ভার্চুয়াল 

প্রদীপ রায়

আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন— আমি জয় লাভ করেছি। মোবাইল থেকে ওর নাম্বারটা ডিলিট করে দিয়েছি। কল রেজিস্টার থেকে, এমনকি সেন্ট আইটেম থেকে তাকে পাঠানো  এসএমএসগুলো পর্যন্ত। ইনবক্সে ওর পাঠানো টেক্সট যেগুলো ছিল, সেগুলো মুছে দিয়েছিলাম আগেই। তবে একটা সময় ছিলো, যখন ওকে খোঁজার সকল উপায় হারিয়ে ফেলবার মত সাহস  আমার ছিলো  না। পরিত্যাগের পেছনে একটা মনোভাব কাজ করে, সেটাকে উটকো আপদ বলে ভাবতেই পারি, কিন্তু আমার মনে সেরকম কোনো আবেগ কাজ করেনি। জিদ ও অভিমানের হ্যাঁচড়া-হ্যাঁচড়িতে তাই আল্টিমেটলি ডিলিটিং করেছি। আর মনের এই দ্বন্দ্বের দীর্ঘ ক্লান্তিকর পরিক্রমা শেষে একটি নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম;আর নয়! একটা মানুষকে আমার প্রত্যাশা বোঝাতে আর কত উপর্যুপরি ব্যর্থতা মেনে যাওয়া যায়, যে কিনা কোনোদিন বুঝবে না তার খাতিরে নিজেকে ব্যয় করা একেবারে বেহুদা!

যাই হোক, এখন আমার আর কোনো ক্ষোভ নেই। মন শান্ত, শিশুর মতো সবুজ। তারপরও যদি সে নিজেই ফোন করে বা এসএমএস পাঠায়, তবে সেটাকে আমি গ্রহণ করব চিন্তার আহার হিসাবে। হয়তো জিদ তাতে সোনালী জেল্লা পাবে। কিন্তু অভিমানের দরজা থাকবে বন্ধ। তবুও না যুক্তিতে, না আবেগে, কোথায় যেন ওর জন্য একটা ফুলের মঞ্জুরির উদগম ঘটবে। সেটা হতে পারতো পাপড়ি মাধুরি ফুলের মতো নিবেদিতা। কিন্তু মনের প্রশাসন এখন সর্বনাশা সুন্দরের ধ্যান করছে না। বিধায় ফল— যা হয়তো কখনো তার কাজে আসবে অথবা ফল শুকিয়ে তা হতে পারে বীজের মতো। তার করপুটে তা অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু যেদিন সময় ওর সঞ্চিত পণ্যের উপর হামলা বাঁধাবে, সেদিন এক নিমিষে তার মন বসন্তের সাবালক বনস্পতির মতো ফুল-ফল-পাতার কৃতজ্ঞতায় বিকশিত হয়ে উঠবে- সময়ের ঝড়ে আমার পক্ষ থেকে এই হবে তার জন্য শুভকামনা। অঙ্কুর প্রত্যাশী অথচ কীটে খাওয়া প্রেমের বীজ নিয়ে এর চেয়ে বেশী কী সফলতা আমরা আশা করতে পারি?

আমজনতার ক্ষেত্রে বরাদ্দ ভোগান্তির সাথে বৌচি খেলছি; আমাকে তুমি ছুঁতে পারবে না দুঃখ, আমি জানি একদমের তেরেকাটা দৌঁড়……

ইন্টারনেটে ওর ছবিটা দেখার পর আমার মনে খুব জোরালো একটা আকর্ষণ জেগেছিল— কী বাহুল্যহীন, প্রাকৃত সুদর্শন এক যুবক! পাতাদের ফাঁকে উঁকি মারা নিটোল আম, যেই কষাটে টকের প্রতি কিশোরীদের লোভ থাকে, যেই স্বাদ শৈশবের সাথে অখন্ড। এইসব একত্রিত হয়ে তৎমূহুর্তে আমার আপাদমস্তক তৃষ্ণায় কাঠ হয়ে গেল, দুর্নিবার বাসনা জন্ম নিলো। তাকে পাবার— কাউকে পাবার। কতো সহজভাবে যে বাসনা আমাদের জন্য বারণ। ততক্ষণাৎ তাকে মেইল করলাম, যদিও সস্তা চাটুকারি ভাষায় এবং সংক্ষিপ্ত: “You look innocent but like a prideful prince”.

