জবানবন্দী

(এই লেখায় কিছু অংশে পুলিশের নৃশংস বর্ণনার উল্লেখ আছে। তাই পাঠককে পড়ার আগে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার জন্য অনুরোধ করছি। ই-ভিজুয়াল প্রোডাকশন-এর একটি আয়োজনে একজন কথক তার অভিজ্ঞতা থেকে একটি সত্য ঘটনা বর্ণনা করেন, যার অবলম্বনে এই গল্পের মূল কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।) 

১। রংবেরঙের বেলুন

ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে রাশেদের কখনই ভালো লাগে না। প্রায় পঁচিশ মিনিট যাবত অপেক্ষা করে যখন রাশেদের ডাক পড়বে, ঠিক তখনই রাশেদের ফোনটা কেঁপে উঠল। রাশেদ এক পাশে সরে গিয়ে ফোন রিসিভ করল। কোন অপরিচিত নম্বর থেকে কেউ ফোন করেছে। রাশেদের নাম নিশ্চিত করে জানতে চাইল রাশেদ কোথায় আছে। রাশেদ যতবারই তার পরিচয় জানতে চাইল, তিনি কোন উত্তর দিলেন না। রাশেদ ফোনের লাইনটা কেটে দিয়ে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল। দূর থেকে এসির একটা হালকা শব্দ বাতাসে ভেসে আসছে। ব্যাংকের কাউন্টারের পেছনে রঙ্গিন বিজ্ঞাপন। তাতে খুব বড় একটা গাড়ির ছবি দেয়া। তার পেছনে একটা র‍্যালি যাতে রংবেরঙের বেলুন নিয়ে উৎসব করতে করতে অনেক মানুষ এগিয়ে চলেছে। 

গত সপ্তাহে দেশের বাইরে থাকা একটি সমকামী দল ফেসবুকে ঘোষণা দেয় যে আগামী সতেরই মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে রংধনু পদযাত্রা আয়োজন করা হবে। এই ঘোষণাটি আসবার পর থেকে চারিদিকে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই তার ফেসবুক প্রোফাইল বন্ধ করে দিয়েছে। দুর্যোগকালীন ব্যবস্থাপনার জন্য খুব গোপন একটা আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। ড্রয়ারের নিচ থেকে পাসপোর্ট বের করে অনেকেই তা সাথে রাখতে শুরু করেছে যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে নিরাপদ কোন স্থানান্তরে যেন অসুবিধা না হয়। 

২। অগস্ত্যযাত্রা

বেলা ১টা বেজে ৩৮ মিনিট। ব্যাংকের কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার জন্যে রাশেদ ওভারব্রিজ পার হচ্ছিল। জ্যৈষ্ঠ মাসের গনগনে সূর্য তখন ঠিক মাথার উপর। দূরে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। রাশেদ যেই ওভারব্রিজটার কথা বলছে তার অবস্থান ধানমন্ডি ৪-এ। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় রাশেদ লক্ষ করল একটা সাদা গাড়ি সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। সানগ্লাস পড়া দুজন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এলেন। তাদের মধ্যে একজন সানগ্লাস খুলে রাশেদের দিকে তাকালেন। আরেকজন ফিসফিস করে তাকে কিছু একটা বলছিলেন। 

রাশেদ নেমে আসতেই রাশেদের দিকে দুইজন এগিয়ে এলেন। রাশেদের নাম ধরে রাশেদ কোথায় যাবে জানতে চাইলেন। তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করবার আগেই তাদের মধ্যে থেকে একজন পকেট থেকে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের আইডি কার্ড বের করে দেখালেন এবং খুব ঠাণ্ডা স্বরে রাশেদকে তাদের সঙ্গে যাবার কথা বললেন। রাশেদ কোন কিছু বুঝে উঠবার আগেই রাশেদের  হাত থেকে ফোনটা তারা নিয়ে নিলেন। একটা শীতল স্রোত ঘাড় বেয়ে রাশেদের পিঠের দিকে নেমে গেল। 

