ভালোবাসা হারিয়ে খুঁজি

শাহরিয়ার সুমন

ভালোবাসা হারিয়ে খুঁজি’ কিছু মানুষের জীবনের তীব্র আবেগ, তাদের সম্পর্কের অন্তর্দ্বন্দ, মান-অভিমান, হতাশা, প্রেম, চাওয়া-পাওয়া, জীবনের সাথে সমঝোতার গল্প। আসুন পরিচিত হই গল্পের পাত্র- পাত্রীদের সাথে…

এই গল্পের নায়ক শুভ্র, সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে মাকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, মা গ্রামে একাই থাকে। শুভ্রর শত চেষ্টাতেও তিনি শহরে আসতে রাজি হননি।

গল্পের আরেকটি প্রধান চরিত্র আদিত্য। পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসায়ে বসেছে। তারা বিদেশ থেকে গাড়ির পার্টস ইমপোর্ট করে। আদিত্যের আরেকটি পরিচয় সে শুভ্রর ভালোবাসার মানুষ। শুভ্রকে সে অনেক ভালোবাসে। গত তিন বছর ধরে তাদের রিলেশন। এই সময়ে অনেক চড়াই- উৎরাই পার করেছে তাদের সম্পর্ক। কিন্তু তাদের সম্পর্কের ভিতে কখন ফাটল ধরেনি। তাদের একজনের প্রতি অন্যজনের ছিলো অগাধ বিশ্বাস, আস্থা, আর অপরিমেয় ভালোবাসা । কিন্তু, পরিবারের বড় সন্তান, বাবা-মায়ের চাপ আর সমাজের কথা ভেবে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আজও সে শুভ্রকে ভালোবাসে। তাই তো এখনো সে তার স্ত্রীকে তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দিতে পারেনি।

রুপা, আদিত্যের স্ত্রী। কিন্তু সেটা এখনো কাগজে কলমে রয়ে গেছে। বিয়ের এতদিন পরেও সে আদিত্যকে নিজের করে কাছে পায়নি। তারপরও সে আদিত্যকে ভালোবাসে, বিয়ের অনেক আগে থেকেই। সে জানে, তার স্বামীর মনের ঘরে সে নয়, বাস করছে অন্য কেউ। তারপরও সে অপেক্ষা করে হয়ত একদিন আদিত্য তার কাছে ফিরে আসবে, তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেবে।

শিমুল। ঢাকায় একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে। শুভ্রর সাথে তার পরিচয় ফেসবুকে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, একসময় ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। সে জানে তার ভালবাসা একতরফা। কিন্তু শুধু কাছে পাওয়ার নামই কি ভালোবাসা? সে সারাজীবন শুভ্রর পাশে থাকতে চায় তার পরম বন্ধু হয়ে। শিমুল জানে, শুভ্রকে সে তার নিজের মত করে কখনো কাছে পাবে না। কিন্তু, এক জীবনে বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি কিছু কি প্রয়োজন? শুভ্র তার পাশে আছে, এটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।

জীবনের এই ভালোবাসার দৌড়ে কে জিতবে, কে হারবে, আসুন দেখা যাক।

.

আজ খুব ভোরেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কেন ঘুমটা ভাঙল বুঝতে পারছি না। আমি কি কোনো স্বপ্ন দেখছিলাম? কিন্তু কোনও স্বপ্নের কথা তো মনে পড়ছে না। তবে ঘুম থেকে উঠার পরই মনটা ভাল হয়ে গেল। শুভ্রের মুখটা দেখলেই আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। কী নিষ্পাপ একটি মুখ। সকালের পবিত্র আলো জানালার ফাঁক গলে শুভ্রের মুখে এসে পড়ছে। শুভ্রকে দেখতে ঠিক যেন কোনো এক স্বর্গীয় দেবশিশুর মত লাগছে। শুয়েও আছে বাচ্চাদের মতো একপাশে কাত হয়ে হাঁটু ভাজ করে। শুভ্রকে দেখলে কে বলবে যে এই ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এত মায়া লাগছে। ইচ্ছে করছে একটু ছুঁয়ে আদর করে দিই। তার এলোমেলো চুলগুলোকে আরেকটু এলোমেলো করি। খুব ইচ্ছে করছে শুভ্রর কপালে একটা চুমো দিতে। কিন্তু জানি, এটা সম্ভব নয়। কখনোই নয়। আমার একটুখানি ভুল শুভ্রকে কাছে পাওয়ার সমস্ত আনন্দকে চিরকালের জন্য শেষ করে দিবে। আমি সেটা কখনোই চাইনা । শুভ্র আমার সাথে থাকতে রাজি হয়েছে একটাই শর্ত যে, আমি কখনো শুভ্রকে স্পর্শ করবো না। আমরা একসাথে একই ফ্লাটে থাকব কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো শারীরিক সম্পর্ক থাকবে না। শুভ্রর শর্তটা মানতে আমার কষ্ট হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তারপরও আমি রাজি হয়েছি। কারণ, আমি যে শুভ্রকে অনেক ভালোবাসি!

এই যে আমি আমার ভালোবাসার মানুষটির সাথে একসাথে থাকতে পারছি, সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার মুখটি দেখতে পারছি, এটাই কি আমার জন্য অনেক কিছু না? প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি, শুভ্র আমার জন্য অপেক্ষা করে, আমি ফ্রেশ হবার পর সে আমাকে চা বানিয়ে খাওয়ায়, রাতের খাবারের পর আমরা দুজন ব্যালকনিতে দাড়িয়ে অনেকক্ষণ গল্প করি। অবশ্য বেশিরভাগ সময় আমিই বকবক করি আর শুভ্র চুপচাপ শোনে। কখনো আমরা দুজন নিঃস্তব্ধ অন্ধকার আকাশে তারা দেখি, রাতে একই বিছানায় একসাথে ঘুমাই। যদিও শুভ্রর ভয়ে হাত দুটোকে সামলে রাখি। ভয় হয় ঘুমের ঘোরে যদি বেখেয়ালে শুভ্রর গায়ে হাত লেগে যায়। যদি শুভ্র ভেবে বসে আমি তার বন্ধুত্বের সুযোগ নিতে চাইছি। আমি কখনো চাই না শুভ্র কোনভাবে আমাকে ভুল বুঝুক। আমার প্রিয় মানুষটি আমার পাশে আছে, এরচেয়ে বড় পাওয়া আমার জীবনে আর কি হতে পারে?

মানুষ তার একজীবনে সবকিছু পায় না। চাওয়া পাওয়া নিয়েই তো মানুষের জীবন। জীবনের অসংখ্য না পাওয়ার মাঝে ছোট ছোট কিছু প্রাপ্তি জীবনকে পরিপূর্ণ করে। শুভ্র আমাকে ভালবাসে না, শুভ্রর কাছে আমি তার শুধুই খুব ভালো একজন বন্ধু। আমি কখনোই তার মনের মানুষ হতে পারিনি, শুভ্রের মনের মানুষ ছিল আদিত্য, যাকে সে মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছে, হয়তো এখনো বাসে। আমি জানি না আমার ভালোবাসায় কী কমতি ছিল, যার কারণে শুভ্র আমাকে ভালোই বাসতে পারলো না, আমি সত্যি জানি না। শুভ্র আমাকে ভালো না বাসুক, তাতে কি? আমি তো বাসি, আমি যে শুভ্রকে অনেক অনেক বেশি ভালবাসি।

.

ঘুমের মাঝেই টের পেলাম, কে যেন আমাকে ডাকছে। ডাকটা আমি শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু জবাব দিতে পারছি না। কে যেন আমাকে খুব আদুরে গলায় ডাকছে, “শুভ্র, শুভ্র!“ একসময় মানুষটি আমার কপালে হাত রাখল। আমি অনুভব করলাম, তার স্পর্শে আমার শরীরটাও যেন একটু কেঁপে উঠলো। কিন্তু আমি কিছুতেই চোখ মেলতে পারছি না। এরপর হঠাৎ একটা চমৎকার মিষ্টি পরিচিত গন্ধ আমার নাকে এলো। এ তো আদিত্যের পারফিউমের গন্ধ! কিন্তু আদিত্য কোথা থেকে আসবে? সে তো চট্টগ্রামে বৌয়ের সাথে সুখের সংসার করছে। আদিত্যের কথা মনে হতেই আমার কাঁদতে ইচ্ছে করল। হঠাৎ সেই সময় লোকটি আমার কপালে চুমু খেল, তারপর ঠোঁটে আর গালে। ঠিক যেন চুমু নয়, কোমল ঠোঁটের আলতো স্পর্শ মাত্র। তখনি আমি নিশ্চিত হলাম, মানুষটি আদিত্য ছাড়া আর কেউ নয়। তার স্পর্শের প্রতিটি অনুভুতি আমি বুঝতে পারি। সে যে আমার শত জনমের চেনা, হৃদয়ের বড় কাছের। আমি প্রচন্ড অভিমানের সুরে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন এসেছ তুমি? তুমি তো আমাকে ছেড়ে চলেই গিয়েছ।”

“আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাইনি, ময়না পাখি।”

“খবরদার, তুমি আমাকে আর কখনো ওই নামে ডাকবে না। তুমি একটা মিথ্যুক।”

“বিশ্বাস কর, ময়না পাখি। আমার শুভ্রকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব বলো?”

“সত্যি! তুমি সত্যি কখনো আমাকে ছেড়ে যাওনি?”

“না, কখনো না। আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। প্লিজ, এখন আমাকে একটু ভালোবাস, আমি যে বহুদিন ধরে তোমার ভালোবাসার তৃষ্ণায় ছটফট করে মরছি।”

আদিত্য আমাকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল। তারপর ধীরে ধীরে হাত বুলাতে শুরু করল আমার চুলে, পিঠে, কোমরে। হাত বুলানোর এলাকা বাড়ছে ক্রমেই। তার হাতের দুরন্ত ছোয়ায় অস্থির করে তুলছে আমাকে। একসময় দুই জোড়া ব্যাকুল ঠোঁট এক হলো। আমরা দুজন যেন এক অভিন্ন সত্তা। প্রথমে দীর্ঘ একটি চুমো, প্রচন্ড তৃষ্ণায় এক ফোটা বৃষ্টির মতো। তাঁরপর মুষলধারে বর্ষণ শুরু হলো। উন্মত্ত আবেগে দুজনই দিশেহারা।

.

“শুভ্র, এই শুভ্র, আর কতক্ষণ ঘুমাবে?”

চোখ খুলেই শুভ্র দেখল শিমুল তার পাশে বসে আছে। তার মানে সে এতক্ষণ আদিত্যকে স্বপ্ন দেখছিল। “সেই কখন থেকে আমি তোমাকে ডাকছি। এখন উঠো।” “আর কিছুক্ষণ ঘুমাই না, প্লিজ!” “১১ টা বেজে গেছে। আজ শুক্রবার, মসজিদে যাবে না?” শুভ্র অবাক হয়ে উঠে বসল “এত বেলা হয়ে গেছে, তুমি আমাকে ডাকনি কেন?” “আমি জানি, কাল রাতে তুমি একটুও ঘুমাওনি। আজ তো বন্ধের দিন, তাই তোমাকে আর জাগাতে ইচ্ছে করল না। ভাবলাম একটা দিন শান্তিতে ঘুমাও।”

শিমুল শুভ্রর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। “কি ব্যাপার, হাসছ কেন?”

“এমনি। তা কী স্বপ্ন দেখছিলে?”

“আমি স্বপ্ন দেখছিলাম, তোমাকে কে বললো?”

“সব কিছু মুখে বলতে হয় নাকি? তোমার মুখের এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝা যাচ্ছিল।”

শুভ্র একটু লজ্জা পেল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে শিমুল জানে সে কি স্বপ্ন দেখেছে।

“আদিত্যকে স্বপ্ন দেখছিলে, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“কেন মনে কর তাকে? আজকে এত দিনেও তাকে ভুলতে পারলে না?”

“আমি কি তাকে বলেছি আমার স্বপ্নে আসতে?”

“দিন-রাত তার কথা ভাবলে স্বপ্ন তো দেখবেই।”

“আমি তার কথা ভাবি না।”

“কেন শুধু শুধু আমার কাছে মিথ্যে বল?”

“চাইলেই কি সব কিছু ভুলে যাওয়া সম্ভব? আচ্ছা, শিমুল বল তো, কিভাবে সে পারল আমাদের এতদিনের ভালোবাসা এভাবে শেষ করে দিতে?”

“জানি না, হয়তো তার অন্য কোনো উপায় ছিল না। হয়তো সে বাধ্য হয়েই বিয়েটা করেছে।”

“তা তো করবেই, শালা বাইসেক্সুয়াল, আমি সত্যি কখনো তাকে ক্ষমা করবো না।”

“আচ্ছা, এখন এইসব বাদ দাও। উঠো, ফ্রেশ হও, রান্না করতে হবে না?”

“রান্না করবো মানে! আজকে কী বার? আজকে তোমার ডিউটি, সপ্তাহে একদিন আমি শুধু আরাম করব।”

“বারে! কেন, আমি যে সপ্তাহে ৬দিন অফিসে যাই?”

“তো কী হইছে? আমাকেও প্রতিদিন ভার্সিটি যেতে হয়, ক্লাস, এক্সাম, কতকিছু!”

“হইছে! আমার জানা আছে, আপনি কত ক্লাস করেন! আদিত্যের শোকে লেখাপড়া তো সব লাটে উঠছে।”

“ওই, কি বললা তুমি? আমি পড়াশোনা করিনা, না? তোমার সত্যিই খবর আছে!”

“কিসের খবর! সত্যি কথা বললেই দোষ, আন্টিকে আমি সব বলব তো।”

“কি বলবা আম্মুকে?”

“এই যে আপনি প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেবদাস হয়ে ঘুরছেন?”

“তুমি সত্যি এগুলা আম্মুকে বলবা?”

“কেন, বললে কি করবা তুমি?”

“তোমাকে এমন মাইর দিমু দেখবা, যে বিছানা থেকেও উঠতে পারবা না!”

“দাও না, তোমার মাইর গুলাও আমার কাছে আদর মনে হবে।”

“কী বললা?”

“না, কিছু না।”

শুভ্র তুমি জান না, তোমার সামান্য একটু স্পর্শের জন্য আমি কতটা কাঙ্গাল হয়ে থাকি সারাক্ষণ, শিমুল কথাগুলো মনে মনে বলে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শুভ্র গোসল করার জন্য টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। সে খেয়াল করেনি, হঠাৎ করেই শিমুলের চোখে পানি এসে গেছে। শিমুল চায় না শুভ্র কখনো তার এই চোখের পানির রহস্য জানুক।

.

শুভ্র ছোটবেলা থেকেই জানত সে সমাজের আর দশটা ছেলের থেকে আলাদা। সে চাইলেও কখনো তাদের মতো হতে পারবে না। না, শারীরিক ভাবে তার মধ্যে কোনো খুঁত নেই। বরং সে একশটা ছেলের মধ্যে দাঁড়ালেও সবাই আগে তার দিকেই তাকাবে। শুভ্র দেখতে বেশ সুদর্শন, কম করেও ৬ ফুট লম্বা, অ্যাথলেটিক গড়ন। উজ্জ্বল শ্যামলা ত্বকে রোদে পোড়া বাদামি আভা। একমাথা অগোছালো ঢেউ খেলানো কাল চুল। পেশীবহুল শরীরে কোথাও এক ফোঁটা মেদ নাই। শুভ্র মাঝে মাঝে ভাবে, সে যদি দেখতে কুৎসিৎ হয়েও অন্য দশ জনের মতো স্বাভাবিক হতো তাহলে সে আল্লাহর কাছে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ থাকত। তবে সে এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। সে তো কোনো অন্যায় করেনি বা নিজের ইচ্ছে থেকেও এমন হয়নি। তাহলে সে কেন নিজেকে অপরাধী ভাববে? এক আল্লাহ্ই সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। যদি আল্লাহ তাকে এভাবে বানিয়ে খুশি হোন, তাহলে সে কেন কষ্ট পাবে? আল্লাহ কখনো কোন ভুল করতে পারেন না, তাই তার জীবন কোন পাপ বা অভিশাপ হতে পারে না।

জীবনে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে সে কখনও ভাবেনি। তার জীবনের একটাই লক্ষ ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা তাকে মানুষ করতে অনেক কষ্ট করেছেন। তাকে নিয়ে তার মায়ের অনেক স্বপ্ন। সে তার মায়ের একমাত্র ছেলে। সে তার মাকে কখনো কষ্ট দিতে চায় না

কিন্তু জীবনের সব সিদ্ধান্ত কি আমাদের হাতে থাকে? জীবনে এমন কিছু সময় আসে, যখন ভালো মন্দ ন্যায় অন্যায় বিচার করার অবস্থা থাকে না। আমাদের জীবন ঘুড়ির নাটাই আর সুতো তখন অন্য কারও দখলে চলে যায়।

আদিত্যের সাথে শুভ্রর পরিচয় ভার্সিটিতেই। সেদিন বিকেলে শুভ্র তার বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসে আড্ডা দিচ্ছিল তাদের বন্ধুদের মধ্যে দুজন মেয়েও ছিল। হঠাৎ শুভ্রর মনে হল, কেউ যেন ওকে লক্ষ করছে। সেই মুহূর্তে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে গেলো কয়েকজন তরুণ। ওরা সবাই ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তাদের মধ্যে একজন ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল যেন সরাসরি শুভ্রর দিকেই। তার গা শিরশির করে উঠলো।

শুভ্রর বন্ধুদের মধ্যে ফাহাদ তখন তিথির চুল টান দিয়ে বলল, “আদিত্য ভাই মনে হয় তোর দিকে তাকিয়ে হাসলেন।” “তোকে বলেছে!”, তিথি হেসে উঠল। “আদিত্য ভাই জানেন, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের মাসে আমার এনগেজমেন্ট। এই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে ফাজলামি শুরু হল। সেদিন কাউকে বলতে পারেনি শুভ্র যে আদিত্য আর কাউকে নয়, বারবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকেই দেখছিল। তার বন্ধুরা কেউ ভাবতেও পারেনি যে ছেলে হয়েও আদিত্য অন্য একটি ছেলের দিকে তাকাবে। সেদিন থেকেই কেন জানি আদিত্যের প্রতি একটা ভাল লাগা জন্ম নিলো শুভ্রর। এরপর ঘটল শুভ্রর জীবনের চরম অপমানজনক ঘটনা। অবশ্য একই সাথে এই দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন।

ক্লাস শেষ করে শুভ্র সেদিন ভার্সিটির ক্যান্টিনে খেতে গেল। সেদিন কিছু ছাত্রলীগের বড় ভাই ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের র‍্যাগ দিচ্ছিল। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন শুভ্রকে ডাকল। শুভ্রর বুক ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল।

“কি নাম তোর?”

“শুভ্র।”

হুমায়ুন আহমেদের শুভ্র, এই বলে তারা হেসে উঠল।

“তুই তো দেখি মেয়েদের মতো সুন্দর। ছেলে মানুষের তো এত সুন্দর হওয়া ঠিক না। রূপ যৌবন হলো মেয়েদের জিনিস।” তাদের মধ্যে আরেকজন বললো।

“ঐ, শার্টের বোতাম খোলা কেন? মাস্তানি করস নাকি?”

শুভ্র দ্রুত শার্টের বোতাম লাগাল। এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে নিজেকে কোরবানির হাটের গরুর মতো মনে হচ্ছিল। লজ্জা অপমানে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

“ঐ, তোর বুকে তো লোম ও নাই, তুই ছেলে নাকি মেয়ে, নাকি হিজড়া?”, দলের সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

শুভ্র আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। তার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। হয়তো ওরা তার সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছে বলেই সে এতটা রেগে গিয়েছিল। সে তো জানে সে আসলে কী। নিজে একজন ছেলে হয়েও যার মেয়েদের প্রতি তার কোনও আকর্ষণ নেই, মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়েই তার সংশয় হয়।

“আপনারা আমাকে এভাবে অপমান করছেন কেন? সিনিয়র বলে কি আপনারা যা খুশি তা করবেন?”

“করলে কী করবি তুই? প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করবি?”

“দরকার হলে তাই করব।”

“কী, এত বড় সাহস তোর! মুখে মুখে কথা বলস, খুব সেয়ানা হইছস, না? তোর সেয়ানাগিরী কিভাবে ছুটাইতে হয়, তা আমাদের জানা আছে।

ঐ, এক্ষুণি প্যান্ট খোল, সাথে আন্ডারঅয়্যারও খোল। আজকে সত্যিই আমরা দেখমু, তুই ছেলে না মেয়ে, তুই কত বড় পুরুষ হইছস আজ সেটা প্রমাণ হইব।

শুভ্র বিস্ময়ে আর ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। কি বলছে ওরা এইসব? ওরা যা বলছে তা কি সত্যি? নাকি যা শুনছে ভুল শুনছে। কি করবে এখন? এতগুলো ছেলে মেয়ের সামনে কিভাবে প্যান্ট খুলবে? শুভ্রর মনে হল সে যদি কোনভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারত বা মাটি ফাঁক হয়ে সে ভেতরে ঢুকে যেতে পারত! “কি ব্যাপার কথা কানে যায় না? বেশি তেড়িবেড়ি করলে নেংটো কইরা পুরো ক্যাম্পাস ঘুরামু।”

কী করবে এখন শুভ্র? আজকের পর এই মুখ কি সে কারো সামনে দেখাতে পারবে? আত্মহত্যা করা ছাড়া তার তো আর কোনও পথ খোলা থাকবে না। কেন জানি মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল শুভ্রর।

.

এমন সময় সেখানে আদিত্য এসে দাঁড়াল। সেদিন সত্যিই আদিত্য শুভ্রর জীবনের হিরো হয়ে আবির্ভাব হয়েছিল তার সম্মান বাঁচাতে।

“এই কি হইতাছে এখানে, তোরা জানস না শুভ্র আমার ছোট ভাই। ওকে আজকের মতো ছাইড়া দে।”

“তুই জানস না দোস্ত, এই পোলা আমাদের লগে বেয়াদপি করছে। ওরে ছাড়ন যাইব না।”

“আচ্ছা, শুভ্রর হয়ে আমি তোদের কাছে মাপ চাইছি।”

” স্যরি, দোস্ত, তোর কথা আমরা রাখতে পারমু না।”

“দেখ, আমার ভাইরে অপমান করা মানে আমারে অপমান করা। তোরা কি সবার সামনে আমারে অপমান করতে চাস?”’

“আচ্ছা, ঠিক আছে, তোর জন্য ওরে মাফ করলাম।” তারপর শুভ্রর দিকে ফিরে বলল, “সিনিয়রদের সম্মান করবা। আর যদি কোনদিন বেয়াদপি কর তাহলে কিন্তু ক্ষমা নাই, এখন কানে ধরে এখান থেকে চলে যাও।”

সেদিন আদিত্যের জন্য শুভ্র চরম অপমানের হাত থেকে রক্ষা পেল। সে এতটাই নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল যে আদিত্যকে একটা ধন্যবাদ দেয়ার কথাও মনে রইলো না। এরপর থেকে আদিত্যের প্রতি তার দুর্বলতা বাড়তে লাগলো। শুধু আদিত্য নামটা শুনলেই তার বুকের রক্ত ছলকে উঠে। শিরশির করে শরীর। দূর থেকে দেখলেও লাফাতে শুরু করে হৃদপিন্ড। এইসব কথা কাউকে বলতেও পারে না সে। নিজে থেকে যেচে পড়ে আদিত্যের সাথে কথাও বলতে পারে না, কারণ আদিত্য তার অনেক সিনিয়র।

.

