*জিজ্ঞাসা বোধক চিহ্ন(?)*

একলা পথিক

_এক্সকিউজ মি…এই সিট’টা সম্ভবত আমার।

~ সরি…?

_ বললাম আপনি যেই সিট’টাতে বসে আছেন, সেটা আমার সিট।

~ আপনি বোধহয় কোঁথাও ভুল করছেন।

_ নাহ! ভুলটা হয়তো আপনারই হচ্ছে। C-1 left এটা আমারই সিট।

~ এইযে আমার টিকেট দেখুন। আমি কিন্তু সঠিক জায়গাতেই বসেছি। দয়া করে আপনার টিকেট’টাও একটু মিলিয়ে নিন। তাহলেই রহস্য বোঝা যাবে।

_ আরে তাজ্জব ব্যাপার তো,দুজনের টিকেটের নং’ই তো দেখছিএকি!(দুজনেই পকেট থেকে টিকেট বের করে একে অপরকে দেখালো)

~ ওহ মাই গড…তাই তো…!

_ কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো সেই তিনদিন আগেই টিকেট বুকিং দিয়ে গিয়েছিলাম। আজিব তো..

~আচ্ছা শুনুন! আমার মনে হচ্ছে এটা বাস অথোরিটির কোন গলদ। চলুনআমরা বাসের সুপারভাইজারের সহায়তা নিই। কোন সমাধান হয়তো পাওয়া যেতে পারে…।

_ হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন…চলুন যাওয়া যাক…।

…………………………………

# সরি স্যার!ভুলটা আসলে আমাদের দিক থেকেই হয়েছে।ভুলে দুজনকেই একই সিট নম্বর দিয়ে ফেলেছি। এতো ঝামেলায় থাকতে হয় যে কখন বেখেয়ালে টিকেটের গড়মিল করে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি।অসাবধানতাবশত ভুলের জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। (বাসের সুপারভাইজার ওদের দুজনের উদ্দেশ্যেই বললো)

_ হুম আগেই বুঝেছিলাম ভুল’টা আপনাদেরই। যাইহোক,ক্ষমা না হয় করে দিলাম।কিন্তু এখন এইটার সমাধান তো করেন।

~ হ্যাঁ সেটাই,একই সিটে বসে তো আর দুজনে যেতে পারবোনা।

# আচ্ছা স্যারেরা আপনাদের একটা সহজ সমাধান দেই।আপনিযেহেতুC-1’এ বসেই পড়েছেন তাহলে আপনি ঐ সিটেই থাকুন আর আপনি পাঁশেরC-2 নং সিটে বসে পড়ুন। দুজনেই যেহেতু সিঙ্গেল পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে চলে যান।

~ ওকে আমি রাজি। আমার কোন সমস্যা নাই।

_ C-2নং মানে কি! দুঃখিত!আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি হতে পারলাম না। সেই তিনদিন আগে এসে বুকিং দিয়ে গেলাম C-1 আর এখন জোর করে কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে C-2 ? অসম্ভব! বাসে উঠলে আমার ভীষণ এসিডিটি’র প্রবলেম হয়। তাই জানালার পাঁশের সিট ছাড়া আমি একদমই বসতে পারিনা।

# স্যার একদিন নাহয় একটু কষ্ট করলেন। অন্যকোঁথাও সিট থাকলে আমি অবশ্যই ম্যানেজ করে দিতাম।

_ নো এক্সকিউজ প্লিজ। সাফ কথা আমি এই সিটে যাবোনা। হয় আমার বুকিং করা সিট’টা ম্যানেজ করে দেন নয়তো টিকেট রিটার্ন নিন। আমি অন্য বাস ধরে চলে যাবো।

# স্যার প্লিজ!একটু বোঝার চেষ্টা করুন। এই মুহূর্তে আপনি টিকেট ফেরত দিলে আমি তো বিপদে পড়ে যাবো।

_ এইসব কলাগাছ বুঝিয়ে লাভ নেই। আপনার ব্যবসায়িক চিন্তা আপনার আর আমার চিন্তা আমার। অযথাই কথা পেঁচিয়ে কোন কাজ হবে না…

