
রুদ্রনীল
১।
সন্ধ্যা হয়ে এল। চারদিকের উজ্জ্বল আলো ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে কালো অন্ধকার। ক্রমশ সে আঁধার রঙ আরও গভীর থেকে গভীরে যাচ্ছে। পুরোপুরি অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে একটি ঝলমলে সুন্দর দিন। আসবে গভীর রাত।এসব ভাবছিল নীল জানলার ধারে বসে বসে।অন্ধকারকে নীলের বড় ভয়। ও চায় প্রত্যেকটা দিন যদি আলোময় থাকতো। নীলের অন্ধকার জীবনে দিনের আলো যে বড় প্রিয়, বড় আকাঙ্ক্ষার!
পাঁচতলা বাড়ির তিনতলার বাসিন্দা নীল, নীলের পরিবার। সরকারি কোয়াটার। একটা কলোনিতে অনেকগুলো সরকারি সাদা পাঁচতলা বিল্ডিং পরপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে । যেন একজন অন্যজনের সহোদর । পরস্পর গল্প করে কোন বাড়ির কোন পরিবারের কী কী হোল। কে কী করল। এসবের ফিস ফিস আওয়াজ যেন মাঝে মাঝে শুনতে পায় নীল ।একলা থাকলে যা হয়। নীলের মাথায় যত উদ্ভট চিন্তা ভর করে। ওর জগতটা খুব ছোট। চারদেয়ালে বন্দী নীলের জীবন।চারদেয়ালের ইট,কাঠ,পাথর যেন ওর বন্ধু, নিত্যসঙ্গী।
তিনতলা দক্ষিনমুখী ফ্ল্যাট এর ঠিক কর্নার এর রুমটা নীলের।মাকে অনেক বলে কয়ে হালকা নীল রঙের ছোঁয়া দেয়া হয়েছে ঘরটাতে।দেয়াল জুড়ে নীলের আঁকা রঙ বেরঙের অসংখ্য কাগজের প্রজাপতি। লাল নীল জরির কাজ কোনটাতে।উত্তর দিকের দেয়ালে মায়ের সাথে হাসিমুখের ছোটবেলার একখানা ছবি।ঘরে বড় বড় দুটা জানালা , সাথে বিশাল এক বারান্দা। বিছানার পাশেই জানালা। জানালার গ্রিল ধরে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে নীল। কলোনির বাচ্চাগুলো এখনো হৈ হুল্লোড় করছে। সে সব দেখেই ওর তৃপ্তি।কখনো নীচে নেমে কারো সাথে খেলা হয়না, কারো সাথে মেশা হয়না। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সম্ভব নয়। কে নিয়ে যাবে ওতগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে নীলকে নীচে! উপর থেকে দেখে দেখেই অনেক বাচ্চাদের নাম জেনে গেছে। ওদের আনন্দ হই-হুল্লোর দেখে নীলের আনন্দ হয়,একা একা হাসে।
২৪ বছর বয়স। অন্য আর ১০ টা মানুষের মত নীলের জীবনটা নয়। নীল কোনো দিনই হাটতে পারেনি, দাঁড়াতেও পারে নি, এছাড়া ওর ডান হাতেও কিছু সমস্যা আছে, তবে দেখলে কিছুই বোঝা যায় না। নীলের এই সমস্যাটা জন্ম থেকেই না কি পরে কোনো কারনে হয়েছে সেটা আজঅব্দি কেউ বলতে পারে নি। অসুখটা নিউরোলজিক্যাল, ব্রেনের যে সেল গুলো হাঁটাচলা আর ব্যালেন্স নিয়ন্ত্রণ করে নীলের সেই সেল গুলোতে কিছু সমস্যা আছে, অপারেশনের মাধ্যমে ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম,উল্টো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।অপারেশন সাক্সেসফুল না হলে পুরোপুরি প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে, তাই সে চেস্টা করা হয় নি কখনো।
বিশেষায়িত স্কুলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে নীল। নানা রকম ঝক্কি ঝামেলা আর বাড়তি একটা বোঝা হওয়ায় আর কলেজমুখি হয়ে উঠা হয়নি। তবু পড়ালেখার প্রতি ওর অনেক টান। সারাঘর ভর্তি অনেক বই নীলের। মা ই কিনে এনে দেন। কম্পিউটার এ ইন্টারনেট ঘেঁটেও অনেক পড়া হয়।
২।
নীল জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার মায়ের জন্য।সারাদিন অফিস শেষে তার মা এই পথ ধরেই বাসায় ফেরে আর মায়ের ফেরার সময়টাতে অপেক্ষা করে মায়ের জন্য ।নীলের অপেক্ষা আজ কেন ফুরাচ্ছেই না, মা এত দেরি করছে কেন আজ! একটা ফোন করে দেখতে হবে।নীল বিছানার উপর ফোন টা খুঁজে। না পেয়ে দেখলো ঘরের শোকেজের উপর!
-উফফফ! জয়ী গেমস খেলে ক্যান যে ঠিক জায়গায় রাখেনা জিনিসপত্তর!… শোকেজ যে আমার নাগালের বহু বাইরে জয়ী কেন এটা মনে রাখেনা! জয়ী।। এই জয়ী কই তুই? কী করিস?এই জয়ী!
জয়ী ছুটে এলো। হাতে টিভির রিমোট।।
-কী হয়েছে রে দা! ডাকিস ক্যান? টিভি দেখি। কিছু লাগবে তোর?
-সন্ধ্যা হইছে সেই কখন। তোর খেয়াল আছে! মা এখনো ফেরেনাই ।একটা ফোন করতে হবে। গেমস খেলে ফোন অত দূরে রাখিস ক্যান? আমি নিব ক্যামনে?
-উহ দা! ভুল হয়ে গেছে রে! এক্ষুনি দিচ্ছি! আর মা কে নিয়ে এত ভাবিস ক্যান? মা কি ছোট নাকি ! সকালে যাবার সময় বলে গেছে ফিরতে দেরি হবে।
জয়ী নীলের একমাত্র ছোটবোন। পুরোনাম অপরাজিতা আহমেদ। মা মিলিয়ে দুই ভাই-বোনের নাম রেখেছেন “নীল অপরাজিতা”। মায়ের নীল অপরাজিতা খুব প্রিয় । মায়ের পছন্দের সাথে সাথে নীল যে কখন একাত্ম হয়ে যায় বুঝেনা! মায়ের সব পছন্দই নীলের পছন্দ। অপরাজিতা ক্লাস সেভেন এ পড়ে। সারাদিন ওর সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকে বাসাতে, জয়ী স্কুল এ চলে গেলে নীল একলা হয়ে পরে।খালি বাসায় সারাদিন একলা থাকতে ওর ভাল লাগেনা,যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে…খুব কষ্ট হয়, খারাপ লাগে।
জয়ী ই একমাত্র মানুষ যে নীলের চোখে মাঝে মাঝেই জল দেখে,নীল ওকে বুঝিয়েছি চোখে সমস্যা আছে। যখন খুব ঘুম পায় তখন চোখে জল আসে, এরপর থেকে নীলের চোখে জল দেখলেই ও বলে, দা একটু ঘুমিয়ে নে।ছোটবেলা থেকেই জয়ী’কে এই বিষয়টা নিয়ে নীল বোকা বানিয়ে এসেছে, ও জানে না আর কতদিন পারবে!
