
গাঙ চিল
((ঢাকার অদূরে কোন এক মফস্বল শহরের, একটি মধ্যবিত্ত ও সুখী পরিবারের ঘটনা বলছি))
একঃ
> মা! ও মা! আমি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি!… বাবা,তুমি যাবেনা আমার সাথে?
~ তোর বাবার খাওয়া প্রায় শেষ! এক্টু দেরি কর, একসাথেই যাস!
— আর দেরি করতে হবে না॥ আমিও চলে এসেছি॥ চল বাপ, তোকে দিয়ে আসি॥ আজ তোর “এইচ.এস.সি” পরীক্ষার প্রথম দিন বলে কথা! তবে,পরীক্ষা কিন্তু ভালো হওয়া চাই ই চাই! “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে” চান্স পাইতে হবে কিন্তু! আমাদের একটা মাত্র সন্তান তুই,আমাদের ঘরের আলো॥ আমার আর তোর মায়ের সব স্বপ্ন যে তোকে ঘিরেই রে বাপ !
> পরীক্ষা ভালো করেই দিতে চেষ্টা করবো,বাবা! রেজাল্ট ভালো আসলে কি দিবা বলো?
— তুই কি চাস বল? আমার শেষ নিঃশ্বাস থাকতে তোর চাওয়া পূরণ করতে চেষ্টা করবো!
> আমি একটা DSLR চাই॥ আমার বন্ধুরা দেখি অনেকেই DSLR দিয়ে ছবি তুলে, কত সুন্দর লাগে ওদের সেই ছবিতে! দিবা বাবা, একটা DSLR কিনে?
[[কথাটি শুনে বাবা,মায়ের দিকে তাকালো]]
~ আমার মুগ্ধ বাপজানরে তো এমনিতেই রাজপুত্তুরের মতো দেখতে! আর ঐ ক্যামেরা দিয়া ছবি তুললে তো আমার বাপটারে একদম নায়ক “ঋত্বিক রওশন”এর মতো লাগবে!
— হ! ঠিকই কইছ মুগ্ধের মা॥ বাপজান তুমি পরীক্ষা দাও ভালো করে,আমি তোমারে কয়েক মাসের মধ্যে DSLR কিনে দিব!
…….তারপর বাবার সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে গেল মুগ্ধ !!!
((ঠিকই ধরেছেন,গল্পের মূল চরিত্র মুগ্ধ!! যার বাবা কাজ করেন একটি গার্মেন্টেসে, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে!! আর তার মা হলেন গৃহিনী!! বাবার বেতনেই চলে তাদের সংসার এবং মুগ্ধের লেখাপড়া! তবে মা-বাবা কখনো তাকে অভাব বুঝতে দেয়নি॥ একমাত্র সন্তান হওয়ায় মুগ্ধের কোন চাওয়াই অপূর্ণ রাখেনা তারা! তাই হয়তো সেদিন, সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও দামি কিছু একটা চাইতে পেরেছিল মুগ্ধ))
দুইঃ
তিন মাস পর……
> মা, মা! বাবা, ও বাবা! আমার রেজাল্ট দিছে!! আমি “গোল্ডেন এ-প্লাস” পাইছি! ((মুগ্ধের কথা কানে যেতেই রুম থেকে ছুটে চলে আসেন তারা! বাবা-মা দুজনের কেউই সারারাত ঘুমাতে পারেননি! এসেই জড়িয়ে ধরে মুগ্ধকে))
~ তোমারে বলছিলাম না মুগ্ধের বাপ! আমার ছেলে ভালো রেজাল্ট করবে!
— ছেলেটা মনে হয় শুধুই তোমার? আয় বাপ,আমার বুকে আয়!!
[[মুগ্ধকে বুকে টেনে নিয়েই কেঁদে দিলেন বাবা॥ কাঁদলো মুগ্ধ আর সাথে তার মা ও]] একটু পরেই মুগ্ধ,
> “আমাকে মিষ্টি মুখ করাবা না?”
