
Joyee
“আমি অবাক হয়ে গেলাম ভাই ওর কথা শুনে! আজকালকার বাচ্চাকাচ্চারা কি একদমই বোঝেনা বাবা মায়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়? কীভাবে ন্যূনতম সম্মান দেখাতে হয়? কী করে বললো আমাকে ও এই কথা? বুকটা একটুও কি কাঁপলো না?”
“হৃদি কিন্তু আর বাচ্চা না রেহনুমা। ১৯ বছর বয়সে পা দিলো সেইদিন। নিজের মেয়ের বয়স ভুলে যাস বুঝি?”
“চুপ থাক তুই । সব কিছুতে তোর ফাজলামি আর ভালো লাগে না আমার।”
“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, এই যে বসলাম এসে তোর কাছে। এবার একটু দয়া করে বলতো, কী বলেছে হৃদি তোকে? কতক্ষণ ধরে র্যান্ট করে যাচ্ছিস কিন্তু আসল কথাটাই বলছিস না।”
“আমাকে আজকে সকালে এসে বললো কী জানি একটা কথা বলবে। সুন্দর করে দুই কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসলো। তখনিই বোঝা উচিত ছিল আমার, যে এটা খারাপ কিছুর আলামত। নইলে আমার মেয়ে সাত সকালে এত সুন্দর করে চা বানিয়ে নিয়ে আসবে আমার রুমে, তাতো হতে পারে না। তারপর…”
“তুই কিন্তু এখন এক ঘণ্টা ধরে চায়ের বর্ণনা দিবি না আমাকে। এত সময় নেই আজকে আমার তোর জন্য। এক লাইনে আসল কথা বল এখনি।”
“হৃদি লেসবিয়ান। ওর নাকি চার বছরের একটা রিলেশন আছে, মেয়েটার কালকে বিয়ে।” – বাক্যটা শেষ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন রেহনুমা আক্তার, যেন সারাজীবন ধরে নিঃশ্বাস আটকে ছিল তার।
“আচ্ছা। তারপর?”
“তারপর আবার কি? হাউমাউ করে কাঁদলো আমাকে জড়িয়ে ধরে, তারপর সারাজীবনের কেচ্ছা আমাকে শুনালো, বললো তাকে যেন গ্রহণ করে নিই আমি। এই তো।”
“তুই কী বলেছিস ওকে?”
“কিছু না। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। হৃদিকে বলেছি ওর কথা শুনে প্রেশার বেড়ে শরীর অনেক খারাপ লাগা শুরু করেছে। শিরিন আন্টির বাসায় যাচ্ছি, একটু চিন্তা করার সময় দরকার।”
“আচ্ছা।”
“এই তোর রিয়্যাকশন শিরিন? আমি কী করবো এখন এই মেয়েকে নিয়ে? কোথায় যাবো? এত ভাল ভাল জায়গায় সারাজীবন পড়ালাম, মেয়ে আমার এত ট্যালেন্টেড ছিল, কোথায় ভেবেছিলাম একটা ভাল ছেলে বিয়ে করে সুখে থাকবে আজীবন। এটা কী হয়ে গেল? আমি কি আমার পাপের শাস্তি পাচ্ছি শিরিন? আমার মেয়েটাই এমন হলো কেন? এই বাংলাদেশে সে কীভাবে বেঁচে থাকবে? আমিই বা সমাজে মুখ দেখাবো কী করে?” – ডুকরে কেঁদে উঠলেন রেহনুমা আক্তার।
একটা টিস্যু এগিয়ে দিলেন শিরিন আশফাক।
“তুই কি আমাকে কিছুই বলবি না শিরিন? আমি মনে হচ্ছে আজকে মরেই যাবো।”
“হৃদির প্রেমিকার নাম বলেছে তোকে?” – ভাবলেশহীন ভাবে জানালার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো শিরিন।
“হ্যাঁ, নিঝুম। ছবিও দেখিয়েছে। ওর চার বছরের সিনিয়র ছিল।”
“নিঝুম কি স্বেচ্ছায় বিয়ে করছে নাকি পরিবারের চাপে?”
“পরিবারের চাপে কিছুটা, কিছুটা স্বেচ্ছায় ও। নিঝুম চেয়েছিল বিদেশে চলে যেতে, হৃদি চায়নি। হৃদি নাকি এই দেশে অনেক কাজ করতে চায়, অনেক কিছু বদলাতে চায়। নিঝুমের পক্ষে প্রতিনিয়ত পরিবার আর সমাজের সাথে লড়াই করে এই দেশে থেকে যাওয়া সম্ভব না। তাই সে তার নিয়তি মেনে নিয়ে বিয়ে করে লন্ডনে চলে যাচ্ছে স্বামীর সাথে।”
“হৃদিটা একদম আমার মতো হয়েছে, আর নিঝুম তোর মতো।”
কান্না থামিয়ে চমকে উঠলো রেহনুমা আক্তার।
“শিরিন, এখন এসব কথা বলার সময়?”
