স্মৃতির মণিকোঠায় জুলহাজ-তনয়

তন্ময় সরকার

দু’জন মহামানব এসেছিলেন, এইতো কয়েক বছর আগে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দের এই বাংলায়। তাদের আমরা জুলহাজ-তনয় নামে চিনি। তারা দিয়ে গেছেন তাদের প্রাণ; বাংলাদেশের অধিকার বঞ্চিত, দলিত, অবহেলিত প্রতিটি বৈচিত্র‍্যময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষ গুলোর জন্য। এই দু’জন শহীদের প্রতিদান হয়ত আমরা কখনোই পূরণ করে পারব না। হয়ত তাদের এই আত্মদান এ দেশের অধিকাংশ মানুষ কখনোই স্বীকৃতি দেবে না। তাদের জন্ম দিবস, প্রয়াণ দিবস হয়ত কখনো এদেশের সংবাদপত্র গুলোর মাথাব্যথার কোনো কারণ হবে না। তবে তাদের এমন নিঃস্বার্থ, মহান মৃত্যুর আর্তনাদের যে ধ্বনি সেদিন ঘাতক দল চার দেয়ালের মাঝেই রুদ্ধ করতে চেয়েছিল; আশা রাখি অদূর ভবিষ্যতে, সেই আর্তনাদের প্রতিধ্বনি একদিন শতকণ্ঠে আরও দৃঢ় ভাবে ধ্বনিত হবে এদেশের আকাশে,বাতাসে। 

সময়টা ২০১৬ সালের, ২৫ এপ্রিল। সকালটা শুরু হয়েছিল আর দশটা দিনের মতোই। কিন্তু শেষ হয় রক্ত, লাশ আর স্বজন হারানোর আর্তচিৎকারে। এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে এক অন্যতম কলঙ্কময় দিন। সেই দিন ক্যুইয়ার অধিকার কর্মী, “রূপবান” ম্যাগাজিনের প্রকাশক ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা জুলহাজ মান্নান এবং আরেক এলজিবিটি অধিকার কর্মী, রূপবানের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব তনয়কে একটি উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী “আনসার-আল-ইসলাম” এর কিছু সদস্য কুপিয়ে হত্যা করেন। 

কীভাবে জুলহাজ-তনয় কে হত্যা করা হয়েছিল তা এখন কম-বেশি আমরা সবাই জানি। কিন্তু যে বিষয়গুলো আমাদের সামনে পরিষ্কার নয়, তা হলো তাদেরকে হত্যার ঘটনা দেশের সাধারণ মানুষ কীভাবে নিয়েছিল? এই অমানবিক, ভয়ংকর ঘটনা তাদের কীভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল? জুলহাজ-তনয় যাদের অধিকার আদায়ের জন্য আ-মৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যাদের কল্যাণ ছিল তাদের ব্রত, সেই মানুষগুলো তাদের হত্যাকে কীভাবে নিয়ে ছিলেন? একজন সাধারণ  হিজরা কীভাবে নিয়েছিলেন? একজন রূপান্তরিত নারী বা পুরুষ কীভাবে নিয়েছিলেন? একজন সাধারণ ক্যুইয়ার সদস্যই বা কীভাবে নিয়েছিলেন? 

এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের এখনো অজানা। হয়ত কখন সে সুযোগটি আসবে অথবা কখনই আসবে না। তবে যথোপযুক্ত উত্তরটি পেতে হলে, ২৫শে এপ্রিলের ঘটনাকে কেবল এই দু’জন মানুষের আত্মদানের ঘটনাতে সীমাবদ্ধ করাটা মোটেই কোনো বুদ্ধি-দীপ্ত কাজ হবে না। কারণ পরক্ষ ভাবে সেদিনের হামলাটি হয়েছিল মূলত পুরো বাংলাদেশের সকল বৈচিত্র‍্যময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের জনগোষ্ঠীর উপরই। সুতরাং ২৫শে এপ্রিলে কেবল দু’জন মানুষের মৃত্যুই হয় নি, তাদের সাথে বাংলাদেশের পুরো ক্যুইয়ার কম্যুনিটির একটি প্রতীকী মৃত্যু সংঘটিত হয়েছিল। এই একটি সংবাদ আমাদের ক্যুইয়ার কম্যুনিটির মানুষদের জীবনের গতি প্রবাহ পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। 

এরপর আরও কয়েক জন হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন বলেও দাবী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে রূপবান সহ বিভিন্ন ক্যুইয়ার সংগঠন তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। কারণ যারা ক্যুইয়ার অধিকার কর্মী ছিলেন, প্রাণনাশের অজানা ভয়ে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকেন। তাদের নিজেদের ক্যুইয়ার পরিচয় ঢাকতে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, ফোন নাম্বার সহ সব কিছু বন্ধ করে দেন। এছাড়া নিরাপত্তার অভাবে আত্মগোপন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে দেশ ছাড়া হয়েছেন অনেকেই। আবার যারা দেশে ছিলেন, তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে গৃহবন্দী জীবন বেছে নেন। এক দীর্ঘ অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ ও সঙ্কা বোধ নেমে আসে এদেশের  পুরো ক্যুইয়ার কম্যুনিটির উপর। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, আমাদের অগ্রযাত্রায় ২৫শে এপ্রিলে কত বড় ধাক্কাটি এসেছিল! 

