আমি,তুমি……সে

রিয়েল ফ্রেন্ড

আজকের রাতটা কেমন অদ্ভুত। চারপাশে নীরবতা। কোথাও কোন জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ঝড়ের আগে যেমন গুমোট পরিবেশ থাকে ঠিক তেমনি গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। সজল শুধু হেঁটেই যাচ্ছে। ধু ধু বালুকাভূমি যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। সজল হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেল। এ যে তার প্রিয় মানুষটির আর্তনাদ। সজল প্রাণপণে সেখানে যেতে লাগলো। শব্দ আরও জোরাল হচ্ছে। সজল দেখছে তার প্রিয় মানুষটির পাশে অদ্ভুত দেখতে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির সমস্ত দেহ থেকে রক্ত-মাংস খসে পড়ছে। লোকটির মুখ দর্শন করে সজলের মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা এই ভেবে যে একজন মানুষের মুখ এমন বীভৎস হয় কী করে। সজল ভেবে পায়না এই লোকটি কেন তার প্রিয় মানুষটিকে এমন করে ভয় দেখাচ্ছে। সজল কিছু বলে উঠার আগেই দেখতে পায় তার প্রিয় মানুষটি সেই অদ্ভুত লোকটির হাত থেকে নিজেকে রক্ষার্থে নিজের বুকে ছুরি বসিয়ে দিল। সজলের চিৎকারে চারপাশ ভারী হয়ে উঠে। সজলের চিৎকার মায়ের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। মা দরজাতে ধাক্কা দিয়ে বলে কি হয়েছে তোর? মায়ের ডাকে সজল সম্বিৎ ফিরে পেল। এই যে ঘুমে স্বপ্ন দেখছিল। দরজা খুলে হেসে সজল বলে কিছু হয়নি মা। ঘুমে ভূতের স্বপ্ন দেখে ভয়ে চিৎকার করছিলাম। মা সজলের কথা শুনে হেসে বলে পাগল একটা। এই বয়সে কেও ভূতের স্বপ্ন দেখে এমন ভয় পায়? আর ঘুমাসনে। তৈরি হয়ে নাস্তা করতে আয়। নাহলে তোর অফিস এর দেরি হয়ে যাবে বলেই মা ঘর থেকে চলে যায়। সজল ভাবনার রাজ্যে নিমজ্জিত হয়। কে সেই ছেলে যে তার ভালবাসার মানুষ? স্বপ্নে যাকে দেখেছে তাকে সে কখনও এর আগে দেখেছে কিনা মনে করতে পারছে না।

সজল আহমেদ বনেদি পরিবারের একমাত্র সন্তান। বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক। সমাজসেবাও করে থাকেন। মা গৃহিণী কানিজ বেগম। সজলদের ঢাকায় গুলশান-১ এ প্রাসাদ সমতুল্য বাড়ি। মেধাবী ও কৌতূহলী সজল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখছে বছর দুয়েক হল। সুঠাম দেহের অধিকারী সজলের বয়স ত্রিশ প্রায়। অনেক মেয়েই সজলের বাহু বন্ধনে আসতে চেয়েছে। কিন্তু, সজলের কোন মেয়েকে পছন্দ নয়। তার মন খুঁজে বেড়ায় অন্য কোন পুরুষের নির্মল মন। এত বয়স পেরিয়ে গেলেও সজল তার ভালবাসার মানুষটিকে এখনও খুঁজে পায়নি। মানুষের প্রতারণা দেখতে দেখতে সজল সহসাই কাউকে বিশ্বাস করতে পারেনা। বাবা-মা সজলের সাথে সব সময় বন্ধুর মতই মিশে। তারাও সজলের সমপ্রেমিতার ব্যাপারে অবগত। তাদের শত কষ্টের মাঝেও ছেলের পছন্দের মর্যাদা দিয়েছেন।

অফিসে এসে পত্রিকা পড়া সজলের অভ্যাস। প্রথম আলো পত্রিকা খুলে নিজেদের অফিসের মার্কেটিং ম্যানেজার এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটা দেখছিল। এমন সময় তার চোখ আটকে যায় একটা অদ্ভুত খবরে। চট্টগ্রামে ঘুরতে যেয়ে দুজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু ও একজন ঢাকা মেডিকেলে মানসিক বিভাগে ভর্তি। এমনই লেখা ছিল সংবাদে। এমনিতে রাতের স্বপ্ন সজলকে বেশ ভাবাচ্ছিল। এখন পত্রিকার সংবাদও তাকে ভাবাচ্ছে। এই ঘটনার সাথে রাতের স্বপ্নের কোন যোগ নেই তো? এমনি প্রশ্ন খেলে যাচ্ছে তার মনে। তাই সজলের কৌতূহলী মন প্রকৃত ঘটনা জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। সজল অফিস থেকে ঢাকা মেডিকেলে যায়। মানসিক ওয়ার্ডে এসে রোগীর খোঁজ নেয়। রোগীর ব্যপারে তথ্য নিতে গিয়ে জানতে পারে সেলিম তার নাম। সেলিমরা তিনজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম ঘুরতে যায়। সীতাকুণ্ডের এক বাংলোতে সেলিমরা উঠে। বাংলোর পাশেই পাহাড়ি রাস্তায় হাটার সময় প্রচণ্ড একটা বাতাস বয়ে যায়। যে বাতাসে রক্তও জমে যায়। এমন সময় সেলিম নিজের দেহে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতে থাকে। সেলিম তার বন্ধুদের এই কথা বলতে যাবে আর দেখে তার দুই বন্ধুর খণ্ডিত মস্তক মাটিতে পরে আছে। সজল রোগীর আত্মীয়কে জিজ্ঞেস করে এসব জানলেন কিভাবে? জবাবে লোকটি বলে সেলিম হসপিটালে আসার পর এসব বলেই জ্ঞান হারিয়েছে। তারপর থেকে শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছে। আমি তোদের কাউকে ছাড়ব না। সজল সেলিমের কাছে আসতেই সেলিম বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল। বিছানার সাথে তার বেঁধে রাখা শরীর প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি দিতে লাগলো আর বলতে লাগলো সজল তোকে আমি ছাড়ব না। তুই কখনই মাশুক কে পাবিনা। তোকে মেরে ফেলব। এই বলতে বলতে সেলিম আবার জ্ঞান হারাল। সেলিমের এমন বিকট শব্দে সজল ভয় পেয়ে যায়। তারচেয়েও বেশী অবাক হয় এই ভেবে যে সেলিম কি করে তাকে জানে। মাশুক কে? এই ভাবতে ভাবতে অফিসে চলে আসে।

অফিসে এসে সজল কাজে মনোযোগ দেয়। সমস্ত কাজের মাঝেই তার রাতের স্বপ্নের সেই মুখ আর সেলিম এই দুটি বিষয়ই খেলা করছে। হঠাৎ শরীরে জ্বর অনুভব করতে থাকে। কিছু ভাল লাগছিল না বলে বাসায় চলে আসে। রাতে জ্বর বেড়ে যায়। কানিজ বেগম ছেলের এই অবস্থা দেখে ব্যাকুল হয়ে উঠে। ছেলেকে দ্রুত ইউনাইটেড হসপিটালে ভর্তি করান। জ্বরের জন্য তিন দিন সজলকে হসপিটাল এ থাকতে হয়। অসুস্থতার জন্য কানিজ বেগম তার ছেলেকে গত এক সপ্তাহ ঘর থেকেই বের হতে দেয়নি। ঘরে থাকতে থাকতেও সজল হাঁপিয়ে উঠছিল। এক সপ্তাহ পরে অফিসে এসে কাজের অগ্রগতির খোঁজ নিতে শুরু করলো। মানব সম্পদ ব্যাবস্থাপক কাসেম সাহেবকে ডেকে নতুন নিয়োগের ব্যাপারে জানতে চাইলো। কাসেম সাহেব বলল ৮ হাজারেরও বেশী আবেদন জমা পরেছে। তাদের মধ্যে ২৫ জনকে বাছাই করা হয়েছে। আপনি কবে তাদের সাক্ষাৎ নিতে চান সেটা বললেই আমি সব ব্যবস্থা করব। সজল কাসেম সাহেব কে বলে আপনি আজকেই তাদের সবাইকে সাক্ষাতের জন্য জানিয়ে দিন। আগামীকাল সকাল ১০ টা থেকে আমি তাদের সাক্ষাতকার নিব। সজলের নির্দেশ অনুসারে কাসেম সাহেব সব প্রার্থীকে সাক্ষাতকারের কথা জানিয়ে দেন।

.

কিছুদিন আগের ঘটনা…

সেলিমদের ঘটনা মিডিয়াতে আসার পর ব্যাপক আলোড়ন পরে যায়। প্রশাসন ঘটনার বিস্তারিত জানতে তৎপর হয়ে উঠে। কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকায় কাজে তেমন অগ্রগতি ছিলনা। একমাত্র যে এর প্রকৃত ঘটনা বর্ণনা দিতে পারতো সেও আজ পাগল। সীতাকুণ্ডের শীতলপুর গ্রামবাসী যে অনুমানের কথা পুলিশকে বলেছে তা পুলিশ এর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলনা। গ্রামবাসী সবার দাবি এটা অতৃপ্ত আত্মার কাজ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক যুগের মানুষ কি করে এটা বিশ্বাস করতে পারে? পুলিশও ঘটনাস্থল থেকে তেমন কোন আলামত সংগ্রহ করতে পারল না। তাই তদন্ত কর্মকর্তা তার কাজের অগ্রগতির জন্য একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী সেলিমের সুস্থতার অপেক্ষায় থাকলো।

এরও কিছুদিন আগের ঘটনা…

বছর দুয়েক যাবত শীতলপুর গ্রামের মানুষদের মাঝে একটা আতঙ্ক তাদের সর্বদা গ্রাস করে রাখতো। কেউ সন্ধ্যা তো দূরের কথা দিনের বেলায়ও বাংলোর সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করতে সাহস করতো না। সেখানে যারাই আক্রান্ত হয়েছে কাকতালীয়ভাবে সবাই প্রেমিকযুগল ছিল। একদিন ঢাকা থেকে তিনজন যুবক সেখানে বেড়াতে আসলে সেই বাংলোতে উঠে। বাংলোর পরিবেশ দেখে তারা মুগ্ধ। তারা পরিকল্পনা করে এই বাংলোতে থেকে চট্রগ্রাম ঘুরে দেখবে। সেদিন দুপুরে তারা পাশের বাজারে গেলে দেখা হয় এক পাগলের সাথে। পাগলটি তাদের থামিয়ে বলে তোরা জীবন থাকতে এখান থেকে চলে যা। ও কাউকে ছাড়বেনা। পাগলের কথায় তাদের হাসি পায় শুধু একজন ছাড়া। সে ভয়ে বাকি দুজনকে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য বলে। অন্য দুই বন্ধুর হাসির বন্যা আরও বেড়ে গেল। বেটা তুইও পাগল হয়ে গেলি নাকি? পাগল কি বলল আর তুইও তা বিশ্বাস করে নিলি। চল আগে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। অনেক ক্ষুধা লাগছে।

সীতাকুণ্ডের অপার সৌন্দর্যে তারা মুগ্ধ। প্রবাহমান ঝর্নার স্রোতধারার সাথে যেন মিশে গেছে ঘুরতে আসা তিন বন্ধুর আনন্দ উল্লাস। তারা তখনও জানতে পারেনি তাদের ভাগ্যে কি নির্মম মৃত্যু লেখা আছে। সন্ধ্যা হবার আগেই তারা বাংলোর উদ্দেশে রওয়ানা হল। বাংলোর কাছে আসতেই তাদের একজন বলে, চল না পাশের ওই পাহাড়ি রাস্তায় একটু ঘুরে আসি। তারা তিনজনে সেখানে ঘুরে দেখছিল। যে বন্ধুটি ভয়ে ছিল সে কিছু একটা শুনতে পেল। অন্য বন্ধুদের বললে তারা হেসে বলে বেটা তুই এখনও ভয়ে আছিস বলেই এমন মনে হচ্ছে। এই পাহাড়ি এলাকায় অনেক পশুপাখি থাকে। পশুপাখির শব্দ শুনেই এত ভয় পেলে হবে? তাদের এমন সান্ত্বনাসূচক বানীর পরও ভয় যেন তার পিছু ছাড়ছে না। হঠাৎ কেমন একটা গুমোট ভাব দেখা দিল। তৎক্ষণাৎ প্রবল বাতাস প্রবাহিত হতে লাগলো। বাতাস যখন বয়ে যায় তখন তা প্রশান্তি এনে দেয়। কিন্তু, এ বাতাসে আছে ভয়ের আগমনী বার্তা। তারা তিনজনেই দাঁড়িয়ে যায়। ভয়ে তাদের রক্ত জমে যাচ্ছে যেন। তারা কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এমন সময় যে ভয়ে চলে যেতে চেয়েছিল সে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা অনুভব করে পড়ে যায়। ব্যথায় তার শরীর ভেঙ্গে আসছিল। কোনমতে উঠে তার বন্ধুদের দিকে ঘুরতেই সে তাদের খণ্ডিত মস্তক মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দিয়ে দৌড় দেয়। একটা শব্দ যেন তার পিছু আসতে থাকে। সেখানেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