নীল সকালে ৬টা – ৬:৩০ এর মধ্যে ঘুম থেকে উঠে তারপর চা করে,কখনো কখনো মায়ের মর্নিং সিপ্টে ডিউটি থাকলে মায়ের সাথে রান্না করে তারপর মা অফিসে চলে গেলে পড়াশুনা, টিভি, আর একাকীত্ব নিয়ে সময় কাটিয়ে দেয়, তারপর মা ফিরলে একসাথে খাবার খায়, আর মায়ের ইভিনিং সিপ্ট থাকলে লাঞ্চের পর মা অফিসে যায় আর নীল জয়ী স্কুল থেকে না ফেরা অব্দি কখনো একটু ঘুমিয়ে , নয়তো পড়ে সময় কাটায়। তারপর জয়ী ফিরলে ওর সাথে একটু খুনসুটি। সন্ধ্যাবেলা জয়ী কে পড়ায়, তার আগে জয়ী স্কুলে যাওয়ার আগে ওর নাস্তা রেডি করা, স্কুলব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া, এইতো এসব করতে করতেই নীলের দিন ফুরিয়ে যায়।হুইল চেয়ারে ঘুরে ঘুরেই এসব করে চলে নীল। অনেক বছরের পুরনো অভ্যাস ।
৩।
মমতা ।
নীলের মায়ের নাম।
মমতার ফিরতে ফিরতে সেদিন বেশ রাত হয়ে যায়। নীল এর মাঝে ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে। আজ হাসপাতালে কি সব অনুষ্ঠান ছিল।সেগুলো সেরে একটা মিটিং করে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছে।
নীল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের সময় কাটায়।অনেকের সাথে কথা হয়। নীলের বাইরের লোকের সাথে কথা বলার অবলম্বন তো কেবল ওই ফেসবুকটুকুই! কত কী যে জানতে পারে।
এ সমাজে সমপ্রেমি মানুষের কত রাখঢাক তার উপর যদি সে আবার প্রতিবন্ধী হয় তবে তার কষ্টের কথা কাকে বলবে। নীল কিচ্ছু করতে পারেনা।কেবল জোরে আর্তনাদ করে বাসায় একলা থাকলে।কান্না ওর নিত্যসঙ্গী। ফুঁপিয়ে কাঁদে ।
সমপ্রেমি মানুষেরা সমাজের চোখে অস্বাভাবিক। অনেক কষ্ট,অনেক যন্ত্রনা এই জীবনটাতে।নীল ভাবে এই সত্ত্বার জন্য কে দায়ী! কেউ কি নিজ থেকে এরকমটা হয়!নীলের এই হাঁটতে না পারায় যেমন ওর কোন হাত নেই ঠিক তেমনি ওর সমপ্রেমি সত্ত্বার জন্যও তো ওর কোন হাত নেই!তবে কেন এদের কে আলাদা করে দেখা হয়! ভালোবাসা তো সবার উপরে! সে ভালোবাসায় ছেলে মেয়ে কেন থাকতে হবে? কেন একজন ছেলে অন্য একটা ছেলেকে সত্যিকারের ভালোবাসতে পারবেনা! ভালোবাসায় তো কোন পাপ নেই!
আজ একজনের সাথে নীলের আলাপ হলো, অনেক গল্পের পর নীল তাকে ওর জীবনের কথা বলে।সব কথা শোনার পর সে বলল ‘তাহলে তুমি এই আইডি চালাও কেনো’ তার কথা শুনে নীল হতবাক, তখন থেকেই একটা প্রশ্ন ওর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।“সমপ্রেমী হতে পা লাগে? প্রতিবন্ধী একজন মানুষের মাঝে সমপ্রেমি সত্ত্বা কেন থাকতে পারেনা! কেন পারেনা ওর ভালোবাসার অধিকার থাকতে।কেন? “
নীলের মন খারাপ হয়ে যায়, অবশ্য ওর কিছু ভালো বন্ধু আছে এ জগতে।যাদের কাছে নিজের কথা মন খুলে বলতে পারে।যারা নীলের পাশে থাকে।শারীরিক ভালোবাসায় হয়ত ক্ষণিকের তৃপ্তি আছে, কিন্তু মনের ভালোবাসায় যে চিরজীবনের সুখ আছে সে নীলের মত মানুষ ছাড়া কেউ জানেনা,কেউ বোঝেনা।
৪।
নীলের বাবা জহির সাহেব। জহির সাহেব ফিরতে ফিরতে বেশ রাত করে প্রায় প্রতিদিনই। মমতা ফেরার পর ওরা তিনজন রাতের খাবার খেয়ে নেয়, কত গল্প করে।সারাদিনের গল্প।মাকে খুব অল্প সময় ই নীল আর জয়ী কাছে পায়। ওর এই সংগ্রামী জীবনে ভেঙ্গে না পরার পিছনে মায়ের ভূমিকাই সব থেকে বেশি।মাকে দেখে শিখেছে কী করে বেঁচে থাকতে হয়! সংগ্রাম করতে হয়!