সাথে কল বা মিসড কল দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আমার ফোন নাম্বারটা দিতে ভুললাম না। তারপর, আশ্চর্যজনক হলেও, সত্যি সাইবার ক্যাফে থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ললিত পুরুষের প্রসঙ্গ অনায়াসেই ভুলে গেলাম। অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি অপেক্ষা না করার কৌশল আয়ত্ত করার নামই জীবন। কম্পিউটারের সামনে বসে তার চিত্রটা গিলে ফেলতে ইচ্ছে করেছিল; কিন্তু মেইল পাঠানো হয়ে গেলে তাকে নিয়ে একটিও উদগ্রীব ভাবনা খরচ করতে হলো না। ফলে যখন তার কল বাস্তবিকই আসলো আমার মনে তখন কোনো প্রত্যাশার উচ্ছিষ্টও ছিল না। তড়িতাহত হওয়ার অনুভূতি যে আনন্দেরও, রক্তের ঝুমুর-ঝুমুর সেই প্রমাণ দিতে লাগলো। তবু সুখের তরঙ্গদল সতর্কতার অবিচল মিনারটাকে গলিয়ে তরল করতে পারে নি। পুরোনো ডালে নতুন পাতা গজায় তা ঠিক। কিন্তু  মরা ডালগুলি সেই দৃশ্য নির্লিপ্ত, বিবর্ণ মেজাজ নিয়েই দেখে—তারা জানে সব কিছুই ঝরে যায়।

 :হ্যালো, আপনি কেশব?

 :হ্যাঁ! 

 একটু দ্বিধা নিয়ে সে জানালো: নাম্বারটা আমি নেট থেকে পেয়েছি, আপনিই কি আমাকে মেইল করেছিলেন?

 :হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই। তারপর উভয় পক্ষের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দিতে আমি  জিজ্ঞেস করলাম (করতে হয়)- কেমন আছেন আপনি?

:ভালো। আপনি?

এরপর এক্ষেত্রে যেসব রুটিন প্রশ্নগুলো করতে হয়— কোথায় থাকেন? পড়াশোনা কোথায় করেছেন? এখন কী জব করছেন? কোথায়? বিবাহিত? বিবাহিত না হলে জিজ্ঞেস করা হতো, বিয়ে করবেন না? মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন? কখনো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছেন? কোনো ছেলের? কবে থেকে আপনি বুঝতে পারলেন, আপনি এমন? ছেলেবেলায় কারো দ্বারা…? এইভাবে আলাপ এগিয়ে নিতে হয় সাধারণত। কিন্তু তার সাথে আলাপ একটি উত্তরে এসে থমকে গেল। সে বিবাহিত। কবে? এইতো, রিসেন্ট। প্রথম দিন দ্রুতই আলাপ শেষ হলো। সতর্কতা কাজে লেগেছে; তার সাথে কথা বলে, আমি আমার পক্ষ থেকে সম্পর্ক নির্মাণের জন্য জরুরী আগ্রহকে কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করলাম; সেইদিন সফল হলাম। আমার অন্তর্নিহিত যুক্তি খুব পরিষ্কার—একে আর্মি পারসন, দুইয়ে বিবাহিত, তিনে চিন্তা-চেতনায় গতানুগতিক (যদিও প্রথম আলাপে এহেন অনুমান করে নেওয়া মূর্খতা)। আমার পছন্দের একটা কোটাও পূরণ করতে পারেনি, তাই বলে শরীর বিনিময়ে বাধা কিন্তু নেই। আমার নৈতিকতা বিবাহকে তেমন কোনো মূল্য দেয় না। তবু তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব নয়, যেহেতু সে বিবাহিত। তাই তার প্রতি আমার প্রথম মনোভাব ছিল নিরাসক্ত কৌতুহলের। যার আড়ালে সাপের মতো কুন্ডুলি পাকিয়ে ছিল অলস লোভ। পরের দিন সে নিজই ফোন দিল, তার পরের দিনও! এতোটা আমি প্রত্যাশা করি নি।কিন্তু এই সামান্য অজুহাতে আমার লোভ গা ঝাড়া দিয়ে সজাগ হলো, সুযোগ বুঝে একে একে ফুটতে লাগলো কামরাঙ্গা ফুলগুলি; তৃতীয়দিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সে ফোন দিলো না নির্দিষ্ট সময় পার হবার পরেও। যেহেতু যৌক্তিকতা আছে আমিই তাকে ফোন দিলাম। সে জানালো

 : এইমাত্র ডিউটি শেষ করলাম, এখন মেসে যাচ্ছি।

 : বিরক্ত করলাম কি?

 : আরে না।

 : না, আপনি ডিউটি করে নিশ্চই ক্লান্ত? তো মেসে গিয়ে কি ঘুম দিবেন; আপনাদের তো আবার ভোরবেলা উঠতে হবে, প্যারেড করতে?

 : ঘুমাবো। তার আগে বৌয়ের সাথে কথা বলবো।

 : প্রতিদিন কথা হয়, বৌদির সাথে?

 : নাহ। সুযোগ পাই না।

আমি কেন জানি আর কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

 : আপনার খবর কি, বলেন?

 :ভালো।

 : আচ্ছা। মেসে চলে আসছি। কালকে কথা হবে আবার, কেমন?