~ তোর বাবা সকালে গিয়েই পাঁচ কেজি মিষ্টি নিয়ে আসছে॥ তুই ভালো রেজাল্ট করবি এটা তোর বাবার বিশ্বাস ছিল!
[[বাবার দিকে তাকাতেই মুগ্ধ দেখল, আনন্দে আর গর্বে বাবার চোখ দিয়ে জল পড়েই যাচ্ছে॥ বাবার কাছে গেল মুগ্ধ….. চোখের জল মুছে দিতেই আবারো মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন বাবা….. সেদিনই প্রথম মুগ্ধ বুঝতে পেরেছিল তার বাবা-মা’র কাছে সে কতোটা দামি]]
পরিবেশ টা স্বাভাবিক করতে মা বললেন, “বাপ ছেলে মিলে আর কতো কান্নাকাটি করবা? এই নাও এবার মিষ্টি খাওয়ায় ছেলেকে!”
তিনঃ
মুগ্ধ ভালো রেজাল্ট করার জন্য বাবা এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিতে দাওয়াত করে খাওয়ালেন ॥ দুপুরে সবাই এলেন ॥ খাওয়া দাওয়া শেষে বিকালে,বাবা সবার সাথে মুগ্ধকে পরিচয় করিয়ে দেয় ॥ তাদের মধ্যেই একজন ছিলেন এলাকার চেয়ারম্যান ॥ যার নাম জাহাঙ্গীর হোসেন ॥ বেশ হাসি খুশি এবং মিশুক ভাবেই সবার সাথে কথা বলছিলেন তিনি ॥ সেদিনও কি কেউ জানতো যে, এই লোকটিই মুগ্ধের জীবন পাল্টে দিবে?!
সেদিন মাগরিবের নামাজের আগেই সবাই চলে গেল!! তারপর নিজেদের এলাকাতেই সেই জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে মুগ্ধের! দেখা হলেই সে কেমন জানি শরীরের কাছে ঘেঁষে বসে! বিষয় টা মুগ্ধের বিরক্ত লাগতো কিন্তু কিছু বলার সাহস পেত না! কথা প্রসঙ্গে জানা যায় যে তিনি অবিবাহিত!
চারঃ
কয়েকদিন পর রাতে খেতে বসে মুগ্ধ বাবাকে বললো……
> বাবা, কি ব্যাপার? আমার DSLR কই? ঐ ভূত কিন্তু আমার মাথা থেকে এখনো যায়নি! — সবুর কর বাপ! তুই চাইছিস আর আমি দিবনা,এটা কখনো হয়?
কোন এক অজানা কারণে, সেদিন মা এক্টু রেগে গিয়েই বললেন…..
~ এইসব ভূত এখন মাথা থেকে নামাও! এত কম বয়সে তোমার DSLR না কিনলেও চলে॥তাও তুমি আবদার করেছ বলে,তোমার বাবা মানা করেনি॥ তুমি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছো,কিছুটা হলেও তোমার পরিবারের কথা ভাবা উচিত॥তোমার আবদার রাখতে নিশ্চই তোমার বাবা……..
মা’কে থামিয়ে বাবা বললেন, — কি শুরু করছো ছেলেটার সাথে? চুপ থাকো তো!
[[মা এমন কি বলতে চেয়েছিলেন যে,বাবা তাকে থামিয়ে দিলেন? সেদিন মুগ্ধ এটা বুঝতে পারেনি॥ মায়ের মুখে কড়া কথা শুনে সেদিনই মুগ্ধ প্রথম বুঝতে পারল যে,কষ্ট বলতেও কিছু একটা আছে! খুব জেদ হলো তার সেদিন]]
পাঁচঃ
পরেরদিন সকালে আবার সেই জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে দেখা মুগ্ধের….
