স্মৃতিময় ভালবাসা

অন্য ভুবন

বাহিরে প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। কে থামাতে পারবে এই বৃষ্টি।

এটা যে প্রকৃতির নিয়ম।

টপটপ করে গাছের পাতায় পড়বে আর উদাসীনদের মন টেনে নেবে এটাই তো বৃষ্টির কাজ।

মনে মনে ভাবছে আর বৃষ্টিকে বকে যাচ্ছে রাজু। রাজুর মা নিষেধাজ্ঞা জারি।

যে বৃষ্টিতে কখনোই ভেজা যাবেনা।

কিন্তু এই দুরন্ত রাজু।

সে কি মানবে কারো নিয়ম।

মানবে কোন বিধান?

গ্রামের একটি দস্যি ছেলে রাজু। বাবা মার একমাত্র সন্তান। 

দেখতে অসম্ভব সুন্দর । কন্ঠে বিধাতার এক অপরিসীম দান রয়েছে। 

যা পৃথিবীর মানুষকে বোধহীন করে দিতে পারে।

লেখাপড়ায় খুব ভালো। তবে চাঞ্চল্যতা তার অসম্ভব প্রতিভাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

তার বাবা মার স্বপ্ন রাজু বড় হয়ে অনেক সম্মানী একজন ব্যক্তি হবে।

লোকমুখে যেন শুধু রাজুর নামই শোনা যায়।

কিন্তু রাজু তার স্বপ্ন পূরনে ব্যাস্ত। তার স্বপ্নগুলো হলো,

গাছে গাছে , পাড়ায় পাড়ায় যা কিছু আছে তা তার হাতের মুষ্ঠিতে রাখা। 

পাকা পেপে, গাছের কাচা আম,পাকা কলা ,খেজুরের রস ভরা কলস ছিদ্র করার মত কতযে কান্ড তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা আছে, তার অন্ত নেই।

কিন্তু দুষ্ট আর খারাপ এক নয়। রাজুর ভিতরে একটা মনুষত্ব বোধ আছে।

যা মানব লোকে বিরাট প্রভাব ফেলে।

কিন্তু তার এই দস্যিপনার জন্যে কতরকমের শালিশী বৈঠক যে বসে,তার হিসেব নেই।

আর এই কারনেই রাজুর মা শিরিন আর তার বাবা সুরুজ মিয়া কতযে তার পিঠ চাপড়েন তারও হিসেব নেই।

রাজুর বাবা সব পেশাতেই কাজ করেন। কখনো নদী থেকে মাছ ধরে সংসার চালান। 

আবার কখনো শাপলা লতা কুড়িয়ে আনেন। 

আবার কখনো কখনো জমিতে ফসলও ফলান। তাদের জমি জমার বলেই সংসারটা চলে যায়।

আজ রাজুর বাবার শরীরটা অসুস্থ। তাই রাজুকেই তাদের ভাত যোগার করতে হবে। 

তাই সকাল না হতেই রাজুর মা তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলছে।

শিরিন: এই রাজু, উঠ গুম থেইক্কা। দেহচ্চা তোর বাপের শইলে কেইমনে কাফনি দিয়া জ্বর আইতাছে। যা বাপ। আইজ তুই কয়ডা হালুক তুইল্লা আন। 

রাজু: যামু তো। আরেকটু ঘুমাইতে দেওনা মা। এরুম করতাছো ক্যান? 

খেতাটা দেও।

শিরিন: না। অহন যদি তুই না যাস তাইলে আমিই যামু কইতাছি।

আর এই সক্কাইল সক্কাইল পানিত নামলে আমার কি অইব তুই তো বালা কইরাই জানস।

রাজু: তুমি খুব খারাপ। আমারে একটু ঘুমাইতেও দিলানা।

বলেই কাঁথাটা গা থেকে সরিয়ে একটা গামছা কোমরে বেঁধে রাজু ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল । 

রাজু বিলের ধারে আসতেই দেখে তাদের প্রতিবেশি সুবোধ আর নুরু।

রাজু: আরে সুবোদ, কহন আইছত? এত্ত সহালে?