নীল কোথাও যেতে পারেনা তাই মমতাও কোথাও দাওয়াত খেতে যায় না।একমাত্র মা ছাড়া বাকি সবার কাছেই নীল বোঝা,এমন কি বাবার কাছেও।নীলের যখন থেকে জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকে মা বাবাকে শুধু ঝগড়া করতেই দেখে এসেছে ।
জহির সাহেব এমনিতে খুব শান্তশিষ্ট মানুষ।এলাকার একটা আধাসরকারী স্কুলে টিচার কাম ক্লার্কের চাকরি করছে নীলের জন্মের পরের বছর থেকেই।বাবার সাথে নীলের বেশ অনেকখানি দূরত্ব।
জন্মদিন টা কখনোই সেভাবে পালন করা হয়নি কিন্তু এ বছর মমতার কী যে হল, বলল এ বার নীলের জন্মদিন করবে ।শুনেই যেন জহির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। নীল পাশের ঘর থেকে সব শোনে আর কষ্টের নীলে পাহাড়টা আরও বড় হতে থাকে ওর মনে। অসহায় ছেলেটার কথা ওর বাবা একটুও কি চিন্তা করে না? নীলের ক্ষোভের আকাশে আরও মেঘ জমতে থাকে।
মমতার তখন মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইরে একটা থানায় পোস্টিং, কিন্তু নীলের জন্ম হয়েছিল ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে। স্কুলের এই চাকরিটা হয়নি, জহির তখন বাইতুল মোকাররম মার্কেটের একটা জুয়েলারি শপে চাকরি করতেন,জহিরের ভরসায় মমতা মিটফোর্ডে এলেন কিন্তু তখন জানতেন না যে সামনে কি ভয়ঙ্কর দুটো দিন তার জন্য অপেক্ষা করছিল। মমতাকে হাসপাতালে রেখে জহির সেই যে গেলেন আর ফিরলেন দুদিন পর, মাঝেই নীলের জন্ম হলো । নীল শুনেছে ওর খালার কাছে এসব অনেকবার।নীল মনে করে ,ও যে একটা অশুভ জিনিস তার প্রমাণ মিলল জন্মের রাতেই , জহির যে জুয়েলারি শপটাতে চাকরি করতেন নীলের জন্মের রাতে চুরি হয় তাই জহির ওই দুদিন আসতে পারেন নি, এদিকে নীলের জন্মের পর থেকে পরবর্তী ১৮ঘন্টা মমতাকে এক ফোটা পানি পর্যন্ত কেউ খাওয়ায় নি ।এসব বিষয় তদারকি করার মতো কেউ ছিলোই না তখন মমতার পাশে। মমতা খিদের জ্বালায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল কারোর কাছ থেকে কিছু চেয়ে খাওয়ার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট ছিল না। আজো যখন মায়ের এই কথাগুলো মনে পরে দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে নীলের।
নীলের একটা ডায়েরি আছে।একবার জন্মদিনে মা ওকে উপহার দিয়েছিল। অনেক দিন ধরেই আগলে রেখেছে নীল ডায়েরিটা। নীল নিজের কষ্টের কথা নিজের দুঃখের কথা লিখে রাখে ডায়েরিতে।শুরুতেই একটা চিঠি।
“প্রিয় মা,
আমি জানি আমি একজন অন্যতম দুঃখী মানুষ, কিন্তু আমি এও জানি আমার চেয়েও দুঃখী হলে তুমি। তুমি আমার জনমদুঃখী মা।
মা তোমাকে মমতা নামটা কে দিয়েছিল?একেবারেই তোমার মতই তোমার নামটা। এত মমতা কই পাও তুমি মা? কেন এত ভালোবাসো আমাকে?এত আদর, এত ভালোবাসা তোমার এই অথর্ব, পঙ্গু ছেলেটাকে দাও ,বিনিময়ে আমি যে কিছুই দিতে পারিনা মা তোমাকে।
জন্মের পর থেকে আমি তোমাকে এতটুকু সুখ দিতে পারিনি কিন্তু কষ্ট দিয়েছি ষোলআনা, সন্তানেরা মা-বাবার জন্য যা করে আমি হয়তো তার কিছুই করতে পারিনি তবে সৃস্টিকর্তা আমাকে যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি।
যখন থেকে ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই আমার মধ্যে একটা সুইসাইড টেন্ডেন্সি কাজ করেছে।এর প্রধান কারন ছিল তোমার চোখের জল । আমি জানি মা তুমি চরম দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে অনেক কষ্টে ইন্টার পাস করেছ। তারপর নার্সিং পড়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়ো। যখন তুমি থার্ড ইয়ারে তখনি একদিন নানাভাইয়ের ব্রেইনক্যান্সার ধরা পরে ।অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো যায় নি। নার্সিং কমপ্লিট করে তুমি ভেবেছিলে এবার নানি আর ছোট বোনকে নিয়ে বাকি জীবনটা পার করে দেবে, কিন্তু কষ্টই যেন তোমার আজন্ম সঙ্গী! তাইতো বাড়ি ফেরার তিন মাসের মাথায় নানিও পৃথীবির মায়া ত্যাগ করলেন। ক্লাস সেভেনে পড়া ছোট বোনটাকে নিয়ে চরম অসহায়ত্বের জীবন কাটাচ্ছিলে তুমি, এর মাঝে তোমার সরকারি চাকুরী হলো কিন্তু পোস্টিং হলো এমন একটা জায়গায় যেখানে খালাকে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব তাই বড়খালার বাড়িতে ছোট খালাকে রেখে গেলে।
জুরাছড়ি। তখনো পার্বত্য শান্তিচুক্তি হয়নি। প্রাণ হাতে নিয়ে সেখানে দুবছর চাকরি করার পর ট্রান্সফার নিয়ে ঢাকা আসতে চেয়েছিলে। পোস্ট ফাকা না থাকায় মানিকগঞ্জ জেলার একটা ছোট্ট উপজেলায় এলে। কিছুদিন পর ছোটখালাকে নিয়ে এলে ।
আমি সব জানি মা।তোমার কষ্টের জীবন আমি সব জানি।
তারপর বাবার সাথে তোমার বিয়ে হলো। বিয়ের পর ভেবেছিলে এবার বুঝি একটু সুখের মুখ দেখবে কিন্তু সে আশাও পূরণ হলো না তার উপর আমি আমার অশুভ ছায়া নিয়ে হাজির হলাম, ।আমার এ ঝরো আগমন যে শুধু তোমার জীবনটাই তছনছ হয়েছে তা কিন্তু নয়, সাথে খালার জীবনের ১২-১৩ টা বছর শেষ করে দিয়েছি।
খালার মুখে শুনেছি, আমার যখন দু’মাস বয়স তখন আমার নিউমোনিয়া হয়েছিল ডাক্তাররা বলেছিল আমার বাঁচার সম্ভবনা নেই, কিন্তু মা তোমার আশীর্বাদ আর অক্লান্ত পরিশ্রমে সে যাত্রায় আমি বেঁচে যাই, সেই যে জ্বালানো শুরু করেছি আজো থামিনি এখন মাঝেমাঝে ভাবি তখন মরে গেলেই ভাল হতো।
জানো মা আমি একটা কথা গোপন করেছি তোমার কাছ থেকে। আমি একজন সমপ্রেমি। আমি ভালোবাসি এক পুরুষ কে। দু’এক সময় মনে হয় আর কাউকে না হোক অন্তত তোমাকে আমার এই দ্বিতীয় সত্ত্বার কথা জানিয়ে দেই। কিন্তু, পারিনা। ভয় লাগে মা।ভয়টা নিজেকে নিয়ে নয় তোমাকে নিয়ে। জীবনে তো তোমাকে কম দুঃখ দেই নি এতবড় আঘাতটা না ই দিলাম।
দুঃখ সইতে সইতে তুমি কেমন যেনো খিটখিটে হয়ে গেছো, অল্পতেই রেগে যাও, মাঝেমধ্যে আমাকেও খুব বকো তাতে আমার একটুও খারাপ লাগে না, কিন্তু যখন দেখি আমাকে বকে তুমি নিজেই আড়ালে গিয়ে কাঁদো তখন যে বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় মা।সেই মূহুর্তে ইচ্ছে করে হয় তোমার দুঃখের কারনগুলোকে শেষ করে দেই, নয়তো নিজেকে।
কিন্তু পারিনা আমি যে তোমার অপদার্থ সন্তান। আমি বাইরে গেলে তোমাকে আর আমাকে নানা রকম অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়ে, যা আমি একদম সহ্য করতে পারি না।তাইতো বের হতে ইচ্ছা করেনা মা। আর আমার জন্য তুমিও কোথাও যাওনা।আমি জানি মা এ যে কত কষ্টের ,আমি বুঝি! তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারলাম না কেবল কষ্ট ছাড়া!
