
চিন্ময়ের ইতিকথা
১.
-এই চল্, ইটকা মারি।
-কিই????
-ইটকা বুঝিস না ! ঢিল ঢিল। দেখেছিস। পাকা পাকা বড়ই!
-তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?
অামি তার কথা তোয়াক্কা না করে বলতে থাকলাম
-এইজায়গায় বজ্জাত একটা বেটি থাকে। গতবার বড়ই পাড়তে গিয়ে কি ধ্যাতানি টা না খেলাম!
-ইমন, তুই বড় হয়ে গেছিস অারো দশ বছর অাগে। সেটা কি ভুলে গেলি! এখন ভার্সিটির এডমিশন কোচিং করছিস। কয়েকদিন পর ভার্সিটিতে পড়বি। অার অধরা ও প্রভা দাড়িয়ে অাছে। বাস ধরতে হবে। তাড়াতাড়ি অায়।
নিতান্তই বেরসিকের মতো চলে এলাম মাসুদের জন্য। ব্যাটা বদের হাড়ি। কোন কাজ করতে দেয় না।
বাস স্ট্যান্ডে পৌছুতেই অধরা ও প্রভা কে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম।অধরা প্রায় খেঁকিয়ে উঠলো
-কোথায় মরে গিয়েছিলি?
-তোদের বাড়ির গোয়ালঘরে।
প্রভাঃ তাড়াতাড়ি চল্, নয়তো বাস মিস করবো।
দৌড়ে একটা বাসে উঠলাম। বসার জায়গা পেলাম। ড্রাইভারের পাশে। বাস দিয়ে এই প্রথম যাচ্ছি ময়মনসিংহ। আগে ট্রেন দিয়ে যেতাম। কিন্তু সময়ের গড়মিলের জন্য ট্রেন ছেড়ে বাস ধরেছি। বাতাস মুখে ঝাপটা মারতে থাকলো। বাতাসের ঝাপটা থেকে মুখটা বাঁচাতে পারছি না। তবে খারাপ লাগছে না। কড়া একটা ব্রেক। সামনের দিকে ঝুঁকে গেলাম। পথের সামনে ছাগল ছিলো। ভাগ্যিস মারা যায় নি। চোখে একরাশ ধন্যবাদ নিয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। তাকাতেই হা হয়ে গেলাম! চোখগুলো অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর। মুখশ্রী পুরুষালী সৌন্দর্যমন্ডিত। কতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম জানি না, কিন্তু ড্রাইভার যখন অামার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখগুলোকে নিজের বশে নিয়ে নিলাম। নিজের কাছে লজ্জা লাগছে। হা করে তাকিয়ে থাকার মত অসাধারন চেহারা না বলে মনকে প্রবোধ দিচ্ছি। কিন্তু অাঙুর ফল টক, এই প্রবাদটা মনে হয়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত মনকে শান্তি দিয়ে চোখের বাধা ভেঙে দিলাম। চোখ দেখছে সেই ড্রাইভারকে। অবিরত
২.
বাস থামলো। জায়গাটার নাম সাহেব কাচারী। একপাশে লেতু মন্ডল স্কুল অার অপরপাশে একটা গাছ। গাছটা আমার চেনা কারন সেটা ছিল অামার প্রিয় “কাঁঠালচাঁপা” ফুলের গাছ। গাছটার পাশে ছোট্ট একটা দোকান। দোকানটার নাম দেখে অবাক হলাম। বনবিথী! সত্যিই নামটা অনেক কাব্যিক। পিছনে বিশাল জঙ্গল। অার কিছু দেখার সুযোগ পেলাম না। গাড়ি চলতে থাকলো অাপনমনে। সারা রাস্তা ড্রাইভারের দিকে অপলক দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করছিলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ড্রাইভারের হাতটা ধরে বনবিথীর পেছনের ঘন বনে হারিয়ে যেতে। কিন্তু স্বপ্নগুলো চোখ অাঁকড়ে ধরে রাখে। বাস্তবে রূপ পায় না।
নামার সময় মাসুদ বললো
-কিরে ইমন,শরীর খারাপ?
-কি যে বলিস না!
-তাহলে নামছিস না কেন? কেউ তো বাসে নেই!
ঘোর থেকে যেন বাস্তবে বেরিয়ে এলাম। লজ্জিত মুখে চুপচাপ উঠে চলে এলাম। যাওয়ার সময় ইচ্ছে হচ্ছিলো ড্রাইভারটাকে দেখার। কিন্তু কেন যেন পিছনে ফিরলাম না। হয়তো সংকোচ। নয়তো…..