 : হ্যাঁ। ভাল থাকবেন।

 ফোন রাখার পর আমার লোভ, আমাকেই ছোবল দিল! কয়েকটা কামরাঙা ফুল ঝরে পড়লো; একটা চিনচিনে যন্ত্রণা মনের মেঘে সরু বিদ্যুতের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলো।

আপনারা হয়তো ভাবছেন, একটা নীতি-গর্হিত প্রেমের ভূমিকা তৈরি হয়েছে। ভালোই হতো যদি গতানুগতিক প্রেম কাহিনীর মতো, ত্রিভুজ জটিলতার একটি বাহু হওয়ার ভাগ্য আমার থাকত, কিন্তু বাস্তবতা অনেক জটিল। কিছু যন্ত্রণা কখনোই মহৎ হয় না, স্রষ্টাকে অভিযোগ করার অধিকার দেয় না। এমনকি যার নামকরণও কঠিন। হ্যাঁ, আমি তার প্রেমে পড়তে চেয়েছিলাম—কিন্তু প্রেমের ইচ্ছা আর প্রেম তো এক নয়। তার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম, সে যখন আমার ফোন ধরতো না, আমি অস্থির হয়ে পড়তাম; যদিও জানতাম তার ডিউটিটাই এমন যে, সে ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় আমার ফোন রিসিভ করতে পারতো না  বা রিসিভ করলেও দুই-এক মিনিটের বেশী কথা বলতেও পারতো না। এসব আমি জানতাম কিন্তু মানতাম না, আমি ভাবতাম বুঝি সে আমাকে উপেক্ষা করছে বা আমার প্রতি তার কোনো প্রকার আগ্রহ নেই। আমার উদ্বেগ পুরোপুরি ঠিক ছিল না আবার একেবারে ভুলও ছিল না। কারণ আমার প্রতি তার আবেগটা আসলে কী রকম ছিল সেটা আমি বর্ণনা করতে অপারগ।

সে কি নিজ উদ্যোগে কোনোদিন আমাকে নিয়ে ভেবেছে? আমাকে সে কী মনে করতো? বোকা? পাগল? লোভী? উটকো আপদ?

আমি জানি না। আমার প্রতি তার মনে যদি সম্ভ্রম জাগতো অথবা বিরক্ত হতো আমার আচরণে, কোনোটাই সে স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করতো না, আমি সেসব অনুমান করে নিতাম। সব থেকে বেদনার ব্যাপার ছিল, আমাকে নিয়ে তার মাঝে কোনো কৌতূহল ছিল না। তার মানে এই না যে সে আমাকে বুঝতে পারতো। আমাকে বোঝার বা নিজেকে বুঝানোর কোনো চেষ্টা বা ইচ্ছা তার মাঝে আমি দেখিনি। তার জীবনে আমাকে একদমই প্রয়োজন ছিল না, তবু কেন যে আমাকে সে সহ্য করতো! কাউকে করুণা করার যোগ্যতাও তার ছিল না। তাহলে? তবে কোন ললিত মায়ায় আসক্ত হয়ে আমি তার সাথে নিজেকে জুড়ে রাখতাম? কতোবার যে তার নাম্বার আমি ডিলিট করেছি! সেন্ট আইটেম থেকে তাকে পাঠানো এসএমএস এর পরে, সেই ফেলে দেওয়া নাম্বার আবার যোগাড় করেছি, আবার ফোন দিয়েছি, আবার অভিযোগ করেছি!

খুব সামান্য হলেও তার দিক থেকেও তাগিদ ছিল। একে তার বৌয়ের সাথে থাকার সুযোগ সে পেত না, সেই সুযোগ যখন হলো—ফ্যামিলি নিয়ে থাকার জন্য সেনানিবাস থেকে ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পেল, তখনো পুরুষ শরীরের প্রতি তার আগ্রহ ফুরিয়ে যায় নি। যদিও আমার শরীর আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু আমি ছাড়া বারবার বেহায়া বিড়ালের মতো কে তার কাছে ধর্ণা দিত, আর নিজের প্রয়োজনের জন্যও কারো কাছে ধর্ণা দেওয়ার স্বভাব তার নাই। তার আত্মসম্মানবোধ খুব সূক্ষ্ম। আর আমি জীবনে প্রেমকে এতো মূল্য দিয়ে রেখেছি যে প্রেমের ন্যূনতম সম্ভাবনায়, প্রেমের বর্বর আকাঙ্খায়, আত্মমর্যাদা পোশাকের মতো খুলে ফেলে ল্যাংটা হয়ে যেতে পারি। আমি প্রেমের পূজায় ব্যাক্তিত্বের বলি দিয়েছি। অবশ্য আত্মমর্যাদার ক্ষতি করে প্রেম আদৌ সম্ভব কিনা, এ নিয়ে এখন আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। দ্বিতীয় কারণ, আবেগের একটা মাধ্যাকর্ষণ থাকে। যেই টান কেউ পাষাণ্ড   না হলে আমূল উপেক্ষা করে থাকতে পারে না। আরেকটা কারণ হলো, তার আত্মপ্রেমকে আমি ঈষৎ বেশী সম্মান দিতাম, যাতে সে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে।

