
ঝরাপাতা
নর্থ সাউথে পড়ার সুবাদে বাংলাদেশে স্থায়ী ভাবে থাকার সব ব্যবস্থা যখন শেষ তখনই কেন জানি মনে হচ্ছিলো আমি কি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাই হোক সব দোটানা পেছনে ফেলে শুরু করলাম নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। আর্কিটেকচার, ক্যাম্পাস, ক্যান্টিন, গ্যালারি আর অল্প সময়ে বুকে টেনে নেওয়া বন্ধুগুলোকে পাওয়ার পর নিজের কালো অতীতটাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। প্রায় বলছি কারণ সেগুলো হঠাৎ হঠাৎ ঘুমের মাঝে দেখা করতে আসে, কিছুসময় যন্ত্রণা করে চলেও যায়। তখন বিছানার কোণে অথবা বারান্দায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে, চোখের জলের সদ্ব্যবহার করে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসি।
এভাবেই প্রথম কিছুদিন কাটল। নিজেকে কিভাবে জানি গুছিয়ে নিয়েছিলাম। গুছিয়ে নেওয়ার কথা না কারণ নিজের চোখের সামনে আমি নিজের পুরো পরিবারকে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি। নিজে কিভাবে জানি টিকে আছি যার সমস্ত কৃতিত্ব আমার নানুর। নানু যদি ওই সময়ে আমার পাশে না থাকতেন তাহলে যে কী হতো চিন্তাতেও আনতে ভয় লাগে। যাই হোক সব কিছু হারিয়ে এখানে যখন আবার সব পেলাম তখন নিজেকে নিয়ে অনেক গর্ব হত। সারাদিন ক্লাসে বন্ধুরা আর রাতে নানা-নানীর বসুন্ধরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে তাদের কোলে মাথা রেখে বাবা-মা’র গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম কিন্তু ঝামেলা শুরু হলো যখন থেকে ইবুর সাথে পরিচয় হল।
পরিচয়ের শুরু আইস ব্রেকিং এর দিন। ডিপার্টমেন্ট এর আট তলার গোডাউন রুমকে গ্রেভইয়ার্ড বলে ডাকে সবাই। সেখানেই ফার্স্ট সেমিস্টারের সবাই কে ডাকা হলো আইস ব্রেকিং এর জন্য। সেখানে সিনিয়ররা সবাইকে এক এক করে ডেকে সবার পরিচয় নিচ্ছিলো আর এক একজনকে একেকটা মজার মজার কাজ করতে হচ্ছিল। একে একে আমার পালা আসলো। টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয়ের পর্ব শেষ করে যেটা করতে বলল করলাম। যতটা ভয়ে ছিলাম তেমন কিছু হল না দেখে বেশ খুশিই ছিলাম। তবে বিপত্তি হল টেবিল থেকে নামার সময় গ্রাভিটি ধরে না রাখতে পেরে সরাসরি নিচে ফ্লোরে পড়ে গেলাম। সেন্সলেস হওয়ার আগে দেখলাম কে জানি আমার মাথা কোলে তুলে নিলো, দেখতে একদম আব্বুর মত। তারপর আর কিছু মনে নেই। পরে জেনেছিলাম ওটা ছিলো ইবতেশাম, থিসিস ব্যাচের।
সেন্স ফেরার পর নিজেকে অপরিচিত একটা রুমে আবিষ্কার করলাম। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দেখার পর বুঝলাম অ্যাপোলোর বেডে। কিছুসময় চুপচাপ থাকার পর উঠতে গিয়ে বুঝলাম পায়ে ব্যান্ডেজ, মাথায় ও আছে ব্যান্ডেজ। সব মনে পড়লো, বুঝলাম চোট তাহলে ভালই পেয়েছি। দেয়ালের ঘড়িতে বাজে ৪.৩০ টা। দিন না রাত বুঝতে পারছি না। আস্তে করে উঠে বসলাম, বসতেই দেখলাম ইবু বসে বসে ঘুমাচ্ছে পাশের সোফায়। ইসস, বেচারা খামাখা কষ্ট করছে। পানি পিপাসা পেল কিন্তু টেবিলটা বেশ দূরে। ইবুকে ডাকতে ইচ্ছা করছিলো না তবুও আস্তে করে কাশলাম। কাশির শব্দে ইবু বেশ চমকে উঠে পড়ল। উঠেই বলল:
– থ্যাংকস গড। তোমার সেন্স তাহলে ফিরল। কেমন লাগছে এখন?