আমি যেদিন মারা যাব সেদিন তোমার হাতে এই ডায়েরিটা যাবে, তুমি পড়বে।।আমার হাতের লেখার,আমার স্পর্শ পাবে এটাতে।আমার জন্য একটুও কাদবেনা মা।আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।আমি জানি তোমার মত করে কেউ আর তার সন্তানকে ভালোবাসতে পারবেনা।
তুমি ভালো থেকো মা। তোমার এই পঙ্গু সন্তানকে এত ভালবাসা দিয়েছ যেটা কোনদিন ফুরাবেনা।
তোমার,
নীল অপরাজিতা “
৫।
বেশ কিছুদিন ধরেই নীলের সাথে একটা ঘটনা ঘটছে। নীল একজন প্রতিবন্ধী আর সেই সুযোগ নিয়ে ওর এক রিলেটিভ ওর সাথে ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ করতে চায় ।
কিন্তু নীল চায় শুধু ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকতে, আদরে জড়িয়ে রাখতে,ভালোবাসতে। ও হাটতে পারেনা, কিন্তু ওর মনের অলিগলি ঘুরে যে কেবল একজন মানুষের রাজত্ব!
নীলের থেকে অনেক বড় তিনি আর সম্পর্কে খালু হন।রহমত। নীলের খালু। নীলের মা সরকারি হাসপাতালের নার্স আর খালাও তাই এবং একই হাসপাতালে চাকরি করেন আর নীলের খালার বাসা ওদের পাশাপাশি। নীল যখনি বাসায় একা থাকে তখনি রহমত নীলকে বিরক্ত করে।
এমনিতেই নীলের জীবনে যন্ত্রণার শেষ নেই তার উপর এই উটকো ঝামেলা শুরু হয়েছে এভাবে চলতে থাকলে আর বেশি দিন বাঁচবো না নীল।ও খুব ভয়ে থাকে সারাদিন কখন কী হয়ে যায়!
নীল প্রতিবন্ধী বলে সেভাবে প্রতিবাদ ও করতে পারে না ।আর কাউকে কিছু বলতেও পারেনা।মাকে বললে মা সহ্য করতে পারবেনা। এ ঘটনা মাকে আরও অনেক কষ্ট দেবে,অনেক চিন্তায় ফেলে দেবে। নীল চায় না ওর মা আরও কষ্ট পান ওর জন্য! নীল এখন কী করবে! মাঝে মাঝে ওর মনে হয় এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে না ফেরার দেশে।
সেদিন কোথা থেকে এক ছেলেকে নিয়ে এসেছে রহমত। নীলের সামনে দাঁড়িয়ে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে সমানে কিস করে যাচ্ছে রহমত সেই ছেলের ঠোঁটে, মুখে, গালে।ক্রমশ সে চুমু উন্মত্ততায় রুপ নিচ্ছে। নীল আর সেখানে থাকতে পারেনা। লজ্জায়, ঘৃণায় নিজের রুমে চলে যায়। ওর মনে ভয় জাগতে থাকে।কাকে বলবে ওর এই কষ্টের কথা। কে শুনবে ওর এই দুঃখের কথা।কে বাঁচাবে ওকে! একজন যে ছিল সে তো আর নীলের কথা মনে রাখেনি। সে তো বিয়ে করে দিব্বি ভালোই আছে।
৬।
আজ রাতের খাবার শেষে মা, জয়ি আর নীল বসে ওর ঘরে… মা নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর গল্প করে… জয়ী চা করে নিয়ে আসে।।গল্প করতে করতে ওরা চা খায়।। মমতা রবীন্দ্রসংগীত খুব ভালোবাসেন। “সহেনা যাতনা ” গানটা মমতা প্রায়ই গুনগুন করে গায়, মায়ের মুখে গানটা শুনলে মনের মদ্ধে কেমন একটা অনুভুতি হয় নীলের। খুব ভালো লাগে।নীল মোবাইলে গানটা ছাড়ে। অন্যরকম একটা পরিবেশ তৈরি হয়।
-মা জানো আজ যখন বৃষ্টি হচ্ছিল তখন বৃষ্টিতে খুব ভিজতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু আমার তো আর সেই অধিকার নেই তাই দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে বাথরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে বসে রইলাম।কি বেকুব আমি, কোথায় বৃষ্টির জল আর কোথায় শাওয়ারের!