~ আচ্ছা সুপারভাইজার ভাই শুনুন! আমার সিট’টা আপনি ওনাকে দিয়ে দিন। C-1আর C-2একটা হলেই আমার চলবে। জানালার পাঁশে বা দূরে বসা নিয়ে আমার কোন প্রবলেম নেই।তাছাড়া ভাইয়ের যেহেতু এসিডিটি’র সমস্যাও আছে। তাই ওনার হয়তো উপকারই হবে।

# ভাই কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো। বাঁচাইলেন আমাকে।

…………………………………

_ অশেষ ধন্যবাদ আপনার সিট’টা আমাকে ছেঁড়ে দেবার জন্য।

~ মেনসন নট প্লিজ। এন্ড ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম অলসো।

_ আচ্ছা একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না তো?

~ জি বলুন।

_ আপনার মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছিলো সুপারভাইজারের সাথে ওমন দুর্ব্যবহার করার জন্য আপনি বোধহয় কিছুটা বিব্রতবোধ করছিলেন। তাছাড়া আমারও অবশ্য ওতোটা চড়াও হউয়া উচিৎ হয়নি।আরেকটু নমনীয় হলেও পারতাম,তাই না?

~ আরে নাহ…ঠিকই আছে। আমি কিছুই মনে করিনি। তাছাড়া আপনার জায়গায় আমি হলেও হয়তো এমন আচরণই করতাম। সেতো আসলেই অন্যায় করেছে।আর শুনুন এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনার এতো এপোলজি চাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।মাঝেমধ্যে পাবলিক প্লেসে এরকম একটুআধটুউচ্চবাচ্যকরা…ঝাড়ি মারা দোষের কিছু না…নিজেকে হিরো হিরো লাগে…হাহাহা…

_ হাহাহা…ভালোই বলেছেন। আপনি তো বেশ রসিক মানুষ দেখছি। আচ্ছাআমি তো সেই কখন থেকে একাই বকবক করেই চলেছি আপনার সাথে তো এখনো পরিচয়ই হলো না।

~ কেন?আপনি বুঝি পরিচয় ছাড়া কারো সাথে বকবক করেন না? হাহাহা…

_ আরে!কি যে বলেন না! আমি হচ্ছি গিয়েবকবক করার ট্যাংকি। একবার কল ছেঁড়ে দিলে অনর্গল পড়তেই থাকি। স্থান-কাল-পাত্র মানিনা। হাহাহা…আচ্ছা যাইহোক,আমি নাবিল।একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার পদেআছি।আপনি?

~ আমি জায়েদ। একটা বেসরকারি ব্যাংকে জব করছি।(একে অপরের সাথে হ্যান্ডসেক করে)

_ বাহ! ব্যাংকার এবং ইঞ্জিনিয়ার ভালোই তো…তাহলে তো আড্ডা বেশ চলবে…কি বলেন?

~ আরে শুধু চলবে মানে কি! বলেন দৌড়াবে।

_ হাহাহা…তা মন্দ বলেন নি। তো ভাই আপনিনামবেন কোঁথায়?

~ এই বাস সর্বশেষ যে বিন্দুতে গিয়ে স্থির হবে সেটাই আমার গন্তব্য।

_ ওহ…আই মিন খুলনাতে!আরে আমিও তো খুলনায় যাচ্ছি। আমাদের চৌদ্দপুরুষের বসতভিটা ওখানেই। একদম খুলনা শহরেই। আপনিও কি আমাদের এলাকার বাসিন্দা নাকি?

~ নাহ ভাই আমি পুরোদস্তুর ঢাকাইয়া।একেবারে গোঁড়া ঢাকাইয়া বলতে যা বুঝায় আর কি। আর এটাই আমার লাইফের প্রথম খুলনা ট্যুর।

_ ওহ…আচ্ছা…অফিসিয়াল কোন কাজে নাকি অন্যকোন জরুরী দরকারে যাওয়া হচ্ছে?বলা যাবে?