-হুমমম, ভালো। পানি খাব, ভাইয়া। প্লিজ একটু হেল্প করেন। টেবিলটা হাতের নাগালে না।
-প্লিজ, এভাবে বলার কিছু নেই। জাস্ট এ সেকেন্ড।
পানি খেয়ে ছোট্ট একটা থ্যাংকস দিলাম।
-ইটস ওকে। তুমি রেস্ট নাও, আমি ডক্টর না আসা পর্যন্ত এখানেই আছি। কিছু লাগলে বলো আমাকে।
-না, ভাইয়া কিছু লাগবে না আর আমার জন্য এত কিছু করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
-ফরমালিটি থাক এখন। তোমার নানু এসেছিলো, উনি তো ভয়ে অস্থির। পরে আমরা বুঝিয়ে ওনাকে বাসায় পৌছে দিয়েছি।
এর পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
-ফজরের আযান দিবে, আমি নার্সকে পাঠিয়ে দিচ্ছি তুমি থাকো, আমি নামাজ পড়ে আসছি।
-ঠিক আছে।
ইবু একটা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নানুর কথাটা আবারও সত্যি হলো। এখনও পৃথিবীতে ভালো মানুষ আছে তাহলে। ঠোঁটের কোণে হাসি এলো। উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারিনি। ঘুম ভাঙল নানীর কান্নার শব্দে। আমার নানী এমনিতেই অনেক সফট হার্টের মানুষ। আর আমার কিছু হলে সে সারাদিন কান্নাকাটি করতে থাকে। নানীর কান্না দেখে কেন জানি হেসে দিলাম। নানী একটা ধমক দিল। তারপর কপালে হাত দিয়ে বললো..
-হ্যাঁ রে, তোর নাকি পা ভাঙছে?
পাশ থেকে নার্সটা বললো যে পা ভাঙেনি তবে মচকে গেছে। সপ্তাহ খানেক রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।
জিজ্ঞেস করলাম কবে বাসায় যাবো?
-বিকালে ডিসচার্জ করে দেবে।
নার্সটা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে একটা সিরিন্জ নিয়ে রেডি হতে লাগলো। সিরিন্জ দেখেই আমার মুখটা শুকিয়ে গেল। বললাম ” ইনজেকশান আমি নেব না।”
-না না…এটা অ্যান্টিবায়োটিক…নিতেই হবে।
আমি করুন চোখে নানীর দিকে তাকালাম। নানী হাসছে। আবারো বললাম নিব না। তখনই ইবু রুমে ঢুকল। আমার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বললো- এটা কোনো ব্যাপার হল। ওয়েট করো
-না না আমার ভয় লাগে।
ইবু নার্সকে ইশারায় কিছু বলে আমাকে দুহাতে অনেকটা ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো তুমি কিচ্ছু টের পাবে না। আমি তখনও গলা ছেড়ে চিল্লাচ্ছি। কিন্তু ততক্ষণে পুশ করা হয়ে গেছে। আর আমি ইবুর শার্ট দুহাতে আকড়ে ধরে বাচ্চাদের মত চিল্লাচ্ছি। ইবু কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো শেষ। আমি চিল্লানি থামিয়ে বললাম
-রিয়েলি শেষ?
-হুম,শেষ।
-কিছু তো বুঝতে পারলাম না।
-হুমমম, এখন তো ছাড়ো?
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি এখনও ইবুকে আকড়ে ধরে আছি। সরি বলে ছেড়ে দিলাম। ইবু আর রুমের সবাই হাসতে লাগল আর আমি বোকার মত একবার নিজের হাতে আর একবার সিরিঞ্জটার দিকে তাকাতে লাগলাম। সপ্তাহখানেক বাসায় নানীর যত্নে আবার নিজের পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। এর মাঝে বন্ধুগুলো বাসায় এসে আড্ডা দিয়ে যেত। কিন্তু ইবু একবারও এলো না। এমনকি ফোনও করলো না। আমিও অতটা সিরিয়াসলি নিলাম না। কারণ, লোকটা যথেষ্ট করেছে ওই দুইদিন। ক্যাম্পাসে আসতেই সবাই আমার খোঁজ নিতে লাগলো। বুঝলাম অ্যাকসিডেন্টটা উপকারই করেছে। ডিপার্টমেন্টের সবাই চিনে গেছে আমাকে। সবার সাথে দেখা হলেও ইবুর সাথে দেখা হলো না। ওদের রুমেও গেলাম, পেলাম না। মনটা কিছুটা খারাপ হলেও বন্ধুদের মাঝে সেটাও হারিয়ে গেল।
.