-পাগল ছেলে । আমি তোকে একদিন বৃষ্টিতে ভিজতে নিয়ে যাব ছাদে দেখিস। আমি যেদিন বাসায় থাকবো সেদিন বৃষ্টি হলেই আমি তোকে নিয়ে যাব…আমি তুই আর জয়ী তিনজনে মিলে ভিজব… জানিশ কতকাল আমিও বৃষ্টিতে ভিজিনা! তোর জন্য আমিও ভিজতে পারবো… মা ছেলে মিলে অনেক মজা করব ।মন খারাপ করিস না বাবা।
-মা, আমি তোমার অক্ষম একটা ছেলে । তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনা। আমাকে নিয়ে কত কষ্ট তোমার মা। বাবা কত কথা শোনায় তোমাকে কেবল আমার জন্য।আমাদের সংসারে যে অশান্তি তাও আমাকে নিয়ে আমি জানি মা।
-কি বলিস তুই এসব! আমি কি তোকে কোন কষ্ট দিয়েছি যে তুই এসব কথা বলস! তুই যে আমার অনেক আদরের মানিক সোনা বাবা। তুই যে আমার নাড়িছেড়া মানিক বাবা! খোদা তোকে আমার কাছে দিয়েছেন যেন আমি তোকে আগলে রাখতে পারি। তুই দেখে নিস আমি তোকে ঠিক আগলে রাখবো বাবা। তোর বাবার কথা ছাড়।মানুষটা অনেক বদলে গেছে।
নীল ওর মাকে জোরে জড়িয়ে ধরে।মা ছাড়া আর কেউ ওকে বোঝেনা।মা’ই যে ওর সব থেকে কাছের বন্ধু!দুজনের চোখে জল। ওদের কান্নার রুদ্ধশ্বাসে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে।।
৭।
জহির কোথা থেকে হন্ত-দন্ত হয়ে ফিরল আজ। বাসায় ফিরে বলল, জয়ী কে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওখানে থাকলেই ভালো পড়াশুনা হবে!
শুনে নীল আর জয়ী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো একজন অন্যজনের দিকে! এ কী বলছে বাবা! সে কি সব জেনে বুঝে বলছে! নীল তাহলে কি করে থাকবে একা একা! জয়ী ছাড়া নীল অসহায়!সারাদিন কিভাবে কাটবে? কী নিয়ে বাঁচবে নীল ? ওর একাকী জীবনে জয়ী আনন্দ ! নীলের দুচোখ ফেটে কান্না আসে।।ও আর সেখানে থাকতে পারেনা…হুইল চেয়ার টা ঘুরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
দরজা লাগিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো নীল। বেঁচে থাকার আর কোনো লক্ষ্যই খুঁজে পাচ্ছে না।নীল মুক্তি চায়, একটু শান্তি চায়।জয়ী শুধু নীলের বোনই না,ওর বেঁচে থাকার অন্যতম কারন।
কিছুক্ষণ পর মমতা ছেলের ঘরে এলেন।পরম মমতায় নিজের বুকে টেনে নিলেন ছেলেকে। মা জানে জয়ী ছাড়া নীল একদম ভালো থাকবেনা। এইটুকুন ছেলে কত কষ্টের জীবন তার। মমতার কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ফুরিয়ে গেছে।ছেলে হবার পরে তার জন্য কত যে কেঁদেছে।তাই এখন আর কান্না আসেনা। কেবল ছেলেকে আগলে ধরে বেঁচে থাকতে চান। জয়ী এসে মায়ের আচল ধরে কাঁদতে শুরু করে।
-মা আমার একটুও ভাল লাগে না একা থাকতে ,জয়ী স্কুলে চলে গেলে দিনের যে সময়টা আমি একা থাকি তখন আমার মনে হয় এই বিশাল পৃথীবিতে আমি ছাড়া বোধহয় কেউ নেই..আমি সুখী মানুষ নই মা।আমি যদি অভিনয় করতাম তাহলে হয়তো সব নায়কেরা না খেয়ে মরে যেতো। না হলে কী করে বাবা, ভাই, বোন আর রিলেটিভরা ভাবে আমার কোনো দুঃখ কষ্ট নেই! তারা ভাবে যে যাই বলুক আমার মনে আঘাত লাগে না। কেনো আমার মনটা কি পাথরের?? কেনো সবাই সবসময় আমার দুর্বল জায়গাতেই আঘাত করে?মাঝে মাঝে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে মনে হয়ে চলে যাই না ফেরার দেশে কিন্তু আমি ভিতু টাইপের লোক তাই পারি না মা। তবে যেদিন আঘাতে আঘাতে ভয়টা ভেঙে যাবে সেদিন কী হবে জানিনা।
-তুই এসব কী বলিস বাবা।জয়ী কোথাও যাবেনা। আমি তোর বাবাকে বুঝিয়ে বলব।
-সত্যি বলছ মা! তুমি সত্যি বলছ ত?
– পাগল ছেলে। একদম সত্যি ।তুই দেখে নিস। ও নীল, শোন তোকে একটা কথাবলা হয়নি ।
-কী?
– আজ অরণ্য ফোন করেছিলো।
অরণ্য! এই নামটা নীলের চোখের পানি থামিয়ে দিল।ওকে আড়ষ্ট করে ফেললো! অরণ্য! সেই অরণ্য! এতো বছর পর!আবার এই নামটা কেন! নীল তো চেয়েছিল ওকে ভুলতে! ভুলেও গিয়েছিল।তবে আবার কেন!
-কেন? কী বলল!
-অনেক কথা বলল! তোকে চাইল কথা বলার জন্য। তোর নম্বরটা ওকে দিয়েছি। তোকে ফোন দিবেনে। আমি আসতে বলেছি বাসায়। বলল আসবে।
-তুমি কিছু বললে না। এতবছর পর আবার কি !
-আরে ও তোকে সব ভেঙ্গে বলবে। ও জানে তুই খুব রেগে আছিস। আমি আর তেমন কী বলব বল?পরের ছেলে ।একসময় থেকেছে এ বাড়িতে।যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে চলে গেছে।আর খোঁজ রাখেনি। অবশ্য অনেক ক্ষমা চেয়েছে । তোকে ফোন দিলে কথা বলিস বাবা। তোর বড় ভাইয়ের মত অরণ্য। মনে নেই সে কত কী করেছে তোর জন্য! রাগ করে থাকিস না বাবা। তুই ঘুমা আমি যাই। আর জয়ীর ব্যাপারে কী করা যায় আমি দেখছি।ও তোকে ছেড়ে থাকতে পারবেনা আমি জানি।তোর বাবাকে আমি বুঝিয়ে বলব।
৮।
মমতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।নীল এখনো ঠায় বসে আছে হুইল চেয়ারে। এই একটি নাম তাকে থমকে দিয়েছে। নীল ফিরে যায় সেই ৩ বছর আগের দিনগুলোতে।
০৭ ফেব্রুয়ারী ২০১২.নীল জানতো ওর দেখাশুনা করার জন্য গ্রাম থেকে মা তার এক দূরসম্পর্কের বোনের ছেলেকে আসতে বলেছেন।
অরণ্য।
শুরু থেকেই অরণ্যর সাথে নীলের লেগেই থাকতো। নীল খুব ভালই বুঝতে পেরেছিল যে ওর বেডরুমে ভাগ বসাবে তাই রাতে তারাতারি ডিনার সের আগেভাগে রুমে গিয়ে লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। কিছুক্ষন পর অরণ্য এলো।নীল নিজমনে পড়ছে। অরণ্য হাত বাড়িয়ে বললো,
-হাই আমার নাম অরণ্য, তোমার নাম নীল তাই না?
