
অন্য ভুবন
১.
সকাল সকাল রোহানের মন খারাপ হয়ে গেলো। তন্ময়ের বিয়ের কার্ড নিয়ে ওর বড়ভাই বাবুভাই এসে হাজির। রোহান জানত একদিন না একদিন এই দিন আসবেই। সে তন্ময়ের বিয়ের ব্যাপারে জানত। সে মনে মনে প্রস্তুতও হচ্ছিল এই দিনটার। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার থাকে হাজার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েও খুব বেশি লাভ হয়না। অল্প অল্প করে জমা করা সব মানসিক শক্তি একসাথে হুড়মুড়িয়ে ভেংগে পড়ে। এটাও ঠিক তেমনি একটা ব্যাপার। যদি তাই না হবে তবে কেনো বাবু ভাইকে দেখেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠবে! কেনই বা কোনরকমে তার হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে মুখ ঘুড়িয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে হবে! এদিকে বাবু ভাই এসেই চেঁচামিচি শুরু করে দিয়েছে,তুমি ওর সবথেকে কাছের বন্ধু। কিসের সব কাজ নিজে দেখাশোনা করবে তা না,হাত গুটিয়ে বসে বাসায় পড়ে আছ। কি যে কর না তোমরা!আশ্চর্য!! কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমাকে যেন কাজ করা অবস্থায় দেখি বলতে বলতে জবাবের অপেক্ষা না করেই চলে গেলেন। বাবু ভাই যখন তন্ময়কে তার কাছের বন্ধু বললেন তখন রোহান কিছুটা আনমনা হয়ে গেল। হ্যা কাছেরই তো! কিন্তু কতটা কাছের, হৃদয়ের কতটা গভীরে পৌছে গেছে তাদের সম্পর্ক সেতো আর কেউ
জানেনা…ভাবতে ভাবতে ফেলে আসা দিন গুলোয় ফিরে গেল রোহান।
২.
তন্ময়ের সাথে রোহানের বন্ধুত্বের শুরু সেই স্কুলজীবন থেকে। তখন থেকেই খুব ভাল বন্ধু ছিল দুজন।এরপর গ্রামে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে একসাথে ঢাকায় কোচিং করতে আসা। ঢাকা ভার্সিটিতে দুজনই বিবিএ তে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। তেমন কোনো আত্নীয় না থাকায় দুজনি হলে থেকে যায়, একি রুমে। আরো ভালোভাবে বললে প্রায়ই একি বিছানায় থাকতো দুজন। এভাবে কতশত রাত যে তারা একসাথে ঘুমিয়েছে তার হিসাব নেই। এত কাছাকাছি থাকা সত্বেও কেউ কারো সমকামি সত্ত্বার কথা কখনো পরস্পরকে
জানতে দেয়নি। ঘুমানোর আগে কিংবা মাঝে তারা কখনো কখনো একে অপরকে জড়িয়ে ধরতো তবে সেটা ছিল আর দশটা বিসমকামির মতই স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ একদিন, রোহানের স্পষ্ট মনে আছে দিনটার কথা। তখন শ্রাবণ মাস চলছিল, বাইরে সেদিন অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছিল। তাদের রুমমেট ভাইয়ের বাসায় গিয়ে আটকে গেছে, ফিরবেনা জানিয়েছিল। তন্ময় রোহানের বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। একসময় দুজন ঘুমিয়েও পড়ল। হঠাৎ মাঝরাতের দিকে রোহানের ঘুম পুরোপুরি না ভাংলেও ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে গেল। তন্ময় তাকে জড়িয়ে ধরে আছে কিন্তু সেটা অন্যান্য দিনের মত নয়। অন্যান্য দিন শুধু জড়িয়েই থাকে কিন্ত
আজ কাছেও টানছে। রোহান বুঝতে পারল তন্ময় আজ বেশি কিছু চায় তার কাছে। তন্ময় নামের একুশ বছর যুবকের আজ শরীর জেগে উঠেছে, আজ সে স্বর্গসুধা পান করতে চায়। রোহান দ্রুত ভাবতে লাগল তন্ময়কে তার ভাললাগে,ভালোও বাসে যদিও কখনো প্রকাশ করেনি। আর কিছু না ভেবে সে তন্ময়ের ডাকে সাড়া দিল। বাকি রাতটা তারা পাড় করল শরীরের আদিমতম খেলায় মাতামাতি করে। দুজন সদ্য তারুণ্য পার করা যুবক জীবনের প্রথম শারিরিক সুখ দেয়ার নেয়ার খেলা শেষে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত
অবস্থায় ভোরবেলা ঘুমে তলিয়ে গেল।
৩.
