
চিত্তি চাকমা
আমার বেড়ে ওঠা চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্ত পরিবারে। যেখানে বাবা-মা আর পরিবারের সকলকে নিয়ে আনন্দে দিন কেটে যেত। যেদিন থেকে বোধজ্ঞান উৎপন্ন হলো তখন থেকে বুঝতে পারলাম পরিবারের মাঝে যে টান, ভাইবোনদের প্রতি যে ভালোবাসা তা অতুলনীয়। যে যেমনই হোক তাকে সেভাবে মানিয়ে নেয় পরিবারের লোকজন। যদিও সমাজের কিছু লোক আছে যারা সারাক্ষণ অন্যের ব্যাপারে কটু কথা বলে তাদের থেকে একটু রেহাই পাওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। কিন্তু এতটাও কষ্টসাধ্য নয় তাদের এড়িয়ে চলার।
শৈশব পেরিয়ে কৈশোর পার করলাম তবুও দেখিনি পরিবারের মাঝে ছেলে মেয়ের মাঝে ভেদাভেদ করতে। কখনো কাউকে বলতে শুনিনি থাক তুমি মেয়ে এসব করতে পারবে না! হয়তো তার বিপরীতে গুটিকয়েক আছে। তাও অতি নগণ্য। দাদীর কাছে শুনতাম, তাদের আমলে তারা নাকি ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে একে অন্যের কাজে সহযোগিতা করতেন। এখনও সে প্রথা আছে তবে আগের তুলনায় একটু কমে গেছে।
কারোর সুখে-দুঃখে এগিয়ে আসতো আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা। পাড়ায় কেউ মারা গেলে তার পরিবারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতার জন্যে এগিয়ে যায় সবসময়। যে যেভাবে পারে সহযোগিতা করে। সেটা হোক আর্থিক কিংবা মানসিক। মা-বাবাকে কোনোদিনও দেখিনি এসবে বাঁধা দিতে। তারা সবসময় চাইতো এসবে এগিয়ে যেতে আর আমাদেরকে বাধ্য করতো এসব কাজে অংশ নিতে। ঠিক বাধ্য করা নয়। বুঝাতো এই বলে যে- তুমি যদি তাদেরকে সাহায্য কর তবে তোমার দুঃসময়েও তারা পাশে এসে দাঁড়াবে।
যেহেতু আমার বেড়ে ওঠা পাহাড়ে তাই আমাদের সংস্কৃতির কথা না বললে নয়। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি যে বাঙালিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এটা কারো অজানা নয়। তার সাথে ভাষায় রয়েছে বৈচিত্রতা। চাকমাদের বর্ণমালার নাম ওঝাপাত। দাদী বলতেন আগে নাকি এই ওঝাপাতটা ছিলো তাদের হাতেখড়ি। কেউ লেখাপড়া করুক আর না করুক এই ওঝাপাতটা ছিলো তাদের শিক্ষার হাতিয়ার।
নমনসুখ!
নামের সাথে সুখ যুক্ত আছে বলে এটা সুখের একটা নাম হবে এমন মনে করাটা ভুল হবে। সম্ভবত নপুংসক শব্দ থেকে এই নমনসুখ শব্দটা এসেছে। নমনসুখ শব্দটা হিজড়া এর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আমাদের সমাজে ইন্টারসেক্স বা আন্তলিঙ্গ যারা তাদেরকে হিজড়া বা নমনসুখ মনে করে থাকে। তবে ট্রান্সওম্যান যারা একদম শরীরকে তোয়াক্কা না করে মনকে ধারণ করে চলাফেরা করে, পোশাক পরিধান করে তাদেরকেও ওই নামে অভিহিত করা হয়।
আমার বাড়ির পাশেই এমন একজনের বাড়ি। আমি তাকে কাকা বলে ডাকি। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখতাম তার হাঁটার ধরন, কথা বলার ভঙ্গিমা একটু আলাদা। তাকে অন্যসব ছেলে মেয়েদের মতো সম্মান দিয়ে চলে সবাই। এমনকি সে একজন সফল টিউটরও। অসাধারণ পড়ানোর ধরণ তার। আমার দিদির শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিলো উনার হাত ধরে। সমাজ তাকে কোনোদিন খারাপ চোখে দেখেনি বা সমাজচ্যুত করেনি। আমাদের সমাজে এভাবে কেউ জন্ম নিলে বোঝা না ভেবে ছেলে-মেয়েদের মতো সমান অধিকার দিয়ে বড় করে। কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত করে রাখে না। উনাকেও ঠিক সেভাবে শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন উনার মা। পরিবার কোনোদিনও তাকে বোঝা হিসেবে ভাবেনি। বরং উনার মা উনাকে নিয়ে খুব গর্ব করে বলেন- আমার ছেলে “পরান্যে”(আদুরে ডাক) ভালো একজন শিক্ষক। তার মতন ছেলে হয়না। আমার আর পরিবারের প্রতি তার কি দায়িত্ব… ইত্যাদি।
ছোটবেলায় কৌতূহল বশত কাকাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- কাকা, আপনি এভাবে কথা বলেন কেন? উনি ইতস্তত হয়ে বললেন, সে তুমি বুঝবে না ভেইপুত(ভাইপো)। বড় হলে হয়তো বুঝতে পারবা। আমি এখন বুঝতে পারি উনার কথার মর্মার্থ। উনার হয়তো অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করতো কিন্তু চক্ষু লজ্জার ভয়ে কিছুই করে উঠতে পারেননি। হয়তো উনার ভিতরটা কত হাহাকার করে উঠতো!