স্থানীয় একটি হসপিটালে তাকে অচেতন অবস্থায় পরের দিন সকালে নিয়ে আসা হয়।ছেলেটির জ্ঞান ফিরলেই তার বাকি বন্ধুদের ব্যাপারে জানতে চায়। বন্ধুদের জন্য সে তার কান্না কিছুতেই থামাতে পারছিল না। কিভাবে কী হল এমন বর্ণনা দিতে দিতে হঠাৎ তার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দিল। তার কণ্ঠের যেন কেমন বিকৃতি ঘটল। সাথে সাথে প্রচণ্ড গতিতে তার সমস্ত দেহ কাঁপতে থাকলো আর বলতে লাগলো আমি তোদের কাউকে ছাড়বনা। এমন বিকট শব্দে মানুষ কথা বলতে পারে কিনা সেটা চিকিৎসকও জানে না। এর কিছু পরে ছেলেটি তার জ্ঞান হারাল। সাথে সাথে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠান হল।

বর্তমান সময়…

সজলের কিছুতেই যেন পিছু ছাড়ছে না সেই রাতের স্বপ্নে দেখা মাশুক আর সেলিমের আক্রোশ। এরই মধ্যে মাশুকের মুখ তার মনে গেঁথে গেছে। কেমন একটা টান অনুভব করছে। যাকে বলে স্বপ্নে পাওয়া প্রেম আর কি। নিজের অজান্তেই মাশুককে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতে থাকলো। ভাবতে লাগলো আদৌ তার দেখা পাবে কিনা। সকালে প্রার্থীদের সাক্ষাতকার নিতে হবে তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে অফিসে গিয়েই যথারীতি পত্রিকা নিয়ে পড়তে লাগলো। সেলিমের মৃত্যুর খবর পত্রিকায় দেখে মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। সজলের যে জানা হল না সেলিমের আক্রোশ কেন তার উপর? মাশুককেই বা কোথায় পাবে? সেলিমের বাসায় গেলে কেমন হয়? এমন ভাবনা থেকেই পত্রিকা অফিস থেকে সেলিমের বাসার ঠিকানা নিয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। কাসেম সাহেবকে ডেকে সজল বলে যায় প্রার্থীদের সাক্ষাতকার নিয়ে যোগ্য প্রার্থী নিয়োগ দিতে। এই বলে সে অফিস থেকে মগবাজারে সেলিমের বাসায় যায়। সেখানে সে সেলিমের শোকার্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর তেমন কোন তথ্য পেলনা। সেলিমের আক্রোশ আর তার মনে গেঁথে যাওয়া মাশুক যে তার কাছে অজানাই থেকে গেল। মন খারাপ থাকায় সে আর অফিস এ ফিরলনা। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগলো। মাশুকের মুখখানা তার সামনেই ভাসতে লাগলো। এমন বিষণ্ণ মনে সজল গান শুনতে ভালবাসে। হাবিবের দিন গেল তোমার পথ চাহিয়া গানটি বার বার শুনতে লাগলো। 

পরেরদিন সকালে অফিসে এসেই সজল সাক্ষাতকারের ব্যাপারে জানতে চাইল। কাসেম সাহেব বলে আপনি থাকলে ভাল হত। জবাবে সজল বলে আপনি আমাদের অফিসের সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি। আমার থেকে আপনার নির্বাচন শতগুণ শ্রেয় হবে। সজলের মুখে এমন কথা শুনে কাসেম সাহেবের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠে। মাসুদুল ইসলাম নামে আপনার বয়সি একজনকে নিয়োগ দিয়েছি। বলেন কি? আমার বয়সি একজন ব্যক্তি রাজ্জাক গ্রুপ এর মার্কেটিং ম্যানেজার এর দায়িত্ব পালন করবে? পারবে তো? সজলের এমন প্রশ্নে কাসেম সাহেব উত্তরে বলেন আপনি এত সিদ্ধহস্তে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারলে সে কেন পারবেনা। সজল তার কোথায় মৃদু হাসে। কবে থেকে কাজে আসতে বলছেন? আগামী সপ্তাহ থেকেই। ভাল করেছেন। নতুন মাসের প্রথম থেকেই যোগ দিক আর আমাদেরও জরুরী হয়ে গেছে। সে যোগ দিলে আমিও একটু রেহাই পাই। কি বলেন কাসেম সাহেব? তারা দুজনেই হেসে উঠেন।

সময় তার আপন গতিতেই এগিয়ে যায়। মাসের প্রথম তারিখেই মাসুদুল ইসলাম রাজ্জাক গ্রুপ এ মার্কেটিং ম্যানেজার হিসাবে কাজে যোগ দেয়। কাজে যোগ দিয়েই মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট এর লোকদের নিয়ে মিটিং এ বসে কুশল বিনিময় করে। কোম্পানির বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা করে। সভা শেষে অফিসের অন্য স্টাফদের সাথে কুশল বিনিময় করে মাসুদ কাসেম সাহেবের রুমে যায়। চা খেতে খেতে কাসেম সাহেবের সাথে কোম্পানির লক্ষ্য ও এর প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়েও কথা বলে। এরপর মাসুদ সাহেব কুশল বিনিময়ের জন্য কোম্পানির এমডি. সজলের রুমে যায়।স্যার ভেতরে আসতে পারি? ইয়েস, কাম ইন। মাসুদ সাহেব রুমে প্রবেশ করতেই সজল চমকে উঠে।

সজল মাসুদকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। মাসুদ সাহেব আবারও বলে, আসতে পারি? 

ও হ্যাঁ, আসুন।

সজল: কেমন আছেন? কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?

মাসুদ: ভালো আছি। তেমন কোন সমস্যা হচ্ছেনা। সবাইকে বেশ সহায়ক মনে হল। আপনি কেমন আছেন?

সজল: ভালো আছি। আপনার বিস্তারিত এখনও জানা হলনা।

মাসুদ: আমি মাসুদুল ইসলাম।

সজল: শুধুই মাসুদুল ইসলাম?

মাসুদ: হ্যাঁ। পড়াশুনা করেছি মালয়েশিয়ার ম্যানিপাল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে। মার্কেটিং এ অনার্স এবং মাস্টার্স। ছোট বেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে বড় ভায়ের কাছেই মানুষ। ভাইয়া কুয়ালালামপুরে ব্যবসা করেন। এসএসসি এর পর আমি ভাইয়ার কাছে চলে যাই। এর আগে আমি চট্টগ্রামে পিআর গ্রুপ এ কাজ করেছি তিন বছর।

সজল: মালয়েশিয়া ছেড়ে দেশে চলে আসলেন যে?

মাসুদ: (মৃদু হেসে) এই দেশই আমার আসল ঠিকানা।

সজল: আই লাইক ইউর থিঙ্কিং।

মাসুদ: স্যার, এখন তাহলে আমি ডেস্কে যাই।

সজল: ওকে।

মাসুদ সাহেব চলে আসার পর সজল আবারো চিন্তার রাজ্যে নিমগ্ন হল। ভাবতে লাগলো মাসুদের যদি অন্য আর কোন নাম না থাকে তাহলে মাশুক কে? মাসুদ কি মাশুক নয়? এমন অনেক ভাবনা সজলের মনে খেলা করতে থাকে। একবার ভাবে মাসুদকে জিজ্ঞাসা করবে মাশুক তার নাম কিনা। আবার নিজেই সমাধান দিতে থাকে। মাসুদকে দেখার পর থেকেই সজলের মনে কেমন এক অজানা আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে থাকে। মনের ঘরে বসন্তের বাতাস আরও বেশী করে বইতে শুরু করে।

মাসুদ সাহেব তার ডেস্কে ফিরে এসে কাজে মনোযোগ দেয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এমডি স্যার এর কথা ভাবতে থাকে। তার সমপ্রেমি মন যে এমন কাউকে মনের ঘরে ঠাঁই দিতে চায়। স্যার কি আমার মতো সমপ্রেমী? ধুর, কী আবোল তাবোল ভাবছি! সমপ্রেমী যদি হতই তাহলে তো তার চোখে সেটা দেখতে পেতাম। নিজেই মনে মনে ভাবতে থাকে আর নিজেই এর সমাধান দিতে থাকে।

দুপুরে লাঞ্চের সময় সজল মাসুদকে একসাথে লাঞ্চ করার জন্য ফোন করে। মাসুদ তাতে সম্মতি জানায়। লাঞ্চের জন্য সজল মাসুদকে অফিসের বাইরে ভিলেজ রেস্তোরাঁতে নিয়ে যায়। সজলের পছন্দ অনুসারে সব খাবারের অর্ডার করা হয়। সজল ইচ্ছা করে মাসুদকে মাশুক বলে ডাকে।

মাসুদঃ আমি মাসুদ, মাশুক নই।

সজলঃ ওহ, সরি।

মাসুদঃ কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?

সজলঃ অবশ্যই।

মাসুদঃ স্যার, মাশুক আপনার কে হয়?

সজলঃ (মৃদু হেসে) আমার একজন বন্ধু।

মাসুদঃ ওহ।

খাবারের সময় দুজনে নীরবে খেয়েই গেছে কোন বাক্য বিনিময় না করে। লাঞ্চ শেষে দুজনেই অফিসে ফিরে আসে।

মাসুদ ভাবতে থাকে মাশুকের কথা। মাশুক কি এমডি স্যারের বিশেষ কেউ? ভাবনার সাথে সাথে তার মনের কোণে মেঘের আভা জমতে শুরু করে। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে আমি তো স্যারের কেউ না। তাহলে কেন শুধু শুধু মন খারাপ করছি?

মাসুদ রাজ্জাক গ্রুপ এ জয়েন করার পর গ্রুপের কর্মদক্ষতা আরও অনেক বেড়ে গেল। তার চৌকস নীতির কাছে অনেক বাঘা কোম্পানিও হার মানতে থাকে। রাজ্জাক ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং রাজ্জাক ফুটওয়্যার শীর্ষে অবস্থান নেয়। রাজ্জাক গ্রুপের কর্ণধার আব্দুর রাজ্জাক সাহেব ৬ মাসের মধ্যেই মাসুদকে মার্কেটিং প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয়। সাথে দেওয়া হয় সার্বক্ষণিক গাড়ি এবং গুলশানে ফ্ল্যাট।

শুভেচ্ছা জানাতে সজল মাসুদকে তার রুমে ডেকে পাঠান।

সজল: কংগ্রাচুলেশনস অফ ইউর সাকসেস।

মাসুদ: থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।

সজল: শুধু কি থ্যাংকস দিলে হবে?

মাসুদ: আজকে আমার ফ্ল্যাটে চলে আসুন। আপনাকে আমি আমার হাতের রান্না করা খিচুড়ি সাথে গরুর মাংসের ভুনা খাওয়াবো।

সজল: তাই নাকি? তাহলে তো অবশ্যই আসতে হয়।

মাসুদ: ওকে, স্যার। তাহলে এটাই ফাইনাল। আজ রাতে আপনি আমার সাথে ডিনার করছেন।

সজল: ওকে, ডান।

মাসুদ কেন জানি নিজের অজান্তেই একটা উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলো। সে যতই সজলকে এড়ানোর চেষ্টা করেছে ততই সজল তার মনে গেঁথে যাচ্ছে। অফিস শেষে বাসায় ফিরেই মাসুদ ঘর গোছাতে লাগলো। ঘর গোছান শেষে রান্নায় মনোযোগ দেয়। স্যারকে খিচুড়ি আর গরুর মাংসের ভুনা বললেও চিংড়ি ভর্তা এবং মুরগীর রোস্টও করলো। রান্না শেষে ফ্রেশ হয়ে স্যার এর অপেক্ষায় থাকলো।

.

আজকে সজলের সময় যেন কিছুতেই কাটছে না। কখন সে মাসুদের বাসায় যাবে এই ভেবে উতলা হয়ে আছে। মাসুদের বাসায় ডিনারে যাবার সময় কিছু গোলাপ ফুল কিনে নেয়। ঠিক রাত সাড়ে ৮ টার দিকে মাসুদের ফ্ল্যাটে চলে আসে। কলিংবেল চাপতেই মাসুদ দরজা খুলে দেয়।

সজলঃ কী করে বুঝলেন আমি চলে এসেছি? দরজার সামনেই কি দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছিলেন?

সজলের প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা থাকলেও সে মুহূর্তে এর উত্তর দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অনেকটাই আবেগ খেলা করতে থাকে মাসুদের মনে।

মাসুদ: আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আপনার গাড়ি আসতে দেখে দরজায় আপনার অপেক্ষায় করছিলাম।

সজল: বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন নাকি ভিতরে আসতে বলবেন?

মাসুদ: ওহ, সরি। প্লিজ কাম ইন।

সজল: ফ্ল্যাটটা বেশ ভালই সাজিয়েছেন। আপনার রুচির প্রশংসা না করে পারছি না।

মাসুদ: ধন্যবাদ, স্যার।

সজল: কে আপনার স্যার? এখন আমি আপনার মেহমান। ইউ ক্যান কল মি জাস্ট সজল।

মাসুদঃ ওকে, স্যার।

দুজনেই একসাথে হেসে উঠে। সজল মাসুদকে গোলাপের তোড়াটা দেয়। তোড়া হাতে পেয়ে মাসুদ কল্পনাতে চলে যায়। সজলের গোলাপের পাপড়ির মতো ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠের মিলন অনুভব করতে থাকে। সজলের ডাকে মাসুদ বাস্তবে ফিরে আসে।

সজল: কিছু ভাবছেন?

মাসুদ: না তো?

সজল: মনে হল কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।

মাসুদ: তাই নাকি?

সজল: ভালবাসার মানুষের কথা মনে করছিলেন নাকি?