সেদিন থেকে প্রায় রোজই লক্ষ করে শুভ্র, সে যেখানেই থাকুক আদিত্যকে ঠিক দেখতে পায়। আদিত্যের চোখ জোড়া কাউকে যেন খুজে বেড়াচ্ছে। আদিত্যের চেহারায় কেমন যেন একটা বিষণ্ন ভাব থাকে। চোখাচোখি হলেই এত দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয় যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছু সময়।

একদিন সন্ধের দিকে আদিত্যের এক ক্লাসমেট শুভ্রকে এসে বললো, “তুমি আদিত্যের ভাই, শুভ্র, তাই না?”

“হ্যাঁ, না মানে…”

“আদিত্যের কিছু নোট আমার কাছে ছিল। কাল আমাদের একটা এক্সাম আছে। আমিই নোটগুলো আদিত্যকে দিয়ে আসতাম। কিন্তু, হঠাৎ আমার একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছে। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। তুমি প্লিজ, আদিত্যকে নোটগুলো পৌছে দাও। নাহলে সে কাল এক্সাম দিতে পারবে না।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। অসুবিধা নেই, আমি ভাইয়াকে দিয়ে আসব।”

‘থ্যাঙ্কস, ভাই, তুমি আমাকে বাঁচালে। নোটগুলো না পেলে আদিত্য আমাকে আস্ত রাখত না।”

সেদিনের ঘটনার পর শুভ্র অনেকবার চেয়েছিল আদিত্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, সেদিনের উপকারের জন্য ধন্যবাদ দিতে। কিন্তু, কেন যেন এক অদ্ভুত লজ্জা আর সংকোচে সে কিছুতেই আদিত্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারেনি, আদিত্য তাকে যে কি ভেবেছে আল্লাহই জানে? হয়তো ভেবেছে, কি ছেলেরে বাবা! এত বড় উপকারের পর একটা থ্যাঙ্কস পর্যন্ত দিল না।

আজ সে আদিত্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে নোট দেয়ার অজুহাতে।

.

আদিত্য বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে, চট্টগ্রামে তাদের নিজস্ব বাড়ি আছে, ভিড় কোলাহল তার কখনোই ভাল লাগত না, তাই সে হলে না থেকে ইউনিভার্সিটি থেকে একটু দূরে একটি ছোট ফ্লাটে একা থাকতো। শুভ্র আগেই তার বাসার ঠিকানা জানত। তাই সেদিন সব সংকোচ জয় করে তার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শুভ্রর বুকটা ভয়ে একটু ধুপ ধুপ করছিল। অনেকক্ষণ বেল বাজানোর পরও কেউ দরজা খুলল না। বাসায় কেউ নেই নাকি, ভাইয়া কি বাইরে- সে নিজে নিজে ভাবল। তালা বন্ধ কিনা পরীক্ষা করতে দরজার নব ঘোরাতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। একটু দ্বিধা নিয়ে সে ভেতরে প্রবেশ করল। এ যেন এক স্বপ্নপুরী, ঢুকতেই বসার ঘর, বেশ ঠান্ডা, নয়নাভিরাম করে সাজানো, কীরকম ফাঁকা ফাঁকা, শান্ত একটা ভাব, ঘরের দেয়াল হালকা বেগুনি, পুরো ঘরে কোন লাইট নেই, অথচ এক অদ্ভুত নীল আলোয় চারদিকে রহস্য তৈরী করেছে, দেয়ালে একটিমাত্র জল রঙ্গের ছবি, সেই ছবির দিকে তাকালে মন ভাল হয়ে যায়।

শুভ্র ভাইয়া বলে জোরে ডাক দিল কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। একটু কৌতূহলের সাথেই সে ভেতরে প্রবেশ করলো। আদিত্য চিৎ হয়ে অচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে। ঘরময় অ্যালকোহলের গন্ধ। কি যেন আদিম আকর্ষন শুভ্রকে আদিত্যের দিকে টানছে, তার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করছে। সে আদিত্যের পাশে বসে তার কপালে হাত রাখল। কপাল ভীষণ গরম, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কেন যেন এই মানুষটার প্রতি অদ্ভুত মায়া অনুভব করছে সে! এর নামই কি ভালোবাসা? আদিত্যকে এই অবস্থায় একা ফেলে যাওয়া তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না।

আদিত্যের পা থেকে জুতোমোজা, গা থেকে শার্ট খুলে নেবার সময় তার হাত কাঁপলো কিন্তু পাত্তা দিল না। টেবিল থেকে ক্লথ তুলে নিয়ে আদিত্যের মাথার নীচে দিল, বালতি করে পানি এনে মাথায় ঢালতে লাগলো। মুছিয়ে দিল চোখ, লোমশ বুক।

হঠাৎ লাল টকটকে চোখ মেলে তাকালো আদিত্য

“তুমি আমার ঘরে কেন, why?”

“প্লিজ, আপনি এখন কথা বলবেন না।”

আদিত্য মাথা নেড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল, এখন তার একটু ভাল লাগছে। জ্বর কমে এসেছে। শুভ্র চাইলে আদিত্যকে একা রেখে চলে যেতে পারত, কিন্তু শুভ্রর সেখান থেকে ফিরে আসতে একদম ইচ্ছা করছিল না। কিছুক্ষণ পর আদিত্য পানি খেতে চাইল। জগ থেকে পানি ঢেলে শুভ্র আদিত্যের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিলে, তার কাঁপা কাঁপা হাতে পানি পড়ে যাচ্ছিল। শুভ্র আদিত্যের হাত ধরে গ্লাস এগিয়ে দিল মুখের কাছে।

পানি খেয়ে হঠাৎ আদিত্য শুভ্রকে কাছে টেনে নিলো। পাগলের মত চুমো খেতে লাগলো শুভ্রকে। শুভ্র নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, কিন্তু মাতাল আদিত্যের শরীরে যেন অসুর ভর করেছে, নিমিষেই যেন সে তার শক্তি ফিরে পেয়েছে।

“প্লিজ, শুভ্র, আমাকে একটু ভালোবাস। বিশ্বাস করো, কেউ কোনো দিন আমাকে ভালোবাসেনি। তুমি জানো না, তুমি আমার, শুধু আমার, আমি যে তোমাকে ভালোবাসি, শুভ্র!”

মাতাল আদিত্যের জ্বরের ঘোরে বলা প্রলাপগুলো সেদিন শুভ্রর সুপ্ত মনে ঝড় তুলেছিল, সে যেন বহু বছর পর খুঁজে পেল পরম কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপুরুষকে। আদিত্য তাকে আরও শক্ত করে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরলো। চুমো খেতে শুরু করল ওর ঠোঁটে, গালে, ঘাড়ে, পিঠে। চুমো খাওয়ার পরিধি ক্রমশ বাড়ছে শরীরের নীচের দিকে, ধীরে ধীরে শুভ্রও সাড়া দিতে শুরু করলো। অতল জলের আহ্বানে তলিয়ে যেতে যেতে সে অনুভব করল অকস্মাৎ যন্ত্রনা তাকে গ্রাস করছে। যন্ত্রনা ছাপিয়ে উঠে আসছে অচিন লোকের আনন্দ।

.

আদিত্য ভোরবেলা ঝরঝরে হালকা শরীর নিয়ে ঘুম থেকে জেগে দেখল, সে সম্পূর্ণ দিগম্বর। তার গায়ে একটা সুতাও নেই। মুহূর্তেই মনে পড়ল কাল রাতের কথা। সে জীবনে প্রথম সেক্স করেছে, তাও একটা ছেলের সাথে। ঘৃণায় রিরি করে উঠলো তার শরীর। তার পুরো শরীরে যেন নোংরা লেগে আছে, নিজেকে বড্ড অপবিত্র লাগছে তার। প্রায় এক ঘন্টা ধরে শাওয়ারে ভিজল, নিজের নগ্ন শরীরের দিকে তাকাতে নিজেরই ঘেন্না লাগছে।

ভার্সিটি এসেই শুভ্র কে খুজে বের করল আদিত্য। তারপর সবার সামনেই তাকে এত জোরে চড় মারলো যে সে মাটিতে পড়ে গেল। শুভ্র অবাক দৃষ্টিতে আদিত্যের দিকে চেয়ে রইলো। সে তার অন্যায়টা কি সেটাই সে বুঝতে পারছে না। আদিত্য সবার সামনেই তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল হলের ভেতরে। শুভ্রকে নিয়ে রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল।

ক্যাম্পাসের সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো আদিত্যের দিকে। তাকে সবাই ভদ্র, শান্ত স্বভাবের ছেলে বলেই জানতো এতদিন। কী এমন করল শুভ্র যে আদিত্য তার উপর এতটা রেগে গেছে?

.

শিমুলের মন খুব খারাপ। রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় ফিরছে তারা। শিমুল গাড়ি ড্রাইভ করছে। শুভ্র সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে, তার নাকি মাথা খুব ব্যথা করছে। শিমুল শুভ্রকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে এসেছিল রাতের ডিনারের জন্য। রান্নার ঝামেলা করতে তার একদম ভাল লাগে না, দুপুরে কোন রকম খিচুড়ি রান্না করেছে, ফ্রিজে গরুর মাংস ছিল, তাই দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে। শুভ্র আসার আগে বুয়াই সব রান্না করে দিয়ে যেত। কিন্তু বুয়ার রান্না শুভ্রর একদম ভাল লাগে না। তাই সে এসেই বুয়াকে পার্মানেন্টলি ছুটি দিয়েছে। সংসারে রান্না থেকে শুরু করে ঘর গোছানোসহ সব কাজ শুভ্র নিজেই করে কিন্তু প্রতি শুক্রবার শিমুলের কাঁধে দায়িত্ব পড়ে। আর ঐ একদিনেই শিমুলের অবস্থা কাহিল।

নিজেদের কথা ভাবলে অদ্ভুত লাগে শিমুলের। ভালোবাসাহীন, সম্পর্কহীন একটা সংসার যেখানে এক ছাদের নীচে বাস করেও পরষ্পর থেকে তারা কতটা দূরে, একসাথে থেকেও তারা দুজনই একা। শুভ্র চাইলেই সব কিছুর একটা নতুন সূচনা হতে পারে, কিন্তু শুভ্র কি কখনো তা চাইবে? শিমুল কি পারবে শুভ্রর মনে নিজের জন্য কিছুটা হলেও জায়গা করে নিতে? এসব ভাবতে ভাবতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল শিমুল, এমন সময় দৈত্যের মত একটা ট্রাক সামনে থেকে বাতাস কাঁপিয়ে আসছিল, আর একটু দেরি হলেই লেগে যেত শিমুলের গাড়ির সাথে।

– দেখে চালাও না, এক্সিডেন্ট করবে তো, শুভ্র চোখ খুলে বললো।

– না, একটা ট্রাক হঠাৎ করে সামনে চলে আসলো।

– তুমি না আমাকে কি যেন বলবে বলেছিলে?

– হ্যা, তোমাকে বলা হয়নি, এই বুধবার সায়ানের জন্মদিন। এবার একটু বড় করেই অনুষ্ঠান করছে। মা খুব ধরেছে আমাকে যাওয়ার জন্য, না গেলে অনেক রাগ করবে।

– কিন্তু ছুটি পাবে অফিস থেকে?

-হ্যাঁ, বসকে বলেছি, ম্যানেজ হয়ে যাবে, তাছাড়া কতো দিন মাকে দেখি না, বাসার সবার জন্যই খারাপ লাগছে।

– ঠিক আছে, যাও তাহলে।

– তুমি একা থাকবে?

– কেন, সমস্যা কী?

– শুভ্র, আমি চাইছি তুমিও আমার সাথে চট্টগ্রাম যাও।

– আমি? আমি কিভাবে যাব?

– কেন, সমস্যা কোথায়?

– সবাই কি মনে করবে?

– তুমি আমার বন্ধু, তুমি আমার সাথে যেতেই পার, তাছাড়া আমি মাকে তোমার কথা বলেছি, মা বলেছেন তোমাকেসহ নিয়ে যেতে।

– তুমি বুঝতে পারছ না, আদিত্য এখন চট্টগ্রামে। সে হয়তো জানে যে তুমি আর আমি এখন একসাথে আছি। সে তো আর জানে না যে আমরা দুজন শুধু বন্ধু।

– গাধার মত কথা বল না, আদিত্য বিয়ে করে বৌ নিয়ে সংসার করছে। তুমি এখন যার সাথে যা খুশি তাই কর, তাতে তার কী এসে যায়?

– যদি আদিত্যের সাথে দেখা হয়ে যায়?

-ওকে, তোমাকে যেতে হবে না, আমি একাই যাব।

শুভ্র কিছু না বলে চুপ করে রইলো। শুভ্রকে আরও কিছু কথা বলার ছিল শিমুলের, কিন্তু এখন আর কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। তার এই অর্থহীন কথাগুলো হয়তো কখনোই বলা হবে না।

তার খুব ইচ্ছে করে শুভ্র কে নিয়ে সমুদ্রে যেতে, সমুদ্রের তীর ঘেষে শুভ্রর হাত ধরে হারিয়ে যেতে নীল অজানায়, সাগরের ঢেউগুলো তাদের পায়ে এসে আছড়ে পড়বে, সূর্যাস্তের পর গোধূলি বেলায় পাথরের উপর বসে দুজনে গল্প করবে। শুভ্র হয়তো তাকিয়ে থাকবে টিমটিম আলোয় জ্বলতে থাকা দূরের জাহাজগুলোর দিকে। শিমুল নিজেই ভেবে অবাক হয় কাকে নিয়ে সে এত স্বপ্ন দেখে যে সারাক্ষণ অতীতের স্মৃতিতে মাতাল হয়ে থাকে? শিমুলের মন আরও খারাপ হয়ে গেল। গাড়িতে মৃদু তালে মিউজিক বাজছে –

”I am so lonely, Broken Angel

I am so lonely, listen to my heart”

.

শুভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদিত্যের দিকে, তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে,

– আপনি এমন করছেন কেন? আমি কি অন্যায় করেছি?

– অন্যায় করেছ মানে? তুমি কাল রাতে কেন আমার বাসায় গিয়েছিলে?

– আমি…. আমি তো নোট দিতে…

আদিত্য শুভ্রর কোন কথাই শুনতে চাইল না,

-সব কিছু হইছে শুধু তোমার জন্য।

– আমার জন্য? আমি তো নিজে থেকে কিছু করিনি, বরং আপনি আমার উপর জোর করেছেন।

– আমি তো মাতাল ছিলাম, হুঁশ ছিল না, তোমার তো হুঁশজ্ঞান সব ঠিক ছিল, তুমি বাধা দিলে না কেন? শালা Gay কোথাকার!

– আপনি নিজে কী সেটা একবার চিন্তা করেছেন? মাতাল হয়ে ছেলে মেয়ের পার্থক্য ধরতে পারেন না, অথচ শরীরের কাম বাসনা কিভাবে মেটাতে হয় সেটা ঠিকই জানেন।

শুভ্র কাঁদছে, তার মুখে চড়ের দাগ লাল হয়ে আছে, আদিত্য আর কিছু না বলে চুপচাপ বেড়িয়ে গেল।

.

আজ প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আদিত্য ভার্সিটিতে যাচ্ছে না। মোবাইল অফ করে রেখেছে, বন্ধু বান্ধব কারো সাথেই কোন যোগাযোগ নেই। সেদিনের শুভ্রর চোখের পানি সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না, নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। সত্যিকারে শুভ্রর তো কোন দোষ ছিল না। ঐ রাতে যা কিছু হয়েছে তার জন্য সে নিজেই দায়ী। কিন্তু, তার নিজেরও কি খুব বেশি দোষ ছিল? ছোটবেলা থেকে ছেলেদের প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করত সে। কিন্তু, তার এই অনুভূতিকে সে সারাজীবন পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু শুভ্রকে দেখার পর তার সব কিছু যেন ওলটপালট হয়ে গেল, শুভ্রর মুখটা সে যেন কিছুতেই ভুলতে পারছে না। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা শুধু তার কথাই ভাবতে ইচ্ছে করে।

ভার্সিটিতে আদিত্যের চোখজোড়া শুধু একটা মুখকেই খুঁজে ফিরে। যেদিন শুভ্রর সাথে দেখা হয় না, সেদিন তার কোন কিছু ভাল লাগে না, ক্লাস করতে ইচ্ছে করে না, খেতে ইচ্ছে করে না, আগের মত এখন আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতেও ভালও লাগে না। তাহলে কি শেষ পর্যন্ত সে শুভ্রর প্রেমে পড়েছে? না হলে কেন সে শুভ্রর জন্য এতটা ফিল করছে? শুভ্রকে খুব মিস করছে আদিত্য, বুকের ভেতর কেমন জানি চিনচিন করে ব্যাথা করছে তার। শুভ্রর কাছে তাকে ক্ষমা চাইতেই হবে, না হলে সে নিজেকে কখনো মাফ করতে পারবে না।

.

– আরে, আদিত্য ভাই, কেমন আছেন আপনি? গত দুই সপ্তাহ কই ছিলেন? ফাহাদ আদিত্যের দিকে হাসি মুখে এগিয়ে আসলো।

– এই তো একটু অসুস্থ ছিলাম।

– তাই তো বলি, আপনাকে ভার্সিটিতে দেখি না কেন?

– ফাহাদ, তুমি কি শুভ্র কে একটু ডেকে দিতে পারবে? ওর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিল।

-ঠিক আছে, ভাইয়া। আমি শুভ্রকে এখনই ডেকে দিচ্ছি।

– থ্যাংকস, ফাহাদ।

– আরে ভাই, এর জন্য থ্যাংকস বলা লাগে?

আদিত্য সন্ধ্যার পর হলের সামনে সিড়িতে দাড়িয়ে শুভ্রর জন্য অপেক্ষা করছে। কিভাবে যে শুভ্রকে কথা গুলো বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। বড্ড অস্থির লাগছে, বাইরের ঠান্ডা বাতাসেও আদিত্যের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

– আপনি আমাকে ডেকেছেন? শুভ্র আদিত্যের সামনে এসে দাড়ালো।

– হ্যাঁ, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।

-আমার সাথে আপনার কি কথা থাকতে পারে? সেদিন সবার সামনে চড় মেরেও সাধ মেটেনি, নতুন করে আবার মারতে এসেছেন?

– শুভ্র, সেদিনের জন্য আমি সত্যি খুব স্যরি। সেদিন আমার মাথা ঠিক ছিল না, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।

– আমি আপনাকে ক্ষমা করার কে, বলুন? আপনারা সিনিয়র, তাই জুনিয়রদের সাথে যা খুশি তা করার অধিকার আছে।

– প্লিজ, শুভ্র! তুমি জানো না, গত দুইটা সপ্তাহ আমার যে কিভাবে কেটেছে, একটা মুহূর্তের জন্য আমি শান্তি পাইনি।

– সো, আমি আপনাকে কিভাবে শান্তি দিবো?

– শুভ্র, প্লিজ, ফরগিভ মি!

-আপনি এখন যান, আর নিজেকে অপরাধী ভাবার কিছু নাই। আপনি কোনও দোষ করেননি। সব দোষ আমার, আমি আপনার ফ্ল্যাটে গিয়েছি। আপনি তো আমাকে বলেননি রাত জেগে আপনার সেবা করতে। যা কিছু হয়েছে আমার কারণে হয়েছে।

-তার মানে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না?

–বারবার একই কথা কেন বলছেন?

-ওকে, ফাইন। ক্ষমা করা তোমার উপর। কিন্তু, যতক্ষণ তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না, আমি এখান থেকে কোথাও যাব না।

–পাগলের মত কথা বলছেন কেন?

-আমি তো পাগলই।

– আপনার যা খুশী তাই করেন, আমি যাচ্ছি।

.

রাত প্রায় ১০টা বাজে, আদিত্য হলের বাইরে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করছে, কেন সে এখানে এত রাতে এভাবে একা দাঁড়িয়ে আছে? আদিত্যের ভেতর যে একটু পাগলামী স্বভাব আছে এটা ভার্সিটির প্রায় সবাই জানে। তাই কেউ আদিত্যকে নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাল না। আদিত্য তার সিদ্ধান্তে অটল, শুভ্র তাকে মন থেকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত সে এখান থেকে যাবে না, দরকার হলে সে সারা রাত দাড়িয়ে থাকবে। এমনিতেও শুভ্রর কাছে তার কিছু শাস্তি পাওনা আছে।

হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হল, অসময়ের বৃষ্টি, বছরের এই সময় সাধারণত বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। ঢালাও বর্ষণ, আদিত্য ভিজছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। ঠান্ডায় তার গা কাঁপছে, তারপরও সে বৃষ্টির ভেতরেই স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে শুভ্রর অপেক্ষায়। সে জানে শুভ্র আসবে, তাকে যে আসতেই হবে।

রাত ১১টা। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, এক মুহূর্তের জন্যও বৃষ্টি থামেনি। শুভ্র জানালার পাশে দাড়িয়ে আদিত্যকে দেখছে। তার খুব ইচ্ছে করছে একটি ছাতা নিয়ে আদিত্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে ডাকতে, বৃষ্টির মধ্যে দুজনই একই ছাতার নিচে দাঁড়াতে। কিন্তু সে জানে এসব পাগলামির কোন মানে হয় না। আদিত্যের জন্য তার খুব খারাপ লাগছে, মানুষটা সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজছে। নির্ঘাত আবার জ্বর বাঁধাবে। আদিত্যের তো রাতে কিছু খাওয়াও হয়নি, এতক্ষণে নিশ্চয় খুব ক্ষিদে পেয়েছে। এত পাগল কেন মানুষটা, বাচ্চাদের মত জিদ ধরে বসে আছে। শুভ্র নিজেও রাতে কিছু খায়নি, ফাহাদ তাকে খাওয়ার জন্য ডেকেছিল, কিন্তু তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

.

– আপনি এখনো দাড়িয়ে আছেন?

– বলেছি না, তুমি ক্ষমা না করলে আমি কোথাও যাব না?

– আপনি সত্যি একটা পাগল।

– এতক্ষণে বুঝলা?

– হ্যাঁ, বুঝেছি, শুভ্র হেসে বলল।

– ক্ষমা করেছ?

– না করে উপায় আছে?

– আরও আগে করলে ভাল হত।

– কেন?

– আমাকে এতক্ষণ দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে হত না।

– আপনার এই শাস্তিটুকু পাওয়ার দরকার ছিল।

– আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি আনন্দ পেয়েছ?

-তোমার কি মনে হয়?

– জানি না।

– যাও, এখন বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি কাপড় চেঞ্জ কর, না হলে আবার জ্বর বাঁধাবে।

শুভ্র নিজেও জানে না কখন থেকে সে আদিত্যকে তুমি বলে সম্বোধন করছে। শুভ্র হলের বারান্দার ভেতরে দাড়িয়ে আদিত্যের সাথে কথা বলছিল। আদিত্য তার হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে আসলো,

– এখন বুঝ, আমাকে বৃষ্টিতে ভেজানোর মজা।

আদিত্য হাসছে, কি সহজ সরল সেই হাসি।

– শুভ্র, চল আমার সাথে।

– এত রাতে, কোথায়?

– আমার ফ্ল্যাটে, প্লিজ!

আদিত্য শুভ্রর দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিল, এই হাতের আহবান উপেক্ষা করার শক্তি আজ শুভ্রর নেই, হয়তো কখনোই ছিল না।

.

