
Green_Bug
ভালোবাসা কাকে বলে? আসলে এর সংজ্ঞাটাই বা কি? হয়তো এর কোন সার্বজনীন উত্তর নেই। একেকজনের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর একেকরকম। তবে অধিকাংশ মানুষই হয়তো বলবে ভালোবাসার জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা সহ্য করা কোন কষ্টের বিষয় না। ভালোবাসার মানুষের হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকালে হয়তো সেই ত্যাগগুলোকে নিয়ে হতাশা আর আক্ষেপের জায়গায় মনে আনন্দই বরং কাজ করে। মস্তিষ্কের মধ্যে ডোপামিন আর সেরেটোনিন মিলে তখন অক্সিটোসিন তৈরি করার আদর্শ পরিবেশ খুঁজে পায়। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের জন্য কে কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে রাজী হবেন? কতটুকু পথ পাড়ি দেয়ার ক্ষমতা রাখেন?
আমার নানা, নিজের আদরের আত্মজাকে তার সমাজের সামনে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি মানুষ মরে গেলে চাকমা রীতিতে মৃত মানুষের জন্য যে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান করা হয়, আমার নানা তার মেয়ের জন্য সেই শ্রাদ্ধও পর্যন্ত করেছেন। ভালোবাসার জন্য আমার মা নিজের চিরচেনা পরিবার আর পরিবেশ ছেড়ে চলে এসেছিলেন, আর আমার নানা তার নিজের ভালোবাসার একমাত্র মেয়েকে সমাজের কাছে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন।
আমার জন্ম এক সাদামাটা বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারে। জন্মের পরে নিজেকে মুসলমান বলেই চিনেছি। বাঙালি আর মুসলিম রীতিনীতিকেই নিজের সংস্কৃতি বলে চিনেছি। আমার বাবা-মার দুই পরিবারের দ্বিমতে ভালোবাসার বিয়ে। আমার বাবার পরিবার বাঙালি মুসলমান হলেও আমার মা এসেছেন দেশের আদিবাসী গোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায় থেকে। বিয়ের আগে উনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ভালোবাসার মানুষকে সারাজীবনের জন্য কাছে পাবার আশায় আমার মা নিজের পরিবার, নিজের চেনাজানা পরিবেশ, নিজের সংস্কৃতিকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন। বিয়ের ব্যাপারটা পরবর্তীতে আমার বাবার পরিবার মেনে নিয়ে আমার মাকে গ্রহণ করে নিলেও আমার মা’র পরিবার আবার কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। আমার নানা, নিজের আদরের আত্মজাকে তার সমাজের সামনে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি মানুষ মরে গেলে চাকমা রীতিতে মৃত মানুষের জন্য যে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান করা হয়, আমার নানা তার মেয়ের জন্য সেই শ্রাদ্ধও পর্যন্ত করেছেন। ভালোবাসার জন্য আমার মা নিজের চিরচেনা পরিবার আর পরিবেশ ছেড়ে চলে এসেছিলেন, আর আমার নানা তার নিজের ভালোবাসার একমাত্র মেয়েকে সমাজের কাছে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন। কেউই কারো কাছে মাথা নত করতে রাজি হননি। আমার মা তো শুধু তার পছন্দের মানুষের সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলেন। কোন অন্যায় তো করেননি, কারো কোন ক্ষতি করে বসেননি, কোন খুন করেননি, কোন অপরাধ করেননি। শুধুমাত্র আমার নানার অবাধ্য হয়েছিলেন বলেই উনি উনার বাবার ভালোবাসা হারিয়েছিলেন। তাহলে কি ভালোবাসার সংজ্ঞা এটাই- কোন মানুষ যখন আমার মর্জিমত চলবে, তখনই আমি তাকে ভালোবাসব?