মুচকি হেসে শিরিন আশফাক বললেন, “দেখলি রেহনুমা, কতগুলো বছর পার হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের অবস্থাটা দেশে একই থেকে গেল, তাই না?”
“তুই কি আমার উপর এখনো রেগে আছিস?” – কিছুটা ভয়ে, কিছুটা দুশ্চিন্তা নিয়ে একটা হাত এগিয়ে শিরিনের হাতের উপর হাত রাখলেন রেহনুমা।
“তুই অন্তত আজকের দিনটায় আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। এমনিতেই হৃদির কথায় আধমরা হয়ে আছিস, আমিও তালিকায় যোগ হলে আজকে আসলেই মরে যাবি তুই।” – বলে ফিক করে হেসে দিলেন শিরিন।
“কি জানি! মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে আমার। আমি তো বিয়ে করলাম। তুই তো আর করলি না।”
“ভাই আমি বিয়ে না করেই সুখে আছি। তোর ফয়সাল সাহেবের মতো একটাকে পাশে নিয়ে রাতে ঘুমাতে হচ্ছে চিন্তা করেই গা টা গুলিয়ে আসে আমার।”
হেসে ফেললেন রেহনুমা আক্তার। বললেন, “বুড়ো হয়ে গেলি, তারপরও একইরকম থেকে গেলি তুই।”
“আর তুই বুড়ি হয়ে গেলি, মা হলি, তারপরও আমার প্রতি তোর ভালবাসাটা এত বছরে এতটুকু বদলালো না।”
হালকা লজ্জা পেয়ে জানালার দিকে তাকালেন রেহনুমা আক্তার। জানালার দিকে তাকিয়েই বললেন, “আমি আসলে তখনো দুর্বল ছিলাম, এখনো আছি। তোদের মত এত সাহসী আর শক্তিশালী কী করে হতে হয় জানা নেই আমার।”
শিরিন আশফাক এগিয়ে এসে রেহনুমা আক্তারের ঘাড়ে নিজের মাথাটা আলতো করে এলিয়ে দিলেন।
“আমি জানি রেহনুমা, এসব পুরনো কথা আর তোকে ভাবতে হবে না। এতকিছুর পরেও যে সারাটা জীবন ভালবেসে গেলি তাতেই কৃতজ্ঞ আমি। আর হৃদিকে বলিস, কষ্টগুলো ফিকে হয়ে আসবে সময়ের সাথে সাথে। পারলে এই গল্পটাও বলিস, কীভাবে মিস রেহনুমা আক্তার আমেরিকান পাত্রকে বিয়ে না করে শিরিন আশফাকের প্রতিবেশী ফয়সাল আহমেদকে বিয়ে করেন। নিশ্চিত আমি, এই গল্প শুনে হেসে লুটোপুটি খাবে ও। ওহ্ আর হৃদিকে এটা বলতে ভুলিস না যেন যে তোর নিজেকে গ্রহণ করতে আরও এক দুই বছর সময় লাগবে, সেই বিশ বছর ধরেই তো চেষ্টা করে যাচ্ছিস, আশা করি একচল্লিশ বছরে পা রাখলে পারবি নিজেকে গ্রহণ করে নিতে। আর তখন হৃদিকেও গ্রহণ করে নিতে পারবি, কোনো সমস্যা নেই।”
রেহনুমা আক্তার হাসছেন। শিরিন আশফাক হাসছেন। মধ্য দুপুরের কড়া রোদ আর দুই চল্লিশোর্ধ নারীর হাসি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
রেহনুমার কাঁচা-পাকা ধূসর চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দিয়ে ঘাড়ে চুমু খেতে খেতে শিরিন বললেন, “আজ থেকে যা আমার কাছে।”
“তাই? কে যেন বলেছিল আজকে আমার জন্য তার সময় নেই?”
রেহনুমার মোবাইলটা নিয়ে শিরিন মেসেজ দিলেন ফয়সাল আহমেদকে, “আজ শিরিনের বাসায় থাকছি, হৃদির মনটা খুব খারাপ, ওকে একটু কফি খেতে নিয়ে যেও।”
শিরিন আশফাক জড়িয়ে ধরলেন রেহনুমা আক্তারকে।
রেহনুমার উত্তাল হৃদয়টা যেন মুহূর্তেই শান্ত হয়ে গেল। দুপুরের কড়া রোদ, শিরিনের বাসার পুরনো বেতের সোফা আর এই আলিঙ্গন – মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন জীবনে এই তিনটি জিনিস থাকে, প্রার্থনা করলো রেহনুমা, যেমনটা করেছিল ঠিক বিশ বছর আগে। যেমনটা করে এসেছে এই বিশ বছরের প্রতিটা দিন।
Joyee wants to love and be loved. She is figuring out life at this moment.