ডিজাইন ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। পরের হেরিটেজ ক্লাসের আরো দেড় ঘন্টা বাকি। আকাশ ওর গিটারটা নিয়ে গান গাইছে আর আমরা সবাই শুনছি। ”আমি কি দেখেছি হায়, একলা পথে দাড়িয়ে…” গানের মাঝে হঠাৎ দরজার দিকে তাকাতেই মনে হলো কেউ একজন সরে গেল। আস্তে করে ক্লাসের বাইরে বের হলাম, কিন্তু তেমন কাউকে দেখলাম না। সবাই যার যার মত করিডোরে হাটছে। কেন জানি আর ক্লাসে ঢুকতে ইচ্ছা করছিলো না। ডাবলহাইটে বসে বসে নিচে তাকালাম…প্লাজা এরিয়াতে সবাই হাঁটাহাঁটি করছে, গল্প করছে, কেউ বা অডিটোরিয়াম এর সামনের সিড়িগুলোতে বসে আছে। আমাদের ডিপার্টমেন্ট এই জায়গাটা থেকে পুরা NSU দেখা যায়। সোজা সামনে তাকালেই আট নাম্বার গেট, ডানে অডিটোরিয়াম, বামে NAC বিল্ডিং, তারপাশে অ্যাডমিন বিল্ডিং, নিচে গ্যালারি আর প্লাজা। চারপাশে দেখতে দেখতে হঠাৎ যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম, যতই আশপাশটা মনোযোগ দিয়ে দেখি ততই বুঝতে পারি কতটা একা আমি তাই আপাতত ক্লাসের দিকে যেতে লাগলাম।
-নাবিল, কেমন আছো?
পেছন থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করল। ঘাড় ঘুরাতেই দেখি ইবু। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-এইতো ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ! আপনি কেমন আছেন?
-হুমম, ভালো। বেশ ভালো। পায়ের ব্যথা কি কমেছে?
-এখন আর তেমন ব্যথা নেই।
-সাবধানে থাকবা, বুঝলা? এখন কি আর ক্লাস আছে?
-ওকে, থাকব। না, একটু পরে আছে।
-ওকে, ভালো থাক। এখন আসি।
হাসি মুখে আল্লাহ হাফেয বলে ক্লাসের দিকে যেতে লাগলাম। দরজার সামনে আসতেই আবার পেছন থেকে ইবু ডাকলো।
-নাবিল, নাবিল…শোন?
-জ্বী, ভাইয়া বলেন।
-লাঞ্চ করেছ?
-না, ভাইয়া।
-তাহলে ক্যান্টিনে চল।
-এখন!
-হ্যাঁ, এখনই।
কথাটা অনেকটা ধমকের সুরে বললো ইবু। আমি আর কোন কথা না বলে চুপচাপ ইবুর পেছনে পেছনে লিফটের দিকে যেতে লাগলাম। লিফটে ঢুকতেই ইবুর ফ্রেন্ডগুলোর সাথে দেখা। ওনাদের ভেতর থেকে একজন ইবুকে বলল,
-কিরে তোর জ্বর কি কমছে?
-অনেকটা কমেছে…
-শাম্মা মিস তোকে খুঁজছিল। কাল দেখা করতে বলছে। লাস্ট উইকের সব গুলা ড্রয়িং জমা কিন্তু কাল।
-ঠিক আছে। রাতে ফোন দিস।
লিফট নিচে চলে এলো। আমার কেন জানি খুব রাগ হচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, নিজের জ্বর সেই কথাটা একবারও বললো না! আবার ভাবলাম, আমাকে কেন বলবে? কিন্তু, ঠিকই মুখ ফসকে বলে ফেললাম,
-আপনার জ্বর সেটা তো ভাইয়া আগে বলেন নাই?