আদিত্য শুভ্রকে নিয়ে সোজা তাদের ছাদে চলে আসলো। তাদের ছাদটা খুব সুন্দর। ছাদের মেঝে সাদা মার্বেল পাথরের, ছাদের একপাশে বাগান, পুরো ছাদের রেলিং জুড়েই বিভিন্ন ধরনের লতানো গাছ। ছাদটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়। আবছা আবছা আলো, মুষলধারে বৃষ্টি, সবকিছু মিলে এক অদ্ভুত রহস্যময়তা তৈরি হয়েছে।

আদিত্য ছাদের দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর শুভ্রর সামনে এসে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে বললো,

-I Love You, শুভ্র, আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আদিত্যের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্র, তারপর আটকে রাখা নিশ্বাস ধীরে ধীরে ছেড়ে বলল,

– তুমি…. আমাকে… সত্যি?

– তুমি জানো সত্যি, তুমি জানো আমরা দুজনই পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলেছি।

-হ্যাঁ।

এক অদ্ভুত আনন্দে শুভ্রর হাসতে ইচ্ছে করছে, আবার কাঁদতেও ইচ্ছে করছে।

-শুভ্র, নিজের সাথে আমি অনেক যুদ্ধ করেছি। কিন্তু, তোমাকে অগ্রাহ্য করার শক্তি আমার নেই। আজকে সম্পূর্ণ স্বজ্ঞানে জেনে বুঝে বলছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। তুমি সামনে আসলে আমি শিহরিত হই। অকারণে সব কিছু ভাল লাগতে শুরু করে। পারবে না এই পাগলটাকে একটু সামলে রাখতে? তাকে একটু কেয়ার করতে, ভালোবাসতে?

শুভ্র কি বলবে বুঝতে পারছে না,

-তুমি কিছু বলবে না?

– আমার সব কথা তো তুমিই বলে দিয়েছ।

শুভ্র আর কিছু না বলে তার ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো আদিত্যের ঠোঁটে, দুজন দুজনের অধরে চুমো খেয়ে চললো অবিরাম ভাবে বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে যেন দুজন তৃষ্ণার্ত পথিক পিপাসার্ত হয়ে পান করছে একে অপরকে। এ যেন কোন যৌনতা নয়, ভালোবাসার সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া।

– আজকে সারা রাত এখানেই থাকব, বৃষ্টিতে ভিজব, আদিত্য বলল।

– পাগল নাকি, জ্বর বাঁধাবে তো!

– জ্বর হলে ক্ষতি কী, এখন তো আমি একা নই। জ্বর হলে তুমি আমার সেবা করবে। আমাকে খাইয়ে দেবে, মাথায় পানি ঢালবে, সারাক্ষণ আমার পাশে বসে থাকবে।

– আর তুমি কী করবে তখন?

– আমি তোমার কোলে মাথা দিয়ে তোমার হাত ধরে শুয়ে থাকব।

– হইসে, চল প্লিজ!

– আমি অনেকক্ষণ ধরে ভিজেছি, এখন আর ঠান্ডা লাগছে না। আজকের রাত আমাদের দুজনের জন্যই অনেক স্পেশাল। এই রাতে ঘুমালে চলে, বল?

বৃষ্টির বেগ এখন অনেকটাই কমে এসেছে, ঝিরিঝিরি করে ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়ছে। আদিত্য তার পরনের জিনস, শার্ট সব খুলে ফেললো। ভেজা কাপড় অনেকক্ষণ শরীরে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আদিত্যের পরনে শুধু একটা কালো রঙ্গের বক্সার, শুভ্রকেও কাপড় খুলতে সাহায্য করলো। দুজনই অর্ধনগ্ন হয়ে বৃষ্টির মধ্যে শুয়ে পড়েছে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনুভব করছে শরীরের প্রতিটি লোম কূপ দিয়ে, খুঁজে নিচ্ছে আদিম উষ্ণতা। একে অপরের সারা শরীরে চুমো খেয়ে যাচ্ছে। আজ কোনও যৌনতা নয়, ভালোবাসার মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। চিনে নিচ্ছে পরষ্পরের দেহের প্রতিটি লোমকূপ, শরীরের মাদকতাময় বুনো গন্ধ, চুমো দিয়ে একে দিচ্ছে পরষ্পরের শরীরে ভালোবাসার সাক্ষর।

এক হয়ে গেছে দুটো শরীর, সময় থমকে গেছে, স্থির হয়ে গেছে পৃথিবী, যেন এই পৃথিবীতে তারা দুজন ব্যতিত বাকী অন্য কিছুর কোনও অস্তিত্ব নেই, ছিল না কোনদিন।

.

– শুভ্র, আর কতক্ষণ ধরে এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো, রাত প্রায় ১২টা বাজে।

– আমার বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না, শিমুল।

– কিন্তু, তাই বলে কতক্ষণ এভাবে গাড়ি নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব? কাল আমার অফিস আছে, শুভ্র।

– আমার কিছু ভাল লাগছে না, শিমুল।

– আমি তোমাকে বুঝি, শুভ্র। কিন্তু, নিজেকে একটু সামলাও, সব কিছু ভুলে যেতে চেষ্টা কর। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

-শিমুল, ব্রিজের উপর গাড়িটা একটু সাইড করে রাখ তো।

– কই যাবে, এই বৃষ্টির মধ্যে?

– আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে।

– আমার শরীর ভালো না, আমি ভিজব না।

-ওকে, তুমি গাড়ির ভেতরে বসে থাক, আমি নামবো।

– ঠিক আছে, আমিও আসছি।

-না, তোমাকে যেতে হবে না, আমাকে একটু একা থাকতে দাও, প্লিজ!

শুভ্র ব্রিজের রেলিং এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার জীবনের একটি বিশেষ রাত। এই রাতেই তো আদিত্য ভালোবেসে শুভ্রর হাত ধরে ছিল, সারা জীবন পাশে থাকার অঙ্গীকার করে ছিল। আজ শুভ্র ও আদিত্যের ভালোবাসার তৃতীয় বর্ষপূর্তি। আজও তুমুল বর্ষণ হচ্ছে, আজও শুভ্র বৃষ্টিতে ভিজছে, কিন্তু আজ আদিত্য তার পাশে নেই, আজ সে একা। সময়ের আবর্তনে পাল্টে যায় জীবনের দৃশ্যপট, শুধু রয়ে যায় স্মৃতি, নিভে যাওয়া আগুনের অবহেলিত ভস্মীভূত সাদা ছাইয়ের মত।

শুভ্র কাঁদছে, চিৎকার করে কাঁদছে। বুক ভাঙ্গা কষ্ট বের হয়ে আসছে মনের গহীন থেকে, আজ প্রকৃতিও কাঁদছে শুভ্রর সাথে তাল মিলিয়ে, শুভ্রর কান্নার শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দে, বৃষ্টির জলে মিলে মিশে একাকার হচ্ছে চোখের পানি।

শিমুল আজ পর্যন্ত শুভ্রর বয়সী কোন ছেলেকে এভাবে কাঁদতে দেখে নি, তার খুব ইচ্ছে করছে শুভ্রর পাশে দাড়িয়ে তার কাধে হাত রাখতে, ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে বলতে, ”প্লিজ, তোমার কষ্টগুলো আমাকে দাও, তোমাকে এত কষ্ট পেতে দেখে আমার যে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে।” কিন্তু, শুভ্রর এই কষ্টের জগৎটা তার একার। শিমুল কখনো সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। কাঁদুক শুভ্র। কেঁদে তার বুকের গভীরে জমে থাকে কষ্ট গুলোকে ভাসিয়ে দিক বৃষ্টির জলে।

শিমুলও গাড়ি থেকে নেমে বাইরে দাঁড়িয়ে একা একা ভিজছে। কেন জানি তার চোখও জলে ভরে উঠছে। তখনি সে সিদ্ধান্ত নিলো শুভ্র না চাইলেও তাকে জোর করে চট্টগ্রাম নিয়ে যাবে। একবারের জন্য হলেও সে শুভ্রকে আদিত্যের সামনে দাঁড় করাবে। কারণ, শিমুল জানে ঠিক এই মূহুর্তে আরও একজন শুভ্রর মত বৃষ্টির মাঝে তার ভালোবাসার মানুষকে খুজে ফিরছে।

Every night in my dreams

I see you, I feel you,

Near, far, wherever you are

I believe that my heart does go on.

Love can touch us one time,

And last for a lifetime.

Once more you open the door,

And you are in my heart

And my Heart will go on and on.

.

সকাল থেকেই আদিত্যের মেজাজ খারাপ। বাসা থেকে বের হবার সময় ভাল মত নাস্তা করেনি। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। রুপা যদি জানতে পারে যে সে এখনো লাঞ্চ করেনি, তাহলে তার খবর আছে। বাসা থেকে বের হবার সময় জিসান আদিত্যকে ফোন করেছিল। জিসান আদিত্য ও শুভ্রর ফেসবুকের বন্ধু। সে তাদের সম্পর্কের কথা অনেক আগে থেকেই জানত। জিসান আদিত্যকে বলেছে শুভ্র নাকি শিমুল নামের একজনের সাথে একই ফ্ল্যাটে থাকছে। থাকুক, তাতে তার কী এসে যায়? তার সাথে এখন তো আর শুভ্রর কোনও রিলেশন নাই। চার মাসে আগেই সবকিছু শেষ হয়ে গেছে ,শুভ্র তো এখন নতুন কোনও রিলেশনে জড়াতেই পারে। কিন্তু তাই বলে শুভ্র কিভাবে পারল এত জলদি গত তিনটা বছরকে ভুলে যেতে? চার মাস না যেতেই তাদের সব ভালোবাসাকে অস্বীকার করে নতুন একজনের সাথে সম্পর্কে জড়াতে। একেবারে লিভ টুগেদার! ভাবতেই আদিত্যের ঘেন্না লাগছে।

আসলে সে নিজেই একটা গাধা। তা না হলে শুভ্রর কথা ভেবে তার নিজের বিয়ে করে বৌকে গত দুই মাসে একবারের জন্য স্পর্শ করে নি। সে জানে, সে রুপার সাথে অনেক বড় অন্যায় করছে। রুপা আসলে অনেক ভাল একটা মেয়ে। সবকিছু চুপচাপ নীরবে মেনে নিয়েছে। রুপা শুধু জানে বিয়ের আগে আদিত্য অন্য কাউকে ভালবাসত, কিন্তু সে কে ? তার নাম কোনও কিছুই রুপা জানতে চায় নি।

শুভ্রর সাথে আদিত্যের সম্পর্কের তিনটা বছর যেন দেখতে দেখতেই কেটে গেল, খুব সুখেই ছিল তারা। ভার্সিটিতে আদিত্যের সব বন্ধুরাই শুভ্রর সাথে তার ঘনিষ্ঠতার কথা জানত। অনেকের কাছে ব্যাপারটা একটু দৃষ্টিকটু ছিল, তবে কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায়নি, আর একবছর পর আদিত্যের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল। ফলে তাকে বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম চলে আসতে হল।

আদিত্য ছিল তার বাবা মায়ের বড় ছেলে, বাবার বয়স হয়েছে, তাই আদিত্য তার বাবার সাথে অফিসে জয়েন করল। তবে স্থানগত দূরত্ব আদিত্যের আর শুভ্রর ভালোবাসায় কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। আধুনিক প্রযুক্তি হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষকেও তার ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। সময় পেলেই মোবাইলে কথা হত, ফেসবুকে চ্যাট, আর রাতে স্কাইপিতে সরাসরি কথোপকথন। তাছাড়া ব্যবসায়ের কাজে আদিত্যকে প্রতি মাসে একবার ঢাকায় আসতে হত। ঢাকায় আসলে ৩/৪ দিন আদিত্য তার নিজের ফ্ল্যাটেই থাকতো, সেই সময় শুভ্রও এসে আদিত্যের সাথে থাকতো। এভাবেই কেটে গেল শুভ্র ও আদিত্যের জীবনের সবচেয়ে মধুর তিনটি বছর। শুভ্র তার পাশে থাক বা না থাক, আদিত্য সব সময়ই যেন অনুভব করত শুভ্রর উপস্থিতি, তার সমস্ত হৃদয় জুড়ে ছিল শুধু একজন, শুভ্র।

শুভ্রও আদিত্যের অনেক খেয়াল রাখত, আদিত্য ঠিক মত খেয়েছে কিনা, বাসায় কখন ফিরলো, ঘুম থেকে উঠেছে কিনা, সব খবর তার রাখা চাই।

একসময় আদিত্য প্রচুর সিগারেট খেত, কিন্তু শুভ্রর সাথে রিলেশনের পর সে সিগারেট ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। শুভ্রর সোজা কথা “তোমাকে আমার আর সিগারেটের মধ্যে যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে, হয় তুমি সিগারেট ছাড়বে, না হলে আমায়।“ আদিত্য সিগারেটকেই ছেড়ে ছিল, শুভ্রর মত ভালোবাসার মানুষকে কি কেউ ভুলেও হারাতে পারে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদিত্যকে হারাতে হয়েছে তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে যাকে সে একদিন তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসত, হয়তো এখনো বাসে।

আদিত্য প্রচুর রাগী, হুট করেই সে রেগে যায়, তবে পরক্ষণেই তার রাগ পানি হতে সময় লাগে না। গত তিন বছরে তাদের মাঝে ঝগড়া-ঝাঁটি কম হয়নি, কিন্তু সেগুলো ভালোবাসার মান অভিমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। শুভ্র বয়সে আদিত্য থেকে ছোট হলেও সে ছিল অনেক ম্যাচিউর, যে কোনও পরিস্থিতি সে খুব ভালভাবে হ্যান্ডেল করতে পারত।

শুধু ভালোবাসা দিয়েই কখনো একটি রিলেশন টিকিয়ে রাখা যায় না। তাদের দুজনের মধ্যেই অকৃত্রিম ভালোবাসা ছাড়াও ছিল একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, সততা, পারস্পারিক বোঝাপড়া , শ্রদ্ধাবোধ এবং সেই সাথে একজন অন্যজনের ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে গুরুত্ব দেয়া। তাই হয়তো সমকামী জগতে আদিত্য আর শুভ্র ছিল আদর্শ জুটি। সবাই যেকোন কিছুতে তাদের উদাহরণ দিত, তাদের দুজনকে দেখে বাকীরাও স্বপ্ন দেখত, জীবনে এমন সঙ্গী পাওয়ার যে তাকে এভাবেই ভালোবাসবে মন প্রাণ উজাড় করে। কিন্তু তারপরও কি টিকে রইলো সেই মজবুত ভালোবাসার বাঁধন? জীবনের বাস্তবতার প্রবল ঘূর্ণিতে হারিয়ে গেল শুভ্র আদিত্যের পবিত্র ভালোবাসা।

.

সেদিন কি অমাবস্যা ছিল? সেই রাতে আকাশে চাঁদ ছিল কিনা আদিত্যের মনে নেই, কিন্তু সে শুধু জানে সেই রাত ছিল তার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ এক নিকষ কালো অন্ধকার রাত। ঐ রাতে সে হারিয়ে ফেলেছিল তার জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ। সেই সাথে হারিয়ে গেল তার জীবনের সব সুখ, আনন্দ আর ভালোবাসা।

ঘড়িতে রাত প্রায় ১টা। শুভ্র আদিত্যের বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিল।

– কি ব্যাপার, আদি এত চুপচাপ, কথা বলছ না যে?

– ভাল লাগছে না

-মন খারাপ?

আদিত্যে চুপ করে রইল।

– কাল চট্টগ্রাম চলে যেতে হবে, তাই মন খারাপ?

-হ্যাঁ।

– আরে পাগল, মন খারাপ করছ কেন? আগামী মাসে তো আবার আমাদের দেখা হচ্ছে, তাই না?

– শুভ্র, তোমাকে আমার কিছু কথা বলার ছিল।

-বল।

– আসলে কিভাবে যে বলব সেটাই বুঝতে পারছি না।

– আমার কাছে কোন কথা বলতে এত hesitate করার কি আছে?

– শুভ্র, তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাস?

– আজ তিন বছর পর এই প্রশ্ন কেন?

– আগে তুমি জবাব দাও

– তোমার সন্দেহ আছে?

– না নেই, তারপরও তুমি বল।

– গত তিন বছরে আমার জীবনের প্রতিটি সকাল ছিলে তুমি, তোমাকে দিয়ে শেষ হয়েছে প্রতিটি রাত, আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে জড়িয়ে আছ শুধু তুমি, আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে আছে শুধু একজন, তার নাম আদিত্য।

– আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি, শুভ্র। তোমাকে ছাড়া আমি সেকেন্ডও বাঁচতে চাই না, বিশ্বাস কর, গত তিন বছরে একটি বারের জন্য তোমাকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবিনি। রাস্তায় কোনও সুন্দর ছেলের দিকে আমার চোখ পড়লে, আমার মনে হয়েছে আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি। আমার জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসব।

আদিত্য শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। সে কিছুতেই আজ নিজেকে সামলাতে পারছে না।

– আদি, তুমি কাঁদছ কেন? কী হয়েছে আমাকে বল, আমি আছি তো তোমার পাশে। তুমি জান না, তুমি এভাবে কাঁদলে আমার কেমন লাগে।

শুভ্র আদিত্যের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে তার কপালে কিস করল।

– শুভ্র, তুমি প্রমিস কর, আমাদের জীবনে যেকোন পরিস্থিতি আসুক না কেন তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না।

– আমার এই পাগল ভালুক ছানাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব বল?

– সত্যি, আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?

– আরে, সত্যি যাব না, এখন চোখ মুছ, বল কি হইসে।

– শুভ্র , বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করছে।

– বিয়ে? তোমার? ভাল তো করে ফেল।

– ফাজলামি না, শুভ্র, দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছে।

– মানে কি? শুভ্র বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।

– আসলে, আমি তোমাকে বলিনি, আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। কথাগুলো তোমাকে আরও আগেই বলা উচিত ছিল, কিন্তু সবকিছু এত জলদি হয়ে গেল যেন আমি নিজেই কিছু বুঝে উঠতে পারি নি।

– তুমি কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আদি। তোমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে আর আমি কিছুই জানিনা !

– এনগেজমেন্ট বলতে তেমন কিছু না, ওদের পরিবারের সবাই এসেছিল, রিং পরিয়ে দিলাম, ব্যস এতটুকু। তাছাড়া আমি নিজেও আগে থেকে কিছু জানতাম না। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাব ভেবে মা আমাকে কিছু জানায় নি।

– তুমি রাজি এই বিয়েতে?

-আমার রাজি হওয়া বা না হওয়ায় কিছু যায় আসে না ,শুভ্র।

– আমার জন্য তুমি কী চাও সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

– আমার আর কোনও উপায় নেই, শুভ্র। আমি তোমাকে এত দিন কিছু জানাইনি কারণ তোমাকে বললে তুমিও কোন সমাধান দিতে পারবে না, শুধু শুধু কষ্ট পাবে। ভেবেছি দেখি, নিজে একা একা কতটা যুদ্ধ করতে পারি।

– এখন আমি কষ্ট পাব না?

– তুমি জানো না, গত দুই মাস আমার উপর দিয়ে কি গেছে! বিয়ে নিয়ে কম ঝগড়া করিনি আমি বাবা মায়ের সাথে। আমার মামা চাচারা পর্যন্ত আমাকে কথা শুনিয়েছে। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস না করেই তার বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।

– তার মানে তুমি বিয়ে করছ?

-আমি নিরুপায়, তুমি আমার পিঠে দাগ দেখে জিজ্ঞেস করলে না কিসের দাগ?

শুভ্র চুপ করে রইলো

– সেদিন বাবার সাথে অনেক ঝগড়া করেছি, ঝগড়ার এক পর্যায়ে বাবা আমাকে বেল্ট দিয়ে পর্যন্ত মেরেছে, জানো! তোমার জন্য এই বুড়ো বয়সে বাবার হাতে মার পর্যন্ত খেয়েছি, আর কী করব, বল? তারপরও যখন রাজি হচ্ছি না, মা আমাকে বলেছে ” তুই কি কোনও মেয়েকে ভালোবাসিস, যদি তেমন কেউ থাকে, আমাকে নাম বল, তুই যেই মেয়েকে বলবি, আমি সেই মেয়েকে তোর সাথে বিয়ে দেব, ঐ মেয়ে কালো গরীব যাই হোক, তোর ভালোবাসার মেয়েটিকে আমি ঘরের বৌ বানাব, তোর বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।” তুমি বল, আমি মাকে কিভাবে বলব যে আমি কোন মেয়েকে নয়, আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি, তার নাম শুভ্র, আমি তাকেই আমার জীবন সঙ্গী করতে চাই।

শুভ্র কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

– জানো শুভ্র, আমার এক চাচা তো আমাকে সরাসরি বলেই ফেললো “তোর ভেতরে কোনও সমস্যা আছে নাকি? থাকলে বল, আমি নিজেই তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তুমি বলো শুভ্র, আমার আর কী করার ছিল?

–ঠিক আছে আদি, আমি তোমাকে কোন দোষ দিচ্ছি না। তোমার জায়গায় আমি হলে, হয়তো আমিও তাই করতাম।

শুভ্র চোখ মুছে একটি শুষ্ক হাসি দিল, প্রাণহীন নির্জীব সেই হাসি। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে বললো, তারমানে এখানেই সবকিছু শেষ? তিন বছরের ভালোবাসার ইতি এখানেই?

– কোনও কিছুই শেষ হয়নি, শুভ্র আমরা কি পারি না বিয়ের পরও আমাদের সম্পর্ক এভাবে ধরে রাখতে? আমি এখনের মত প্রতি মাসে একবার ঢাকায় আসব, মাসে ২/৩টা দিন আমরা একসাথে থাকব?

– তোমার রক্ষিতা হতে বলছ?

– দেখ, শুভ্র এটা তো সমাজের কথা। সমাজের চোখে তো আমাদের ভালোবাসাই পাপ। কিন্তু, আমরা জানি আমরা কোনও পাপ করিনি, কারন ভালোবাসা কখনো পাপ হতে পারে না।

– কিন্তু আদি, তোমার বিয়ের পরও যদি আমরা এভাবে রিলেশন রাখি, তাহলে সেটা অনেক বড় অন্যায় হবে।

– হোক, অন্যায়, I can’t live without you.

-না, আদি, তুমি তোমার বৌকে এভাবে ঠকাতে পার না। বিয়ের পরও যদি তুমি আমাকে ভালোবাস, তাহলে কখনোই তুমি তাকে ভালবাসতে পারবে না। এটা just প্রতারণা, আমি কারও সাথে এত বড় ছলনা করতে পারব না।

– But I love you, শুভ্র!

– আমার কাছে আমাদের ভালোবাসা অনেক পবিত্র। প্লিজ, আদি, একে পরকীয়ার নাম দিয়ো না। তাছাড়া সত্য কখনো চাপা থাকে না, একদিন তোমার বৌ সব সত্যি জানবে, সেদিন কিভাবে তুমি মুখ দেখাবে?

– ঠিক আছে, এখন থেকে আমরা যদি খুব ভাল বন্ধু হিসেবে থাকি?

– আদি, তুমি কখনোই তো আমার বন্ধু ছিলে না, আর হতেও পারবে না। নিজের ভালোবাসার মানুষকে কেবল বন্ধু ভাবা কখনও সম্ভব না, তুমি আমি কেউ সেটা পারব না।

– তাহলে কী করব?

– সব কিছু ভুলে যাও, মনে কর, গত তিন বছর তোমার জীবন একটা স্বপ্ন ছিল, ঘুম ভেঙ্গে গেছে, স্বপ্নও শেষ হয়ে গেছে।

– এত সহজ সব কিছু?