সুবোধ: এইতো ৫/১০ মিনিট অইব।

সুবোধও গ্রামের সাধারণ একজন ছেলে। বাবা নেই। মা বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে।

আর সুবোধ রাজুর সমানে কলেজে পড়ে।

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিটা এখন অনেকটাই কমে এসেছে।

রাজু পানিতে নেমে কিছু শালুক আর শাপলা লতা তুলে পানির উপরে এসে দাড়িয়ে রইল। 

সুবোধ আর নুরুরও তোলা শেষ প্রায়।

সবাই এখন বাজারের পথে রওয়ানা দিচ্ছে । রাজু,সুবোধ ও নুরুও তাদের পণ্য নিয়ে বাজারের পথে হাঁটা ধরল।বিক্রি করা হয়ে গেলে রাজু কিছু চাল আর ডাল আর বাকি টাকাটা দিয়ে রাজু তার বাবার জন্য কিছু ওষুধ কিনে নেয়।

বাড়ি ফেরার পর রাজু তার মাকে বলে 

রাজু: মা, ওমা। ভাত বসাইছ? আমার পেডে খোব খিদা লাগছে।তাড়াতাড়ি ভাত দেও।

শিরিন বেগম: রাজু বাপ তুই পইর থেইক্কা ডুবডা দিয়া আয়। আমি ভাত বাড়তাছি।

রাজু পুকুরে যায় গোসল সারতে। পুকুরটা মোটামুটি অনেকটা বড়ই।

দিঘি বললেও চলে।

গোসল করতে একসময় রাজুর চোখ আটকে যায় পুকুরের দক্ষিন পাড়ের দিকে।

ঐ পাড় দিয়ে সদর রোডের রাস্তাটা।রাজু দেখে একটা ছেলে পড়ে আছে পানির উপরে। পা গুলো পাড় ঘেঁষে পড়ে আছে।

রাজু তো ভয় পাবার মত অবস্থা ।চারদিকে সাহায্যের জন্য চোখ ঘুরাচ্ছে কিন্তু কেউ নেই।

রাজু পানি থেকে লাফিয়ে উঠে ছেলেটার কাছে যায়। গিয়ে দেখে পাড়ের উপর একটা ব্যাগ পড়ে আছে। রাজু ছেলেটাকে ধরে টেনে তুলতে যায়। ছেলেটার বয়স ১৯ কি ২০ হবে। ছেলেটার মুখে রক্ত । মনে হচ্ছে কেউ কিল ঘুসি মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। রাজু ছেলেটাকে টানতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে ।

রাজু তার মাকে ডাকার জন্য ছুটতে ছুটতে বাড়িতে যায়। রাজুর মা রান্না করছিল।

রাজু: মা, মা। 

শিরিন বেগম: কি হইছে?

রাজু: মা পইরের পাড় একটা পুলা পইরা রইছে। মনে হইতাছে কেউ মারছে।

মা যলদি আইয়ো।

শিরিন বেগম: চল চল।

রাজুর বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

সুরুজ মিয়া: কি হইছে?

রাজু: আব্বা পইরের পাড় যাইতাছি। তুমি যলদি আইয়ো।

রাজু আর তার বাবা মায়ের প্রচেষ্টায় ছেলেটাকে তারা বাড়িতে আনে। 

রাজুর মা ছেলেটার মাথায় গরম সেকঁ দিতে থাকে। একসময় ছেলেটা চোখ খুলে।

শিরিন বেগম: অহন কেমন লাগতাছে বাজান?

ছেলেটা বলল আমি এখানে কেন?

রাজুর বাবা বলল আফনেরে ঐ পইরের পাড় থেইক্কা আমরা তুইল্লা আনছি। 

আমরার রাজু আফনেরে দেহে আপনি পইড়া রইছেন। ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল আমার নাম আবির। মহসীন সাহেবকে চিনেন তো।ওনি আমার নানা।

সুরুজ মিয়া: মাতবর সাহেব আপনের নানা। কন কি? আফনেরে মারনের সাহস কার অইল?