কোচিং ক্লাস করে বাসায় চলে এলাম। সারাটাদিন কিভাবে যে কেটে গেলো, তা মনে হয় সময়রাও জানে না।
পরদিন তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম। সেই লোকটার বাসে উঠবো। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি অধরা অাসে নি। একটু লেট হবে। মনে মনে অধরাকে গাল দিলাম। কিন্তু গালাগালি করে তো অার লাভ নেই। যে যাওয়ার, সে তো চলেই গেছে। অবশেষে অধরা এলো। তারপর অারেকটা বাস দিয়ে রওনা হলাম। চুপচাপ সিটে বসে অাছি। পাশে প্রভা। অনেকক্ষণ ধরে বকবক করলো। যখন দেখলো, অামি কোন রেসপন্স করছি না তখন বললো
-তোর কি মন খারাপ?
আমি ছোট্ট করে একটা না বললাম।
কি বুঝলো কে জানে! সেও অার কথাবার্তা বেশী বললো না।
৩.
পরদিন সবাই ঠিক সময়েই অাসলাম। কিন্তু সেই বাসটাকে অার দেখতে পেলাম না। অবাকই হলাম। বাস কি একেকটা একেকদিনে যায়? অামি কিছু না বলে উঠলাম। অসম্ভব ভীড়। তবে কিছুক্ষনের মাঝে ড্রাইভারের পাশের সিটটা পেলাম। ড্রাইভার নির্বিকার ভঙ্গীতে পান খাচ্ছে ও গাড়ি চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিশ্রী শব্দ করে পানের পিক ফেলছে। ভীষন বিরক্ত হলেও যথাসম্ভব সোনামুখ করে বললাম
-আচ্ছা এই সময় তো এই বাসটা যায় না!
-হইসে গিয়া, কাইল ওই বাসটা “একচিডেন” করছে।
মনটা কেন যেন বিষাদতমষায় ছেয়ে গেলো। অামি অাবার জিগ্যেস করলাম
-কারও ক্ষয়ক্ষতি হইসে?
-সবাই কমবেশ দুঃখু পাইছে। তবে ডাইবার সাবের হাত ভাইঙ্গা গেছে। হে অহন মমসিং চরপারা হাসপাতালে আছে।
-কয় নম্বর ওয়ার্ডে?
-পুরাতন বিল্ডিংএর ২১ নং ওয়ার্ডের ১২ নং বেডে।
আমি তাকে শুষ্ক একটা ধন্যবাদ দিলাম। কোচিং করলাম মনমরা মন নিয়ে। চিন্তা করছি যাবো কি? সব ঝেরে ফেলে কয়েকটা গোলাপ নিয়ে রওনা দিলাম হাসপাতালের দিকে। ফ্রেন্ডদের বললাম,”তোরা অাধা ঘন্টা রেস্ট নে, আমি অাসছি।”
অটোর ভাড়া মিটাতে গিয়ে হাতের ফুলগুলো পড়ে গেলো। ফুললগুলো মাড়িয়ে গেলো একটা ছেলে। নষ্ট হয়ে গেছে এগুলো।চুপচাপ চললাম সেইই ওয়ার্ডের দিকে।
ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি যে ১২ নং বেডে একটা লোক ঘুমোচ্ছে। পাশে একটা বৃদ্ধ মহিলা তার সেবাযত্ন করছে। অামার খুব ইচ্ছে করছিলো তার পাশে বসতে। কিন্তু ইচ্ছেগুলো থেকে যায় ইচ্ছের অন্তরালে। চুপচাপ চলে এলাম।
৪.
দিনগুলো যেন হাওয়ার ভরে কেটে যাচ্ছে। চোখের পলকে কতগুলো দিন কেটে গেলো…। এখন ময়মনসিংহ থাকি। ড্রাইভারটার কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু বাস দিয়ে যাওয়া অাসা হয় খুব কম। যদিও যাই, তখন তাকে দেখতে পাই না। সত্যিই, ক্ষনিকের মোহের রেশটা কতদিন থাকে!