সেই শুরু।তারপর থেকে চলতে থাকে তাদের নতুন জীবন। কখনো পড়ন্ত বিকেলে টিএসসির আড্ডায়, আবার কখনো কোন ঘোর লাগা সন্ধ্যায় হাতে হাত রেখে সোহরাওয়ার্দীতে হেটে চলা। মাঝখানে বিশ্রামের জন্য কোন বেঞ্চের এককোনে কাধে মাথা রেখে বসে থাকা। কোন কোন রাতে নীলখেতের তেহেরি খেয়ে আর রুমে না ফিরে সারারাত শহরজুড়ে ঘুরে বেড়াত দুজন। যেন পুরো শহরকে দেখিয়ে দেয়া আমি আর একা নেই, তুমি আর আমার একাকীত্ব নিয়ে উপহাস করতে পারবেনা। একবার তন্ময়ের মাথায় কী ঢুকল কে জানে! সারারাত বৃষ্টিতে হাটবে। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে রোহানের খুব জ্বর হয়েছিল সেবার। পরে তন্ময়ই তাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিল। ওরা দুজন এত আপন হয়ে গিয়েছিল যে দুজন দুজনকে নিজেদের সম্পত্তি ভাবত। কেউ কখনো ভাবেনি যে চরম বাস্তবতার কাছে এমন হাজারো সম্পত্তির কোন মূল্যই নেই..
৪.
পড়াশুনার পাট চুকিয়ে দুজনই একসময় চাকরি জীবনে প্রবেশ করে। ভালই চলতে থাকে।হঠাৎ একদিন তন্ময় রোহানকে জানায় বাসা থেকে তার বিয়ের জন্য মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। রোহানের ভেতরে ভেতরে ঝড় উঠলেও সে সেটা তন্ময়কে বুঝতে দেয়নি।বলেছিল ভালই তো, বিয়ে তো সবাইকেই করতে হবে। আমার একটা কাজ আছে বলে রোহান সেদিন তন্ময়ের কাছ থেকে চলে আসে।তারপর থেকে রোহান তন্ময়কে এড়িয়ে চলা শুরু করে। সে চায়নি তার জন্য তন্ময়ের কোন সমস্যা হোক। তন্ময় কখনো তাকে কথা দেয়নি যে সারাজীবন তার সাথেই থাকবে। আবার রোহানও কখনো তন্ময়কে বলেনি যে তার সাথেই বাকি জীবন থাকতে হবে।তবু ভীষণ কষ্ট হতে থাকে তন্ময়ের। বুকের ভেতরটা কেমন ফাকা লাগে যেন সব থাকার পড়েও কিছু নেই। একবার কী নিয়ে জানি ওদের ঝগড়া হয়েছিল। মাঝখানে তন্ময় ওদের এক স্ট্রেইট ফ্রেন্ডের সাথে দুইদিন ঘুরেছিল। ওই সময়টাতেও ঠিক একিরকম অনুভূতি হয়েছিল তার। কি আশ্চর্য রকম মিল অনুভূতিটায় কিন্তু বড্ড অমিল ফলাফলটায়।সেবার সে জিতেছিল,ভালবাসা দিয়ে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। এবারো ভালবাসার কমতি নেই তার, কিন্তু ভালবাসা দিয়ে সবসময় সবকিছু হয়না। কখনো কখনো ভালবাসাকে হার মানতে হয়পরিবার, সমাজ আর বাস্তবতার কাছে।
৫.
আজ সেই অভিশাপ্ত রাত, আজকের রাতেই তন্ময় অন্যের হয়ে যাবে। কাকতালীয়ভাবে এখন শ্রাবণ মাস চলছে।বাইরে বৃষ্টি ও পড়ছে
টিপটিপ করে। রোহান উদভ্রান্তের মত বৃষ্টির মধ্যে হাটতে থাকে। আজ সে একমুহুর্তের জন্যও কোথাও থামবেনা,হাটতেই থাকবে, হাটতেই থাকবে…যেন থমকে দাড়ালেই তন্ময়ের সব স্মৃতি তাকে আঁকড়ে ধরবে। নিয়নের হলদেটে আলোয় মধ্যরাতে একজন যুবক হেটে যাচ্ছে। মধ্যরাতে জায়গাটা মোটেও নিরাপদ নয়। কিন্তু রোহানের কাছে আছেই বা কি! সবথেকে মূল্যবান যা আছে তা হল প্রাণটা। সেটা কেড়ে নিলেই যেন সে বাঁচে।সব কষ্ট, অপূর্ণতা নিমিষেই শেষ হয়ে যেত। হঠাৎ তার খুব কাছ দিয়ে একটা গাড়ি তাকে অতিক্রম করে কিছুদুরে গিয়ে থমকে দাড়ালো। যেন তারই পরিচিত কেউ তাকে চিনতে পেড়ে গাড়ি
থামিয়েছে। একবার রোহানের মনে হল তন্ময় নাকি!! ধুর কি আজেবাজে বকছি আমি, উনি তো এখন মধুরাত কাটাচ্ছেন নিজেই মনে মনে বলল রোহান। ছিনতাইকারী নয়ত আবার!!হলে তো ভালই হয় ভাবতে ভাবতে অপ্রকিতস্থর মত হেসে ফেলল সে। আমাদের সামনে কী আছে তা আমরা কখনই জানিনা। তবু আমাদের প্রতিনিয়তই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়, অনাগত নিয়তির দিকে।
রোহান ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তার অনাগত নিয়তির দিকে…
উৎস: অন্যভুবন
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ০৯, ২০১৬