~ নাহ অফিসিয়াল কিছুই না। বিষয়টাআসলে দরকারের চেয়েও ভীষণ দরকারি এবং জরুরীর চেয়েও অধিক জরুরী।

_ ঠিক বুঝলাম না।

~ হাহাহা…অবশ্য আপনার বোঝার কথাও না। আমার জীবনের সবচেয়ে দরকারি এবং জরুরী মানুষটা যে ওখানেই থাকে। যাকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকার কোন অর্থ খুঁজে পাই না। যার জন্য আমি নির্দ্বিধায় সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে পারবো। এককথায় আমার কাছে পুরো পৃথিবী একদিকে আর সে অন্যদিকে। বিগত মাত্র কয়েকটা দিন তাকে দেখিনি বলে এখনো আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আসলে তার জরুরী তলবেই তল্পিতল্পা গুঁটিয়ে তার পানে ছুটছি। সে যে আপনারই এলাকার মানুষ…তাই…

_ বাহ জনাব আপনি তো বেশ রোম্যানটিক। আজকাল প্রিয়জনকে কেউ এতোটা ইম্পরট্যান্স দেয় সেটা জেনে ভীষণ ভালো লাগলো…তো এই হল আপনার খুলনা যাবার রহস্য…?

~ হ্যাঁ…বিএফের সাথে দেখা করতেযাচ্ছি।তার বাসাও খুলনা শহরে। ওরওখানেই উঠবো।যদিও এমনিতে সে ঢাকাতেই থাকে। তবে পারিবারিক একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে সে এখন বাড়িতে আছে।

_ আমি তাহলে মনেমনেঠিকই ধরেছিলাম…জিএফের সাথেই দেখা করতে যাচ্ছেন…হাহাহা…

~ সরি ব্রাদার…আপনি সম্ভবত শুনতে ভুল করেছেন…আমি জিএফ নয়…বিএফ বলেছি…বি এন্ড এফ…দ্যাট মিনস বয়ফ্রেন্ড…বাংলায় বললে ছেলেবন্ধু…আমি একজন গে…নাউ ইটয টোট্যালি ক্লিয়ার টু ইউ?

_ অ্যা আআআ…

~ অ্যা…নয়…হ্যাঁ…আমি একজন সমকামী।

_ কিইই…?…ও আচ্ছা আচ্ছা…বুঝেতে পেরেছি…!(বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে)

~ কি হলোমুখ শুকিয়ে গেলো যে? সমকামী শুনে একেবারে ভড়কে গেলেন মনে হচ্ছে? হাহাহা…

_ তা কিছুটা…আসলে আগে কখনো সরাসরি এমন কাউকে দেখিনি তো তাই একটুবিস্মিত হলাম…

~ আপনি এমনভাবে বলছেন যেন সমকামীরা ভিনগ্রহের কোন প্রাণী। আরে ভাই এরা আপনার মতই মানুষ। আপনার আশেপাশেই কত আছে। কেউ হয়তো প্রকাশ্যে আর কেউ হয়তো অপ্রকাশ্যে। এই যেমন আমি অকপটে স্বীকার করে নিলাম আমি একজন সমকামী।আমার ফ্যামিলি ফ্রেন্ডসরাও আমার বিষয়ে সব জানে।

_ ওহ…তাই নাকি…?

~ জি তাই…।

_ হুমমম…বুঝলাম…

~ নিশ্চয়ই এখন আমাকে দেখে খুব ঘেন্না হচ্ছে তাই না? কথা বলতেও রুচিতে বাঁধছে? আমার মানসিক সুস্থতা নিয়েও আপনার সন্দেহ হচ্ছে? ভাবছেন কি এক আজব চিড়িয়ার পাঁশে বসে আছেন…যার হাত-পা-চোখ-নাক-মুখ সব আপনার মতই কিন্তু রুচি কতটা বিকৃত…হাহাহা…

_ নাহ…ঠিক ঐরকম কিছুনা…ওরকম ভাববো কেন?

~ অনেক সময় কারোকারো চোখমুখের অভিব্যক্তিই তার ভেতোরের কথা বলে দেয়। আচ্ছা আমার কথা বাদ দিন আপনার কথা বলুন…

_ ভাই কিছু মনে কইরেন না…আসলে আমার না এখন একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বলেছিলাম না,বাসে উঠলে আমার ভীষণ এসিডিটির সমস্যা হয়। বমিবমি ভাব জাগে। মাথা ঝিনঝিন করে।

~ হাহাহা…হোহোহো…ইটয ওকে ব্রো…নো প্রবস…সো নাউ ইউ সুড টেইক রেস্ট।

_ কি হলো…ওভাবে হাসলেন যে?