কিন্ত আমার দেখি মেয়েদের শরীরের প্রতি একেবারেই কোন আকর্ষণ কাজ করছেনা। পাশে বসে আমিও ওদের সাথে পর্ণ দেখছি, কিন্তু আমার নজর তো শুধু সেখানে পর্ণোছবির পুরুষটার দিকেই। তাদের লিঙ্গ, তাদের পেটানো শরীর, তাদের খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি মুখ দেখে আমার সারা শরীরে কেমন যেন এক অন্যরকম শিহরণ খেলে যায়। কিন্তু আমার ক্লাসমেটদের সামনে কখনো আমার এই আকর্ষণ প্রকাশ করার সাহস হয়নি। তারা নারীদেহের প্রতি আকৃষ্ট, আমিও তাদের সাথে সেই পালে মিশে যাওয়ার ভান ধরতাম।
চলে আসি সেই ঘটনা পেরিয়ে আরো এক দশকেরও পরে, আমার কৈশোর বয়সে। এডোলিসেন্ট পিরিয়ডের সময়। শরীরে তখন অনেক নতুন হরমোন বইছে যা আগে কখনো বয়নি। আমি তখন জিলা স্কুলের ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি। ক্লাসের ছেলেদের দেখতাম মেয়েদের গোপনাঙ্গের প্রতি কি এক নিষিদ্ধ নেশা। সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে পর্ণোছবি দেখার সময় মেয়ে মানুষের শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। মেয়েদের বক্ষ, যোনি, এগুলার রং, আকার এসব নিয়ে কত গবেষণা তাদের! কিন্ত আমার দেখি মেয়েদের শরীরের প্রতি একেবারেই কোন আকর্ষণ কাজ করছেনা। পাশে বসে আমিও ওদের সাথে পর্ণ দেখছি, কিন্তু আমার নজর তো শুধু সেখানে পর্ণোছবির পুরুষটার দিকেই। তাদের লিঙ্গ, তাদের পেটানো শরীর, তাদের খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি মুখ দেখে আমার সারা শরীরে কেমন যেন এক অন্যরকম শিহরণ খেলে যায়। কিন্তু আমার ক্লাসমেটদের সামনে কখনো আমার এই আকর্ষণ প্রকাশ করার সাহস হয়নি। তারা নারীদেহের প্রতি আকৃষ্ট, আমিও তাদের সাথে সেই পালে মিশে যাওয়ার ভান ধরতাম। সেই অল্প বয়সেই survive, through blending in এর আদিম সত্তা মনের অজান্তেই আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। তাই কারো সামনে নিজের আসল সত্তাকে আর প্রকাশ করা হয় নি।
বুঝতে পারলাম আমার মা’র বিয়ের সময় যা ঘটেছিল অনেকটা তারই পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। এবার আমি, আমার মা’র জায়গায় আর আমার মা ওনার বাবার জায়গায়।
চলে আসি আরো পনেরো বছর পরে। এই লেখাটা লেখার অনেকটা নিকট অতীতে। আমি, আমার বাবা-মা সবাই আমরা এখন বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকা প্রবাসী। যদিও আমার বাবা আমেরিকা থাকেন না, উনি বাংলাদেশ-আমেরিকা আসা যাওয়ার মধ্যেই থাকেন। আমার বয়স এখন ত্রিশের উপরে। দেশে পড়াশোনা শেষ করার পরে নিজের মোটামুটি পাঁচ বছরের যে ক্যারিয়ার ছিল, সেসব বিসর্জন দিয়ে নতুন দেশে আবার অনেকটা শূন্য থেকে শুরু করার চেষ্টা করছি। পিছনের সবকিছু ছেড়ে চলে আসার কারণ একটাই, এখানে হয়তো নিজের মত বেঁচে থাকার একটা সুযোগ পাব। দেশে যেমন বিয়ে না করলে আশেপাশের দশজনের কথা শুনতে হয়, এখানে তা শুনতে হবে না। হয়তো আমার মনের মানুষ পাওয়ার এবং তার সাথে বাকি জীবন একসাথে থাকার সম্ভাবনা বাংলাদেশের তুলনায় এখানে বেশি। তাই সব ছেড়ে চলে আসা। কাজ-পড়াশোনা এসব নিয়েই আসলে ব্যস্ত থাকি। এরমধ্যে এক বন্ধের দিনে হঠাৎ একদিন আমার মা হুট করে আমাকে ধরে কান্নাকাটি শুরু করলেন। তিনি দেশে থাকতেই বুঝে গিয়েছিলেন যে আমি সমকামী। তিনি আমার এই সত্তাকে কোনভাবেই মেনে নিতে রাজি না। উনার মতে সমকামিতা একেবারেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ একটা কাজ। শুধু এই সমকামিতার জন্যই মানব সমাজে যত যৌনরোগ ছড়িয়েছে বলেও ওনার বিশ্বাস। আমার কাছে মিনতি করছেন আমি যেন এসব ছেড়ে দিই। এখন না হোক ভবিষ্যতে যেন বিপরীত লিঙ্গের কাউকেই আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে মেনে নিই। আমি তো থতমত খেয়ে গেলাম, হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতিতে পড়বো, তা তো আশা করি নি। বুঝতে পারলাম আমার মা’র বিয়ের সময় যা ঘটেছিল অনেকটা তারই পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। এবার আমি, আমার মা’র জায়গায় আর আমার মা ওনার বাবার জায়গায়। যদিও আমার জীবনে এই মূহুর্তে সেই রকম ভালোবাসার মানুষ কেউ নেই, কিন্তু তাই বলে আমি এমন একজন মানুষের সাথে সারাজীবন ঘর করবো যাকে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে কখনোই ভালোবাসতে পারবোনা এটা আমি চিন্তাই করতে পারি না। কৌশলে আমি খালি আমার মাকে বললাম, আমি এমনই কিন্তু আপাতত আমি নতুন দেশে আমার ভিত্তি গড়া নিয়ে ব্যস্ত। কোনরকম প্রেম বা যৌনজীবন বলে আমার এই মুহূর্তে কিছুই নেই। তাই তোমার চিন্তা করার কোন দরকার নেই। কিন্তু মনে মনে আমিও চিন্তা করছি সময় কি তাহলে চলে এসেছে? কোনদিন যদি জীবনে কেউ চলে আসে তাহলে কি তার হাত ধরে আমি যদি পাড়ি দিতে চাই, আমার বাবা-মা কি তাহলে আমাকে মৃত ধরে নিবেন? শুধুমাত্র আমি তাদের মেজাজ-মর্জি মতে চলিনি বলেই কি আমাকে সেই একই রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে? এই কি তাহলে ভালোবাসা? কারো মেজাজ-মর্জি মত নিজের জীবনযাপন করা?