__ কোথায় যাও?
> জানিনা
__ কেন কি হয়েছে? বাসা থেকে রাগ করে এসেছ নাকি?
> তেমন কিছু না (ইতস্তত কণ্ঠে)
__ কি হইছে বলো তো শুনি?
> না,আংকেল ॥ এগুলো আমাদের পারিবারিক ব্যাপার॥
__ আমি যদি তোমার পরিবারের কেউ হতাম তাহলেও কি আমাকে বলতে না? তুমি আমাকে বলতে পারো॥ আমি কাউকে কিছু বলব না॥
[[তারপর মুগ্ধ গতরাতের সব কথা খুলে বলে জাহাঙ্গীর কে! কিন্তু এটাই যে তার জীবনের কালো অধ্যায়ের সূত্রপাত হবে, সেটা কি আর সেদিন সে বুঝেছিল]]
সব কথা শুনে জাহাঙ্গীর,
__ আরে, শুধু একটা DSLR? এটা আমিই তোমাকে দিব!
> আপনি কেন দিবেন আমাকে?
__ আমাকে তুমি আংকেল বলো তাই॥ তবে,আজ থেকে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে! [[মুগ্ধ ঐদিন অনেক খুশি হয়েছিল এটা ভেবে যে, জাহাঙ্গীর যদি তাকে DSLR টা কিনে দেয় তাহলে মা-বাবার আর কষ্ট করতে হবেনা তার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য]]
হঠাৎ করেই…..
__ কি ভাবছ মুগ্ধ?
> কই! কিছু না!
__ যাই হোক! তুমি কি ঢাঃবিঃ তে ভর্তি হতে চাও?
> হ্যাঁ॥ এটা আমার বাবা-মায়ের স্বপ্ন! আর আমি চাই তাদের এই স্বপ্নটা পূরণ করতে॥
__ কিন্তু কীভাবে করবা? শহরে থেকে ভর্তি কোচিং করেও হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী চান্স পায় না,আর তুমি এখানে থেকে কীভাবে কি করবে? ওখানে চান্স পেতে হলে ভালো কোথাও কোচিং করতে হবে তোমার॥ এই যেমন – ইউসিসি/ইউনিএইড ভর্তি কোচিং॥ তার জন্য তো তোমাকে ঢাকা যেতে হবে॥
> কিন্তু আমি যে ঢাকার কিছুই চিনি না! যাই ও নাই কখনো!
__ তো কি হয়েছে? আমি আছি না? আমি তোমাকে নিয়ে যাব! সামনের সপ্তাহে আমার পলিটিকাল একটা কাজে ঢাকা যেতে হবে॥ তুমি চাইলে আমার সাথে যেতে পারো॥ তবে,তোমার মা-বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার॥ আরো একবার ভেবে দেখ, ঢাকা গেলে তোমার মা-বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে আবার তোমার ইচ্ছা অর্থাৎ DSLR টাও ওখান থেকেই তোমাকে কিনে দিব আমি॥
ছয়ঃ
বাবা-মা’কে মুগ্ধ জানালো যে, সে ঢাকা যেতে চায় ভর্তি কোচিং করার জন্য॥ আর জাহাঙ্গীর তাকে DSLR কিনে দিতে চেয়েছে এটা বললো না মা-বাবা’কে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য॥ আর তারাও ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাকে ঢাকা যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলেন॥ কিন্তু, বাবা বললেন…..
__ তুই থাকবি কোথায় ওখানে গিয়ে? আমাদের তো কোন আত্মীয় স্বজনও ওখানে নেই! > তুমি চিন্তা করোনা তো বাবা! জাহাঙ্গীর আংকেল ও ঢাকা যাচ্ছেন॥ আমি তার সাথেই চলে যাব॥ আর আংকেল কে বলব, আমার জন্য একটা রুম ঠিক করে দিতে॥ তাহলেই তো হবে নাকি?
__ জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে তোর কথা হইছে এই বিষয়ে?
> হ্যাঁ॥ __ তাইলে আর চিন্তা নাই॥ তুই যেতে পারিস ওনার সাথে॥ আমি আর তোর মা মাঝে মাঝে গিয়ে তোকে দেখে আসব বাপ! কখনো তো তোকে ছাড়া থাকি নাই, তাই এক্টু কষ্ট হবে॥ তবে, তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এই কষ্টটা ভুলে থাকতে পারবো॥ তুই শুধু মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া টা করিস॥ এটাই তোর কাছে চাওয়া॥ অবশেষে মুগ্ধ, জাহাঙ্গীর এর সাথে রওয়ানা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে….
