বুনো গোলাপের বিলাপ

মন্দ্রসপ্তক

চারিদিকে যখন অন্যায়-অবিচার,শোষণ-উৎপীড়নের প্রতিযোগিতা, তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যায় বিচার প্রাপ্তির একেকটা খবর যে কী অসীম শক্তি ধারন করে, তা হয়ত কিছু কথায় লিখে বুঝানো দায়। ঝড়ের মত উলটে-পালটে দেয় চিন্তার তরণী। যেন এক অচেনা বাতায়ন খুলে চোখের সামনে উম্নুক্ত হয় চেনা পৃথিবীর প্রিয়-অপ্রিয় মূহুর্তগুলো। টাইম-ট্রাভেল হয়ত এভাবেই করি আমরা। হয়ত কেউ কেউ কখনই করে না। আর কেউ কেউ হয়তো প্রতিনিয়ত। এখনো কলাবাগানের সামনে দিয়ে যাবার সময় কিংবা পান্থপথের বউ বাজারের গলি থেকে বিপরীতে চলে যাওয়া গলিটাকে বড় আপন বলেই মনে হয়। মনে হয়, ঐ তো, ওখানেই আছে আমার  প্রিয় বন্ধু! অনেক অনেক দিন পর তার সাথে আবার দেখা হবে, কথা হবে, মান-অভিমান হবে! আর ফেরার সময় হয়ত বলবে,”বাসায় ফিরে কল করবে । কিন্তু ইদানীং কম কেন আসছ, বলত?”

জুলহাজ-তনয়ের হত্যা মামলার রায়ের খবরটা পড়ে এক লহমায় একটা টাইম-ট্রাভেল করে ফেললাম। সব সময়ের মত গলা বুজে এলো, চোখদুটো কেমন ঝাপ্সা হয়ে গেল। কেমন একটা বিবশ করা অনুভূতি,সারা শরীর জুড়ে। তবে এসব কোনো ভয় কিংবা ঘৃণা থেকে নয়; নয় কোন অজানা আশঙ্কা থেকে।  নিজেকে নির্লিপ্ত বলেই মনে হয়। 

আজকের এই খবরের শিরোনামে আমার নামও থাকতে পারতো। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য আমি সেদিন ওর দেখা পাইনি। আমাদের একই সাথে ঐদিন কলাবাগান যাবার  কথা ছিল। কনফার্ম করার জন্য তাকে কল করলে  সে বলল, “বাসায় কিছু মানুষ এসে অপেক্ষা করবে, আমি বিকেল  ৪ টায় বেরিয়ে যাচ্ছি”। আমি বললাম, “আচ্ছা তাহলে আমি অফিস শেষে রওনা দিচ্ছি।সন্ধ্যায়  দেখা হচ্ছে।” ঘণ্টা খানেক পর সেই নাম্বার থেকে একটি কল এলো। আমি ফোনটা পেয়ে একদম হতভম্ব হয়ে  দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম, না, একটু আগেই তো আমাদের  কথা  হল। কথা বলতে বলতেই ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললাম। এপ্রিলের ভ্যাপসা গরমে সেদিন একটু বেশিই ঘামছিলাম। গাড়ির ভেতর এসি চলছে, তবুও আমি  ঘামেই চলছি।আমার নিজেকে মনে হচ্ছিল একটা গ্লাসের ভেতর আটকে থাকা মাছি মত। অনেক চেষ্টা করছি বেরিয়ে যেতে, কিন্তু পারছিলাম না!গাড়ির সিট টা যেন ব্ল্যাক হোলের মত আমাকে শুষে নিচ্ছে। আমি দুই হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। ঝরঝর করে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, আমার ড্রাইভার আড়চোখে আমাকে দেখে বললেন, “স্যার, আপনার কেউ কি মারা গেছেন?”  উত্তর না দিয়ে  বললাম, “দয়াকরে,একটু তারাতাড়ি চালান।”

আসলেই কি ও মারা গেছে? ফোনে যা শুনলাম তা কি ঠিক? 

