শেষ ঘন্টা

অন্য ভুবন

জিয়া উদ্দানের লেকের পাড়. আমার ভালোলাগার অন্যতম অনুসঙ্গ. একাকিত্বের, কষ্টের, মনখারাপের সময়গুলো এখানেই কেটে যায়. আজ রবিবার. শীত শেষ হয়ে এলো বলে. লেকের ধার কৃষ্ণচূড়া ফুলে আচ্ছন্ন. বসন্তের আগমনের জানান দিচ্ছে ওরা. লেকের ধারে বসে আকাশ দেখছি. ফারহান এসে পৌছাতে আরো ১ ঘন্টা লাগবে……………

ফারহান. আমার জীবন থেকে নেয়া একটি নাম. যার জীবনের প্রতিটি ছন্দে ছিলো গিটার, গান, মাস্তি, আড্ডা,আইস্ক্রিম, প্যারিস রোড, নদী, নৌকা, আকাশ আর… আর আমি…….

ওর সাথে পরিচয়টা ফেসবুকে. বেশকিছুদিন চ্যাট হওয়ার পর ফোনে কথা বলা. তার কিছুদিন পর স্বাভাবিক ভাবেই দেখা করার বিষয়টা চলে আসছিলো. ও বারবার বলছিলো. কিন্তু আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম প্রতিনিয়ত…

সেদিন ও ছিলো রবিবার. শরতের শুরু. চারদিকে কাশফুল. আকাশে সাদা মেঘের ভেলা. প্রচন্ড মন খারাপ ছিলো সেদিন. তাই আমার প্রিয় লেকের ধারে বসে আকাশ দেখছিলাম. হঠাত ফোনটা বেজে উঠলো. ফারহানের ফোন. রিসিভ করতেই বল্ল, — “তুমি কোথায়? আজই দেখা করতে চাই তোমার সাথে”. আমি অনেকটা মজা করেই বল্লাম,– “আমি লেকের ধারে বসে আছি, চলে আসো.” ও আসছি বলেই ফোনটা রেখে দিল. নিষেধ করার জন্য ফোন দিচ্ছিলাম. কিন্তু ফোন বন্ধ. গোধুলির শেষ সময় তখন. দিনের আলো রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল. নীড় ফেরা পাখিরা ছুড়ে যাচ্ছিল গন্তব্যে. আর আমি আকাশ দেখছিলাম. হঠাত করেই আবার ফারহানের ফোন. ফোন রিসিভ করতেই ও বল্ল,– “আমি পৌছে গেছি. ব্রিজের উপর দাড়িয়ে আছি, তুমি কই?”

অনেকটা অপ্রস্তুত আমি. ভাবছিলাম কি করব. কি করা উচিত. শেষমেশ বলেই দিলাম, “দাড়াও আসছি”. দূরে দেখা যাচ্ছিল নীল পাঞ্জাবী পরা ছেলেটাকে. একদিন ফোনে ওকে বলেছিলাম, যদি কখনো আমাদের দেখা হয়, সেদিন নীল পাঞ্জাবী পরে এসো. ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ওর কাছে. ওর প্রতিচ্ছবি ও ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিলো.অবশেষে আমার ক্যানভাসে শ্যামবর্নের মাঝারি উচ্চতার সেই মানুষটি. সাদাসিধে একটা মুখ. সাদাসিধে দুটি চোখ. আমায় দেখেই হাসল সে. আমি সম্মহিতের মত তাকিয়ে দেখছিলাম ওর হাসি.একটা মানুষের হাসি কিভাবে এত সুন্দর হতে পারে!!!! এমন হাসি দেখেই একজীবন পার করে দেয়া যায়. দুজন লেকের পাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম. সন্ধা গড়িয়ে রাত নামলো. আমাদের কথা, গল্প, আড্ডা,গান যেন শেষই হতে চাইছিলোনা. অবশেষে অনেক রাতে দুজন দুজনের বাসায় ফিরে গেলাম. সে রাতে ঘুমোতে পারিনি. কল্পনার কিশলয় গুলো তখন ফারহানকে নিয়ে ব্যস্ত. নির্ঘুম সারারাত ফজরের আজানের পর ঘুম নেমে আসে চোখে.সারাদিন কেটে বিকেলে ঘুম ভাঙ্গে. উঠে ফোনটা হাতে নিতেই দেখি ফারহানের sms. ও অপেক্ষা করছে. আমি আবার ছুটে গেলাম লেকের পাড়ে. বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধা. হঠাত ঝড়ের বেগে বাতাস বইতে শুরু করলো তারসাথে হাল্কা বৃষ্টি. গিয়ে দেখি ফারহান দাঁড়িয়ে. আমি গিয়ে পাশে দাঁড়ালাম. আলতো করে আমার হাতটা ধরে সেখানে গুজে দিলো নীল খামে লেখা একটা চিরকুট………