আবির: জানিনা। আর আমার সাথেই বা ওদের শত্রুতা কিসের। আমার ক্যমেরাটাই ওদের লোভ

শিরিন বেগম:অহনের যুগে কেউ কেউরে মারতে দ্বিধা করেনা। টেহা পইসাই সব।

আবির: আপনাদের ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। আপনারা আমাকে ওখান থেকে না আনলে আমি হয়তো এতক্ষণে মরেই যেতাম।

আর আপনার ছেলেটাই তো আজ আমার প্রাণদাতা। ওর কাছে আমি সারাজীবন ঋণি থাকব। কিসে পড় তুমি?

রাজু: এইটে।

আবির ছেলেটার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়েই আছে। ছেলেটার চেহারায় কোথায় যেন একটা অসম্ভব সুন্দর বস্তু লুকিয়ে আছে। যা বার বার আবিরকে ছেলেটির দিকে আকর্ষিত করে তুলছে।

আবির: আংকেল আমাকে এখন বাড়িতে যেতে হবে। নানা নানু টেনশন করছে। 

বলেই আবির উঠে গেলো। 

আর ওদিকে আবিরের নানা তার লোকজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে কোন সকালেই। আবির বাড়ি ফিরতেই তার নানু তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয়। কোথায় ছিল সে সারারাত জিজ্ঞেস করতে থাকে। আবির সব খুলে বলার পর আবিরের নানা তেলেবেগুনে জলে উঠল। তিনি সভার আয়োজন করতে বলল। লোকগুলোকে তাদেরকে ধরতেই হবে।

কিন্তু আবির তাদেরকে এসব ঝামেলায় জড়াতে নিষেধ করে।আবির ঘুমোতে যাওয়ার আগে রাজুর কথাই ভেবে যাচ্ছে। গ্রামের একটা সাধারণ ছেলে। কিন্তু আবিদ তার মধ্যে একটা অসাধারণ কিছু খুজে পাচ্ছে। যা আবিরকে বার বার রাজুর দিকে টানছে।

সকালে আবির ঘুম থেকে উঠার পর রাজুদের বাড়িতে যায়। 

রাজুর মা আবিরকে দেখে রাজুকে ডাকতে শুরু করে।

রাজু: আরে। আবির ভাই আফনে। কহন আইলেন? 

শিরিন বেগম আবিরকে বসার জন্য একটা চেয়ার এনে দেয়। 

আবির: আন্টি আমি একটু রাজুকে নিয়ে যেতে এসেছি।

শিরিন: কই যাইবেন রাজুরে লইয়া?

আবির: এই এখানেই। পাশের গ্রামে নদীর কাছে যাবো।

রাজু: যাই মা?

শিরিন বেগম: যা বাবা।

আবির রাজুকে নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে রাজুর অনেক ছবি তুলে নেয়। আবিরের হৃদয়ে আরো বেশি জায়গা জুড়ে নেয় রাজু।

রাজুর এই চাঞ্চল্যতা, বেশি কথা বলা, রাজুর দুরন্তপনা গুলো আবিরের কাছে শুধু ভালোই লেগে যাচ্ছে ।কিন্তু এই ভালো লাগা গুলোর মানে কি, আবির বুঝতে পারছেনা।

এভাবে আবির প্রত্যেক দিন রাজুকে নিয়ে ঘুরতে বেরোত।

আবিরের রাজুর প্রতি ভালো লাগা দিন দিন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আবিরের ভালো লাগা কখনযে একটা অভিশপ্ত ভালোবাসায় জন্ম নিয়েছে আবির তা টেরই পায়নি।

যখন আবির শহরে যাবার প্রশ্ন উঠল তখনই রাজুর প্রতি আবিরের ভালবাসা প্রকাশ পেল। 

আবির মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল। রাজুকে আবিরের মনের কথাটা বলবে। তার হৃদয়ে রাজু কতটুকু রাজ্য জুড়ে আছে।

কিন্তু এই দুরন্ত রাজু, না বুঝে ভালবাসার মানে, না বুঝে প্রেম কি জিনিস। 

আবিরের ভালবাসা রাজু হেসেই উড়িয়ে দিল। কিন্তু আবির তার হৃদয়ের কথাটুকু না বললে আর কোনদিন নাও বলতে পারে। তার বিবেকের কাছে সে দায়ী থাকবে। তাই সে রাজুকে যতটুকু সম্ভব তার আবেদনটুকু রাজুর কাছে নিবেদিত করেছে।

আবির তার একবুক ভালবাসা আর কষ্ট নিয়েই শহরে ফিরে যায়।

৪ বছর পর

রাজু এখন অনেক বড়। শুদ্ধ করে কথা বলতে শিখেছে। আবিরের বলা ভালবাসা কি জিনিস সেটা বুঝতে শিখেছে। কতরজনী রাজু তার ভুলের জন্য চোখের পানি ফেলে বালিশ ভিজিয়েছে তার হিসেব রাখা কঠিন।

কিন্তু রাজুর কথা কি মনে পড়ে আবিরের?