-আরে, তেমন কিছু না।
-তেমন কিছু না তাতেই এক সপ্তাহ ভার্সিটিতে আসেন নাই!
ইবু প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললো,
-কী খাবা?
-কিছু না।
-আরে, একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না তাই তো তোমাকে নিয়ে এলাম। আমার জন্য অন্তত কিছু খাও। শর্মা নিব নাকি বার্গার নিব?
কিছুসময় চুপ থেকে বললাম জুস খাবো আর কিছু না।
-জুস! শুধু জুস!
বলেই হাসতে লাগলো,
-Okay. Wait a minute. I’ll be back.
-Okay.
দুমিনিটের ভেতরে সে হাজির। নিজের জন্য চিকেন আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আমার জন্য জুস তবে একটা না, তিনটে।
-এতগুলা জুস কে খাবে?
-কেন, তুমি?
-না ভাইয়া, সরি!
ইবুর মন খারাপ হল, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। সেটা দেখে বললাম,
-আচ্ছা ঠিক আছে। আমি দুটো আর আপনি একটা, ডান?
-ওকে, ডান।
হাসি মুখে দুজনেই খাচ্ছিলাম আর গল্প করছিলাম। ওই দিন থেকে নতুন করে যেন সব কিছু চলতে লাগল। আমার আর ইবুর বয়সের, ক্লাসের বড় গ্যাপ থাকলেও, দুজনের মাঝে সিনিয়র -জুনিয়রের সম্পর্ক ক্রস করে অনেকটা ফ্রেন্ডলি হয়ে গিয়েছিলাম।
ইবুর থিসিস জুরির দিন এগিয়ে আসতে লাগল। এর মাঝেই ইবুর সাথে নানা-নানীরও ভালো একটা বন্ডিং হয়ে গেলো। ডিপার্টমেন্ট এর সবাই আমাদেরকে ভাবতো যে আমরা হয়তো দুই ভাই। ভাবার কারণও ছিল যথেষ্ট। ইবু আমার যথেষ্ট টেক কেয়ার করত, আমিও সব কিছুতেই ওর কথা শুনতাম।
জুরির জন্য পুরা ডিপার্টমেন্ট এ তখন প্রচুর ব্যস্ততা। ইবুর থিসিসের সাবজেক্ট ছিলো কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ। ল্যান্ডস্কেপের জন্য ইবু কয়েকবার কক্সবাজার গিয়েছে কিন্তু ঠিকঠাক মত ল্যান্ডস্কেপের মাপটা নিতে পারে নি। লাস্ট বারের মত ও যাবে, খুবই হাইপার হয়ে আছে। বিনা কারণে আমরা যারা ওর মডেলের জন্য কাজ করছিলাম তাদের উপর চিল্লাচিল্লি করতে লাগল। এমন কি আমার উপরও…প্রথম প্রথম মন খারাপ হলেও তূর্য ভাইয়ার কথায় বুঝলাম, আসলেই তো ওর এটা নিয়ে মেজাজ খারাপ হবারই কথা। কারণ, পাঁচ বছরের সাধনার ফল এটা। বিন্দু মাত্র ভুল মানে সব শেষ। আমি ইবুর কাছে ঝাড়ি খেয়ে চুপচাপ লাইব্রেরির পাশের চিপায় বসে আছি তখন তূর্য ভাইয়া আসল।
-কী ব্যাপার, নাবিল? এখানে কেন? মডেলের কাজ কিন্তু অনেক বাকি।
-আমি আর কাজ করব না।
-তুমি কি তোমার ভাইয়ার কথায় রাগ করছ…
কোনো উত্তর দিলাম না, কারণ আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। কোন ভাবেই চেপে রাখতে পারছিলাম না।
-আরে বোকা ছেলে, চোখ মুছে ফেল। ইবতেশাম ভাই তো তোমাকে একা বকে নাই, সবাইকেই বকেছে। শোন এখন সবার মেজাজ খারাপ। এর মাঝে তুমি যদি মন খারাপ কর তাহলে কিন্তু তোমার ভাইয়ার জুরিই খারাপ হবে। So, stop crying. Be brave, okay?
-Okay.
