
অরণ্য রাত্রি
মুখবন্ধ
ক্লাস থ্রি এর একটি ছেলে কতটুকুই বা বুঝে? অথচ আমার জীবনে এই ক্লাস থ্রি থেকেই আমি শিকার হয়েছিলাম হোমোফোবিয়ার। একদম ছোটবেলা মানে স্কুলে ভর্তি হবার আগে থেকেই আমার প্রিয় খেলনা ছিল পুতুল, ছোট ছোট হাড়ি পাতিল। ছোটদের কাঁচের চুড়ি কেনার প্রতি আমার ছিল অসীম আগ্রহ। পুতুলের বিয়ে দেয়া, হাড়ি পাতিল নিয়ে খেলাধূলা করার প্রশ্রয় পেয়েছিলাম আমি আমার নানির কাছে থেকে। নানি আমাকে কাপড় দিয়ে নতুন নতুন পুতুল বানিয়ে দিতেন। আমার আম্মু আব্বুও এই ব্যাপারে না করতো না কখনো। যখন আমার নানি মারা যান তখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। তার কিছুদিন পর থেকেই আমার আব্বু আম্মু বার বার বলতো পুতুল নিয়ে ছেলেদের খেলতে নেই। খেলতে হবে ফুটবল, ক্রিকেট। আমি তাদের কথা শুনতাম না। আমার ঘর ভর্তি পুতুল আর খেলনা হাড়ি পাতিল ছিল। একবার আম্মুর এক বান্ধবী তার ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেন। তার ছেলে আমার সাথেই পড়তো । তখন আমরা ক্লাস থ্রি তে। আম্মু আমাকে ছেলেটাকে নিয়ে আমার ঘরে গিয়ে খেলতে বললো। সেইদিন আমি প্রথম বুঝতে পারলাম পুতুল, হাড়ি পাতিল আসলেই ছেলেদের খেলনা নয়। কারণ পরের দিন ছেলেটি ক্লাসের সবাই কে মজা করে বলছিল আমি পুতুল আর হাড়ি পাতিল নিয়ে খেলি। আর যায় কোথায়, সারা ক্লাস আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করলো। সাথে সাথে চলল বুলিং…আমি বাসায় গিয়ে পুতুল হাড়ি পাতিল ফেলে দিলাম। দেখলাম আম্মু আব্বুও খুশি। সেদিন আমি প্রথম হোমোফবিয়া কি তার প্রাথমিক পাঠ পেলাম। কিন্তু কেউ জানতেও চাইলো না আমার মনের অবস্থা কেমন ছিল তখন!!!
মূল আলোচনা
বয়ঃসন্ধি মানুষের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। তখন মানুষের যৌন বৈশিষ্টগুলো প্রকাশ পায়। যেমন ছেলেদের দাঁড়ি উঠা, মেয়েদের মাসিক শুরু হওয়া। এই সময় সিস-পুরুষরা সিস-নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয় আর সমকামী মানুষরা একই লিঙ্গের মানুষদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বডি ল্যাংগুয়েজ, কথা বলার ভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসে। স্কুল সমকামী মানুষদেরকে বুলি করার জন্য মনে হয় উপযুক্ত স্থান। কারণ এই বয়সের ছেলে বা মেয়েরা তাদের থেকে আলাদা কাউকে নিজেদের সার্কেলে নিতে চায় না। আর কোন ছেলে যদি একটু মেয়েলি হয়, তার উপর চলে বুলিং এর স্টিম রোলার। নানা ভাবে অত্যাচার করা হয় তার উপর। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা বুলিং করে মজা পায়। তারা ভেবেই নেয় মেয়েলি ছেলেটাকে বুলিং করাটা কোন অপরাধ নয়। এটাই তার প্রাপ্য। সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় কখন তাকে বুলিং এর শিকার হতে হয়। আর শিক্ষকরাও যদি এই ব্যাপার নিয়ে বুলিং করে তাহলে আর যায় কোথায়। বাসায় এসে বাবা মা কে বলতে পারে না বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে। কেউ কেউ বললেও অধিকাংশ মা বাবা তা বুঝতে পারে না। আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছিল আমি আমার স্কুল পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আব্বু আম্মু তা না করে আমার ক্লাস টিচার এর সাথে কথা বলতে গেল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। আমার ক্লাস টিচার আমার সিট পরিবর্তন করে দিলেন। প্রথম দুই-একদিন ভাল গেলেও আবার কিছুদিন পর শুরু হল বুলিং। আমি পড়তে পারতাম না বাসায় এসে। খালি স্কুলের সহপাঠিদের অপমান গুলো চোখের সামনে ভাসতো। কান্না আসতো, আর তার ফলাফল পেলাম এস এস সি পরীক্ষায়। রেজাল্ট ভাল হল না। এরপর অবশ্য বুলিং এর শিকার তেমন আর হতে হয়নি। আমার কলেজ, ভার্সিটি জীবনে আর এই বুলিং এর শিকার হতে হয় নি।
বুলিং এর শিকার হলে মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিষণ্ণতা খুব ভয়াবহ ভাবে চেপে বসে। কিন্তু আমাদের দেশে এই কথা গুলো অভিভাবকরা বুঝতে পারে না। যে ভিক্টিম সেও বুঝতে পারে না কি করা উচিৎ। মানসিক রোগও যে একটা রোগ তা আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ বুঝে না। আর বুলিং এর কারণে কেউ যে মানসিক ভাবে অসুস্থ হতে পারে তা বোঝা তো আরও পরের কথা। এছাড়া সেলফ কনফিডেন্স, আত্মমর্যাদা কমে যায় ভিক্টিমের। কেউ কেউ সুইসাইড করে বা এটেম্পট নেয়। আরেকটা বিষয়, ভিক্টিমদের অনেকেই তাদের কাছের মানুষদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। কেউ কেউ পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এ আক্রান্ত হয়। এ সকল ভিক্টিমের জন্য কাউন্সেলিং খুব জরুরি। সেই সাথে ওষুধেরও দরকার লাগতে পারে।