মাসুদ: (স্মিত হাসি দিয়ে) কেউ থাকলে না ভাবব!

সজল: (স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে) হুম। আর কত একা থাকবেন? কাউকে তো আপনার মনের ঘরে আসতে দিন।

মাসুদ: মনের ঘরের দরজা তো তার জন্য খুলেই রেখেছি। সে যে এখনও আসছেনা।

সজল: কাউকে মনের ঘরের নিমন্ত্রন দিয়েছেন কি?

মাসুদঃ ভাবছি খুব শিঘ্রই দিব।

সজলঃ ভেরি গুড।

মাসুদঃ শুধু আমি দিলেই কি হবে? আপনার কি অবস্থা?

সজলঃ (কিছুটা অবাক হয়ে) মানে?

মাসুদঃ ( লজ্জায় মাথা নত করে) মানে…শুধু আমার কথাই বলছেন। আপনার মনের ঘরের কথা জানতে চাইছি।

দুজনেই হাসতে লাগলো। মাসুদ বলল, আমার কথা তো অনেক জানলেন। এবার খাবার খেয়ে বলেন আমি কেমন রান্না করতে পারি। রাত অনেক হয়ে গেছে, ক্ষুধাও বেশ লাগছে। সজল সাহেব, এবার চলেন আমরা খেতে বসি। সজল হেসে বলল, চলুন।

সজল: এত খাবার কখন রান্না করলেন? বললেন খিচুড়ি সাথে গরুর ভুনা খাওয়াবেন আর এখন দেখছি কত কিছু। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম।

মাসুদ: আরে না! কিসের কষ্ট? প্রিয় মানুষের জন্য এ তেমন কোন কষ্টই না।

সজল: আমি কি আপনার প্রিয় মানুষ?

মাসুদ চুপ করে থাকে। কথা পালটিয়ে সজলকে প্রশ্ন করে খাবার কেমন হয়েছে?

সজলঃ আপনি বেশ ভালো রান্না করেন। ইচ্ছে করছে যে রান্না করছে তার হাতের আঙ্গুল খেয়ে ফেলতে। রান্না এত ভালো তাহলে তার হাততো আরও বেশী ভালো হবে।

সজল হাসতে লাগলো। সজলের সাথে সাথে মাসুদও হাসতে লাগলো। মাসুদের হাসি সজলের মনে ঝড় তুলতে লাগলো। অন্য রকম এক শিহরণ তার মনে খেলা করতে লাগলো। সজলের খুব ইচ্ছে করছিলো মাসুদকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তার ভালবাসার পূর্ণতা দিতে। ভয়…যদি মাসুদ তার মতো সমপ্রেমী না হয়! নিজের উচ্ছ্বাস নিজের মাঝেই দমিয়ে রাখল।

রাত সাড়ে ১১ টার সময় সজল মাসুদকে বলে আপনাকে আর বিরক্ত না করি। জবাবে মাসুদ সজলকে বলে এমন বিরক্ত হতে খারাপ লাগেনা।

সজল: তাহলে তো বারবার বিরক্ত করতে হয়।

মাসুদ: ইউ আর ওয়েলকাম।

সজল: ইচ্ছে তো করছে আপনার সাথে সারারাত গল্প করে কাটিয়ে দেই। কিন্তু কোন উপায় নেই। সকালেই অফিস। রেস্ট নেওয়া তো দরকার। কী বলেন, মাসুদ সাহেব?

মাসুদ মাথা নেড়ে শুধু হুম বলল।

সজল: আপনার আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ। অনেক সুন্দর একটা সময় পার করলাম। আসা রাখি ভবিষ্যতেও আরও হবে।

মাসুদ: ইনশাআল্লাহ্‌।

সজলঃ আজ তাহলে আসি।

মাসুদ সজলকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। যদিও সজলের প্রস্থান তার মনকে বিষণ্ণ করে তুলছিল। তার মনটাও কেমন যেন করছিল।

সজল গাড়ি ড্রাইভ করছে। গাড়ির এসি অফ করে উইন্ডো খুলে দিল। হঠাৎ একটা অদ্ভুত রকমের বাতাস সজলের কানের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হল। সজল শুনতে পেল কেও তার নাম ধরে মৃদু ভাবে ডাকছে। ভাবল হয়তো মাসুদ তাকে মিস করছে। কিন্তু না, আবারও কেউ ডাকল সজল বলে। সজল পাশে তাকাতেই গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অপর দিক থেকে আসা সিএনজি এর সাথে সংঘর্ষ হয়। মুহূর্তেই পীচঢালা পথ রক্তে লাল হতে থাকে।

.

সজলের চলে যাওয়ার পর মাসুদের মন কেমন এক অজানা সঙ্কায় নিমজ্জিত হয়। তার চোখে শুধু সজলের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। কেন জানি তার অবচেতন মন বলছিল সজলের কোন বিপদ হয়েছে। এমন ভাবনার কারণে তার কপালে প্রিয় মানুষ হারানোর ভয়ে ঘাম জমতে শুরু করে। মনকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছিল না। ভাবল সজলকে একটা ফোন করলে কেমন হয়। সজলকে ফোন করলে কল রিসিভ হয়না। কয়েকবার ফোন করার পরও কেউ ফোন রিসিভ না করায় মাসুদ আরও ঘাবড়ে যায়। সেই মুহূর্তেই মাসুদ গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়। সজলের সাথে কথা না বললে যে তার অস্থির মন আর শান্ত হবে না। সে যে একদম দুশ্চিন্তা করতে পারেনা।

মাসুদ কিছুদুর আসতেই একটা জটলা দেখতে পায়। জটলা দেখেই তার মনে ভয় আরও ঘনিভূত হতে থাকে। সজলের কিছু হয়নি তো? ভয়ে ঘাম দিতে লাগলো। জটলার কাছে আসতেই সে বুঝতে পারে তার ভাবনার বিন্দুমাত্রও ভুল ছিলনা। এ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা না করেই মাসুদ সজল কে তার গাড়িতে করেই হসপিটালে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় সিএনজির দিকে একপলকে চেয়ে থাকে।

এক্সিডেন্টের কারণে সজলের রক্তক্ষরণ হয় যার ফলে রক্তের প্রয়োজন পড়ে। সজলের জন্য ও গ্রুপ রক্তের প্রয়োজন পড়ে। প্রিয় মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় রক্তের জন্য মাসুদ ছটফট করতে থাকে। মাসুদ ভুলেই যায় তার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। ও নেগেটিভ যে সবাইকে দিতে পারে অনেকক্ষণ পরে মাসুদের তা মাথায় আসে। ডাক্তারকে বলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে মাসুদ নিজেই রক্ত দেয়। চেয়ারম্যান স্যারকে সজলের এক্সিডেন্টের কথা জানিয়ে দেয়।

রাজ্জাক সাহেব এবং কানিজ বেগম তাদের একমাত্র সন্তানের দুর্ঘটনার খবর শুনে পাগলের মত হসপিটালে ছুটে আসেন। কানিজ বেগমকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছিল না। রাজ্জাক সাহেব ডাক্তারের কাছে জানতে পারেন মাসুদ তার ছেলেকে হসপিটালে এনে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছে।

রাজ্জাক সাহেব: বাবা মাসুদ, তুমি অনেক ক্লান্ত। তোমার বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন। অনেক রাত হয়েছে। তুমি বাসায় চলে যাও। আমরা দুজন তো আছি।

কানিজ বেগম: হ্যাঁ বাবা। তুমি বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও।

মাসুদ: স্যার আমি একদম ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আপনারা বাসায় চলে যান। আমি তো আছি।

কানিজ বেগমঃ আমি আমার ছেলের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কোথাও যাচ্ছি না।

রাজ্জাক সাহেবঃ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) ঠিক আছে।

দুর্ঘটনায় সজল মাথায় মারাত্মক আঘাত পায়। প্রচুর রক্তক্ষরণও হয়। ভোরের দিকে সজলকে পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার থেকে কেবিনে আনা হয়। রাজ্জাক সাহেব এবং কানিজ বেগম ফজরের নামাজ পড়ে ছেলের প্রান ভিক্ষা চেয়ে আল্লাহ এর কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। বাবা-মায়ের দোআ আল্লাহ কখনও ফেলতে পারেন না। তেমনি সজলের বেলাও হল। সে সময়ই সজলের জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ মেলেই বাবা-মায়ের ক্রন্দনরত মুখ দেখে সজলের চোখ দিয়েও পানি ঝরতে থাকে। কানিজ বেগম ছেলের সামনে গিয়ে সজলের কপালে চুমু দিয়ে আল্লাহ এর কাছে সজলের জ্ঞান ফেরায় শুকরিয়া জানান।

মাসুদকে কেবিনের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সজল বলে আপনি এত ভোরে এখানে?

রাজ্জাক সাহেব: ও-ই তো তোকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে। ও-ই তোকে রক্তও দিয়েছে।

কানিজ বেগম: ওকে অনেক বললাম বাসায় চলে যেতে কিন্তু যায়নি।

মাসুদ: আমার কথা থাক। স্যার, আপনারা এখন বাসায় চলে যান। আমি আছি।

সজলও চাইছিল সে মাসুদের সাথে একা থাকুক। তাই সে বাবা-মাকে বাসায় চলে যেতে বলল। সজল আর মাসুদের জোরে রাজ্জাক সাহেব কানিজ বেগমকে নিয়ে বাসায় চলে আসেন।

সজল এক পলকে মাসুদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

মাসুদ: এমন করে কি দেখছেন? এভাবে দেখলে গলে যাব যে?

সজল: আমি তো কাউকে গলতে দেখছি না।

মাসুদের নীরবতা দেখে সজল প্রশ্ন পালটে সিএনজি ড্রাইভার এর কথা জিজ্ঞেস করে।

সজল: আমি তো ভাবছিলাম তুমি আমাকে ডাকছ। পাশে তাকাতেই দেখি কেউ নাই। এমন সময় দেখি রং সাইড দিয়ে একটা সিএনজি আসছে। সিএনজিকে সেইভ করতে যেয়ে রাস্তার পাশে গাছের সাথে গাড়ি ধাক্কা খায়। গাছের সাথে ধাক্কা লাগার আগে সিএনজির সাথেও গাড়ির সংঘর্ষ হয়।

মাসুদ: হুম।

সজল: সিএনজি ড্রাইভার এর খবর জান? তার জন্যও টেনশন হচ্ছে।

মাসুদ: (অনেকক্ষণ চুপ থেকে) কিছুই বলতে পারবনা। সিএনজি ড্রাইভার এর চিন্তা পরে করলেও চলবে।

সজল: সরি, আমি তুমি করে বলে ফেললাম।

মাসুদঃ মাই প্লেজার।

সজল: শুধু আমি ডাকলেই হবেনা। আমাকেও তুমি করে বলতে হবে।

মাসুদ: (মৃদু ধমকে) এখন পটপট বন্ধ করে ঘুমাও। তোমার বিশ্রাম দরকার। আমি গেলাম।

মাসুদ উঠতে যাবে আর অমনি সজল তার হাত ধরে।

মাসুদ: ( দুষ্টু ভাব নিয়ে) কি?

সজল: না গেলেই যে আমি বেশি ভালো থাকবো।

মাসুদ: তাই?

সজল: হুম…তাই।

সজল: আমি তোমাকে গুন গুন করে অনেক গান গাইতে দেখেছি। আমাকে একটা গান শোনাও না, প্লিজ?

মাসুদ: তার মানে তুমি আমাকে ফলো করতে?

সজল: প্লিজ!

সজলের কথায় মাসুদ হাবিবের কাটে না মায়াবী এই রাত গানটা গাইতে লাগলো। মাসুদের গানের গলা অসাধারণ। গানের এক পর্যায়ে সজল মাসুদের হাত ধরে সামনে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে, আমি কি নিমন্ত্রণ পেতে পারি না?

সজলের এমন কাণ্ড দেখে মাসুদের হাতে স্বর্গ পাওয়ার মত অবস্থা। কি করবে কিছু বুঝতে পারছিল না।

ভালবাসি তোমায়। অনেক অনেক বেশি ভালবাসি। মোর দ্যন মাই লাইফ। কথাগুলো বলতে বলতে মাসুদ সজলকে চুমু দিতে লাগলো। দুজনের ওষ্ঠের মিলন যে কখন হয়েছে কেউ বলতেও পারবেনা।

সজল: মরে যাব তো। এবার আমাকে একটু শ্বাস নিতে দাও?

সজলের কথায় মাসুদ হেসে উঠে। হঠাৎ সজল মাসুদের বুকের বাম পাশে যেখানে হার্ট থাকে সেখানে একটা মাথার খুলির ট্যাটুর মতো দেখতে পায়। দেখতে মনে হচ্ছিল জীবন্ত। এই বিষয়ে মাসুদকে জিজ্ঞাসা করতে যেয়েও থেমে যায়।

সজল যে কয়দিন হসপিটালে ছিল সে কয়দিন বলতে গেলে মাসুদ অলিখিত ছুটি কাটিয়েছে। রাজ্জাক সাহেব এবং কানিজ বেগম মনে করেন আল্লাহর ইচ্ছায় আর মাসুদের সেবায় সজল আজকে সুস্থ। তারা মাসুদকে কখনও কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভোলেনা। ধীরে ধীরে মাসুদও তাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যায়।

দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরে সজল পত্রিকায় পড়ে জানতে পারে সিএনজি ড্রাইভার এর অপমৃত্যুর কথা। ভাবতে থাকে দুর্ঘটনায় সে বেশী আহত হয়েও বেঁচে আছে অথচ যে তেমন আহত হয়নি তার মৃত্যু হল। সজল নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকে। তার কৌতূহলী মন সিএনজি ড্রাইভার এর অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে ভাবতে থাকে। তাকে যে জানতেই হবে কিভাবে মৃত্যু হল তার। নাহলে যে সে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবেনা।

.

