
কাশফুল
ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির পিছনের দিকের ধানক্ষেতের দিকে যেতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।তবে এখন সেগুলো আর ধানক্ষেত নেই।বর্ষার পানিতে ধানক্ষেতগুলো এখন ভরপুর। আর এই সময়টাতেই প্রতি বর্ষায় অজস্র শাপলা ফুলের মেলা বসে বর্ষার পানিতে ডোবা ধানক্ষেতগুলোতে।
আজ শাপলার পরিমানটা একটু বেশিই লক্ষ করলাম।মনে মনে ভেবে নিলাম আজ বেশ কামাই হবে।ডাটাসহ শাপলাগুলোকে বাজারে বিক্রি করে যা পাবো তাতে মায়ের নামাজ পড়ার জন্য একটা খেজুরের পাটি।(অনেকদিন হলোই দেখছি পাটিটা ছেড়া।খুব কষ্টে নামাজ পড়েন মা।)ছোট্ট বোনটির জন্য কাচের রেশমি চুড়ি আর পেট ভরে কুদ্দুস কাকার দোকানের রসে টইটুম্বুর রসোগোল্লা আর জিলাপি খেয়ে তবেই বাড়ি ফিরবো।
ভোর বেলা।এখনও পাড়ের ব্যাঙগুলো ডাকাডাকি করছে।চারদিকে এখনও অন্ধকার।তার সাথে দুর থেকে ভেসে আসা শিয়ালীর ডাকগুলো যেন এক ভুতুরে পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
শরীরটা হঠাৎ কেপে উঠলো।পাগুলো অসার।কিন্তু বেলা পরে গেলে বাজারে শাপলার দামই পাবোনা ভেবে মনকে জোর করে বুঝিয়ে গলায় ঝোলানো ছোটবেলার তাবিজটাকে একটা চুমু খেয়ে দুয়া ইউনুস পড়তে পড়তে পাড়ের দিকে এগুলাম।
(পরিচয় দেবার মতো বিশেষ কিছু নেই।তবে যেটুকু আছে সেটুকু বলি। আমি সেলিম।ইতিমধ্যে নিশ্চই বুঝেছেন যে গ্রামের বাসিন্দা।বাপের রেখে যাওয়া একটুকরা জমি চাষ করি,কিছু ছাগল চড়াই আর সেগুলোর দুধ বিক্রি করে যা হয় তাতে আমি, আমার মা আর ছোট্টো বোন সালমার দুবেলার পেট ভরে যায়।নেশা করে গ্রামের এক যুবতিকে ধর্ষনের অপরাধে গ্রামের লোকেরা পিটিয়ে প্রায় দুই মাস আগে আমার বাপেরে মেরে ফেলে।সেই থেকে আমরা সমাজ কতৃক “একঘরে”।ঐযে দেখছেন পূবের তালপাতার ছাউনি আর মাটির চাদরে ঘেরা কুটিরটা,আমি আমার মা আর সালমা সেখানেই থাকি।)
ইতিমধ্যে চারদিকটা একটু ফরসা হয়েছে।পাখিরাও ডাকছে।এবার গায়ের জামাটা খুলে লুঙ্গিটা গুটিয়ে নেমেই পড়লাম।
চারদিকে অজস্র শাপলা ফুল।বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।সাদা পাপরিগুলো যেন আকাশে ফুটে থাকা একএকটা তারা আর সেগুলোর ঘ্রান।আহা সে এক অপরুপ চাহুনি।
শাপলাগুলো তোলা শুরু করলাম।দুহাত ভরে গেলে সেগুলো পাড়ে রেখে আবার নেমে পরলাম।
শবে আবার ডাটাসহ তোলা শুরু করেছি শাপলা।হঠাৎ পেছন দিকটাতে পানির খলখলানির শব্দ।যেন আরো একজন আছে সেখানে।এবং সে এদিকেই আসছে।
পেছনে ঘুরতেই দেখি আমার বয়সি একজন যুবক।দেখে বেশ চমকে গেলেও এক ধমকে কাদিয়ে ফেললাম।
……..ঐ মিঞা।কেডায়??
এহানে কি করেন?
আগে তো দেহি নাই??
চোড় নি?
শালায়……….
তাইতো বলি হাসের ডিমগুলারে কেডায় চুড়ি হরে?তোর আইজ নিস্তার নাই।
বেস্। বর্ষার বর্ষনও হার মানবে তার চোখের বর্ষনের কাছে।
…..কাদেন কেল্লা???মরবার ভয়ে?
