
শাহরিয়ার সুমন
ভূমিকাঃ এটি নিছক একটি কাল্পনিক গল্প, তাই এর মাঝে কোন লজিক বা যুক্তি খোঁজা অর্থহীন। এটি কোন সাইন্স ফিকশন গল্পও নয়, কারণ সাইন্স ফিকশন লেখার মত এত পাণ্ডিত্য আমার নেই।
প্রায় এক মাস আগে, মারুফ সেদিন অফিসের কাজে সীতাকুন্ড গিয়েছিল। কাজ শেষ করে অফিস থেকে বের হতে তার বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। রাস্তা কিছুটা নিরিবিলি। অল্পকিছু গাড়ি চলাচল করছে, মানুষজন খুব একটা নেই। মারুফ নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। গাড়িটা সে অফিস থেকেই পেয়েছে। শীতলপুরের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলোয় মারুফ দেখতে পেল, একজন বৃদ্ধ মহিলা রাস্তার পাশে বসে আছে, হাত দিয়ে গাড়ি থামানোর ইশারা করছে। মারুফ গাড়ি থামিয়ে হাইওয়ের একপাশে সাইড করে রাখল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে মহিলাটির কাছে গিয়ে জানতে পারলো, বৃদ্ধার স্বামী খুব অসুস্থ, হাপাঁনী রোগী। হঠাৎ রাতে তার শ্বাসের সমস্যা শুরু হয়েছে। ঘরে বৃদ্ধা ছাড়া অন্য কেউ নেই। তাই স্বামীর জন্য ঔষূধ কিনতেই সে এত রাতে ঘর থেকে বের হয়েছে। ঔষুধ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ তার মাথা ঘুরাতে শুরু করে, তাই পথের মাঝেই বসে পড়ে সে। বৃদ্ধা মারুফকে বললো, “বাজান, এই সাম্নের গলির ধারে আমার বাড়ি, আপনি আমারে একটু কষ্ট কইরা নামাইয়া দেবেন?” মহিলার কথা শুনে মারুফের দয়া হল। সত্যিই তো, এত রাতে অসুস্থ মহিলাটি একা একা যাবে কিভাবে? মারুফ বৃদ্ধাকে হাত ধরে উঠে দাড়াতে সাহায্য করলো। সে লক্ষ করলো বৃদ্ধা ঠিকমত সোজা হয়ে দাড়াতে পারছে না, তার শরীর কাপঁছে। তাই সে শক্ত করে তাকে আগলে ধরে গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসতে সাহায্য করলো। গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পর একটা গলির সামনে মহিলাটি তাকে নামিয়ে দিতে বললো। গাড়ি থামতেই মহিলাটি নিজেই দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসলো। তারপর মারুফকে কিছু না বলে দ্রুতপায়ে গলির মাঝে হারিয়ে গেল, একবারও পেছনে ফিরে তাকালো না। মারুফ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো, কে বলবে যে এই মহিলাটি কিছুক্ষণ আগেও এতটা অসুস্থ ছিল যে সোজা হয়ে দাড়াতে পারছিল না! বিস্ময়ে মারুফ হতভম্ব হয়ে গেল। সেরাতে মারুফ সত্যিই ভীষন ভয় পেয়েছিল। পথে পুরোটা সময়ে সে আয়তাল কুরসী পড়তে পড়তে বাসায় ফিরে আসলো।
এক মাস পরঃ
সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। সারাদিন একটানা কাজের পর অফিস শেষে ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরেছে মারুফ। সে একটা সফটওয়ার কোম্পানীতে চাকরী করে, বড় একটা কোম্পানীর প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে ইদানিং খুব বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। মারুফ তার এক কলিগের সাথে শহরে একটি ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। তাদের বাসাটি এক রুমের, তবে সাথে কিচেন আর অ্যাটাচড বাথরুম আছে। ছোট হলেও তাদের বাসাটি সুন্দর, ছিমছাম বেশ গোছানো, রুমের সাথে একটি ছোট্ট ব্যালকনি। সেখানে মারুফের গাছেরা বেশ শান্তিতেই বসবাস করছে।
মারুফ পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার লক খুললো। আজ সে ফ্লাটে পুরোপুরি একা। তার কলিগ মাসুদ ভাই গ্রামে গেছেন। ঘরে ঢুকেই মারুফের কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভুতি হল। মনে হল, ঘরে সে যেন একা নয়, সে ছাড়াও অন্য কেউ একজন আছে। কেমন অপরিচিত একটা গন্ধ, কিছুটা বেলী ফুলের সুবাসের মত। মাসুদ ভাই ফিরে আসলেন নাকি? ঘরের আরেকটি চাবি মাসুদ ভাইয়ের কাছে থাকে। কিন্তু তিনি তো বলেছেন আরো দুদিন পর ফিরবেন। ঘরে চোর ঢুকলো নাকি? বাহ! আজকাল চোরের শরীর থেকে বেলী ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়, ভালোই তো! চোরের সন্ধানে