গল্পের এতদূরে চলে এসে আজকে এই গল্পের অন্যতম একটা চরিত্র সে এর সাথে পরিচিত হই। পাভেল রহমান। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। জন্ম চট্টগ্রামে। বেড়ে উঠা ইউএসএতে। খুব ছোট থাকতেই বাবা-মা তাদের একমাত্র সন্তানকে শিক্ষার জন্য ইউএসএতে পাঠিয়ে দেন। বাবা-মায়ের স্নেহ মমতা কি সেটা সে ছেলেবেলা থেকেই অনুভব করতে শিখেছে। গোয়াল ছাড়া গরু বলতে একটা কথা আছে। তেমনটা পাভেলের বেলায়ও। ধনীর আদরের দুলাল বলে কখনও অর্থ কষ্টে পড়তে হয়নি। যখন যা চেয়েছে তাই পেয়ে এসেছে। ইউএসএতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু মনকে গঠন করতে শেখেনি। রাফ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। মদ খাওয়া, পার্টিতে যাওয়া, নিত্যনতুন সঙ্গীর শয্যাসঙ্গি হওয়া তার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে যায়। তার মতো সুদর্শন পুরুষের সঙ্গীর অভাবও হয়না যদি পকেটের জোর হয় খুব বেশি।

পাভেলের ইচ্ছা ছিল সে ইউ এস এ তে স্থায়ীভাবে থেকে যাবে। তার সেই ইচ্ছায় ভাটা পরে তার পিতৃবিয়োগে। পিতার অবর্তমানে যে সে ছাড়া আর কেও ছিলনা তার বাবার ব্যবসা আর বিশাল সম্পত্তির দেখাশুনার।

পাভেলের পিতৃবিয়োগের পর তার মা সুফিয়া রহমানের অনেক পরিবর্তন আসে। সে স্বামী হারিয়ে বুঝতে শিখেছে স্বামী-সন্তান কি জিনিস। সমাজ-সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকা সুফিয়া রহমান তার নাড়িছেঁড়া ধনকেও আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত করতে দ্বিধা করেনি। আজ তিনি অনুতপ্ত। তার এই পরিবর্তন ছেলের মনেও মায়ের জন্য মায়া তৈরি করে। তাইতো পাভেল তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বাবার ব্যবসা দেখার জন্য দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

কথায় আছে কয়লা ধুলে ময়লা যায়না তেমনি পাভেলেরও। দেশে আসার পর তার মা ও তার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। পাভেল যে জিনিসকে একবার নিজের মনে করে নিবে সেটা যে তার চাই ই চাই। অনেকটা একরোখা স্বভাবের।

পাভেল উভকামি হওয়াতে রাতের শয্যাসঙ্গি হিসাবে সে ছেলেদেরও ছেড়ে কথা বলতনা। পাভেলের বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল যে যেখানে বাবা-মা তার সন্তানকে ভালবাসতে জানেনা সেখানে কি করে অন্য একজন অপরিচিত তাকে ভালবাসবে। তাই ভালবাসার কোন মূল্য তার কাছে নাই।

পাভেল খুঁতখুঁতে স্বভাবের এবং সৌন্দর্যের পূজারী। একজনকে দ্বিতীয়বার নিজের শয্যাসঙ্গি খুবই কম করত। তেমনি কাজের বেলাতেও। কোন কাজ করাকে সে দুবার করা পছন্দ করত না। সে যতই আয়েশি জীবন উপভোগ করুক না কেন নিজের ব্যবসা দেখার বেলায় ঠিক এর উলটো।

পি আর গ্রুপ চট্টগ্রামের অন্যতম একটি। তার বাবা ছেলের নামানুসারেই রেখেছিলো পি আর গ্রুপ। তাদের গ্রুপের অন্তর্গত ছিল শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, টিএমটি রড ফ্যাক্টরি এবং ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। এত বড় একটি গ্রুপ অব কোম্পানিকে ৩০ বছরের একজন যুবক দক্ষ হাতে পরিচালনা করবে তা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী তো দূরের কথা কোম্পানির কেউই ভাবতে পারেনি।

পাভেলের কাজের ধরনে তার কোম্পানির সব স্টাফ রীতিমত হিমশিম খেত। সবাইকে সময়মত অফিসে আসতেই হবে। তার ইস্পাত কঠিন মনোভাব তার কোম্পানির সব স্টাফদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করত। কাজে কেউ অবহেলা করলে কোন কম্প্রোমাইজ করত না। যদিও দুয়েকজন তার স্বভাবের সুযোগ নিতে চাইত কিন্তু পাভেলের নৈপুণ্যের সাথে কেউ পেরে উঠত না।

পাভেলের বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল তার একমাত্র ছোট চাচার মেয়ে সিমিন রহমানের সাথে তাকে বিয়ে দিবে। সে মোতাবেক দুই পরিবারের মাঝে একটা মৌখিক সম্মতিও ছিল। সিমিন চট্টগ্রাম মেডিকেলের ছাত্রী। দেখতেও দারুণ এবং মার্জিত রুচি সম্পন্ন। সিমিনও পাভেলকে ভালোবাসে। অপেক্ষাতে আছে পাভেলের বধূ হওয়ার।

পাভেলের কাছে এসব ভালবাসার কোন মূল্য নেই। সে যেটা বিশ্বাস করে না সেটা সে করতে পছন্দও করে না। তার মতে বিয়ের কোন মানে নেই। সে চাইলেইত নিত্যনতুন সঙ্গী পাচ্ছে। তাই একজনকে নিয়ে পরে থাকার কোন মানে সে খুঁজে পায়না।

যতই সে উশৃঙ্খল হোক বা যতই ইস্পাত কঠিন মনোভাব দেখাক না কেন তার মনটা ছিল মোমের মত নরম। গরিব দুঃখীদের কষ্ট তাকে ব্যথিত করত। যথাসম্ভব কারো বিপদে আর্থিকভাবে সহায়তা দিতে ভুলত না। ঘূর্ণিঝড় বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে ভুলত না। হয়ত উপরওয়ালা তার এহেন কার্যক্রমে সন্তুষ্ট ছিলেন বিধায় উত্তরোত্তর তার সমৃদ্ধিও হয়েছে। তার এহেন কার্যক্রমের জন্য সমাজে তার গ্রহনযোগ্যতাও বেড়ে যায়।

শুধু সমাজের লোকজনকে না আশে পাশের রাস্তাঘাট সংস্কার করতেও দ্বিধা করতনা। সে ভাবতো যেটা সে নিজেই করতে পারবে সেটা করতে কেন স্থানীয় প্রতিনিধির আসায় বসে থাকবে। সরকারের কোষাগারেও নিয়মিত কর ও খাজনা পরিশোধ করে আসছে। সি আই পি এর খেতাব পেতেও পাভেলকে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি।

নতুনদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া তার অভ্যাসে পরিনত হতে থাকে। তার মতে ইয়ং অ্যান্ড এনারজেটিক যারা তারাই তার অগ্রযাত্রার সহায়ক হতে পারবে। সেই ভাবনা থেকেই সে তার কর্ম ক্ষেত্রে সর্বদা নতুনদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।

দেশের মাটিতেই শুধু রাজত্ব করবে তা কি হয়? তাকে যে দেশের বাইরেও নিজের কোম্পানির অবস্থান তৈরি করতে হবে। তার স্বপ্ন পি আর গ্রুপের রড দিয়ে তৈরি হবে বিশ্বের বড় বড় স্থাপনা। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে মধ্যপ্রাচ্যকে উপযুক্ত ভেবে নেয়। সেই হিসাবে সে তার লক্ষে এগোতে থাকে। তার লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য সে একজন ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। তার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সে মাশুক নামে একজন ২৫ বছরের উঠতি যুবককে নিয়োগ দেয়।

কোম্পানির কাজের স্বার্থে পাভেল নিজেই মাশুককে নিয়ে দেশের বাইরে যেত। কোম্পানিও যেমন সুযোগ দিয়েছে মাশুককে তেমনি মাশুকও হতাশ করেনি। তাদের দুজনের প্রচেষ্টাতে পি আর গ্রুপ দুবাইয়ের আল-নাহিয়ান কোম্পানির সাথে চুক্তি করতে সমর্থ হয়। কোম্পানির এমন সফলতায় পাভেল মাশুককে শুভেচ্ছা জানাতে ভুল করে না। তেমনি মাশুকও।

মাশুক দেখতে যেমন তেমনি তার বাচনভঙ্গি। অনেক কর্মঠ। কোন কাজে হাত দিলে তা অসমাপ্ত রাখা তার স্বভাবের মধ্যে পড়ে না। কাজের বেলায় বেশ খুঁতখুঁতে আর সময় জ্ঞান সচেতন। তার এমন চারিত্রিক গুণাবলি পাভেলের সাথে মিলে যায় যা পাভেলের মনকে নাড়া দেয়। মাশুকের উপস্থিতি পাভেলের মাঝে ভালো লাগার সঞ্চার করে। দিন দিন পাভেল কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করে।

.

মাশুকের কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে পাভেল তাকে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং ম্যানেজার হিসাবে পদোন্নতি দেয়। মাশুকের বসার ডেস্ক পাভেলের রুমের পাশেই করা হয়। পাভেল অফিস এ কখনও মাশুকের আগে আসতে পারেনি। যখনি অফিসে এসেছে মাশুককে তার ডেস্কেই পেয়েছে। কেমন একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব খেলে যেত পাভেলের মনে। যদিও এই প্রতিযোগিতায় সে পরাজিত হতেই বেশি পছন্দ করছে।

পাভেল মাশুকের ডেস্কের দিকে একটা সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দেয়। সবায় ভাবতো হয়তো নিরাপত্তার জন্য এমন ব্যবস্থা। আসলে পাভেল এই সিসি ক্যামেরা দিয়ে মাশুককে দেখত। মাশুককে প্রতি সেকেন্ডে দেখাটা তার অভ্যাসে বদলাতে লাগলো। তার ইস্পাত কঠিন মন কখন যে গলতে শুরু করেছে তা সে নিজেও জানেনা।

মাশুকের চিন্তা পাভেল অনেক আগেই মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। তার চিন্তায় পাভেলের দৈনন্দিন অভ্যাসেরও আমূল পরিবর্তন আসতে থাকে। এখন সে আর আগের মত মদ খায় না তেমনি শয্যাসঙ্গীর ছোঁয়াও খুঁজে বেড়া য়না। তার এই পরিবর্তন তার মায়ের চোখও এড়িয়ে যায়না। মা ভাবে হয়তো সিমিনের সাহচর্যে তার ছেলের এই আমুল পরিবর্তন। সিমিনের সাথে পাভেলের বিয়ের কথাটা পাভেলের সাথে আলোচনা করে ঠিক করবে ভেবে রাতে পাভেলের ঘরে যায়।

মা: তুই কি ব্যস্ত?

পাভেল: নাহ। কেন বলত?

মা: সিমিনের ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?

পাভেল: নাহ। আমি এই বিষয়ে এত দ্রুত ভাবতে চাচ্ছি না। আমার মন যাকে চাইবে আমি তাকে নিয়েই থাকব।

মা: সিমিন তো তেমনই একজন মেয়ে।

পাভেল: আমিও তা অস্বীকার করছি না।

মা: তাহলে সমস্যা কোথায়?

পাভেল: আমি চাই আমার মন তা ঠিক করুক। আমার মন যাকে গ্রহন করবে আমি তাকেই মেনে নিব।

মা: তোর যা ইচ্ছে।

সিমিনের কথা শেষ হতেই মা পাভেলের ঘর থেকে চলে আসে।

মা চলে যাওয়ার পরেই পাভেলের মনে মাশুকের ভাবনা খেলতে থাকে। মাশুকের কথাবার্তার ধরন, তার উপস্থিতি সবকিছুই পাভেলের কাছে জাদুকরি মনে হচ্ছিল। ভাবে মাশুককে একটা ফোন করবে। ফোন দিলে মাশুক কি ভাববে এই ভাবনায় ফোনও করে না। ঠিক করে অন্য একটা নাম্বার থেকে মাশুককে এসএমএস পাঠাবে। যেই ভাবা সেই কাজ।

রাত সাড়ে ১১ টা বাজে। মাশুক ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় সে তার মোবাইলে এসএমএস দেখতে পায়। এসএমএসটিতে লেখা ছিল-

I want you. I cannot live without you. You are mine and always be mine.

অজানা নাম্বার থেকে এমন খুদে বার্তা দেখে মাশুক ভাবতে থাকে কে সে? তার জানামতে এমন কেউ নেই যে তাকে এমন করে লিখতে পারে। তাই মাশুকও এর উত্তরে শুধু এটুকুই লিখল-

Who are you?