আবার সবাই কাজে লাগলাম। রাত দশটা পর্যন্ত কাজের পর একে একে সবাই চলে গেল। আমি আর ইবু সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। সিকিউরিটি গার্ড এসে বললো এখনই বেরোতে হবে। রুম লক করতে হবে। সব কিছু নিয়ে বেরোতে বেরোতে রাত সাড়ে দশটা। ইউনিভারসিটির দুই নম্বর গেটে এসে দেখি কোন রিকশা নেই। তখনই ইবুর বাসা থেকে ফোন এলো, যে বাসায় কেউ নেই, সে যেন রাতে বাইরে থেকে ডিনার করে আসে। সব শুনে বললাম
-ভাইয়া, আজ আমাদের বাসায় চল। তুমি গেলে নানী খুবই খুশি হবে।
-না না, সমস্যা নেই। তুই চল, তোকে বাসায় দিয়ে আমি অ্যাপোলোর দিকে গিয়ে খেয়ে নিব।
-তুমি যাবা কিনা বল। বলেই নানীকে ফোন করে বলে দিলাম যে ইবু আজ আমাদের বাসায় থাকবে।
-এটা কি করলি তুই?
-কিছু না। চল।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় এলাম। এসে দেখি নানি অলরেডি খাবার রেডি করে বসে আছে। আমরা বাসায় ঢুকতেই নানী ইবু কে জড়িয়ে ধরে বলল,
-এতদিন পর এই বুড়ির কথা মনে পড়েছে?
-হুমমম…আমার তো তবু মনে পড়ে, তোমার তো তাও পড়ে না।
বলেই দুজনে হাসতে লাগলো। কেন জানি নিজের কাছে খুব ভালো লাগলো দৃশ্যটা দেখে। নানী তাড়াতাড়ি দুজনকে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো। ডিনারের পর ইবু আর আমি দুজনেই ছাদে গেলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ইবু বললো,
-আমার উপর রাগ করেছিস তুই?
-কই না তো।
-তাইলে দেখলাম তূর্যর সামনে কাদছিস আর আমার নামে নালিশ করছিস।
চুপ করে থাকলাম। বলার কিছু নেই, দুপুরের রাগটা আবার মাথা চড়া দিয়ে উঠলো।
-বারে, তুমি খামাখা চিল্লাইতে পারো আর আমি রাগ করতে পারি না!!
-ও তাই। এই পিচ্চিটা এখন রাগ করতে শিখে গেছে। ছয় মাসে পিচ্চিটা তাহলে একটু বড় হইছে।
বলেই কাছে টেনে নিলো। অনেক ভালো লাগছিল ইবুর বুকে মাথা রেখে। ইচ্ছা হচ্ছিল এভাবেই সারারাত থাকি। নিজের অজান্তেই চোখের কোনে পানি চলে এলো। আব্বু -আম্মুকে মিস করছিলাম খুব। আব্বু -আম্মু বেচে থাকলে এভাবেই ভালোবাসত, আদর করতো আমাকে।
-নাবিল।
-উউউ।
-ঘুমাবি না?
-হুমম।
-নাবিল! কাঁদছিস কেন??
-আব্বু আম্মুকে মিস করছি খুব। মাঝে মাঝে মনে হয় এক দিনের জন্যও যদি আব্বু-আম্মুকে ফিরে পেতাম তাহলে…আর কথা বলতে পারলাম না… ইবু আমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-আমি আছি তো। আমি তোকে সারাজীবন ভালোবাসব, কাছে রাখব। তুই কান্না বন্ধ কর। তুই কাঁদলে আমারও যে কান্না পায়….
-ভাইয়া।
-বল।
-না, কিছু না। চল, রুমে চল। সকালে অনেক কাজ আছে।
-হুমম, চল।
.
রুমে এসে বললাম,
-ভাইয়া, তোমার অসুবিধা হবে না তো, বেড শেয়ার করতে। আমার কিন্তু শোয়া ভালো না। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাই আমি।
-আরে না, কোন সমস্যা নেই। তুই লাইট অফ করে ঘুমা।
-ঠিক তো?