~ আরে ও কিছুনা…এমনিই হাসলাম..আচ্ছা শুনুন…আপনিচাইলে কিন্তু হেডফোন দিয়ে আমার আইপ্যাড থেকে গান শুনতে পারেন। গান শুনলে হয়তো ভালো লাগতে পারে।

_ নো থ্যাংকস। আপনিই শুনুন।এই একটু চুপচাপ থাকলেই আমার ভালো লাগবে।(কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো নাবিল)

………………………………

ব্যতিক্রম চারিত্রিক বৈশিষ্ট এবং ভিন্ন যৌনসত্তার কথাজানার পর নাবিলের আর জায়েদের সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছাই থাকলো না। জায়েদকে এড়িয়ে যাবার জন্যই সে এসিডিটির মিথ্যে অজুহাত দাড় করালো।জায়েদতার লাইফের একান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয় কথাটার সহজ স্বীকারোক্তি করলেও নাবিল সেটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারলো না। নাবিলের কাছে জায়েদকে ভীষণ রকমের মানসিক বিকারগ্রস্থ এবংবিকৃত ও কুরুচির যৌন চরিত্রের বৈশিষ্ট সম্পন্ন একটা ছেলে বলেমনে হল। নইলে কোন সুস্থস্বাভাবিক মানুষ এইভাবে প্রকাশ্যে নিজেকে সমকামী বলে দাবী করতে পারে এটা নাবিলের কল্পনারও অতীত ছিল।শিক্ষিত মার্জিত একটা ছেলে জেনেশুনে এতো বড় একটা অন্যায় ও পাপের কাজ কীভাবে করছে ভেবে জায়েদের উপর ওর ভীষণ রাগ চাপলো।

নাবিল মনেমনে ভাবতে লাগলো যদি সম্ভব হত তাহলে ওকে যথেচ্ছভাবে উত্তমমাধ্যম দিয়ে ওর নোংরা মানসিকতা ছুটিয়ে দিতাম।বেদম মার মেরে ওর কুৎসিত চিন্তাধারার ভূত ছাড়িয়ে দিতাম। ব্যাটা দুশ্চরিত্রের বদমাশ কোথাকার। নাবিল কোনভাবেই ভেবে কূলকিনারা করতে পারছে না যে ছেলেটা দেখতে এতো সুদর্শন,স্মার্ট,আধুনিক। চাইলেই ভুরিভুরি মেয়ে ওর পেছনে লাইন লাগাবে আর সেই ছেলেই কিনা আরেকটা ছেলের পশ্চাৎ মেরে বেড়ায়। ছিছিছি…এরকম হলে ওর উপর আল্লাহর গজব পড়তে আর বেশি দেরি নাই। আর হারামিটা বলে কিনা সে আরেকটা ছেলেকে তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তার জন্য সবকিছু ত্যাগ পর্যন্ত করতে পারে। তবে নাবিল সবচেয়ে অবাক হয় যে ওর পরিবার-পরিজন পর্যন্ত ওর এই বিষয়টা সহজেই মেনে নিয়েছে ভেবে। ওর মতে নিশ্চয়ই হালারপুতের ফ্যামিলিতেও কোন ঝামেলা আছে। হয় হালারপুত একটা বেজন্মা নয়ওর বাপ-মাচৌদ্দগুষ্টিই বোধহয় মানসিক রোগী। নয়তো ওর মতন জাহান্নামের কীটকে কেউ সমর্থন দেয়।

একদিকে জায়েদকে নিয়ে নাবিল মনেমনে ভর্তসনাজপেই চলেছে। অন্যদিকে জায়েদ বেশ আমুদে মেজাজে কানে হেডফোন লাগিয়ে গানের তালেতালে মাথা দোলাচ্ছে আর আইপ্যাডে ফেসবুকিং করছে। হুট করে আইপ্যাডের স্ক্রিনে চোখ পড়তেই নাবিলের চক্ষু যশোরের জামতলার বিখ্যাত রসগোল্লার মত ডাঁসাডাঁসা সাইজের হয়ে গেলো। আড়চোখে তাকিয়ে সে দেখতে পেলো জায়েদের ফেসবুকের নিউজফিডের বেশীরভাগ ছবিই একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে চুমু খাচ্ছে এমন টাইপের।আবার কোন ছবিতে দুইটা পূর্ণ উলঙ্গ ছেলে একেঅপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। তবে নাবিলের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হল যখন সে দেখলো কোন একটা ফটোতে জিম করাশক্তপোক্ত গড়নেরসুশ্রী একটা ছেলের যৌনাঙ্গ তুলনামূলক তার চেয়েওকমবয়সীঅপূর্ব সুদর্শন আরেকটা ছেলের পশ্চাৎ গহ্বরে গুপ্ত।