সেই প্রশ্নটা রাজুর মনে থেকেই যায়।

রাজু এখন ঢাকার একটি কলেজে সেকেন্ড ইয়ারসে পড়ছে। এসএসসি তে ভালো ফলাফলই রাজুকে এতদূর আসতে সাহায্য করেছে। দেখিয়েছে নতুন পথের দিশা।

কিন্তু এই যান্ত্রিক কৃত্রিমত্তার শহরে হাজারো লোকের ভিড়ে রাজু একদিন চেনা দুটি চোখ খুজে পায়। যেই চোখ গুলো রাজুকে ভালবাসার কথার নিদর্শন হয়েছিল।

রাজু আবিরকে দেখতে পায় তার পাশের একটি ফ্লাটে বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে।

আবিরকে দেখার পর রাজুর মনে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।

যা ছাড়া রাজুর জীবন মূল্যহীন।রাজুর গালবেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

কিন্তু আবির কি রাজুকে এখনো সেই আগের মত ভালবাসে, নাকি অন্য কারোর হৃদয়ের মনিকা সে ?এই প্রশ্ন গুলোই রাজুকে আবিরের সামনে দাড় করিয়ে দেয়।

পরদিন রাতে রাজু আবিরের বাসায় গিয়ে উঠে। বাসায় ঢুকার পর রাজু দেখতে পেল বাসায় কেউ নেই। কিন্তু সবগুলো রুমের দরজা গুলো খুলা।

রাজু আস্তে আস্তে সবগুলো রুম ঘুরে ঘুরে আবিরকে ডাকতে থাকে। 

কিন্তু আবির কোথায়।কোন সারাশব্দ না পেয়ে রাজু ছাদে উঠে।

ছাদের একপাশে আবির দাড়িয়ে আছে। রাজুকে দেখার পর আবির রাজুর দিকে এগিয়ে আসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবির রাজুকে চিনতে পারে। 

আবির: রাজু! তুমি

রাজু: চিনতে পারছো আমাকে?

আবির কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে

তুমি? এখানে? আমার বাসার ঠিকানা তুমি কোথায় পেলে? আর এখানেই বা আসলে কি করে?

রাজু: তুমি একদিন বলেছিলে তুমি আমাকে ভালবাসো। কিন্তু আমি সেদিন ছিলাম একটা বোধশূন্য বালক।যার হৃদয়ে ভালবাসা নামক বস্তুটা ছিলনা।

কিন্তু তুমি সেই ভালবাসার বীজটা আমার বুকে বপন করে দিয়ে চলে আসো। আর একবারো পিছন ফিরে তাকাওনি। জানতেও চাওনি তোমার ভালবাসার মানুষটি কেমন আছে তোমাকে ছাড়া। আমি কি তোমার আগের সেই ভালবাসার মানুষটি রয়েছি। নাকি অন্যকোন একজন সেই জায়গা দখল করে আছে, তা জানার জন্যই আজ আমি তোমার সামনে।

আবির: আমি জানতাম রাজু। তুমি ঠিক একদিন আমার ভালবাসা বুঝবে। আর তুমি আমারই হবে। আমি তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষায় থাকবো। আজ সে অপেক্ষার সমাপ্তি হলো। আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি রাজু।আজ আমি আমার বাবা মার কাছ থেকে দূরে সরে রয়েছি শুধু তোমার জন্য ।বাবা আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি বাবার কথায় কোনভাবেই রাজি ছিলাম না। আমি বাবাকে বলেছিলাম আমার সব সত্যিটা।চেপে রাখিনি। আমার বাবা খুব অর্থ পিপাসু আর জেদী।

আর তাই বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আর আমি কিভাবে আমার ভালবাসার মানুষ নিয়ে সুখে থাকি সেটাও বাবা দেখে নিবে বলে দিয়েছে।

কিন্তু মায়ের মতো আপন কে হতে পারে? মা বাবাকে না ছাড়তে পারুক আমাকে ছাড়েনি। 

আমাকে মা এখানে এসে দেখে যায় ।আর রাজু তুমি বলছ এই আবির এখন কার? 

