
মেঘ রাজ সাইমুন
১|
সকালে পূণমের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো|
রাঙামাটির ‘নীল মুন’ বাংলোর একটি ঘরে বৃষ্টি স্নান ভোরের সূর্যের পূর্ণ আলো আমার মুখ এসে পড়লো|পূণম জানালার পর্দা সরিয়ে দেওয়ায় পুরো ঘর রবির কিরণে ভরে গেল|আমি চাঁদের কথা জিজ্ঞাসা করতেই পূণম জানালো,চাঁদ ওর মণি আব্বুর ছবির দিকে তাকিয়ে বসে আছে|মুহূর্তের মধ্যে আমার দুচোখ জলে ভরে গেলো|কি করে ভুলে গেলাম যে আজ মুনের ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী|মানুষ বড়ই স্বার্থপর প্রানী|সময় মানুষকে অনেকটাই বদলে দেয়|তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেলাম|পূণমকে বললাম,চাঁদকে রেডি করিয়ে তুমিও রেডি হয়ে নাও|পূণম কোনো প্রশ্ন করলো না,অবাকও হলো না|কারন ও জানে আজকের দিনে আমার গন্তব্য কোথায়!এই নারীটিকে আমার জীবনের একটা আদর্শ বলা চলে|কোনদিন না চেয়েছে স্ত্রীর মর্যাদা,না চেয়েছে এতোটুকু ভালোবাসা|আমি নিজে থেকে আপন ভেবে যা দিয়েছি তাই আপন খেয়ালে যতনে নিয়েছে হাসি মুখে|ওকে দেখে মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়|এ কি মানুষ!নাকি অন্য কিছু|
চাঁদ আর পূণমকে নিয়ে গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম সেই ঠিকানায়,যে স্বপ্নের ঠিকানায় আমার প্রিয় মানুষটি চির নিদ্রায় পরম শান্তিতে|গাড়ি চলছে আর আমার মনের আঙ্গিনায় উকি দিচ্ছে চার বছর আগের হৃদয়ের ঘরে বসবাস করা মরিচা পড়া স্বপ্নগুলো|
আমি ফারহান আহমেদ নীল|নোয়াখালির ছেলে|অনাবিল ভালোবাসায় ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠা|যৌবন জীবনে কঠিন বাস্তবের মুখে পড়ি নিজের আপন সত্ত্বার বেসামাল খেয়ালে|স্বপ্নের নীল ঘুড়ি ছুঁতে,শুভ্র মেঘের আড়ালে শরতের সুর খুঁজতে,উড়ন্ত বকপক্ষীর মুক্ত চলার সুখ দেখতে পড়ালেখা অর্ধসমাপ্ত রেখে পরিবারের দায় ভার কাধে নিয়ে উড়াল দেয় সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকাতে|
প্রথম প্রথম জীবনকে বিষাদময় মনে হতে অচেনা সব মানুষগুলোর মাঝে|সুখের সুরগুলো বেসুরে বাজতে লাগলো|ছোটবেলা মা,বড় ভাইয়ার ভালোবাসার শাসনে থেকেও জীবনকে সম্পূর্ণ মনে হতে|কিন্তু প্রবাসী জীবনে সেই অগোছালো ভুলগুলো কেউ গুছিয়ে সুধরানোর চেষ্টা করতো না|আপনজন চিরকাল আপনই হয়|কারোর দুঃখে যদি কেউ কাঁদে সেটা আপনজনই কাঁদে|
এভাবে জীবন ব্যস্ততায় আমি হাঁপিয়ে উঠছিলাম|সকাল থেকে সন্ধ্যা প্রবাস জীবনে শুধু কাজ আর কাজ|জীবনকে রাঙানোর সময় এখানে খুব কম|রাতের বিছানায় চাতকপাখির মতো এফবিতে দুঃখের আলাপন,একটু কাউকে খুঁজে ফেরা|আবার ভোর লগ্নে সেই ব্যস্তকর্ম জীবন|ভালোবাসাবিহীন ছিন্ন আমি দিন দিন নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম গভীর বিষাদে|স্বপ্নগুলো চৈত্রের শুকনো পাতার মত ঝরে পড়তে লাগলো|
বছরের ক্রান্তিলগ্নে অক্টোবরের শেষের দিকে এফবিতে খুলনার একটা ছেলের সাথে পরিচয় ঘটে|প্রথম প্রথম দুষ্টু মিষ্টি আলাপনগুলো প্রযুক্তির এই বিশাল আবিষ্কার এফবির মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো|তারপর ফোনালাপ|এভাবে আমার চৈত্রের শুকনো পাতার স্বপ্নগুলো আবার কচি হতে লাগনো বর্ষার সুখ বৃষ্টির আগমনে|ব্যস্তমুখী জীবনের মাঝে আমি এক টুকরো সুখ কুড়িয়ে পেলাম মুনের মনের গহীনে|দিনকে দিন দুজন দুজনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়া,অতঃপর ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা|আশ্চর্যের বিষয় আমরা কোনদিন কাউকে ‘ভালোবাসি’ একথাটি বলিনি|এভাবেই আমার প্রবাস জীবনে শ্রাবণ মেঘের আড়ালে সোনালী স্বপ্নের আলো ছড়িয়ে গেলো মুন|
পরের বছরের শুরুতে আমি দেশে ফিরে আসি মুনকে নিয়ে সুখের ঘর বাধতে|আমি চেয়েছিলাম মুনকে নিয়ে প্রবাসে কোথাও স্বপ্নের নীড় গড়তে|কিন্তু ও এদেশ ছেড়ে যেতে রাজি ছিলো না|আমিও জোর করি নি,জানি এদেশে এগুলা সম্ভব নয়|তবুও চেষ্টা করেছিলাম ওকে নিয়ে দেশের অচেনা কোথাও ঘর বাঁধতে|বেঁধেও ছিলাম|দুজন দুপরিবারকে কৌশলে রাজি করিয়ে একসাথে এসেছিলাম এই রাঙামাটিতে|বাংলার এই জায়গাটাই আমার মুনের খুব প্রিয় ছিলো|আমার যে ছিলো না এমনটাও নয়|
রাঙামাটিতে সুখেই যাচ্ছিলো আমাদের দিনগুলো|
দুজন দুজনকে এতোটাই ভালোবাসতাম যে এক মুহূর্তে কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারতাম না|কিন্তু মুনের একটা জেদের কারনে আজ আমার জীবন শূণ্য মরুভূমিতে পরিনত হলো|কি হতো যদি মুন এমনটা না করতো!আমরা কি পারতাম না সারাজীবন একে অপরকে ভালোবেসে দুজন দুজনার হৃদয় আকাশে স্বপ্নপাখি হয়ে উড়তে?
