
রুদ্রনীল
৪।
পত্রিকা হাতে করে তাকিয়ে আছেন আনোয়ার সাহেব। চোখেও ভালো দেখতে পাননা। পুরনো চশমাখানা চোখে দিয়েই চলছে অনেকটা বছর। বেশ অনেকদিন হল ঝাপসা দেখছেন। বউমাকে তিনদিন বলা হয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু কে নিয়ে যাবে তাকে ডাক্তারের কাছে। তারা যে সকলে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। আনোয়ার সাহেব এই সংসারে একজন বাড়তি মানুষ ছাড়া কিছুই না আর। কাজের লোকের ও মূল্যায়ন তার থেকে বেশি এ বাড়িতে। একজন অথর্ব বুড়োকে উলটো তিনবেলা খাবার দিতে হচ্ছে ।একখানা কামরা তার জন্য বরাদ্ধ। এ রুমখানা খালি হলে বৈঠকখানা করা হবে । কোন চেয়ার টেবিল থাকবেনা এ ঘরে , চারদিকে সরু কারুকাজের ইটের আস্তরণ দিয়ে, সুন্দর করে লাইটিংস করে, পাশে স্বর্ণলতার জাল দিয়ে বোনা হবে। বিছানো গদি তে গানের আসর বসবে বন্ধুদের নিয়ে, কি যে মজা হবে ,এলিনা ভাবে। বুড়ো মরেও না। হাড় জুড়িয়ে খাচ্ছে। বাপু, ৮৫ বছর তো হল আর কত?
নিজ কানেই শুনেছেন আনোয়ার সাহেব একদিন। টেলিফোনে এলিনা তার মাকে বলছিল এসব কথা।
আনোয়ার সাহেব সেদিন নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কাদলেন, শব্দ করে, বাচ্চাদের মত, তবে সে কান্নার শব্দ কারো কানে পৌঁছেনি। সে চোখের জল কারো হাতে মুছে যায়নি। কোথাও কেউ নেই আনোয়ার সাহেবের যে তাকে একটু শান্তির আশ্রয় দিতে পারে। যে পারে সুন্দর একটা দিন উপহার দিতে।
পত্রিকার একটা শিরোনামে আনোয়ার সাহেবের চোখ আটকে গেল, নিচে একখানা ছবিও দিয়েছে। দুজন পুরুষ বরের বেশে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাসিমুখে। উপরের শিরোনাম “সমকামী বিয়ে বৈধতা পেল আমেরিকায়”। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন খবরটি ।
স্মৃতি ফিরে চলে সেই সবুজ গ্রামে , ধূসর মাঠে। রহমতপুর গ্রামে। যে গ্রামে আনোয়ার সাহেবের জন্ম , বেড়ে উঠা। দুরন্ত সেই ছেলেবেলা , ছুটন্ত সেই কৈশোর। যৌবনের প্রথম সেই শিহরণ , প্রথম পরশ। প্রথম ভালোবাসা। সেই গ্রামের ধানক্ষেতে।
মতিহার ।মতি। মতিয়ার। মতিহারের শুরুর দুই বর্ণ আর আনোয়ারের শেষ দুই বর্ণ মিলে মতিয়ার! নামটা মতি ই দিয়েছিল। সেই সব কত স্মৃতি। কত ভালোলাগা, ভালোবাসার অনুভূতি । দুজন পুরুষের খাটি ভালোবাসা যে কিরকম হতে পারে তা মতির কাছ থেকেই জানা।
আজ মতিকে বড় বেশি প্রয়োজন আনোয়ারের। সে থাকলে কখনই আজ আনোয়ার এর এ কষ্ট দেখতে পারত না।
মতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশ এ মাস্টার্স করে আমেরিকায় ভিসার জন্য আবেদন করে। সাথে আনোয়ারের জন্য ও! মতির স্বপ্ন ছিল আনোয়ারকে সাথে নিয়ে দুজন অন্য এক ভুবনে চলে যাবে। যে জগতে কেউ তাদের অন্য চোখে দেখবে না। যেখানে দুজন মিলে এক ছাদের নিচে থাকতে পারবে। যে ঘরে কেবল তারা ভালোবাসা নিয়ে বাঁচবে।