ভার্সিটির কোচিং প্রায় শেষ হতে চললো বলে। দেখতে দেখতে কোচিংটা শেষ হয়ে গেলো। রেডি হচ্ছি। বাসায় যাবো। বাস স্ট্যান্ডে গেলাম। দেখি যে সেই ড্রাইভারটা। তাড়াতাড়ি বাসে উঠলাম। বাসে লোক কম। তবুও অামি ড্রাইভাবের পাশের সিটে বসলাম। ড্রাইভার অামার দিকে তাকিয়ে হাসছে। অামার যে কি ভালো লাগছিলো!মনে হচ্ছে একরাশ জোনাকী অামায় ছেঁকে ধরেছে। মনে করেছিলাম যে পুরুষগুলোর চেহারা সুন্দর, তাদের হাসি সুন্দর হয় না। কিন্তু অামার ধারনা ভুল প্রমানিত করলো। বাস চলতে শুরু করলো। সেই অনুভূতি। তবে এবার মাসুদ, অধরা ও প্রভা নেই। বাস চলছে অাপনমনে। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে বাস থেমে গেলো। অামরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম। কিছু একটা হয়েছে! ড্রাইভার চেক করে বললো,”চাকা পাংচার। অামাদের কাছে অার কোন এক্সট্রা চাকা নেই। তবে একটা বাস অাসছে একঘন্টা পর। সেখানে এক্সট্রা চাকা অাছে। ঠিক করতে করতে দুঘন্টা লাগবে। “
সবাই নেমে গেলো গাড়িকে গালাগাল দিতে দিতে। অামি ও ড্রাইভারও নামলাম সবার শেষে। ড্রাইভার সামনের দিকে এগুচ্ছে। অামিও গুটিগুটি পায়ে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। কিছুক্ষন হাটতেই সামনে পড়লো, “বনবিথী স্টোর”। সেখানে ড্রাইভার এগুচ্ছে। অামিও গেলাম। দোকানটার থেকে চা নিলাম। দোকানের পিছনে বসার জায়গা অাছে। চা নিয়ে পিছনে চলে এলাম। দেখি যে ড্রাইভার বসে সিগারেট ফুকছে। অামাকে দেখে অাকর্ণ হেসে বললো
-বসেন বসেন।
আমি তার পাশে বসলাম। সামনে গভীর জঙ্গল অনেকটা জায়গা জুড়ে। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন ভাবছি। হঠাৎ ছেদ পড়লো তার কথায়
-আপনে অামার দিকে চাইয়া থাকেন ক্যে?
এরকম কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হব, তা অামি কল্পনাও করতে পারি নি। হাদার মতো বসে অাছি। অাবার দেখছি তার ভুবনভোলানো সেই হাসি। অামার মনটা কেমন যেন উশখুশ করতে লাগলো। সে অামার বামহাতের উপর তার হাতটা রাখলো। অাশেপাশে কেউ নেই। অামার কেমন যেন লাগছিলো। সে অামার হাতে অালতো করে চাপ দিলো।হয়তো সে ভাবলো ‘নীরবতা সম্মতির লক্ষন’। অামি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে অাছি। অামি কিছু বলছি না! কারন অামি হতভম্ব হয়ে গেছি এরকম অাচরনে। এরকমটা প্রত্যাশ্যাই করিনি। সে অামার হাত রেখে অারো বিভিন্ন জায়গায় হাত দিতে লাগলো। একসময় সে অামার প্যান্টের জিপারের উপর হাত রাখতে যাবে, অামি রাগে তার হাতটা ধরে ছুঁড়ে দেই। সে অবাক হয়ে অামার দিকে তাকিয়ে থাকে। অামি রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকি। বেশি রাগে অামার চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে যায়। বুঝতে পারছি, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কিন্তু সে পানি কিসের জন্য! রাগ নাকি কল্পিত ভালোবাসার অবমাননা?
কাঁঠালচাঁপা গাছটার নিচে দাড়িয়ে অাছি। একটা ফুল পড়লো। তুলে নিলাম। বাস ঠিক হয়ে গেছে। এবারও ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম। নিশ্চুপ চলতে লাগলো বাসটা। চলতে চলতে একসময় থেমে গেলো। গস্তব্যে পৌছুলাম। কাঁঠালচাঁপা ফুলটা রেখে বাস থেকে নেমে গেলাম। পিছনে ফিরলাম। দেখি, সেই ফুলটা নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অাছে ড্রাইভার। ব্যাথা ও করুণামিশ্রিত এক চাহনি।
চলে গেলাম রিক্সা দিয়ে। তারপর অার বাস দিয়ে ময়মনসিংহ যাওয়া হয়নি। জানি না, সেই ড্রাইভার কেমন অাছে? অামায় কি মনে অাছে? না কি মনে নেই!
সবই হয়তো পরিবর্তন হবে। কিন্তু অমলিন থেকে যাবে কাঁঠালচাঁপা আর
সেই ‘বনবিথী স্টোর’…
উৎস: অন্যভুবন
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১১, ২০১৬