…..না ভাই।মুই তো শাপলা তুইলতে আইছু।পাশের গেরামে থাহি।রফিকের পুলা।মামার বাড়িতে থাকি।মোল্লা বাড়ি।
…..তয় আমি কি কইরবার পারি?এহান থেইকা যান।এহানের সব শাপলা মুই তুইলতুম। …..হ।যাইতেছি।
পরক্ষনেই আবার সাপ পোকার ভয়ের কথা মনে পরে গেলো।ভাবলাম একজন সঙ্গী থাকলে মন্দ হবে না।
……হ হইছে।যাওন লাগবো না।তয় একটা শর্ত আছে।শাপলা তুইলা বেইচা যা টাহা কামিইমু তার একভাগ তুমি পাবা।
…হয়।মুই রাজি।
শাপলা তুলতে তুলতে বেশ ভালোই ভাব হয়েছে দুজনার।অনেকদিন একঘুরে জীবনে যেন এক প্রানের সঞ্চার।
কিছুক্ষনের মধ্যেই সব শাপলা দুজনে তুলে ফেলেছি। পাড়ের জমানো শাপলাগুলারে আটি করে বেচার উদ্যেশ্যে বাজারে রওনা হই।ইতি মধ্যে পূর্ব আকাশের রক্তিম বড় সূর্যটারর দেখা মিললো।
বেশ খানিকটার পথ।যেতে যেতেই শোনা হলো ওর পরিচয়।আমার মতনই এতিম সে।বাবা মা কেউ নেই।মামার বাড়িতে বড়। নাম রাজু।
শুনলাম তার মামা বাড়িতে থাকা চাকরের বেশের কথা।থাকতে চায়না সে সেখানে।দুইবার পালিয়ে চলে গেছিলো।কোথাও ভাতের যোগার না করতে পেরে বারবারই ফিরতে হয়েছে।ছোটখাট ভুলেও বেদম প্রহর খেতে হয় মামার কাছ থেকে।আর মামির ভৎসনা তো আছেই।
মায়া পরে গেলো মুহুর্তেই।নিজের কেটে যাওয়া শৈশব আর দুঃখ কষ্টে কাটানো কৈশরের কথা জানালাম ওকে।
নিজের জন্য নয়।রাজু কেদে উঠলো আমার জীবনের গল্প শুনে। বাজারেরর কাছাকাছি চলে এসেছি………………
রাস্তার ধারে বিক্রির উদ্যেশ্যে শাপলার আটিগুলো নিয়ে বসতেই এক পেয়াজের বেপারি দুইটা লাথি দিয়ে দুজনকেই তুলে দিলো সেখান থেকে।সেটা নাকি তাদের এলাকা।
এক মেয়েদের মালা চুড়ি দোকানের দোকানী বেপারটা দেখে আমাদের ডাক দিলো। তার দোকানের কোনার ধারে বসে শাপলাগুলো বিক্রি করার অনুমতি পেলাম। রাজু শাপলা বিক্রি করছে,আর আমি আমার বোনের জন্য রেশমি চুড়ি দেখছিলাম ঐ দোকানীর কাছ থেকে। নীল রঙের রেশমী চুড়িগুলো বেশ চোখে ধরেছে।
দুপুর গড়িয়ে গেছে।ইতিমধ্যে রাজুর শাপলা বিক্রি করা শেষ।বেশ ভালোই খেল দেখিয়েছে সে। শাপলার ডাটাগুলোর ভালো দাম পেলাম।
দোকানীর কাছ থেকে চুড়িগুলো কিনে রওনা হলাম কুদ্দুস কাকার মিঠাই দোকানে।একঘড়ে থাকায় অনেকদিন পর দেখা হয়েছে কাকার সাথে।আমার আপন ছোটকাকা সে।
আমাকে দেখে বেশ খুশিই হলেন তিনি।দুজনে ফ্রিতে রসোগোল্লা আর জীলাপি মুখ মেরে খেলাম।নরবার উপায় নেই।তাই একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। কতদিন পর যে খেলাম দুজনেই তা হয়তো নিজেরাই জানিনা।কারন আমরা দুজনেই আজ জীবনের গল্পের কাছে পরাজিত।
যাই হোক।অনেক ঘোরাঘুরি কররলাম।
এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামাতে পশ্চিমের সূর্যটা ব্যাস্ত হয়েছে আমাদের বাড়ি ফেরবার তারা দিতে। মায়ের জন্য নামাজের খেজুরের পাটি কিনে রওনা হলাম বাড়ির উদ্যেশ্যে।
আবার খানিকটা পথ।তবে পথটা এবার দুজনার জীবনের গল্প সাজানোর পথ।
রাজুকে যেতে দেইনি আর।আমাদের কাছেই রেখে দিলাম ওকে।ও খুব খুশি এতে।ও মুক্তি পেলো বন্দি জীবন থেকে।আর আমি আর আমার সমাজ কতৃক বিচ্ছিন্ন পরিবার পেলো নতুন এক সদস্য।সুযোগ পেলাম আমাদের দুজনার জীবনের গল্পকে নতুন মোড় দিতে।
[আজ সেই থেকে আমরা একসাথে।আমার মা পেলো আরেকটা ছেলে।আমি পেলাম আরেকটা ভাই সাথে বন্ধুও বটে।এভাবে প্রায় বারোটা বছর কেটে গেছে।একসঙ্গেই থাকি আমি আর রাজু একে অপরের ছায়ার মতো।বাজারে এখন আমাদেরও দোকান আছে।অন্য পাঁচজনের মতো আমরাও বেশ সুখী আছি আজ।সমাজও একঘুড়ে জীবন থেকে অনেকদিন আগেই আমাদের গ্রহন করেছে আবার।বোনের বিয়ে দিয়েছি ১ বছর আগে।কাল আমার আর রাজুর বিয়ে।পাত্রীরা একই গ্রামের দুই চাচাতো বোন ।আমাদের নতুন এই জীবনের গল্পে কাল আপনাদের সবার নিমন্ত্রন।আমার আর রাজুর জীবনের গল্পকে আরও একবার নতুন করে সাজিয়ে দিয়ে যাবেন।]
উৎস: অন্যভুবন