স্টোনওয়ালের আগে কী হয়েছিল?

রুদ্রনীল আসলান

সেই ষাটের দশকের কথা বলছি, যখন  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ মদের চোরা-চালানের অজুহাত দেখিয়ে,মার্কিন পুলিশদের বিভিন্ন ক্যুইয়ার  বারগুলোয় অভিযান চালানো একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমরা এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন সে দেশের প্রচলিত  আইন মার্কিন শাসকদের তখনও মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই সমকামীতা তখনও আইনত নিষিদ্ধ এবং রাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র ও আইন “জুডেও-খ্রিষ্টান” নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত। এমনই এক সময় সেই ষাটের দশক,  যখন সবে মাত্র আমেরিকায় সামাজিক সংস্কার মূলক আন্দোলন সবে কুঁড়ি মেলতে  শুরু করেছে। নাগরিক অধিকার আন্দোলন চলছে, E.R.A  ( Equal Rights Amendment ) এর হাওয়া এসে লেগেছে। দ্বিতীয় ফেমিনিস্ট ওয়েভের প্রস্তুতিও  চলছে।

তবুও এতো রদবরল আসার পরও ক্যুইয়ার কম্যুনিটি ( LGBTQ+ Community)  নিয়ে তখনও কোনরকম কথা নেই। এ যেন এক অকথ্য ব্যাপার-স্যাপার ! আমেরিকার  প্রায় সব অঙ্গরাজ্যগুলোয় “সমকামী ও রূপান্তরকামীদের” মানসিক ভাবে অসুস্থ  হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং নানা রকম বিদ্বেষমূলক আইন প্রণয়ন করা হতো। তবে এতো ঘৃণা, তুচ্ছতাচ্ছিল্যের পরও একটি বিদ্রোহ জেগে ওঠে,ধীরে ধীরে তা আরও বেগবান  হয়। তবে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গটা ছিলো খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত । 

সময়টা ২৮শে জুন ১৯৬৯,গ্রিনউইচ গ্রাম, নিউ ইয়ার্ক

মধ্যরাতে স্টোনওয়াল ইন নামের একটি সমকামী কেন্দ্রিক বারে পুলিশ হানা দেয়। সেখানকার বহু কর্মচারী আর কাস্টমারদের তারা সেদিন  আটক করেন। কিন্তু হঠাৎ বারটির আশেপাশের মানুষদের মধ্যে খবর ছড়িয়ে যায় যে, পুলিশ বারটিতে  অভিযান চালাচ্ছে।  কৌতূহলী  মানুষেরা বারটি ঘিরে ধরেন। যখন পুলিশ আটককৃত ব্যাক্তিদের বের করে আনছিলেন , তখন জনতা ক্ষিপ্ত  হয়ে ওঠেন। তারা ক্রমশ চিৎকার করা শুরু করেন এবং বন্দীদের মুক্তির দাবী জানান। এক পর্যায়ে তারা পুলিশদের আক্রমণ করে বসেন। বার থেকে বের হবার রাস্তাটি বেশ সংকীর্ণ হবার কারণে পুলিশরআ পরেন বিপাকে। স্থানীয় থানা থেকে আরও  পুলিশ আসার পরেও কায়দা করতে ব্যর্থ হয়। বারের ভিতরে থাকা মানুষেরা মদের বোতলে আগুন জ্বালিয়ে ছুড়ে মারতে থাকেন। এক নিশ্চুপ-নিভৃত, বলা যেতে পারে অজপাড়াগাঁ “গ্রিনওয়িচ”, সেই রাত ও তার বাকি ছয়দিনে যে একটি ইতিহাস রচনা করবে, তা কোন ব্যক্তি ইতোপূর্বে ধারনাও করতে পারেন নি। 

এমনই কথা শোনা যায় “স্টোনওয়াল রাইওট”  বা “স্টোনওয়াল” ( Stonewall Riots)   অভ্যুত্থান নিয়ে। প্রায় আধুনিক সময়ের কাছাকাছি  হলেও, এই সংস্কার পন্থী দাঙ্গার তেমন  উল্লেখযোগ্য  কোন রকম ছবি নেই! নেই কোন বিশ্বস্ত প্রামাণ্যচিত্র বা দলিল। পরবর্তী সময় হতে আজ অবধি, যা কিছু জানা গিয়েছে তা সবই প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যহতে। এমনকি সেই বিখ্যাত ঘটনা যেখানে “মার্শা পি জনসন” একটি ইট পুলিশের গাড়িতে ছুড়ে মেরেছিলেন, তাও বিতর্কিত। তাই বলে থেমে থাকেনি এই দাঙ্গার আগুন। পুরো পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পরে এর প্রভাব। A Queer History of the United States-এর লেখক “মাইকেল ব্রোনস্কি” বলেন, “আমার মনে হয়  কে কি কখন করেছিল, সেটা জরুরী নয়। জরুরী হলো এর চূড়ান্ত রাজনৈতিক প্রভাব।”  