প্রেমের স্বাদ আমি জানি না, অপ্রেমের স্বাদ আমি চিনি। তাকে নিয়ে কয়েকটা দিনের মিষ্টি ভ্রম ছাড়া বাকিটা সময় আমি বুঝতে পেরেছি, এখানে প্রেম নেই এবং এখানে প্রেম অসম্ভব। এতে তাকে নিয়ে আমার উদ্বেগ ও অস্থিরতা হ্রাস পায়নি, তার টানা নির্বিকারতা সেই অস্থিরতা উত্তোরত্তর বাড়িয়ে দিয়েছে। সে ফোন দিতো না, আমি তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতাম। এজন্য যে, প্রথম দিকে পরপর কয়েকদিন সেই আমাকে ফোন দিত, আর আমি তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতাম। এভাবেই আমি অভ্যস্থ হয়েছিলাম। তারপর, নির্দিষ্ট সময়ে তার ফোন আসে না, কিছুক্ষণ আমি অন্যমনস্ক হয়ে অপেক্ষা করি।যুক্তি দিয়ে ভাবি,হয়তো ওর ডিউটি তখনো শেষ হয় নি। তাই আবার নতুন করে সময় নির্দিষ্ট করি। যখন সেই সময়ও পার হতে থাকে, আমিই তাকে ফোন করি। ওপার থেকে কেউ ধরে না। একবার, দুইবার। আর না!

তবু খানিক বিরতি দিয়ে তৃতীয় বার ফোন করি। সে ধরে না। আমি অপেক্ষা করতে থাকি হয়তো যেকোনো সময় তার ফোন আসবে, আমার ফোন না ধরার কারণ সে ব্যাখ্যা করবে। কিন্তু প্রত্যাশিত কোনো ঘটনাই ঘটে না। তখন বাধ্য হয়ে অনেকটা উপসংহারের মতো তাকে এসএমএস পাঠাই:

 “দিন-রাত ডিউটি থাকে নাকি! ফোন করছেন না, ধরছেনও না।কোনো সমস্যা হয়েছে? নাকি আমার আচরণে কোনো ভুল হয়েছে?আমাকে জানান প্লিজ।”

যথেষ্ট হয়েছে, ওকে নিয়ে আর ভাবা যাবে না। আমার পক্ষ থেকে একটা সুস্থ সম্পর্কের জন্য যতোটা উৎকণ্ঠা দরকার তা খরচ হয়ে গেছে। এখন ওর দিক থেকে জরুরী প্রত্যুত্তর না আসলে আমার বুঝা উচিত, আমি ছবিতে আঁকা ফুলের থেকে মধু প্রত্যাশা করছি। যেখানে যা নেই, সেটাকে চাইছি। কিন্তু হায়! মনের উপরিভাগে যেখানে বুদ্ধির নিরস নিরঙ্কুশ অধিকার। আমার যুক্তিবোধ, আমার আত্ম-প্রদত্ত নীতিমালা, সেই আকাট রাজ্যের সীমানা ভেদ করে গভীরে, মাছের পিছল শরীরের চঞ্চল গতির একটা অক্ষরও পাঠ করতে পারে না।

আমার দুর্ভাগ্যও, সে ফোন করলো সেই রাতেই।

 : কী খবর, কেমন আছেন?

 : ভালো তো, বেশ ভাল। আপনি কেমন?

এ হলো মুখোশ পরা দুঃখের পরিমিতিবোধ।

 : ডিউটি করতে করতে জান শেষ ভাই। আর আপনি কী সব লিখে পাঠাইছেন?

আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম না, বরং তাকে বললাম

 : যান, মেসে গিয়া বিশ্রাম নেন।

 : মেসেই যাচ্ছি। তো আপনার অস্থিরতা কমেছে? আমি এই প্রশ্নেরও উত্তর দিলাম না, যেন এই প্রশ্ন একান্ত ভিত্তিহীন। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম,

 : বৌদিরে এখানে নিয়ে আসেন, আপনার তাতে সুবিধা হবে।

: তাই! তাহলে আপনার অস্থিরতা কাটবে? পাকা শিকারির মতো এই প্রশ্নটা করে একটু হাসল। তারপর আবার বলল

: আনবো। একটু সময় লাগবে। আপনার কথা বলেন…

মনে মনে বললাম, আমার কথা আর কি তোমাকে বলি! মুখে বললাম

: এইতো।

 এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে জানাল, আগামীকাল দেখা করার একটা চান্স হতে পারে, আমি কি কাল ফ্রি আছি?

আহা! এর নাম প্রাপ্তি। আমাকে সে জিজ্ঞেস করছে, আমার সময় হবে কি না! বো বক্ত কিস কাম কা যো তুমহে বক্ত না দে পায়ে? মনের মধ্যে আটকে থাকা গোমড়া ভাবটা কেটে গেল। আমি কৃতজ্ঞতায় কিছুটা আরক্ত হলাম। এতোক্ষণ কৌতূহলকে সেনাপতি বানিয়ে আমি যে তার সাথে ঠাণ্ডা যুদ্ধ করছিলাম তার অবসান হলো। আমার কথার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে বেসামাল, বাঁচাল হয়ে উঠলো।

 : ইস! আপনি যদি বিয়ে না করতেন!

 : তাহলে? তার কথায় কৌতুক।

 :তাহলে আমি আপনাকে বিয়ে করতাম।

 : তারপর?