মাশুকের রিপ্লাই দেখে পাভেল হাসতে থাকে আবার এটাও ভাবতে থাকে মাশুক কি তার ভালোবাসায় সাড়া দিবে কিনা। নিজেই এর উত্তর খুঁজে নেয়। আমি তো হারতে শিখিনি। আমাকে যে করেই হোক মাশুককে পেতে হবে। ওকে আমার ভালোবাসার মর্যাদা দিতেই হবে। ও শুধুই আমার। সৃষ্টিকর্তা মাশুককে আমার জন্যই সৃষ্টি করেছেন।

এমন সব ভাবনা পাভেলের মাঝে খেলা করতে থাকে।

সকালে জগিং এ যাওয়া পাভেলের অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠেই মাশুককে একটা খুদেবার্তা পাঠাল।

মাশুকও খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে জগিং করে। সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগেই দেখে সে একই নাম্বার থেকে এসএমএস এসেছে যাতে লেখা ছিল-

সুপ্রভাত। সকালের এই পরম সৌন্দর্যের মাঝেও তোমার সৌন্দর্যকে খুব মিস করছি। অপেক্ষাতে আছি তোমাকে আপন করে কাছে পাবার।

মাশুক এসএমএসটি পড়ে হাসতে থাকে আর ভাবতে থাকে কে সে যে তাকে এমন করে অপরিচিত নাম্বার থেকে এসএমএস পাঠাচ্ছে। একটা কল দিয়ে দেখি- এমন ভাবনা থেকেই মাশুক সেই নাম্বারে কল করল।

মাশুকের ফোনকল দেখে পাভেল অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর রিসিভ করে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে মাশুক বলে- হ্যালো। পাভেল চুপ করে থাকে। মাশুক আবারও বলে হ্যালো। এবারও পাভেল চুপ করেই থাকে। মাশুক কোন উত্তর না পেয়ে বলে- আপনি বোধহয় বাকপ্রতিবন্ধি। তাই কথা বলতে পারেন না। ঠিক আছে আপনি আমাকে বার্তা পাঠাতেই থাকেন। আমিও দেখবো আপনি কতদিন কথা না বলে থাকতে পারেন। এই বলে মাশুক ফোন কেটে দেয়।

মাশুকের এমন জেদি কথা শোনার পর থেকে পাভেলের মনে ভালোবাসার ঝড় আরও বেশি করে বইতে শুরু করে। মাশুককে আরও বেশি আপন মনে হতে থাকে। মাশুকের মতোই জেদি আর চ্যালেঞ্জিং মানুষই তার পছন্দ। তাই পণ করে ফেলে যে কোন কিছুর বিনিময়েই সে মাশুককে হারাতে পারবেনা এবং মাশুককেও কারো হতে দিবে না।

.

সকালে অফিসে এসেই পাভেল মাশুককে তার রুমে ডেকে পাঠায়। মাশুককে কারণে অকারণে রুমে ডেকে আনাটা পাভেলের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মাশুক রুমে প্রবেশ করতেই-

পাভেল: গুড মর্নিং। কেমন আছেন?

মাশুক: গুড মর্নিং, স্যার। আই এম অলওয়েজ ফাইন। হোয়াট এবাউট ইউ?

পাভেল: আই এম গুড।

মাশুক: স্যার কি আমাকে কিছু বলবেন?

পাভেল: কিছু বলার জন্যই আপনাকে ডেকে আনা।

মাশুক: আই এম সরি। আসলে হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে বিধায় আপনাকে বলা।

মাশুকের এমন কথা শুনে পাভেলের খুব রাগ হতে থাকে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে-

পাভেল: মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর ট্যুরে যাব। ভাবছি আপনাকে নিয়েই যাব।

মাশুক: আমি গেলে কাজের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

পাভেল: আমি কি আপনার কাছে মুখ্য নই?

মাশুক: অবশ্যই। কোম্পানির স্বার্থটা আগে দেখতে হবে না।

পাভেল: আগে আমার স্বার্থ দেখেন, বুঝেছেন?

মাশুক: ওকে, স্যার। কবে যাওয়ার চিন্তা করছেন।

পাভেল: নেক্সট সপ্তাহেই।

মাশুক: ওকে, স্যার।

পাভেল: শুধু ওকে বললে হবে না। আপনার পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্রাদি ম্যানেজার সাহেবের কাছে আজকেই দিয়ে দিবেন।

মাশুক: আজকেই?

পাভেল: আজকে মানে এখনই, বুঝতে পারছেন?

মাশুক: ওকে, স্যার।

পাভেলের কথামত মাশুক তার পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্রাদি বাসা থেকে এনে ম্যানেজারের কাছে দিয়ে কাজে মনোনিবেশ করে।

এমন সময় মাশুকের মুঠোফোনে এসএমএস আসে যাতে লেখা ছিল-

তোমার খুশিতে আমি খুশি। তোমাকে সুখী করতে সারাটি জীবন আমি থাকবো তোমার পাশে। দিবে কি তোমার পাশে আমাকে ঠাঁয়?

মাশুক এর উত্তরে লিখে- দেখিনি আমি যাকে ক্যামনে দেই ঠাঁয় আমাতে?

এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাশুক উত্তর পায়- খুব শীঘ্রই আসব তোমার সামনে। ভালো থেক।

এসএমএসটা দেখে মাশুকের কেন জানি ভালই লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগল এক পাগলকে সামলাতে ব্যস্ত তার উপর আরেক পাগলের হাতছানি।

এর চারদিন পর—-

পাভেল এবং মাশুকের ভিসা এবং টিকেট কনফার্ম হওয়ার পরদিন রাতেই তারা সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করে। তাদের জন্য প্যানপ্যাসিফিকে রিজার্ভেশন করা ছিল। হোটেলে আসতেই মাশুক দেখে একটি রুম বরাদ্দ দেওয়া। সে কিছুটা অবাক হয়ে যায়। ইতস্তততাও কাজ করতে থাকে। আমার সাথে রুম শেয়ার করলে কি খুব সমস্যা? পাভেল মাশুককে বলে। জবাবে মাশুক বলে- আররে না। আমি ভাবছি আপনার সমস্যা নিয়ে।

পাভেল: সমস্যা হবে না ভেবেইত একটা রুম বুকিং করিয়েছি।

বিমানের সাড়ে তিন ঘণ্টার ভ্রমনে তাদের ক্লান্তি চলে আসে। হোটেল রুমে আসতে আসতে তাদের স্থানীয় সময় রাত আড়াইটা বেজে যায়। পাভেল যে অপেক্ষাতে আছে তার মানুষটিকে আপন করে পাওয়ার। বিছানায় ঘুমোতে যেতে তার নিজেরই কেমন যেন লজ্জা লাগছে।

পাভেলের লজ্জা মাশুকের নজর এড়িয়ে যেতে পারল না। পাভেলকে স্বাভাবিক করতে মাশুক বিছানাতে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত ছিল বিধায় বিছানায় শুতেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ঘুমন্ত মাশুকের মুখ দর্শন করে পাভেল আরও বেশি আবেগি হয়ে যায়। ভাবতে থাকে কি করে এত পবিত্রতা থাকতে পারে তার ঘুমন্ত মুখে। যতই দেখে যেন দেখার তৃষ্ণা ততই বেড়ে যাচ্ছে। এমন সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে নিজেকে কি করে বঞ্চিত করতে পারে তাই এক দৃষ্টিতে মাশুকের দিকে চেয়ে থাকে। ঘুমকে বনবাসে পাঠিয়ে পাভেল সারারাত জেগে থাকে।

সকালে দুজনে ফ্রেশ হয়ে সিঙ্গাপুর দর্শনে বের হয়। প্রথমেই তারা সেরাঙ্গুন মস্তফা সেন্টারে যায়। সেখানে মসজিদ এ দুজনে ফজরের নামাজ আদায় করে। তারপর মস্তফা সেন্টারে বিভিন্ন ফ্লোর ঘুরে দেখে। সে সময় পাভেল মাশুককে অনেক দামি দামি পারফিউম কিনে দেয়। মাশুক পাভেলের এমন আগ্রহ দেখে অবাক হতে থাকে। ভাবতে থাকে পাভেল কি তার প্রতি দুর্বল কিনা? এ-ও ভাবে এসএমএসকারী আর পাভেল একই ব্যক্তি কিনা।

এরপর একে একে তারা বার্ড কেইজ, পোর্ট, সেন্তসা ঘুরে দেখে। সেন্তসার মারলায়ন দেখে পাভেল অবাক হলে মাশুক বলে- এটা হচ্ছে একটা দেবতার মূর্তি যার নিচের অর্ধেক মাছ আর উপরের অর্ধেক সিংহের। সেন্তসার দৃষ্টিনন্দন ভিউতে পাভেল মাশুকের একের পর এক স্ন্যাপ নিতে থাকে। সেখানে তারা ক্যাসিনোতে যায়। মাশুকের পারফর্মেন্সে রীতিমত অবাক হয়ে –

পাভেল: আমার জানামতে দেশে ক্যাসিনো নেই। তুমি তো আমাকে রীতিমত অবাক করে দিলে।

মাশুক: এ তেমন কিছুনা। নেট থেকে গেইম খেলে শিখেছি।

পাভেল: সরি! তুমি করে বলে ফেললাম।

মাশুক: কিসের সরি? আমাকে তুমি করে বললেই আমি খুশি হব।

তারপর তারা মেরিনা বে যায়। সেখানে তারা অনেকক্ষণ সময় কাটায়। এসময় পাভেলের ইচ্ছা করছিল মাশুককে সব খুলে বলতে। মাশুক যদি তার ভালবাসা মেনে না নেয় সেই ভয়ে পাভেল কিছুই বলে না।

সিঙ্গাপুরে তিনদিন থেকে সিল্ক এয়ারে কুয়ালালামপুর আসে। সকাল সকাল চলে আসায় দুজনেই হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে যায়। বুকিত বিন্তাং, কেএল সেন্টার, পেত্রনাস টুইন টাওয়ার ঘুরে পুত্রাজায়া যায়। সেখান তারা দুজনেই তুয়াঙ্কু জয়নাল আবেদিন মসজিদের সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়। তারা আসর এবং মাগরিবের নামাজও আদায় করে সেখানে।

ভ্রমনের ক্লান্তি যেন তাদের উচ্ছ্বাসের কাছে পরাজিত হয়েছে। মাশুক এমন ভাবে সব কিছুর বর্ণনা দিচ্ছিল যে পাভেলের কাছে মনে হচ্ছিল মাশুক একজন মালয়েশিয়ান। পাভেল মাশুককে এমন প্রশ্ন করলে মাশুক হাসতে থাকে। কথা প্রসঙ্গ পালটে বলে খুব ক্লান্ত লাগছে। রুমে ফেরা দরকার। আমারও তাই মনে হচ্ছে বলে পাভেলও সমর্থন জানায়।

এখানেও দুজনে একি রুমে থাকে। সারাদিনের ভ্রমনের ক্লান্তিতে মাশুক বিছানায় যেতেই ঘুমিয়ে যায়। পাভেলেরও তন্দ্রা ভাব ছিল কিন্তু ঘুমাতে পারছিল না। কারণ, পাভেল ঘুমের থেকে যে তার মনের মানুষের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখ দেখতেই বেশি ভালোবাসে। একসময় ঘুমে পাভেলের চোখ লেগে আসলে হঠাৎ তার ঠোঁটে অন্য কারো ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করতে থাকে।

.

পাভেলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে যা অনুভব করেছে তা আসলেই বাস্তব কিনা।

মাশুকও ঘুমের ঘোরে পাভেলকে জড়িয়ে ধরে আর বলতে থাকে- তোমার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে আছি। তোমাকে কত খুঁজেছি। প্লিজ আমাকে একটু আদর কর।

প্রিয় মানুষের এমন আকুল আহ্বান এ কেউ সাড়া না দিয়ে পারে না। তেমনি পাভেলও পাগলের মতো মাশুককে আদর করতে শুরু করে দিল। এতদিনের সঞ্চিত স্বপ্ন আজ বুঝি পূর্ণ হতে চলল। হঠাৎ মাশুক পাভেলকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। পাভেল মাশুকের এমন আচরনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সরি বলে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সোফাতে বসে।

সকালে উঠে কেউ কারো দিকে ঠিকমত তাকাতেও পারছিল না। কথা বলা তো দূরের কথা। সকাল গড়িয়ে দুপুর হওয়ার পথে। পরিকল্পনা মাফিক কিছুই হচ্ছিল না। মাশুক নিজেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য পাভেলকে গেন্তিং হাইল্যান্ডের কথা এমনভাবে বলল যাতে মনে হয় তাদের মাঝে কিছুই হয়নি। পাভেলের যেন প্রাণ ফিরে এল।

গেন্তিং হাইল্যান্ডের মেঘের স্পর্শ তাদের মনকে ছুয়ে দিল। সেখানে তারা ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে দুদিন অবস্থান করল। এবার পাভেল ডাবল বেডের রুম নিল। রুমে যেয়ে দুপাশে দুই বেড দেখে মাশুক মৃদু হাসল। মাশুকের এই মৃদু হাসি দেখে পাভেল সেই হাসির অর্থ বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।

মাশুক হয়ত তাকে ভালোবাসে দেখে এবার রুমের এমন পরিবর্তন দেখে মৃদু হেসেছে- এই ভেবে পাভেলও হাসতে লাগল।

রাতে ঘুমানোর সময়-

পাভেল: তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?

মাশুক: হ্যাঁ। আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। এক পাগলের খোঁজে আছি। তাকে অনেক ভালোবাসি।

পাভেল: এখনও ধরা দেয়নি?