তবে স্টোনওয়াল হওয়ার আগেও ক্যুইয়ার অধিকারের পক্ষে একাধিক  আন্দোলন হয়েছিল। অনেক জ্বালাও-পোড়াও হয়েছিল,মানুষজন রাস্তায়ও নেমেছিলেন। এই যেমন, ১৯৬৬ সালে স্যাল ফ্র্যান্সিসকোর ক্যাম্পটন ক্যাফেটেরিয়াতে ক্যুইয়ার  সদস্যরা পুলিশের অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেন। তবে এ আন্দোলনটি স্টোনওয়ালের থেকে একদিক দিয়ে  ভিন্ন। তা হলো, ঐ শহরের ক্যুইয়ার  সংস্থাগুলো “উগ্রতাবাদী” বলে সেই প্রতিবাদে অনেকেই  নিজেদের জড়াতে চান নি। আবার ষাট-পূর্ব ক্যুইয়ার  আন্দোলনও অনেক প্রকট ছিলো। কিন্তু তাদের ইতিহাস মুছে ফেলা হয়েছে  কারণ সে সময়ের ক্যুইয়ার অধিকার কর্মীরা বামপন্থী রাজনীতির  সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। 

১৯৩২ সালে, বাম সাংবাদিক জন পিটম্যান তার রেডিক্যাল পত্রিকা, দ্য স্পোকসম্যান-এ “প্রেজুডিস এগেইনস্ট হোমোসেক্সুয়াল” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ ছাপান। তিনি সেখানে লেখেন, “নিগ্রো এবং সমকামীরা উভয়ই একটি মৌলিক জিনিস আশা করেন। তা হলো: অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে অন্য সবার মত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা।…” পিটম্যানের মতে সমকামী নারী-পুরুষদের প্রতি নানা রকম বিদ্বেষ, সামাজিক সুবিচার ও ন্যায়-অন্যায় বোধের পরিপন্থী । কিন্তু প্রশ্ন থাকে যে, কেমন করে বামপন্থী রাজনীতি  সমকামীদের সাথে  বা সমকামী অধিকার আন্দোলনে  যুক্ত হলো? 

এর একটা কারণ হতে পারে যে, আমেরিকান বামেরা নিজেদেরকে এমন একটি শহরে নিজেদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবার জন্য নিরাপদ মনে করতেন  যেখানে সমকামীরাও নির্বিঘ্নে  ঘুরে বেড়াতেন, বসবাসও করতেন । “পেরশিং স্কয়ার” এমনই এক জায়গা, যেখানে মানুষেরা যেতেন, নানা রকম মুক্ত আলাপ আলোচনা করার জন্য।অর্থাৎ সেসময়  এই স্থানটি লিবারিজমের চর্চায় আতুড়ঘরে পরিণত হয়।বিভিন্ন সময় এই জায়গাটি আবার গে-লেসবিয়ানদের আশ্রয় নেবার জন্যও বিখ্যাত ছিলো।পরবর্তীতে বামপন্থী জনগণ এবং ক্যুইয়ারদের এই সম্পৃক্ততা এতোটাই দৃঢ় হয়ে ওঠে যে, তাদের কাছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর বৈচিত্র‍্যময় লিঙ্গ পরিচয়ের অধিকারকে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলেই গণ্য করা হত। বেটি মিলার্ড, একজন কম্যুনিস্ট লেখিকা, তার প্রগতিবাদ এবং বৈচিত্র‍্যময় লিঙ্গ পরিচয়ের অধিকারের প্রতি অনুরাগ বুঝাতে তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, “সমাজতন্ত্র এবং সেক্স এই দুটোই আমি শুধু চাই।” যদিও সেক্স বলতে মিলার্ড কি বুঝিয়েছিলেন সেটি স্পষ্ট নয়। তবে বোঝা যায় যে প্রাক-স্টোনওয়াল সময়ে ক্যুইয়ার এক্টিভিটসদের মনে বিপ্লব আর লিঙ্গ বৈচিত্র্যতার মুক্তির ধারণা কতখানি মিলেমিশে  ছিলো। 