আমি মুনকে স্বপ্নপাখি বলে ডাকতাম|কারন ওই ছিলো আমার জীবন আকাশে একমাত্র উড়ন্ত পাখি,যে আমার হৃদয়ের সুনীল আকাশে সর্বত্র বিচরণ করতো|মুনই আমার মনের আঙ্গিনার শেষ জমিনের বৃক্ষে নীড় বেঁধেছিলো|জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছিলো সাতরং এর রংধনুতে|
হঠাৎ চাঁদের ডাকে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো|
~রাজ আব্বু|আমি ওটা খাবো|
পথে দাড়িয়ে একটা আট নয় বছরের ছেলে হাওয়ায় মিঠাই বেচতে ছিলো|
~চাঁদ এমন করে না বাবু|ওটা খেলে পেটে অসুখ করে|
~আচ্ছা পূণম|থাক না!ছোট মানুষ|আমি এনে দিচ্ছি তো|
পূণম চুপ করে গেলো|আমি চলতি গাড়ি থামিয়ে নেমে গেলাম হাওয়ায় মিঠাই আনতে|
মুনের হাওয়ায় মিঠাই খুব প্রিয় ছিলো|চাঁদ হয়তো ওরই স্বভাব পেয়েছে|আমি মুনকে কখনো হাওয়ায় মিঠাই কিনে দিতে চেয়েতাম না|কারন ও হাওয়ায় মিঠাই খেয়ে জিহ্বা ঠোঁট রাঙালে আমি নিজেকে সামলাতে পারতাম না|শুধু ওকে কিস করতে ইচ্ছা করতো|কিন্তু ও এতোটাই দুষ্টু ছিলো ঐ সময়ে
ওর ধারে কাছে আমাকে ঘেষতেই দিতো না|আমি শুধু চাতকপাখির মতো ওর পাণে তাকিয়ে থাকতাম আর ওর দুষ্টু মিষ্টি বাঁকা হাসি দেখতাম|ফাজিলটা হাওয়ায় মিঠাই খেতো আর আমার বোকা তাকানোর দিকে চেয়ে চোখ টিপতো|
আমার হঠাৎ হাসি পেয়ে গেলো|তবুও তেমন হাসি হাসতে পারলাম না,যেমনটা হাসতাম আমার মুনকে জীবন্ত দুষ্টুমি দেখে|
~সাহেব এই নিন|
ছেলেটার হাত থেকে হাওয়ায় মিঠাই নিয়ে ওকে টাকা পরিশোধ করে গাড়িতে আসলাম|চাঁদকে হাওয়ায় মিঠাই দিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করতাম|
গাড়ির আয়নায় দেখলাম ঠিক মুনের মতো করে হাওয়ায় মিঠাই খাচ্ছে চাঁদ|বুকটা কেঁপে উঠলো আমার|
প্রথম রাঙামাটিতে এসে যেদিন আমার হাতে বাঁদল দিনের প্রথম কদম পেয়েছিলো মুন|সেদিন শ্রাবণ সন্ধ্যায় প্রবল বর্ষণে ভিজে ছিলো ও|আমাকেও ভিজতে হয়েছিলো বাধ্য হয়ে|যদিও বর্ষা বাঁদল আমার প্রিয় নয়|তবুও মনের মানুষের খুশিতে সুখের ঢেউ হতে বর্ষায় ভিজা আমার সেই প্রথম|রাতে খুব জ্বর ওঠেছিলো মুনের শরীর|আমি প্রায় পাগল হয়ে গেছিলাম ওর অবস্থা দেখে|শেষে অনেক চেষ্টায় উষসী ভোরবেলা ও চোখ খুলে প্রথম আমাকে দেখেছিলো|
হঠাৎ পূণমের ধাক্কায় বাস্তবে এলাম|বুঝলাম কবরস্থানে পৌছে গেছি|কবরস্থানের চৌকাঠে পা রাখতেই দুচোখ নোনা জলে ঝাপসা হয়ে এলো|
২|
সকালে মিষ্টি ঠোঁটের দুষ্টুমিতে আমার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলো|দেখলাম সাইমুন আমার দিকে তাকিয়ে আছে|আমি বললাম,
~কি ব্যাপার এতো ভোরে ঘুষ দিচ্ছো কেন স্বপ্নপাখি?
