সন্ধ্যা নামার আগে

অরণ্য রাত্রি 

সুখপুর স্টেশন টা আজকে লোকে লোকারণ্য। আমি স্টেশনের একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি। এখনো ঢাকাগামী ট্রেন এসে পৌঁছায়নি। আজ  সুখপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। তাই আজকের এই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। কিন্তু কালকে অফিসে একটা জরুরী মিটিং থাকায় আজকেই ফিরে যেতে হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। অনেক মানুষ স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। এই কয় বছরে স্টেশনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে খুব ছোট ছিল স্টেশন টা। এখন অনেক বড় করা হয়েছে স্টেশন টা।আগে স্টেশনটা ছিল খুব নির্জন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সাথে শহরটাও বড় হয়েছে। তাই  মানুষের আনাগোনা বেড়েছে ।  আমার পাশে একজন পেয়ালা থেকে চা পিরিচে ঢেলে খাচ্ছে আর শব্দ করছে। এই ব্যাপার টা আমার খুব অপছন্দের। জয় ঠিক এইভাবে চা খেতো। আমি কতো না করতাম ! কিন্তু সে শুনতোই না। জয় ছিল আমার সেরা বন্ধু। তাকে আমি ভালবাসতাম । কিন্তু সেই ভালবাসা কখনো পূর্ণতা লাভ করে নাই। 

ঢাকাগামী ট্রেনটা চলে এসেছে। আমি দ্রুত একটা ম্যাগাজিন কিনে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে প্লাটফর্মে আসলাম। এখানে ট্রেন থামে ১০ মিনিটের মত। আমি দ্রুত ভীড় ঠেলে ট্রেনে উঠলাম। টিকেট মিলিয়ে আমার কামরায় এসে বসলাম। আর কেউ নেই কামরায়। আমি জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছি। ফেরিওয়ালা আর কুলিরা ব্যস্ত ভাবে চলাচল করছে। স্টেশনটা প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠেছে । কারণ কিছুক্ষণের মাঝেই ট্রেন টা ছেড়ে দিবে। হঠাত দেখলাম জয় কে। আমি কি ভুল দেখলাম?? না এ তো জয় । আজকে সে অনুষ্ঠানে এসেছিল। আমরা ২ জনেই ২ জন কে দেখেছি। কিন্তু কথা বলি নাই। আমি ভয় পাচ্ছি জয় না আবার আমার কামরায় এসে বসে। অবশ্য আমার মাঝে ২  ধরণের চিন্তা কাজ করছে। এক আমি চাই না যে জয় আমার কামরায় আসুক। আমি তার মুখোমুখি হতে চাচ্ছি না। আবার আমার দ্বিতীয় সত্ত্বা চাচ্ছে যে জয় আসুক…। আমার পুরোনো ভালবাসা যেন জেগে উঠেছে। দেখি নিয়তি কি লিখে রেখেছে আমার কপালে। 

নিয়তি লিখে রেখেছিল হয়তো যে জয় আমার কামরায় আসবে। জয় নিজেও কেমন যেন অবাক হয়ে গিয়েছে। কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছে বলেই মনে হচ্ছে। ও আর আমি যে এক কামরায় যাবো, আমার মত এমনটি সেও ভাবে নি। তার উপর আমাদের কামরায় আর কেউ নেই। আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুঝতে পারছি না আমার এখন কি করা উচিৎ ? কুশল বিনিময়? ১০ বছর পর আমরা ২ জন এত কাছাকাছি হলাম। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। ট্রেন চলছে ঝিক ঝিক শব্দ করে। আস্তে আস্তে গতি বাড়ছে। এক সময় পূর্ণ গতিতে চলতে শুরু করলো । কথা জয়ই শুরু করলো।জয় বলল

  • চা খাবি?