মাশুক: এখনও না। তবে খুব শীঘ্রই দেখা হবে।

পাভেল মাশুকের এমন কথা শুনে মনে মনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে এসএমএসের সেই ব্যক্তিকে মাশুক ভালোবাসে। ইচ্ছে করছে এখনই মাশুককে সব বলে দিতে। আবার ভাবে দেশে গিয়েই মাশুককে সারপ্রাইজ দিবে।

গেন্তিং থেকে তারা দুজনে লাংকাউই যায়। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে তারা মুগ্ধ হয়। পাভেল স্কুবা ডাইভিং এ যেতে খুব ভয় পাচ্ছিল কিন্তু মাশুকের জোরাজুরিতে রাজি হয়। এখানেও তারা দুজনেই প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যায়। পাভেল ঘোরার ফাঁকে শপিংমলে যেতেও ভুল করে না। সেখানে এক ডায়মন্ডের দোকান থেকে পাভেল রিং কিনলে-

মাশুক: ভালোবাসার মানুষের জন্য নিশ্চয়ই।

পাভেল: হ্যাঁ। দেশে গিয়েই ভালোবাসার মানুষের হাতে পরিয়ে দিয়ে সারপ্রাইজ দিবো।

মাশুক: কংগ্রাচুলেশনস ইন এডভান্স।

পাভেল: থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, ডিয়ার।

পাভেলের মুখে ডিয়ার শুনে মাশুক অবাক হল। এই ট্যুরে এসে পাভেল মাশুককে শুধু অবাকই করে যাচ্ছে।

দীর্ঘ দশ দিনের ভ্রমণ শেষে দুজন চট্টগ্রামে ফেরত আসে।

রাতে মাশুক যখন ঘুমাতে যাবে তখন তার মুঠোফোনে সেই নাম্বার থেকে এসএমএস আসে যাতে লেখা ছিল- ওয়েলকাম ব্যাক।

মাশুক রিপ্লাই দিল- সব খবর রাখছেন দেখি।

ফের রিপ্লাই আসে- তুমি সর্বদাই আমার পাশে আছ, ছিলে এবং থাকবে। আগামী শুক্রবার বিকাল ৩ টায় তুমি সিতল্পুরের বাংলো বাড়িতে চলে এসো। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব। ভালো থেক।

মাশুকের কেন জানি ভালো লাগছিল এই ভেবে যে এতদিনের লুকোচুরির অবসান হতে চলেছে।

সকালে মাশুক ঘুম থেকে উঠে দেখে কোন এসএমএস নেই। ঠিক তখনি এসএমএস আসে যাতে লেখা ছিল- এসএমএস না দেখে ঘাবড়ে গেলে? এর আর কী দরকার? শুক্রবার তো দেখাই হচ্ছে, কী বল?

মাশুকও শুধু ওকে লিখে রিপ্লাই পাঠায়।

অফিসে এসেও মাশুক কাজে মন দিতে পারছিল না। মাশুকের এমন অস্থিরতা সিসি টিভিতে দেখে পাভেল মৃদু হাসতে থাকে আর খুশিতে মনে মনে গান গাইতে থাকে।

অফিসের সাপ্তাহিক শেষ কার্যদিবস যেন কিছুতেই শেষ হতে চায় না। তেমনি আজকেও তেমন মনে হচ্ছে পাভেলের কাছে। আজকের পর সে তার কাছের মানুষটিকে আপন করে পাবে। যে মানুষটি তার আমূল পরিবর্তন করেছে।

অফিস শেষে ইচ্ছা করেই পাভেল মাশুককে তার রুমে ডেকে পাঠাল।

ভাবছি আগামীকাল আপনাকে নিয়ে কক্সবাজার যাব। যাবেন নাকি?

পাভেলের এই প্রস্তাব শুনেই মাশুক বলল কাল একজন অধরা মানুষের সন্ধান আমি পাব। যে করেই হোক আমাকে যে সেখানে যেতেই হবে। সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আপনার প্রস্তাব গ্রহন করতে পারছিনা বলে দুঃখিত। এই বলে পাভেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলো।

পাভেল মাশুকের মুখ থেকে এমন কিছুই শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। তার আর বুঝতে বাকি রইলনা যে মাশুক তাকে ভালোবাসে। মনে মনে সে ভালোবাসার স্বর্গ বুনতে লাগল।

পরেরদিন শুক্রবার বিকাল ৩ টায় মাশুক সিতল্পুরের বাংলো বাড়িতে এসে হাজির হয়। এসেই দেখে খুব সুন্দর করে সবকিছু গোছান। বাংলোর প্রবেশ পথ থেকে দোতলার রুম পর্যন্ত গোলাপের পাপড়ি দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে।

গোলাপের পাপড়ির পথ অনুসরণ করতে করতে মাশুক দোতলার রুমে প্রবেশ করে। সব কিছু অন্ধকার। রুমের আলো জ্বালতেই মাশুক যা দেখল তা সে বিশ্বাস করতে পারল না।

পাভেলের রক্তমাখা নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। হাতে সেই ডায়মন্ডের রিং। মাশুকের বুঝতে বাকি রইলনা সেই অধরা ব্যক্তি পাভেল। পাভেল তাকে এমন সারপ্রাইজ দিবে সে এটা ভাবতেও পারেনি। মাশুক বিশ্বাস করতে পারছিলনা যে সে পাভেলের কাছ থেকে গত সন্ধ্যায় শেষ বিদায় নিয়ে আসছে। আর কোনদিনও পাভেলের এসএমএস আসবে না তার কাছে।

সেখান থেকে মাশুক যে কোথায় হারিয়ে গেল তা আজও পাভেলের মৃত্যু রহস্য এর মতো অজানাই থেকে গেল।

.

বর্তমান সময়ে……

সিএনজি ড্রাইভার রফিকুলের অপমৃত্যু সজলকে বেশ ভাবাতে থাকে। হাসপাতাল থেকে রফিকুলের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে টিকাটুলি যায়। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি গত হলে সে পরিবারে কি দুর্গতি নেমে আসে তা রফিকুলের বাড়িতে না গেলে সজলের হয়ত কখনও জানা হতোনা। সজলের মুখে দুর্ঘটনার কথা শোনার পর রফিকুলের স্ত্রী তাহমিনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সজলের সহানুভূতি জানানোর ভাষাও তখন হারিয়ে যায়।

অনেকক্ষণ নিরবতার পর সজল তাহমিনাকে রফিকুলের মৃত্যুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে-

তাহমিনা: হের তেমন কোন সমস্যাই আছিল না। হাতের ব্যথায় কেউরে মরতে দেখছেন?

সজল: শুধু হাতের ব্যথা?

তাহমিনা: ডাক্তারও কিছুই কইতে পারল না। সুমনের বাপ (রফিকুল) আমগোরে এমনে ফালাইয়া চইলা যাইব হেইডা ভাবতেও পারি নাই।

সজল: পুলিশকে জানাইছেন?

তাহমিনা: কি অইব? হেরা কি আমগো মতন গরিব মাইনসের কথা হুনব?

সজল তাহমিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। মনটা তার খুব বিষণ্ণ হয়ে যায়। কিছুতেই রফিকুলের মৃত্যু রহস্য তার মাথায় খেলছে না। হাতে আঘাত পাওয়া ব্যক্তি কিভাবে মারা যায় এমন ভাবনাই খেলতে থাকে। এমন সময় সজলের মুঠোফোনে মাসুদের কল আসে। ফোনকল রিসিভ করতেই-

মাসুদ: আমি হারিকেইন দিয়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোথায় তুমি?

সজল: বাসায় চলে আসছি। কিছু ভালো লাগছে না।

মাসুদ: কেন? (উত্তেজনা নিয়ে) কী হয়েছে তোমার?

সজল: রফিকুলের বাসায় গিয়েছিলাম। ওর মৃত্যুর ব্যাপারটা আমার কাছে খুব খটকা লাগছে। বেচারার পরিবারে আজ দুঃখের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

মাসুদ: রফিকুল কে?

সজল: সেদিনের দুর্ঘটনার সেই সিএনজি ড্রাইভার।

মাসুদ: (রেগে গিয়ে) সেই দুর্ঘটনা ওর জন্যই হয়েছে। ওর এটা প্রাপ্য ছিল।

সজল: (অবাক হয়ে) তুমি এসব কি বলছ?

মাসুদ: সরি বাবা…আমার ভুল হইছে। মাফ চাইছি। তোমাকে আজকে দেখব না এটা কেমন হল?

সজল: চলে এসো।

মাসুদ: ঠিক আছে। অনেক কাজ পড়ে আছে। এখন রাখছি। এত টেনশন করে মাথা নষ্ট করার কারণ নেই। সন্ধ্যায় দেখা হবে। ভালো থেক।

সজল: তুমিও ভালো থেক।

সজলের সাথে ফোনে কথা শেষ করতেই সজলের মা ঘরে প্রবেশ করে।

মা: তোকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন?

সজল: কিছুনা মা। এমনি।

মা: মাসুদের সাথে কি কিছু হয়েছে?

সজল: না। পাগলটা সন্ধ্যায় আসছে।

মা: নিজের যত্ন নে, বাবা। তুই এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠিসনি। তোকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হয়। আমি এই তাবিজটা হুজুরের কাছ থেকে তোর জন্যে এনেছি। আয় তোকে পড়িয়ে দেই।

সজল: মা, তুমি এখনও এই তাবিজ কবজে বিশ্বাস কর?

মা: আল্লাহর কালাম সাথে রাখতে সমস্যা কী? এতে আয়াতুল কুরসি লিখে তাবিজে ভরে দেওয়া আছে। ইনশাআল্লাহ, কোন বিপদ তোকে স্পর্শ করতে পারবে না।

সজল: তোমার দোয়াই আমার জন্য বড় তাবিজ।

মা: আমার দোয়ার সাথে এটা রাখতে তোর সমস্যা কোথায়?

সজল: ঠিক আছে। পরিয়ে দাও। এবার খুশি?

মা: পাগল একটা!

সজল: এবার আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াও। বোধহয় কফি খেলে ক্লান্তি দূর হবে।

মা: ঠিক আছে, আমি রহিমকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

মা ঘর থেকে চলে যাওয়ার পর সজলের তন্দ্রাভাব জেগে উঠে। চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে থাকে। এমন সময় কেও ফিসফিস করে বলতে থাকে- কতদিন নিজেকে বাঁচাবি। যত চেষ্টাই করিস মাশুককে তুই কখনও পাবি না। এই বলে কেউ হাসতে থাকে যা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল।

এমন সময় রহিম কফি এনে সজলকে ডাক দিলে তার তন্দ্রা ভাব কাটে। ভাবতে থাকে সেদিনের দুর্ঘটনার সময় যে কণ্ঠ তাকে নাম ধরে ডেকেছিল সেই কণ্ঠই আজকে তাকে আবার হুমকি দিল। তার মানে কোন অশুভ শক্তি তার ক্ষতি করতে চাচ্ছে যা মায়ের দেওয়া তাবিজের কারনে তার কাছে আসতে পারছে না।

আবার মাশুকের চিন্তা চলে এল সজলের মাথায়। কে সে? তাকে তো সজল চেনে না। আর এখন সে অন্য একজনকে তার জীবনসঙ্গী ভাবতে শুরু করেছে। মাসুদের সাথে মাশুকের কোন সম্পর্ক নেই তো? ভাবতে থাকে মাসুদ আসলেই এই বিষয়ে তাকে সব খুলে বলবে।

অফিস শেষ হওয়ার পরই মাসুদ সজলের বাসায় চলে আসে। সজলের রুমে ঢুকতেই সজল মাসুদকে বুকে জড়িয়ে নেয়। মাসুদও সজলের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে সজলের মাথাকে বুকের সাথে ধরে রাখে আর বলে-

মাসুদ: এই হৃদয়ের সমস্ত কম্পনে শুধু তুমি আছ। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন থাকবে।

সজল: কবি কবি ভাব কবিতার অভাব।

মাসুদ: যে কষ্ট দেওয়া শুরু করে দিয়েছ তাতে কবি না হয়ে কোন উপায় আছে?

মাসুদের কথা শেষ হওয়ার আগেই সজল মাসুদের ঠোঁটে চুমু দিতে শুরু করে। সুখের সাগরে দুজন ভাসতে থাকলে চারপাশ, সময় সব ভুলে যায়। এমন সময়-

মাসুদঃ শ্বাস তো নিতে দাও?

সজলঃ আচ্ছা?

দুজনেই হাসতে লাগল।

তোমার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা আছে। সজল মাসুদকে বলে।

তোমার সব কথাই আমার কাছে অতীব জরুরী কথা। জবাবে মাসুদ সজলকে বলে। কী বলবে বল।

সজল সেদিনের সেই স্বপ্ন থেকে দুর্ঘটনা পর্যন্ত মাসুদকে সব খুলে বলল। সজলের মুখ থেকে সব শোনার পর মাসুদ হাসতে থাকে। বলতে থাকে- আমার বাবুটা শেষমেশ ভূতের খপ্পরেই পড়ল।

আমি হাস্য রসের জন্য কথাগুলো তোমাকে বলিনি। সজল মাসুদকে একটু গম্ভীর ভাবেই বলে।

মাসুদঃ সরি, ডিয়ার! তুমি এত সিরিয়াসলি নিবে আমি ভাবতে পারিনি।

সজল: ঠিক আছে। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তো।

মাসুদ: যথা আজ্ঞা।

সজল: মাশুক কে?