সাতঃ
মুগ্ধের মাঝে কিছুটা ভীতি আর বিস্ময় কাজ করছিল নতুন শহর আর স্বপ্নের DSLR নিয়ে!! ঢাকায় পৌঁছতে বিকাল হয়ে গেল॥ অতঃপর জাহাঙ্গীর, মুগ্ধকে নিয়ে উঠলো বিলাসবহুল এক আবাসিক হোটেলে॥ সেখানে গিয়েই হোটেলের সাজসজ্জা, আর বাহারি রকমের ডেকোরেশন এবং দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জা দেখে অবাক হয় মুগ্ধ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে॥ সে যেন কোন এক স্বপ্নপুরীতে চলে এসেছে॥ আর সেখানের একেকজন ফরেনারকে দেখে সে যেন সাক্ষাৎ দেবদূত দেখছে,এমন একটা অবস্থা॥ কিন্তু, তার এই স্বপ্নপুরী তেই যে আর কিছুসময়ের মধ্যে তার জীবন ধ্বংসের বীজ বপন করা হবে,সেটা তখনো তার অজানা……. খাওয়া দাওয়া শেষে তারা এক রুমে গেল॥ এক বেডের বিশাল এক রুম॥ সেখানে জাহাঙ্গীর আর তাকে একসাথেই থাকতে হবে॥ এই প্রথম মা-বাবা’কে ছাড়া অন্য কারো সাথে বেড শেয়ার করতে হবে,এটা ভেবতেই কেমন জানি মনমরা হয়ে যায় মুগ্ধ॥ রাতে শুয়ে শুয়েই জাহাঙ্গীর বলছে…….
__ কেমন লাগছে জায়গাটা?
> ভালোই॥ তবে,বাবা-মা’র কথা খুব মনে পড়ছে। আর দুই-একের ভিতরই আমাকে একটা রুম ঠিক করে দিয়েন,আমি সেখানে থেকেই লেখাপড়া করব!
__ এখন কি এসব না বললে হয় না? এসব বাদ দাও তো!আর তুমি কি জানো এখানের অনেক ফরেনার তোমাকে পছন্দ করেছে!!
>> তারা আমাকে পছন্দ করবে কেন?
__ তাদের মনোরঞ্জনের জন্য!! কি পারবে না?
>> মানে? আমি কীভাবে আর কেনই বা তাদের মনোরঞ্জন করতে যাব? আমি ঢাকা আসছি আপনার সাথে,তাও লেখাপড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে!!
__ কীভাবে মনোরঞ্জন করতে হয় দেখবা?
এই বলেই জাহাঙ্গীর ঝাপিয়ে পড়ে মুগ্ধের উপর!! মুগ্ধ চিৎকার করতে গেলে ওর মুখ চেপে ধরে জাহাঙ্গীর॥ আর বলতে থাকে……
__ লাভ নাই চিৎকার করে! কেউ আসবে না! আর আসলে, একসাথে সবার মনোরঞ্জন করতে হবে! পারবা তো?
সেদিন ভয়ে চুপ হয়ে যায় মুগ্ধ! সেই রাতের সাক্ষী হয়ে থাকে মুগ্ধের চোখের জলে ভেজা বালিশ, রক্তাক্ত বেডশিট আর জাহাঙ্গীরের শরীরের কিছু আঁচড়ের দাগ ॥ মুগ্ধের বোবা কান্না আর জাহাঙ্গীরের বেডে ঝড় তোলার শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে চারপাশ ভারি হয়ে উঠেছিল……….