এত দিন পর কথা হল তাও প্রথম কথা হল চা খাবো কিনা। অবশ্য ঠিকই আছে । আর কিইবা বলতে পারে সে? অবশ্য কুশল বিনিময়ের চেয়ে চা খাবো কিনা জিজ্ঞেস করাটা মনে হয় কম অস্বস্তিকর। আমি বললাম

  • খাওয়া যায়।

জয় ২ টা ওয়ান টাইম গ্লাস বের করলো । ফ্লাক্সে গরম পানি নিয়ে এসেছে। ২ গ্লাসে টি ব্যাগ দিল। আর ২ চামুচ করে চিনি। আমি আঁতকে উঠলাম 

  • চিনি দিলি কেন?
  • কেন তুই তো সব সময় ২ চামুচ চিনি খেতি
  • কিন্তু সে তো দশ বছর আগের কথা। এখন তো ডায়াবেটিস শরীরে বাসা বেঁধেছে 
  • ওহ। এই অসুখ বাঁধালি কেমন করে
  • আরে বাবা মার আছে। জেনেটিক্যালি হয়েছে। অসুবিধা নেই একদিন চিনি খেলে কিছু হবে না।

আমি গ্লাস থেকে চুমুক দিলাম। ঠিক সেই স্বাদ। জয় খুব ভাল চা বানাতে পারতো। এখনো ঠিক এক রকম আছে। আমি জানালা দিয়ে উদাশ ভঙ্গীতে তাকালাম। হঠাৎ আপন মনেই হেসে ফেললাম। মনে পড়ে গিয়েছে আমাদের ভার্সিটির প্রথম দিকের কথা। আমি আর জয় ক্যান্টিনে চা খেতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ক্যান্টিনে যে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের ঢুকা নিষেধ তা জানা ছিল না। আর তারপর যা হবার তাই হল। আমরা ২ জনই র‍্যাগ খেলাম। তখন খুব অপমানের মনে হয়ে ছিল। কিন্তু এত দিন পর এই অপমানটাকেও যেন মধুর স্মৃতি মনে হচ্ছে। আর সেই দিন থেকেই আমার জয়ের সাথে বন্ধুত্বের সূচনা। আমাকে হাসতে দেখে জয় জিজ্ঞেস করলো 

  • কিরে হাসছিস যে?
  • ভার্সিটির প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে গিয়েছে। চা খেতে গিয়ে যে আমরা ২ জনেই র‍্যাগ খেলাম

জয়ও হেসে দিল। বলল:

  • তোর দোষে র‍্যাগ খেয়েছিলাম
  • উহু আমার কোন দোষ ছিল না। পুরোটা তোর দোষে ।

আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। এরকম খুনশুটি আমাদের আগেও হত। কিন্তু এখন কি আর সেই সম্পর্ক আছে। তাই চুপ হয়ে গেলাম। জয়ও কেমন যেন চুপ হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। অস্বস্তিকর নীরবতা। আবার স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে জয়। জয় বলল 

  • আজকে  সারাদিন এত মানুষের মাঝে তোর সাথে আমার তেমন কথা হয় নি

আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছা করলো না । তাই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম

  • জয় তুই বেশ মোটা হয়ে গিয়েছিস। শুকানোর চেষ্টা কর।
  • আরে, চেহারা দিয়ে কি হবে?
  • তা ঠিক। এখন তো প্রেম করার বয়স নেই। আর রিতা তো তোর জীবনেই আছে জয়
  • আমার জীবনে? রিতা তো বিয়ে করে এখন সে  আমেরিকায় সেটেল্ড। তার হাসবেন্ড সেখানে একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকুরী করে। 

রিতা, জয়ের বান্ধবি ছিল। রিতা, জয় ছাড়া কিছুই বুঝতো না। শেষের দিকে  তাদের বিয়ে হবে এটা ধরেই নিয়েছি সবাই। কিন্তু এখন জয় এর কাছে শুনছি রিতা আরেকজন কে বিয়ে করেছে। খুব অবাক হলাম। জয়  আমাকে  জিজ্ঞেস করলো 

  • সোহাগ ভাল আছে?