এই হৃদয়টা শুধু তোমার জন্য বরাদ্দ রাজু।আর কেউ আবিরের হৃদয়ে নেই।

আমার সবটুকু জুড়েই তুমি।

রাজু: আমিও তোমাকে পাগলের মত ভালবাসি আবির। কিন্তু সেটা বুঝতে আমার অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু যেই ভুলটা আমি একবার করেছি তা আর করতে চাইনা। আমাকে তোমার বাহুডোরে বেঁধে ফেল আবির।কখনো ছেড়োনা।

আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না আবির। কখনোই না।

রাজু আবিরকে জড়িয়ে ধরে। শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ ভারী হচ্ছে।

ভালবাসায় কাতর দুটি ঠোট জড়িয়ে যায় একে অপরের সাথে।

সপে দেয় রাজুর জমিয়ে রাখা সবটুকু ভালবাসা ।আবিরও উজাড় করে দেয় তার হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা ।রাজুর অস্তিত্বের প্রতিটা কোষ আবির তার ভালবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় ভিজিয়ে দেয়। একে দেয় ভালবাসার আল্পনা।দুটি হৃদয় দুটি দেহ এক হয়ে যায় এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে।

কলিং বেলের শব্দে রাজু দরজা খুলে দেয়।হাতে একটি টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে এক ভদ্র মহিলা ভিতরে ঢুকে।

আবির: মা। তুমি। এত সকাল সকাল।

রাজু: ইনি তোমার মা? স্লামুআলাইকুম আন্টি।

ওয়ালাইকুমুস্সালাম। তুমি নিশ্চয়ই রাজু।

রাজু: হ্যা আন্টি।

এদিকে এসো বাবা। তোমাকে একটু দুচোখ ভরে দেখি। 

তোমার ভালবাসা পাবার জন্যই আমার ছেলেটা আজ আমার থেকে বিচ্ছিন্ন। কি আছে তোমার মধ্যে জানিনা। আবিরের বাবা শহরের সবথেকে সুন্দরী প্রভাশালী লোকদের মেয়ে আবিরকে বিয়ে করতে বলে। কিন্তু আবির তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে তার পাশে দেখতে চায়না। 

সুখী হও তোমরা। আমার আশীর্বাদ সবসময় তোমাদের পাশে থাকবে।

রাজু আবিরের দিকে ছলছল চোখ নিয়ে তাকায়। আমাকে এত ভালবাসে একটা মানুষ তা আমার ধারণার বাহিরে।

আবির নে। তুই না পায়েস পছন্দ করিস। আমি তুর জন্য বানিয়ে এনেছি।

আবির: কই দেখি দেখি। মা তুমি আবার এসব কষ্ট করে বানাতে গেলে।

আমি তো তোর কাছে থাকিনা বাবা।তুই কি খাস না খাস? তাও জানি না।

এই এটুকুই তো করতে পারি। আমার ছেলেটাকে তুমি দেখে রেখ বাবা।

আমার ছেলেটা এখন তোমার দায়িত্বে।আবির তুই খেয়ে নিস। আমি এখন যাই।

আবিরের মা চলে গেল।

রিকশায় করে আবির রাজুকে নিয়ে একটি শপিং মলে ঢুকে কিছু শপিং করে বেরিয়ে আসে। আসার পথে আবিরের বাবা ইশমাম চৌধুরী আবিরের সাথে রাজুকে দেখতে পায়।

গাড়ির গ্লাস নামিয়ে কিছুক্ষণ দেখার পর ইশমাম চৌধুরী গাড়ি চালাতে বলেন ড্রাইভারকে।