কিন্তু এই জোঁট পরবর্তীতে স্থায়ী হয় নি। আমেরিকায় কোল্ড ওয়ারের দরুণ এক আশু কম্যুনিস্ট বিপ্লবের ভয়, রেড স্কেয়ার জনতার মনে ছিল। বিভিন্ন সমকামবিদ্বেষী ও এন্টি-কম্যুনিস্ট কনজারভেটিভ বারেবারে কম্যুনিজম আর সমকামীদের ঐক্যতা দেখিয়ে তাদেরকে জনগনের মনে আরো বিষিয়ে  তোলার চেষ্টা করেছিলো। রেড স্কেয়ারের মত চলে আসে লেভেন্ডার স্কেয়ার। পঞ্চাশ শতকে যৌন ও লিঙ্গ বৈচিত্রময় ব্যাক্তিদের “চরিত্রহীন” এবং “কম্যুনিস্টের মত বিপজ্জনক” ইত্যাদি নানান হাস্যকর অজুহাত দিয়ে সরকারী চাকরী থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়।  এমতাবস্থায় নিজেদের রাষ্ট্রীয়শত্রু হিসেবে না দেখানোর জন্য ক্যুইয়ার সমাজকর্মীরা নিজেদের ধীরে ধীরে বামপন্থী সহকর্মীদের থেকে সরিয়ে নিতে থাকেন । পাশাপাশি তারা তাদের সংগঠন থেকে উগ্র রেডিক্যাল সদস্যদেরও সরিয়ে ফেলতে থাকেন  এবং আমেরিকান সংস্কৃতির ধারাবাহিক জীবনের সাথে যোগসূত্র তৈরি করতে মনোযোগী হন। তবে স্টোনওয়াল তার পরবর্তী যৌনবৈচিত্র্যতার আন্দোলনে,  আগের সেই ফেলে দেওয়া রেডিক্যাল শক্তি বেশ তীব্রভাবেই অনুভূত করেছিল বলেই মন হয়।

 এইসব সংগঠনগুলো আমেরিকার সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য, লেকলাইডারের মতে, “নিজেদের রেডিক্যাল গোড়া থেকে সরিয়ে তীব্রভাবে হেটেরোনর্মাটিভিটি আর শ্বেতশ্রেষ্ঠত্ব-এ বিলিয়ে দেয়।” যার প্রভাব আমরা আজকের সময়েও দেখতে পারি।

আমাদের ক্যুইয়ার  আন্দোলনের ধারনা স্টোনওয়াল অভ্যুত্থানকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ। এর এক অন্যতম কারণ অবশ্য পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ফুলেফেঁপে ওঠা ম্যাকার্থিজমের ভয়াল থাবা, যা আমেরিকান রাজনীতির পটভূমি বদলিয়ে দেয়,রচিত হতে থাকে আমেরিকার নতুন ইতিহাস। যাতে তারা ঠিক করে দেন, কোন ঘটনা বলা হবে আর কোনটা ভুলে যাওয়া হবে, কাকে মনে রাখা হবে আর কাকে নয়!

যদিও স্টোনওয়াল আধুনিক ক্যুইয়ার আন্দোলনের মূলভিত্তি এবং গে লিবারেশন ফ্রন্ট গড়ার অনুপ্রেরণা। তবু আমাদের মনে রাখতে হবে স্টোনওয়ালের আগেও ক্যুইয়ার  সদস্যরা ছিলেন এবং তারা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আদায়ের জন্য নিজ নিজ অবস্থানে সংগ্রাম করে গেছেন। আমেরিকার ক্যুইয়ার  কম্যুনিটি যদিও নিজেদের রেডিক্যাল  তকমা থেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু স্টোনওয়াল-পরবর্তী সময়ের আন্দোলন ফের রেডিক্যালিজমের দিকেই ঝুঁকে পড়ে।

তথ্যসূত্রঃ

1. Lecklider, A. (2021, June 9). Perspective | the push for lgbtq equality began long before stonewall. The Washington Post. https://www.washingtonpost.com/outlook/2021/06/10/push-lgbtq-equality-began-long-before-stonewall/. 

2. Stern, S. W. (2021, May 6). Despite everything, queer leftists survived. Jacobin. https://www.jacobinmag.com/2021/06/aaron-lecklider-love-next-meeting-review.

রুদ্রনীল আসলান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত একজন বাইসেক্সুয়াল হাইস্কুলার।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.