আমার ভার্সিটি লাইফে শেষ  পরীক্ষার পর আমার একটা বয়ফ্রেন্ড হয়ে ছিল। তার নাম সোহাগ । আমি যে সমকামী এটা জয় জানতো।  আমাদের মাঝে  মানে আমার আর সোহাগের মাঝে রিলেশন  ছিল  অল্প কয়েকদিনের। মাত্র ১ মাসের। এটা কে ঠিক রিলেশন বলাও যায় না। আমি উত্তর দিলাম না।এই ব্যাপার টা নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগছে না। জয় মনে হয় বুঝলো তাই আর জিজ্ঞেস করলো না। 

আজকে প্রোগ্রামে একটা কালচারার প্রোগ্রাম হয়েছে। প্রায় সব ব্যাচ থেকেই কেউ না কেউ পারফর্ম করেছে। কিন্তু আমাদের ব্যাচ থেকে কেউ করে নি। আসলে আমাদের ব্যাচটা একটু আঁতেল ব্যাচ। শুধু মাত্র জয় সকল প্রোগ্রামে পারফর্ম করতো । তার মত গান সেই সময় কোন ব্যাচে কেউ গাইতে পারতো না। আমি ভেবেছিলাম আজকে জয়ের পারফরম্যান্স থাকবে। সে ভার্সিটির বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতো। তার সাথে কত প্রোগ্রামে গিয়েছি গান শুনতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম

  • জয়  তুই এখন আর আগের মত  গান করিস?

জয় বলল

  • না।কবেই ছেড়ে দিয়েছি 
  • হম। তুই বদলে গিয়েছিস  জয়। 
  • শুধু আমি বদলেছি? তুই বদলাস নাই অরণ্য?
  • আমি হয়তো শারীরিক ভাবে আগের মত ফিট নেই। কিন্তু আমার যা করতে ভাল লাগে এখনো তাই করি। মা , বাবা ২ জনেই বাসায়।২ জন অসুস্থ মানুষ। শুধু তাদের কথা ভেবে কিছু কিছু কাজ করতে বাধ্য হয়েছি।

জয় এবার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।

  • আগের দিন গুলোই  খুব সুন্দর ছিল । তাই না?বিশেষ করে আমরা দুই বন্ধু। পহেলা ফাল্গুনে একসাথে পাঞ্জাবি ঘুরতে বের হতাম। তারপর আমার গানের প্রোগ্রাম থাকতো। কত বার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোর নিয়ে গিয়েছিলাম গান গাইতে। পহেলা বৈশাখ , বর্ষার প্রথম দিন। কোন কিছু সেলিব্রেশন বাদ দিতাম না আমরা।তারপর কক্সেসবাজারের কথা মনে আছে?

এই প্রশ্ন করে জয় হঠাত থেমে গেল। এই প্রশ্নটা আমাদের ২ জনের জন্যই খুব অস্বস্তিকর। তাই জয় যেন কোন নিষিদ্ধ কথা বলে ফেলেছে  এমন একটা মুখের এক্সপ্রেশন দেখতে পারলাম। 

আমার মনে পড়ে গেল জয়ের সাথে একবার  কক্সবাজার বেরাতে গিয়েছিলাম। জয়ের ট্রেন ভ্রমণ খুব ভাল লাগতো। তাই তো চিটাগং পর্যন্ত আমরা ট্রেনে গেলাম। আমার এই ট্রেন ভ্রমণ প্রীতি আমি জয়ের কাজ থেকেই পেয়েছি। জয় পানি ভয় পেতো । আমার হাত ধরে সমুদ্রে নেমেছিল সে। আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর মুহূর্তের একটি সেটি। তারপর হোটেলে রাতে যা ঘটলো তার জন্য আমরা ২ জন কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের কি হল জানি না। সেই রাতে আমাদের মাঝে যেটুকু দূরত্ব ছিল তা দূর হয়ে গেল। শরীর এবং মন ২ টাই এক হয়ে গেল। কিন্তু পরের দিন সকালে আমার আর জয়ের ২ জনই মন মরা হয়ে গেলাম। একি হল। আমরা তো এটা চাই নি। আমরা ২ জনই নিজেদের প্রবোধ দিলাম যে এটা একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা শুধু মাত্র ভাল বন্ধু। কিন্তু আসলেই কি তাই? ব্যাপারটা মোটেও সেরকম না।