-হুমম।
লাইট অফ করতেই জানলার গ্লাসের ভেতর দিয়ে চাদের আলো পুরা রুমের ভেতরে অন্য রকম একটা পরিবেশ তৈরি করলো। আমি জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে আছি। ইবু উল্টা দিকে। কিছুক্ষণ পর ঘুরে ইবুও জানালার দিকে মুখ ফিরাল। আমি নিজে এবার ঘুরে গেলাম। ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখতে অন্য রকম লাগছে। চাদের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে। মনে মনে আল্লাহকে আমার চারপাশের এই মানুষ গুলোকে উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিলাম। একবার মনে হলো ইবুকে ছুঁয়ে দেখি। পরে ভাবলাম না থাক, বেচারা সারাদিন যথেষ্ট কাজ করেছে, রেস্ট নিক এখন।
হঠাৎ করে ইবু চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলে উঠলো
-আমার দিকে কেউ তাকিয়ে থাকলে আমার ঘুম হয় না। কথাটা শুনেই লজ্জা পেলাম। বললাম,
-কই? কে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে?
-ভূত, একটা ভূত তাকিয়ে আছে।
-বাজে কথা বাদ দিয়ে ঘুমাও।
-বাজে কথা না। তোর পেছনে কে জানি দাঁড়িয়ে আছে, সাদা কাপড় পরে।
এটা শোনা মাত্র আমি একলাফে ইবুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ভূতে আমার প্রচন্ড ভয়। ইবু তাল সামলাতে না পেরে আমাকে নিয়েই ফ্লোরে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ মৌনতা, আমি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছি ইবুর দিকে আর ইবু আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর ইবু হো হো করে হেসে দিলো। ওর হাসি দেখে একদিকে মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো অন্য দিকে চাদের আলোতে মন অন্য কিছুও চাচ্ছিল। যাই হোক, নিজেকে সামলে উঠে বসলাম। ইবু উঠে এক গ্লাস পানি এনে বলল,
-তোর এত ভূতের ভয়…
-কে বলেছে? আমি কাউকে ভয় টয় পাই না।
-তা তো দেখলামই।
-কি দেখেছ?
-তুই আমাকেও ভয় পাস না?
-না।
-সত্যি, তুই আমাকেও ভয় পাস না?
-বললাম তো না।
-ঠিক তো?
-হুমম, ঠিক।
ইবু আমাকে এক ঝটকায় বেডের উপর চেপে ধরল। সেদিনের ওই ইবুকে আমি আগে কোনদিন দেখিনি। সেই অন্যরকম ইবু আমাকে আবার বলল,
-ভয় পাস না তুই?
ইবুর চোখের থেকে আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না। ইবুর মুখটা আরো নিচে নেমে এলো। গরম শ্বাস আমার মুখে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে বললাম, না। এবার ইবুর আর আমার মাঝের দূরত্ব আরো কমে এলো। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ওই চাহনি সহ্য করার মত ক্ষমতা আমার ছিল না। বুঝলাম আজ কিছু হবে। দুজনেরই শ্বাস ভারী হচ্ছে সাথে, কমছে মাঝের দুরত্ব। শক্ত পাথরের মত পড়ে রইলাম বিছানার সাথে।
এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানি না। তবে সেদিন থেকে ইবুকে আমি প্রচন্ড ভয় পাওয়া শুরু করলাম । ওই রাতে ইবু সারারাত সোফায় শুয়েছিল আর আমি বেডের কোনায়। রাতে আর কোন কথা হয়নি। কিন্তু এর পর থেকে বুঝে গিয়েছিলাম আমার উপর ইবুর আর ইবুর উপর আমার অধিকার আছে। যেটাকে আমরা কখনই কোন নামে সংজ্ঞায়িত করি নি। এর পরে আমাদের মাঝে কথা খুবই কম হত কারণ কথার প্রয়োজন হয়নি। একজন অন্যজনের চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারতাম সব কিছু।
এর পরের দিনগুলো ছিলো অন্য রকম। মাস খানেকের ভেতরে ইবুর থিসিসের রেজাল্ট হয়ে গেল। নতুন জবে ঢুকল ইবু। আগের মত পাশে না পেলেও দিনে অন্তত একবার চোখের সামনে সে আসতই। সপ্তাহে ছুটির দিনের বিকালটা ছিলো ইবুর বাইকের পেছনে বসে ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়া। আর রাতে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে ও যখন কপালে আলতো চুমু দিয়ে বলত, ”তাড়াতাড়ি ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়বা কিন্তু” তখন নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখি মনে হত।
সুখের দিনগুলো কখনই স্থায়ী হয় না। আমারও হল না। ফোর্থ সেমিস্টারের ফাইনালের সময় নানু বেশ অসুস্থ হয়ে গেল। আমার যেদিন ডিজাইনের ফাইনাল জুরি সেদিন জুরির পর সবাই আমাকে কনগ্রাচুলেশানস জানাচ্ছিল কারণ জুরিটা বেশ ভালো হয়েছিল। মনে মনে বেশ গর্ব বোধ হচ্ছিল, কারণ ইবুর আশাগুলো পূরণ করতে পারছি। ও সব সময় আমাকে টিচারের মত গাইড করে। তার ফল হল এই জুরি। সবার সাথে কথা বলতে বলতে ইবুকে বা বাসায় ফোন করার মত টাইমই পাচ্ছিলাম না। একটু ভিড়ের বাইরে গিয়ে ফোন বের করতেই দেখি ইবুর সতেরটা মিসড কল। সঙ্গে সঙ্গে আবারও কল এল। রিসিভ করতেই ইবু বলল,
-জুরি শেষ?