মারুফ পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না, তবে গন্ধটা আগের চেয়ে জোড়ালো ভাবে পাওয়া যাচ্ছে। গন্ধ রহস্য নিয়ে মারুফ আর বেশি মাথা ঘামালো না। এমনিতেই সে অনেক ক্লান্ত, সারাদিন অনেক ধকল গেছে তার উপর দিয়ে। এখন গোসল করে ফ্রেশ হয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করতে হবে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো রুদ্র এসে হাজির হবে। রুদ্রর ভার্সিটিতে এক্সাম চলছে, তাই গত দুই সপ্তাহ তাদের দেখা হয়নি। রুদ্রর কথা ভাবতেই মারুফের পুরো শরীরে যেন কামনার স্রোত বয়ে গেল। রুদ্র অতটা সুদর্শন না হলেও বিছানায় তার তুলনা মেলা ভার। রুদ্রর উপস্থিতিতে অসাধারণ খেলুড়ে হয়ে উঠে মারুফ। রুদ্র আসার আগে তার জীবনটা ছিল বড্ড পানসে, রসকষহীন। কামলীলার যে এত ছলাকলা থাকতে পারে, সেটা মারুফ রুদ্রর কাছ থেকেই শিখেছে। তবে শুধু যৌনতার জন্য নয়, মারুফ রুদ্রকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে। তাকে হারানোর কথা ভাবতেই পারে না সে। বাসা থেকে বিয়ের জন্য অনেক প্রেসার দিচ্ছে তাকে। শুধু রুদ্র কষ্ট পাবে ভেবেই এসব নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছে না সে।
রুদ্রর কথা ভাবতে ভাবতে মারুফ যখন বিছানায় বসে নিজের প্যান্ট শার্ট ছাড়ছিল, হঠাৎ সে অবাক হয়ে লক্ষ করল একটি ছোট্ট চড়ুই পাখি কোথা থেকে যেন উড়ে এসে তার বিছানার উপর বসে আছে। নিশ্চয় সকালবেলা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। সে অফিসে যাওয়ার সময় দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়ায় বেচারা নিশ্চয় আর বের হতে পারেনি। নিশ্চয় সারাদিন বের হবার জন্য অনেক ছটফট করেছে বেচারা চড়ুই।
পাখিটি একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মারুফের দিকে, একটু ভয়ও পাচ্ছে না তাকে। মারুফ হাত এগিয়ে দিতেই নির্ভয়ে চড়ুইটি তার হাতের তালুতে উঠে বসল। এখনো চেয়ে আছে পাখিটি তার দিকে। মারুফ জানালা খুলে পাখিটিকে তাড়িয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে চড়ুইটি আবার উড়ে গিয়ে বসলো সিলিং ফ্যানের পাখার উপর, যেন সে এই ঘর থেকে বেরোতে চায় না। মারুফ আর চড়ুই নিয়ে মাথা ঘামালো না। টাওয়েল নিয়ে আপনমনে শিস দিতে দিতে ঢুকে পড়লো বাথরুমে। বাসায় কেউ নেই, তাই আর বাথরুমের দরজা লাগানোর প্রয়োজনবোধ করলো না। কল খুলে সম্পূর্ণ দিগম্বর অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেল শাওয়ারের নীচে। সে তার সারা শরীরে সাবান মাখছে, আর গুনগুন করে গাইছে,
“আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে, জানিনে, জানিনে কিছুতেই কেন যে মন লাগে না।।
গোসল করার সময় গুনগুন করে গান গাওয়া মারুফের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। শাওয়ারের নীচে ভিজতে ভিজতে তার মনে হচ্ছে সে যেন সত্যিই বর্ষাস্নান করছে। বৃষ্টির অবিরত ধারা মৃদু আঘাতে আছড়ে পড়ছে তার উদোম নগ্ন শরীরে। গান গাইতে গাইতে হঠাৎ বাথরুমের আয়নায় চোখ পড়তেই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল মারুফ। একি দেখছে সে! মারুফ ভালোভাবে তার চোখমুখে পানি দিয়ে আবার তাকালো আয়নার দিকে। না, চোখের ভুল নয়। সে যা দেখছে একদম সত্যি! সে অবাক হয়ে দেখলো একটি মেয়ে তার বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? নিশ্চয় তার কোন ভুল হচ্ছে। সে পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকালো, মেয়েটি সত্যি দাঁড়িয়ে আছে, মুগ্ধচোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেয়েটির বয়স খুব বেশি হলে হলে হয়তো বিশ একুশ হবে। কি অদ্ভুত গাড় সবুজ রঙের আলখেল্লা টাইপ একটি পোশাক মেয়েটির পরনে। চোখগুলো ঘন নীল গভীর সমুদ্রের মত। এক রাশ ঘন সোনালী চুল। মেয়েটি অসম্ভব রুপবতী। মারুফের মনে হলো, এ যেন পৃথিবীর কোন মানবী নয়, স্বর্গ থেকে ভুল করে কোন অপ্সরা নেমে এসেছে।
– কে তুমি? এখানে কিভাবে এলে?