পরদিন রাজুকে কলেজের সামনে নামিয়ে আবির ভার্সিটিতে চলে যায়।

রাজুর কলেজ থেকে আবিরর ভার্সিটিতে যেতে পাঁচমিনিট সময় লাগে। 

আবির: রাজু কলেজ ছুটি হওয়ার পর তুমি ঠিক এখানেই দাড়িয়ে থাকবে।

আমি তোমাকে নিয়ে যাব।

ঠিক আছে।

রাজু মাথা নেড়ে সায় দেয়।

কলেজ ছুটি হওয়ার পর রাজু অপেক্ষা করতে থাকে আবিরের জন্য।

পাঁচ মিনিটের স্থলে পনেরো মিনিট হয়ে গেল। কিন্তু আবিরের দেখা নেই।

রাজু আবিরের মোবাইলে ফোন দেয়।

আবির: হ্যালো রাজু, আমি একটি কাজে আটকে গেছি।

তুমি একটু কষ্ট করে বাসায় চলে যাও প্লীজ।

রাজু: ঠিক আছে। কখন ফিরবে তুমি? 

আবির: ঠিক বলতে পারছিনা।

তবে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে যাবো সোনা। বাই।

রাজু ফোন রাখার পর একটি রিকশা ডেকে উঠে পড়ে।

রিকশা তার গতিতে চলছে। হঠাত্ করে পিছন থেকে একটি ট্রাক এসে রাজুর রিকশাটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। রাজু ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তার একপাশে পড়ে যায়। লোকজন জড়ো হয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যে।

ফোন পাবার পর আবির হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে আসে।

ডাক্তারের কথা শুনার পর আবির তার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। 

রাজুর বাম পায়ে প্রচণ্ড আঘাতের কারণে পা টা অকেজো হয়ে গেছে। কোন কাজ করবেনা রাজুর দেহের এই অঙ্গ। আবির রাজুর কেবিনে যাওয়ার পর আবির রাজুর পাশে বসে। রাজু আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রাজু: আবির ডাক্তার কি বলল?

আবির: তেমন কিছুই না। বলেছে তোমার পায়ে আঘাত খেয়েছ। কিছুদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যাবে।

রাজু: কেন মিথ্যে বলছ আবির।আমি জানি।আমার এই পা দিয়ে আমি আর কিছুই করতে পারবনা।আমি যে পঙ্গু হয়ে গেলাম আবির।

বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাজু।

আবির রাজুকে বুকে জড়িয়ে রাখে।আর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে

হাসপাতাল থেকে রিলিজ করার পর আবির রাজুকে বাসায় নিয়ে আসে।

রাজু এখন আর আগের মতো হাটঁতে পারেনা। 

একটি হুইল চেয়ারে বসে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকেনা।

রাজুকে সুপ খাওয়াচ্ছিল আবির। তখন একটি ভদ্রলোক এসে বলে যায় আবিরকে তার বাবা নিচে ডেকেছে। তার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। 

আবির তার বাবার সাথে কথা বলার জন্য নিচে যায়।কথা বলা শেষ হলে ফিরে আসে। 

রাজু আবিরকে জিজ্ঞেস করে কেন ডেকেছিলো। 

আবির: মা। আর কে আসবে? মা-ই তো আমাকে দেখতে আসে। 

আবির তার ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ কয়েকদিনে রাজুর থেকে বেশি অসুস্থ মনে হচ্ছে আবীরকে। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে রাজুর সেবা শুশুশ্রায় ব্যস্ত রাখে নিজকে।

রাজু শুধু অঝোরে দুচোখের জল ঝরিয়ে যায় তার কিই বা করার আছে।

একজনের জীবনে এসে তার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলছে। অভিশপ্ত করে তুলছে রাজু আবিরের জীবনটাকে।

তাই রাজু সিদ্ধান্ত নিল গ্রামে ফিরে যাবে।

রাজু: আবির, তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।

আবির: আমারও ছিল রাজু।

রাজু: কি কথা। ঠিক আছে বলো।

আবির: রাজু, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি বাবা-মার কাছে ফিরে যাবো।

বাবা-মাই সন্তানের স্বর্গ। আর আমি স্বর্গ ছেড়ে নড়কে পড়ে আছি। আমার এসব আর মোটেও ভাল লাগছেনা। তুমি আমাকে মুক্তি দাও।

রাজু স্তব্ধ হয়ে আবিরের কথাগুলো শুনছিল। ভিতর থেকে একরাশ কষ্ট বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজু তো এটাই চেয়েছিল। তাই ভিতরটাকে পাথর করে রেখে আবিরের কথাগুলো হাসিমুখে গ্রহন করল। 

আবিরের এতদিনের ভালবাসা কি তাহলে নাটক ছিল? 