~একদম ভালো হচ্ছে না কিন্তু নীল!আ…মি..ই তো কিস দিতেই পারি আমার নীলপাখিকে!এটাতে আবার ঘুষের কি দেখলে?
আমি মুনকে আমার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম|দুজনের নিঃশ্বাস একে অপরের মুখে পড়তে লাগলো|
~ওয়াক ধুঃ|কি গন্ধ!তুমি ছাড়োতো আমায়|আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে|ওঠে ফ্রেশ হও তো|অফিস আছে তো তোমার|
~কি আমার মুখে গন্ধ|দাড়াও দেখাচ্ছি মজা|
বলে আমি মুনের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলাম|এভাবে কিছুক্ষণ হারিয়ে গেলাম দুজনে|মুন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
~এই শোনো না নীল!প্লিজ|
~বলো শুনছি তো|
~বলছি ‘ছায়ামণি স্কুল’ এ চাকরিটা করি আমি|তুমি অনুমতিটা দাও|আজ শানু ভাইয়া ফোন দিছিলো আবার|
~কি শানু আবার তোমায় ফোন দিছিলো|ঐ বেটার ঠ্যাংটায় এবার আমি ভেঙ্গে দেবো|আমি তোমাকে বলেছি না যে তোমার চাকরি করার দরকার নেই|আমি যা করি তাতেই আমার চলে যায় স্বপ্নপাখি|তুমি কেন অযথা পরিশ্রম করবে?আমি তা চাইছি না মুন|আর শানু লোকটা ভালো না|
~কি যে বলো না নীল তুমি?শানু ভাইয়া খুব ভালো|সারাদিন তুমি অফিসে থাকো|আমার একা একা বাসায় ভালো লাগে না|
~তবুও মুন|তাছাড়া আজকাল প্রায় তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো|তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারো?
~মিঃ নীল|আমার কিচ্ছু হবে না|প্লিজ প্লিজ নীলপাখি|
~ওকে বাবা ঠিক আছে|তবে একটা শর্ত আছে|
~কি!বলে ফেলো|
~তুমি শানুর সাথে বেশি মেলামেশা করতে পারবে না|
~আমার প্রতি তোমার এতোটুকু বিশ্বাস বা ভরসা নেই?
কথাটা বলেই দেখলাম মুনের চোখ থেকে লেবুর রসের মতো জল পড়ছে|
~এই পাগল|কাঁদছো কেন?বিশ্বাস না থাকলে কি আমি তোমায় এতোটা ভালোবাসতে পারতাম|কিন্তু তোমাকে হারানোর যে আমার বড্ড ভয়!আমি চাই না বৈশাখহীন কোন কালবৈশাখী ঝড় আমার থেকে তোমাকে কেড়ে নিক|
মুন আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো|এই সুখের সময় অবাধ্য চোখ থেকে দুফোঁটা আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে আমার মুনের মাথার ঘনকালো কেশে গিয়ে পড়লো|
~ওহ নীল|খুব দেরি হয়ে গেলো|তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও|আমি ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি,তোমার অফিসে লেট হয়ে যাবে|আর শোনো যাওয়ার পথে আমাকে ছায়ামণিতে ড্রপ করে যেও|
বলেই মুন দ্রুত বেরিয়ে গেলো|আমি কিছুক্ষণ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমে চলে গেলাম|
আজ অফিস ছুটির দিন|সারাদিন মুনকে নিয়ে রাঙামাটি ঘুরে দেখার প্ল্যান করলাম|দুজন দুজনকে নিয়ে হারানোর নেশায় মাতুর হয়ে সকাল সকাল বেরোলাম কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে|আজ ছয় মাস এখানে আছি,অথচ ভালো করে ৬,৪৮১ বর্গ কি.মি.র রাঙামাটির কোথাও তেমন ঘুরে দেখা হয়নি|
কাপ্তাই হ্রদ থেকেই রাঙামাটির দর্শনীয় স্থানগুলো শুরু|মুনের কাপ্তাই হ্রদটা খুব বেশি প্রিয় ছিলো|
বাইরে থেকে দেখলে রাঙামাটি শহরটিকে ১৭২২ বর্গ কি.মি. কাপ্তাই হ্রদের বুকে জেগে ওঠা ছোট একটি গিরিশহর মনে হবে|এর পূর্বে ভারত মিজোরাম রাজ্য,উত্তরে খাগড়াছড়ি,দক্ষিণে বান্দরবান অবস্থিত|কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের কারনে সৃষ্টি হয়েছে এই সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদ|
আমার সব থেকে ভালো লাগতো রাঙামাটির ৩৩৫ ফুটের ঝুলন্ত সেতু|কিন্তু মুন বোকাদের মতো ভয় পেতো|ও বলতো যদি সেতুটা ছিড়ে পড়ে|ওর কথা শুনে আমি পাগলের মতো হাসতাম|আজও হাসি পাই আমার|
কাপ্তাই হ্রদের থেকে বোটে করে আমরা রাজবাড়ীতে গেলাম|রাজবাড়ীর সৌন্দর্য্যে মুন পাগল প্রায়|আমাকে বলল,
~নীল জানো?আমার খুব ইচ্ছা এই রাজবাড়ীর মতো একটা বাংলো করার|যার নাম দিবো ‘নীলমুন’ বাংলো|বাংলোর চারপাশে আমার প্রিয় লাল গোলাপ আরো অনেক ফুল শোভা পাবে|তুমি অফিস থেকে আসলে আমি আর তুমি ফুলের মাঝে বসে কফি খাবো,আর হৃদয়ের স্বপ্ন বুনবো|
~ওকে বাবা!আমার মুনের জন্য আমি সব করবো|বড় বাংলো করবো যার নাম দিবো ‘নীলমুন’ বাংলো|কি খুশি তো?