যখন থেকে আমার বোধোদয় হওয়া শুরু হয়েছিল তখন থেকেই কেন যেন ছোট বাচ্চাদের প্রতি আমার এক অসীম মায়া-মমতা ছিল। কেন যেন অল্প বয়স থেকেই স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমার একটা সংসার হবে, একটা স্বামী, দুটো অথবা তিনটা বাচ্চা থাকবে। দুই টোনা আর তাদের ছানাপোনার এক মিষ্টি সংসার। বয়স হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রেমিক/স্বামী পাওয়ার আশা ছেড়ে দিলেও নিজের একটা সন্তান পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে আমি কেন যেন একেবারেই নারাজ। অন্তত একটা হলেও আমার সন্তান থাকবে। যার ফোকলা দাঁতের হাসি দেখে আমি আমার সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে যাব। যার চোখে আমিই তার একমাত্র পৃথিবী এমন একটা অনুভূতি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা আমি কেন যেন ভাবতেই পারি না। আমার এই চাওয়া পুরোটা না হলেও, অনেকটাই পূরণ করে দিয়েছে আমার ভাগ্নে নিভান। একেবারে সহজ-সরল একটা ছেলে, বয়স এখন তার মোটে সাত বছর। আমেরিকার আরেক শহরেই আমার ফুপাতো বোনের সংসার, মাঝেমধ্যে আমাদের শহরে বেড়াতে আসে। আমরাও তাদের শহরে বেড়াতে যাই। ওরা আসার কথা শুনলে আমি খালি নিভানকে কখন আমার কোলে তুলে নিতে পারব সেই আশায় থাকি। আমাদের ওদের শহরে যাওয়ার কথা শুনলে নিভানও নাকি তার মামার দেখা পাওয়ার আশায় পথ চেয়ে থাকে। দেখা হলে সারাক্ষণ আমার সাথে একেবারে আঠার মতো লেগে থাকার স্বভাব ছেলেটার। কিন্তু চিন্তা করি এই ছেলেটাও তো একদিন বড় হবে। তখন যদি সে এমন কিছু করে যেটা আমার পছন্দ না কিন্তু আসলে কোনরকম অন্যায়ও না, তখন কি আমিও তাকে ভালোবাসা বন্ধ করে দিব? আমার পছন্দের বাইরে গিয়ে কারো কোন ক্ষতি না করে সে তার জীবনযাপন করছে বলে আমিও কি আমার পূর্বপুরুষদের পথ অনুসরণ করব? আমার পছন্দমত চলবেনা বলেই এতদিনের ভালোবাসার মানুষটাকে আমি আমার থেকে আলাদা করে দিব?

বাবা হওয়ার স্বপ্ন সব সময় দেখে থাকলেও আজকাল তাই ভয় হয়। আমার পূর্বপুরুষদের জেদের গুণ (নাকি দোষ) আমার মধ্যেও যদি প্রবাহিত হয়ে থাকে? আমার নানা তার মেয়ের নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে বিবাহ মেনে নিতে পারে নি। আমার মা-বাবা, আমার সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মেনে নিতে রাজি না। আমিও যদি পরবর্তীতে আমার ভবিষ্যৎ সন্তানের এমন কোন বৈশিষ্ট্য অথবা জীবনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নারাজ হয়ে তাকে আমার ভালোবাসা থেকে আলাদা করে দিই? তাহলে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা আসলে কি?
My name is Green_Bug, just an adventurer who likes to roam around the Earth and take pictures. Writing has never been my thing but tried to share something with you guys all, hope you guys will be all considerate while reading the piece and forgive any mistakes.