বক্ষে আমার তৃষ্ণা

চিন্ময়ের ইতিকথা

উল্লেখ্য, এটি একটি আত্নবিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ। লেখক নিজস্ব দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন।

—————————————-

দুটি শব্দ মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। শব্দ দুটি হল “আমি কেমন”। আচ্ছা, আপনি চিন্তা করে দেখুন তো, আপনি কেমন? আপনার একটা সংজ্ঞা আপনি নিজে দাড় করান তো। পারছেন? যদি পারেন, তাহলে বলব, আপনি নিজেকে সময় দেন। আর নিজ সম্পর্কে নিজের থেকে আর কেউ ভালো জানে না। সবচেয়ে ভালো লাগে যদি নিজের সম্পর্কে অন্য কেউ জানে এবং আমাকেই জানায় যে আমি কেমন। অথচ আমার অবচেতন মন এই জিনিসটা স্পষ্ট অবগত এবং আমি নিজেকে জানার প্রচেষ্টার মাধ্যমে চিনতে পারি নিজেকে।

মানুষের মানবীয় গুণাবলীর আঁধার হল মন। কিন্তু মন নিজে কিছু করতে পারে না। করতে হয় চিন্তার দ্বারা। বিভিন্ন আবেগ হয়তো অনুভূত হয় মন থেকে। কিন্তু সেই আবেগের উদয় বা সৃষ্টের পিছনে যে মস্তিষ্কের হাতটা অনেক বড় তা তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাহলে চিন্তার দ্বারা যদি মনের ভিতরটা অনুভব করতে পারি, তাহলে কেন আমরা বলব যে ”গভীর মন”? কেন “গভীর মস্তিষ্ক ” বলব না? “মনের বাড়ি” শব্দটার সাথে আমরা হয়তো অনেকে পরিচিত না। মহাজাতকগণ কোয়ান্টাম বিদ্যার সাহায্যে কিছু অটো-সাজেশনের (যে সাজেশন মস্তিষ্কে গাঁথার ফলে সেই সাজেশন-রূপ কাজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়) প্রতিষ্ঠা করেছেন। যা আমাদের কল্পরাজ্যের সেই মনের বাড়িতে পৌঁছে দেয় এবং মনের মাঝে অনাবিল সুখের সৃষ্টি করে। আসলে মনের বাড়ি হল নিজের কল্পনায় তৈরি একটা বাড়ি। আর সেখানে জলাশয়কে প্রেম রূপে চিহ্নিত করতে পারি। অনেকে বলে প্রেম সীমাহীন এক আবেগ, যাতে বিশালতা উপলব্ধি হয়। আর তার ফলে যদি সেই জলাশয়কে খরস্রোতা নদী ধরি, তাহলে সেই নদীতে তো মনের মানুষ স্রোতের টানেই ভেসে যাবে। নদীকে সে বিন্দুমাত্র আন্দোলিত করতে পারবে না। অপরদিকে মনের প্রেম রূপ পুকুরটাতে যদি মনের মানুষ স্নান করে তাহলে হয়তো পুকুরটার কানায় কানায় ঢেউয়ের দ্বারা আন্দোলিত হতে পারে। তাহলে এর দ্বারা আমরা কি বিশালতাটাকে বিসর্জন দিব? প্রেমের ক্ষেত্রে?