 : তারপর, বিয়ের পর যা যা করতে হয় করতাম।

 : হুঁ। কথার একটা ছন্দ যেন পাচ্ছিলাম, আরো বললাম

 : আপনার দেহ সুন্দর, আপনার মন সুন্দর, আপনার চোখ, আপনি… সবটাই সুন্দর…

 এবার সে জানতে চাইলো, বোধহয় আমার কথা তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।

 : কই? আমি তো কালো?

 : কৃষ্ণও তো কালো, আমার অকাট্য যুক্তি।

 : হুঁ।

এখানেই কথার ইতি আমার অনুভূতির প্রতি অন্যায় অপর্যাপ্ত মনে হওয়ায়, আমি আরো কিছু বলতে চাইছিলাম। কিন্তু সেটা ঠিকভাবে গুছাতে না পেরে বেকুবের মতো বলতে থাকলাম

 : আপনি বিবাহিত। জানি না উচিত কি না। দেহের চাহিদা তো আছেই, দেহাতিরিক্ত একটা কী রকম অনুভূতি আপনার জন্য আমার মনে কাজ করে। ঠিক বুঝাতে পারবো না। হয়তো প্রেম নয়, তবু কী যেন… কেমন কোমল একটা ভাব……

এবার উভয় পক্ষের জন্য সর্বাধিক ভাল উত্তরটাই সে বাছাই করা নিলো। আসলে উত্তর হিসেবে সে আমার সামনে রাখলো একটি নৈর্ব্যক্তিক আয়না—“ নিজেকে প্রশ্ন করেন।”

তারপর শোনা যায় এমন নীরবতা মাঝখানে রেখে সে কথার জাল গুটিয়ে দিল—

“ঠিক আছে—আজ থাক, কালকে আবার কথা হবে। কেমন?”

প্রথমে আয়নাটায় অর্ধস্বচ্ছ কুয়াশা ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। আস্তে আস্তে সেটা ফরসা হয়ে উঠলে সেখান থেকে মেঘমুক্ত রশ্মির মতো বেদনার তীর আমার অহমকে আহত করল। কী চাই ওর কাছে? আমার এই নাজায়েজ অথর্ব অস্থিরতার মানে আমাকে বুঝতে হবে। ব্যাখ্যা করতে হবে আমাদের অসম্পর্কের বিন্যাস।

ঐ ছোকড়া বিবাহিত। দিনে-রাতে ডিউটি দিয়ে কাহিল অবস্থা। ওর কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। মাসের পনের দিন ডিউটি থাকে রাতে, বাকি পনের দিন, দিনের বেলা। ওর ব্যক্তিগত সময় আমার মতো অফুরন্ত নয়। কিন্তু একথাও আমাকে বলে না যে, বাপু আমার সময় নেই, সুযোগ নেই, তুমি অন্য কোথাও ট্রাই করো। বরং প্রদেয় আবেদন ফিরিয়ে দেয় আবেদনকারীর অন্তর্দশনের দরবারে। আর ওর মনের এই নরম ঋদ্ধতার জন্যই তাকে ডিলিট করা যায় না। তাহলে ঐ কষাটে বিধৌত কচি আমের ভিতর প্রজ্ঞার একটা কণা আছে, যেটা আমাকে এতো বলিষ্ঠভাবে টানছে? যেহেতু তার দিক থেকে স্পষ্ট কোনো অনাগ্রহ নেই, প্রজ্ঞা কি এভাবে খেলে আমার মতো মূঢ়মতিদের নিয়ে? যার দরুণ আমার নিজেকে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গতে হয়? তাহলে ভীষণ ব্যস্ত এই বিবাহিত পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কী গতি! কিন্তু কে জানে তাকে এতোখানি মর্যাদা দেওয়া সঠিক কি না! এমনভাবে ঘটনাকে ভাবলে ক্ষতি কী যে, পেটে-চেটে মোটামোটি তৃপ্ত এক যুবা মনের কোনো তুচ্ছ অতৃপ্তি নিয়ে খেলছে। অথবা এ দু’এর মাঝখানে সে নিজেও কোনো অস্থির নির্মাণের অধীন, যা আমার পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। তাকে ফেলাও যাচ্ছে না আবার গেলাও যাচ্ছে না। কী পরিহাস, এই দোটানার মাঝে প্রেম কোথাও নেই! অথচ প্রেমের তৃষ্ণা ছাড়া এই যন্ত্রণার মেয়াদ বাড়ানোর কোনোই কারণ নেই। ইস্! তার অস্থিরতা যদি আমার কাছে বোধগম্য হতো! তার পরিমিতিবোধ আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল।