আনোয়ার এর মা তার দুঃসম্পর্কের বোনের মেয়েকে ছেলের জন্য ঠিক করে রেখেছেন অনেক আগেই। মাতৃভক্ত আনোয়ার মায়ের পিছুটানে বাধা পরল । একদিকে মতি অন্যদিকে মা ।নিজের ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে অনেক কষ্টে মাকে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরিয়ে আনতে আনোয়ার বিয়ে করলেন জাহানারাকে। সময়ের সাথে সাথে এই জাহানারাই আনোয়ার এর ভালোবাসার জায়গাটা অনেক খানি দখল করে নিল। তবে কোথাও এক জায়গায় ঠিক ই মতি তার আসন গেড়ে আছে আজ অব্দি।
মতি সেই যে ভুল বুঝে রাগ করে চলে গেল আর ফিরলনা। অনেক চেষ্টা করেছে আনোয়ার মতির সাথে যোগাযোগ করার। তবু সে তাকে কোন উত্তর দেয়নি।
মতির কাছে আনোয়ারের অনেক ঋণ বাকি আছে।
-মৃত্যুর আগে মতির কাছে যদি একবার যেতে পারতাম। শুনেছি ও ভালোই আছে। সুন্দর, সুঠাম দেহের সেই ধবধবে সাদা মতিয়ার এখনও সেই আগের মতই আছে তো? এখনও আমাকে ভালোবাসে সেই আগের মত?আমাকে যে তার কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় মতিয়ার আমাকে মনে রেখেছে কি? কই আমিতো তাকে ভুলে যাইনি। এখনও মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে মতিয়ার ঠিক যেমনটি জাহানারা।
– এই যে বাবা শুনুন…
আনোয়ার হটাৎ যেন বাস্তব জগতে ফিরে এলেন। হাতে থাকা পত্রিকাটির পাতা চটজলদি গুটিয়ে নিলেন,বউমা তাকে মনোযোগ দিয়ে ওই খবর পরতে দেখে ফেলেছে কিনা কে জানে।
– হ্যাঁ বউমা, বল।
– শুনুন বাবা, আপনার ছেলে বলছিল অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাইনা। আর বাবুর গরমের ছুটি শুরু হবে এইতো পরের সপ্তাহেই । ভাবছি আপনার ছেলে ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে আমরা সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আসব। আপনিতো বুড়ো মানুষ। কি করতে কি করেন, আপনাকে একলা রেখে যেতে পারিনা। আর আপনিতো রবি ভাইয়ের বাসাতেও যেতে চান না। তাই ঠিক করেছি খাদিজার বাসায় আপনাকে রেখে আসব। আর সেটা কালই। ওর সাথে কথা হয়েছে। কিছুদিন ওর ওখানে থাকতে পারবেন। আমাদের অনেক কেনাকাটা আছে। আপনি বরং টুকটাক গুছিয়ে নিন যা নেবার,কাল সকালে আপনাকে রেখে আসব।
৫।
খাদিজা আনোয়ার সাহেবের ছোট মেয়ে। দেশে থাকে এই মেয়ে । স্বামী কাস্টমস অফিসার। অনেক বড় ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। খুব সুখে আছে মেয়ে তার। বাকি দুই মেয়ে দেশের বাইরে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখেই আছে। বাবা ভক্ত খাদিজা। জাহানারা মারা যাবার সময় এই মেয়ে ছোট ছিল। অনেক কষ্টে বড় করেছেন আনোয়ার সাহেব। দেখে শুনে বড় ছেলে ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছে।
- বাবা, তুমি কত বছর পর এলে আমার বাড়িতে। কেমন আছো বাবা। তোমাকে কতদিন পর দেখলাম।
- ভালো আছি মা, তুই কেমন আছিস? তুইতো যাসনা মা ও বাড়িতে ,ভাই-ভাইয়ের বউ এর উপর এতো রাগ করে থাকলে চলে মা। তোরা তো সব এই আমার কোলে পিঠে করেই বড় হয়েছিস । তোর বুড়ো বাপটাকে দেখতে ইচ্ছে হয়না মা?