-জি না আমি শাহরিয়ার, শুধু মা আমাকে ওই নামে ডাকে ।
-আমি তোমাকে কী বলে ডাকব? মন বলে ডাকি??
-কেন! আপনি খামখা আমাকে মন বলে ডাকতে যাবেন কেনো?
– না মানে তোমাকে তো সবাই আলাদা আলাদা নামেই ডাকে দেখছি, যেমন খালা ‘বাপ্পি’। বাড়িতে বসে শুনেছি বড়খালা তোমাকে ‘বিল্লি’ বলে ডাকে, তাই ভাবলাম আমিও তোমাকে একটা নাম দেই।
একথা বলেই অরণ্য একটা মুচকি হাসি দিলো। তখন রাগে নীলের গা জ্বলে যাচ্ছিল।
-দেখুন আমাকে যারা বিভিন্ন নামে ডাকে তারা আমার কাছের মানুষ, আপনাকে তো আমি চিনিই না এর আগে কোনদিন দেখিও নাই।আপনি কেনো আমাকে নাম দেবেন? বাইরের সবাই যে নামে ডাকে আপনিও সেইনামেই ডাকবেন।
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে যেদিন তোমার কাছের মানুষ হতে পারব সেদিন না হয় তোমাকে ‘মন’ বলে ডাকব, সেই দিনের আগে অব্দি না হয় শাহরিয়ার বলেই ডাকবো।
নীল বড় বড় চোখ করে তাকালো! ভাবতে লাগলো, এই পোলায় কী কয়!
অরণ্য বলল- ভয় পেলে নাকি? আরে ভয় পাওয়ার কিছু নাই ।কাছের মানুষ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি আমি যেদিন তোমার বন্ধু হতে পারবো সেদিন না হয় তোমাকে মন বলে ডাকব।
তারপর দিনগুলো বেশ ভালই কাটছিল।নীলরা তখন যে বাড়িতে ভাড়া থাকত সেখানে সাপ্লাই পানি ছিল না তাই ছেলেরা সবাই কলতলাতেই গোসল করত, অরণ্য যখন খালিগায়ে গোসল করতে যেত তখন লুকিয়ে লুকিয়ে অরণ্যকে দেখত। কি সুন্দর পুরুষ। যাকে অনেকক্ষন ধরে দেখা যায়। যার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা যায়। যার উঁচু সুগঠিত বাহু, বুক দেখে পাগল হয়ে যাওয়া যায়। ভেজা লুঙ্গির ফাকে যার উত্তিত বিশেষ অঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকা যেত অপলক।অরণ্য হয়ত বুঝতো কিন্তু কোনো দিন কিছু বলত না।
কি সুখের ছিল সেই দিনগুলো, ধীরেধীরে ওরা খুব ভালো বন্ধু হল, অরণ্য ‘তুমি’ ছেরে তুই তে নেমে এলো আর নীল ‘আপনি’ ছেরে তুমি তে। সব কাজ ওদের একসাথে করা চাই ।একসঙ্গে খাওয়া, কলতলায় একসাথে গোসল করতে গিয়ে মগ,বালতি,সাবান এসব নিয়ে ঝগড়া করা, রাতে দুজনে একসাথে পাল্লা বই পড়া। প্রতিযোগিতার পুরস্কার আর শাস্তি কি ছিল। কথা ছিল যেদিন যে তার পড়া আগে শেষ করতে পারবে না সেদিন বিছানা করা আর সকালে ওঠানোর কাজটা তাকে একাই করতে হবে।
এভাবে ৭টা মাস কেটে গেল তারপর এলো নীলের জীবনের সবচে সুখময় দিনটা, সেদিন ছিল নীলের জন্মদিন, এতদিনে ওরা প্রাণের বন্ধু হলেও পূর্বের কথামতো অরণ্য কিন্তু নীলকে ‘মন’ বলে ডাকা শুরু করেনি বিষয়টা নীলের খারাপ লাগলেও কখনো অরণ্যকে কিছু বলেনি পাছে কিছু মনে করে?
নীল সেদিন সজাগ ই ছিল। পরীক্ষা চলছিল তাই পড়ছিল।
রাত ঠিক ১২।০১ মিনিটে বিছানা থেকে উঠে অরণ্য দু’হাত দিয়ে নীলের মাথাটা চেপে কপালে ওর ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে বলল,” Happy Birth Day আমার মন”।
নীল একটু অবাক হয়ে বলল
-তুমি কিভাবে জানলে আজ আমার জন্মদিন। আর তোমার মন! এই কথাতার মানেই বা কি?
-ইচ্ছে থাকলেই জানা যায়, আর ‘আমার মন’ বলতে আমি কী বোঝাতে চেয়েছি সেটা না বোঝার মতো বোকা তো তুই নোস, দ্যাখ মন আমরা কেউ কাউকে না বললেও দুজনেই খুব ভালো করে জানি যে আমরা দু’জনেই একই পথের পথিক আর আমি এও জানি তুই অন্য কাউকে ভালবাসিস না, কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোকে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি রে…. ভালোবাসবি আমাকে??
নীলের চোখ দিয়ে শুধু কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছিল,একজন অচল মানুষ যে কারো ভালোবাসার মানুষ হতে পারে সেটা ওর ভাবনার বাইরে ছিল।
অরণ্য নীলের কান্না দেখে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল
-আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি মন বাবু।
তারপর অরণ্যর ভালোবাসা নীলকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো কোন এক অজানা দ্বীপে।চুমুতে চুমুতে ভরে উঠল ওদের সাড়া শরীর। নীল ক্রমশ আবিষ্কার করতে থাকল অরণ্যর বলিষ্ঠ দেহকে! অরণ্য ভালোবাসায়, আদরে ভরিয়ে তুলল নীলকে।
এর পরের কয়েকটা মাস কিভাবে কেটে গেছে টেরই পায়নি নীল। একবার বাসার সবাই পনেরো দিনের জন্য দেশের বাড়ি গিয়েছিল, বাসায় শুধু অরণ্য আর নীল, অরণ্য বলেছিলে ‘এই পনেরো দিন হবে আমাদের হানিমুনের’ ।
লজ্জায় নীলের মুখটা একেবারে লাল হয়ে গিয়েছিল, তাই দেখে অরণ্য বলল,”হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। “
কিছুদিন পর নীলদের বাসা থেকে চাকরির উদ্দেশ্য বিদায় নিলো অরণ্য, সেদিন নীল কি কান্নাটাই না কেঁদেছিল।
সেই কান্না দেখে অরণ্য বলেছিলে -ধুর বোকা ছেলে আমি কি একেবারে চলে যাচ্ছি নাকি আবার আসব তো।
কই অরণ্য তো আর তো ফিরে এলো না।এর পরের কয়েক মাস অবশ্য ফোন খোঁজ খবর রেখেছিল অরণ্য তবে একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। নীল অনেক চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করবার কিন্তু কিছুতেই অরণ্যকে পেলনা!