রাশেদ দুবার ঢোক গিলল। তার ব্যাগে পানির বোতল ছিল। কিন্তু রাশেদের  মনে হল বোতল বের করে পানি খাবার মত শক্তি তার নেই। কোন এক অজানা অপরিচিত গলার স্বর রাশেদের কানে ফিসফিস করে বলল আমাকে এদের সাথে যেতেই হবে। 

৩। প্রবৃদ্ধির প্রতীক ঘোড়সওয়ার 

মিন্টু রোডের যেই বাড়িতে রাশেদকে নিয়ে যাওয়া হল বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে ভেতরে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের অফিস রয়েছে। চারিদিকে অনেক বড় বড় গাছপালা। জায়গাটা ছায়া ঘেরা। সামনে ব্যস্ত শহর। দুই দিক দিয়ে গাড়ি আসছে যাচ্ছে। অদূরে রাস্তার মোড়ে একটা ঘোড়ার গাড়ির ভাস্কর্য রোদের আলোয় ঝকমক করছে। 

একটা ভাঙ্গাচুরা বেঞ্চের উপর রাশেদ বসে আছে। রাশেদের পাশে আরও কয়েকজন। বাইরে একটা ছোটখাটো জটলা। দেয়ালের টিউব লাইটের পাশে একটা বড় টিকটিকি পোকা ধরবার জন্য ওঁত পেতে বসে আছে।

রাশেদ দেয়াল থেকে চোখ সরিয়ে থানার ওসির দিকে তাকাল। তার সামনে রাশেদের ফোন, ব্যাটারি, সিম কার্ড সহ আরও কয়েকটা টুকরা অন্য আরেকজন অফিসার এসে রেখে গেল। ওসিকে দেখে খুব একটা বদরাগী মনে হচ্ছিল না। রাশেদের পাশে বসে থাকা বয়স্ক একজন ভদ্রলোককে তারা ভেতরে নিয়ে গেলেন। ফ্যানের বাতাসে পর্দা অল্প অল্প কাঁপছে। পর্দার এপাশ থেকে রাশেদ বুঝতে পারছিল তাকে অন্য আরেকটা ঘরে নিয়ে ভারী দরজাটা টেনে বন্ধ করে দেয়া হল। 

প্রথমে একটা আর্ত চিৎকার শুনল রাশেদ। তারপর কয়েকটা ঘুষির শব্দ। সেই সাথে একটা চাঁপা গোঙানি। তারপর অনেকক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নেই। রাশেদের কেন যেন মনে হচ্ছিল আলপিন দিয়ে তার নখের নিচে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তারা কোন তথ্য উদ্ধার করবার চেষ্টা করছেন। 

কয়েক মুহূর্তের জন্য রাশেদের মনে হল রাশেদের শরীরটা গুলিয়ে উঠছে। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম। রাশেদ চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করল। কেন যেন হঠাৎ রাশেদের মনে হল সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। উঠে দাড়াতে গিয়েও রাশেদ বসে পড়ল। 

তার কিছুক্ষণ পর বয়স্ক ওই ভদ্রলোককে এনে রাশেদের পাশে বসিয়ে দেয়া হল। খুব সাহস করে রাশেদ তার দিকে তাকিয়ে দেখল তার আলখাল্লায় ছোপ ছোপ রক্ত। হাতে একটি নখও নেই। 

রাশেদের শ্বাসকষ্ট নেই তবুও হঠাৎ করে তার নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হতে লাগলো। 