-হ্যাঁ।
-বাসায় আসো।
-একটু পরে আসি।
-না, এখনই আসো।
-কেন, কোন সমস্যা? নানু কি বেশি অসুস্থ?
-এত কথা না বলে এখনই বাসায় আসো। আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
ফোন কেটে দিলো। বুঝতে পারিনি তখনও যে আমার নানু আর নেই। বাসার নিচে আসতেই দেখি অনেক মানুষ। ইবু এসে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। দরজার সামনে দাড়াতেই বুঝলাম আমি আমার আরো একজন ভালোবাসার মানুষকে হারালাম। নানী কোন কথায় বলছে না। চুপচাপ নানার মাথার কাছে বসে তজবি পড়ছে। চোখ থেকে পানি পড়ছে অনবরত। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। সাদা চাদরে মোড়ানো নানু কে দেখে সেই পাঁচ বছর আগের আব্বু-আম্মুর কাফনে মোড়ান মুখ দুটো মনে পড়ে গেল। কাঁদতে পারছিলাম না। বুকের উপর যেন পাথর চেপে বসেছিল তখন।
নির্বাক চোখে চারিদিকে তাকিয়ে বুঝলাম আবারো অন্ধকারে ডুবতে চলেছি।
নানু মারা যাবার পর ইবুর আব্বু আম্মু অনেকটা জোর করে আমাকে আর নানীকে ওদের বাসায় নিয়ে গেল। আর আমাদের ফ্ল্যাটটা তালা মারা অবস্থায় পড়ে রইল। নিজের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি থাকতেও কিছুই নেই আমার। নানী সারাদিন কি যেন ভাবে। একদিন কাছে ডেকে বললো,
-নানাভাই, তুই এমন শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন?
-কই, না তো?
-না, ইবুর মা বললো তুই নাকি ইদানিং ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করিস না?
-আরে না, সারাদিন তো ক্যাম্পাসেই থাকি। ক্যান্টিনে তো সব রকমের খাবার পাওয়া যায়।
-থাক আর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলা লাগবে না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
-আমি মরে গেলে তোকে কে দেখবে রে, ভাই?