“আগামীকাল দেখা হবে”—কথাটাকে আমি তার প্রতিশ্রুতিই মনে করেছিলাম। তাই তাকে নিয়ে আমার মনে ঘটমান দ্বন্দ্ব মনেই গুছিয়ে রেখেছিলাম, যাতে তার কাছে সেটা সৎ ভাবে উপস্থাপন করতে পারি। ভেবে রেখেছিলাম তার জন্য একটা গিফট নিয়ে যাবো। কিন্তু আমার আশার উপর ছাই ছিটিয়ে দিতে তার জুড়ি নাই। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলো না, সেটা বড় ব্যাপার নয়। আর্মি প্রফেশানে সবসময় জরুরী ব্যস্ততা থাকে, তাও আবার হাসপাতালের মতো সংবেদনশীল জায়গায়৷ বড় কথা হলো এটাকে সে প্রতিশ্রুতিই মনে করে নি। যার জন্য দেখা হবে না, এই কথাটা ফোন করে, অন্তত এস.এম.এস করেও জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না। অপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে আমিই ফোন দিলাম এবং সে যথারীতি ফোন ধরতে পারলো না। তবে কিছুক্ষণ পরে দেখা করতে না পারার কারণ জানিয়ে আমাকে মেসেজ করলো। দুঃখও প্রকাশ করলো। আমি ফোন না দিলে যা হয়তো সে করার কথা ভাবতেও পারত না। তারপরই আমি, অত্যন্ত শান্ত মেজাজে সকল লিস্ট থেকে তার ফোন নাম্বার ডিলেট করে দিলাম। ডিলেটের সিলসিলা এই থেকে শুরু হয়েছিল…

তখনই যদি ব্যাপারটার মীমাংসা হয়ে যেত, ওর প্রতি শুভকামনা রেখে একটা সেমি ট্র‍্যাজিক সমাপ্তি ঘটতে পারত! কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা সেরকম নয়। কয়েকদিন পরে সে আচমকা একদিন ফোন দিলো। যা যা ডিলেট করেছিলাম তা সব সস্মমানে ফিরে আসলো আমার মোবাইলে। আমার মনে, আবার নিজেকে আমি আবিষ্কার করলাম অনন্ত ঘূর্ণিপাকের ভিতর। এখন আমি এক পারি তাকে মানা করে দিতে, যেন সে আমার সাথে কোনোপ্রকার যোগাযোগ না রাখে। কিন্তু আমি তা করতে পারি না। কেন? মায়ার কারণে? নাকি ওর প্রতি একধরনের সম্ভ্রমবোধ থেকে? নাকি তার কালো শরীরের চৌম্বকীয় টানে, যার আস্বাদ তখনো পাই নি? ইস্! যদি বলতে পারতাম, ভালোবাসার কারণে!  কিন্তু তা তো সত্য নয়। প্রেমের আকাঙ্খা ছিল, প্রেম ছিল না।

তার ফোন পাওয়ার পর আমি আপাদমস্তকে অনুভব করলাম, আমি এ কয়দিন ডাঙ্গায় পড়ে থাকা জিয়ল মাছের মতো বেঁচে ছিলাম। এখন আমার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়েছে। তাই এ কয়দিন কিরকম বেঁচে ছিলাম! মনে মনে কী কী প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম, কীভাবে তাকে আমার মোবাইল ও মন থেকে চিরতরে ডিলিট করে দিতে চেষ্টা করছিলাম, সব গড়গড় করে তাকে বলে দিলাম। তারপর শ্বাস নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

: আমার কথাগুলো কি আপনার কাছে প্রলাপ মনে হচ্ছে?

সে উত্তরে বললো

: না, মোটেও প্রলাপ মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে এসব আপনার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। মানসিক ভাবে ভালো থাকার জন্য মানুষ যে রকম করে।

: বেশ! তাহলে তুমি কী চাও? তোমাকে নিয়ে আমার আবেগ বিপজ্জনক, বিধায় তা ছেটে ফেলার প্রয়াসকে সাবাশি দাও? বলো তাহলে কেন তুমি আমাকে ফোন করেছ?

এই কথাগুলো তাকে বলি নি। তখন তার ফোন পেয়ে আমি এতোই উত্তেজিত ছিলাম যে কী বলছি, কেন বলছি, এবং তার প্রত্যুত্তরে সে কী ইঙ্গিত করছে তা বিচার করার অবকাশ ছিল না।

আমি জানি আপনারা আমার উপর বিরক্ত হচ্ছেন। অতি তুচ্ছ ঘটনাকে, বা যেখানে তেমন কোনো ঘটনাই নেই, সেসব একটা অশুভ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে পেতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা, যা আবার একেবারে নির্ভেজাল-নিখুঁত ভাবে করা হচ্ছে কিনা সেই নিশ্চয়তা আমি দিতে পারবো না। তবু এটা আমাকে করতেই হবে। ধরে নিন এটা আমার প্রতিশোধ স্পৃহা- না ওর প্রতি, না আপনারা যারা আমার লেখা কষ্ট করে পড়ছেন তাদের প্রতি। কিন্তু কেন?