 কিন্তু আমরা এত দিন হলে  এক সাথে যে ঘরে থাকতাম সেই ঘর পরিবর্তন করে ফেললাম। এই  ঘটনা আমাদের ভার্সিটি লাইফের একদম শেষ দিকের ঘটনা। পরীক্ষা হয়ে গেল। আমাদের ভার্সিটি লাইফ শেষ হয়ে  যাবে। শেষ পরীক্ষার দিন আমি বুঝলাম আমি জয় কে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমাকে আমার সব কথা জয় কে বলতেই হবে। আমি অনেক বিতং করে একটা চিঠি লিখলাম। ফোন করে বা সামনাসামনি বলার সাহস ছিল না।পরিক্ষার শেষে আমি আমার চিঠিটা জয়ের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলাম এবং কিছু না বলে দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছি। একবার পিছনে ফিরে তাকালাম দেখি জয় চিঠি টা হাতে নিয়ে  হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

একটা স্টেশনে থামলো টেন। ইঞ্জিন চেঞ্জ হবে। বেশ অনেকক্ষন দাঁড়াবে এই স্টেশনে। ২ জন অল্প বয়স্ক ছেলে আমাদের কামারায় এসে উঠলো। তাদের একজনের গায়ে আর্জেন্টিনার জার্সি আর আরেকজনের গায়ে ব্রাজিলের।বিশ্বকাপ চলছে তো।  আমার খুব হাসি পাচ্ছে। এক সময় আমি আর জয় ও  ২জন ২ দল কে সাপোর্ট করতাম। আমি ব্রাজিল আর জয় আরজেন্টিনা। কত যে নিজেদের মাঝে ঝগড়া হয়েছে এই বিষয় নিয়ে । কি ছেলে মানুষ ছিলাম আমরা। কিন্তু ছেলে ২ টা আমাদের কামারায় আসায় একটু সমস্যা হচ্ছে আমার। আমার একটা কথা জয় কে জিজ্ঞেস করতেই হবে। কিন্তু ছেলে ২ টার সামনে তা করা যাচ্ছে না। আমাদের পরীক্ষার  শেষে গ্র্যাজুয়েশন পার্টি হয়েছিল। এটাই ছিল আমাদের শেষ পার্টি। তখনো জয় আমার চিঠির জবাব দেয় নি। আমি পার্টি তে ঢুকার পর থেকেই সবাই আমার দিকে  অদ্ভুত দৃষ্টি তে তাকাচ্ছিল। আর এক জন আরেক জনের সাথে কানাকানি করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি্লাম না কেন এমন হচ্ছিল। আমি কি করলাম যে সবাই আমার দিকে এই ভাবে তাকাচ্ছে। আমি এসি রুমেও ঘামছিলাম। তিন্নি আমার খুব ভাল বান্ধবী। আমি তাকেই জিজ্ঞেস করলাম

  • কি হয়েছে রে? সবাই আমার দিকে এই ভাবে তাকচ্ছে কেন?

তিন্নি আমার কথা শুনে কেমন জানি চুপ হয়ে গেল । তারপর বলল 

  • তুই আজকে হলে চলে যা। 
  • কেন? আমি গ্রাজুয়েশন নাইটে থাকবো না?
  • আসলে তোর নামে একটা খবর বের হয়েছে। আর তুই তো জানিস আমাদের ব্যাচের ছেলে রা কত টা ব্যাকডেটেড।
  • এত ভণিতা করে বল কি হয়েছে 
  • তুই জয় কে কোন চিঠি লিখেছিস?