অদ্ভুত এক ভালোলাগায় শিহোরিত হচ্ছিলাম. নির্বাক আমি কিছুই বলতে পারিনি. শুধু জড়িয়ে ধরলাম তাকে. শক্ত করে………………

তারপর….. তারপর নতুন এক আমি. নতুন কিছু স্বপ্ন. আর নতুন এক জীবন. যে জীবনের প্রতিটি বাকে ছিলো ফারহান. যে জীবনের প্রতিটি ছন্দে ছিলো ফারহানের ভালোবাসা. স্বপ্নময় ছিলো সে দিনগুলো.প্রতি ঘন্টায় কথা বলা. মাঝে মাঝে কথা বলে সারারাত কাটিয়ে দেয়া. যখন তখন দুজন একসাথে ঘুরতে বের হওয়া. আবার কখনো ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়া. মান অভিমান. স্বপ্নের মত করেই কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো. কিন্তু হঠাত একদিন এক ঝড় এসে সব কিছু শেষ করে দিয়ে চলে গেলো. নতুন কেউ আমার ফারহানকে নতুন ভালোবাসায় সিক্ত করে চলছিলো. আমার ভালোবাসা ত পুরোনো হয়ে গেছে. তাই আজ আমি ফারহানের কাছে বড় বেশি তিক্ত. বড় বেশি অবহেলার………..

ফারহানের ফোন. আবার ফিরে এলাম আজকের বসন্তের গোধুলি লগ্নে.. ১ ঘন্টা হয়ে গেছে. ও পৌছে গেছে হয়ত. কখন রাত নেমে এলো বুঝতেই পারিনি. চারদিক অন্ধকার. ভয়ংকর অন্ধকার.স্তব্ধ. বিষন্ন. প্রকৃতি ও বোধহয় অনুভব করছে আমার আমিকে. তাই হয়ত আমার কষ্টগুলোকে নিজের করে কি এক রিক্ততায় হারিয়েছে নিজেকে. আজ ফারহান আর আমার শেষ দেখা. সহজ ভাষায় যাকে ব্রেকাপ বলে. আর কখনো ফারহানের সাথে দেখা হবেনা. ওর হাসি দেখা হবেনা. আর কখনো একসাথে আইস্ক্রিম খাওয়া হবেনা. লেকের পাড়ে বসা হবেনা. হবেনা প্রতিঘন্টায় কথা. কললিস্টে থাকবে না আমার নাম্বার. আর কখনো বলবেনা ফারহান. বলবেনা ভালোবাসি…………..

ও পৌছে গেছে. আমার পাশে এসে বসলো. ক্ষানিক ক্ষন পরে বলল,– “আমি চাইনি তোমার সাথে আর কখনো দেখা হোক. কেনো ডেকেছো? কি বলবে বলো?”