ছবিটা দেখে নাবিল রীতিমত ভিরমি খেলো। তার নিজের প্রতি নিজেরি ঘেন্না হতে লাগলো এমন জঘন্য চরিত্রের একটা ছেলের পাঁশে বসে তাকে পুরোজার্নি টাইম কাঁটাতে হবে বলে। সে জায়েদের কাছ চেপে গিয়ে জানালার দিকে গা ঘেঁষে বসলো।ক্যারেক্টারলেস এই ছেলেটার কাছ থেকে সহায়তা নিয়েছিলো বলে ও নিজেই নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলো। আর মনেমনে জায়েদকে হাজারো গালাগাল এবং অভিশাপ দিতে ব্যস্ত হলো।

…………………………………

= ভাইয়া তুমি এই বাসেই আসবা আগে জানতাম না তো? (গাড়ি খুলনা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছানোর পর বাস থেকে নামতে দেখে নাবিলের ছোটভাই সীমান্ত চিৎকার করে নাবিলকে উদ্দেশ্য করে বললো)

_ তা জানবি কি করে। আমার তো আসার কথা ছিলো আগামীকাল। কিন্তু হুট করেই অফিস থেকে ছুটি’টা পেয়ে গেলাম তাই আজই চলে আসলাম।

= ও আচ্ছাবুঝেছি…এসেছো ভালোই হয়েছে। বাড়িতে এমনিতেও অনেক কাজ। বোঝোই তো বিয়ে বাড়ি হলে যাহ্‌ হয় আর কি…!

_ হুম সেজন্যই তো আসলাম…তা তুই এ অবেলায় এই বাসস্ট্যান্ডে একাএকা কি করিস? আমিতো আমাকে রিসিভ করার জন্যকাউকে আসতে বলিনি!

= তোমার জন্য আসিনি তো…বড় আপুর বিয়ে উপলক্ষে ঢাকা থেকে আমার খুব ক্লোজ একটা ফ্রেন্ড আসছে।তাকে রিসিভ করতে এসেছি। সেও এই বাসেই এসেছে। তুমিও এই বাসে আসতেছো জানলে তোমার সাথে ওকে পরিচয় করায়ে দিতাম।

_ ও তাই নাকি…ভেরি স্ট্রেঞ্জ! তা কই তোর ফ্রেন্ড। পেয়েছিস?

= বাস থেকে নেমেছে বললো…আচ্ছা তুমি একটু দাড়াও। আমি ওকে খুঁজে নিয়ে আসছি। তারপর একসাথেই বাসায় ফিরবো,কেমন?

_ ওকে। আমি এ পাঁশেই আছি। তুই জলদি আসিস।

…………………………

জীবিত আর মৃত মানুষের মধ্যে দূরত্ব কেবল প্রাণের। প্রখর খরতাপের মধ্যে থেকেও মঙ্গোলিয়ার মত হিমাংকের নিচের শীতলতা অনুভব করার অনুভূতি কেবল একজন মৃতব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারেন। নাবিলের কাছে নিজেকেই হয়তো স্বয়ং সেরকম এক জীবন্তলাশ অনুভূত হতে লাগলো যখন সত্যটা সে স্বচক্ষেই দেখলো। হাজারো লোকের ভিড়ে সীমান্তের আগন্তুক অনুসন্ধিৎসুচোখ দুটিজায়েদকেই খুঁজে নিলো। সীমান্ত জায়েদের কাছে ঘেঁষতেই জায়েদ হ্যাঁচকাটানে সীমান্তকে বুকে জড়িয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে কপালে একটা মৃদু চুমু খেলো। আর সীমান্তও যেন পরম মমতায় জায়েদের বুকে আছড়ে পড়লো।ভেতোরে চেপে রাখা বহুদিনের চাপা দীর্ঘশ্বাসটুকু সজীব নিঃশ্বাসের মত জায়েদের বুকে ছেঁড়ে দিলো।সীমান্তের ঠোঁট জুড়েবন্দী পাখির খাঁচাহীন হবার স্বাধীনতার সুখ। আর জায়েদের চোখেমুখে ভালোবেসে আরো গভীর ভালোবাসায় পড়ারতৃপ্তির রেখা।দিনদুপুরে ভরা মজলিশে সীমান্ত আর জায়েদের এমন কেমিস্ট্রি নাবিলের কাছে বেশ বিব্রতকর ঠেকলো। আর কেউ না বুঝুক পর্দার অন্তরালের মূল রহস্য সেতো ঠিকই জানে।