মুন দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিলো|বলল,
~লাভ ইউ স্বপ্নপাখি|
আমি মুনের একটা হাত এনে আমার হাতে মাঝে রাখলাম|
রাজবাড়ি থেকে মুনের জন্য সুবলং ঝর্ণায় যেতে হলো|এটি রাঙামাটি সদর থেকে ২৫ কি.মি. দূরে|পাহাড়ের বুনোলতার গা বেয়ে সুবলং ঝর্ণার জল লালমাটিকে স্নান করিয়ে দেয়|দেখলে মনে হয় সুনীল আকাশের স্বপ্নের চলন্ত প্রতিচ্ছবি সুবলং ঝর্ণার প্রতিটি জলকণা ধারন করছে|মুন একটি পাথরের উপরে বসে সুবলং এর জল নিয়ে খেলা করছে|এসময় অবশ্যই ঝর্ণায় জল তেমন থাকে না|কিন্তু বর্ষার শুরুতে বান ডেকে ঢল নামে পাহাড়ের বুক চিরে|মুন ঈশারায় আমায় কাছে ডাকলো|আমি যেতেই জলের ছিটা আমার দিকে ছুড়ে মারলো|
~কি করো মুন|ভিজে যাচ্ছি তো স্বপ্ন|ভিজা শরীর নিয়ে আর কোথাও কিন্তু যেতে পারবো না|বলে দিলাম|
~তুমি যাবে,তোমার ঘাড়ও যাবে তোতাপাখি!
~কি আমার সাথে মাস্তানী হচ্ছে|দাড়াও দেখাচ্ছি মজা|
বলেই ওর দিকে দিলাম ছুট|ও দৌড় শুরু করে দিলো|আমি পিছে ছুটলাম|
~মুন|এই মুন হচ্ছে টা কি?দাড়াও বলছি|তবে…রে…
মুন হাঁপাতে হাঁপাতে দাড়িয়ে গেলো|আমি ওর কাছে ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম|
~কি পারলে না তো|
~নীল আমার না খুব ক্ষুধা লেগেছে|
~এই আগে বলবে তো|চলো কোনো রেস্তোরাঁতে যায়|
~হুম সোনা|চলো তো জলদি|
রাঙামাটিতে ১৯৮৬ সালে ‘পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স’নির্মাণ করা হয়|এখানে এতো সৌন্দর্য্যের সমরোহের কারনে রাঙামাটিকে ‘ডিয়ার পার্ক’ ডাকা হয়|ডিসি বাংলোতে বাতিঘর দেখার মতো এখানে|বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধ,বালুখালী কৃষিখামার,ফুরেমন পাহাড় রাঙামাটিতেই অবস্থিত|উপজাতি জাদুঘর স্থাপিত করা হয় ১৯৭৮ সালে পরে ২০০৩ সালে পূর্ণনির্মাণ করা হয়|রাজবন বিহারে প্যাগোডা আর বনভান্তের বাসস্থান দেখলে মানুষের মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়|৫ কি.মি. বিস্তীর্ণ মোমঘর ও সুখীনীলগঞ্জ রাঙামাটিকে নিবিড় মায়াতে আটকে রেখেছে|একে রাঙামাটির শান্তিনিকেতন বলা হয়|পৃথিবীর অপর সৌন্দর্য্য বেষ্টিত এই শহরকে মনে ধরবে না এমন মানুষ পাওয়া ভার!