– সহজ কিনা জানিনা।

– একবার ভেবেছি সবকিছু ছেড়ে ঢাকায় চলে আসব।

– আমি চাই না, তুমি আমার জন্য তোমার বাবা মাকে ছেড়ে দাও। আমি সেটা কখনো চাইব না। তুমি ঘরের বড় ছেলে, তোমাকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন, বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে আমরা কখনো সুখী হতে পারব না

– শুভ্র, প্লিজ, তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।

– দেখ, আদি, পৃথিবীতে সব কিছু ভাগ করা যায়, কিন্তু ভালোবাসার মানুষকে কখনো শেয়ার করা যায় না, অন্তত আমি তা পারব না। আল্লাহ হয়তো আমাদের ভালোবাসার রিজিক এতটুকুই দিয়ে ছিল।

– ঠিক আছে, শুভ্র তুমি যা চাও, তাই হবে, কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, আদিত্য সব সময়ই শুভ্রর ছিল এবং থাকবে।

এভাবেই ইতি ঘটলো আদিত্য আর শুভ্রর তিন বছরের সম্পর্ক। রিলেশন ব্রেকআপ হতে পারে, কিন্তু ভালোবাসায় কখনও ইতি ঘটে না, সত্যিকার ভালোবাসা আমৃত্যু বেঁচে থাকে প্রেমিকের হৃদয়ে।

– শুভ্র শেষ বারের মত আমাকে একবার কিস করবে?

– সব কিছু তো শেষ, আদি?

-প্লিজ, শুভ্র, শুধু একবার।

সারা রাত আদিত্য শুভ্রকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে শুয়ে ছিল, তাদের মাঝে সব কথাই যেন হঠাৎ করেই একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিল। দুজন প্রেমিক পুরুষ পাশাপাশি চুপচাপ শুয়েছিল। সারারাত তাদের কেউই এক করতে পারেনি দু চোখের পাতা। চারিদিকে ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা, নিঃশব্দে দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বেদনার অশ্রু জল। ঘড়ির কাটার টিক টিক শব্দ সজোরে আঘাত করছে মধ্যরাতের কুৎসিত নীরবতাকে।

“চারদিকে উৎসব, পরিপূর্ণ নিয়ন আলোয়

আমার পৃথিবী ঘিরে আসছে আধার কালোয়

সানাইয়ের সুর, নিয়ে যাবে দূর

একটু একটু করে তোমায়

আজকের রাতে তুমি অন্যের হবে

ভাবতেই চোখ জলে ভিজে যায়

এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়?”

.

রুপা একা একাই মার্কেটে ঘুরছে, সকালে বাসায় তার তেমন কোন কাজ থাকে না। আদিত্য অফিসে যাওয়ার পর তার সময় যেন কাটতে চায় না। বাচ্চাদের শপগুলোতে ঘুরে বেড়াতে তার খুব ভাল লাগে। ছোট ছোট জামা, পুতুল, খেলনা, পছন্দ হলে ২/১টা জিনিস কিনেও ফেলে সে। যদিও তার এখনো কোনও বেবি হয়নি, কখনো হবে কিনা সেটাও সে জানে না।

রুপার বয়স পঁচিশ। রুপসী মেয়েদের যা যা থাকতে হয়, সবই রুপার আছে, গায়ের রঙ ফর্সা, গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় অনেকখানি লম্বা, ঘন কালো পাপড়ি ঘেরা বড় বড় চোখ, যেখানে পৃথিবীর সব রহস্য লুকিয়ে আছে, টিকালো নাক, লোভনীয় ঠোঁট, সব কিছু ছাপিয়ে চোখে পড়ে সর্বাঙ্গে ব্যক্তিত্বের ছটা, অসাধারন। অথচ একটুও উগ্রতা নেই, নেই অনাবশ্যক চাপল্য। তারপরও কেন আদিত্য তার প্রতি এতটা উদাসীন সে বুঝতে পারে না। রুপার মনে হয় তার নিজের মধ্যেই হয়তো কোনও কমতি আছে, যার কারণে বিয়ের এতদিন পরও আদিত্য তাকে কাছে টেনে নেয় নি। মাঝে মাঝে রুপার নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়, সে জানে না এভাবে কত দিন সে নিজেকে সামলে রাখতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতে রুপা একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়তো কিডশপে পেছন থেকে ধাক্কা লেগে গেল এক সুদর্শন, লম্বা তরুণের সাথে।

– আরে রুপা তুই, কত দিন পর দেখা, কেমন আছিস তুই?

– ভাল, তুমি আসলা কোথা থেকে?

– কেন? ঢাকা থেকে!

– না, আমি ভাবলাম তুমি হয়তো মরে টরে গেছ।

– মরে গেলে তো ভালই হত। তুই কেমন আছিস বল?

– আমার সাথে কোন কথা বলবা না তুমি

-অই, এত রাগ করস কেন তুই?

– তোমার মত মানুষের সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছা আমার নাই। এই বলে রুপা সামনে হাঁটতে লাগল।

তরুণটি পেছন থেকে রুপার হাত ধরে বললো, তুই এখনো সেই আগের মতই আছিস। তোর মনে আছে, ছোটবেলায় আমি সারাক্ষণ তোর পেছনে লেগে থাকতাম, পেছন থেকে তোর বেনী ধরে টান দিতাম, আর তুই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতি।

– দেখুন, মিস্টার, আমি এখন আর ছোট নই, আর আপনার বোনও নই। যে ভাই তার বোনের বিয়েতে আসার সময় করতে পারে না, সেরকম ভাইয়ের আমার দরকার নাই।

– আমি নিজে না আসলে কি হইসে, তোর জন্য গিফট পাঠাইছি না?

– আপনার গিফটের আমার কোনও দরকার নেই, আমার স্বামীর অনেক টাকা পয়সা আছে, আমি যা খুশী তা কিনতে পারি

– ফুটানি দেখাস আমার সাথে! বেশি কথা বললে চুল টাইনা ছিঁড়ে ফেলব, বুঝছস?

– কি বললা তুমি! তোমার এত বড় সাহস!

– আচ্ছা, ঝগড়া পরে করিস। আগে চল কোথাও গিয়ে বসি, চা কফি খাই। গলা শুকাই গেছে। তোর সাথে ঝগড়া করতে গায়ে এনার্জি দরকার।

শিমুল রুপাকে নিয়ে একটি কফিশপে ঢুকল, রুপা শিমুলের আপন মামাতো বোন। কফি খেতে খেতে অনেকক্ষন চললো দুই ভাই বোনের মধুর ঝগড়া-ঝাঁটি। শিমুলের উপর অনেক ক্ষেপে আছে রুপা, অনেকদিন পর সুযোগ পেয়েছে মনের ঝাল মেটাবার।

– হইসে, বোন, মাফ কর আমারে, তোর বিয়েতে না আইসা অনেক বড় অন্যায় করছি, এখন তোর যা খুশি শাস্তি দে আমারে।

– অবশ্যই শাস্তি দিবো, তোমার শাস্তি হল আগামী এক সপ্তাহ তুমি আমাকে সময় দিবা।

– আমার চাকরীটা কে করবে, তুই?

– সেটা আমি জানি না, তুমি এখানে কেন আসছিলা?

-এই তো সায়ানের জন্মদিনের জন্য গিফট কিনলাম।

– আচ্ছা, এক কাজ কর, তুমি আজকে রাতে আমার বাসায় আসো, একসাথে ডিনার করা যাবে, তোমার তো এখনো আমার বরের সাথে দেখা হয়নি।

– তোর বরকে তো অবশ্যই দেখব। কিন্তু আজকে আসার দরকার কী? কাল রাতে পার্টিতে তো এমনিই দেখা হবে। তোরা আসবি না?

– আসব, কিন্তু তুমি আজকেই আসবা, কথা কম বল, এমনিতেই বিয়েতে না এসে তুমি অনেক বড় পাপ করছ।

– আচ্ছা, বাবা, আসব। কিন্তু ঢাকা থেকে আমার এক বন্ধুও আসছে, তাকে একা রেখে!

– কোনও সমস্যা নেই, তুমি তোমার বন্ধুকে নিয়ে আসো, একসাথে আড্ডা দেয়া যাবে। ঘরটা একটু গরম হবে, এমনিতে তো উনি বাসায় ফিরে মুখটা হপ করে রাখে।

– কেন, খুব গম্ভীর মানুষ নাকি?

– জানি না, রুপা তাচ্ছিল্যের সাথে বললো।

– আচ্ছা রুপা, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

– হ্যাঁ, বল।

– বিয়ে করে স্বামী নিয়ে তুই সুখী তো?

রুপা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরে সামান্য হেসে বললো,

– হ্যাঁ, সুখী, অনেক সুখী আমি, আমার মত এত সুখী মনে হয় এই দুনিয়াতে আর কোনও মেয়ে নেই।

রুপা হাসছে, অদ্ভুত কষ্টের হাসি। আইয়ুব বাচ্চুর সেই গানটা খুব মনে পড়ছে তার ”সুখেরই পৃথিবী, সুখেরই অভিনয়, তারপরও কেউ সুখী নয়।”

শিমুল এখনো জানে না, শুভ্রর ভালোবাসার মানুষ আদিত্যই তার খুব প্রিয় এই বোনটির স্বামী। প্রকৃতি কি মানুষের জীবন নিয়ে, তাদের অনুভূতি নিয়ে খেলতে ভালোবাসে? প্রকৃতি বড় রহস্যময়।

.

শিমুল ও শুভ্র রুপাদের বাসার ড্রয়িং রুমে বসে আছে। রুপা তাদেরকে বসিয়ে অনেকক্ষণ হল ভিতরে গেছে, কিন্তু এখনো ফেরার নাম গন্ধ নেই। শুভ্রর প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে।

-শিমুল, আমার ভাল লাগছে না।

শিমুল শব্দ করে হেসে উঠলো।

– কী ব্যাপার হাসছ কেন?

– তোমার কথা শুনে।

– আমি এমন কি হাসির কথা বললাম?

– গত কয়েক মাসে তোমার মুখে এই কথাটা মনে হয় হাজার বার শুনেছি। দোহাই লাগে তোমার, ভালো লাগে না এই কথা আর বল না।

– ঠিক আছে, এখন থেকে মন খারাপ থাকলেও মুখে ক্লোজ আপ মার্কা হাসি দিয়ে রাখব।

– That’s good, যখন তুমি মনে করবে, তুমি ভাল আছ, তখন দেখবা সবকিছু এমনিতেই ভাল লাগছে। আমির খানের মত বলবা, ” All Is Well”

-Thanks, গুরুজি! আপনার উপদেশের জন্য। এখন থেকে আপনার কথা মতই চলব। শিমুল আবার হাসতে লাগলো।

আদিত্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। এইমাত্র গোসল করে বেরিয়েছে সে , কোমরে একটা সাদা টাওয়েল প্যাঁচানো।

চুল থেকে এখনো পানির ফোটা গড়িয়ে পড়ছে শরীরে। এত বড় ছেলে অথচ এখনো ভাল করে মাথাটা মুছতে পারে না। রুপার খুব ইচ্ছে করছে টাওয়েল দিয়ে আদিত্যের মাথা মুছিয়ে দিতে। কিন্তু নিজের স্বামীর উপর এই সামান্য অধিকারটুকু রুপা খাটাতে পারেনা। রুপা খুব ভাল করেই জানে আদিত্য তাকে ভালোবাসে না। বিয়ের আগে আদিত্য অন্য কাউকে ভালবাসতো, হয়তো এখনো বাসে। সে আদিত্যের নামে মাত্র বৌ। রুপা আদিত্যের বেডরুমে তো প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু এক সাথে ঘুমানোর অধিকার তার নেই। বিয়ের দুই মাস পরেও আদিত্য ও রুপা রাতে আলাদা ঘুমায়। রুপা বিছানায় শোয় আর আদিত্য ডিভানে। আদিত্যের এত উপেক্ষা, অবহেলা সত্ত্বেও কিভাবে যেন রুপা একটু একটু করে এই মানুষটাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে। রুপা জানে, আদিত্য মানুষ হিসেবে অনেক ভালো, তাকে ভালো না বাসলেও তার অনেক কেয়ার করে। তার ছোট ছোট প্রতিটা জিনিসের খেয়াল রাখে। তার কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা, তার ভাল লাগা, মন্দ লাগা সবকিছুকেই গুরুত্ব দেয় আদিত্য। কিছুদিন আগে রুপার যখন খুব জ্বর হল। আদিত্য সারা রাত তার পাশে জেগে ছিল, তার মাথায় পানি ঢেলেছে, পরদিন সকালে অফিসেও যায়নি, নিজেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছে। যে মানুষটা তার এত খেয়াল রাখে, তাকে ভালো না বেসে কি কোনও উপায় আছে?

প্রতিদিন শাওয়ারের পর আদিত্যকে খালি গায়ে দেখতে রুপার খুব ভাল লাগে, এক অন্য রকম আকর্ষণ অনুভব করে সে। তাই এই সময়ে অন্য কাজ ফেলেও রুপা আদিত্যের সামনে বসে থাকে।

– তাড়াতাড়ি কর আদি, শিমুল ভাই কখন থেকে একা বসে আছেন।

– তুমি যাও, তুমি এখানে কেন শুধু শুধু বসে আছ?

-না, আমি তোমাকে নিয়ে একসাথে যাব।

– উফ, রুপা, তোমার ভাই আজকে এতদিন পর তার বোনের বাসায় এসেছে। কোথায় তুমি তোমার ভাইকে সঙ্গ দিবে! তা না করে আমার সামনে সঙয়ের মত বসে আছ।

– শিমুল ভাই তোমার সাথে দেখা করার জন্যই এসেছেন।

– আচ্ছা তুমি যাও, আমি ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি।

– আমার সামনেই কর, রুপা হাসছে,

-মানে?

– কেন, আমার সামনেও লজ্জা পাও?

– তুমি যাবে?

– যাচ্ছি, তুমি জলদি আসো।

.

ড্রয়িংরুমে ঢুকেই আদিত্য একটা বড় ধাক্কা খেল, এক হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুত তার শরীরে প্রবেশ করলেও সে মনে হয় এতটা শক হত না।

সে স্বপ্ন দেখছে না তো?

ড্রয়িং রুমে স্বয়ং শুভ্র বসে আছে, পাশে কে, তার নতুন বয়ফ্রেন্ড?

– এসো, আদিত্য, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, আমার ফুফাতো ভাই শিমুল, ঢাকায় থাকে, প্রাইম ব্যাংকে জব করে। আমাদের বিয়ের সময় আসতে পারেনি, তাই তোমার সাথে পরিচয় হয়নি।

আদিত্য বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। রুপার কোনও কথাই যেন তার কানে ঢুকছে না। সে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, শুভ্র তার সামনে বসে আছে! শিমুল নিজেই সোফা থেকে উঠে আদিত্যের সাথে হাত মেলালো, আদিত্য মূর্তির মত তার হাত বাড়িয়ে দিল।

রুপা শুভ্রকে দেখিয়ে বললো,

– আদি, উনি হচ্ছেন শুভ্র, ভাইয়ার বন্ধু, ঢাকা থেকে এসেছে, ডিইউতে বিবিএ পড়েন।

আদিত্য চুপচাপ মাথা নেড়ে সোফায় বসল।

– আচ্ছা আদি, তুমি তো শুভ্রকে চেনার কথা, রুপা জিজ্ঞেস করল।

– কেন, আমি কিভাবে চিনব?

– তুমিও তো ডিউতে বিবিএ পড়েছ, তাই না?

– আমি কি ঢাকা ভার্সিটির সব স্টুডেন্টকে চিনি নাকি? আজব সব কথা বল? আদিত্য কিছুটা বিরক্ত স্বরে বললো।

– না চিনলে না চিনবে, এত রেগে যাচ্ছ কেন?

– উল্টোপাল্টা কথা বললে বিরক্ত হব না?

শিমুল বুঝতে পারছে ড্রয়িং রুমের পরিবেশ ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছে। আদিত্যকে দেখামাত্রই শিমুল তাকে চিনতে পেরেছে, শুভ্রর মোবাইল এখনো আদিত্যের ছবিতে ভর্তি। শিমুল নিজেই চেয়েছিল আদিত্যের সাথে শুভ্রর একবার দেখা হোক কিন্তু তাই বলে এভাবে! সে কি স্বপ্নেও কখনো ভেবেছিল আদিত্যই রুপার স্বামী। কি করবে এখন সে? শুভ্র নিশ্চয় খুব অস্বস্তি বোধ করছে। আল্লাহই জানে, শুভ্র কোন সিনক্রিয়েট না করে বসে। পরিবেশ সহজ করার জন্য শিমুল রুপাকে বলল

– ঐ, রুপা, কথা কম বল, কখন থেকে বসে আছি, এখনো চা নাস্তা কিছু দিলি না।

– সরি, আমি তো ভুলেই গেছিলাম যে এখানে একজন পেটুক বসে আছে, আমি এক্ষুণি আনছি।

রুপা ভেবেছিল চারজনে মিলে চমৎকার আড্ডা দিবে, কিন্তু সে আশা গুড়ে বালি। পরিচয় পর্ব থেকে শুরু করে ডিনারের পুরোটা সময় শুধু তারা দুই ভাই বোনই কথা বলেছে, শুভ্র ও আদিত্য নীরব স্রোতা হয়ে শুধু শুনেছে।

অবশ্য আদিত্য শিমুলের সাথে ২/১টা কথা বলেছে কিন্তু শুভ্র একদম চুপ। তার মুখ যেন কেউ সীল গালা করে দিয়েছে। কয়েক মাস আগেও যে প্রেমিক যুগল একসাথে হলে কথার ফুলঝুরি শুরু হত, আজ তারা পরষ্পরের কাছে অতি অপরিচিত, ভিন্ন মেরুর দুই বাসিন্দা। সময়ের সাথে পরিস্থিতি কত দ্রুত বদলে যায় !

.

শুভ্রর মেজাজ আজ মহা সপ্তমে, তার ইচ্ছে করছে শিমুলকে কাচা চিবিয়ে খেতে, পারলে খুন করে ফেলতে। রুপাদের বাসা থেকে ফেরার পথে একটা কথাও বলেনি শুভ্র। শিমুলও নিজ থেকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করেনি। শিমুল জানে এটা হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব সংকেত। ঝড়ের পূর্বে বাতাস যেমন স্থির হয়ে যায়, চারদিকে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে, শুভ্রর মেজাজও ঠিক তেমনই। যে কোনও মূহুর্তে প্রবল বেগে আঘাত হানবে। বাসায় ফিরে কোনও কথা না বলে সোজা রুমে আসলো। তারপর ব্যাগ নিয়ে কাপড় গোছাতে শুরু করল।

– কি ব্যাপার, ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন?

– আমি এক্ষুণি ঢাকা চলে যাব।

– মানে কী? কাল জন্মদিনের পার্টি, তুমি আজ কেন ঢাকায় যাবে?

– আমি যদি জানতাম তুমি আমার সব চেয়ে বড় শত্রু, তাহলে আমি জীবনেও চট্টগ্রাম আসতাম না।

– কেন, আমি কি করেছি?

– তুমি আমাকে আদিত্যের বাসায় নিয়ে গেলে কেন?

– আমি কিভাবে জানব, ওটা আদিত্যের বাসা?

– তুমি জানো না তোমার বোনের স্বামী কে?

– না, জানি না। কারণ, বিয়ের সময় আমি এখানে ছিলাম না।

– মিথ্যে কথা।

– আমি কেন তোমার সাথে মিথ্যে বলব?

– জানি না। আমার ব্যাগ গোছানো শেষ, আমি যাচ্ছি।

শিমুল শুভ্রর হাত থেকে তার ব্যাগ কেড়ে নিলো।

– পাগলামী করো না, শুভ্র, তুমি এভাবে চলে গেলে আমি বাসায় কী বলব?

– তোমার যা খুশি তুমি তা বল।

– বিশ্বাস কর, শুভ্র! আমি সত্যি জানতাম না আদিত্য রুপার স্বামী। তুমি কি মনে কর, আমি যদি জানতাম তাহলে কখনো তোমাকে রুপার বাসায় নিয়ে যেতে পারতাম? তুমি কষ্ট পাও এমন কিছু কি আমি করতে পারি? আদিত্যকে দেখে তুমি যতটা অবাক হয়েছ, আমি ঠিক ততটাই অবাক হয়েছি।

– কিন্তু কাল পার্টিতে আদিত্য নিশ্চয় রুপার সাথে আসবে?

– যদি আসে, তোমার সমস্যা কী?

– তুমি জানো না আমার কি সমস্যা? শুভ্র চেচিয়ে উঠলো।

– আস্তে শুভ্র, বাসার সবাই শুনবে, I can understand your problem, কিন্তু শুভ্র, সমস্যার মুখোমুখি হয়েই তার সমাধান করতে হয়, সমস্যা থেকে পালিয়ে গেলে কখনো তার সমাধান হয় না।

– আমার কোনও সমস্যার সমাধানের দরকার নেই, আমি আর আদিত্যের মুখোমুখি হতে চাই না। আমি আজকেই ঢাকা চলে যাব।

-প্লিজ শুভ্র, এভাবে যেয়ো না। শুধু আমার জন্য হলেও থাক, তুমি এখন এত রাতে এভাবে বাসা থেকে চলে গেলে ব্যাপারটা খুব বাজে দেখাবে। এত দিনের বন্ধু হয়ে কি আমি তোমার কাছ থেকে এটুকু আশা করতে পারি না?

শুভ্র আর কিছু না বলে চুপচাপ বিছানায় বসে পড়ল। সে নিজেও বুঝতে পারছে এভাবে যাওয়াটা ঠিক হবে না, সে যদি এখন চলে যায় শিমুল অনেক কষ্ট পাবে। এই মানুষটাকে কষ্ট দেওয়া তার পক্ষে কখনো সম্ভব না।

শিমুল তার জন্য অনেক কিছু করেছে, তার চরম দুর্দিনে পাশে দাড়িয়েছে নিঃস্বার্থ ভাবে, তার পরম বন্ধু হয়ে।

.

পার্টিতে যাওয়ার জন্য রুপা সেই কখন থেকে সাজগোজ করে বসে আছে। সন্ধ্যা থেকে আদিত্যের জন্য কত যত্ন করে সাজল, বিয়ের পর এই প্রথম সে আদিত্যকে নিয়ে কোন পার্টিতে যাবে, অথচ আদিত্য এখনো অফিস থেকেই ফেরেনি। এভাবে কতক্ষণ রেডি হয়ে বসে থাকা যায়? রুপা আদিত্যকে ফোন করল।

– হ্যালো, আদি, তুমি কোথায়?

– এই তো এখনো অফিসে।

– মানে কি? পার্টিতে যাবে না?

– আসলে রুপা, অফিসে কয়েকজন বিদেশী বায়ার এসেছে, প্রচণ্ড কাজের ঝামেলা, আমার আসতে দেরি হবে।

– তুমি না বললে আমাকে ৭টার মধ্যে রেডি হয়ে থাকতে, আমরা একসাথে পার্টিতে যাব।

-সরি রুপা, আজ তুমি একাই চলে যাও।

– না আদি, আমার পক্ষে একা যাওয়া সম্ভব নয়। তুমি না গেলে, সবাই আমাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করবে।

– প্লিজ রুপা, বুঝতে চেষ্টা কর।

– আদি, প্লিজ, গত দুই মাস ধরে আমি তো তোমাকে অনেক বুঝলাম, এবার না হয় তুমি আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা কর। আমিও একজন মানুষ, আমারও সহ্যের সীমা আছে।

-ওকে, এক কাজ কর, তুমি তোমার বাবা মায়ের সাথে চলে যাও, আমি অফিস থেকে বের হয়ে সরাসরি পার্টিতে চলে আসব।

– ঠিক আছে, তুমি আসবে কখন?