আমাদের দেশটা খুবই রক্ষণশীল। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ মুসলিম। আর ইসলামে সমকামিতা নিষিদ্ধ। রয়েছে চরম শাস্তির কথা। সমাজে সমকামী মানুষদের দেখা হয় অভিশপ্ত হিসেবে। এমন কি তাদের জন্য সমাজে গজব নেমে আসবে এমন কথাও অনেকে ভেবে থাকে। এরকম প্রতিকূল অবস্থায় কামিং আউট করা কতটা কঠিন তা অনুমেয়। বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবাই যে কামিং আউট কে নেতিবাচক হিসেবে নিবে তা হয়তো না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমাজের মানুষ তাকে আর মেনে নিতে চায় না। সে হয়ে পড়ে একঘরে। অনেকের ক্ষেত্রে বন্ধু বান্ধব আত্মীয়রা এর সমাধান হিসেবে বিয়ের পরামর্শ দিতে থাকে। চলে দিন রাত ধর্মীয় বাণী।
এ তো গেল সমাজের কথা। বাবা মা মানুষের জীবনের সবচেয়ে আপন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের কাছে কামিং আউট করলে বাবা মা ব্যাপারটা মেনে নেয় না। চলে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে শুরু হয় সেই ছেলে বা মেয়ে কে বিয়ে দেয়ার চিন্তা ভাবনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এরকম সমকামী মানুষরা বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিয়ে কি এইভাবে করা বাঞ্ছনীয়? এমন শুনেছি বিয়ের আগের রাতে পাত্র আত্মহত্যা করেছে। বিয়ের পর অনেকেই তার নিজের জীবন নিয়ে হতাশায় থাকে। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। কাউকে বলতেও পারে না সেই কথা। কেউ কেউ ড্রাগ নেয়। কেউ কেউ গোপনে নিজের লিঙ্গের মানুষের সাথে রতিক্রিয়ায় লিপ্ত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে টিকে না। সেটা বরং সাপে বর হয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপর পক্ষ বিয়ে না টেকার জন্য কোর্টে মামলা করে বা মামলার ভয় দেখায়। চায় বিশাল অংকের টাকার ক্ষতিপূরণ।
যে সকল বাবা মা শিক্ষিত তারা অনেকেই নিজের সন্তান কে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে চায়। তারা ভাবে সমকামিতা মানসিক রোগ। কিন্তু সমকামিতা যে কোন মানসিক রোগ নয় তা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমাদের দেশের কিছু মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং কাউন্সেলররা দাবী করেন তারা সমকামিতা ভাল করে দিতে পারেন। কি উপায়ে কিভাবে তারা একজন সমকামী মানুষ কে স্ট্রেট করে দিতে পারেন তা আমার জানা নেই।
একবার একজন রোগীর কাছে শুনেছিলাম সে সমকামী । কিন্তু সে স্ট্রেট হতে চায়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন? তার উত্তর ছিল ধর্মে বাঁধা আছে। এই কথার কি উত্তর আছে? আসলে সমকামিতা কোন অসুখ নয়। তাহলে আমি কিভাবে তাকে সাহায্য করতে পারি? শুধু বলেছিলাম, আপনি যত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা মেনে নিতে পারবেন ততই ভাল। আপনার কাউন্সেলিং করলে হয়তো মেনে নেয়াটা সহজ হবে। কিন্তু সে মনে হয় খুব বিরক্ত হল। জানি না কবে এই অবস্থার উত্তরণ হবে।
কর্মক্ষেত্রে সমকামীরা বুলিং এর শিকার হয়। জানাজানি হয়ে গেলে প্রাইভেট সেক্টরে চাকুরি চলে যাওয়ার সম্ভবনাকে একদম ফেলে দেয়া যায় না।
একাকীত্ব সমকামী মানুষদের জন্য যেন আরেকটি অভিশাপ। যা যে কোন বয়সে হতে পারে। যখন মানুষের সঙ্গীর দরকার হয় তখন একই সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের আরেকজন মানুষ কে খুঁজে পাওয়া দরকার। নাহলে একজন মানুষ একাকিত্বে ভুগতে থাকে। এই একাকিত্ব তাকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত করে। তবে আজ কাল ইন্টারনেটের কল্যাণে সঙ্গী খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। কিন্তু এখন ব্ল্যাকমেইলিং এবং প্রতারণার শিকার হচ্ছে অনেকেই। এই ব্যাপারটা খেয়াল রাখতে হবে।
এছাড়া সমকামী মানুষদের মাঝে বডি ডিসমরফিয়া এবং ইটিং ডিসঅর্ডার হওয়ার প্রবণতা বেশি রয়েছে।
আমার ছোটবেলার একাকিত্ব, বুলিং এর দিনগুলো এখনো আমাকে কাঁদায়। স্কুল জীবনটা আমার কাছে বিভীষিকাময় ছিল। আমি তা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। আমাদের দেশে সমকামী মানুষদের চলার পথে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা। এই সকল প্রতিবন্ধকতা যে কাউকে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তুলে। জীবনে ভাল থাকার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকাটা খুব জরুরী। সহমর্মিতা, সহানুভূতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি ডাক্তার নাই হতে পারি। কিন্তু পাশে থেকে বলতে তো পারি, “তুমি একা নও, আমি আছি তোমার পাশে।”