৪। একটা টানানো চট

রাশেদ ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের অফিসে এক রাত ছিল। তাকে তেমন কোন কিছুই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। রাতে অন্য আটক করা ব্যক্তিদের সাথে যেই ঘরে তাকে থাকতে দেয়া হয়েছিল রাশেদের মনে আছে সেই ঘরটা ছিল অসম্ভব অন্ধকার। ঘরের এক পাশে একটা চট টানানো। তার ওপাশ থেকে বিকট গন্ধ বলে দিচ্ছিল অনেকদিন ওই শৌচাগারে কোন পানি ব্যবহার করা হয়নি। 

সারারাত রাশেদ ঘুমিয়ে ছিল কিনা রাশেদের মনে নেই, একটা আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে দিয়ে রাত গভীর হচ্ছিল। এরপর এক সময় অল্প অল্প করে আলো ফুটতে শুরু করলো। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। 

সকাল ৮ টার দিকে আমাকে ওসির সামনে চেয়ারে নিয়ে বসানো হল। জবানবন্দি নেয়ার জন্য। খুব অবাক হয়ে রাশেদ লক্ষ্য করল তার ব্যাপারে ওসির সব কিছুই জানা। কোথায় আলোচনা হয়, কারা তাকে সহায়তা করে, অর্থের যোগানে কোন দূতাবাস তাদের মদত দেয় এর সবই তাদের জানা। 

জবানবন্দি লেখা শেষ হবার পর তাকে দস্তখত করতে দেয়া হল। কলমটা ধরতে গিয়ে কেন যেন রাশেদের হাত থেকে কলমটা পড়ে গেলো। কোন এক অজানা কারণে রাশেদের খুব দুর্বল লাগছিল। রাশেদ বারবার চাচ্ছিল পুরো জবানবন্দিটা একবার পড়ে দেখতে। কিন্তু কেন যেন শেষ মুহূর্তে আর পড়ে দেখতে সাহস হল না। 

রাশেদ স্বাক্ষর করবার দুই ঘণ্টা পরে একটা প্রিসন ভ্যানে করে মোট ২৮ জনকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হল। 

৫। রাইটার

তখন সকাল কয়টা বাজে রাশেদের মনে নেই। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে খুব বিশাল একটা মাঠ। চারপাশে কোন গাছপালা নেই। এক কোনায় কেবল দুটা রেইনট্রি। চারপাশে প্রাচীরের উপর তারকাটা দিয়ে ঘেরা। লাইন করে ঢোকার পর তাদেরকে কুঁজো হয়ে মাঠে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখা হল। এর অনেকক্ষণ পর যখন রাশেদের ডাক আসলো রাশেদ বুঝতে পারল এখানে কয়েকজন দলনেতা রয়েছে। দলনেতাদের এখানে রাইটার বলা হয়, তারা সব কিছু লিখে রাখে। নামের বদলে তাকে একটি নম্বর দেয়া হল। এরপর থেকে রাশেদ যতদিন এই কারাগারে ছিল এই নম্বর দিয়েই সব সময় তাকে সম্বোধন করা হত। 

আরও কিছুদিন পরে রাশেদ জানতে পেরেছিলাম যে যারা রাইটার তারা আসলে যাবৎজীবন সাজা প্রাপ্ত কয়েদী। বিভিন্ন কাজে তাদেরকে নিয়োজিত করে তাদের সাজার মেয়াদ কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। 

তাকে যে নির্বাচন করেছিল, রাশেদের সঙ্গে সে সব সময় ভালো ব্যবহার করতেন। কেবল মাত্র একবার বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতে দেরি হওয়ায় তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। রাইটারদের প্রতি সপ্তাহে সাড়ে তিন হাজার টাকা করে পাঠাতে হত। যাদের এই টাকা দেবার সামর্থ্য ছিল না, তাদের নানান ভাবে পদে পদে হেনস্থা হতে হতো। 