– এই তো ৯টার মধ্যে চলে আসব।

– মনে থাকে যেন, তুমি না আসলে আমি সবার কাছে ছোট হয়ে যাব।

– আমি বলেছি তো আসব, রাখি।

আদিত্য ফোন রেখে দিল। রুপার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সে ভেবেছিল আজ সে সবার সামনে আদিত্যের হাত ধরে পার্টিতে যাবে। কিন্তু সে এতই দুর্ভাগা যে তার অতি সামান্য চাওয়াটুকু কখনো পূরণ হয় না। রুপার মনে হয় সে হয়তো জীবনে বড় কোন পাপ করেছে। তাই আদিত্য তাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছে। রুপা তার মাকে ফোন করল, উনারা পার্টিতে যাওয়ার সময় রুপাকে পিকআপ করবে। রুপার সময় যেন কাটছে না, আর কিছু না পেয়ে ঘরের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিল। আদিত্য এত অগোছালো স্বভাবের, টেবিলের উপর এক গাদা গল্পের বই ফেলে রেখেছে। আদিত্য প্রচুর বই পড়ে, রাতে ঘুমোবার আগে বই না পড়লে তার নাকি ঘুম আসে না। রুপা টেবিল থেকে আদিত্যের বইগুলো বুক সেলফে তুলে রাখছিল। হঠাৎ বইগুলো থেকে একটা ছবি নিচে পড়ল। রুপা কৌতূহলবশত ছবিটা তুলে নিলো, এটা আদিত্যের ভার্সিটিতে থাকা কালের ছবি। রুপা অবাক হয়ে দেখল, আদিত্যের পাশে শুভ্র বসে আছে। আদিত্যের কাধে হাত রেখে অনেকটা ঘনিষ্ঠভাবে। তার মানে আদিত্য শুভ্রকে চেনে? খুব ভালো করেই চেনে। তাহলে কাল কেন শুভ্রকে না চেনার ভান করল? কেনই বা তার কাছে মিথ্যে বলল। পুরো সন্ধ্যা জুড়ে শুভ্রও তো আদিত্যের সাথে কোনও কথা বলেনি। আদিত্যের সাথে শুভ্রর এমন কি সম্পর্ক যা তারা দুজনই তার কাছে গোপন করেছে?

রুপা ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, খুব সাধারণ একটা ছবি, মনে হচ্ছে দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাশাপাশি বসে আছে, তারপরও কেন রুপার মনের মধ্যে এমন খচখচ করছে?

.

আদিত্যের কোন ইচ্ছেই ছিল না পার্টিতে যাওয়ার।

কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই, রুপার জন্য তাকে যেতেই হবে, অথচ পার্টিতে যাওয়া মানেই আবার শুভ্রর মুখোমুখি হওয়া. তার চোখের সামনে তার ভালোবাসার মানুষ অন্য আরেকজনের হাত ধরে ঘুরে বেড়াবে, এই দৃশ্য দেখার চেয়ে মরে যাওয়াও ভাল, কিন্তু মরার ভাগ্যও তার নেই। সবকিছু দেখে মুখ বুঝে সহ্য করতে হবে, কিছু করার নেই তার। পার্টিতে এসেই সবার আগে রুপাকে খুজে বের করলো আদিত্য। কী অসাধারণ সুন্দর লাগছে রুপাকে। গোলাপি রঙয়ের একটি জামদানি শাড়ি পরেছে রুপা। চুলগুলো খোলা, বাতাসে উড়ছে। তাকে কোন রূপকথার গল্পের ডানাকাটা পরীর সাথে তুলনা করলেও যেন ভুল হবে না। আদিত্যকে দেখে রুপাই আগে এগিয়ে এল।

– এত দেরি করলে যে?

-সরি, রাস্তা অনেক জ্যাম ছিল, তাই একটু দেরি হয়ে গেল।

– ঠিক আছে, তুমি এসেছ, এটাই আমার জন্য অনেক।

– একটা কথা বলব?

– বল।

– আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে, আমি তো চোখ ফেরাতেই পারছিনা তোমার থেকে।

– তোমাকে চোখ ফেরাতে কে বললো?

– সত্যি রুপা , you are looking so gorgeous & hot.

-যাক ভাল, অবশেষে আমার উপর তোমার একটু নজর পড়ল।

আদিত্য শুভ্রকে আগেই খেয়াল করেছে, তার থেকে একটু দূরেই শিমুলের পাশে দাড়িয়ে আছে, শুভ্রকে দেখিয়ে সে আরও বেশি করে রুপার প্রশংসা করছে।

– আদি, তোমার হাতে ফুল, কার জন্য?

– কার জন্য আবার, আমার কি দশটা বৌ আছে নাকি?

পার্টিতে আসার সময় রাস্তায় একটি পিচ্চি মেয়ে ফুল বিক্রি করছিলো, সিগন্যাল পড়লে মেয়েটি আদিত্যের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, কেন জানি মেয়েটির জন্য খুব মায়া হল তার। তাই কোনও কিছু না ভেবেই আদিত্য মেয়েটির হাতের সবগুলো গোলাপ কিনে ফেললো। আদিত্যের আচরণে রুপা একটু অবাকই হচ্ছিল। আদিত্য তার হাত ধরে হেসে হেসে কথা বলছে! বিয়ের পর এই প্রথম বউ কথাটি সে উচ্চারণ করল।

– আজকে কি সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে?

– কেন?

– না, আজ মনে হয় তুমি একটু বেশি ভাল মুডে আছ।

– কেন, আমি কি সব সময় খারাপ মুডে থাকি?

– না, কখনো আমাকে কিছু দাওনি তো।

-আচ্ছা, এখন ফুলগুলো নাও।

– আমার চুলে একটা গোলাপ পরিয়ে দাও না, প্লিজ! চুলের ক্লিপের সাথে লাগিয়ে দাও।

রুপা ভেবেছিল আদিত্য এক্ষুণি তাকে একটা জোড়ে ঝাড়ি মারবে। কিন্তু, আদিত্য রুপাকে অবাক করে তার চুলে সত্যি গোলাপ পরিয়ে দিল।

বিয়ের পর এই প্রথম আদিত্য রুপার প্রশংসা করল, আবার তার জন্য ফুল কিনে এনেছে, রুপার মনে হচ্ছে সে যেন কোনও সুন্দর স্বপ্ন দেখছে, ঘুম ভাঙলেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। আদিত্যের ছবিটার কথা ভুলেই গেছে সে। রুপার এই মূহূর্তে মনে হচ্ছে, সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।

কাল সকালেই শিমুল ও শুভ্র চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে যাচ্ছে। তাহলে কি এখানেই শেষ হবে শুভ্র ও আদিত্যের ভালোবাসার গল্প? তাহলে কেন প্রকৃতি তাদের দুজনকে একে অপরের মুখোমুখি করলো। প্রকৃতির সব কাজের পেছনেই কোনও না কোনও রহস্য লুকানো থাকে। আমরা সাধারণ মানুষ হয়তো সবসময় সেই রহস্যের অর্থ খুজে পাই না। আমরা কেউ কি জানি কাল প্রভাতের নতুন সূর্য আমাদের জীবনে কি বার্তা বয়ে আনবে? হয়তো আজ রাতেই শুরু হতে যাচ্ছে শুভ্র ও আদিত্যের জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

.

শুভ্রও পার্টিতে পুরোটা সময় শিমুলের সাথে সাথে থেকেছে, তার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছে, আদিত্যকে দেখিয়ে কয়েকবার শিমুলের হাতও ধরেছে।

– শুভ্র, কেন করছো এইসব?

– কি করছি?

-এই যে ইচ্ছে করে আমার হাত ধরে আদিত্যকে জেলাস ফিল করাতে চাইছ?

– আমি কেন আদিত্যকে জেলাস ফিল করাতে চাইব?

– কারণ আদিত্য তোমার সামনে রুপার প্রশংসা করছে।

– আদিত্য যা খুশি তাই করুক, তাতে আমার কী এসে যায়?

– সত্যি কিছু এসে যায় না?

– আদিত্য তার বৌকে ফুল দিলে আমার কেন গা জ্বলবে? সে তো অন্যায় কিছু করছে না। তার বিয়ে করা বৌয়ের সাথে সে যা খুশি করতে পারে।

– মন কি ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠিতে চলে?

– জানি না, শিমুল। আমি কালই ঢাকা চলে যাব। তুমি কি আমার সাথে যাবে কাল?

– হ্যাঁ, আমিও চলে যাব। ছুটি শেষ তো আমার।

– তাহলে তো ভাল, একসাথেই ফেরা যাবে।

– শুভ্র, আমি ঠিক করেছি যাওয়ার আগে আদিত্যের সাথে কিছু কথা বলব।

– কী কথা?

– আদিত্য তোমার আমার সম্পর্ক নিয়ে তোমাকে ভুল ভাবছে, তার ভুলটা ভেঙ্গে দেওয়া উচিত।

– কী দরকার? আদিত্য আমাকে যা খুশি তাই ভাবুক, আমার কিছু যায় আসে না।

-কিন্তু, আমার যায় আসে, শুভ্র। আমি চাই না আমার বন্ধুকে কেউ ভুল বুঝুক, তাকে মন থেকে ঘৃণা করুক।

– শিমুল, তুমি তোমার বোনের সুখ চাও না? আদিত্য এখন আমাকে যত বেশী ঘৃণা করবে, রুপার জন্য তত ভাল হবে, আদিত্য আমার কাছ থেকে যতটা দূরে সরে যাবে, ঠিক ততটাই রুপার কাছে যেতে পারবে, ওদের দুজনের সম্পর্ক আরও বেশি মজবুত হবে।

– কিন্তু, শুভ্র…

– শিমুল, তুমি খেয়াল করেছ কিনা জানিনা, কাল তাদের বাসায় গিয়ে আমি স্পষ্ট বুঝেছি, আদিত্য ও রুপার মাঝখানে অনেক বড় একটা দূরত্ব আছে। আমি কখনো তাদের দুজনের সংসারে দেয়াল হয়ে থাকতে চাই না। আমি চাই, আদিত্য রুপাকে নিয়ে অনেক সুখী হোক, আদিত্য ভাল থাকলেই আমার সুখ। আদিত্য আমাকে ঘৃণা করেও যদি নিজে সুখে থাকে, সেটাই কি আমার কাম্য হওয়া উচিৎ নয়?

-You are really great শুভ্র, তোমাকে আমার স্যালুট করতে ইচ্ছে করছে। আমি অনেক ভাগ্যবান যে তোমার মত একজন মানুষকে জীবনে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি।

– আমার জায়গায় তুমি হলেও তাই করতে।

-আমি তোমার মত এতটা উদার হতে কখনো পারতাম না। শুভ্র, আমি তোমার কাছ থেকেই শিখেছি ভালোবাসা কাকে বলে, শুধু কাছে পাওয়ার নামই ভালোবাসা নয়, ভালোবাসার জন্য এক ছাদের নিচে বাসা করার দরকার হয় না। দূর থেকে ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে ভাল রাখা, তার সুখের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নামই ভালোবাসা।

.

শিমুল অনেকক্ষণ ধরেই শুভ্রকে খুজে পাচ্ছে না, সে একা বারান্দায় দাড়িয়ে আছে, কাল সকালেই আবার ঢাকা চলে যেতে হবে, তার কোন কিছুই ভাল লাগছে না। কেন জানি মনটা খুব অস্থির লাগছে আজ। রুপার জন্য খুব মায়া লাগছে। আদিত্যকে নিয়ে সত্যি কি রুপা সুখে আছে? নাকি এই সবকিছু শুধু লোক দেখানো অভিনয়? শিমুল তার এই বোনটিকে অনেক ভালোবাসে, শুধু রুপার জন্যই তো সে সবকিছু জেনেও চুপ করে আছে, এছাড়া সে আর কী বা করতে পারে?

আজ পূর্ণিমা, বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদের আলোয় স্নান করছে গোটা পৃথিবী, সবকিছু ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। তারপরও কেন শিমুলদের ছোট্ট বারান্দা আজ এত অন্ধকার?

– ভাইয়া, আদিত্যকে দেখেছ? রুপা এসে শিমুলকে জিজ্ঞাসা করলো।

– না কেন?

-কোথায় যে গেল, অনেকক্ষণ ধরেই ওকে দেখছিনা।

– আছে কোথাও, যাবে কই, রুপা তোকে তো আজ দারুণ লাগছে।

-কেন, প্রতিদিন কি খারাপ লাগে নাকি?

– লাগে তো, ড্রাকুলার বৌয়ের মত লাগে, শিমুল হাসছে।

-কি বললা তুমি? কপট রাগ দেখালো রুপা।

– ঐ, গাধী, ড্রাকুলার বৌ গুলা কিন্তু অনেক সুন্দর হয়, বুঝলি?

– হইছে, আমার এত বুঝার দরকার নাই, তুমি নিজে কী? একটা জম্বি ভুত, রুপাও হাসতে লাগলো।

– রুপা, কাল সকালে আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি।

– এতদিন পর এসে কয়েকটা দিনও থাকবা না?

– ছুটি শেষ, ইচ্ছা করলেও উপায় নেই, যেতেই হবে।

– ভাইয়া, তুমি একটা বিয়ে করে ফেল, আর কত দিন এভাবে একা থাকবে?

– আমাকে দিয়ে বিয়ে শাদী হবে না, আমি এখনই অনেক ভাল আছি।

– সেদিন তোমার কথা বলে ফুপি অনেক কান্নাকাটি করছিলো, ফুপির বয়স হয়েছে, তুমি বিয়ে করে সংসারি হলে তিনি একটু শান্তি পেতেন।

– দেখ রুপা, সবার কপালে সব সুখ লেখা থাকে না। তাছাড়া শখ করে নিশ্চয় কেউ একা থাকে না। আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়, আমার হয়ে তুই মাকে বুঝায় বলিস, শিমুলের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসলো।

– কিন্তু তুমি বিয়ে করবে না কেন? সমস্যা কোথায়, আমাকে অন্তত বল?

– তুই কি তোর সব কথা আমাকে বলিস? আমি যদি জিজ্ঞেস করি, সত্যি আদিত্য তোকে ভালোবাসে কিনা, তুই কি কখনো আমাকে সত্যি কথা বলবি?

রুপার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হল না, তাহলে কি ভাইয়া তার আর আদিত্যের সম্পর্কের দূরত্বটা বুঝতে পেরেছে? কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? রুপা চুপচাপ বারান্দা থেকে চলে গেল। শিমুল তাকিয়ে আছে অসীম আকাশের দিকে। সে নিঃসঙ্গ চাঁদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছে কে বেশি একা, সে নাকি লক্ষ কোটি দূরের ঐ কলঙ্কিত চাদ।

.

জ্যোৎস্না এসে থমকে দাড়িয়েছে শিমুলের ছোট্ট ছাদে। আদিত্য শুভ্রকে জোর করে ছাদে নিয়ে এসেছে।

– কি ব্যাপার আমাকে ছাদে নিয়ে এলে কেন?

-তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

-তুমি তো শুভ্র নামের কাউকে চেনোই না, যাকে চিনো না, জানো না, তার সাথে কিসের কথা?

– ফাজলামি বন্ধ কর, কেন তুমি আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করলে, এভাবে কেন তুমি আমাকে ঠকাইছ?

– আমি তোমাকে ঠকাইছি, কি নাটক করছি আমি তোমার সাথে?

– সত্যি তুমি আমাকে কখনো ভালবাসছ? যদি বাসতে, তাহলে দুই মাস না যেতেই শিমুলের সাথে লিভ টুগেদার করতে পারতে না।

– আমি শিমুলের সাথে লিভ টুগেদার করছি তোমাকে কে বললো?

– তুমি কি ভাবছ, আমি তোমার কোনও খবর জানি না?

– আর তুমি কি ভাবছিলে তোমাকে হারিয়ে আমি দেবদাস হয়ে মদ খেয়ে পথে পথে ঘু্রে বেড়াব?

– না, তা ভাবিনি, তবে এতটা নির্লজ্জ হবে তাও ভাবিনি।

– কেন তুমি বৌ নিয়ে ফুর্তি করলে দোষ হয়না, আমি করলেই দোষ?

– মুখ সামলে কথা বল, শুভ্র!

– না বললে কী করবে তুমি? কী করার সাহস আছে তোমার? তিন বছর আমার সাথে প্রেম করে এখন বাপের ভয়ে বৌয়ের আঁচল ধরে ঘুরছ, আর আমাকে তুমি নির্লজ্জতা শেখাও।

-শুভ্র, আরেকটা বাজে কথা বললে চড় দিয়ে তোমার সবগুলো দাঁত ফেলে দেব।

– আমাকে চড় দিয়ে কী বুঝাতে চাও, খুব পুরুষ হইছ তুমি? তোমার পুরুষত্বটা তোমার বৌয়ের সাথে গিয়ে দেখাও।

আদিত্য সত্যি সত্যি শুভ্রকে চড় দিয়ে বসল, সে কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না, রাগে তার হাত পা কাঁপছে।

– আদিত্য, তোমার এই চড়টা আমি ইচ্ছে করলেই ফিরিয়ে দিতে পারি। ভেবো না, তোমার চেয়ে আমার হাতে শক্তি কিছু কম আছে কিন্তু আমি তোমার মত কাপুরুষ নই। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা কোন বীরত্বের লক্ষণ নয়।

– হ্যাঁ, আমি কাপুরুষ, কাপুরুষ বলেই তোর মত একটা নর্দমার কীটকে তিন বছর ধরে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি, কাপুরুষ বলেই নিজের বিয়ে করা বৌকে আজ পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারিনি, তোর মত একটা জঘন্য প্রাণীর জন্য আমি রুপার মত মেয়েকে ঠকিয়েছি, তোর কথা ভেবে নিজে কষ্ট পেয়েছি, একটা রাত শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি আমি শুধু তোর জন্য। তুই আসলেই একটা জঘন্য নর্দমার কীট। যে মানুষের কাছে মন বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই, যার কাছে শরীরের জ্বালাই সব, তাকে আমার মানুষ বলে ভাবতেও ঘৃণা হয়। তোর মত পশুরা শুধু শরীর খুজে বেড়ায়, তোদের কাছে ভালোবাসার কোন দাম নেই।

-আদিত্য, মুখ সামলে কথা বল।

-না বললে কী করবি তুই, মিথ্যা কিছু বলছি নাকি, তোরা রাস্তার কুকুরের চেয়েও বেশি জঘন্য।

আদিত্য দ্রুত ছাদ থেকে সিড়ি দিয়ে নেমে গেল। সে রাগে এতটাই অন্ধ হয়ে আছে যে খেয়ালই করল না, সিড়ির নিচে রুপা দাঁড়িয়ে আছে। রুপা আদিত্যকে পেছন থেকে অনেকবার ডাকল, কিন্তু রুপার সেই ডাক হয়তো আদিত্যের কান পর্যন্ত পৌছাল না, সে কোন দিকে না তাকিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা রাস্তায় নেমে পড়ল। রুপা ছাদে এসে দেখল শুভ্র একা পাথরের মূর্তির মত ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে। জ্যোৎস্নার আলোতে শুভ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে রুপার বুকটা ধক করে উঠলো। এটা যেন কোন স্বাভাবিক মানুষের মুখ নয়, শুভ্রর অনিন্দ্য সুন্দর মায়াবী মুখটা চাঁদের আলোতে ভয়ঙ্কর লাগছে। রুপা বেশ বুঝতে পারছে শুভ্র ও আদিত্যের মাঝে কিছু একটা হয়েছে, বেশ বড় রকমের কোনকিছু। রুপা একবার ভাবল শুভ্রর সাথে এই নিয়ে কথা বলবে, তারপর মনে হল এই সব প্রশ্নের জবাব অবশ্যই শিমুলের কাছে আছে।

শিমুল এখনো বারান্দায় চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।

– ভাইয়া, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।

– হ্যাঁ, বল।

– শুভ্রর সাথে আদিত্যের কি সম্পর্ক?

– কি পাগলের মত কথা বলিস, ওদের মাঝে আবার কি সম্পর্ক থাকবে, ওরা তো একজন অন্যজনকে ভালো করে চেনেই না।

– মিথ্যে বলবে না ভাইয়া, আমি অনেক কিছু জানি। শিমুল চমকে উঠলো

– কি জানিস্ তুই?

– আমি শুভ্র ও আদিত্যের একসাথে তোলা ছবি দেখেছি।

– কোথায় পেলি তুই ছবি?

-আজ আদিত্যের বইয়ের ভেতরে ছবিটা দেখেছি। ভাইয়া আমি জানি, তুমি সবকিছু জান। এখন আমি বুঝতে পারছি সেদিন তোমাদেরকে দেখে আদিত্য এতটা চমকে গিয়েছিল কেন?

– দেখ, রুপা, তোর যদি কিছু জানার থাকে তাহলে তুই সরাসরি তোর স্বামীকে জিজ্ঞেস কর।

– কেন, আমার ভাইয়ের কাছ থেকে কোন কিছু জানতে চাওয়ার অধিকার আমার নেই?

– আগে বল, হঠাৎ করে এইসব জানতে চাইছিস কেন? আদিত্য কোথায়?

– আদিত্য এতক্ষণ শুভ্রর সাথে ছাদে ছিল।

– এখন কই?

– জানিনা কোথায় গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছে। আমার সামনে দিয়ে চলে গেল, অথচ আমাকে যেন দেখতেই পেল না। আমি পেছন থেকে অনেক ডাকলাম কিন্তু শুনলই না মনে হয়।

– শুভ্র এখন কোথায়?

-মনে হয় এখনও ছাদে, খুব অদ্ভুত লাগছিল শুভ্রকে। আদিত্যের সাথে ওর কোন ঝগড়া হয়েছে কিনা কে জানে?

শিমুলের মন বলছে খুব বড় রকমের কোন অঘটন ঘটতে চলেছে। সে রুপাকে আর কিছু না বলে দৌড়ে ছাদে গেল, কিন্তু সেখানে কাউকেই দেখতে পেল না, জ্যোৎস্না আলোকিত শূণ্য ছাদ। শিমুল শুভ্রর মোবাইলে ফোন করলো কিন্তু মোবাইল বন্ধ। শিমুল বারবার ডায়াল বাটন টিপতে লাগলো কিন্তু বারবার সেই যান্ত্রিক নারী কণ্ঠ একঘেয়ে গলায় বলে যাচ্ছে ” আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না”. রুপাও শিমুলের পেছনে ছাদে উঠে আসলো।

– রুপা, আদিত্যের মোবাইলে একটা ফোন দে তো।

– ফোন করছি অনেকবার, রিং পড়ছে কিন্তু সে ধরছে না।

শিমুলের খুব ভয় লাগছে, কোথায় গেল, শুভ্র? কী এমন হয়েছে ওদের দুজনের মাঝে যে ওদের কেউ ফোন ধরছে না? কেন যে সে শুভ্রকে তার সাথে চট্টগ্রাম নিয়ে এসেছিল? সব দোষ তার, সব কিছুর জন্য সে নিজে দায়ী, এখন কোথায় খুঁজবে সে শুভ্রকে?

.