খাওয়ার জন্য সেই সিম্বল অব রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতুর কাপ্তাইয়ের কাছে যেতে হলো|এখানে দুটো উপজাতি রেস্তোরাঁ আছে|একটা ‘পেদা টিং টিং’|যার অর্থ পেট টান টান|এই রেস্তোরাঁয় বিগল বিচিপানি,কফিসহ সব স্বাদের খাবার পাওয়া যায়|এখানে খেতে বসলে খেতে খেতে মানুষের পেট টান টান হয়ে যায়|তাই এমন অদ্ভূত নাম|অপরটি কাপ্তাইয়ের পাশেই উচু টিলায় ‘চাং পাং’|যার অর্থ চাইলেই পাই|এখানে সব ধরনের বাঙালিয়ানা খাবার পাওয়া যায়|আমি মুনকে নিয়ে ‘চাং পাং’ রেস্তোরাঁয় ঢুকে বসলাম|
খাওয়া শেষে গেলাম ৫০ একরের ইকো টুকটুক ভিলেজে,যেখান থেকে সন্ধ্যার পর পূর্ণ চাঁদের আলোর প্রতিবিম্ব কাপ্তাই লেকে দেখলাম|
রাত ৮টায় মুন নিয়ে বাসায় ফিরলাম|
৩|
আজ মুনের জন্মদিন|ভোরে উঠে ওর জন্য পায়েস রান্না করলাম|মুনকে না ডেকে অন্য রান্নাগুলো শেষ করলাম|অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সারাদিন মুনের সাথে বাসায় কাটাবো প্ল্যান করলাম|
আমি সব গুছিয়ে গিয়ে দেখলাম মুন এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে|সিলিং ফ্যানের বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছে|অপূর্ব সুন্দর লাগছে ওকে|আমি এগিয়ে গিয়ে আলতো করে মুনের কপালে চুমু খেলাম|এই ছেলেটিকে এতো ভালোবাসি|আমার ছোঁয়ায় মুন জেগে গেলো|
~হ্যাপি বার্থডে স্বপ্নপাখি|
~থ্যাংক ইউ নীলপাখি|
আমি দেখলাম মুনের দুচোখের নিচে শুকনো জলের ছাপ|
~কি ব্যাপার মুন?তুমি আবার কাঁন্নাকাটি করেছো|আচ্ছা এবার কথা দিলাম তোমাকে তোমাদের গ্রাম থেকে ঘুরিয়ে আনবো|প্লিজ এভাবে লুকিয়ে রাতে আর কাঁদবে না|তুমি বোঝো না কেন তুমি এমন করলে আমি কেমনে ভালো থাকি সোনা!
~এই জন্মদিনে আমি একটা জিনিস চাইবো|দিবে?
~জো হুকুম করেগা সাব|আমার মুন কিছু চাইবে আর আমি দিবো না|তা কি করে হয়!
~আমি একটা সন্তান চাই|তোমার সন্তান!
~এসব কি বলো তুমি|মাথাটা কি গেছে?
~আমি এতো কিছু বুঝি না|আমি চাই|
~হাউ ইজ ইট পসিবল মুন?তুমি তো আর আমার সন্তান গর্ভে ধারন করতে পারবে না|সো এটা সম্ভব নয়|
~তুমি একটা বিয়ে করো|
~এক্সকিউজ মি|আমি তোমাকে ভালোবাসি|তাকাও আমার দিকে|হুম…আই জাস্ট লাভ ইউ,নট আদার|
~কিন্তু আমি তো সন্তান চাই তোমার|সেটা যে করেই হোক|
~পাগলামি করো না মুন|
~আজ আমার জন্মদিন|তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে আমি যা চাইবো তাই দিবে|
~উফফ্ শিট|তোমার মাথাটাই গেছে|
আমি অভিমান করে বারান্দায় এসে দাড়িয়ে ভাবতে লাগলাম মুনের কথাগুলো|আমার দুচোখ জলে ভরে গেল|
আজ দুদিন হলো মুন কিছু খাই না|আমি শত চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারলাম না|কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো|শেষে শানুকে ডেকে আনলাম|শানু আমাদের সম্পর্কটা জানতো|ভাবলাম ও যদি কিছু করতে পারে|
শানু এসেও হাল ছেড়ে দিলো|আমি শানুকে বললাম,
~দেখছেন তো অবস্থা!কি করা যায় বলুন তো?আমি আর ওকে কষ্ট দিতে পারছি না|
~আমি বলি তুমি একটা বিয়েই করো|
~স্টপ দিস ইয়ার|আমি এটা পারবো না|
~তাহলে কি করার?
~আপনি ওকে বুঝান না!প্লিজ|
~যথেষ্ট বুঝিয়েছি নীল|
~আচ্ছা এখানে কোন মেয়ের গর্ভভাড়া পাওয়া যাবে|যত টাকা লাগে আমি ম্যানেজ করবো|প্লিজ একটু দেখুন না|
~কি বলো তুমি নীল!এটা বাংলাদেশ|এরা বাঙালি মেয়ে|এটা ওয়েস্টার্ণ দেশ নয়|
আমি শানুর হাত ধরে বললাম,
~তবুও যদি পারেন|
~ওকে ট্রাই টু মাই বেষ্ট|
দুদিনের মাথায় শানু পূণম নামের এক খ্রিস্টান মেয়েকে নিয়ে হাজির হলো|এর মাঝে আমি মুনকে জোর করে খাইয়েছি|মেয়েটি দেখতে ভালো বলাই চলে|
কথায় কথায় জানতে পারলাম ওর বাবা ক্যান্সারের রোগী,চিকিৎসায় প্রচুর টাকার প্রয়োজন|সব চেষ্টা শেষে মেয়েটি শরীর বিক্রি শুরু করেছে|এর মাঝে মেয়েটি দুতিন জনের ঘরেও গেছে|
মুনকে সব জানালাম|কিন্তু ও আরেকটা জেদ ধরে বসলো|ও অবৈধ সন্তান চাই না|চাই ভালোবাসার সন্তান|শেষে বাধ্য হয়ে রাজী হলাম|
পরেরদিন পূণমকে নিয়ে ডাক্তার চেকিং করিয়ে আনলাম|
মুনের অজান্তে নয় মাসের কন্টাক ম্যারিজ করে সত্যি সত্যি পূণমের গর্ভভাড়া নিলাম মুনের সন্তানের জন্য|
আজ দুদিন হলো পূণম এখানে আছে|কিন্তু ওর দিকে আমার কোন খেয়াল নেই দেখে মুন ডেকে বলল,
~নীল|আমি জানি!আমি থাকলে পূণমের কাছে যাবে না তুমি কোনদিন|তাই আমি আজ রাতের জন্য শানু ভাইয়ার বাসায় যাচ্ছি|তুমি কিন্তু কথা রাখবে|আমার সন্তান চাই|
আমি হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম|এ কি আমার মুন!