- হয়ত বাবা, তাইতো যখন তোমার কথা মনে পরে সেই ছবিখানা বের করে দেখি আর কাদি। তোমাকে ফোন করি। একটু কথা বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেই বাবা। যাক ওসব কষ্টের কথা থাক। অনেক দিন পর এসছ। বাবা মেয়ে মিলে এখন কেবল আনন্দ। ইসস বাবা!! তোমার চশমাটার যে কি অবস্থা হয়েছে। পাওয়ারের কাগজটা কই? চশমা বানিয়ে দেবো তোমাকে।
- সে কি আর আছে আমার মা। ৫ বছর ধরে এ চশমা ব্যবহার করছি । ও কবে গেছে!
- ঠিক আছে বাবা, ডাক্তার দেখিয়ে তবে চশমা বানাবো। বাবা, জানি তুমি সকালে আসবে । বেশ অনেক ঘি দিয়ে, সবজি দিয়ে তোমার পছন্দের খিচুড়ি রান্না করেছি। সাথে মাংস। জানি মায়ের মত স্বাদ হয়নি , তবু তোমাকে নিজ হাতে খাওয়াবো বাবা।
আনোয়ার সাহেব চোখের জল ধরে রাখতে পারলেননা। বহুদিন পর কেউ তার খোঁজ খবর নিচ্ছে। কেউ তার ভালো লাগা মন্দ লাগা প্রাধান্য দিচ্ছে। খাদিজা ছোট বাচ্চার মত বাবাকে খাইয়ে দিচ্ছে । বাবা মেয়ে দুইজনেই কাঁদছে। এ কান্না সুখের , এ কান্না প্রাপ্তির।
-এই যে কই গেলে। আমাকে তো অফিসে যেতে হবে নাকি!
আনিস চিৎকার করে উঠে ।খাদিজার স্বামী। কাস্টমস এ কাজ করে বলেই কি মন মেজাজ খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। আগে তো এরকম ছিল না।
-ও বাবা, আপনি এসেছেন । কেমন আছেন ।
- ভালো আছি। তা বাবা আনিস তুমি কেমন আছো?
- ভাল।আমি অফিস যাবো। আপনি তো শুনলাম অনেকদিনের জন্যই এসেছেন। তা কথা হবে পরে। আমি আসছি এখন।
আনোয়ার সাহেব আজ চোখের ডাক্তারের কাছে গেছিলেন। খাদিজা নিয়ে গেছে তাকে ।অনেকদিন পর বাইরে একটু হাটলেন তিনি।
ডাক্তারের ওখান থেকে পার্কে হেটে বেরিয়েছেন মেয়েকে নিয়ে । খাদিজা তাকে আইসক্রিম কিনে দিয়েছে। বুড়ো মানুষ বাচ্চাদের মত চেটে চেটে আইসক্রিম খাচ্ছে দেখে অনেকেই হাসছিলেন। ফিসফিস করে কি যেন বলছিলেন । আনোয়ার সাহেব মজা করে করে আইসক্রিম খেলেন। অনেকদিন তার ইচ্ছে করছিল আইসক্রিম খাওয়ার। কিন্তু আমাদের ধারণা, আমাদের সমাজ মনে হয় নিয়ম বেঁধে দিয়েছে বুড়োদের আইসক্রিম খেতে নেই। আনোয়ার সাহেব আজ নিয়ম ভেঙ্গে বাধন হারা মুক্ত পাখি। মনের ছোট ছোট শখ, ছোট ছোট চাওয়া পূরণ হচ্ছে । মেয়ে অনেক গল্প করল , সুখের দুঃখের। একসাথে থাকাকালীন কত স্মৃতি,কত স্বপ্ন , কত ভালোবাসার গল্প, টুকরো স্মৃতি।
আনোয়ার সাহেব রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়বেন। হটাৎ আনিসের বড় গলা শুনতে পেলেন। খাদিজার সাথে আনিসের ঝগড়া হচ্ছে মনে হয়। এ ঘর থেকে সব কথা শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট।
- প্লিজ তুমি এতো চিৎকার করোনা। বাবা ও ঘর থেকে শুনতে পাবে। আমিতো আর কিছুই চাইনি তোমার কাছে।
- শুনলে শুনুক। ন্যাকামি বন্ধ কর। অনেক হয়েছে। তোমাকে পালছি এখন তোমার বাবাকেও পালতে হবে নাকি আমার? ক্যান তোমার বড় লোক তিন ভাই আছে কি করতে? মেয়ের ঘাড়ে এসে উঠেছে।তাও ভালো যে কিছুদিন থেকে চলে যাবেন।কিন্তু তুমি কি শুরু করলা?ক্যান ওনার চিকিৎসার জন্য ক্যান আমাকে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে?১ পয়সা এনেছি তোমার বাপের বাড়ি থেকে?