অনেকদিন পর আদিত্য ড্রিংক করলো, রাত ১২টার দিকে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরল। রুপা আদিত্যের উপর প্রচন্ড রেগে ছিল, প্রথমত তাকে পার্টিতে একা রেখে আদিত্য উধাও হয়ে গেল, যেখানেই যাক তাকে অন্তত বলে তো যেতে পারত। সে এতবার ফোন করেছে, কিন্তু আদিত্য একবারও তার ফোন রিসিভ করেনি। তার উপর এখন রাতের ১২টা বাজে মদ খেয়ে বাসায় ফিরে বমি করে ঘর ভাসিয়েছে। যে জিনিস খেলে সহ্য হয়না, তা যে কেন মানুষ টাকা দিয়ে কিনে খায় রুপা বুঝে পায় না। রুপা ঠিক করেছিল আজ আদিত্য বাসায় ফিরলে সে ভালমত ঝগড়া করবে, অথচ এখন উল্টো আদিত্যের জন্য তার মায়া লাগছে, কী নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বিছানায় পড়ে আছে মানুষটা!

মাঝে মাঝে মধ্যরাতে রুপার ঘুম ভেঙ্গে যায়, সে বিছানায় উঠে বসে তাকিয়ে থাকে আদিত্যের ঘুমন্ত মুখের দিকে, এত মায়া লাগে এই মানুষটাকে দেখলে, এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে নিজেকে প্রচন্ড সুখী মনে হয় তখন। রুপার মনে হয় সে তার বাকী জীবনটা আদিত্যের মুখের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিতে পারবে। তার আর কিছু লাগবে না। কেন এত ভালোবাসে সে এই মানুষটাকে? আদিত্যের কথা ভাবতে ভাবতে রুপার চোখ ছল ছল করে উঠলো। হঠাৎ আদিত্য রুপাকে তার কাছে ডাকল, রুপা কিছু বুঝে উঠার আগেই রুপাকে জড়িয়ে ধরলো আদিত্য।

– আমাকে তুমি ক্ষমা কর রুপা, আমি অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। তোমাকে তোমার প্রাপ্য অধিকার আমি দিইনি, প্লিজ আমাকে তুমি মাফ করে দাও।

– তুমি কোন অন্যায় করনি আদিত্য, আমি কখনো জোর করে তোমার ভালোবাসা চাইনি। আমি চেয়েছি তুমি যখনই আমাকে স্পর্শ কর, মন থেকে ভালোবেসে কর। শুধু স্বামী হিসেবে দায়িত্ব রক্ষার জন্য তুমি আমার সাথে শোও, আমি সেটা কখনো চাইনা, আদিত্য।

– প্লিজ রুপা, আমাকে একটা সুযোগ দাও, আমি শুধু তোমার হতে চাই।

– আমি তো তোমারই, আদি।

– আজ তুমি আমাকে একটু ভালোবাস, রুপা। কেউ আমাকে কখনো ভালোবাসেনি, শুধু ছলনাই করেছে আমার সাথে। আজ তোমার ভালোবাসার আমার বড্ড প্রয়োজন।

– আমি তো এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম, আদিত্য। আমি জানতাম একদিন সত্যি তুমি আমাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিবে।

রুপা তার কথা শেষ হবার আগেই আবিষ্কার করলো কখন যেন সে হারিয়ে ফেলেছে তার অধরোষ্ঠ। আদিত্য চুমো খেতে শুরু করলো তার ঠোঁটে, গালে, গলায়। পিঠে হাত বুলাতে গিয়ে ব্রার হুকটা বারবার হাতে লাগছে, খুলে দিল ওটা। হাত বুলানোর এলাকা বাড়ছে ক্রমশই। কিছুক্ষণ পর রুপাও সক্রিয় ভাবে সাড়া দিতে শুরু করলো। রুপার চোখ বন্ধ, গরম হয়ে উঠছে শরীর, নিঃশ্বাস। নড়েচড়ে জায়গা করে দিচ্ছে আদিত্যের হাত দুটোকে। রুপা আদিত্যের বুকের লোমশ জঙ্গলের মাঝে হারাতে গিয়ে শুনতে পেল অন্ধকারের গান। বহুদিনের প্রতীক্ষিত সেই গান যা শোনার জন্য পঁচিশটা বসন্ত সযত্নে অপেক্ষা করে আছে রুপা।

.

ঘড়িতে তখন রাত ৩টা, মোবাইলের শব্দে রুপার ঘুম ভাঙলো, কে ফোন করবে এত রাতে ? শিমুলের কল দেখে অবাক হল রুপা, ভাইয়া কেন এই মধ্যরাতে তাকে ফোন করেছে, কোনও বিপদ আপদ হল না তো?

– হ্যালো রুপা, আদিত্য কোথায়?

– এইতো আমার পাশেই, ঘুমাচ্ছে।

– আদিত্যকে একটু ফোনটা দে তো, ওর সাথে আমার জরুরী কথা আছে। রুপা বুঝতে পারছে নিশ্চয় সিরিয়াস কোন ব্যাপার, না হলে ভাইয়া এত রাতে ফোন দিয়ে আদিত্যকে চাইত না, তাই রুপা কথা না বাড়িয়ে আদিত্যকে ঘুম থেকে জাগাল।

– হ্যাঁ, বলেন শিমুল ভাই। এত রাতে?

– শুভ্র কোথায়, আদিত্য?

– আমি কিভাবে জানব আপনার বন্ধু কোথায়?

– তুমি শুভ্রকে কী বলেছ?

– আপনি কি এইসব কথা জিজ্ঞেস করার জন্য এত রাতে আমাকে ফোন করেছেন?

– শুভ্র এখনো বাসায় ফেরেনি, আদিত্য। তোমার সাথে কথা বলার পর থেকেই তার মোবাইল অফ। এই অচেনা শহরে সে একা একা কোথায় ঘুরছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি গাড়ি নিয়ে আশেপাশের সব জায়গায় ওকে খুঁজেছি। কিন্তু, কোথাও ওর কোন খোঁজ পাচ্ছি না। আমার খুব ভয় লাগছে আদিত্য, তুমি তো জান শুভ্র কতটা সেনসেটিভ।

– আমি জানি, শিমুল ভাই। আপনি একটু শান্ত হোন। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন হয়তো এর মধ্যে একটা খোঁজ পাওয়া যাবে।

– কিন্তু এর মধ্যেও যদি শুভ্রর কোন খোঁজ না পাই?

– তখন না হয় আমরা হাসপাতাল আর থানাগুলোতে খোঁজ নিব।

– আমার খুব ভয় লাগছে, আদিত্য!

– আপনি এত টেনশন কইরেন না, প্লিজ।

আদিত্য জানে শুভ্র কতটা ইমোশনাল একটা ছেলে। শিমুলকে সান্ত্বনা দিলেও সে নিজেই অনেক ভয় পাচ্ছে শুভ্রর জন্য। আজকে সত্যি যদি খারাপ কিছু ঘটে তাহলে কি সে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে? কী দরকার ছিল শুভ্রকে এত কিছু বলার? আদিত্য বুঝতে পারছে শুভ্রকে চড় মারা তার একদম উচিত হয়নি, কিন্তু রাগ উঠলে যে তার মাথা ঠিক থাকে না, এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন রাত শেষ হয়ে গেল আদিত্য নিজেও জানে না।

.

গভীর রাত। পৃথিবী ঘুমিয়ে গেছে, তবে এখনো জেগে আছে কিছু ঘুমহীন মানুষ আর রাস্তার কিছু নিশাচর প্রাণী। মধ্যরাতের নির্জন নীরব রাস্তা, শুভ্র রাস্তার মাঝখানে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটছে। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। এখনো নিঃসঙ্গ চাঁদ ঝরিয়ে যাচ্ছে তার অবারিত জ্যোৎস্না, চারদিকে আলো আর আলো। রাস্তার লাইটপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে গোমড়া মুখে। কোথাও একটা পাতা ঝড়ে গেল নিঃশব্দে। দূরে কোথাও চিৎকার করছে একটা নিঃসঙ্গ কুকুর। বাতাস আজ বড্ড অস্থির, থমথমে পরিবেশ, কোথাও যেন অশুভ কিছু হতে চলেছে। শুধু শুভ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে হেটে চলছে ঠিক রাস্তার মাঝখানে গন্তব্যহীনভাবে। নিরন্তর সেই যাত্রা। 

ঠিক ঐসময় শুভ্রর পেছন থেকে প্রচন্ড গতিতে ছুটে আসছে একটি টয়োটা কার। গাড়ির ড্রাইভার শুভ্রকে দেখতে পেয়ে বারবার হর্ন বাজাচ্ছে। কিন্তু, হর্নের জোরাল আওয়াজও শুভ্রর কানে প্রবেশ করছে না। কোনও দিকেই তার খেয়াল নেই। যা ইচ্ছে তাই হোক, আজ আর কোনও কিছুতেই শুভ্রর কিছু যায় আসে না। আজ সে সারা রাত জ্যোৎস্না স্নান করবে। মুঠো মুঠো জোছনা গায়ে মেখে সে ভুলে যাবে তার সব কষ্ট, সব অভিমান।

জ্যোৎস্নার আলোতে শুভ্রর ছায়া পড়েছে রাস্তায়, একী! ছায়াটা এত লম্বা কেন? আশ্চর্য! মৃত মানুষের মত স্থির হয়ে আছে ছায়াটা। পিচ ঢালা কালো রাস্তা হঠাৎ এমন লাল হয়ে যাচ্ছে কেন?

“আমিও মানুষ বটে

আমারও একলা রাতে বড় একা লাগে

জ্যোৎস্নার জলে স্নান সেরে থোকা থোকা কষ্ট পেড়ে আনি

ভালোবাসা আমাকেও বিষম কাঁদায়। ”

.

ফজরের আযান পড়ছে। শিমুলের সাথে কথা বলার পর আদিত্যের আর ঘুম হয়নি। টেনশনে, ভয়ে অস্থির হয়ে আছে সে, নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে তার। শুভ্র নিখোঁজ, সারারাত বাসায় ফেরেনি। অথচ, সে কি সুন্দর দিব্যি আরামে বিছানায় শুয়ে আছে। শিমুলকে একটা ফোন করলে কেমন হয়?

আদিত্য রুপার মোবাইল থেকে শিমুলের নাম্বার নিয়ে ফোন করল।

– হ্যাঁ, শিমুল ভাই? আমি আদিত্য বলছি, শুভ্রর কোনও খোঁজ পেয়েছেন?

– আদিত্য, আমি শিহাব, শিমুলের বড় ভাই।

– ওহ, ভাইয়া আপনি, শিমুল ভাই কই?

– শিমুল তো ডাক্তারের সাথে কথা বলছে, আমরা এখন হাসপাতালে।

আদিত্যের বুকে পাঁজরে কেউ যেন প্রচন্ড জোরে আঘাত করলো,

-কেন? শুভ্রর কী হয়েছে?

-তুমি শুভ্রকে চেন? শুভ্র তো কাল রাতে এক্সিডেন্ট করেছে।

– কী বলছেন ভাইয়া? শুভ্রর এখন কী অবস্থা?

– শুভ্রর অবস্থা খুব একটা ভালো না। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে। ডান পায়ে দুটো ফ্রাকচার হয়েছে।

– ভাইয়া, শুভ্র বাঁচবে তো?

– বাঁচা মরা তো আল্লাহর হাতে, তবে ডাক্তাররা খুব একটা আশা দিচ্ছে না।

– আপনারা এখন কোন হাসপাতালে?

– মেট্রোপলিটন।

– ঠিক আছে, ভাইয়া। আমি এখনই আসছি। 

আদিত্যের হাত পা কাঁপছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আদিত্যের প্রায় দশ মিনিট সময় লাগলো নিজেকে স্বাভাবিক করতে। তারপর কোনরকম মুখ ধুয়ে প্যান্ট শার্ট পড়ে নিলো। রুপাকে ঘুম থেকে জাগালো,

– রুপা, আমি একটু হাসপাতালে যাচ্ছি

– এত সকাল, হাসপাতালে কেন?

– শুভ্র এক্সিডেন্ট করেছে, ওর অবস্থা খুব খারাপ।

– আমিও যাব তোমার সাথে। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর, আমি এক্ষুণি রেডি হয়ে নিচ্ছি।

– তুমি কেন যাবে? তোমার যাওয়ার দরকার নেই।

– তুমি কেন যাবে জানতে পারি? তুমি তো শুভ্রকে চেনোই না, তোমার সাথে ওর তো কোন সম্পর্ক নেই।

– কাউকে হাসপাতালে দেখতে যেতে হলে সম্পর্ক থাকতে হয় নাকি?

– না কিন্তু অপরিচিত কাউকে দেখার জন্য নিশ্চয় কেউ ভোর ৬টা বাজে হাসপাতালে উপস্থিত হয় না।

– রুপা, তুমি কী মিন করতে চাইছ আমাকে সরাসরি বলবে?

– আমি কোনও কিছু মিন করছি না, যা সত্যি তাই বলছি। এখন তো ভিজিটিং আওয়ার নয়, তুমি এখন গিয়ে কী করবে?

-আমি জানি না, আমি কী করব? কিন্তু আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।

– কেন, শুভ্রর জন্য তোমার এত টান কেন? ওর বাঁচা মরায় তোমার কী এসে যায়?

-প্লিজ, রুপা! এখন এসব কথা বলার সময় নেই, তুমি যদি যেতে চাও তাড়াতাড়ি রেডি হও, আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।

রুপা নিজেও বুঝতে পারছে না, আদিত্যের সাথে শুভ্রর এমন কী সম্পর্ক থাকতে পারে? হঠাৎ একটা সন্দেহের বীজ তার মাথায় উঁকি দিয়ে গেল, তারমানে কী আদিত্য শুভ্রকে…কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? রুপার পায়ের তলায় যেন মাটি সরে গেল। নিজেকে সামলাল রুপা, সে জানে তাকে এখন অনেক শক্ত হতে হবে।

.

শুভ্রকে প্রায় মরা অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। সাথে সাথে অপারেশন করা হয়, সেলাই করে বন্ধ করা হয় মাথার রক্তক্ষরণ। তাকে এখন আইসিউতে রাখা হয়েছে, ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে আছে শিমুল, চুল এলোমেলো, চেহারা বিধ্বস্ত, চোখগুলো লাল হয়ে আছে। শিমুলের সাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে গেছে, তার সারা শরীরে লেগে আছে শুভ্রর শুকিয়ে যাওয়া কালচে রক্ত।

আইসিইউর রুম থেকে একজন ডাক্তার বের হয়ে আসলো, শিমুল দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

– ডক্টর, শুভ্রর এখন কি অবস্থা? ও বাঁচবে তো?

– দেখুন, আমরা ডাক্তাররা কখনো আশা ছাড়ি না। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছি, কিন্তু শুভ্রর কন্ডিশন খুব খারাপ। তাই, আপনারা যেকোন খারাপ কিছুর জন্য মনকে প্রস্তুত রাখেন।

ডাক্তারের কথায় শিমুল আরও বেশি ভেঙ্গে পড়ল। সে কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না, চোখ দিয়ে অনবরত পানি বের হচ্ছে। 

শিহাবের খুব অদ্ভুত লাগছে শিমুলের আচরণ দেখে, বন্ধুর জন্য খারাপ লাগছে ভাল কথা, তাই বলে এভাবে কান্নাকাটি করতে হবে? শিহাব এসে শিমুলের কাঁধে হাত রাখলো, শিমুল ভাইকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেদে উঠলো।

– শিমুল, তুই বাচ্চাদের মত কাঁদছিস কেন? একটু সামলা নিজেকে, পুরুষ মানুষ কখনো এভাবে কাঁদে?

– ভাইয়া, শুভ্র সত্যি বাঁচবে তো?

– দেখ, তোর আর আমার হাতে তো কিছু নাই, আল্লাহ যদি চায়, শুভ্র অবশ্যই বাঁচবে, আমরা তো চেষ্টা করছি।

– যদি আল্লাহ না চায় তাহলে?

– শিমুল, বাচ্চাদের মত কথা বলবি না। কান্নাকাটি বন্ধ করে আল্লাহর কাছে দোয়া কর।

– ভাইয়া, শুভ্রর যদি কিছু হয়, আমি ওর মাকে কিভাবে মুখ দেখাব?

– শুভ্রর মাকে ফোন করছস?

– না জানাইনি, উনার হাই ব্লাড প্রেশার, শুভ্রর এক্সিডেন্ট হইছে শুনলে উনি সাথে সাথে প্রেশার উঠে মারা যাবেন।

– কিন্তু, শুভ্রর ফ্যামিলির মানুষকে তো জানান উচিত, পরে কিছু হলে কে রেসপন্সিবিলিটি নেবে? উনারা তো উল্টো আমাদের দোষ দিবেন, বলবে আমরা তাদের কাউকে কিছু জানাইনি।

– শুভ্রর সব দায়িত্ব আমার, তাছাড়া আমি কারও নাম্বারও জানি না।

– আচ্ছা, তুই এখন বাসায় যা, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নে, তোর সারা শরীরে রক্ত লেগে আছে।

– শুভ্রকে একা ফেলে আমি কিভাবে বাসায় যাব?

– তুই এখানে থেকেই বা কি করছিস,আর আমি তো আছি।

– শুভ্রর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না, তুমি চাইলে বাসায় যাও।

– তোকে একা রেখে বাসায় যেতেও তো আমার ভয় লাগছে

– আমার কিচ্ছু হবে না।

– সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে, শুভ্রর কিছু হলে তো তুই নিজেই মরে যাবি। আমাদের কিছু হলেও মনে হয় তুই এরকম করে কাঁদতি না

– ভাইয়া প্লিজ, তুমি একটু চুপ করবে?

এমন সময় আদিত্য আর রুপা এসে হাজির হলো। আদিত্যকে দেখেই শিমুলের মাথায় রক্ত চড়ে গেল।

– তুমি এখানে কেন এসেছ? কে আসতে বলেছে তোমাকে? শুভ্র মরেছে কিনা দেখতে এসেছ? চিন্তা করো না, ও মরলে তোমাকে জানাজার জন্য ইনভাইট করা হবে।

– ভাইয়া, আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন আমার সাথে?

– কিভাবে কথা বলব তোর সাথে? তোর ভাগ্য ভাল যে তুই রুপার স্বামী, না হলে তোকে এতক্ষণে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলতাম আমি। আল্লাহর কসম বলছি, যদি শুভ্রর কিছু হয়, আমি তোকে খুন করে ফেলব। এর জন্য যদি আমার বোনকেও বিধবা হতে হয় আমি কেয়ার করি না।

শিহাব তার ভাইকে ধমক দিল,

– এই শিমুল, কী হচ্ছে এইসব? পাগলের মত কী সব আজেবাজে কথা বলছিস? আদিত্যের কী দোষ? শুভ্র কী আদিত্যের গাড়িতে এক্সিডেন্ট করেছে নাকি?

– কোনও বাজে কথা বলছি না আমি। শুভ্রর এই অবস্থার জন্য আদিত্যই দায়ী, তোমরা কেউ জান না, ওর আসল চেহারাটা কী। ও একটা মানুষরুপী জানোয়ার।

শিহাব বুঝতে পারছে শিমুলকে এখন কোনও ভাবেই থামানো যাবে না, সে আদিত্যকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

– আদিত্য, তুমি কিছু মনে করো না, ভাই। বন্ধুর শোকে ওর মাথা পাগল হয়ে গেছে, ও কি বলছে না বলছে সে নিজেই জানে না।

এদিকে রুপা ভাইকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। সবকিছুই তার কাছে বড় এলোমেলো লাগছে। আদিত্য, শিমুল ভাই সবাই কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে, সবাই শুভ্রকে এত ভালোবাসে কেন? কেন জানি শুভ্রকে হিংসে হচ্ছে তার, আজকে শুভ্রর জায়গায় যদি রুপা আইসিউতে শুয়ে থাকতো, তাহলে কি কেউ তার জন্য এমন করে কাঁদত?

রুপা আদিত্যের সামনে এসে দাঁড়াল, আদিত্য একদম শান্ত স্থির, চুপচাপ এককোণে বসে আছে।

– চল আদিত্য, বাসায় ফেরা যাক।

– এসেছি যখন শুভ্রকে এক নজর দেখে যাই।

– এত অপমানের পরও এখানে বসে থাকবে।

– প্লিজ রুপা, শুভ্রর জ্ঞান ফিরুক, তারপর না হয় বাসায় যাব, আদিত্যের কণ্ঠে প্রবল আকুতি।

– কিন্তু, শুভ্রর কখন জ্ঞান ফিরবে কিছুই তো বলা যাচ্ছে না।

– শুভ্রর কিছু হলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না।

– আদিত্য, তুমি কি আমার একটা প্রশ্নের সত্যি জবাব দেবে?

– কি, বলো।

– শুভ্র তোমার কে?

– তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, রুপা।

– দেখো আদিত্য, না বুঝার ভান করে কোন লাভ নেই। গতকাল তোমার ডায়েরীর ভেতরে আমি তোমার আর শুভ্রর একসাথে তোলা ছবি দেখেছি।

– রুপা প্লিজ, আমরা এসব নিয়ে পরে কথা বলি।

– না, আমাকে এক্ষুণি সব জানতে হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।

আদিত্য বুঝতে পারছে রুপা তার সাথে শুভ্রর সম্পর্কটা অনেকটাই অনুমান করে ফেলেছে, এখন আর তার কাছে কোনকিছু লুকানোর কোন মানে হয় না।

– আমি আর শুভ্র একে অপরকে ভালোবাসতাম, গত তিন বছর ধরে আমাদের রিলেশন ছিল। তোমার সাথে বিয়ের কারণে শুভ্র আমার সাথে ব্রেকাপ করে। কাল রাতে শুভ্রর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল, আমি শুভ্রকে অনেক খারাপ কথা বলেছি, আমার জন্যই শুভ্র আজ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, আমি আসলেই অনেক খারাপ একটা মানুষ।

– তুমি কি শিমুল ভাইকে নিয়ে শুভ্রকে সন্দেহ করেছ?

– হ্যাঁ, তুমি কিভাবে জানলে? রুপাকে দেখে অবাক হচ্ছে আদিত্য, সব কথা জানার পরও কিভাবে এই মেয়ে নিজেকে এতটা শান্ত রেখেছে?

– আমি জানি, শিমুল ভাইও শুভ্রকে অনেক ভালোবাসেন, তার চোখ দেখেই সেটা বুঝা যায়,

– তুমি কি আমাকে ঘৃণা করছ, রুপা?

– হ্যাঁ করছি, তোমাকে প্রচন্ড ঘেন্না লাগছে আমার। কিন্তু এই জন্য নয় যে you are gay or bisexual, I hate you because you are a cheater, তুমি আমাকে ঠকিয়েছ, আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছ তুমি।

– বিশ্বাস কর, রুপা! আমার আর কোনও উপায় ছিল না।

– তুমি তো বিয়ের আগে থেকেই আমাকে চিনতে, তখন আমাকে সব কথা খুলে বললে না কেন?

– একবার নিজেকে আমার জায়গায় দাঁড় করিয়ে চিন্তা কর, আমার জায়গায় তুমি হলে কী করতে? পারতে এই কথাগুলো কাউকে বলতে?

– জানি না, তবে আমি এটা ভাল করে জানি, আমি কখনো কারো বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারতাম না।

– রুপা please, forgive me.