মুন যাবার সময় দেখলাম ওর দুচোখ বেয়ে জল ঝরছে|ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছে,এটা তো ওর হৃদয়ে বাজবেই|যদিও সন্তান তার উদ্দেশ্য|
সে রাতে শত কষ্টের পরে আমি পূণমের সাথে মিলিত হয়|
বিষাদময় কালো অন্ধকারের ছাপ হৃদয়ে রেখে আমি আমার মুনকে সেই একটি রাতের জন্য চোখের আড়াল করি|আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো সেই রাতে|তবুও শুধু আমার স্বপ্নপাখির সন্তানের জন্য সেটা কষ্টে করেছিলাম|
পরদিন ভোরবেলায় গিয়ে দেখলাম মুন শানুর ৫বছরের ছেলের কাছে শুয়ে আছে|চোখে কাঁন্নার ছাপ স্পষ্ট|হয়তো সারারাত নির্ঘুমে কেঁদেছে আমাকে রেখে|এই ছেলেটা পারেও বটে|
মুন যদিও জেদ ধরে ছিলো তবুও সেই রাতের পরে পূণমকে আর এ বাসায় আমি রাখিনি|শানুকে বলে একটা বাসার ব্যবস্থা করলাম|
পূনম গর্ভবতী হলো|পূণমের যত্নের জন্য মুনের জেদে আমাকে নার্স রাখতে হলো|পূণম সব জানতো মুনের ব্যাপারে|ও কখনো আমাদের সম্পর্কটাকে বাঁকা চোখে দেখেনি|ওর চোখে তা স্পষ্ট ধরা পড়েছিলো|মুন খুশিতে আটখানা|দিনে বারকয়েক পূণমের কাছে যেত|ওকে মুন আপু বলে ডাকতো|পূণমও মুনকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখতো|
আজকাল অফিস থেকে এসে আমি মুনকে তেমন কাছে পাই না|সেদিন অফিসে ছুটি ছিলো|দেখলাম মুন বিছানায় শোয়া|আমি গিয়ে মুনের মাথাটা আমার কোলে তুলে নিলাম|মুন জেগে গেলো|
~ওহ তুমি!
~মুন তুমি আজকাল আমায় সময় দিচ্ছো না একদম|
~সরি নীলপাখি|আসলে সময়গুলো আজকাল চাঁদ নিচ্ছে তো|
~চাঁদটা আবার কে?
~কেন আমার ছেলে!
~ছেলে হবে তোমাকে কে বলল|
~এই যে মি. আপুর সাত মাস চলে|আমি চেক আপ করিয়েছি|
~ওরে বাপরে!তলে তলে এতো|কিন্তু আমি তো আমাদের ছেলের নাম স্বপ্ন রাখবো|
~নো ওয়ে|আমার ছেলের নাম চাঁদই হবে|আমার নাম অর্থে|
~সে তুমি ডেকো|আমার স্বপ্নপাখির সন্তানের নাম স্বপ্ন ই হবে|
~যাও তোমার সাথে কথা বলবো|
~কি!দেখি তো কে বলল এমন কথা?
বলেই আমি মুনের মুখের
দিকে তাকালাম|ছেলেটি অদ্ভুত!আমার সন্তানের আশাপূরণে সব করলো মুন|আমি ওর ঠোঁটে কিস করতে গেলাম|ও আমার ঠোঁটে হাত রাখলো|আমি শিউরে উঠলাম|
~শোনো!আমার সন্তান আমাকে কি বলে ডাকবে জানো?
~কি?
~মণি আব্বু|
~আর আমাকে?