বউ বাজারের বিপরীতে থাকা গলিটাতে সেদিন এতো মানুষের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমে আমার আর পা চলে না। তারপরের মুহুর্তগুলো কেমন যেন ভূতুড়ে বলে মনে হচ্ছিল। শুধু মনে পড়ছিল,আমার বন্ধুর আহাজারি। যেন একটা পাখি ডানা ঝাঁপটে আকুতি করছে! পাখিটার সেই আকুতি আজো ফুরায়নি। শুকায়নি আমাদের কারোর চোখের জল। যে বুলবুলি নীরব হয়ে গেছে, ঝরা বুনো গোলাপের বিলাপ কি সে শুনতে পাচ্ছে?  তা আমার জানা নেই। 

আমরা এমন একটা উত্তঙ্গ সময়ের অভিযাত্রী যেখানে মিথ্যা, লালসা, হঠকারিতা কোভিডের চাইতেও দীর্ঘসময় ধরে আমাদের তিলে তিলে মারছে। কিন্তু এই ভাইরাসের আক্রমণ এতটাই ব্যাপৃত যে টিকে থাকার লড়াইটা জমবি (Zombie) বনাম স্বাভাবিকের। রাষ্ট্রীয় মদদে যে দেশ এখন ল্যান্ড অফ দ্যা ওয়াকিং ডেড এ পরিণত হয়েছে তার ন্যারাটিভে সততা খুঁজতে গেলে যা মিলবে তা হল আরও দুর্বোধ্য প্রপঞ্চের পাঁচালী। বৈশ্বিক রাজনীতির দাবায় এখানে মূহুর্মূহু বদল হয় রাজা, রানী আর বিশপ! আর যারা সামান্য সৈন্য, তারা তো বধের জন্য ব্যাধের শরের নিশানায় সদাপ্রস্তুত। কি এক আদিম ঘোর তাদের চোখে মুখে। তথাকথিত দিকভ্রান্তদের বিনাশ নিশ্চিত করতে এসব সৈন্যের দিকবিদিক পদচারণা থেমে যাবে না। দিনে দিনে তারা সংখ্যায় বাড়বে, অন্ধবিশ্বাসের বলে বলীয়ান হবে। আমরা হারাবো বন্ধু, আপনজন, অধিকারের লড়াইয়ের উচ্চকণ্ঠ কমরেডদের। কারণ দাবার চালে আমরা এখনো দূর্বল, অপরিণত! 

তনয় আর জুলহাজকে হারিয়ে আমরা অনেককিছু হারালাম কিন্তু সবটুকু নয়। সাময়িকের জন্য সাকির পাত্র বেলফুলে ভরে উঠেছে; সকরুণ ভাঙ্গা চাঁদের ম্লান আলোতে আমরা ক্ষণিকের জন্য পথ হারিয়ে ফেললেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হইনি। সময়ের তাগিদে, চোখ মুছে আবার খুঁজতে নেমেছি রংধনুর দিশা। 

ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে অগ্রসরমান ঘাতক হায়েনার হাসি আমরা যেন ভুলে না যাই। আসুন, নিজেদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করে গড়ে তুলি। বাহুবলে হয়ত আমরা ওদের চেয়ে আজ পিছিয়ে, কিন্তু ধী-র বলে আমরা যেন ওদের চেয়ে অনেক বেশি আগুয়ান হই। যে ভালোবাসার অধিকার চাইতে গিয়ে ভাই,বন্ধু, স্ব-জন হারালাম, ঘাতকের ঘৃণার সামনে সেই ভালোবাসার শিখা অনির্বাণ যেন কোনদিন নিভে না যায়! এই প্রত্যাশায়! 

মন্দ্রসপ্তক একজন লেখক এবং প্রযুক্তিবিদ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.