
অরণ্য রাত্রি
২০১৬ সাল আমাদের কমিউনিটির জন্য একটি ভয়াবহ এবং শোকের বছর। কারণ এই বছর আমরা হারিয়েছি তনয় এবং জুলহাজ ভাইকে। অনেকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। যদি ২০১৬ সালকে মাঝখানে রেখে একাল এবং সেকালে ভাগ করা হয় আমাদের কমিউনিটিকে, তাহলে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে আমি কী দেখেছি বা কী পরিবর্তন এসেছে তা নিয়ে কিছু লিখবো বলে অনেক দিন ধরে ভাবছি। আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমি কোনো এক্টিভিস্ট ছিলাম না, এখনো নই। নই কোনো রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তাই নিজেকে সাধারণ মানুষ বলছি।
প্রথমেই আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি যারা নিজেদের অনেক কাজের মধ্যেও কমিউনিটির জন্য কাজ করেছে বা করছে। আর যারা দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে তাদের প্রতিও আমার অনেক শ্রদ্ধা। কারণ তারা আমাদের কমিউনিটিকে যেভাবে সাহায্য করেছে নিজেদের এত বড় স্যাক্রিফাইসের মাধ্যমে, তা আসলেই অসাধারণ। আসলে তারা যদি কিছু লিখে, তাহলে মনে হয় সেই সময় আর এই সময়ের পরিস্থিতির পার্থক্য আমার চাইতে অনেক ভালোভাবে বোঝাতে পারবে। তবুও কিছু লেখার ধৃষ্টতা দেখালাম।
এই আমার আমিকে আমি চিনতে পারি যখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। গে শব্দটা আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু বুঝতাম না এর মানে কী। এক সময় যখন বুঝলাম তখন আমি হতাশায় নিমজ্জিত হলাম। আমি হতে চাইলাম স্ট্রেট। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় যেমন, তেমনি আমার মতো আরেকজনকে আমি খুঁজে পেতে পারি এই দেশে তাও আমার জানা ছিল না। হতাশায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম আমি। সেই আমি যখন আমার মতো আরও অনেক মানুষের সন্ধান পেলাম তখন আমি মেডিকেল কলেজে পড়ি। মিগ৩৩ থেকে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত যখন বাসায় পিসি আর ইন্টারনেটের সংযোগ নেয়া হলো, তখন আমার মনে হলো আমি একটা রঙিন জাদুর জগতে প্রবেশ করেছি। জাদুর জগতই বটে। আমার বিষণ্ণতা আর হতাশা দূর হয়ে গেল। কিন্তু এই জগত থেকে পরবর্তীতে অনেক কষ্ট পেয়েছি। জীবনের ভাঁজে ভাঁজে কত খেলা!
সময় খুব নিষ্ঠুর। এত সহজে চলে যায়। মনে হয় নিমিষে এতগুলো বছর পার করে ফেলেছি। যখন আমি পিসি হাতে পেলাম তখন প্রথমেই আমি মাই গেডার নামে একটা সমকামী সামাজিক মাধ্যমে একটা প্রোফাইল খুলি। সময়টা ২০০৭। সেই প্রোফাইলে আমার মুখের একটা অর্ধেক ছবি দিয়ে রেখেছিলাম। সেখানে বাংলাদেশী মানুষের প্রোফাইল ছিল মাত্র ২০০ কি ৩০০। কমিউনিটি ছিল খুব ছোট। ঘুরে ফিরে সেই একই মানুষজন। পড়াশোনা বাদ দিয়ে চলতো সারা রাত চ্যাটিং। কিন্তু আমি খুব ভয় পেতাম। নিজের পরিচয়, আসল নাম কাউকে তেমন বলতাম না। কীসের যে এত ভয় আসতো আমার, তা আমি এখনো বুঝে পাই না। কিন্তু এখনকার জেনারেশনকে দেখি সহজেই নিজের নাম-পরিচয় বলছে। এই জেনারেশন অনেক স্মার্ট এবং সাহসী।