অনেকে কষ্ট পেতে ভালোবাসে, অনেকে বা কষ্ট দিতে ভালোবাসে। আসলে সবকিছু কি মানুষের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা রাখে? যারা রাখে, তারা হয়তো মহাপুরুষের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু যারাই বা কষ্ট দিতে ভালোবাসে তারা কি খুশিই থাকে? তারা হয়তো জীবনের এক পর্যায়ে মর্ম যাতনায় ভোগে। গতানুগতিকের সেই ধারাগুলোই তখন তার জীবনের নাভিশ্বাস হয়ে উঠে। অনেকে কষ্ট পাওয়ার পর বলে যে আমি ভুলতে চেষ্টা করি। আসলে চেষ্টা করে কোন জিনিস ভোলা যায় না। যদি সারাক্ষণ মন্ত্রের মত জপ করার মতো বলো যে “আমি তাকে ভুলে যাবো” তাহলে ধরতে গেলে তুমি তার নাম ১০৮ বারই স্মরণ করছো। তো তাকে ভুলবে কী করে? সবার মাঝে কোন না কোন ধরনের তারল্য বিদ্যমান। কারো মনে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহ হয়, কারো মনে প্রবাহিত হয় নদীর বান ডাকার মতো। আর এসব তরলপূর্ণ মানুষগুলো ভয়াবহ রকমের প্রতারিত হয় একটি সাধারণ উক্তির দ্বারা, “ভাইয়া আপনাকে তো অনেক হাসিখুশি দেখি, মনে হয় আপনি অনেক কষ্ট বয়ে বেড়ান।” এই উক্তিটির পরেই লোকটার প্রতি আমাদের যে কারোরই শ্রদ্ধা বোধ সৃষ্টি হবে। কিন্তু তাকে কখনো তার ছোট ছোট আচরণের দ্বারা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন সে কেমন? না, তা দেখার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ আপনি তার প্রতি মুগ্ধ। আর সেই আপনাকে হয়তোবা অনেক বড় কষ্ট দিয়ে চমৎকারভাবে আপনার মুগ্ধতার প্রত্যাবর্তন করবে। সেটাও মুগ্ধতাই বটে। মনকে বিশ্লেষণ করা আমাদের কাজ না। যাদের কাজ তারা তা নিয়ে মাথা ঘামালে কিংবা চুল ছিঁড়লেও আমাদের তাতে বিন্দুমাত্র কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমরা আমাদের কানের পরিধি বিস্তৃত রাখি ফলাফল শোনার জন্য। তাই প্রতিদিনকার মতো পত্রিকার পাতায় রাশিফলগুলো একবার ঘুরে আসতে কারোরই দ্বিধা হয় না। প্রেম পিয়াসীদের জন্য প্রেমিকের মন গ্রামীণ হলেই শ্রেষ্ঠ। কারণ নির্মল বায়ু ও খোলামেলা মাঠের মতো তার হৃদয় পটেও আবেগের দৃশ্যগুলো এরকমই হবে। যদি শহরের দৃশ্যপট চিন্তা করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, মনের কালিমায় উপচে পড়া ডাস্টবিন আর মেকি কান্নার মতো বয়ে যাচ্ছে ড্রেনের পানি। দীর্ঘশ্বাসগুলো বেরুচ্ছে কলকারখানার কালো ধোঁয়ার মত। মফস্বল এলাকার দৃশ্যপট আলাদা। সেখানে মিলিয়ে মিশিয়ে সবকিছু বিদ্যমান। আর যারা গ্রামকে ভালোবেসে গ্রামের দুতিনদিনের আবহাওয়ায় উপযুক্ত শহুরে সুবিধা না পাওয়ার পর যখন গ্রামের প্রতি ভয়াবহ রকমের বিতৃষ্ণা জাগে, তাদের প্রতি প্রশ্ন জাগে, তারা কি করে এতো কোমল বড় ও নির্মল মনের গ্রামীণ হৃদয়ের কাউকে তাদের হৃদয়ে স্থান দিবে। হয়তো তাদের কিছু হবে না। যা ঘটবে, তা হল ঐ গ্রামীণ মন কিছুটা বা পুরোপুরি কলুষিত হবে। যা দিল্লির মত শহরের প্রতিকৃতি রূপ হৃদয়বান মানুষদের বিন্দুমাত্র স্পর্শ করবে না।

আমরা প্রেমকে কখনো আবেগ ছাড়া সংজ্ঞায়িত করতে পারি না। কারণ প্রেম আবেগ। প্রেমের ফলে দুটো মানুষের মনের মধ্যে আকর্ষণ অনুভূত হয়। আর আমরা প্রেম প্রেম করে যে চিৎকার করে বেড়াই তা কি কাম বহির্ভূত? প্রেম স্বর্গীয় আর কাম তামসিক গুণ। কুকুরেও কাম বাসনা প্রবল, কিন্তু তাদের প্রেম কি জাগ্রত হয়? আসলে প্রকৃত প্রেমের দ্বারা কখনো বন্ধন ঘটে না। প্রকৃত প্রেম দ্বারা ঘটে মুক্তি। কামযুক্ত বন্ধনের মাধ্যমে ঘটে বন্ধনযুক্ত বহুকাল ধরে চলে আসা একটি আবেগ। যাকে মানুষ প্রেম দ্বারা সংজ্ঞায়িত করেছে। আমার কামরূপ প্রেমে বিশ্বাসী। এতে অনেক বিশ্বপ্রেমিক হয়তো আমার উপর লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কিন্তু তাদের কে বলছি। আপনি যদি নিজেকে তথাকথিত সমাজের টপ বা বটম বলে বিবেচিত করেন, তখন আপনি একটু ভালো করে পর্যালোচনা করে দেখুন তো, আপনি কি কোন অক্ষম লোকের সাথে বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইবেন কি? আমরা শুধু জিনিসের সৌন্দর্যটাই দেখি। যেমন আকাশের সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই, ভেজা অরণ্যের রূপ দেখে আমরা বিমোহিত হই। কিন্তু কখনো আকাশের বিশালতার দ্বারা নিজের মনকে বিশাল রূপে অনুভূতি দিতে পারি না। সেই সবুজের তারুণ্যও থেকে যায় অনুভূতির অন্তরালে। শুধু রস আস্বাদন করে ফেলে দেয়াই যদি আমাদের কর্ম হয় তাহলে ব্যক্তিগত জীবনে ভালোলাগার মানুষটাকে শুধুই আস্বাদনের ভিত্তিতে কামরূপ প্রেম করব। আর এটা জানার পর আশা করি আঁতকে ওঠার কোন প্রয়োজন নেই।

মাঝে মাঝে নিজের মনে প্রশ্ন জাগে। যদি সেই মহাপুরুষদের কে নিজের মতো করে অনুধাবন করার চেষ্টা করি, তাহলে তৃষ্ণা জাগে। মোহমুক্তির। আসলে কি মোহের ঊর্ধ্বে যাওয়া সম্ভব? তখন মনটা গ্রীষ্মের খর-তপ্ত রৌদ্রের মতো হয়ে সমস্ত প্রাণরস শুকিয়ে যায়। তবুও বসন্তের কোন উদাস দুপুরে জাগে ‘বক্ষে আমার তৃষ্ণা এক মোহহীন ভালোবাসার’।

ৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.