আটঃ
পরের দিন সকালে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না মুগ্ধ॥ রক্তমাখা বেডশিট দেখে নিজেই আতকে উঠে সে॥ আর ভাবতে থাকে,একটা সামান্য DSLR এর জন্য এই প্রতিদান দিতে হলো॥ নিজের প্রতি ঘৃণা হয় তার॥ হঠাৎ বাইরে থেকে জাহাঙ্গীর রুমে আসে,আর বলে……
__ কি এইবার বুঝছ তো কীভাবে মনোরঞ্জন করতে হয়? তবে,যাই বলো-আমি সন্তুষ্ট! ব্যাপক মজা পাইছি গতরাতে॥ এমন মজা যদি ফরেনাররা পায় তাহলে বাজারে তোমার চড়া দাম উঠবে॥
চুপ হয়ে শুধু কথাগুলো শুনছে মুগ্ধ আর চোখের পানি ফেলেই যাচ্ছে……
হঠাৎ একটা ফোন আসে জাহাঙ্গীরের॥ কথার ধরণ শুনে মুগ্ধ এবার বুঝতে পারল যে, “আজ রাতে তাকে অন্য কারো মনোরঞ্জন করতে হবে॥ আর সেই জন্য দরদাম করছে জাহাঙ্গীর” কথার মাঝখানেই সে মুগ্ধ কে বলে……
__ তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও॥ আমি আসছি এক্টু বাইরে থেকে॥
জাহাঙ্গীর রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে অনেক কষ্টে মুগ্ধ বেড থেকে উঠে দরজার কাছে যায় পালিয়ে যাবে বলে॥ কিন্তু, জাহাঙ্গীর তাকে আটকে রেখে গিয়েছিল রুমে……. পালাতে গিয়েও পারল না সে॥
সারাদিন মুগ্ধকে চোখে চোখে রাখতে থাকে জাহাঙ্গীর॥ একরকমের গৃহবন্দি অবস্থা তার॥ খুব কান্না করে মা-বাবার কথা মনে করে॥ কিন্তু,আজ তার কান্না মুছে দেয়ার কেউ নেই॥
রাত হয়….. খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে আসে তারা….. আজ মুগ্ধের শয্যাসঙ্গী হয় কোন এক ফরেনার ॥ আর জাহাঙ্গীর রুম থেকে যাওয়ার সময় তাকে এই বলে শাষিয়ে যায় যে, “যদি খুশি করতে না পারো তাহলে কিন্তু খবর আছে”…..
অতঃপর, বাধ্য হয়ে থাকতে হয় সেই ফরেনারের সাথেও॥ অনেক আকুতি করেও মুগ্ধ নিস্তার পায়নি তার কাছ থেকেও॥ প্রথমে যেই ফরেনারদের দেখে মুগ্ধ স্বর্গের দেবদূত মনে করেছিল, আজ তাদের আজরাইল মনে হচ্ছে॥ পরেরদিন সকালে হঠাৎ একটা ফোন আসে জাহাঙ্গীরের কাছে॥ফোন টা করেছিল মুগ্ধের বাবা!! এটা বুঝতে পেরে মুগ্ধের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে॥ বাবার সাথে কথা বলার জন্য জাহাঙ্গীরের পায়ে ধরে সে,কিন্তু জাহাঙ্গীর তার বাবাকে বলে……
__ ভাইজান,এতো টেনশন নিয়েন না॥ আমি গতকালই মুগ্ধকে কোচিং এ ভর্তি করে দিছি॥ ও অনেক ভালো আছে॥ ও তো এখন কোচিং এ গেছে॥আসলে পরে কথা বইলেন॥আর মুগ্ধ এখন ওর লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেছে,আপনাদের কথা এই দুইদিনে তেমন একটা বলেও নাই॥
কথাটা শুনে অনেক কষ্ট পায় বাবা !! আর এদিকে মুগ্ধ কেঁদেই চলেছে……. মুগ্ধ হঠাৎই বাবা বলে চিৎকার দেয়ার সাথে সাথে জাহাঙ্গীর ওকে একটা থাপ্পড় মেরে বাইরে চলে যায় !!