বয়েজ অনলি বাংলাদেশ (বব) এর কথা জানলাম। একটা ইয়াহু গ্রুপ ছিল তখন বব। কিন্তু তাদের অনেক অফলাইন কার্যক্রম ছিল। যেমন পার্টি, মুভি শো, গেট টুগেদার, পিকনিক, ওয়ান ডিশ পার্টি। তখন কিন্তু এই পার্টিগুলোতে অনেক নতুন মুখ দেখা যেত। তো এই পার্টিতে যাওয়া শুরু করি একজনের হাত ধরে। তিনি আর কেউ নন আমাদের প্রিয় জুলহাজ ভাই। আসলে তখন জুলহাজ ভাই কোনো গ্রুপের এডমিন হিসেবে যুক্ত ছিলেন না কোথাও। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় তার মাঝে লিডারশিপ ব্যাপারটা জন্মগতভাবেই ছিল। তিনি অনেক কিছু আয়োজন করতেন। প্রথম দিকে ছোট ছোট আয়োজন। যেমন তার চাকুরী পাওয়া উপলক্ষে পার্টি দিলেন। জন্মদিনেও পার্টির আয়োজন করতেন। হঠাৎ করেই চলে যেতেন কিছু মানুষ নিয়ে ঘুরতে। সবকিছুর সুন্দরভাবে আয়োজন তিনি খুব ভালোভাবেই করতে পারতেন।
তখনকার পার্টিগুলো অনেক রাত পর্যন্ত চলতো। কখনো কখনো রাত একটা দু’টা বেজে যেত শেষ হতে হতে। যাদের বাসায় যাওয়ার অসুবিধা ছিল তারা আগে থেকেই ঠিক করে আসতো বাকি রাতটা কোথায় থাকবে। তখন এত রাত পর্যন্ত পার্টি হলেও নিরাপত্তার ভয় কারো মাঝেই দেখতাম না খুব একটা। তখনো কিন্তু রূপবানের জন্ম হয়নি। আমার কিছু বন্ধু হলো। তাদের সাথে হ্যাং আউট করতাম প্রায়ই। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার জীবনে কিছু পরিবর্তন আসলো। আমি নিজেকে গুটিয়ে নেয়া শুরু করলাম। সেই সময়টা ২০১০ সাল। আমার শেষ অংশগ্রহণ করা পার্টি ছিল পিঙ্ক পার্টি। জুলহাজ ভাই তখন এই পার্টির অন্যতম আয়োজক। তখন থেকেই তার লিডারশিপের গুণাগুণগুলো আস্তে আস্তে প্রকাশ পাওয়া শুরু করেছে। আমার মনে আছে ২০০৯ সালে রবীন্দ্র সরোবরে খুব ছোট করে একটা ইফতার পার্টি হয়েছিল। সেটার আয়োজন করেছিলেন জুলহাজ ভাই। এরপর অনেক বড় বড় ইফতার পার্টি হয়েছে। আমি যাইনি। কিন্তু আমার কাছে এখনো সেই ইফতার পার্টি খুব মধুর স্মৃতি হিসেবে রয়েছে। এরপর বেশ অনেক বছর কেটে যায়। আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন আসে। সেই জন্য আমি এই জাদুর জগৎ থেকে বিরতি নেই। কিন্তু আমি মোটামুটি কিছু কিছু প্রোগ্রামের কথা শুনতাম। যেমন রেড পার্টি, এটা সম্ভবত কোনো রিসোর্টে সারা রাতব্যাপী হতো।
রূপবান প্রকাশিত হলো। বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ম্যাগাজিন। সেটার প্রকাশনী উৎসবে আমি এসেছিলাম। আমার এক বন্ধুর কারণে আসা হয়। বহু বছর পর আবার কোনো কমিউনিটির প্রোগ্রামে আসলাম। সেই অনুষ্ঠানে অনেক ভিআইপি মানুষ উপস্থিত ছিলেন। খুব সুন্দরভাবে প্রোগ্রামটা শেষ হয়। রূপবানের কপিও সংগ্রহ করলাম। আমার কাছে চমৎকার লেখেছিল রূপবানের প্রথম সংখ্যা।