~রাজ আব্বু|
~ওকে|এবার আমার বিড়ালকে একটু আদর করতে দাও তো|
আমি মুনের অধরে আমার অধর রাখলাম|দুজনের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলো|আমি পরম শান্তিতে হারিয়ে গেলাম মুনের মাঝে|
যথাসময়ে আমাদের স্বপ্ন পৃথিবীতে এলো|জন্মের পর পূণম সন্তান দিতে নারাজ হলো|মুন প্রায় পাগল হয়ে গেলো|শেষে শানুর মাধ্যমে পূণমের দুর্বলতার সুযোগে ওকে বিদেশের জমানো ব্যাংকে রাখা ৫লাখ টাকার বিনিময়ে আমাদের কন্টাক ডিভোর্স করিয়ে স্বপ্নকে ফিরে এনে মুনের হাসি ফুটলাম|এতো সব ঘটনা মুনের অজান্তেই থেকে গেল|
৫|
আজ স্বপ্নের পৃথিবীতে আগমনের এক বছর হলো|মুন তার চাঁদের ১ম জন্মবার্ষিকীতে কিছু কমতি রাখেনি|এই এক বছরে মুন তার চাঁদের মণি আব্বু শুধু নয় চোখের মণি হয়েছে|
আমাদের স্বপ্নের আদর সোহাগের কোন কমতি ছিলো না|সারাদিন অফিস শেষে এসে দেখতাম মুন স্বপ্নকে নিয়ে হাসি আনন্দে আছে,দেখে আমার সব ক্লান্তি চলে যেতো|এরই মাঝে স্বপ্ন আধ আধ বুলি শিখে গেল|জীবনের সাতরং এ পূর্ণ হলো আমাদের জীবন|ভালোবাসায় ভরে গেল আমাদের সুখের ঘর|আমি কোনদিন মুনের সাথে অসুখী ছিলাম না|আজ আড়াই বছর হলো আমি আর মুন পরিবার ছেড়ে রাঙামাটিতে আছি|আমি অবশ্য চাকরির কিছু টাকা মাকে পাঠাতাম নোয়াখালির ওয়াছেকপুরে আমার জন্মভূমিতে|কিন্তু মুন তার চাঁদের জন্য ছায়ামণির চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলো,তাই ও ওটা করতো না|
ভরদুপুরে আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত|এর মাঝে বাসা থেকে মুনের ফোন এলো|স্বপ্ন অসুস্থ হয়ে পড়েছে|আমি গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম|
স্বপ্নকে হাসপাতালে ভর্তি করলাম|ডাক্তার আমাকে ডেকে বলল,
~দেখুন মি. ফারহান|আপনাকে একটু শক্ত হতে হবে|আমি এখন যা বলবো….
~কি বলছেন আপনি?সিরিয়াস কিছু হয়নি তো আমার স্বপ্নের|
~অস্থির হবেন না প্লিজ|আসলে আপনার ছেলের একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে|
~কি বলছেন আপনি|মাথা গেছে?
~মি. ফারহান|অস্থির হবেন না প্লিজ|এখন দরকার মাথা ঠান্ডা রাখার|একজন সুস্থ মানুষের কিডনি ট্যান্সেফার করতে পারলে আপনার ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে|
~কিন্তু ডাঃ কে আমাকে এতো বড় দয়া করবে?কে বাঁচাবে আমার স্বপ্নকে?প্লিজ ডাঃ আপনি একটা কিছু ব্যবস্থা করেন|আর একটা কথা আমার সাথে যে ছেলেটা আসছে ওকে এব্যাপারে কিছু জানাবেন না প্লিজ|ওকে সামলানো যাবে না একদম|আমি আপনাকে অনুরোধ করছি|
~ওকে|
হঠাৎ ডাক্তার চেম্বারের বাইরে কারো কাঁন্নার শব্দ পেলাম|বাইরে গিয়ে দেখলাম মুন কাঁদছে|তার মানে ও সব শুনেছে|
~প্লিজ মুন এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না|আমাদের স্বপ্নের কিছু হবে না|দেখো!
~আমি বড় অন্যায় করেছি নীল,পূণম আপুর সাথে|ওনার কাছ থেকে চাঁদকে আনা আমার একদম ঠিক হয় নি|মা কাছ থেকে সন্তানকে আলাদা করা মহাপাপ|
~কি বলো এসব তুমি|তুমি কেন পাপ করবে?তোমার জন্যইতো স্বপ্নকে আমরা পেয়েছি|দেখবে ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে|
~আমি এতো কিছু বুঝিনা|যেভাবে হোক আমি আমার চাঁদকে বাঁচবো|
আমি মুনকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিলাম|
পূণমের থেকে মুক্তি পেতে অনেক টাকা চলে গেছিলো|আমার হাতে তেমন টাকা পয়সা ছিলো না|যা পেতাম সংসারে আর বাড়ি পাঠিয়ে শেষ হয়ে যেতো|মা চাঁদের কথা জানতো না|কোনদিন বলিও নি আমি|
এগুলাতো হুট করে বলতেও পারবো না|তাই টিভি,বেতারে স্বপ্নের জন্য কিডনি ডোনার খুঁজতে লাগলাম|এদিকে দিনকে দিন স্বপ্নের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো|মুন অনেকটা ভেঙ্গে পড়লো|আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না|শানুও কিছু করতে পারলো না|
সেদিন সন্ধ্যায় একা বাসায় শুয়ে স্বপ্ন আর মুনের কথা ভাবছিলাম|মুন স্বপ্নের সাথে হাসপাতালে ছিলো|
হঠাৎ আমার ফোনে হাসপাতাল থেকে কল এলো,জানাল স্বপ্নের কিডনি অপারেশন হয়ে গেছে|আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না|ছুটে হাসপাতালে গেলাম|
মুন তার কেবিনে আধশোয়া অবস্থা আছে|আমি ভিতরে ঢুকে গেলাম|
~এমন টা কেন করলে মুন?আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তো যে তোমার চাঁদকে আমি সুস্থ করবো|তাহলে?
~সরি|নীলপাখি|আমার কিছু হবে না|একটা কিডনি নিয়ে এই পৃথিবীতে অনেকেই বেঁচে থাকে|তাছাড়া আমার চাঁদের জন্য আমি সব করতে পারি|
~কিন্তু তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারো?