– না আদিত্য, আমি কখনো তোমাকে ক্ষমা করতে পারব না। এই বলে রুপা রুপা দ্রুত হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল।

রুপা এলোমেলো ভঙ্গিতে রাস্তায় হাঁটছে। নিজেকে বড় অসহায় লাগছে তার। চেহারায় কেমন যেন একটা দিশেহারা ভাব। তার চোখগুলো পানিতে টলমল করছে, সব কেমন ঝাপসা লাগছে। সানগ্লাসটা সাথে থাকলে ভাল হত। সকালবেলা তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে সঙ্গে আনা হয়নি। জল ভরা চোখ কাউকে দেখাতে ইচ্ছে করে না। রাস্তায় হাজার রকমের মানুষ, ব্যস্ত ভঙ্গিতে শুধু ছুটছে, কারও যেন একটু থামবার অবসর নেই। শুধু রুপার হাতেই যেন অফুরন্ত সময়, তার জন্য তো কেউ অপেক্ষা করে বসে নেই। কোথাও কেউ নেই, সে শুধুই একা। হঠাৎ একটি চার পাঁচ বছরের বাচ্চার দিকে রুপার চোখ পড়ল। বাচ্চাটি গর্বিত ভঙ্গিতে গটগট করে হাঁটছে। তার মা হাত ধরতে চাচ্ছে কিন্তু সে কিছুতেই হাত ধরতে দেবে না। রুপার চোখ আবার ভিজে উঠছে। এমন একটি বাচ্চা কি তার নিজের হতে পারে না! যাকে বুকে নিয়ে সে তার এই ছোট্ট জীবনটা একাই কাটিয়ে দিতে পারবে! তার আর কাউকে দরকার নেই, কাউকে না। রুপা চোখ মুছে ফেললো, এই মূহূর্তে তার দুর্বল হওয়া চলবে না।

.

শুভ্রর অবস্থা খুব একটা ভালো না। শরীরের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ এখনো বন্ধ হচ্ছে ন। মাথার আঘাতটা খুব গুরুতর, এক্ষুণি একটা অপারেশন করা দরকার, কিন্তু শুভ্রর কন্ডিশন দেখে ডাক্তাররাও ভয় পাচ্ছে, তারা সিনিয়র সার্জনের জন্য অপেক্ষা করছে, তিনি এলেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল শুভ্রর শরীর একদম রেসপন্স করছে না, শুভ্রর ভেতরে মানুষের বেঁচে থাকার সহজাত ইচ্ছেটাই যেন মরে গেছে। তবে ডাক্তাররাও হাল ছাড়ছে না, তারা শুভ্রকে বাঁচিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুভ্রর শরীরটাকে নিয়ে চলছে যমে মানুষে লড়াই। এই লড়াইয়ে শুভ্র শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে তো?

আইসিউ থেকে একজন ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলল,

-এখানে শুভ্রর গার্জেন কে আছে?

– ডক্টর আমি, শিমুল এগিয়ে গেল।

– আপনি পেশেন্টের কে হোন?

– আমি ওর বন্ধু।

-কেন, এখানে তার ফ্যামিলির কেউ নেই?

– এখানে তো আমি ছাড়া কেউ নেই। শুভ্রর মা ফেনীতে থাকেন, তিনি অসুস্থ বলে আমরা তাকে কিছু জানাইনি। আমি শুভ্রর খুব ভালো বন্ধু, সে আমার ভাইয়ের চেয়েও বেশী আপন।

– দেখুন, তাহলে এটা আপনার রেসপন্সিবিলিটি। শুভ্রর মাথায় খুব ইমার্জেন্সি একটা অপারেশন করতে হবে, খুব রিস্কি। তাই আপনাকে কিছু কাগজে সিগনেচার করতে হবে, যদি অপারেশনে আপনার বন্ধু মারা যায়, তাহলে কোনভাবেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী হবে না। পরবর্তীতে যদি পেশেন্টের ফ্যামিলির কেউ কোনও অভিযোগ করে তার সব দায়দায়িত্ব আপনার।

– ঠিক আছে, আমার কোনও সমস্যা নেই।

– আর অপারেশনের জন্য রক্ত লাগবে। রক্তের গ্রুপ এবি পজেটিভ, আপনারা তাড়াতাড়ি রক্ত জোগাড় করেন।

– স্যার, আমার রক্তের গ্রুপ এবি পজেটিভ। আমি শুভ্রকে রক্ত দিব। আদিত্য এগিয়ে এসে বলল।

– ঠিক আছে, আপনি আমার সাথে আসুন।

– দাঁড়াও আদিত্য, আমি চাই না শুভ্রর শরীরে তোমার রক্ত মিশুক।

– শুভ্রর প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথেই তো আদিত্য মিশে আছে, আদিত্যকে আপনি কিভাবে শুভ্র থেকে আলাদা করবেন, বলুন? প্লিজ শিমুল ভাই, আগে আমরা শুভ্রকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনি, তারপর যত খুশী আপনি আমাকে শাস্তি দিয়েন। আদিত্য রক্ত পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের সাথে ল্যাবের দিকে রওনা হলো।

.

অনেক রাতে আদিত্য বাসায় ফিরল। তার বাসায় ফেরার কোন ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু, শিমুল তাকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে কারণ বাসায় রুপা একা তাছাড়া হাসপাতালে শুধু একজনই রাতে থাকতে পারবে। আদিত্য বাসায় ঢুকে দেখে রুপা চুপচাপ ড্রয়িংরুমে বসে আছে,

– তুমি এখনো ঘুমাওনি?

– না, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তুমি গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি খাবার গরম করছি।

– আমি খাব না রুপা, ক্ষিদে নেই।

– সারাদিনও তো কিছু খাওনি।

– কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, কেমন জানি বমি বমি লাগছে।

– ঠিক আছে, তাহলে সব খাবার ফ্রীজে ঢুকিয়ে ফেলি।

– তুমি খেয়েছ ?

– না।

– তুমি খাওনি কেন?

– খুব আনন্দে আছি তো তাই।

-ঠিক আছে, তুমি টেবিলে খাবার দাও, আমি গোসল করে আসছি।

আদিত্য প্লেটে ভাত নাড়াচাড়া করছে, তার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। রুপাই প্রথম নীরবতা ভাঙল।

– শুভ্রর এখন কী অবস্থা?

– বিকালে আবার একটা অপারেশন হইছে, সেটা সাকসেসফুল হয়েছে কিন্তু শুভ্রর শরীর কোনও ধরনের রেসপন্স করছে না, সে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে, ডাক্তাররা ভয় পাচ্ছে যে একবার যদি কোমায় চলে যায় তাহলে আর বেঁচে থাকার কোনও আশা নেই।

– আদিত্য আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আর এই মিথ্যে সম্পর্কের বোঝা বয়ে বেড়াতে চাই না। আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাই, I want to divorce. 

– রুপা, পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা কর। এই বিষয়গুলো নিয়ে তো আমরা পরেও কথা বলতে পারি।

– আমি তোমাকে এখনই ডিভোর্স দিতে বলছি না, আমি শুধু আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে জানিয়ে দিলাম।

-রুপা, আগে শুভ্র তো বাঁচুক।

-শুভ্রর সাথে আমার সিদ্ধান্তের কোন সম্পর্ক নেই। তোমার সাথে এক ছাদের নিচে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমি কালই আমার বাবার বাসায় চলে যাব।

– প্লিজ রুপা, এত বড় শাস্তি আমাকে দিয়ো না। তুমি অন্তত এই সময় আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।

– আমার জায়গায় তুমি হলে কী করতে, আদিত্য? সবকিছু জানার পরও আমার সাথে সংসার করতে?

– আমি জানি না, রুপা। কিন্তু এই মূহূর্তে তুমি আমার পাশে থাকাটা আমার জন্য সবচেয়ে বেশী জরুরি।

– তুমি আসলেই স্বার্থপর, আদিত্য। তুমি শুধু নিজের কথাই চিন্তা করছ অথচ আমার কষ্টটা তুমি একবারও ভাবছ না। আমি জানতাম বিয়ের আগে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতে। কিন্তু সে যে একজন পুরুষ মানুষ তা কি আমি স্বপ্নেও কোনও দিন কল্পনা করেছিলাম!

– কিন্তু রুপা, আমি তো কোনদিন তোমাকে ঠকাইনি। তোমাকে বিয়ে করে শুভ্রর কাছে কোনও দিন যাইনি। আমাদের বিয়ের আগেই শুভ্রর সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে ফেলেছি আমি।

– বিয়ের পর গত দুইমাস ধরে তুমি আমার সাথে যে আচরণ করেছ তা কি অন্যায় নয়? রাতের পর রাত আমরা আলাদা বিছানায় ঘুমিয়েছি। গত দুইমাসে নিজের স্বামীকে আমি কতটুকু পেয়েছি? জবাব দাও, আদিত্য! শুভ্রর সাথেও কি তুমি অন্যায় করনি? তিন বছর কাউকে ভালোবেসে সারা জীবন পাশে থাকার অঙ্গীকার করে একদিন হঠাৎ তার হাত ছেড়ে দেয়া কতটুকু বীরত্বের কাজ, আদিত্য?

– আমি যা করেছি বাধ্য হয়ে করেছি।

– দেখ, আমি এই নিয়ে তোমার সাথে ঝগড়া করতে চাই না। নিজের স্বামীকে নিয়ে একজন পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর এইসব ভাবতেও আমার রুচিতে বাঁধছে।

রুপা না খেয়ে টেবিল থেকে উঠে গেল। আদিত্যের খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কাঁদতেও পারছে না সে। হায়রে পুরুষ মানুষ! নিজেকে প্রচন্ড ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে আদিত্যের। তার বিয়ের সিদ্ধান্তটাই ছিল মস্ত বড় ভুল। আজ কে সুখী হয়েছে? সে, শুভ্র নাকি রুপা? কার জন্য, কিসের জন্য এত স্যাক্রিফাইস করল সে? শুভ্র হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে, খুব শীঘ্রই হয়তো রুপার সাথে তার ডিভোর্স হয়ে যাবে। সবকিছু জানার পর তার বাবা মাও কি সুখী হবে? শুভ্র সব সময় একটা কথা বলত, ”একজন অসুখী মানুষ কখনো তার আশে পাশের মানুষকে সুখে রাখতে পারে না। তাই আগে নিজে সুখে থাকো, তারপর সবাইকে সুখে রাখ।” সত্যিই তো, আদিত্যও কি পেরেছে নিজের সুখকে বলী দিয়ে কাউকে সুখী করতে?

.

প্রায় একবছর আগের কথা। শুভ্র তখন প্রথম আদিত্যের সাথে চট্টগ্রামে বেড়াতে এসেছে। আদিত্য শুভ্রকে নিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে এসেছে। হালকা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, সমুদ্র থেকে বয়ে আসছে বৃষ্টি ভেজা দখিনা বাতাস। মাতাল হাওয়ায় শীতের আমেজ। শুভ্র ও আদিত্য একটি বড় ছাতার নীচে বসে সমুদ্র দেখছে, তাদের দুজনের হাতেই ধূমায়িত কফির মগ, সাথে আছে গরম গরম পিঁয়াজু।

-আদিত্য, তুমি না সত্যি একটা পাগল।

– কেন, আমি আবার কী করলাম?

– এই বৃষ্টির মধ্যে কেউ সি বিচে আসে?

– আসে না কে বলল? এই যে আমরা আসলাম, ঐ দেখ আরেকটা কাপল বসে আছে।

ওদের একটু সামনেই খুব অল্প বয়সী একটা মেয়ে আর ছেলে বসে গল্প করছে।

– ওরাও আমাদের মত পাগল।

– প্রেমে পড়লে মানুষ একটু পাগলই হয়।

– তুমি কি নতুন করে প্রেমে পড়ছ নাকি? আমাদের রিলেশনের কিন্তু প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে।

– তো কী হইছে, আমি তো প্রতিদিনই নতুন করে আমার ময়না পাখিটার প্রেমে পড়ি। আচ্ছা শুভ্র, তুমি ছেলেটাকে দেখছ?

– হুম, দেখলাম তো।

-অনেক কিউট, তাই না?

– তোমার চোখে তো দুনিয়ার সব ছেলেই কিউট। আর ঐ ছেলে বয়সে তোমার চেয়ে কম করেও দশ বছরের ছোট হবে, বুঝলা?

– তো, কি হইছে তুমিও তো আমার ছোট!

– আমি আর ওই ছেলেকে কি এক হল নাকি। দোহাই লাগে তোমার, এই পিচ্চি ছেলেগুলোকে অন্তত তোমার চোখের কুদৃষ্টি থেকে রেহাই দাও।

-আমার দৃষ্টি খারাপ, আর তোমার তো সব বুড়াগুলোকে পছন্দ।

– হ্যাঁ, সেজন্যই তো তোমাকে পছন্দ হইছে।

– কী বললা তুমি, আমি বুড়া?

– না, তুমি তো ছোট বাবু! এখনো ফিডারের দুধ খাও।

– ঠিক আছে, আজ রাতেই দেখা যাবে, কে বুড়ো আর কে টগবগে তরুণ।

– কেন, এখনো কিছু প্রমাণ হওয়া বাকি আছে নাকি?

আদিত্য প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে বলল, এখানের পিঁয়াজুগুলো অনেক মজা, তাই না?

– হুম, আরেক প্লেট অর্ডার দাও তো।

– কাঁকড়া ভাজা খাবে?

– ছিঃ, ওয়াক থু!

– এই, মেয়েদের মত ঢঙ কর কেন তুমি?

– কাঁকড়া মানুষ খায়?

-না খেলে ওরা বিক্রি করে নাকি? তুমি জান মানুষ কত শখ করে কিনে খায়? অনেক টেসৃট, বুঝলা?

– তোমার যতো খুশি কাঁকড়া খাও। আমার কোন শখ নেই এই বিশ্রি প্রাণিগুলোকে খাওয়ার।

– আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি খেয়ো না। আমি খাব।

আদিত্য ইচ্ছে করেই শুভ্রকে রাগাচ্ছে, কেন জানি শুভ্রকে রাগাতে তার খুব মজা লাগে। বৃষ্টি এখন অনেকটাই কমে গেছে, হালকা হালকা ফোটা পড়ছে। শুভ্র ও আদিত্য সাগরের তীর ধরে হাঁটছে। খালি পায়ের নিচে ভেজা বালু সুড়সুড়ি দিচ্ছে, সমুদ্রের বড় বড় ঢেউগুলো শান্ত হয়ে আছড়ে পড়ছে তাদের দুজনের পায়ে। আদিত্য শুভ্রর কাঁধে হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে, গোধূলি বেলায় শেষ বিকেলের সূর্যের রক্তিম আভায় কেমন যেন মায়াবী দেখাচ্ছে পরিচিত এই পৃথিবীটাকে। আশেপাশে মানুষজন তেমন নেই, বৃষ্টির জন্য আজকে মানুষ খুব কম, তাছাড়া তারা দুজন হাঁটতে হাঁটতে বিচের একদম শেষ মাথায় চলে এসেছে। শুভ্রর খুব ভাল লাগছে আদিত্যর হাত ধরে হাঁটতে। যদি এই পথ চলা কখনো শেষ না হত!

– আদিত্য, একটা সমস্যা হইছে,

– কী?

-আমার টয়লেটে যাওয়া দরকার।

– এইখানে সমুদ্রের মাঝখানে টয়লেট কোথায় পাবা?

– খুব জোড়ে ধরছে তো।

– উফ, ছোট না বড়?

– ছোট।

– তাহলে উপরে চল, কোন ঝোপঝাড়ে গিয়ে সেরে নাও।

শুভ্র একটি ঝোপের পেছনে দাড়িয়ে প্যান্টের জিপার খুলে নিজেকে হালকা করছে, আদিত্য হঠাৎ করে পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরলো।

– কি কর, আদিত্য খবরদার, এদিকে তাকাবে না।

– আর কত দেখব, গত তিনবছর ধরেই তো দেখছি, এখনো কি কিছু দেখার বাকি আছে নাকি?

– ও আচ্ছা, এখন তাহলে তোমার আর আমাকে দেখতে ভালো লাগে না?

– না, একই পুরনো জিনিস আর কত দেখতে ভাল লাগে। মাঝে মাঝে রুচি পরিবর্তন করা দরকার।

– তাই না?

-হ্যাঁ, কেন আমি ভুল কিছু বলেছি? আদিত্য হাসতে লাগলো।

– ঠিক আছে, তোমাকে আর পুরনো জিনিস দেখতে হবে না। নতুন কাউকে খুজে নাও। পারলে ঐ পিচ্চি ছেলেটার সাথে গিয়ে প্রেম কর।

– এক পিচ্চির জ্বালায় বাঁচি না, এবার করলে একটা বুড়োর সাথে প্রেম করব।

শুভ্র তার প্যান্টের জিপার বন্ধ করে রাগ করে আদিত্যকে ফেলে একা একাই হাঁটতে লাগল। সে বড় বড় পাথরগুলো টপকে নিচে সৈকতে নামছে। আদিত্য তার পেছনে পেছনে আসছে।

-এই শুভ্র, সাবধানে নামো, গর্ত আছে।

-আমি গর্তে পড়লে তোমার কী, আমি মরলে তুমি তো আরও খুশি!

-হ্যা, সত্যি তো অনেক খুশি হব। তখন নতুন নতুন ছেলেদের সাথে প্রেম করে বেড়াব।

শুভ্র হাঁটু পানিতে দাড়িয়ে চুপচাপ সূর্যাস্ত দেখছে। বৃষ্টিভেজা সমুদ্র আসলেই অসাধারণ সুন্দর। শুভ্র মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাল। সে সত্যি অনেক ভাগ্যবান যে এই অকৃত্রিম সুন্দরের মাঝে দাড়িয়ে সৃষ্টির বিশালতাকে উপলব্ধি করতে পারছে। শুভ্র জানে, একদিন তারা কেউই থাকবে না। আমরা সবাই হারিয়ে যাব সময়ের অতল গহ্বরে। কিন্তু এই সমুদ্র সবসময়ই থাকবে বহু মানুষের হাসি কান্না, সুখ, দুঃখ আর ভালোবাসার নীরব সাক্ষী হয়ে। এসব ভাবতে ভাবতে শুভ্র কিছুটা আনমনা হয়ে গিয়েছিল। আদিত্য যে কখন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে বুঝতেই পারেনি। শুভ্র কিছু টের পাবার আগেই আদিত্য তাকে কোলে তুলে নিল।

– এই কি করছ, কেউ দেখলে কি বলবে?

– বলবে, এই দেখো দুইটা ছেলে কেমন বেহায়ার মত প্রেম করছে।

– আদি, জলদি নামাও আমাকে।

– ছাড়ব না, আমি এখন তোমাকে কিস করব

-আমি কিন্তু এখন সত্যি চিৎকার করব।

শুভ্রর কথা শুনে আদিত্য আরো জোরে হাসতে লাগল।

– আদিত্য, প্লিজ ছাড়ো আমাকে।

-সত্যি ছেড়ে দেব? ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম। এই বলে আদিত্য শুভ্রকে পানিতে ফেলে দিল। শুভ্রর শার্ট প্যান্ট সব ভিজে একাকার।

– এটা কী করলে তুমি?

– তুমি নিজেই তো বললে ছেড়ে দিতে!

শুভ্র ভেজা কাপড় নিয়ে রাগ করে একা একা হাঁটছে। আদিত্যের কোন কথারই উত্তর দিচ্ছে না।

শুভ্র, রাগ করেছ? আমি সত্যি স্যরি, আমি তো তোমার সাথে মজা করছিলাম। তুমি জান না, আমার ময়না পাখিটাকে রাগাতে আমার খুব ভালো লাগে?

-তুমি আমার সাথে আর কোনও কথা বলবে না, তুমি এখান থেকে যাও, প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও।

-আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার যা খুশি আমাকে শাস্তি দাও, তারপরও আমাকে মাফ করো।

– ওকে, তোমাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

– তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব।

-সত্যি, তাহলে সব শার্ট প্যান্ট খুলে বিশবার কানে ধরে উঠবস কর।

– শাস্তিটা একটু বেশী কঠিন হয়ে গেল না? শুধু শার্ট খুললে হয় না?

– না, সব খুলতে হবে, অন্যায় যখন করেছ, শাস্তি তো পেতেই হবে

– সত্যি সত্যি খুলব?

– হ্যাঁ, পরনে একটা সুতাও থাকতে পারবে না, শুভ্র হাহা করে হাসছে।

– কেউ দেখে ফেললে কী হবে?

– সেটা আমি কি জানি?

– ওকে, তুমি কি ভাবছ আমি পারব না? আশেপাশে এমনিতেও কেউ নাই, তোমার সামনে আর লজ্জা কী?

আদিত্য সত্যি সত্যিই তার শার্ট জিনস সব খুলে ফেলল। তারপর শর্টপ্যান্টে হাত দিতেই শুভ্র বাঁধা দিল,

– এই কী কর, তোমার আসলেই মান সম্মান নাই।

– আমি কী করলাম? তুমি নিজেই তো বললে সবকিছু খুলতে হবে।

– আমি বললেই তুমি করবে?

– হ্যাঁ, করব। তুমি বলেই দেখ। তুমি বললে আমি এই বিশাল সাগরেও ঝাঁপ দিতে পারি, যদিও আমি সাতার জানি না।

– এত ভালোবাস আমাকে?

– হ্যাঁ, বাসি। কারণ, আমি জানি, আমি সাগরে ঝাঁপ দিলে তুমিও সাথে সাথে ঝাঁপ দিবে আমাকে বাঁচানোর জন্য। তুমি যদি পাশে থাক আমার মরতেও ভয় নেই।

– জান আদিত্য, আমিও চাই আমার জীবনে শেষ মূহূর্তেও যেন আমি তোমার হাতটা ধরে রাখতে পারি, তোমার কোলে মাথা রেখেই যেন আমি মরতে পারি।

– প্লিজ শুভ্র, এসব ফালতু কথা এখন বাদ দাও। আমি তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই, তোমার হাত ধরে আরো অনেকদূর পথ চলতে চাই।

আজকের জন্য সূর্য বিদায় নিয়েছে পৃথিবীর কাছ থেকে। শুভ্র আদিত্যর পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে, সাগরে ঢেউ এসে পরম ভালোবাসায় স্নান করিয়ে দিচ্ছে এই প্রেমিকযুগলকে।

– জান শুভ্র, তুমি যখন আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধর, আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। অদ্ভুত একটা ফিলিংস হয় নিজের ভেতরে। দেখ, আমার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে।

– আমারো খুব ভালো লাগে, মনে হয় তুমি শুধু আমার, আর কারো নও।

– আমি তো শুধু তোমারই, আমার শরীর মন সব কিছুর উপর শুধু তোমারই অধিকার আছে।

– সত্যি আদিত্য, তুমি সারাজীবন এভাবেই আমার পাশে থাকবে তো?

-কেন, বিশ্বাস কর না আমাকে?

-তোমাকে তো আমি আমার নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি, আদিত্য।

– আমার ময়না পাখিটাকে ছেড়ে আমিও যে বাঁচব না, শুভ্র! আচ্ছা, এসব কথা এখন থাক, তুমি আমার ঘাড়ে একটা কিস কর না, প্লিজ।

– এখন না, কেউ দেখে ফেলবে,

– কে দেখবে? আশেপাশে কেউ নেই।

শুভ্র কিস করছে আদিত্যর ঘাড়ে, পিঠে। আদিত্যর শরীরের মাতাল করা বুনো গন্ধ পাগল করে তুলছে শুভ্রকে। তলপেটের নিচে কেমন একটা শিরশিরে অনুভুতি হচ্ছে। শুভ্র বুঝতে পারছে তার প্যান্টের সামনের দিকটা অনেকটাই ফুলে গেছে। শুভ্রর মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এই যে অসাধারণ সুখানুভূতি, এর কাছে পৃথিবীর সব অমূল্য সম্পদও ফিকে হয়ে যাবে।

.