- দেখ আনিস আমি তোমার টাকা যেভাবে পারি শোধ করে দেবো । তুমি প্লিজ আমাকে টাকাটা ধার দাও । আমার কাছে যে কোন টাকাই থাকেনা সেতো তুমি জানো! ডাক্তার বলেছে বাবার চোখের অবস্থা খুব ই খারাপ। আরও অনেক আগে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। অপারেশন টা খুব জলদি না করালে বাবা অন্ধ হয়ে যাবে । ২০ হাজার টাকা লাগবে। তুমি প্লিজ না করোনা। আমি তোমার পায়ে পড়ি।
- শোন আমি টাকা দিতে পারবোনা। কাল থেকেই দেখছি , বুড়োকে নিয়ে ঢং শুরু করে দিয়েছ। কেন এতবছর তো কোন খোঁজ নেয়নি । আজ বিপদে পরে আমার বাড়ি এসে উঠেছেন। তাও ভালো কথা… থাকবেন, খাবেন, চলে যাবেন। তবে তার পিছনে আমি কেন টাকা ঢালব?
- আমার গয়নাগুলোতো সব তুমি নিয়ে নিয়েছ। সেখান থেকে একটা গয়না না হয় ব্যাংক থেকে এনে দাও ।এগুলো তো আমার বাবারই দেয়া । কমসে কম ৫০ লাখ টাকা হবে সে গয়নার এখন দাম!
- কি কইলি, হারামজাদী মাগী । তরে অনেকদিন কোন মালিশ দেয়া হয়না তাইনা? তুই বড় বার বাড়ছিস । আমারে তুই গয়নার খোটা দিস! এই বান্দির বাচ্চা কত টাকার গয়না দিসে তোর বাপে?
আনোয়ার সাহেব খাদিজার চিৎকার শুনছেন। বেত দিয়ে তাকে মারছে আনিস।আনোয়ার সাহেব সহ্য করতে পারলেন না আর ।উঠে এলেন। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। খাদিজা বাবাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। ছোটবেলায় বড় ভাই বোন মারলে যেভাবে বাবার বুকে এসে আশ্রয় নিতো ঠিক তেমনি। খাদিজা বাচ্চা খুকির মত জোরে জোরে কাঁদছে বাবাকে ধরে।
- বাবা আনিস, তুমি আর ওকে মেরোনা বাবা । আমার অনেক আদরের মেয়ে। কোনদিন ওকে আমি বা ওর মা মারিনাই। ও তোমার এ মার সহ্য করতে পারবেনা বাবা। ও মরে যাবে। আমার জন্য কোন টাকা লাগবেনা বাবা । তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও। দুদিন ধরে তোমাদের বাড়িতে আছি। তিনবেলা খেতে দিচ্ছ সেটাইত অনেক কিছু! আমি কাল সকালেই চলে যাবো বাবা।
খাদিজা বাচ্চা খুকির মত কেদেই চলেছে। আনোয়ার সাহেব মেয়েকে বুকে আঁকড়ে ধরে আছেন। বুক ফাটা তীব্র কান্না আসছে ভিতর থেকে আনোয়ার সাহেবের। খোদা তুমি আমাকে কেন এখনও নেওনা । আমার আর কত কি দেখতে হবে, আমার আর কত সহ্য করতে হবে?
আনোয়ার সাহেব খাদিজাকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসলেন। মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন।
- বাবা, দুনিয়াটা খুব নিস্থুর বাবা। এখানে… এখানে ভালোবাসার কোন মূল্য নেই । বলতে যেয়ে কথা ধরে এল খাদিজার। ভিতর থেকে চাপা আর্তনাদ। বাবাগো………।। আমি কি তোমার জন্য কিছুই করতে পারবোনা! মেয়ে হয়েছি বলে কি বাবা মায়ের উপর আমার কোন দায়িত্ব পালনের অধিকার আমার নেই বাবা! চোখের সামনে তোমাকে এভাবে মরে যেতে দেখব। আমার মনে যে অনেক কষ্ট বাবা। কেউ নেই বলার। কাউকে জানতেও দেইনা বাবা।
- মা…রে.. মা….তুই আর কাদিস না মা। কত মার খাবি আর।তুই তো মরে যাবি। এই তুই ভালো আছিস মা! তুই অনেক ভালো আছিস তাই না মা!