— “জাহাঙ্গীর ভাই,আমি মনে হয় মুগ্ধের কণ্ঠ শুনলাম॥ আপনি বললেন যে ও কোচিং এ গেছে”
__ আরে না ভাইজান! ছেলের জন্য আপনার মন উতলা হয়ে আছে তো তাই এমন হচ্ছে॥ ওর আওয়াজ শুনবেন কীভাবে? ও তো এখন কোচিং করতেছে ইউসিসি তে॥ সবচেয়ে ভালো কোচিং এ ওকে ভর্তি করে দিয়েছি॥
— আমার বাপজান টারে এক্টু দেখে রাইখেন।। আপনার ভরসাতেই তো ওকে পাঠাইলাম ঢাকায়॥ আমাদের ছাড়া কখনো থাকে নাই তো তাই ওরে এক্টু বেশি সময় দিয়েন ভাই॥
__ তা বলতে হবে না ভাইজান॥ আমি ওকে সবসময় চোখে চোখে রাখি॥ আপনি এত চিন্তা কইরেন না তো॥ আচ্ছা, আজ রাখি তাহলে॥ পরে আবার কথা হবে॥
কথা শেষে,রুমে গিয়ে জাহাঙ্গীর দেখল মুগ্ধ কাঁদছে। তারপর বললো….
__ তোমার বাবা বলছে তোমাকে বেশি সময় দিতে॥ আসো এক্টু সময় দেই তোমাকে॥ রাতে তো আবার অন্য কেউ সময় দিবে তোমাকে…….
নয়ঃ
এভাবে কেটে যায় একটা সপ্তাহ॥ প্রতিদিনই মুগ্ধকে অন্যদের মনোরঞ্জন করতে হচ্ছে।। আর ঐদিকে ছেলে তাদের ভুলতে বসেছে বলে বাবা-মা অভিমান করে জাহাঙ্গীরের নম্বরে আর ফোনও দেয় না॥ হঠাৎ করেই বাবা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন॥ মা ফোন দেয় জাহাঙ্গীরের নম্বরে এবং তাকে বলে, সে যেন মুগ্ধকে বাড়ি যেতে বলে॥ এই খবরটিও অজানা থাকে মুগ্ধের॥ তাও,কোন সাড়া না পেয়ে মুগ্ধের বাবা-মা আস্তে আস্তে চিন্তায় পড়ে যায়॥ প্রায় একমাস পেরিয়ে যায় দেখতে দেখতে,কিন্তু তাদের প্রাণপ্রিয় ছেলের সাথে তাদের কথা হয়না॥ বাবা জাহাঙ্গীরের নম্বরে ফোন দিয়ে ঠিকানা চায়॥ এবার জাহাঙ্গীরের কিছুটা ভয় হয়॥ কেটে দেয় ফোন……..
বাবা-মা উতলা হয়ে ওঠেন এবার॥ গ্রামের অন্যান্য পলিটিকাল লিডারদের বিষয় টা জানান॥ তারাও একটা হস্তক্ষেপ নেয় কিছু করার॥
এদিকে আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মুগ্ধ॥ আজ তার কোন স্বপ্ন নেই॥ শুধু মা-বাবার বুকে ফিরে যেতে চায় সে॥ হঠাৎ একদিন জ্বর উঠলো তার॥ সেই জ্বর কিছুতেই কমছেনা!! অবশেষে একপ্রকারের বাধ্য হয়েই জাহাঙ্গীর তাকে শহরের একটা নামি হসপিটালে নিয়ে যায়॥
অনেক টেস্ট-পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে, অবশেষে রিপোর্ট আসে!! রিপোর্টে যা এসেছে তা জানার জন্য মুগ্ধ বা জাহাঙ্গীর কেউই হয়তো প্রস্তুত ছিল না॥ ডাক্তার বললেন….. “মুগ্ধের এইচ.আই.ভি পজেটিভ” কথাটা শুনে জাহাঙ্গীর রীতিমতো ধমকাতে শুরু করলেন মুগ্ধকে, তাও ডাক্তারের সামনে (ভালো সাজার চেষ্টায়) !! আর, মুগ্ধের কথা নাই বা বললাম! শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো…………..