শুভ্রর এক্সিডেন্ট হল আজ তিনদিন। কিন্তু তার অবস্থার কোন উন্নতিই হচ্ছে না। গত তিনদিনে শুভ্র একবারের জন্য পুরোপুরি তার সেন্স ফিরে পায়নি। ডাক্তাররাও শুভ্রকে নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন, তবুও তারা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আদিত্য ও শিমুল দুজনেই উদ্ভ্রান্তের মত হাসপাতালে বসে আছে। রুপা অনেক চেষ্টা করেও একবারের জন্য আদিত্যকে বাসায় পাঠাতে পারেনি। কিছু বললে উলটো রুপার সাথে রাগারাগি করে, বলে, বাসায় কেন যাব আমি? কে আছে আমার বাসায়। শিমুলের মুখ দিয়ে তো কোন কথাই নেই, চুপচাপ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর আইসিইউ থেকে ডাক্তার বের হলেই দৌড়ে যায় শুভ্রর কোন ইম্প্রুভমেন্ট হয়েছে কিনা জানার জন্য।

ভিজিটিং আওয়ারে আদিত্য শুভ্রকে এক নজর দেখার জন্য ভেতরে ঢুকল। শিমুলও এখন আর তাকে আর বাঁধা দেয়না কারণ সেদিন আদিত্য রক্ত না দিলে শুভ্রর অপারেশন সম্ভব হত না। শুভ্রর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রাখা হয়েছে। আদিত্য শুভ্রর বেডের সামনে গিয়ে বসে তার হাতের উপর আলতো করে নিজের হাত রাখলো। এই মূহুর্তে রুমে কোন ডাক্তার নেই, শুধু দুজন নার্স এককোণে বসে আছে। আদিত্য অনেকক্ষণ চুপচাপ শুভ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কী নিষ্পাপ পবিত্র সেই মুখ! আদিত্যর নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে, এই মুখটিকে সে কিভাবে অবিশ্বাস করল?

”শুভ্র, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? কেন তুমি এমন করলে? আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজের এত বড় ক্ষতি করলে? শুভ্র, যাকে এত ভালোবাসলে তার মনের কথাগুলো একবারও বুঝলে না? তুমি জান না শুভ্র, আমি আজও তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়, তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি যে নিজেই যন্ত্রনায় ক্ষতবিক্ষত হই। প্লিজ, শুভ্র তুমি একবার ভালো হয়ে যাও, আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না, কখনো তোমার গায়ে হাত তুলব না, তুমি যত খুশি আমাকে মেরো, আমি একটুও রাগ করব না। তোমার কিছু হলে আমি কিভাবে বাঁচবো, বল? আমি মরে যাব, শুভ্র! আর একটিবার শুধু আমাকে সুযোগ দাও। আমাকে তুমি ক্ষমা চাইবার সুযোগটুকুও দেবে না? তুমি ক্ষমা না করলে যে আমি মরেও শান্তি পাব না। এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না, শুভ্র!

নার্সরা আদিত্যকে ইশারায় চলে যেতে বললো, তার সময় অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। আদিত্য যাওয়ার আগে শুভ্রর কপালে আলতো করে চুমো খেলো, হাত দিয়ে আদর করলো শুভ্রর গালে, শুভ্রকে একবার স্পর্শ করার লোভটুকু সে কিছুতেই সামলাতে পারলো না, তাঁরপর সোজা বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আদিত্য জানে না নার্সরা তাকে খেয়াল করেছে কিনা, করলেও আজ তার কিছু যায় আসে না।

.

বাতাসে তীব্র আতরের গন্ধ। কেউ যেন অপূর্ব গলায় কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করছে। পড়ার ভঙ্গিতে, পড়ার স্বরে কোথাও যেন একটা অপার্থিব কিছু আছে, যা মন ছুয়ে যায়, শিমুল চোখ বন্ধ করে কোরআন তিলাওয়াত শুনছে। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে তখন তার হঠাৎ মনে হলো তাকে ঘুমালে চলবে না। শুভ্র হাসপাতালে একা, তাকে এখনই যেতে হবে। কিছুক্ষণ পরেই শিমুল দেখলো আইসিউ থেকে একটি লাশ বের করা হচ্ছে, সবাই লাশটিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, লাশটি সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। শিমুল ভীড় ঠেলে লাশের কাছে গিয়ে মুখ থেকে কাপড় সরাল। শিমুল তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, এ যে শুভ্র! কী মায়া ভরা শান্ত সে মুখ। শিমুল চিৎকার করে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলো, হঠাৎ শিমুল দেখে শুভ্র চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়েছে, কিন্তু সেই চোখ প্রাণহীন স্থির, সেই চোখ থেকে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসছে, টকটকে তাজা লাল রক্ত, রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাসপাতালের ফ্লোর, শুভ্রর শরীরও রক্তের সাগরে ভাসছে, কী বীভৎস সেই দৃশ্য! 

শিমুল আর সহ্য করতে পারছে না। চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো শিমুল। এতক্ষণ চেয়ারে বসে দুঃস্বপ্ন দেখছিল সে। ঘামে ভিজে গেছে তার শরীর, নীরব নিস্তব্ধ হাসপাতালের করিডোর। শিমুলের চিৎকার শুনে আদিত্যের ঘুম ভেঙে গেছে। হতভম্ভ হয়ে সে তাকিয়ে আছে শিমুলের দিকে।

– আদিত্য, শুভ্র ঠিক আছে তো? আদিত্য কিছু না বলে চুপচাপ শিমুলের হাতটা চেপে ধরল। কি বলবে সে ? কোনকিছু বলার যোগ্যতা তো সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। আজ যে সে সবার কাছেই অপরাধী।

.

হাসপাতালে শুভ্রর জ্ঞান ফিরেছে। জীবনের শেষ মূহূর্তে এসেও কেন যেন বার বার আদিত্যর মুখটাই চোখের সামনে ভাসছে। মনে পড়ে যাচ্ছে আদিত্যর সাথে কাটানো সেই ভালোবাসার দিনগুলোর কথা। আদিত্যকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে শুভ্রর। তার খুব ইচ্ছে করছে শুধু একবার আদিত্যকে দুচোখ দিয়ে দেখতে, তাকে একবার জড়িয়ে ধরতে। শুভ্রর অবস্থা খুব একটা ভালো না। ডাক্তাররা শুভ্রর বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। শিমুল ঢাকায় শিফট করতে চেয়েছিল। কিন্তু ডাক্তাররা বলেছেন, বিদেশে নিয়ে গেলেও কোনও লাভ নেই, শুধু শুধু রোগীকে টানা হ্যাঁচড়া করে কষ্ট না দিয়ে একটু শান্তিতে মরতে দিন। শুভ্রর মা ছেলেকে দেখতে এসে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এমনিতেই তিনি হাই প্রেশারের রোগী। একমাত্র ছেলে যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে, কোন মা-ই বা তখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে! রুপা তাকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে। ঘুমের ঔষুধ দিয়ে উনাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

শিমুল এইমুহূর্তে শুভ্রর বেডের সামনে বসে আছে, সে কিছুতেই শুভ্রর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।

– আমার দিকে তাকাও, শিমুল। তোমাকে আমার কিছু কথা বলার ছিল।

– বলো, আমি শুনছি।

– আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিয়ো। আমার জন্য তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ, আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাস। আমার দুর্ভাগ্য যে আমি তোমার মত মানুষকে ভালোবাসতে পারিনি। কিভাবে বাসব বলো, আমার মন যে অনেক আগেই অন্য কাউকে দিয়ে ফেলেছি। আদিত্যই ছিল শুভ্রর জীবন, সে চলে যাওয়ার সাথে সাথে যেন শুভ্রর আত্মাই মরে গেছে, একটা আত্মাহীন মানুষ কি কাউকে ভালোবাসতে পারে বলো?

– এখন এইসব কথা থাক, শুভ্র।

-না শিমুল, আমাকে বলতে দাও, প্লিজ। এখন না বললে যে কথাগুলো আর কখনোই বলা হবে না। আমার হাতে যে খুব বেশি সময় নেই ।

– একটা চড় দেব তোমাকে! কে বলেছে তোমার হাতে আর সময় নেই? তোমাকে বাঁচতেই হবে। শিমুলের জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে।

– আমিও তাই ভেবেছিলাম, হয়তো একদিন সত্যি আমি তোমাকে আপন করে নিতে পারব, ধীরে ধীরে হয়তো একদিন আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলতাম। যে মানুষটা আমাকে এতটা ভালোবাসে, তাকে ভালো না বেসে কি থাকা যায় বলো? কিন্তু বিধাতা কিছুতেই আমাকে সেই সুযোগটা দিলেন না।

– প্লিজ শুভ্র, তুমি চুপ কর।

-তবে একটা সত্যি কথা কী জানো? আমার জীবনে তোমার গুরুত্ব কখনোই আদিত্য থেকে কম ছিল না। শিমুল, তুমি আমার জন্য যা করেছ, সেই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না। আল্লাহর কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ যে তোমার মত একজন বন্ধুকে আমি আমার পাশে পেয়েছি। তুমি আমার পাশে ছিলে, আমার জীবনের চরম দুঃসময়ে, আমি সেটা কখনো ভুলব না।

শিমুল চুপ করে আছে, আজ তার বলার মত কোনও ভাষা নেই, শুভ্রর সামনে সে কাঁদতে পারছে না, কিন্তু কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

– শিমুল, আদিত্য কোথায়, সে আমাকে দেখতে আসে নাই?

– আসবে না কেন? সে তো গত এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালেই আছে, বাসাতেও যায়নি একবারের জন্য।

– তুমি আমার একটা শেষ উপকার করবে?

– বল।

– শেষবারের মত আমি আদিত্যকে একবার দেখতে চাই। জ্ঞান ফেরার পর সে একবারও আমার সাথে দেখা করতে আসেনি।

– ঠিক আছে, আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আদিত্য শুভ্রর কেবিনের সামনে পাথরের মত দাড়িয়ে আছে, ভালো মন্দ কোনও অনুভূতি তার মধ্যে কাজ করছে না। শুভ্র মরে যাচ্ছে, সে এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কোন মুখে শুভ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। আদিত্য স্থির, অটল যেন এক পাথরের মূর্তি, শুধু তার চোখগুলো নীরবে বারি বর্ষণ করে যাচ্ছে।

রুপা শুভ্রর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

– শুভ্র, আমি কি শুধু একবার তোমার হাতগুলো স্পর্শ করতে পারি?

রুপা শুভ্রর হাত দুখানা জড়িয়ে ধরে বললো, প্লিজ শুভ্র, তুমি আমাকে মাফ কর। আমি হয়তো না জেনেই তোমার আর আদিত্যের মাঝখানে চলে এসেছি। দুজন পুরুষের মধ্যেও যে ভালোবাসা এতটা গভীর হতে পারে, তোমাদের দুজনকে না দেখলে আমি তা কখনো বিশ্বাস করতে পারতাম না। শুভ্র, গত কয়েকদিনে আমি দেখেছি তোমার জন্য আদিত্যের ভেতরে কী পরিমাণ ব্যাকুলতা। আদিত্য সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসে। হয়তো পরিস্থিতি, পরিবার বা সমাজের কারণে সে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও সে কখনো তোমাকে ভুলতে পারেনি। আদিত্যের জন্য তুমি যতটা কষ্ট পেয়েছ, তোমার কাছ থেকে দূরে থেকে সে ততটাই কষ্ট পেয়েছে। তোমাদের দুজনের এই ভালোবাসা অনেক পবিত্র, এর মধ্যে কোনও পাপ থাকতে পারে না, তোমাদের দুজনের সম্পর্ককে ঘৃণা করলে, সত্যিকার ভালোবাসাকেই অপমান করা হয়।

– থ্যাংকস, রুপা। একজন নারী হয়ে যে তুমি আমাদের এই নিষিদ্ধ ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিলে, এটাই আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। রুপা তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব, দিবে?

– তুমি বলো শুভ্র, আজ তুমি যা বলবে আমি করব।

– আদিত্য অনেক ভালো একজন মানুষ, আমি চলে যাবার পর সে অনেক বেশি অসহায় হয়ে পড়বে। প্লিজ তুমি কখনো ওর হাতটা ছেড়ো না।

– না শুভ্র, আদিত্য শুধু তোমার, সারাজীবন শুধু তোমারই থাকবে।

-কিন্তু আমি তো ওকে একা ফেলেই চলে যাচ্ছি, আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই। প্লিজ রুপা, তুমি কথা দাও, তুমি সারাজীবন আদিত্যের পাশে থাকবে।

– ঠিক আছে, আমি কথা দিলাম।

আদিত্য কিছুতেই শুভ্রর সামনে যেতে চাচ্ছিল না। শিমুল তাকে অনেকটা জোর করেই শুভ্রর কাছে পাঠালো। শুভ্রর শেষ ইচ্ছা যে তাকে পূরণ করতেই হবে।

শুভ্রর কেবিনে এখন আদিত্য একা, সে নার্সদেরকেও কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যেতে বলেছে, জীবনের শেষ কিছুটা সময় সে আদিত্যের সাথে একা থাকতে চায়।

– কাঁদছ কেন আদিত্য? জীবনে শেষ লগ্নে এসে আমি যে তোমার হাসি মুখটা দেখতে চাই। প্লিজ আদিত্য, আমার জন্য হলেও হাসো, হাসি মুখে তোমার শুভ্রকে বিদায় দাও।

আদিত্য শব্দ করে কেদে উঠলো, শুভ্র, তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

– ধুর বোকা, আমি কি তোমার উপর রাগ করেছি নাকি? আমার ভালুক ছানার উপর কি আমি সত্যি সত্যি রাগ করতে পারি? আদিত্য, আমাকে একবার ময়না পাখি বলে ডাকো না।

আদিত্য শুভ্রর হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো,

-আমার ময়না পাখি, তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচব বলো, ভালুক ছানা যে তার ময়না পাখিকে ছাড়া একদম একা হয়ে যাবে।

-একদিন তো আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে, আমি না হয় একটু জলদি চলে যাচ্ছি।

-প্লিজ ময়না পাখি, এভাবে বলো না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।

– আমার ভালুক ছানাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব, বল? আমি তো সবসময়ই তোমার সাথেই আছি, তোমার ছায়াসঙ্গী হয়ে। তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের মাঝেই আমি বেঁচে থাকব।

– শুভ্র, আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

– আমিও যে তোমাকে অনেক ভালোবাসি, আদিত্য। আর একটা কথা, শুভ্র কখনো তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, আমি কিভাবে আমার ভালোবাসাকে ঠকাতে পারি, বল?

– আমি জানি, শুভ্র। তুমি শুভ্র বরফের মতই পবিত্র, সুন্দর, পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষ। পৃথিবীর কোনো পাপ পঙ্কিলতা তোমাকে স্পর্শ করতে পারে না।

– আদিত্য, গত তিনমাসে তোমার স্পর্শগুলো না আমি ভীষণ মিস করেছি। শেষবারের মত আমাকে একবার চুমু খাবে ?

শুভ্রর কথাগুলো বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল তার। আদিত্য আলতো করে চুমু খেলো শুভ্রর কপালে, ঠোঁটে, শুভ্রর গালে বুলিয়ে দিল তার ঠোঁটের শেষ পরশটুকু।

ফজরের আযান পড়ছে। কাল সারারাত আদিত্য শুভ্রর পাশে মেঝেতে বসে তার হাত ধরে ছিল, তার গরম নিঃশ্বাস পড়েছে শুভ্রর মুখে। রাতে শুভ্রর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়, তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়, এতকিছুর মাঝেও আদিত্যের হাতটা সে ছাড়েনি, হয়তো অজানা মৃত্যুর দেশে পাড়ি দেয়ার আগে ভালোবাসার মানুষটির হাতে হাত রেখে পেতে চেয়েছিল জীবনের শেষ অভয়টুকু। ডাক্তারদের কাছে শুভ্রর শেষ অনুরোধ ছিল তার জীবনের অন্তিম মূহূর্তে যেন আদিত্যকে তার পাশে থাকতে দেয়া হয়। ডাক্তাররা শুভ্রর কথা রেখেছে। আদিত্য সারারাত শুভ্রর পাশে জেগেই ছিল কিন্তু শেষ রাতের দিকে তার চোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম।

আদিত্য ঘুমাচ্ছে। সে এখনো জানে না কখন যে তার ভালোবাসার মানুষটি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে না ফেরার দেশে।

.

“পরিশিষ্ট”

শুভ্র চলে গেছে আজ দশ বছর হল। আজ শুভ্রর দশম মৃত্যুবার্ষিকী। সময় যেন খুব দ্রুতই চলে যায়, দেখতে দেখতে কিভাবে দশটা বছর পার হয়ে গেল। শুভ্রর আত্মার মাগফিরাতের জন্য রুপা প্রতি বছর এই দিনে একটি ছোটখাট মিলাদের আয়োজন করে। আশেপাশের সব এতিমখানার বাচ্চাদের দাওয়াত দেয়া হয়, তাদের একবেলা তৃপ্তি করে খাওয়াতে বড় ভালো লাগে রুপার। সন্ধ্যায় হুজুররা আসবে, কুরআন পাঠের পর মিলাদ পড়ে শুভ্রর জন্য দোয়া করা হবে। দুপুরে বাচ্চাদের খাওয়ানো হচ্ছে। বাচ্চারা সবাই গোল হয়ে বসেছে, তাদেরকে খাবার পরিবেশন করছে রুপা, আদিত্য ও শুভ্র। আনন্দে শুভ্রর মুখ ঝলমল করছে, মনের সুখে সবার প্লেটে মাংস দিয়ে যাচ্ছে সে। হ্যাঁ, শুভ্র আবার ফিরে এসেছে রুপা ও আদিত্যের মাঝে, তাদের একমাত্র সন্তান হয়ে। রুপার ইচ্ছেতেই তাদের একমাত্র ছেলের নাম রাখা হয়েছে শুভ্র। প্রকৃতি বড় রহস্যময়। মাঝে মাঝে প্রকৃতিতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার কোন সঠিক ব্যাখ্যা কখনো খুজে পাওয়া যায় না। এমন একটি রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে আদিত্য ও রুপার জীবনেও। সেটা হলো ছোট্ট শুভ্র দেখতে অনেকটাই আমাদের শুভ্রর মত হয়েছে। সেই মুখ, সেই হাসি। যারা পুনঃর্জন্মে বিশ্বাস করে, তারা হয়তো বলবে শুভ্রর পুনঃর্জন্ম হয়েছে। রুপাদের ড্রয়িংরুমে শুভ্রর একটি বড় ছবি টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। পিচ্চি শুভ্র মাঝে মাঝে সেই ছবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে তার সাথে এই মানুষটার এত মিল কেন? বড় হলে কি সে দেখতে ঠিক এই রকম হবে? তবে সে তার মায়ের কাছে শুনেছে এই মানুষটা নাকি তার আরেকটা আব্বু যে তার জন্মের আগেই আল্লাহর কাছে চলে গেছে। তার মা বলে যারা আল্লাহর অনেক প্রিয়, আল্লাহ তাদের তাড়াতাড়ি তার কাছে ডেকে নেন। তার এই আব্বুটার প্রতি শুভ্রর আগ্রহের শেষ নেই। সে প্রতিদিন তার বাবা মায়ের কাছে চোখ বড় বড় করে শুভ্র আব্বুর গল্প শুনে, আর হাজার রকমের প্রশ্ন করে, আর আদিত্য ধৈর্য্যের সাথে তার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। আদিত্যের পুরো পৃথিবীটা এখন তার একমাত্র সন্তান শুভ্রকে নিয়ে। হয়তো এই পিচ্চি শুভ্রর মাঝেই সে খুঁজে পেয়েছে তার হারানো ভালোবাসার মানুষটিকে। নিজের ব্যবসা আর পিচ্চি শুভ্রকে নিয়ে ভালোই আছে আদিত্য।

তবে রুপা আদিত্যকে কখনোই ক্ষমা করেনি, শুভ্রকে সে কথা দিয়েছিল তাই আজও আদিত্যের হাত সে ছাড়তে পারেনি। আজকে এতবছর আদিত্য ও রুপা একসাথে একই ছাদের নীচে সংসার করছে, তারপরও তাদের মাঝে বিশাল দূরত্ব, যেন দুজন দুই গ্রহের মানুষ, স্বামী স্ত্রী হিসেবে একসাথে থাকলেও মনের দিক থেকে তারা আজও আলাদা। পিচ্চি শুভ্রই আজ তাদের মাঝে একমাত্র সেতু বন্ধন।

শিমুল এখনো বিয়ে করেনি, কখনো করবেও না। তার এই ঘর এই সংসার একদিন শুভ্রর ছিল, সারাজীবন শুভ্ররই থাকবে। শুভ্রর জায়গায় অন্য কেউ আসবে শিমুল তা কখনো কল্পনাও করতে পারে না। শুভ্র মারা যাওয়ার পর ছেলের শোকে শুভ্রর মা প্রায় পাগল হয়ে যায়। কারো সাথেই কথা বলেন না, একা একা চুপচাপ বসে থেকে শুধু কান্না করেন। শুভ্রর বোনদের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, তাই শিমুল শুভ্রর মাকে ঢাকায় নিজের কাছে এনে রেখেছে, নিজের মায়ের মতই শিমুল উনার খেয়াল রাখে, দেখাশোনা করে, শুভ্রর মা তো তার নিজেরই মা, আর এই ঘরটা তো শুভ্ররই। তবে এখন তিনি কিছুটা স্বাভাবিক, তিনিও শিমুলকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসেন। মাঝে মাঝে শিমুলকে ভুল করে শুভ্র ডেকে ফেলেন। ভালোই আছে শিমুল, তাদের মা ছেলের সংসার নিয়ে, সাথে আছে শুভ্রর ফেলে যাওয়া স্মৃতি। শুভ্র চলে যাওয়ার দশ বছর পরও আজও শিমুল শুভ্রকে ভুলতে পারেনি। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে শুভ্র তাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি, শুভ্র আছে তার পাশে এবং সবসময় থাকবে।

যখন শুভ্রর কথা তার খুব বেশি মনে পড়ে, তখন সে ছাদে এসে দাঁড়ায়, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অসীম নক্ষত্রের পানে। শুভ্রর খুব প্রিয় একটি কবিতা শিমুল প্রায় বিড়বিড় করে আবৃত্তি করে।

”এক সময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল,

ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী।

আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি তোমায় ডাকছি।

সে রাতে তুমি জেগে থেক বন্ধু, ঘুমিয়ে পড় না।

আর হ্যাঁ, ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিয়ো আমি আসছি।

আর যদি কোকিল ডাকে, ভেব আমি আর বেশি দূরে নেই।

তারপর, হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে লুটিয়ে পড়লে বুঝবে আমি এসেছি।

সে রাতে তুমি জেগে থেক বন্ধু, ঘুমিয়ে পড় না।”

ছোটবেলা মা বলত মানুষ মারা গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়, সত্যিই কি তাই? আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র। আজও জোছনা রাতে হাজারও নক্ষত্রের ভীড়ে শিমুল খুঁজে ফেরে তার ভালোবাসার মানুষটিকে, যে সবাইকে ছেড়ে হারিয়ে গেছে বহু দূরে অজানা তারার দেশে। এই গ্রহ নক্ষত্র যত দিন থাকবে, শিমুল খুঁজে ফিরবে তার হারানো ভালোবাসাকে।

ৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.