এটা একধরণের স্বৈরাচারী আনন্দ— একটা অন্ধ আক্রোশ। লিখতে আমার যে রকম কষ্ট হচ্ছে; সেই স্মৃতিগুলিকে খুঁড়তে, সেই কষ্ট সেই বিরক্তি বোধ আপনাদের মাঝে সঞ্চারিত করে দিতে পারলে আমার কষ্ট লাঘব হবে এবং আমি আরো কিছুক্ষণ আপনাদের বিরক্ত করে যাব এবং একইসাথে আমি নিজের জন্যেও বিরক্তি কামাই করে যাব।

নিজের জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরিবর্তন না এনে তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সে আমার জন্য করেছে। ফ্ল্যাট পাওয়ার পর যখন সে একা থাকত, অর্থাৎ যখন তার স্ত্রী থাকত না, তখন আমাকে সে তার ফ্ল্যাটে যেতে দিয়েছে। আমরা একসাথে সিগারেট ফুঁকেছি, ইন্টারনেট ব্রাউজ করেছি; একদিন সে আমার জন্য ফার্মের মুরগি অবধি রান্না করেছিল। আমরা একসাথে খেয়েছি, একসাথে একই বিছানায় শুয়েছি। চূড়ান্ত ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার আগে সে আমাকে তার ঠোঁটে চুমো দিতে দিতো, তার বুকে মুখ ঘষতে, তার স্তনের কুসুমে চুমুক দিতে; জিভের ডগা দিয়ে আমি সেখানে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতাম। সে মেনে নিতো।

তার নাভির ঘ্রাণ নিতাম। তার দুই বগলকে ছিন্নভিন্ন করতেও দিতো আমায়, তার বাহুর বলিষ্ঠ পিছল পেশীতে গাল রেখে শুয়ে থাকতে দিতো। তার শরীরে আমার এই হাড্ডিসার দেহের লেপটে থাকাকে সে কিছুক্ষণ সহ্য করত। এসবই তার দয়া। দুই হাতের অঞ্জলিতে তার মুখমণ্ডল ধরে আমি দেখতাম তার গম্ভীরতা, “তুমি হাসো না কেন? তোমার মুখে খুশি নাই কেন? তুমি গম্ভীর হয়ে আছো কেন?”—আমি এসব প্রশ্ন তাকে করতাম। সে অস্বীকার করে একটু হাসতো।

একটু চুষে দেবার পর তার ভেজা শিশ্নটাকে কোথাও ঢুকিয়ে দেওয়ার জরুরী তাগিদ যখন তার মাঝে জেগে উঠত, তখন আর কোনো সোহাগ সে সহ্য করতে পারতো না। তখন কেবল একটা গর্তের চাহিদা! তারপরই অব্যাখ্যাত অনির্ধারিত, পৃথিবীর শেষ পর্বের মতো রহস্যময় এক প্লাবন নামতো তার শরীরে। কিন্তু সেটা যেন কয়েক ফোঁটা ঘন আঠালো তরলের (নোংরা মেঘের মতো রঙ) উন্মেষ থেকে বিলয়ের সংক্ষিপ্ত অভিযাত্রার স্বতন্ত্র একটা ব্যাপার। যার সাথে পূর্বাপর আহ্লাদগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। এরপর তাকে চুমো দিতে চাইলে সে বিরক্তি প্রকাশ করত। তার বাহু জড়িয়ে ঘন হতে চাইলে, সেই শরীর যে একটু আগে আমাকে সহ্য করেছিল; আর কোনো খাতির করতো না। এভাবে বিকেল ঘনিয়ে আসলে তার ডিউটিতে যাওয়ার সময় হয়ে যেত, তখন আমাকে চলে আসতে হতো।

আমি আবদার করতাম।

: আমি যাব না। আজ রাতে তোমার বাসায় থাকবো।

সে যুক্তি দেখাতো।

: আমি তো ডিউটিতে চলে যাব, তুমি কীভাবে থাকবে?

আমি বলতাম,

:তুমি যাও, আমি একাই থাকব।

যেন আমি সত্যিই থাকতে চাচ্ছি। এই মনে করে সে আশঙ্কিত হয়ে উঠতো।

:না, না! অসুবিধা আছে, থাকা যাবে না”।

“না আমি থাকবো”—আমি মিছিমিছি জেদ করতাম, তখন সে আর কিছু বলতো না, বিছানা থেকে নেমে রুমের খুঁটিনাটি কিছু জিনিসপত্র গুছাতে শুরু করত, যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদায়ের মুহূর্ত উৎপন্ন হতো। আমি আমার মোবাইল পকেটে রাখতাম, সিগারেটের প্যাকেটটা রাখতাম, রুমালটা; আস্তে আস্তে শার্টের বোতাম লাগাতাম; সে বলতো,

: কয়েকটা সিগারেট নিয়ে যাও।

আমার নিতে ইচ্ছা করতো না, তবু নিতাম। সে দুয়ার খুলে দিতো, আমি তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখতাম, শীতের বিকাল ফুরিয়ে এসেছে। পথের উপর শুকনো পাতার বিষণ্ণতা দেখতাম, আকাশের দিকে অবাক হয়ে তাকাতাম, চারপাশের গতিশীল পৃথিবীর মাঝে ঢুকতে আমার ভিতরে অনিচ্ছা জাগতো। কিন্তু মৃত ঝরা পাতারা কয়েক মুহূর্তের বেশী আশ্রয় দিতো না। আমি সিএনজি স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যেতাম।