সজলের মুখে এই প্রশ্ন শোনার পর মাসুদের চোখ রক্ত লাল হয়ে যায়। কোন উত্তর না দিয়ে সজলের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সজলও মাসুদের পিছু নেয়।

আমি মাশুকের প্রশ্ন করতেই তুমি এমন রিঅ্যাক্ট করে চলে আসলে কেন? সজল মাসুদকে জিজ্ঞাসা করে। জবাবে-

মাসুদ: তুমি আমাকে একদম বিশ্বাস করোনা।

সজল: বিশ্বাসের কী হল?

মাসুদ: অবশ্যই বিশ্বাসের। তুমি এমন প্রশ্ন অনেক আগেও একবার আমাকে করেছিলে। আমি তখনও বলেছি আর এখনও বলছি আমি মাসুদ। মাশুককে আমি চিনি না, জানিও না।

সজল: কথাগুলো স্বাভাবিকভাবে তখন বললে হত না? আমি সমস্যার মধ্যে থাকলে তুমি কি আমাকে এভাবে ফেলে চলে যাবা?

মাসুদ: তোমার কি তাই মনে হয়?

সজল: কখনই না। আমার চেয়েও বেশী আমি তোমাকে খুব বিশ্বাস করি।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে।

সরি, ডিয়ার। নীরবতা ভেঙ্গে সজল মাসুদকে এমন বলে বুকে টেনে নেয়। চল আজকের এই রাতটা বাহিরে কাটাই। সজলের এমন প্রস্তাবে-

মাসুদ: তাহলেই হইছে? কাল সকালে অফিস করবে কে? জনাব রাজ্জাক সাহেব আমাকে বিনা নোটিশে চাকুরিচ্যুত করবে।

সজল: জনাব রাজ্জাক মানে? বাবা বলতে সমস্যা হয়?

দুজনেই হাসতে লাগলো। চল হাতিরঝিলে কিছুক্ষণ বসে আসি- মাসুদ সজলকে বলে।

জ্বী, জনাব বলে সজলও প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে।

হাতিরঝিলে দুজনেই হাতে হাত ধরে হাঁটতে আর খুনসুটিতে ব্যস্ত। এমন সময়-

সজল: ব্রিজের নিচে বেঞ্চটাতে বসি।

মাসুদ: ঠিক আছে চল।

বেঞ্চে বসতেই মাসুদ চারপাশ দেখে নিয়ে মাসুদকে চুমু দিতে লাগলো। তখন-

মাসুদ: স্যার বুঝি আমাকে সামাজিক ভাবেও মেরে ফেলবেন। কেউ দেখলে খবর করে দিবে।

সজল: আমি আমার সম্পত্তির যা খুশি তাই করব তাতে কার কী?

মাসুদ: অরে বাপরে! ভীষণ সাহসী দেখছি।

সজল: হইছে…এবার একটা গান শোনাও।

মাসুদ: তোমাকে যে হারে গান শোনাচ্ছি এমন করে ক্লোজআপ ওয়ানে অংশ নিলে নিশ্চিত প্রথম হতাম।

সজল: হইছে! প্যান প্যান বন্ধ করে গান শোনাতে বলছি শোনাও। কথা কম।

মাসুদ: জ্বী, জনাব।

মাসুদ তখন লুৎফর হাসানের ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো গাইতে শুরু করলো। মাসুদের গায়কী অসাধারণ। যেকোন গানই খুব সুন্দর রপ্ত করে ফেলতে পারে।

মাসুদ যখন গান গাইতে থাকে তখন সজলের কেমন যেন অনুভূতি হতে থাকে। হঠাৎ সেখানে সজল কাউকে দেখতে পেল। যে একটি গিটার নিয়ে ঘুড়ি গানটি গাইছে।

(গানের কথাগুলো এমন-

ময়লা টি-শার্ট,

ছেঁড়া জুতো

কদিন আগেই

ছিল মনেরই মতো

দিন বদলের

টানা-পোড়েনে

শখের ঘুড়ি নাটাই সুতো

ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো

তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?

তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?

তোমার নিকট অতীত

আমার এক যুগ আগের শীত

পৃথিবী তোমার অনুকূলে থাকে

আমার বিপরীত

তোমার ছোট্ট চাওয়া

আমার বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া

তারপর একা ঘরে মন

জড়সড়

ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো

তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?

তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?

তোমার রোদেলা শহর

আমার রংচটা রংয়ের ঘর

জানালা তোমার অভিমুখে খোলা

দেয়াল নড়বড়

তোমার একটু ছোঁয়া

আমার স্বপ্নকে খুঁজে পাওয়া

তারপর ঘুমভাঙ্গা চোখ

জড়সড়

ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো

তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?

তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?)

গানের প্রতিটি কথার সাথে সাথে ছেলেটির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ছেলেটির কান্না দেখে সজলের খুব মায়া হতে থাকে। ছেলেটির সাথে কথা বলতে সজল তার কাছে যেতে থাকে। সজল যতই কাছে যেতে চাইছে ছেলেটি যেন ততই দূরে চলে যাচ্ছে। সজল ভুলেই যায় মাসুদ তার সাথে আছে। একই গান মাসুদও গাইছে। কিন্তু, ছেলেটার গানই যে সজলকে বেশি টানছে। মনে হচ্ছে এটা যেন গান নয় ছেলেটি তার মনের আর্তনাদ সুরের মাধ্যমে বর্ণনা করছে।

ছেলেটিকে দেখতে যেয়ে সজল যে কখন রাস্তার মাঝখানে চলে আসছে তা টেরও পায়নি। এমন সময় বিপরীত দিক দিয়ে একটা গাড়ি আসতে থাকে যেখানে সজল দাঁড়ান।

.

মাসুদ দ্রুত সজলকে হাত ধরে টান দিয়ে গাড়ির নিচে চাপা পড়া থেকে রক্ষা করে-

– কী হয়েছে তোমার? সেই কখন থেকে আমি তোমাকে ডেকেই যাচ্ছি। তুমি কাকে ফলো করছিলে?

– কেউ একজন এখানে গান করছিল। তার কণ্ঠে ছিল বেদনার সুর।

– আমিতো কাউকে দেখতে পেলাম না।

– কিছু তো একটা সমস্যা আছে। সেদিন তোমার বাসা থেকে আসার পর গাড়ি চালানোর সময় কেউ আমাকে নাম ধরে ডাকছে, আবার গত রাতে মা হাতে এই তাবিজ পরানোর পর থেকে একটা অদৃশ্য লোকের আমাকে হুমকি দেয়া, আবার এখন কারো করুণ সুরে গান গাওয়া। এসব আমার ভ্রম হতে পারে না। নিশ্চয়ই এর সাথে কোন কারণ অবশ্যই লুকিয়ে আছে। আমাকে তা জানতেই হবে।

সজলের এমন কথা শোনার পর মাসুদের মনে ভাবনার উদ্রেক হয়। সে হিসেব মেলাতে পারে না কেন শুধু সজলের উপর এমন অশরীরি আক্রমণ।

– চল বাড়ি ফেরা যাক। আজকে তুমি আমার সাথেই থাকবে।

– ঠিক আছে।

বাসায় ফিরেই দুজনে বিছানায় গেল। সজল মাসুদকে ভালবাসার পরশে ভরিয়ে দিতে লাগলো। আদরে আদরে ভরে দিতে থাকল মাসুদের কপাল, চোখ, ওষ্ঠযুগল। পর্যায়ক্রমে ঘাড় থেকে বক্ষে আদর করতে লাগলো। মাসুদও ভালবাসার আদরে কাঁপছিল। এমনই মুহূর্তে সজল যেই না মাসুদের বুকের বাম পাশে চুমু দিতে যাবে তখন সেখানে ক্রোধের অগ্নিতে জ্বলন্ত একটা মাথার খুলির হুঙ্কার দেখতে পেল। ভয়ে সজল-

– (চিৎকার করে) তোমার বুকে দেখ কি ঐটা?

সজলের কথায় মাসুদ আয়নাতে দেখতে পায় সত্যি সত্যি তার বুকের বামপাশে মাথার খুলি দেখা যাচ্ছে যা একদম জীবন্ত দেখাচ্ছে। সে অবাক হয়ে দেখছে আর ভাবছে- কী করে এমন হওয়াটা সম্ভব? এমন সময় হঠাৎ একটা অদৃশ্য লোকের অট্টহাসি শোনা গেল। সেই হাসির শব্দ দুজনেই শুনতে পেল।

– এবার বল। কী বলবে এসবের? আমি তো কোন মাশুককে চিনিনা। যার জন্য সেই অতৃপ্ত আত্মা আমাকে এভাবে জ্বালাচ্ছে।

– কিছু ভেব না। আমি থাকতে তোমার কোন ক্ষতি হবে না।

মাসুদের আর বুঝতে বাকি থাকল না ব্যাপারটা আসলে কী।

সকাল হতেই মাসুদ সজলকে তার বাড়িতে পৌছে দিয়ে-

– আজকে তোমার অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাসায় থাক। আমি অফিসে যাচ্ছি। একদম দুশ্চিন্তা করবে না। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি বাসা থেকে বের হবে না।

– ঠিক আছে।

মাসুদ সজলকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলে-

– (সজল অবাক হয়ে) কী হয়েছে তোমার?

– কিছু হয়নি। তোমাকে আমি হারাতে পারব না।

– আমিও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।

ঠিক আছে। আমি চললাম- বলেই মাসুদ সজলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে যায়।

দুপুরের দিকে হঠাৎ সজলের মুঠোফোনে মাসুদের একটা খুদে বার্তা আসে। যেটাতে লিখা ছিল-

“অনেক অপ্রিয় সত্য ঘটনা তোমার অজানা ছিল যা আজ আমি তোমাকে সব কিছু তোমার মেইলে জানিয়েছি। তুমি মেইলটা পড়ে নিও। বেঁচে থাকলে দেখা হবে।’’

সজল সময় ক্ষেপণ না করে দ্রুত মেইল চেক করতে যায়। মেইলে যা লেখা ছিল-

প্রিয় সজল,

এই পৃথিবীতে নিজ চোখে অনেক জিনিস দেখা যায় বা নিজ কানে যা শোনা যায় তা আসলে আদৌ সত্য নয়। তেমনি আমি, মানে মাসুদুল ইসলাম, সত্য নই। আমি মাশুক যার জন্য তোমাকে এত কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। তোমার কি মনে আছে মালয়েশিয়ার কথা? তুমি তোমার বাবা-মায়ের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলে সেই আজ থেকে ৫ বছর আগে। গেন্তিং হাইল্যান্ডের সেই দুর্ঘটনার কথা নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাওনি। ক্যাবল কার থেকে আমি যখন পড়ে যাচ্ছিলাম এই তুমি আমাকে বাঁচিয়েছিলে। আমাকে জাস্ট বললে আপনার কিছু হয়নি তো? আমি তোমাতে এতই আবিষ্ট ছিলাম যে কিছুই বলতে পারলাম না। আমার জীবন রক্ষাকারীকে আমি তখনই মনের মাঝে গেঁথে নেই। সেদিনের পর থেকে আমি তোমাকে ফলো করতে থাকি যতদিন তোমরা মালয়েশিয়াতে ছিলে। আমি তোমাদের সাথেই ঢাকা আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু টিকিট স্বল্পতার কারনে দুই দিন পরে আসি। তোমার কোন ঠিকানা আমার কাছে ছিল না। অনেক খোঁজ করি তোমার। সিদ্ধান্ত নেই এদেশে থেকে যাব। বাধ সাধে আমার বড় ভাই। সে আমাকে ফেরত যাবার জন্য টাকা পাঠান বন্ধ করে দেয়। সিদ্ধান্ত নেই চাকুরি করব আর তোমাকে খুঁজে যাব। পাভেল রহমানের পি আর গ্রুপে আমার জব হয়ে যায়। চাকুরির জন্য চট্টগ্রামে যেতে হয়। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ৩টি বছর পার করে দেই। এরই মাঝে পাভেল আমার ভালবাসায় দুর্বল হয়ে পড়ে। আমি যে পাভেলকে আমার ভাল বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবিনি। তোমাকে না পেয়ে যখন আশা ছেড়ে দিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম পাভেলকে আর বঞ্চিত করব না ঠিক সে সময়ে আমি তোমার দেখা আবার পেলাম। আমাদের অফিসে তুমি একটা চুক্তি সইয়ের জন্য আস। তোমাকে দেখে আমি আবার আমার আশা ফিরে পেলাম। খুশিতে আমি পাভেলকে আমার সব কথা বলি। সে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। সে যেকোন মূল্যে আমাকে তার করে পেতে চেয়েছিল। তোমাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সে কিলার জুমনকে নিয়োগ করে। আমি সেই মুহূর্তে পাভেলের ফোনালাপ শুনে ফেলি। রাগে আমার সমস্ত দেহ কাঁপতে থাকে। এই রাগটাকেই আমি কখনও নিয়ন্ত্রন করতে পারিনি। চতুরতার সাথে আমি পাভেলের সাথে শুক্রবার বিকালে শীতলপুর বাংলোতে দেখা করার প্রস্তাবে রাজি হই আর পাভেলের মোবাইল থেকে কিলার জুমনের নাম্বার নেই। জুমনকে ফোন করে আমার নির্ধারিত জায়গায় আনিয়ে প্রথমে আমি ওকে খুন করি। ভাবতে থাকি পাভেল বেঁচে থাকলে ও তোমাকে আবার মেরে ফেলার চেষ্টা করবে। তাই ওকেও মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই। সেদিন বিকাল ৩ টায় আমি শীতলপুরের সেই বাংলো বাড়ীতে যাই। গিয়ে দেখি পাভেল আমার সাথে মিলনের পূর্ণ আয়োজন করেছিল। আমিও সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাই। পাভেল ভালোবেসে আমাকে আপন করে কাছে পেতে আমার কাছে আসতেই আমি ৩ বার ওর বুকের বাম পাশটাতে চাকু বসিয়ে দেই। সেখানেই সে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরে। এরই মাঝে আমি মালয়েশিয়াতে এসে আমার নাম আর লুক চেঞ্জ করে পুনরায় ঢাকা এসে তোমাদের কোম্পানিতে জয়েন করি। তোমাকে কাছে পেয়ে আমি আমার জীবন আবার গড়তে থাকি। যখন শুনি রফিকুলের সিএনজি এর সাথে তোমার কারের এক্সিডেন্ট হয়েছে তখন আবার আমার সেই ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠে। তোমাকে কেউ আঘাত করলে তাকে আমার মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে, আর তাই আমি রফিকুলকে হাসপাতালে শ্বাসরোধ করে হত্যা করি। এত কিছুর পরও আবার বাধা। এবার পাভেলের অতৃপ্ত আত্মা। পৃথিবীর কোন শক্তি তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না যতদিন আমি জীবিত আছি। আমি চললাম শীতলপুরে যেখানে আমি পাভেলকে নিজ হাতে হত্যা করেছি। এর শেষ যে আমাকেই করতে হবে। বেঁচে থাকলে আমি আবার তোমার কাছেই ফিরে আসবো। জানিনা এই আমাকে তুমি তখন গ্রহণ করবে কিনা। ভালোবাসি তোমাকে। অনেক বেশি ভালোবাসি।