এক্ষেত্রে ২০১৭ সালে “BBC বাংলার” এক প্রতিবেদনে সাক্ষাৎকার দেয়া ক্যুইয়ার সংগঠন “Boys Of Bangladesh” (B.O.B) এর একজন সদস্য বলেছিলেন, “যদিও ঐ ঘটনার এক বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু ভয় আমাদের মধ্যে রয়েই গেছে।

যতটা না মৌলবাদী বা সরকারের কাছ থেকে হুমকি, তার চেয়েও বড় হচ্ছে ব্যক্তিগত, সামাজিক সমস্যাগুলো। যেমন অনেকের চাকরী চলে গেছে বা বাসায় জেনে যাওয়ার কারণে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।” 

সেই প্রতিবেদনে তিনি আরও  বলেছিলেন, “জুলহাজ মান্নানের বন্ধু একজন চাকরি হারিয়েছেন। তার অফিস জেনে গেছে যে, সে জুলহাজের বন্ধু। বা অন্য বন্ধুদের বাসায় বলা হচ্ছে, ও তুমি জুলহাজের বন্ধু ছিলা বা তুমি তনয় এর সাথে কাজ করেছো? তার মানে তো তুমিও সমকামী!” 

জুলহাজ-তনয় হত্যা কাণ্ডের রায়

অবশেষে পাঁচ বছরের দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যার এক মামলায় ঢাকার একটি আদালত ছয় জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন। এছাড়াও ওই মামলার দু’জন অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হয়েছে। রায়টি ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক, মজিবুর রহমান। 

হত্যা মামলাটিতে দীর্ঘ তদন্তের পর পুলিশ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার-আল-ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) আটজন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল ঘটনার তিন বছর পর, ২০১৯ সালের ১২ই মে। 

২০২০ সালে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারের কার্যক্রম শুরু করা হয়। মামলাটিতে অভিযুক্ত আসামীরা হলেন, চাকরীচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, আকরাম হোসেন, সাব্বিরুল হক, জুনাইদ আহমদ, মোজাম্মেল হোসাইন ওরফে সায়মন, আরাফাত রাহমান ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, শেখ আব্দুল্লাহ এবং আসাদুল্লাহ।

চাকরীচ্যুত সেনা কর্মকর্তা, জিয়াউল হকসহ চারজন অভিযুক্ত এখনও পলাতক রয়েছে। 

দীর্ঘ পাঁচ বছরের অপেক্ষার পর জুলহাজ-তনয় হত্যা কাণ্ডের একটি রায় আমরা পেয়েছি। কিন্তু এরপরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়,যেগুলো আমাদের এখনো সঙ্কীত করে। 

বিচারক মজিবুর রহমানের কণ্ঠে ভেসে আসা চুয়ান্ন পৃষ্ঠার এই রায়ে ছয় আসামীর ফাঁসির দণ্ডাদেশ কী আসলেই কোনো সুবিচারের পরিচায়ক? মৃত্যুদণ্ড কী কখনও অপরাধ, বিশেষত উগ্রবাদিতা দমাতে পেরেছে? রায় ঘোষণা শেষে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত স্বয়ং আসামীদের হাস্যোজ্জ্বল উচ্ছ্বাস, আদালতের দেওয়া পর্যবেক্ষণকে কী সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করে না? তাছাড়া, হত্যাকাণ্ডের মূল হোতারা কী অধরাই থেকে গেল? এই রায়ের মাধ্যমে ক্যুইয়ার অধিকার আন্দোলনের ওপর কী আদৌ কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে? বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কি এখন থেকে ক্যুইয়ার অধিকারের বৈধতা ও স্বীকৃতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন? নাকি, সমকাম ভীতু রাষ্ট্রযন্ত্রের এই বিচার প্রক্রিয়া জন্ম দিল শুধুই প্রহসনের?

তথ্যসূত্রঃ

i) https://www.bbc.com/bengali/39702053

ii)https://www.google.com/amp/s/www.bbc.com/bengali/news-58391257.amp

আমি তন্ময় সরকার। গ্রাজুয়েশন করছি গণিতের উপর। শখের বসত নিয়মিত লেখালেখি করছি। তবে নিজেকে পাঠক হিসেবে ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। পছন্দ ও আগ্রহের বিষয় বিজ্ঞান, বিশেষত গণিত। তবে শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সমান ভাবে আকর্ষণ করে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.