৬। এক বালতি পানি

রাশেদ এই জেলখানায় ছিল ২৫ দিন। প্রতিদিন খুব সকালে একটা রডের শব্দে রাশেদের  ঘুম ভাঙত। প্রথম দিন ঘুম ভাঙার পর রাশেদ খুব অবাক হয়ে লক্ষ করল সবাই কোন একটা রেসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরও কিছু সময় পর রাশেদ বুঝতে পারল সকালে গোসলের জন্য এক ট্যাংকই পানি জমা করা থাকে। যারা আগে যাবে কেবলমাত্র তারাই এই পানি ব্যবহার করার সুযোগ পায়। রাশেদ যেই রাইটারের অধীনে ছিল সে প্রতিদিন রাশেদের জন্য এক বালতি পানি আলাদা করে রাখত। 

তাদেরকে প্রত্যেককে দুটো করে কম্বল দেয়া হয়েছিল। একটা নিচে দিয়ে শোবার, আরেকটা গায়ে দেবার। বর্ণনা শুনে মনে হতে পারে যে কম্বলগুলো হয়তো খুব পরিষ্কার ছিল না, কিন্তু আসলে তা নয়। জেলখানায় নানা রকম ছোঁয়াচে রোগের কারণে সবাই সবার কম্বল খুব পরিষ্কার রাখত এবং কেউ নিজের কম্বল অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দিত না। এমন কি যেই কম্বলটা নিচে দেয়ার, সেই কম্বলটা গায়ে দেয়ার কোন নিয়ম ছিল না। 

তারা যারা রাইটারকে টাকা দেয়ার সামর্থ্য রাখত, কম্বল শুধুমাত্র তাদের জন্যই বরাদ্দ ছিল। বাকিরা মেঝেতে থাকতো। দুটা কম্বলের মাঝামাঝি যতটুকু জায়গা থাকতো, তারা কেবল মাত্র ওইটুকু জায়গাতেই এক পাশ ফিরে শুয়ে থাকতে পারত। 

যেই হল ঘরটাতে তারা ছিল, তার এক পাশে ছিল একটা বইয়ের শেলফ। খুব পুরনো, হলুদ হয়ে যাওয়া কিছু বই জড়ো করে রাখা ছিল ওই শেলফে। রাশেদ যেই কয়দিন ওই ঘরে বন্দি ছিল, সারাদিন বই পরেই রাশেদের সময় কাটতো। কেবল নামাজের সময় কয়েকজন তাকে ডাক দিয়ে নামাজের জন্য নিয়ে যেত। 

২৫ দিনে রাশেদের মোট দশ কেজি ওজন কমেছিল। প্রতিদিন তাদেরকে খিচুড়ির মত একটা খাবার খেতে দেয়া হত। খেতে খুব খারাপ না হলেও বালির কারণে বেশিরভাগ সময়ে রাশেদ খেতে পারত না। 

৭। লোহার মাকড়শা

রাশেদ ছাড়া পাবার এক দিন আগে রাশেদ জানতে পারে যে কাল সকাল রাশেদ এখান থেকে চলে যাবে। খুব ভালো করে কোন কিছু বুঝবার আগেই রাশেদ আবিষ্কার করল যে রাশেদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে তার পরিবারের অন্যদের সাথে দাড়িয়ে আছে। 

বাসায় যাবার পর রাশেদ সেদিন অনেক সময় নিয়ে গোসল করেছিল। সেদিন রাতে সে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমোতে গিয়েছিল। 

কিন্তু মাঝরাতে রাশেদের ঘুম ভেঙ্গে যায় দুঃস্বপ্ন দেখে। তাদের বাসার পাশে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছিল। পাইলিং করে বড় বড় গর্ত করা হয়েছিল। রাশেদের মনে হতে লাগল গর্তগুলো থেকে বিশাল বড় যান্ত্রিক কিছু মাকড়সা বের হয়ে রাশেদের দিকে এগিয়ে আসছে। চাঁদের আলোয় তাদের যান্ত্রিক হাত পা গুলো চক চক করছে। খুব কাছে আসার পর অপলক চোখে তারা তাকিয়ে আছে রাশেদের চোখের দিকে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.