মাসুদ।

মেইল পড়ে সজল বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়তে লাগল। মাসুদের সব স্মৃতি তার চোখের সামনে ভাসতে থাকল। মাসুদের কথা মনে আসতেই মোবাইল নিয়ে মাসুদের নাম্বারে ফোন করতে লাগল। প্রতিবারেই সেই একই অট্টহাসির আওয়াজে ফোন রিসিভ হয়। সজল বুঝতে পারে মাসুদের কাছে সরাসরি না গেলে কোন কিছুতেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। তাই সে সময় ক্ষেপন না করে দ্রুত শীতলপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

.

সজলের কাছে মেইলের মাধ্যমে সব কিছু স্বীকার করে মাসুদ মানে মাশুক চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের শীতলপুরে সেই বাংলো বাড়িতে বিকালের মধ্যেই চলে আসে। মাশুকের আগমনের সাথে সাথে যেন চারপাশে এক অদ্ভুত রকমের হিমশীতল বাতাস বয়ে যেতে লাগলো। পাখিদের কলরব বেড়ে গেল। চারপাশ যেন জানান দিয়ে যাচ্ছে মাশুকের আগমনী বার্তা।

মাশুকের মনে বিন্দুমাত্র ভয় কাজ করছিল না। বরং, সে পাভেলের অতৃপ্ত আত্মাকে খুঁজছিল।

– আমি জানি তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ। তোমার খুনি আমি। আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমাকে মেরে তোমার খুনের প্রতিশোধ নিয়ে সজলকে মুক্তি দাও।

– ( অট্টহাসির সহিত) তোমাকে অবশ্যই আমি শাস্তি দিব। তবে সেটা তোমাকে মেরে নয়। তোমার সম্মুখে সজলকে মেরে। সজলের মৃত্যুর পর যে শোকে তুমি ভুগবে সেটাই হবে তোমার শাস্তি আর আমার মুক্তি।

এই বলেই সে আওয়াজ আর তখনকার সেই পরিবেশ কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মাশুক বুঝতে পারে সজল তার জন্য এখানে আসবেই। তাকে যে করেই হোক এখানে আসা থেকে আটকাতে হবে। তাই সে সজলের মোবাইলে কল করে। কল রিসিভ হতেই সেই অট্টহাসির আওয়াজ। মাশুক বুঝতে পারে এভাবে সে সজলের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেনা। এখান থেকে ফিরে যাবার কোন উপায়ও নেই। তখন ভাবনার জগতে মাশুক হাবুডুবু খেতে থাকে।

এমন সময় এক পাগল কিসিমের এক লোক এসে সেখানে হাজির হয়ে-

– এতদিন পরে তুই আইছস। আরও আগে আসলে নিরীহ ৩ জন মানুষের জান দিতে হত না।

– কে আপনি?

– তুই আমারে চিনবিনা। আমি তোর সব জানি। তুই যে পাপ করছস হের প্রায়শ্চিত্তও তোকেই করতে হবে।

– আমি সেই প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি। আমাকে বলে দেন কিভাবে করব।

– তুই এখনি বাবার দরবারে যেয়ে আল্লাহ এর কাছে মাফ চা। তুই তখনই তোর মুক্তির পথ খুঁজে পাবি।

কথাগুলো বলার সাথে সাথেই পাগল কিসিমের লোকটি কোথাও যেন হারিয়ে গেল।

মাশুকও সময় নষ্ট না করে ফটিকছড়িতে বাবার দরবারের দিকে রওয়ানা হয়।

এই সময়ে সজল সীতাকুন্ডে এসে পৌঁছায়। কিছুদূর সামনে যেতেই সে মাশুককে দেখে গাড়ী বন্ধ করে তাকে ডাক দেয়। মাশুক সজলকে দেখেই দৌড়ে ছুটে আসে।

– তোমাকে বলেছি আমি না ফেরা পর্যন্ত বাসা থেকে বের হবেনা। কেন তুমি এখানে এসেছ?

– আমার জীবন রক্ষা করতে তুমি এখানে নিজের জীবন বিপন্ন করতে এসেছ আর আমি বাড়িতে স্বার্থপরের মত বসে থাকব?

– দুশ্চিন্তার আর কোন কারণ নেই। সব ঠিক হয়ে গেছে।

– তাহলে চল আমরা ঢাকা ফিরে যাই।

– কি বল? তুমি সেই বাংলো বাড়িটা না দেখেই চলে যাবে?

– দরকার নেই আমার সেই অশুভ বাংলো বাড়ি দেখার।

– (মাশুকের চোখ দুটি রাগে লাল হয়ে) তোমাকে যে যেতেই হবে। নাহলে আমি অতৃপ্তই থেকে যাব।

সজলের বুঝতে বাকি থাকলোনা এটা মাশুক রূপী পাভেলের অতৃপ্ত আত্মা। সে কিছু না বলেই গাড়ি করে সেই বাংলোতে যায়। বাংলোতে আসতেই মাশুক রূপী সেই আত্মা উধাও হয়ে যায়। হঠাৎ সে মাশুকের আর্তনাদ শুনতে পায়। সজল দৌড়ে বাংলোটির দ্বিতীয় তলায় যায় যেখান থেকে আর্তনাদের শব্দ আসছিলো। সজল দেখতে পায় সেখানে মাশুককে দেয়ালের সাথে হাতে পায়ে ক্রুশ বিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। মাশুকের এই অবস্থা দেখে সজলের চিৎকারে চারপাশ ভারি হয়ে উঠে। তখন সেই অট্টহাসির শব্দ আবার শুনতে পাওয়া যায়।

– এক শর্তে মাশুককে ছাড়বো।

– কি শর্ত?

– তোর হাতের তাবিজটা খুলে বাইরে ফেলে দে।

কি করবে কিছুই মাথায় আসছিল না। মাশুকের জীবন বাঁচানোই তার কাছে মুখ্য মনে হতে থাকে। তাই সে দ্বিতীয়বার না ভেবেই হাত থেকে তাবিজটা খুলে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

তাবিজ ফেলে দেওয়ার সাথে সাথে মাশুকের অবয়ব সেখান থেকে উধাও। সজল বুঝতে পারে সে মায়ার জালের ফাঁদে পা দিয়েছে। সে আল্লাহকে স্মরন করতে থাকে। এমন সময়-

– আমি চাইলে তোকে অনেক আগেই মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু এমন একটা সময়ের অপেক্ষাতে ছিলাম। তোর জন্য মাশুক আমাকে যেভাবে মেরেছিল আমিও তোকে সেভাবেই মারব।

এমন কথাগুলো শেষ হতে না হতেই একটা অদৃশ্য চাকু সজলের দিকে ছুটে আসছিল। সজল মনে প্রাণে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। হঠাৎ সব কিছু যেন স্বাভাবিক হয়ে যায়। সজল বুঝতে পারে পাভেলের অতৃপ্ত আত্মা কোথাও ছুটে যাচ্ছে।

সজলও দ্রুত সেখান থেকে নিচে নেমে আসতেই পাগল কিসিমের সেই লোকটাকে দেখতে পায়।

– ফটিকছড়িতে বাবার দরবারের কাছে গেলেই তুই সব কিছু বুঝতে পারবি।

লোকটির সেই কথা বলে উধাও হওয়ার সাথে সাথেই সজল গাড়ি নিয়ে ফটিকছড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

এক ঘন্টা আগের ঘটনা-

মাশুক লোকটির কথামত বাবার দরবারে আসে। ওযু করে সে দরবারে যেয়ে আল্লাহের কাছে প্রার্থনা করতে থাকলো। মনের সমস্ত কথা সে ব্যক্ত করতে থাকলো। তার গুনাহের জন্য বেশি করে আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে থাকল আর এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাইল। প্রার্থনা শেষে সে কল্পনার মত পাভেলকে সে খুন করার দৃশ্যটি দেখতে পেল। দেখতে পেল পাভেলের বুকে চাকু চালানোর পর পাভেলের বুকের কিছু রক্ত ফিনকি দিয়ে মাশুকের বুকের বাম পাশে এসে পড়েছে। পাভেলের মৃত্যুর সময়ও দৃষ্টি সেখানেই ছিল।

মাশুকের হুঁশ ফিরলে কিছুই বুঝতে পারছিল না। দরবার থেকে বের হয়ে আসতেই সেই পাগল কিসিমের লোকটাকে দেখতে পেল।

– কি করতে হবে সেটা তুই নিশ্চয়ই বুঝে গেছিস।

– আমি এখনও বুঝতে পারছিনা।

– তোকে নিজেই তোর বুকের বাম পাশে চাকু চালাতে হবে। তাহলে সেই অতৃপ্ত আত্মার মৃত্যু হবে।

বর্তমান সময়ে-

লোকটির বাতলে দেওয়া কথামত মাশুক যেই নিজের বুকে চাকু চালাতে যাবে অমনি পাভেলের আত্মা এসে সজলকে আটকে রাখার দৃশ্য দেখায় যেমনটি সজলকে দেখিয়েছিল। মাশুক সজলের এমন দৃশ্য দেখে খুব মিনতি করতে থাকলে পাভেল বলে-

– ঠিক আছে আমি তোমাদের দুজনের কাছ থেকেই চলে যাচ্ছি। তুমি নিজের বুকে চাকু চালিও না।

– আমি চাকু চালালেই তুমি আর সজলকে কিছু করতে পারবেনা।

– তুমি ঠিকই বলেছ। কিছুই করতে পারব না। তবে আমার নিশ্চিহ্নের সাথে সাথে সজলও হারিয়ে যাবে।

আজকের রাতটা কেমন যেন অদ্ভুত যেমনটি সেদিনের সেই স্বপ্নে সজল দেখেছিল। চারপাশে নীরবতা। কোথাও কোন জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ঝড়ের আগে যেমন গুমোট পরিবেশ থাকে ঠিক তেমনি গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। ফটিকছড়িতে বাবার দরবারে এসে সজল শুধু হেঁটেই যাচ্ছে। ধু ধু বালুকাভুমি যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। সে হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেল। এই যে তার প্রানপ্রিয় মানুষ মাশুকের আর্তনাদ। সজল প্রাণপণে সেখানে যেতে লাগল। শব্দ আরও জোরাল হচ্ছে। সজল দেখছে তার প্রিয় মানুষটির পাশে অদ্ভুত দেখতে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির সমস্ত দেহ থেকে রক্ত-মাংস খসে পড়ছে। লোকটির মুখ দর্শন করে সজলের মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা এই ভেবে যে একজন মানুষের মুখ এমন বীভৎস হয় কী করে। সজলের বুঝতে বাকি থাকেনা এটা সেই পাভেলের অতৃপ্ত আত্মা। সজল কাছে যেতেই মাশুক বলে ডাক দেয়। সজলের ডাকে মাশুক ফিরে দেখে বুঝতে পারে পাভেল তাকে যা দেখিয়েছে সবই ভুল।

সেই অতৃপ্ত আত্মা সজলকে মেরে ফেলতে উদ্যত হতেই মাশুক নিজেই বুকের বাম পাশে হৃদপিন্ডের দিকে চাকু বসিয়ে দেয়। চাকু বসানোর সাথে সাথেই পাভেলের অতৃপ্ত আত্মা বিকট চিৎকার করতে করতে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে।

সজল মাশুকের কাছে আসতেই-

– তুমি এসব কি করলে? আমার জন্যে নিজের জীবন শেষ করে দিলে?

– আফসোস! তোমাকে নিজের করে পেলাম না। খুব ভালোবাসি তোমাকে।

– কিছু হবে না তোমার। আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে?

– আমাকে আরো জোরে তোমার বুকে চেপে রাখ। আমি তোমার বুকে মাথা রেখেই শান্তির ঘুম দিতে চাই।

কথাগুলো বলার সাথে সাথেই সজলের বুকে মাথা রেখে মাশুক না ফেরার দেশে চলে যায়।

উৎস: অন্যভুবন

প্রথম প্রকাশ: জুন ৩০, ২০১৫

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.