এই কথা শুনে আমার মেরুদণ্ড দিয়ে  একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।আমার চিঠির কথা তিন্নি জানলো কেমন করে। আর সেই চিঠিতে আমার  সব আবেগ ঢেলে দিয়েছি। আমি কতটা ভালবাসি জয় কে তা লিখেছি। এই চিঠি অন্য কেউ পড়লে খুব চিন্তার বিষয় । তিন্নি বলছে

  • তোর ওই চিঠি আমাদের হলে পর্যন্ত চলে এসেছে। ব্যাচের সবাই এই চিঠি পড়ে ফেলেছে।
  • এই চিঠি গেল কিভাবে তোদের কাছে চলে গিয়েছে। 
  • জানি না।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমি চারিদিকে তাকালাম। যার দিকেই তাকাচ্ছি খালি মনে হচ্ছে সে বুঝি আমাকে নিয়ে হাসছে। আমি এক দৌঁড়ে ক্লাব থেকে বের হয়ে গেলাম। হলে আমার ঘরে যেয়ে আমি দরজা বন্ধ করে বসে ভাবতে চাইলাম। কিন্তু মাথা কাজ করছে না। তার মানে জয় ই এই চিঠি সবাই কে দেখিয়েছে। আর কে দেখাবে। জয় আমাকে ভাল নাউ বাসতে পারে। তাই বলে সবাই কে চিঠিটা দেখিয়ে দিল। তার পরের দিন ই আমি হল ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে জয় আমার লেখা চিঠিটা সবাই কে দেখিয়েছে। 

ট্রেন ঢাকার কাছে চলে এসেছে। একটা স্টেশনে থামলো । ছেলে ২ টা নেমে গেল সেই স্টেশনে। এখন  শুধু আমি আর জয়। সে আমার কেনা ম্যাগাজিনটা উলটে পালটে দেখছিল। এটা একটা ফিল্মের ম্যাগাজিন। জয় আমাকে জিজ্ঞেস করলো 

  • কিরে এখনো তুই বাংলা সিনেমা দেখিস?

আমার জয় কে নিয়ে সিনেমা হলে অনেক বাংলা সিনেমা দেখা হয়েছে। সেই প্রসঙ্গেই বলছে। কিন্তু আমার এই কথায় মন নেই। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর জানতেই হবে। তা হল জয় কেন আমার তাকে দেয়া চিঠির কথা সবাই কে জানালো।সময় কম।  আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম

  • তুই আমার চিঠির কোন উত্তর দেস নি ভাল কথা। কিন্তু আমার চিঠির কথা সবাই কে জানালি কেন। 

জয়ের মুখটা দেখে মনে হচ্ছে সে প্রচণ্ড কষ্ট পেল।সে বলল 

  • আমি তোর চিঠির কথা সবাই কে জানাই নাই। 
  • তাহলে?
  • রিতা তোর চিঠি সবাই কে দেখিয়েছে।
  • রিতার কাছে চিঠি গেল কিভাবে।
  • তুই তো জানিস রিতা আমাকে কত টা ভালবাসতো । কিন্তু আমি বার বার রিজেক্ট করেছি। আমার হলে মেয়ে দের প্রবেশ নিষেধ। তারপরও সে ঝুঁকি নিয়ে আমার ঘরে পর্যন্ত চলে আসে। পরীক্ষা শেষ । আর আমাদের দেখা হবে না। সে এসেই আমার কাছে কান্নাকাটি শুরু করলো । বলছে আমি হ্যাঁ না বলা পর্যন্ত সে যাবেই না। এক পর্যায় ইম্পালসিভ হয়ে বলে ফেলি যে আমি সমকামী । কিন্তু বিশ্বাস কর তোর কোন কথা আমি বলি নাই
  • তাহলে চিঠির কথা জানলো কিভাবে
  • আমার কথা শোনার পর সে সিংহীর মত ফুঁসছিল। আমার টেবিলে যা যা ছিল রাগের মাথায় সব ছুঁড়ে ফেলছিল। আমি থামাতে যাই। কিন্তু কোন ভাবেই শুনছিল না আমার কথা। তার এক কথা তাকে আমাকে বিয়ে করতেই হবে। এক পর্যায় টেবিলের উপর রাখা চিঠিটা তার নজরে আসে। আমি বাঁধা দেয়ার আগেই চিঠি টা সে হাতে নেয়। আমি কেঁড়ে নিতে পারতাম। কিন্তু তাতে রিতা থামতো না। সে চিৎকার শুরু করতো। আশে পাশের ঘর থেকে সবাই এসে দেখত যে আমার ঘরে একটা মেয়ে এসেছে। একটা কেলেঙ্কারি হত। সে চিঠি টা পড়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে যে তুই নাকি সব নষ্টের মুল। তোকে সে ছাড়বে না। তোর জন্য নাকি আমি নিজেকে  সমকামী  ভাবছি। আমি অনেক অনুনয় করছি । কিন্তু রিতা একটা কথাও শুনে নাই আমার।

