজকের আবহাওয়াটা বেশ স্নিগ্ধ। তাই আজ বেশ খোশমেজাজ তার। চলতে চলতে হঠাৎ দমকা হাওয়া সমেত বৃষ্টি এসে পুরো ভিজিয়ে দিলো তাকে। হাতে ছাতা নেই। ভিজে পুরো একাকার। গরমের দিনে এটা সত্যি সত্যিই মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো। খুশিতে কাক-ভেজা ভিজে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতেই পিছলে পড়ে যায় সে।

শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম থেকে জেগে দেখে- পাতলা একটা চাদর গায়ে শুকনো অবস্থায় বিছানায় সে। এতক্ষণ যা হচ্ছিলো সবই স্বপ্ন ছিলো। পাশ ফিরে জানালা দিয়ে দেখে বাইরে সত্যি সত্যি বৃষ্টি হচ্ছে। রাতে জানালাটা পুরোপুরি বন্ধ করা হয়নি। তাই সুযোগ পেয়ে শীতল হাওয়া রুমে ঢুকে তাকে চুমু খেয়ে ঘুম থেকে জাগালো।

আজ ছুটির দিন। তাই ঘুম ভাঙ্গাতে অ্যালার্ম বাজেনি। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল ঠিকই জাগিয়ে দিয়েছে তাকে। চোখ কচলিয়ে আর শরীর মোচড় দিয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করে সে। হাতে মোবাইল নিয়ে সময় দেখে, প্রায় দশটা। চিরায়ত নিয়মে ডাটা অন করে ম্যাসেঞ্জার চেক করে। সেই পরিচিত ইনবক্স। যেন আরবের মরুভূমি কিংবা গ্রীষ্মের দাবদাহে খরায় ফেটে যাওয়া ঊষর জমি। বহুকাল ধরে যেখানে চাষাবাদের কথা পর্যন্ত কেউ তোলেনি। কোথাও কেউ নেই! যে কয়জনের মেসেজ তার হৃদয়ে খুশির জোয়ার বয়ে আনে তাদের দেখা নেই। যদিও তাদের নাম আর ছবির পাশে সবুজ বাতি জ্বললেও মেসেজের খরা থেকে যায়।

মনটা কেমন করে ওঠে তার। জ্বলজ্বল করা সবুজ বাতিগুলোও যেন তাকে অপমান করছে। এমনিতেই নক দেয়ার প্রচণ্ড প্রবণতা তার উপর প্রিয় মানুষের আইডিগুলোর সম্মুখ সারিতে উপস্থিতি তাকে আরও বেশি কষ্ট দেয়। বারবার চেক করতে যায়। কিছু লিখতে চায়। অথচ কি লেখা যায় ভাবতেই সময় চলে যায়। কখনও আবার মনের সমস্ত জমানো কথাগুলো এক নিমেষেই লিখে ফেলে। কিন্তু কি মনে করে কেটে দিয়ে বের হয়ে আসে।

কখনও ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে কল বাটনে চাপ পড়ে খুন করে ফেলে অদৃষ্ট। “ভুলে চাপ পড়ে কল এসেছিলো” লিখে মেসেজ পাঠায় সৌজন্যতার খাতিরে। কখনও “ওকে” রিপ্লাই আসে। কখনও বা সিন করে অমনি রেখে দেয় তারা। তারপর, সেখানে মাকড়সারা মনের মাধুরি মিশিয়ে তাদের শিল্পগুণের প্রসার ঘটিয়ে জগতের চিরায়ত নিয়ম রক্ষা করে। তার ইজোর নামের সার্থকতা ওখানেই।

ইজোর, নামটির অর্থটা ঠিক কি? চাকমারা টং ঘর কিংবা সাধারণ ঘরের সামনে বা পিছনের দিকে বসার জন্য মাচার মতো বাড়তি যে দাওয়া বানায়, তাই ইজোর। যেখানে বসে আড্ডা দেয়, হুক্কা খায়, নাস্তা করে, জ্যোৎস্না রাতে বসে গল্প করে আর জ্যোৎস্নার আলোয় অবগাহন করে। কিন্তু ঘুমানোর সময় কিংবা ঝড়-বৃষ্টিতে ঘরের ভেতরে নেয় না কেউ। কেউ নিতে পারে না। প্রয়োজনে ব্যবহার করে অবহেলিত, পরিত্যক্ত একটা জায়গায় পরিণত হয় এই মাচাটা। এই ইজোরের অবস্থাটাও অনেকটা এই মাচা “ইজোর”- এরই মতো।

তাকে কেউ ভালবাসার মানুষের জায়গায় বসাতে পারে না, যাদের সে মনে-প্রাণে চায়। তবে তারা কদর করে, বন্ধুর মতো ভালোবাসে তাকে। কিন্তু এই ভালবাসা দিয়ে কি আর মন ভরে? জীবন হয়তো এগোয় তবে অন্দরে এক অতৃপ্তি থেকে যায়। মোটামুটি হলদেটে ফর্সা চামড়া আর ছিপছিপে গড়নের শরীর নিয়ে ইজোরের চেহারা দেখতে অতটা মায়াবী না হলেও কেউ কেউ খুব পছন্দ করে তাকে। কিন্তু সে যাদের পছন্দ করে তাদের কাছে সে ঠিক ওভাবে পছন্দের হয়ে উঠতে পারে না। এজন্য তার দুঃখের সীমা নেই। সে বুঝতে পারে, মঙ্গোলিয়ান চেহারা বলেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয় না তারা। চুল ঠিক নেই, পড়ে গিয়ে টাক হবার পথে। নাক-মুখ-চোখে চুম্বকত্বের অভাব। গোঁফ-দাঁড়ির কথা আর না-ই বলি। মঙ্গোলয়েড প্রকৃতির মানুষগুলোর দাঁড়ি সম্পর্কে সবাই অবগত। এগুলোর বাইরেও তাদের মুখমণ্ডলে যে একটা মায়ায় আকৃষ্ট করার শক্তি থাকে সেটাও নেই তার।