-নানী, আল্লাহর দোহায় লাগে। তুমি থাম।
-হুমম, আমার অবশ্য কোনো চিন্তা নেই। ইবু আছে, আমি জানি ও তোকে সবসময় আগলে রাখবে। ও তোকে অনেক ভালোবাসে।
-আমি জানি।
-না, তুই কিছুই জানিস না। রাতে তুই ঘুমিয়ে পড়লে ইবু তোর মাথার পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। দিনে দশবার ফোন করে ওর মাকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করে। বাড়ির সবগুলো কাজের লোককে বলে রাখে যাতে তোর কোন অযত্ন না হয়।
-নানী, আমি নিজেও জানি ইবু ভাইয়া কখনও আমাকে ছাড়বে না। কিন্তু বিনিময়ে তো আমি কিছুই দিতে পারছি না।
-আরে পাগল, দেওয়া-নেওয়ার হিসাব সব জায়গায় হয় না।
-কি জানি, নানী। আমার জন্য শুধু দোয়া করো যেন সব কিছু এভাবেই চলে।
পুরোদুনিয়া একদিকে আর ইবু অন্য দিকে। সবরকমের বিপদ থেকে ও আমাকে আগলে রাখল সব সময়। সারাদিন অফিস, বাসার সবার দেখাশুনা সব কিছুই ইবু করতো। এর মাঝে আরো আট মাস কেটে গেলো। নানী মারা গেল শীতের শুরুতে। নানীর মৃত্যুটা আমাকে ততটা নাড়াতে পারেনি কারণ মারা যাবার আগে আমি নানীর সাথে এত সময় কাটিয়েছি, এত গল্প করেছি যে ওই স্মৃতি গুলো সারাজীবন নানীকে আমার মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে। নিজেকে কোনদিন এতিম বলে আগে মনে হয়নি কিন্তু নানী মারা যাবার পর নিজেকে এতিম এতিম লাগত।
যখনই ভাবতাম পুরো পৃথিবীতে আমার নিজের রক্ত বলে কেউ নাই তখন আর বাঁচার কোন ইচ্ছা থাকত না। কিন্তু, ইবুর মুখের দিকে তাকালেই আবারও নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা হত। শেষমেষ নিজেকে আবার গোছাতে শুরু করলাম। ইবুর আম্মু আমাকে নিজের ছেলের মত করে যত্ন করতো, আব্বুর তো কোন তুলনা হয় না, আর ইবু তো ইবু…
এত কিছু ঘটার পরও ইবুকে আমি সেই আগের মতই ভয় পেতাম। কথা হতো সেই চোখে চোখে। তখনও পর্যন্ত আমাদের সম্পর্কটা সেই নামহীন সম্পর্ক হয়েই আছে। একদিন সন্ধ্যার আগে ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে আছি, তখন ইবু এলো বাসায়। গাড়ি থেকে নেমেই আমাকে দেখল। শুকনো একটা হাসি দিলাম। সিড়িতে শব্দ হচ্ছে, বুঝলাম ইবু ছাদেই আসছে। পাশে এসে দাড়ালো। বাইরে হালকা ঠান্ডা। আমি একটা ফুল টিশার্ট পড়ে আছি। ইবু পুরা ফর্মাল ড্রেসে। ইবু সাধারনত ফর্মাল পড়ে না। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
-পার্টি ছিল?
-হুম, রুমির বৌভাতের অনুষ্ঠান ছিল।
-তুমি বিয়ে করবে না?
হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করেছিলাম, কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই। ইবু আমাকে প্রচন্ড জোরে একটা চড় মেরেছিলো সঙ্গে সঙ্গে। তারপর দুহাতে আমাকে আঁকড়ে ধরে আলতো করে আমার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলেছিলো ” তুই এখনও আমাকে চিনতে পারিস নি।” হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম মানুষটার দিকে। পারে কিভাবে মানুষটা। নিজের সুখ, চাওয়া-পাওয়া, কামনা-বাসনা সব বিসর্জন দিয়ে কিভাবে থাকতে পারে। তারপরে আর কোনদিন আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করি নি। আসলে জিজ্ঞেস করতে হয়নি।
ইবু আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে আগলে রাখতে হয় ভালোবাসার মানুষগুলোকে। কিভাবে দেহে দেহ না মিলিয়ে, শুধু চোখে চোখ রেখেও ভালোবাসা যায়। কিভাবে নিজেকে সঁপে দিতে হয় অন্যের জন্য। আমি সব শিখেছি ইবুর থেকে। ইবু আমাকে শূন্য থেকে তুলে এনেছিলো। আমার যখন কিছুই ছিলো না তখন ইবু আমাকে সব কিছু দিয়েছে। এমনকি নিজের প্রাণটাও আমাকে দিয়ে গিয়েছে ও। আমার যখন দুইটা কিডনিই নষ্ট হলো তখন নিজেকে শেষ করে দিয়ে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখল। বিনিময়ে এই শূন্য আমি, নিজের ভালোবাসাকে ভালোবেসে নিজেকে প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে রাখছি। কারণ আমি জানি, আমি যতদিন বেঁচে থাকতো ততদিন ইবুও বেচে থাকবে আমার মাঝে। আর বেঁচে থাকবে আমার নামহীন, সংজ্ঞার বাইরের শূন্য সম্পর্কটা।
উৎস: অন্যভুবন