এরপর আবার আমার বিরতি। কিন্তু এক সময় মনে হলো আমি কেন এইভাবে দূরে থাকবো। এইভাবে আইসোলেটেড হয়ে থাকলে কখনো ভালো থাকা যায় না। আবার একটা প্রোগ্রামে আসলাম। একটা এ্যাওয়ার্ড শো। সেখানে আমি প্রথম তনয়কে দেখি। কিন্তু কথা হয় নি। এটা সম্ভবত ২০১৫ সালের কথা।
আমি ২০১৫ তে ফেক আইডি খুলি ফেসবুকে। সেখানে কিছু বন্ধু হলো। আমার সকল কর্মকান্ড ছিল ফেসবুকভিত্তিক। অনেকগুলো পেজ ছিল যেখানে কুইয়ার গল্প পোষ্ট করা হতো। আমিও গল্প লেখা শুরু করলাম। আমার মনে আছে সেখানে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প পোস্ট করা হতো। অনেক গল্পই ছিল জীবনমুখী। মন্দ্রতে অনেক গল্পই আর্কাইভ করা হয়েছে। ফেসবুকে এখন অনেক মানুষের আনাগোনা। সেই ২০০৮ সালে যেমন বেশিরভাগ মানুষকে চিনতাম, তেমনি ২০১৫ সালে এসে মনে হলো অসংখ্য মানুষ বাংলাদেশে রয়েছে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ থাকতো ফেক আইডি নিয়ে। কীসের জানি একটা আতংক কাজ করতো আসল নাম ঠিকানা বলার ক্ষেত্রে। আমি জানি না তখন ফেসবুকের বাইরের জগতে কী হয়। শুধু শুনেছি জুলহাজ ভাইয়ের কলাবাগানের বাসার কথা। কিন্তু আমার সেখানে যাবার সৌভাগ্য হয়নি। রূপবানের দ্বিতীয় সংখ্যা বের হলো। তখন কমিউনিটির একজন একটা রেস্টুরেন্ট (নাম প্রকাশ করলাম না) দিয়েছিলেন। সেখানে অনেকেই আসতেন। আড্ডা দিতেন। সেখান থেকে আমি রূপবানের দ্বিতীয় সংখ্যাটা সংগ্রহ করি।
বব তখন কাজ করতো। আড্ডার আয়োজন হতো প্রায়ই। আমি আড্ডায় যেতাম। নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতাম। তখন মনে হতো খোলা আকাশের নিচে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। রেইনবো র্যালির কথা শুনতাম। এপ্রিলের ১৪ তারিখ এই র্যালি হয়েছে আমার জানামতে ২ বার। তৃতীয় বার আয়োজন করা হয় ২০১৬ সালে। কিন্তু আমি ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম র্যালিটি হয়নি। কিন্তু জানতাম না কেন হয়নি। এরপর হঠাৎ করে শুনলাম ঘটনাটার কথা। সম্ভবত ২৫শে এপ্রিল ঘটনা ঘটে। আমি জানতে পারলাম সন্ধ্যাবেলা। আমি যে পেজে সবচেয়ে বেশি গল্প লিখতাম, সেই পেজের এডমিন আমাকে ফোন দিলো। সে জানালো সে খুব ভয় পেয়েছে। আইডি সে ডিএক্টিভেট করে দিচ্ছে। পেজের কাজ আর সে করবে না। আমার মাথাটা কাজ করছিল না। একদিকে আমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ঢুকেছে। তা হল আইডি ডিএক্টিভেট করবো কিনা। আর জুলহাজ ভাইকে খুব পছন্দ করতাম। তার মৃত্যুর খবর শুনে আমার চোখের সামনে ভাসছিল তার সাথে আমার স্মৃতিগুলো। কষ্ট পাচ্ছি, আবার দুশিন্তা। কি যে একটা অবস্থা তখন!