অতঃপর মুগ্ধকে নিয়ে দ্রুত গতিতে সেখান থেকে প্রস্থান করে॥ হোটেলে যায় তারা॥ ঐরাতে কারোরই ঘুম হয়না॥ জাহাঙ্গীর ভাবে, “তার সোনার ডিম পাড়া হাঁস দিয়ে সে আর ডিম পাড়াতে পারবে না! অন্যদিকে গ্রামের রাজনৈতিক ক্ষমতা টাও হারাতে হলো! এমন কিছু হবে সেটা সেও ভাবেনি”।
অপরদিকে মুগ্ধ ভাবছে, “তার বাবা-মায়ের কথা! তাকে ঘিরে তাদের স্বপ্নের কথা! তার DSLR এর স্বপ্নপূরণে বাবার করা অঙ্গীকারের কথা! রেজাল্ট নিয়ে আসার পরে মা-বাবার কান্নাজড়িত মুখটা আজ ভেসে উঠছে তার সামনে বারবার!” সবকিছু ভেবে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় সে….. “এই মুখ কীভাবে সে তার বাবা-মা’কে দেখাবে? তার তো জীবনের আর কোন মূল্যই নেই! আজ যে সব শেষ হয়ে গেল! কীভাবে পূরণ করবে তার মা-বাবার স্বপ্ন?”
” মৃত্যু যে তার সুনিশ্চিত! তার DSLR এর এই একটা স্বপ্নপূরণে যে তাকে এতবড় মাশুল দিতে হবে এবং মা-বাবার স্বপ্নপূরণে এমন প্রাচীর সৃষ্টি করবে,সেটা তো সে কখনো ভাবেনি॥ তাহলে, এমন স্বপ্ন সে দেখতোই না কখনো॥ আজ খুব খুব বেশি রাগ হচ্ছে তার জাহাঙ্গীরের উপর! এই একটা ব্যক্তির জন্য তার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে? কিন্তু, সে কোন শাস্তি পাবে না? এটা তো হতে পারে না!” নিজের মনে মনে এমন হাজারো চিন্তা-ভাবনা করতে করতে ফজরের আযান কানে এলো তার…….
জাহাঙ্গীরের দিকে তাকিয়ে সে দেখল যে, জাহাঙ্গীর ঘুমানোর চেষ্টা করছে!! তারপর মুগ্ধ গেল বাথরুমে! বের হয়ে সেও ঘুমাতে গেল….. ……………………………..
পরের দিন সকালে, সকল পত্রিকার হেডলাইন…… ** রাজধানীর কোন এক অভিজাত হোটেলে যুবকের হাতে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি খুন !! অতঃপর যুবকের আত্মহনন !**
চারিদিকে হইচই পড়ে যায়॥ সাংবাদিক,ফটোগ্রাফার চলে আসে মুহূর্তের মাঝেই॥ পত্রিকায় ছবি ছাপা হয় তাদের॥ জানা যায়, মুগ্ধ বাথরুমের আয়নার কাঁচ ভেঙে তা দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে জাহাঙ্গীর কে॥ তারপর,সেই কাঁচ দিয়েই নিজের হাতের রগ কেটে আত্মহনন করে মুগ্ধ॥
বাবা-মা এবং এলাকাবাসী পত্রিকা এবং সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারে এই ঘটনা॥ অবশেষে ছুটে যায় হসপিটালে॥ তখনো যে তারা বুঝতে পারেনি, তাদের আদরের বাপজান আর নেই॥ তাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে সে॥
পাগলপ্রায় বাবা-মা হসপিটালে আসার সময় নিয়ে আসে মুগ্ধের স্বপ্নের সেই DSLR !! এসে যখন তারা দেখে তাদের মুগ্ধ কে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, তখন যেন তাদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়॥ নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না তারা॥ কান্নায় ফেটে পড়ে তারা দুজন॥ মা মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে…… “বাপজান, তোর ইচ্ছা ছিল DSLR দিয়া ছবি তুলবি! বাপ আমার, ওঠ! তিনজন মিলে একখান ছবি তুলি! ওঠ বাপ! তোর বাবা নিজের একটা কিডনির সমস্যার কথা তোকে কখনো জানায় নাই॥ আমি জানাইতে গেছি তাও আমারে বলতে দেয় নাই॥ সে নিজে এত দামি দামি ওষুধ না খাইয়া সেই টাকা জমাইয়া তোর জন্য এই DSLR কিনছে!আর তুই সেই ক্যামেরা দিয়ে ছবি না তুলে চলে যাবি? এইডা কিন্তু ঠিক না বাপ! তুই না বলছিলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমাদের স্বপ্নপূরণ করবি? এসব না করে তুই কীভাবে যাবি? কি এমন হইছিল তোর? আমাদের কেন একবার বললি না? কেন এমন করলি?”
এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর জানতে ব্যাকুল আজ মায়ের হৃদয়॥ কিন্তু, উত্তর যে আজ নেই……..
~ ও মুগ্ধের বাপ,তোমার ছেলে কথা কয় না কেন? ওরে ডাকো! তোমার সব কথা তো ও শুনে! ওরে একবার ডাকো না!
বাবার গায়ে হালকা ধাক্কা দিতেই মেঝেতে গড়িয়ে পড়েন তিনি…… ডাক্তার চেক করে বলে, “হার্ট এটাক করেছেন তিনি! ছেলের এই পরিণতি সহ্য করতে না পেরে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন!”
এরই মধ্যে সেখানের কর্তব্যরত এক পুলিশ এসে মায়ের হাতে একটা চিঠি দিয়ে যায়! যা ছিল মুগ্ধের লেখা……….
“মা ও বাবা,
যখন তোমাদের কাছে আমার এই চিঠি যাবে,তখন আমি চলে যাব না ফেরার দেশে!অনেক প্রশ্ন তোমাদের মনে আসবে,কেন আমি এমন করলাম?তোমরা এটা জানো না যে,জাহাঙ্গীর আমাকে ঢাকায় এনেছে DSLR দিবে বলে,আর আমাকে কোচিং এ ভর্তি করবে বলে॥কিন্তু,আসার পর থেকে সে শুধু আমার উপর অত্যাচারই করে গেছে॥অন্যদের ভোগ্যসামগ্রীও আমাকে বানিয়েছে।অনেক কেঁদেছি মা॥কিন্তু,আমার কান্না দেখার কেউ ছিল না॥ এভাবে আমি অসুস্থ হয়ে যাই॥ডাক্তারি রিপোর্টে আসে আমি এইডস রোগী॥এই মুখ কীভাবে তোমাদের দেখাতাম বলোতো?আজ অথবা কাল,মৃত্যু যে আমার সুনিশ্চিত!তাই,আমাকে নিয়ে তোমাদের দেখা স্বপ্নগুলোও আমার ইচ্ছা থাকা সত্তেও পূরণ করা সম্ভব হবে না॥তাই,এই সিদ্ধান্ত নিলাম॥আর,আমার মতো আর কোন মুগ্ধের জীবন যেন জাহাঙ্গীরের মতো জানোয়ার নষ্ট করতে না পারে,তাই ওকে শাস্তি দিয়ে গেলাম॥আর আমার একটা শেষ ইচ্ছা আছে! বাবার আমার জন্য DSLR কিনবে সেটা আমি জানি! ঐ DSLR টা দিয়ে যেন আমার লাশের একটা পিক তোলা হয়! তোমরা তোমাদের বাপজান কে এ ছবি টাতেই দেখ!…
চলে যাচ্ছি তোমাদের ছেড়ে! ভালো থেকো তোমরা!!”
বুকে পাথর চেপে মা আজ সন্তানের লাশ আর স্বামীর লাশের মাঝে বসে ছেলের শেষ ইচ্ছা টা পূর্ণ করলো……..
……………সমাপ্ত……………
উৎস: অন্যভুবন