নীল ভাবে হয়তো অরণ্য নতুন কাউকে খুঁজে নিয়েছে, কিন্তু সে যে শত চেস্টা করেও কিছুই ভুলতে পারছে না। কিভাবে পারলো অরণ্য সবকিছু ভুলে যেতে? কিভাবে??
৯।
সকাল সকাল মমতা অফিসে বেড়িয়ে গেছেন। জয়ী স্কুলে। জহির সাহেবও বেড়িয়েছেন সেই সকালে। নীলের মন গতরাত থেকে খুব অশান্ত হয়ে উঠেছে। এতবছর পর অরণ্য! নাম্বার নিয়েছে। ফোন করে কী বলবে ।রাগে ঘিন্নায় যে আর ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা!
সকাল ১১তায় ঠিক ফোন টা এলো। নীল জানে এটা কার ফোন! ফোন বেজেই চলছে।।নীলের হাত কাপছে…।কী করবে ও! একটা বাটন এর আড়ালেই ওর প্রিয় মানুষটির কণ্ঠ…সেই তিনবছর পর! ২য়বারের মত ফোন বেজেই চলেছে।
নীল এবার আর পারলোনা …কাপা কাপা হাতে কানের কাছে ধরল,
-হ্যালো হ্যালো মন! কেমন আছ! হ্যালো!
নীল কী বলবে বুঝতে পারছেনা । সেই নামটা “মন”… অরণ্য ভালোবেসে দিয়েছিল!
অরণ্য বলেই চলে,
-আমি জানি নীল তুমি আমার উপর খুব রেগে আছ! কিন্তু বিশ্বাস কর তুমি তোমার কথা একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনা…মায়ের কথা রাখতে পারিবারিক পছন্দে হুটকরেই বিয়েটা করেছিলাম।আমি জানতাম, তুমি ভুল বুঝেছ,অনেক কষ্ট পেয়েছ। আমি চাইছিলাম তুমি ভুল বুঝেই থাকো।আমিতো তোমার সাথে প্রতারনা করেছি। আমি কোন মুখে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখব। কিন্তু জানো ৭ দিন আগে আমার একটা মেয়ে হয়েছে। ও নাম রেখেছি নীলা! আমি আর পারলামনা।তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম ।খালার কাছ থেকে তোমার নাম্বারটা নিছি। একটু কথা বল নীল। আমি তোমার একটু কথা শুনতে চাই।
নীলের কষ্টের পাহাড় যেন সব গলে পড়তে লাগল! যে মানুষটা তাকে ভুলেই গেছিল, যে মানুষটা তাকে অবহেলা করে চলে গিয়েছে বলে ভেবে এসেছে এতদিন সে কিনা তার মেয়ের নাম রেখেছে নীলের নামের সাথে মিল রেখে! সে কিনা এতদিন পরে ফোন দিয়েছে ঠিক সেই আগের মত।।ঠিক সেই আগের আবেগটা!
-কেমন আছ অরণ্য? ভালো আছত?
-আমি ভালো নেই। আমি একদম ভালো নেই মন।তুমি কেমন আছো?
-আমি ! হা! আমি খুব ভালো আছি।খুব। তুমি আমাদের বাসা থেকে চাকরির জন্য সেই যে বিদায় নিলে তারপর থেকে খুব ভালোই আছি। তুমি আমাকে ভুলে গেছো কিন্তু আমি যে শত চেস্টা করেও কিছুই ভুলতে পারছি না।তোমাকে যে অনেক ভালোবাসি। তুমি যে আমার জীবনের ধ্রুব সত্য ! কিভাবে পারলে সবকিছু ভুলে যেতে? কিভাবে??………….
-আমি অন্যায় করেছি।আমি ভুল করেছি।আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মন। আমাকে ক্ষমা করো।সবকিছুই আমার মনে আছে, মৃত্যুর আগ অব্দি সব মনে থাকবে।
-জানো অরণ্য
খুব মিস করি সেই “সামওয়ান স্পেসাল” মানুষটিকে ।যে আমার এলোমেলো চুলগুলো দেখে বলত, কী অবস্থা তোমার সারাদিন বনমানুষ সেজে থাকো কেনো. আর নিজেই চিরুনি টা হাতে নিয়ে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতো। বিকেলবেলা আমাকে বলতো চল বাইরে ঘুরে আসি ।আমি বলতাম – না থাক বাইরে গেলে সূর্য্য, বাতাস, আর রাতের আকাশের চাঁদ আমাকে দেখে উপহাস করবে আর তাছাড়া বাইরে গিয়ে কী লাভ আমি তো আর তোমার হা…… বাকি কথা গুলো বলার আগেই আমার মুখে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে বলতো – আর কোনদিন এসব বলবে না তুমি. তারপর আমার হাত ধরে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুতে।
-নীল সামনের মাসে আমাদের সেই প্রথম দেখার দিন !মনে আছে সেই ৭ ফেব্রুয়ারী!আমি চাই এই দিনে তোমার সাথে দেখা করতে।তিনবছর পর আবার আমাদের মিলন হবে।আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো তোমার বাড়ির সামনের রাস্তায়… আমি চাই তুমি আমার জন্য নেমে আসবে নিচে..যেভাবেই হোক! আমি চাই তুমি আমার জন্য বাহিরে আসবে।আমি চাই তুমি নিজেকে পৃথিবী চেনাবে।।ঘরে বদি আর কতকাল ! আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার প্রিয় নীল অপরাজিতা হাতে। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
আজ অনেকটা বছর পর আবার নীলের মন চঞ্চল হয়ে উঠল।! আজ মনে হচ্ছে কেন সে হাঁটতে পারেনা।।কেন তার চলার শক্তি নেই?তাহলে এক্ষুনি ছুটে যেত অরণ্যর কাছে..নীলের ভালোবাসার কাছে।
সেদিন রাতেই মমতা ফেরার পর নীল বলল, সে অপারেশনটা করাতে চায়,নীলের বিশ্বাস সে ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে।হাঁটতে পারবে, দৌড়াতে পারবে। এ কষ্টের জীবন আর বয়ে নিতে পারছেনা।
১০।
নীলের বাসায় একটা ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা চলছে কদিন যাবৎ। প্রায় লাখখানেক টাকা চুরি হয়েছে। অনেক কষ্টে মমতা টাকাগুলো জমিয়েছিলেন নীলের চিকিৎসার জন্য। আর চুরি করেছে এমন একজন লোক যাকে কিছু বলার উপায় নেই।। মমতা দিশেহারা হয়ে পড়লেন ।কী করবেন তিনি! ওদিকে ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করা হয়ে গেছে।জহির নির্বিকার। ডাক্তারের সাথে কথা বলে একটা সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করা হয়েছে।আর ওই সময়ে টাকা নাই।তবে কি নীলের চিকিৎসা হবেনা? নীলের সেরে উঠার শেষ প্রদীপটুকু নিভে যাবে?