আমি কথা গুলো শুনছি আর আমার চোখ থেকে পানি পড়ছে। এত দিন ভুল বুঝেছি জয় কে। তাই তো বাড়ি ফিরে জয়ের উপর প্রতিশোধ নিতে  আমি সোহাগের সাথে রিলেশনে যাই। কিন্তু সেখানে কোন ভালবাসা ছিল না। তাই এক মাসের বেশি টিকে নি সম্পর্কটি। জয় বলেই যাচ্ছে।

  • কিন্তু এই ঘটনার পর আমি সোজা বাড়ি যাই।রিতার সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। ঢাকায় গিয়ে তোকে সব কিছু খুলে বলবো ভাবছিলাম। তাই তোকে ফোন দেই। কিন্তু তুই আমার ফোন ধরে বলিস যে তুই সোহাগের সাথে রিলেশনে গিয়েছিস। আমি তোকে আর কোন কথা বলার আগে তুই ফোন কেটে দিলি। তার এক সপ্তাহের মাথায় আমি ইউ কে ভাইয়ের কাছে চলে যাই।
  • কিন্তু সোহাগের সাথে রিলেশন তো তুই ইউ কে চলে যাবার পরেই ভেঙে যায়। আমাদের মাঝে কোন ভালবাসা ছিল না। শুধু তোকে জেলাস করাই আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল। 
  • তার মানে সোহাগ কে নিয়ে আমি ভুল বুঝেছি। আমি তোকে অনেক ভালবাসতাম রে। কিন্তু আমাদের ভুল বুঝাবুঝি তে সব শেষ হয়ে গেল। 

জয়ের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছে। তার চোখ থেকে পানি পরছে। আমার ইচ্ছা করছে তার চোখ টা মুছে দেই। এখনো যে তাকে আমি অনেক ভালবাসি। আমার চোখ থেকেও পানি পরছে। জয় তার চোখ মুছে আমার পাশে এসে বসে  চোখ মুছে দিল। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল জয়ের বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদি । কিন্তু তা সম্ভব নয়। জয়  বলল 

  • চল জীবন টা নতুন করে শুরু করি। এখন সোহাগ নেই। রিতাও নেই। শুধু তুই আর আমি। 
  • কিন্তু এখন যে পলি আছে!
  • মানে?
  • আমার স্ত্রী। রিতা যখন  চারদিকে ছড়িয়ে বেরিয়েছিল যে আমি সমকামী তখন এই কথা গুলো এত টাই চারিদিকে ছড়িয়ে ছিল যে বাবা মায়ের কানে চলে যায়।বাবা মা আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করে।

এরপর অনেকক্ষণ আমরা ২জনেই চুপ।কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে যাবো ৫ মিনিটের মাঝে। আমি

 ব্যাগ গুছালাম। বললাম 

  • তোর ভাবি মানে পলি আসবে আমাকে নিতে। দেখা করবি?
  • না থাক । আজকে না আরেকদিন
  • ওকে, ভাল থাকিস
  • তুইও

আমি স্টেশনে নামলাম। নামতেই দেখলাম পলি আর আমার ছোট মেয়ে বিপাশা। এক সময় আমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলেম। কিন্তু বিপাশা জন্ম নেয়ার পর এই চিন্তা আর করি নাই। বিপাশার মুখ টা কল্পনা করলেই মনে হয় জীবন টা এত সুন্দর। কেন এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো ???? 

সমাপ্ত।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.