শিক্ষকতা ছাড়াও কাকার আরেকটা বড় গুণ হলো তার গানের গলা। খুব সুন্দর করে মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পিনোন-হাদি পরে নেচে নেচে গান করতে পারতেন তিনি। এজন্য পাড়ায় কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে তাকে বিশেষ একজন হিসেবে ডাকা হতো। ছোটবেলায় আমি উনার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম আর ভাবতাম কি অসাধারণ তার প্রতিভা। নেচে গাওয়ার সময় পিনোন-হাদি পরতে পারার মাঝে আনন্দ খুঁজে পান বলেই হয়তো অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যান উনি। তখন হয়তো খুঁজে পান নিজের সত্তার পূর্ণতা।
সেদিনও আমাদের বাড়ির উঠোনের এক অনুষ্ঠানে গান করেছিলেন কাকা। আমার খালার অনুরোধে তাকে ডাকা হয়েছিলো গান গাওয়ার জন্যে। মা নিজের পিনোন-হাদি বের করে দিয়ে তার হাতে দিলো।
মা আদর করে তাকে ডাকতো নুদিবানা। কোন ছেলে একটু সাজগোজ বা পরিপাটি করে থাকলে তাদেরকে নুদিবানা আর মেয়েদের বলা হয় নুদিবানি। কাকার সাজগোজ তো বলার বাইরে। প্রায় সময়ই লুঙ্গি পড়ে থাকতেন। লুঙ্গিটা এমনভাবে পড়তেন যাতে কোথাও উঁচু নিচু না হয় বা কোথাও যাতে ভাজ না পড়ে। এছাড়াও বাড়ির চারপাশটা ফুলের বাগানে ভরা। ঘর একদম পরিপাটি করে সাজানো, বাড়ির দেওয়ালে নকশা আঁকানো। সত্যি অনেক পরিপাটি এবং প্রতিভাবান কাকা।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে কাকার বড়বোন অন্ধ। বাবাও নেই। ছোটবোনকে বিয়ে দেয়ার পর অন্ধ বোন ও বৃদ্ধা মা কে নিয়ে সংসার তাদের। তাই মা এবং প্রতিবেশীদের পীড়াপীড়িতে না চাইতেও মাঝবয়সে গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিলো। বিয়ের সপ্তাহ খানেক আগে আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমার মাকে বলতেন- বুজি, মর হি অব হিজেনি। মোক লোবার ন’চাং তুও লোই পাংঅর(ভাবী, আমার কি হবে জানিনা। বিয়ে করতে চাই না, তবুও করতে হচ্ছে)
তখন তো বুঝতাম না তবে এখন বুঝতে পারি কেন উনি এভাবে বলেছিলেন। আমাদের সমাজে হিজড়া, গে, লেসবিয়ান, ট্রান্সজেন্ডার এসব বিষয় এখনো অজানা। এখনকার পড়ুয়ারা সমকামী/গে ব্যাপারটা একটু-আধটু জানলেও ভাল করে বুঝে না।আমি যদি বাড়িতে নিজেকে গে হিসেবে পরিচয় দিই মা-বাবা কোনোদিনও বুঝে উঠতে পারবে না। আর ব্যাপারটা ভেঙ্গে বললে অবাক হবে যে, এরকম একটা ব্যাপার আছে এবং থাকতে পারে এটা ভেবে।
যাইহোক, কাকার জন্য দুঃখ হয়, না চাইতেও বিয়ে করতে হয়েছিল বলে। পরিবার-সমাজ হয়তো ওর চালচলন দেখে তিরস্কার করে বের করে দেয়নি। তবে তার অন্তরের আর্তনাদ কাকা এবং আমি ও আমার মতো মানুষেরা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। সকল মানুষ সমানে এগিয়ে চলুক কোনো ভেদাভেদ না করে। গড়ে উঠুক সুষ্ঠু সমাজ আর বদলে যাক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। নমনসুখ শব্দটা যেন একটি সুখের নাম হয়ে ওঠে।
লুডুঙ- আদিবাসী কুইয়ার ঝুলি,আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আদিবাসী লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষের লেখা নিয়ে বিশেষ সংকলন।
চিত্তি চাকমা: ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা খাগড়াছড়ি জেলাধীন দীঘিনালা উপজেলায়। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিষয় নিয়ে স্নাতকে অধ্যয়নরত। ভিনদেশে পাড়ি জমিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পুরো বিশ্ব ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রবল। নিজেকে গে হিসেবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
🖤🖤