নীল সবসময় বাসাতেই থাকে, নীল যখন গোসল করছিল তখন ওর সেই বদ খালু রহমত ঘরে ঢুঁকে টাকাটা নিয়েছে।
কে নিয়েছে সেটা নীল আর মমতা বুঝতে পেরেছে কিন্তু করার কিছুই নেই।এমন কি খালাও বুঝতে পেরেছে, আজ মমতার সাথে রহমতের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে অনেক।টাকা চুরির পর থেকে বদমাইশ টা একবারো নীলদের বাসায় আসে নি, এটা নিয়ে মমতা প্রশ্ন করতেই শয়তানটা নানা রকম উল্টোপাল্টা কথা বলা শুরু করে।
নীলের কারনে কেউ কখনো ওদের বাসা থেকে একটা সুতাও নিতে পারেনি, আর এতগুলো টাকা চুরি হয়ে গেল কিন্তু নীল কিছুই করতে পারলো না।রহমত এরকম একটা জঘন্য কাজ করবে কেউ সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি এমনকি নীল ও নয়।
১১।
আজ দুপুর ২ টায় নীলের ফ্লাইট চেন্নাইয়ে ।টাকা হারানোর পর মমতা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। নীল ও কিছু বলতে পারলোনা।অনেক স্বপ্ন দেখেছিল সে। আবার সুস্থ হয়ে উঠবে,শেষ প্রদীপটুকু কিছুতেই নিভতে দেবেনা।
বেশ কয়েকদিন মমতা বাড়িতেই ছিল।কোন আশার আলোই দেখতে পাচ্ছিল না। কিভাবে টাকা জোগাড় হবে? কী করে নীলের চিকিৎসা করাবে এসব ভেবে সে অস্থির হয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ করেই মমতা এসে একদিন বলল, টাকার জোগাড় হয়ে গেছে।নীলের চিকিৎসা হবে, কিছুতেই সে হার মানবে না।
কে দিল ওতগুলো টাকা,কই থেকে পেলে এসব জিজ্ঞেশ করেছিল নীল কিচ্ছু বলল না মমতা। নীল ভাবতে লাগলো কে দিল এতগুলো টাকা! কে!
একদিন ফিসফিস করে মাকে মোবাইল কথা বলতে শোনে নীল , “বাবা তুই যে উপকার করলি তার ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবোনা।তুই নীলকে এত ভালোবাসিস! কিন্তু কেন এই শর্ত দিলি যে কাউকে এ নিয়া কিছু বলতে পারবোনা!”
তবে কি অরণ্য!অরণ্য দিয়েছে টাকা।কেন? কেন দিল? নীলকে সুস্থ করে তুলার জন্য! অরণ্যই কি তবে মমতাকে রাজি করিয়েছিল!নীল এসবের উত্তর খুজে পায়না!
বাসা ভরতি লোকজন। নীলকে দেখতে এসেছে । হয়ত এই’ই ওকে শেষ দেখা…আর তার জন্যই এত লোকজনের আনাগোনা।
নীল কাল থেকে অরণ্যর কথা ভেবে যাচ্ছে, কী করবে নীল? একটা ছেলে যে কিনা ওকে ভালোবাসে, যার ভালোবাসার যোগ্য নীল নয় সে তার জন্য অপেক্ষা করবে।
আজ ৭ ফেব্রুয়ারী।
নীল অপরাজিতা সেই ভালোবাসার মানুষ তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে! এত বছর পর!কিন্তু অরণ্যর যে সংসার আছে! ওর যে একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে।নীলা!
কী করবে নীল এখন।
নীল আর সহ্য করতে পারেনা। যদি আর না ফেরা হয়! যদি অপারেশন টেবিলেই নীলের শেষ সময়টা হয় তবে ত আর দেখতে পারবেনা অরণ্যকে! যাবার আগে একবারের জন্য হলেও অরণ্যর মুখটা দেখতেই হবে।
কিন্তু সামনে যে লম্বা পথের দেয়াল,অনেকগুলো সিঁড়ি ভাংতে হবে… পা থাকলে, হাটার শক্তি থাকলে নীল এক দৌড়ে বেড়িয়ে যেত অরণ্যর কাছে ।ওকে দেখতে পেয়ে যে মরেও সুখ!
জয়ী কাল থেকে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে,ও সাথে যেতে পারছেনা। নীল জয়ী কে এক পাশে ডেকে নেয়, আদর করে ছোট বোনকে সব বুঝিয়ে বলে..নীল ওকে একটু নীচে নামিয়ে দিতে বলে….জয়ী নীলকে সবার চোখের আড়ালে করে নিচে নামিয়ে দিল।
নীল হুইল চেয়ার টেনে টেনে এগিয়ে চলে তার জন্য অপেক্ষা করা সেই ভালোবাসার মানুষটার কাছে।। কোন দিকে খেয়াল নেই ওর,কেবল শরীরের সমস্ত শক্তিটুকু দিয়ে হুইল চেয়ারে হাত চালিয়ে যাচ্ছে । কোথা থেকে এত শক্তি সাহস এসেছে নীলের মনে নীল জানেনা।
ছুটে চলেছে নীল। অরণ্যর ভালোবাসার হাতছানি ছুটে আসছে প্রচণ্ড আবেগে, নীলকে এগিয়ে নিচ্ছে সামনের দিকে। আজ অরণ্যর সাথে উড়ে চলেছে প্রজাপতি হয়ে।নীল অরণ্যে প্রজাপতি হয়ে ঘুরে বেরাবে ওরা দু’জন।
সমাপ্ত
উৎস: অন্যভুবন
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১২, ২০১৬