যে আকাঙ্ক্ষা আমার মনে সমস্ত কামনার সম্রাট হয়ে বসেছিল এতক্ষণ—যাকে দর্শনের জন্য দীর্ঘ অনির্দিষ্ট অপেক্ষা; অপেক্ষার প্রহরগুলোয় অন্যান্য আগন্তুকদের বাসনার সাথে টিকে থাকার লড়াই করে যাওয়া, সেই বিজয়ী সম্রাট এখন অথর্বের মতো চিৎ হয়ে পড়ে আছে, একটি মৃত টিকটিকির মতো! যেন একটা শাঁকচুন্নি শুষে নিরস করে দিয়েছে আমার সবথেকে ললিত কামনা।

এরপরও আমি তার ফোনের জন্য ভিক্ষুকের মতো অপেক্ষা করে থাকব।এসএমএস পাঠাব।  হঠাৎ তার আস্তানায় গিয়ে হাজির হবো। মন খারাপ করবো।  আরো হাজারোবার তার নাম্বার, তার মেসেজ মুছে দিয়ে আবার সযত্নে টুকে নিবো। যেখানে প্রেম নেই, স্নেহ নেই, স্বীকৃতি নেই, যেখানে আমার ব্যথা-বেদনা ব্যাকুলতার কেউ গ্রাহক নেই।সেখানেই হৃদয়ের মধুর উত্তাপ আমি খরচ করতে থাকবো অনেক জারজ মুহূর্ত ধরে!

আজ আবার তাকে হারিয়ে ফেললাম; আমূল। আমারই জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে সে মেসেজ দিয়েছিল।

: ডোন্ট এসএমএস মি।

আমি তাকে কল করলে ফোন ব্যস্ত দেখাতো, আমার মোবাইল থেকে তার মোবাইলে কল ঢুকত না। অন্য নাম্বার থেকে কল করাতে ঢুকলো; আমি ক্ষোভ প্রকাশ করলাম, নিশ্চয় এ তার টেকনিক্যাল কারিগরি, যার দরুন আমার মোবাইল থেকে তার মোবাইল এ কল যাচ্ছে না। সে অস্বীকার করলো, আমি অবিশ্বাস করলাম; তাতে তার কী আসে যায়! আমার মনে বিশ্বাস জাগানোর দায়িত্ব কি তার নাকি! সে বললো,

: রাখি এখন।

আমি বললাম,

: না। কিন্তু অবরুদ্ধ অভিমান নিয়ে কোনো কথাও খুঁজে পেলাম না; সে বললো,

: কিছু বলছ না তুমি; আমি রাখি।

আমি ফোন কেটে দিতে পারছিলাম না, বললাম,

: ফোন কেটে দেওয়ার জন্য এতো অস্থির কেন তুমি? আমার সাথে কথা বলতে তোমার ভাল লাগে না?

প্রায় পরিহাসের মতো ছিল তার উত্তর।

: আমার দুই হাতে বাজার; পরে কথা বলবো।

“অ” ধ্বনি তুলে আমি ফোন কেটে দিলাম। তাকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সে আর কোনোদিন আমাকে ফোন দিবে না। আমি জানি, সে আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখতে চায় না। তো সে আমাকে একেবারে ব্লক করে দিক। যাতে আমার এস.এম.এস. ও তার কাছে পৌঁছাতে না পারে। তবে কেন সেই পথ সে বন্ধ করে দিচ্ছে না!

এইসব আমি তাকে লিখে পাঠালাম, সেই মন খারাপ করা ভারী সন্ধ্যায়। 

একটু পরেই তার এসএমএস আসলো,

: “ডোন্ট এসএমএস মি।”

দর্পচূর্ণ হলো গদার আঘাতে। ইতঃপূর্বে তার পক্ষ থেকে এতো স্পষ্ট নিষেধ কখনো আসেনি। আসলে এই চরম নিষেধের জন্য আমিই তাকে বাধ্য করেছিলাম; আমার অজান্তেই। আমি মুক্তি চেয়েছি নিজেরই সৃষ্টি করা মায়াজাল থেকে। পেরেছি কি?

তোমরা আমার জন্য প্রার্থনা করো, যেন আমার হৃদয় মহাবিশ্বের হৃদয়ের সাথে মিশে যায়। যেন আমার ব্রহ্মাণ্ডকে আমি ভালবাসতে পারি। আর কিছু যেন, আমাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে না পারে।

অপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে আমিই ফোন দিলাম এবং সে যথারীতি ফোন ধরতে পারলো না। তবে কিছুক্ষণ পরে দেখা করতে না পারার কারণ জানিয়ে আমাকে মেসেজ করলো। দুঃখও প্রকাশ করলো। আমি ফোন না দিলে যা হয়তো সে করার কথা ভাবতেও পারত না। তারপরই আমি, অত্যন্ত শান্ত মেজাজে সকল লিস্ট থেকে তার ফোন নাম্বার ডিলেট করে দিলাম। ডিলেটের সিলসিলা এই থেকে শুরু হয়েছিল…

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.