রঙ্গিন দুনিয়ায় এসব বিষয় জানা হয়তো সহজ নয়। তবে মুখোশ পরলেই সব পরিষ্কার হয়ে ওঠে। মুখোশ পরে কতজনকে যে ফাঁসিয়েছে জালে, সেকথা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে যায় তার। কিন্তু যখন সে মুখোশ উন্মোচন করে তাদের কাছে তখন সবাই দূরে সরে যায়। ওপাশে গতানুগতিক যেরকম মুখমণ্ডলের অপেক্ষায় বসে থাকে এ পাশ থেকে আশানুরূপ দেখা না পেয়ে চিরদিনের জন্য তারা দরজা বন্ধ করে দেয় মুহূর্তেই। এই অদৃষ্ট তাকে বারবার কুঠারাঘাতের মতো বিঁধে।

জীবনকে খুব সাধারণভাবে দেখার মাঝেই নিজের সুখ খুঁজে পায় ইজোর। ঘুরাঘুরি, বই আর মনের মতো একটা সঙ্গীর সঙ্গ পাওয়ার ইচ্ছা-ই তার জীবনের সম্বল। আর সে যে সঙ্গীর ইচ্ছা পোষণ করে তা প্রচলিত সমাজে নিষিদ্ধ। এজন্য গোপনে, অভিসারে প্রণয়াকাঙ্ক্ষা করতে হয় তাকে। তার জীবনে কিছু কাছের মানুষ আছে যাদের সাথে তার সম্পর্ক এমন, যেন সে তাদেরকে কেন্দ্র করে উপগ্রহের মতো ঘুরছে। না পায় সে একদম কাছে যাওয়ার অধিকার, না পায় সে দূরে যাবার অনুমতিও।

বয়স প্রায় ত্রিশ ছুঁই ছুঁই তার। জীবনের অলিগলি কম পার করেনি সে। অনেককিছু দেখে এসেছে, সয়ে এসেছে। যেখানে নিজ শহরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কর্তৃক অবহেলা,লাঞ্ছনা, হাসি ঠাট্টার পাত্র হতে হয়। অন্য শহরে একদম অপরিচিত পরিবেশে কতটা হতে হয় এবং কি পরিমাণ অসহায় হয়ে থাকতে হয় কেবল ভুক্তভোগীই জানে। আর আছে জীবনের এই বদ্ধ কুঠুরি, যার সন্ধান এখনো সেভাবে কেউই পায়নি।

মামু, আ হদক্ষণ পুরি থেবে!!

ভাগ্নের ডাক শুনে হুঁশ ফিরে তার। হুম? বলে ভাগ্নের দিকে তাকায় সে।

ভাগ্নে- বারো টা বাজি যিয়েগোই। হক্কে উদিবি!

ইজোর- হুম, উদোঙর..

বলেই ফোনে সময় দেখে, প্রায় দুপুর ১২টা। উঠে মশারি তুলে বিছানা গুছিয়ে রাখে। নিয়মমাফিক দুই গ্লাস পানি খেয়ে বারান্দায় যায় সে। এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে ভাবনায় কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল, সে খেয়ালই ছিলো না তার। তারপর বারান্দায় যে কয়টা গাছপালা আছে,ইজোর সেগুলোর যত্নে নিজেকে মনোনিবেশ করে ।

লুডুঙ- আদিবাসী কুইয়ার ঝুলি,আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আদিবাসী লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষের লেখা নিয়ে বিশেষ সংকলন।

ইনজেব চাকমা: চাকমা সম্প্রদায়ের মা-বাবার ছয় সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান আমি। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় স্থায়ী নিবাস। চাকুরিসূত্রে চট্টগ্রাম শহরে থাকা হয়। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর থেকেই মূলত এই শহরে আছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীববিজ্ঞানের একটা শাখা নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছি। শিল্প-বিজ্ঞান-সাহিত্য হলো আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। আত্মনির্ভরশীলতা, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে চলা, ঘুরাঘুরি, বই সংগ্রহ ও পড়া, মানব হিতকর কাজে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করা, কাছের মানুষদের যথাসম্ভব সময় দেয়া হলো আমার জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা আদর্শ। শখের মধ্যে আছে ঘুরাঘুরি, ফটোগ্রাফি, লেখালেখি, বাগান করা, গান শোনা ইত্যাদি। তবে লেখালেখিটা সময় সুযোগে করার ইচ্ছা প্রবল হলেও আমি নিয়মিত না অর্থাৎ মৌসুমী লেখিয়ে। সমাজনির্ধারিত লিঙ্গানুসারে পুরুষ। যৌন অভিমুখিতায় সমকামী। মানব হিতকর সকল কর্মকাণ্ড এবং বৌদ্ধ ধর্ম যথাসাধ্য অনুসরণ করার চেষ্টা করি। মুক্তমনা।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.