- হ্যাঁ বাবা, কখনো তোমাদের কিছু বলিনি। সব মুখ বুজে সহ্য করে গেছি । তোমাদের বাড়িতেও যেতে পারিনা কেবল ওই পাষণ্ডটার জন্য। ভাইয়া ভাবির সাথে যে ওর সেই ঝামেলা হয়ছিল তার পর থেকে আমার ও বাড়ি যাওয়া বারণ।
- ভালোই হয়েছে মা।ও বাড়িতে যাওয়ার দরকার নাই। ওখানে সুখ নাই। ওখানে কেবল স্বার্থপরতা। আমি ওদের কাছে বোঝা মা। আমি আর ফিরবনা ওখানে। ওই দেখ ব্যাগ এ তোর মায়ের ছবি নিয়ে আসছি। আমি আর ফিরবনা …ওই বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
- তুমি ফিরবানা তাহলে কই যাবা বাবা, বড়দা’র ওখানে যাবা?
- না মা ।আমি আর কারো বাসায় যাবনা। কেউ আমাকে গ্রহন করবেনা। আমি বাড়তি ঝামেলা সবার কাছে। জানিস মা, বয়সের সাথে সাথে বাড়ির পুরনো জিনিস পত্রের মত বৃদ্ধ মানুষগুলো ও একসময় অচল হয়ে যায়। তাদের ও ঘর থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়! কেউ সেটা সরাসরি না করতে অজত্নে অবহেলায় ঘরের আবর্জনার স্তুপ এর মদ্ধে ফেলে রাখে ।ঠিক তেমনি আমিও আজ ফেলনা অচল মানুষ। আমাকে আর কারো দরকার হয়না মা। আমি বুড়ো, অথর্ব । সবাই তোরা যে যার সংসার নিয়ে ভালো আছিস,ব্যস্ত আছিস। আমি আর কারো সংসারের বাড়তি ঝামেলা হবোনা মা।
খাদিজা বাবাকে ধরে কাঁদছে। আনোয়ার সাহেবেরও চোখের পানি ঝরছে …
– মা শোন, পত্রিকার পাতায় পড়েছি বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে। ওখানে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দেরকে রাখে। আমাকে তুই ওইখানে রেখে আয় মা, আমি ওখানেই ভালো থাকবো।
একটা সিএনজি এসে থামলো গাজীপুরের এই নিভৃত পল্লীতে। শহর থেকে বেশ দূরে মনোরম সবুজ ঘেরা পরিবেশে এই “আনন্দ আশ্রম”। জীর্ণ শীর্ণ কোঁচকানো চামড়ার শরীরের বয়সি এক বৃদ্ধ নেমে এলেন সিএনজি থেকে সংগে তার মেয়ে। বাবাকে রেখে যাবেন এখানে। এখানেই সে অনেক ভালো থাকবে জীবন শেষ কটা দিন।
আনোয়ার সাহেব এক পা পা করে হেটে যাচ্ছেন সামনের দিকে। পিছনে সমস্ত পিছুটান ফেলে রেখে। ছেলেমেয়ে, জাহানারা, সেই ঘর, ভালোবাসার সে চেয়ার ছেড়ে ।
ঝাপসা চোখে চশমার ওপারে কাকে যেন দেখলেন করিডোরে। মতিয়ারের মত সেই মুখ , সেই চোখ। তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন সফেদ পাঞ্জাবি পরা সেই ভদ্রলোক , তবে কি।। তবে কি!! এ কি করে সম্ভব!
আনোয়ার সাহেব এগিয়ে চলেছেন করিডোরের দিকে। আগের চেয়ে জোরে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে । এ শক্তি বড় অদ্ভুত। অনেক মায়ার। অনেক টানের……………………
****************************সমাপ্ত********************************
উৎস: অন্যভুবন