যারা এতদিন আমাদের কমিউনিটিকে সাপোর্ট দিয়েছে বা সংগ্রাম করেছে তাদের কেউ কেউ হুমকি পেয়ে দেশের বাইরে চলে যায়। আর শুনেছিলাম অনেকেই আইডি ডিএক্টিভেট করে কোনো নিরাপদ জায়গায় রয়েছে। তখন আতংকটা এতোই ছড়িয়েছিল যে ফেসবুকে ফেক আইডি গুলোর অনেকেই আর অনলাইনে আসতো না, গল্প পোস্ট করা তো দূরের কথা। আমি যদিও আইডি ডিএক্টিভেট করি নাই। সময় বহতা নদীর মতো। আঁকাবাঁকা পথে চলে। এই ভয়ঙ্কর সময়টা এক সময় কেটে গেল। আস্তে আস্তে সবাই আবার ফিরতে শুরু করলো ফেসবুকে। আবার গল্প পোস্ট করা শুরু হলো। কিন্তু সবার মাঝেই কেমন একটা শঙ্কা কাজ করতো যে কোন বিপদ হবে না তো।
এরপর আবার অফলাইন এক্টিভিটিসগুলো শুরু হলো, কিন্তু অত্যন্ত প্রাইভেসি মেইনটেইন করে। সিকিউরিটি ইস্যুটা খুব বড় আকার ধারণ করে। আগে যেমন অনেকেই আসতো দূরদূরান্ত থেকে। কিন্তু তখন খুব যত্ন করে বাছাই করা হতো কাদেরকে ইনভাইট করা যাবে, সিকিউরিটির কারণে। আগের মতো এত বড় বড় পার্টি আর হতো না। এত রাত পর্যন্ত পার্টি হতো না। মাঝে মাঝে গেট টুগেদার হতো খুব স্বল্প পরিসরে। এমন কি বিভিন্ন প্রোগ্রামগুলোতে এনআইডি কার্ড নিয়ে যাওয়া লাগতো। আর খুব সিকিউরড প্লেসে প্রোগ্রাম হতো। জুলহাজ ভাই এর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে একটা প্রোগ্রাম হয়েছিল। খুব স্বল্প পরিসরে প্রোগ্রামটা হয়। তখন মনে হতো কোনো বদ্ধ ঘরে ঢুকেছি। পুরনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে। কেন জানি মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। কিছুটা ভয়ও কাজ করছিল। আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হলো। ভয় আস্তে আস্তে কেটে যেতে লাগলো। কিন্তু সিকিউরিটি আর প্রাইভেসিতে কোনো কম্প্রোমাইজ করা হলো না। এবং এটা আসলেই দরকার ছিল। ইতি রূপবান নামে একটি বই প্রকাশিত হল খুব স্বল্প পরিসরে। এটা পত্র-গল্পের একটি সংকলন ছিল। আগের মতো রূপবান প্রকাশনা উৎসবের মতো এত বড় আকারে নয়।
এখন প্রতারণা বা ব্ল্যাকমেইলের কথা শুনি। এখন হুক-আপ করতে গিয়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছে। কিন্তু আমি যখন প্রথম প্রথম এই কমিউনিটিতে আসি তখন এই ধরণের ঘটনার কথা শুনি নাই। কারণ সবাই ছিল পরিচিত মুখ। কিন্তু এখন এত মানুষ নিজেকে কুইয়ার হিসেবে দাবী করে! আমার মনে হয় এই ব্যাপারগুলোতে সবার সচেতন হওয়া উচিত। কারো বাসায় ভাল মতো না জেনে চলে গেলে ব্ল্যাকমেইলের ভয় থেকেই যায়। আর প্রেম ভালবাসার ক্ষেত্রে অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
আগে ডেটিং প্লেসগুলোর মাঝে জনপ্রিয় ছিল বসুন্ধরা সিটি। এছাড়া রমনার কথা জানতাম। ওখানে অনেকে দেখা করতে যেত এবং সেক্স করাও সম্ভব ছিল। অবশ্য তা রাতের বেলা। আমি কক্ষনো রমনায় যাই নাই। এছাড়া শাহবাগ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এখন তো রমনায় সন্ধ্যার পর ঢোকা নিষেধ। এখন অনেক রেস্টুরেন্ট আর কফি শপ হয়েছে। সেখানে ডেট করা হয়। এছাড়া ধানমন্ডি লেক তো রয়েছেই। আর নতুন যুক্ত হয়েছে হাতির ঝিল।
ডেটিং সাইটগুলোর মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ম্যানজাম। এছাড়া ছিল মাই গেডার, প্ল্যানেট রোমিও ইত্যাদি। কিন্তু এখন টিন্ডার আর গ্রাইন্ডার এই সব সাইটের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কারণ এগুলো মোবাইলে চালানো যায়। আর এখন তো ঘরে ঘরে স্মার্ট ফোন।
এরপর শুরু হলো করোনা ভাইরাসের দাপট। ঘর থেকে বের হওয়া মুশকিল। সেই সময় বেশ কয়েকটা ফেসবুককেন্দ্রিক প্লাটফর্ম তৈরি হলো। তারা বিভিন্ন অনলাইন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের কমিউনিটির মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যতে বেশ ভুমিকা পালন করে, যেমন: আড্ডা, অনলাইন আড্ডা। এর মাঝে ২টা বই প্রকাশিত হয়। একটা হলো একটা ছোট গল্পের সংকলন, যা আমাদের কুইয়ার সাহিত্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বলে আমি মনে করি। এই সব প্লাটফর্মগুলোতে কিন্তু নিজের আসল পরিচয় দিতে হয়, যেটা আগে ছিল না। অবশ্য গ্রুপগুলো সিক্রেট গ্রুপ। আসলে জুলহাজ ভাইয়ের মৃত্যু আমাদেরকে অনেক সাবধান হতে শিখিয়েছে। অনেক বছর পার হয়ে গেল। জুলহাজ ভাই এবং তনয়ের কেসটা বিলম্বিত হতে শুরু হলো। আমার মনে হতো কোনো রায়ই হয়তো হবে না। অবশেষে তার রায়ও বের হয়েছে। তিনজনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমার কিছু খোলা প্রশ্ন রয়েছে:
- আমরা এই রায় থেকে আসলে কী পেলাম?