~আরে পাগল,কিছু হবে না|আর যদি কিছু হয়েও যায় তোমার স্বপ্ন তো তোমারই রইল|আর আমি তোমাকে শূণ্য করে যাবো না,পূর্ণ করে যাবো দেখো|
~তুমি একটু থামবে প্লিজ|
~দেখবে কোন একদিন হয়তো একদম থেমে যাবো|
আমি মুনের ঠোঁটে চেপে ধরলাম|বললাম,
~স্বপ্ন আর তুমি|দুজনই আমার হৃদয়ের দুই টুকরো|
মুন আমাকে জড়িয়ে ধরলো|আমি ওর মুখটা তুলে কপালে একটা কিস দিলাম|
স্বপ্নের কেবিনে গিয়ে স্বপ্নকে দেখে এলাম|
একমাস পর স্বপ্ন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল|কিন্তু মুন দিনদিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিল!আমি জিজ্ঞাসা করলে বলতো,ও কিছু না|আমি দেখতাম মুন তেমন খাওয়া দাওয়া করতো না|চেহারায় কেমন কালি পড়ে যাচ্ছিল|মুনকে দেখে আমার অন্তরাত্মা ফেটে যেতো|ডাক্তারের কাছেও যেতে চাইতো না|কখনো কখনো গভীর রাতে স্বপ্ন আর আমার মাঝ থেকে উঠে বারান্দায় দাড়িয়ে থাকতো|জিজ্ঞাসা করলে বলতো,ঘুম আসছে না|
একদিন সন্ধ্যায় মুনকে কোথাও পেলাম না|আমি স্বপ্নকে নিয়ে যতটুকু পারি খুঁজে দেখলাম|আমার দেড়বছরের স্বপ্ন বারকয়েক মণিআব্বু বলে ডাকলো|
রাত ৮টার দিকে পূণমকে সাথে নিয়ে ফিরলো|আমি তো অবাক|আড়ালে নিয়ে প্রশ্ন করতে বলল,
~আপু চাঁদকে দেখতে এসেছে|
~তুমি ওকে কোথায় পেলে|
মুন এড়িয়ে গেলো|বলল,
~চাঁদকে নিয়ে খেতে এসে|
সেই রাতে মুন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে|পূণম আর আমি ধরাধরি করে হাসপাতালে আনি|
ডাক্তার জানালো বাঁচার সম্ভবনা খুবই কম|অবশিষ্ট কিডনিটা নষ্ট হয়ে গেছে|আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো|বলল,
~কি বলছেন এসব?
~আচ্ছা উনি তো মাঝেমাঝে আমাদের এখানে আসতেন|ওনাকে তো বলা হয়েছিলো ওনার কিডনী ড্যামেজ|
~কিন্তু ডাঃ আমিতো জানি না কিছুই|
রাত দশটার দিকে মুন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো|ডাঃ আমাদেরকে ডেকে ভিতরে পাঠালো|দেখলাম মুন মুখ থেকে অক্সিজেন মাক্স সরাল|
~নীল!চাঁদকে একটু এদিকে আনবে|
আমি চাঁদে নিয়ে ওর কাছে গেলাম|
~নীল|চাঁদকে আজ থেকে তোমাদের কাছে রেখে গেলাম|তুমি ওর খেয়াল রেখে|ওর মাঝেই তুমি তোমার এই স্বপ্নকে খুঁজে পাবে|আর পূণমকে তুমি আবার বিয়ে করবে কথা দাও|
পূণম শুধু একবার বলল,
~ভাই তুমি চুপ করো|
~মুন প্লিজ সোনা|এমন করে বলো না|আমি মরে যাবো|
মুনের অবস্থা সিরিয়াস হলো|ডাঃ আমাদের সরিয়ে দিলো|
রাত একটার দিকে আমার মুন স্বপ্নপাখি আমাকে নিঃস্ব করে গেল|
মুনের মৃত্যুরপর আমি কখনো চাঁদকে স্বপ্ন বলে ডাকি নি|কারন আমার আসল স্বপ্ন তো মুন ছিলো|
পূণমের ডাকে আমি বাস্তবে এলাম|দেখলাম করবস্থানের সেই চৌকাঠেই আমার পা আটকে আছে|
আমি মুনের কবরের দিকে এগিয়ে গেলাম|প্রাণী জীবচক্রে বিষাক্ত বিচ্ছু মরে স্বপ্নের নীল প্রজাপতি হয়,আবার প্রজাপতি মরে বিচ্ছু|তেমনি আমার পরম সুখের জন্য মুন বিচ্ছু বিষে বিষাক্ত হয়ে স্বপ্নের প্রজাপতিপূর্ণ করে গেল আমার হৃদয় ঘরকে|চাঁদ জিজ্ঞাসা করল,
~রাজ আব্বু,মণি আব্বু এখানে থাকে কেন?
কি উত্তর দিবো আমি চাঁদকে|
কি করে ওকে বুঝাবো যে,তোকে ভালো রাখতে আমার মুন আমার হৃদয় ঘরে আজ শুধু স্বপ্ন হয়ে আছে|আমি আজও ওকে আমার হৃদয় ঘরে স্বপ্ন করে বেঁচে আছি|
মুনের স্বপ্নের ‘নীলমুন’ বাংলোর প্রিয় লাল গোলাপ এখন শোভা পাচ্ছে আমার মুনের কবরে|
উৎস: অন্যভুবন
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ০৭, ২০১৬
কিছু বলার ভাষা নেই সাইমুন দাদা। এভাবেই হয়ত হারাতে হয়ে নীলের স্বপ্নমুনকে