অনেক কিছুই বলব বলে ভেবে রেখেছি. কিন্তু সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে. ওকে দেখলেই আমার পৃথিবীটা কেমন যেন ওলট পালট হয়ে যায়. ওর চোখে চোখ রাখতেই হারিয়ে ফেললাম নিজেকে. ওই চোখের গভীরতা কখনোই খুজে পাইনি. ব্যর্থ এই আমি বারবার শুধু হারিয়েছি নিজেকে. বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে. তীব্র আর্তনাদে ভেতরটা ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে. অজান্তে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে. মূল্যহীন, সস্তা পানি. সময়ে অসময়ে যা ঝরে পড়ে……………

অনেক কিছু বলার ছিলো. কিছুই বলতে পারিনি . হয়ত আর কখনোই বলা হবেনা. সময় এসেছে বিদায়ের. সবচেয়ে কাছের মানুষটার বিদায়. বিদায় জানিয়ে ফারহান চলে যাচ্ছে. চিরতরে. ইচ্ছে করছে পিছন থেকে ওর হাতটা চেপে ধরি. পৃথিবীর সব শক্তি এক করে জড়িয়ে ধরি. শক্ত করে. যেন কোথাও হারিয়ে যেতে না পারে. ইচ্ছে করছিলো, চিতকার করে বলি. ফারহান, আমায় এভাবে একা রেখে যেও না.আমি বাঁচতে পারবো না. ভালোবাসি তোমায়. ভীষণ ভালোবাসি. পারিনি. পারিনি বলতে. শুধু নিশ্চুপ দাড়িয়ে ছিলাম. আর ওর প্রতিচ্ছবি ক্রমেই অস্পষ্ট হচ্ছিল. ধীরে ধীরে সে মিলিয়ে গেলো. অজানায়. ফারহান চলে গেছে অন্ধকার এই আমি আর আমার ভালোবাসাকে পেছনে ফেলে আমার পৃথিবীর শেষ প্রান্তে নতুন কোনো পৃথিবীর সন্ধানে. যেখানে হয়ত কেউ একজন দাড়িয়ে তার প্রতিক্ষায়……….

আজ আমার পৃথিবী অন্ধকার. চারপাশ স্তব্ধ. কেউ নেই কোথাও. ফারহান আজ দূরে. অনেক দূরে. ও নিয়ে গেছে আমি নামক সত্ত্বাকে. আর দিয়ে গেছে সস্তা কিছু আবেগ. এক সমুদ্র চোখের জ্বল. কিছু স্মৃতি. আর ভালোবাসা নামক অদ্ভুত এক অনুভুতি………….

জানিনা কেমন থাকবো. হয়ত খুব ভালো. হয়ত খুব খারাপ. কিন্তু ফারহান বেচে থাকবে. আমার প্রতিটা সকাল হয়ত ওকে দেখেই শুরু হবে. প্রতিটা ভোরের সূর্যের উষ্ণতায় হয়ত ফারহানের ই ছোয়া পাবো……

অনেক বছর পর কোনো একদিন কোনো এক শপিং মল এ, বা কোনো বাস স্ট্যান্ড এ, অথবা কোনো রেল স্টেশনে. কিংবা সমুদ্রের পাড়ে হয়ত দেখা হয়ে যাবে ফারহানের সাথে. সেদিন হয়ত পাশে থাকবে তার ভালোবাসার নতুন কোনো পৃথিবী. পরম যত্নে, পরম মমতায় ফারহান তার হাত শক্ত করে ধরে রাখবে. আমার চোখে চোখ পড়তেই তা সরিয়ে নিবে ফারহান. দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে চলে যাবে আমার দৃষ্টির সীমানার বাইরে….

অপরিচিতের মত হয়ত তাকিয়ে থাকবো সেদিন ও. অশ্রুশিক্ত চোখে হয়ত দৃষ্টি মেলে দেবো সমুদ্রে অথবা পাহাড়ে কিংবা আকাশে. ফারহানের অস্তিত্বের খোঁজে. আমার আকাশ টা যে শুধুই ফারহানের………………..

(সমাপ্ত)

উৎসঃ অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.