- এখন কি আর আমাদের উপর কোন হুমকি থাকবে না?
- হ্যাঁ, জুলহাজ ভাই এবং তনয়ের ঘটনার সাথে যারা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু যারা পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে তাদের কি কোনোদিন বিচার হবে?
- উচ্চতর আদালতে এই রায়ের বিপক্ষে কোনো রায় দেয়া হবে কিনা?
- আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কি আমাদের মেনে নিতে পারবে কোনোদিন?
- কোনো ফেসবুক পোস্টে সমকামীদের পক্ষে কিছু লিখলেই তার নিচে পড়ে হাজার হাজার নোংরা কমেন্ট আর ভয়ঙ্কর সব হুমকি। ৩৭৭ ধারার মত একটা ভয়ঙ্কর ধারা আমাদের সংবিধানে রয়েছে। কিন্তু এই ধারার ব্যবহার খুব সীমিত। এই ধারা তুলে দেয়ার জন্য কোন আন্দোলন করার জন্য এখন সঠিক সময় কি?
- এতে কি আমরা আরও ভয়ঙ্কর কোনো ফলাফল দেখবো?
- কট্টর ধর্মান্ধ যারা তারা কি নতুন করে আমাদের উপর অত্যাচার করার চেষ্টা করবে?
- সরকার আর দেশের সাধারণ জনগণ কি আমাদের পক্ষে থাকবে, যেখানে পরিবারের মানুষই আমাদের এই আইডেন্টিটি মেনে নিতে পারে না?
আমার মনে হয় আমাদের এখন চিন্তা করা উচিত কীভাবে সাধারন মানুষের মাঝে আমাদেরকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। যদিও এটা খুব দীর্ঘ প্রক্রিয়া হবে। আমার জীবদ্দশায় এই গ্রহণযোগ্যতা কতোখানি দেখতে পাবো জানি না। সবচেয়ে বড় কথা হলো জুলহাজ-তনয়ের মতো আর কোন মৃত্যু যেন না হয়। মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগে। মনে হয় এই দেশে থাকলে কক্ষনো আমি স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারব না। ইচ্ছা করে দেশের বাইরে চলে যাই। কিন্তু তাও এখন আর সম্ভব নয় আমার জন্য।
মাঝে মাঝে মনে হয় সব সময় পজিটিভ চিন্তা করবো। কিন্তু ফেসবুকের নিউজ ফিডে গেলেই দেখি সংখ্যালঘুদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চলছে, যেমন: আদিবাসী, হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষ এবং আরো অসংখ্য সংখ্যালঘু মানুষ। এখন দিন এসেছে তাদের তীব্র প্রতিবাদের। কিন্তু আমাদের মতো সংখ্যালঘুদেরও প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নাই। কে শুনবে আমাদের কথা! তাই আমাদের চিন্তা আমাদেরকেই করতে হবে। কমিউনিটির মানুষ একে অপরকে সাহায্য করবে। তাহলে হয়তো আমরা নিজেদেরকে এতোটা অসহায় মনে করবো না। আসুন সবাই মিলে এক সাথে বাঁচার চেষ্টা করি।