তাই অদূরে দাঁড়িয়ে নাবিলের নিজের চোখকে বিশ্বাস করা ছাড়া আর কিছুই করার সাহস ছিল না। অপ্রত্যাশিত দৃশ্য অবলোকনে শরীরের শক্তিরাও এমন দুর্বলতার মাতম তুললো যেহাঁতেধরে থাকা সামান্য ট্র্যাভেল ব্যাগটাও আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে মাটিতে লুটালো।রাজ্যের ভাবনাগুলো তার মস্তিষ্কে ভর করে ঘণ্টা পিটিয়ে কেবল ওই একটা শব্দই বারবার উচ্চারণ করছিল‘সমকামী’। তার নিজের আপন ভাইও একজন সমকামী। একজন গে। একজন বিকৃত যৌনচারি।

হঠাৎ সীমান্তের ডাকে নাবিল সম্বিৎ ফিরে পেলো। দেখলো সীমান্তের ডান হাঁতে জায়েদের ব্যাগ আর বাম হাতটা জায়েদের হাতের সাথে শক্ত করে পেঁচিয়ে হাসজ্জল মুখে আলাপ করতে করতেওরা তার দিকেই আসছে। আর সাধারণ কতগুলো ছেলেদের মত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে হয়তো জনসম্মুখে ওদের এ আচরণ সে খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিত কিন্তু দৃশ্যটা নাবিলের কাছে ছিল চরম লজ্জাজনক এবং অসস্তিকর।তাই সে সীমান্তের ডাকে কোনরূপ সাড়া না দিয়ে পেছন ঘুরে হাঁটতে আরম্ভ করলো।

ঠিক তখনি জিজ্ঞাসা’রা চারদিক থেকে তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণে নাবিলকে বিধ্বস্ত করতে শুরু করলো। শতসহস্র জিজ্ঞাসা সমস্বরে চিৎকার করে নাবিলের কাছেজানতে চাইলো…জায়েদের ব্যতিক্রমী যৌনতা জানার পরতার অস্তিত্বের প্রতি…তার পরিবারের প্রতি…তার মানসিক অবস্থার প্রতি…নাবিলের ভেতোরে যে চরম ঘৃণা জন্মেছে…ঠিক একই দোষে দুষ্ট রক্তের সম্পর্কেরআপন ভাইকেও কি তেমনিভাবে ঘৃণা করতে পারবে সে?

ঘৃণা কি সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য নাকি সম্পর্কভেদে পক্ষপাত দুষ্ট?

একই পাপের জন্য অভিশাপ-আশীর্বাদ কি সমান্তরালে চলতে পারে?

সমঅপরাধে একজনকে ঘৃণ্যতমভেবে দূরে ঠেলে অন্যজনকে কি আপনবলে মেনে নিতে পারবে?

ওদের জীবন ওদের স্বাধীনতা ওরা ওদের মত করে ভালবাসতে পারলে পৃথিবী কিংবা তোমাদের মেনে নিতে সমস্যা কোঁথায়?

লোকারণ্য বাস-স্টপেজের সমস্ত কোলাহল ডিঙিয়ে জিজ্ঞাসাদের প্রশ্নগুলোই কেবল নাবিলের কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।সে সামনে এগোতে পারছিল না। চতুর্দিক থেকে জিজ্ঞাসা বোধক চিহ্নগুলো ওর পা দুটিকে মাটির সাথে তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে যেতে বলছিলো।

*সমাপ্ত*

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.