আবিরের চোখ তো মিথ্যে বলতনা। আবিরের শ্বাস-প্রশ্বাসে রাজু তার প্রতি আবিরের ভালবাসার প্রমাণ পেত। আবিরের চোখের জল, তার দেওয়া সবকথা। সবকিছুই কি মিথ্যে ছিল ?সব?

রাজু: ঠিক আছে আবির।আমিও চাই তুমি আমার বন্ধন থেকে মুক্ত হও।অবশ্য বন্ধন নয়। কারাগার বলতে পারি।

রাজু আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে খুজতে লাগল। এই সেই আবির। 

কিন্তু আবির রাজুর চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে পারলনা কেন? 

আর আবিরের চোখের কোনে জল দেখা যাচ্ছে যে।

আবির রাজুকে তার মা-বাবার হাতে সোপর্দ করে দিয়ে ফিরে যায়।

রাজুর মা-বাবা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাদের একমাত্র ছেলে।

তার জীবন এরকম অন্ধকারে ছেয়ে যাবে তারা কখনোই ভাবেনি। তাদের আশার আলো ছিল একমাত্র রাজুই। আজ সেই প্রদীপটুকু নিভে যাচ্ছে।

আজ অনেকদিন হয়ে গেল। রাজু নিজেকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়েছে।

কিন্তু আবির কি গুছিয়ে নিয়েছে। নিবেই বা না কেন? হয়তো কোন ধনীর দুলালীকে বিয়ে করে সুখেই আছে। 

হঠাত মনে পড়ে আবিরের বাবার কথা। আবিরের বাবা রাজুর আর আবিরের ভালবাসার একটা বাধাঁ ছিল। তিনি কখনো চাইতনা আমাকে নিয়ে আবির সুখে থাকুক। 

হয়তো বা ওনার নির্দেশেই ট্রাকটা তাকে ধাক্কা মেরেছিল। যার ফলে আজ রাজু পঙ্গু।

কে জানে, হয়তো বা রাজু তার বাবার হুমকিতেই আমাকে তার জীবন থেকে তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

থাকুক না। কিছু কথা অজানা। তবে আবির কতটা সুখে আছে রাজুকে ছাড়া তা দেখতে রাজুর বড় সাধ জাগে।

একটি গানই তখন রাজুর হৃদয়ে বেজে উঠে 

“বড় সাধ জাগে,

একবার তোমায়দেখি।”

আবির সুখে থাকুক এটাই তো রাজু চাইতো। হাসিমাখা ঐ মুখটা আবিরের সারাজীবন অম্লান থাকুক। আজীবন এটাই চাইবে। হোক না, তা রাজুকে ছাড়া। 

তবে কিছু প্রশ্ন এখনো রাজুকে নাড়া দেয়।

জানালা দিয়ে এখনো রাজু সদর রাস্তার দিয়ে তাকিয়ে থাকে। হারিয়ে যায় তার কৈশর জীবনে।

শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে রাজুর। কতইনা সুন্দর ছিল। কতইনা মধুর ছিল রাজুর অতীত।

হেসেখেলে কাটিয়ে দিত বেদনাহীন জীবন। সারাগ্রাম ঘুরে বেড়াতো। কেউ ছিলনা ভালবাসার পরম সুখ বা বিষাদময় কষ্ট দেওয়ার জন্য। তখনই তো রাজু সুখে ছিল। 

আবির তার জীবনে একটা স্মৃতিময় ভালবাসা হয়ে এসেছিল। যা রাজুকে বাঁচতে শেখাবে।

তবে আজীবন এই প্রশ্নগুলো রয়েই যাবে।

কেন এলে আবির?

কেন এলে একমুঠো ভালবাসা নিয়ে?…

উৎস: অন্যভুবন

প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১০, ২০১৬

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.