মেয়েটি পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলো, আমি অরিন।
– কি করছ তুমি এখানে?
-তোমাকে দেখছি। তুমি অনেক সুন্দর। আমাদের ওখানে তোমার মত এত রুপবান কোন পুরুষকে আমি কখনো দেখিনি।
সত্যি মারুফ অত্যন্ত সুদর্শন একজন পুরুষ। অপূর্ব মুখমন্ডল, চেহারায় অসম্ভব মায়া, যেন দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছে করে। আর তার ঠোটে এক চিলতে হাসি যেন সারাক্ষণ লেগেই আছে। খাড়া নাক, বড় বড় কালো চোখ। উচু চিবুক। মাথা ভরা এক রাশ কালো চুল। চওড়া প্রশস্ত বুক, শরীরে কোথাও এক ফোটা মেদ নেই। ভেজা শরীরে মারুফের সোনালী পশমগুলো দেহের সাথে লেপ্টে আছে। বিধাতা যেন অনেক সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে সৃষ্টি করেছেন এই চমৎকার মানবদেহটি। এমন রুপবান পুরুষ মানুষ খুব সচরাচর একটা দেখা যায় না।
অরিনের কথায় নিজের নগ্ন শরীরের দিকে চোখ যেতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল মারুফ। হঠাৎ মেয়েটিকে দেখে সে খানিকটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। হ্যাঙ্গার থেকে তোয়ালে নিয়ে দ্রুত শরীরের মাঝখানের অংশে জড়িয়ে নিল সে।
– মানে কি এসব? কেন এসেছ তুমি?
– তোমাকে শেষবারের মত দেখার জন্য। আমাকে যে অনেক দূরে চলে যেতে হবে।
– কোথায় যাবে তুমি?
– যেখান থেকে এসেছিলাম। আমার মিশন শেষ। পৃথিবীতে থাকার সময় ফুরিয়ে গেছে আমার।
-কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ?
– তোমাকে তো বললাম আমার নাম অরিন, পৃথিবীতে আসার সময় আমাকে এই নামটি দেয়া হয়েছে। তোমাদের পৃথিবীর গ্যালাক্সির বাহিরে নিউট্রাল জোনের কাছাকাছি ভ্যালেরিয়া গ্রহ থেকে আমি এসেছি।
– কি সব গাজাখুরি গল্প বলছ? তুমি কি ভেবেছ তুমি যা বলবে আমি তাই বিশ্বাস করব?
– আমি তো তোমাকে বলিনি আমাকে বিশ্বাস করো। তাছাড়া তোমার বিশ্বাস করা বা না করায় আমার কিছুই যায় আসে না।
– তুমি যদি এলিয়েন হও, তাহলে আমার সাথে এভাবে বাংলায় কথা বলছ কিভাবে?
-আমার কানে একটি ক্ষুদ্র মডিউল বসানো আছে, এটি পৃথিবীর যেকোন মানুষের ভাষা আমাকে অনুবাদ করে দিচ্ছে। তেমনিভাবে আমার গলায় ভোকাল কর্ডের উপর একটি শব্দ উপস্থাপক যন্ত্র রয়েছে, যার মাধ্যমে আমি এখন তোমার সাথে কথা বলছি।
– আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, তুমি এক্ষুণী এখান থেকে চলে যাও।
– আমি চলে যাব। তবে এখন নয়
-কখন যাবে?
– যখন আমার ইচ্ছে হবে
– না, তোমাকে এখনই যেতে হবে।
– না গেলে কি করবে?
– আমি জোর করে তোমাকে বের করে দেব
– তুমি সত্যি আমাকে বের করে দিবে? মেয়েটি কিছুটা অসহায়ের দৃষ্টিতে মারুফের দিকে তাকালো।
– হ্যা, দিব
-ঠিক আছে সেই চেষ্টা করে দেখ
মারুফ এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরলো। সাথে সাথেই মেয়েটির চোখগুলো যেন আমূলে বদলে গেল। সেখান থেকে এক ঝলক তীব্র আলো এসে আঘাত করলো মারুফের দেহে। দাড়ানো অবস্থা থেকে মাটিতে ছিটকে পড়লো সে। মারুফের মনে হল সে যেন প্রচন্ড বিদ্যুতের শক খেয়েছে। তার সমস্ত শরীর যেন ঝিনঝিন করছে।
– আমি দুঃখিত, আশা করি তুমি খুব বেশি ব্যাথা পাওনি। আমি তোমাকে ইচ্ছে করে আঘাত করতে চাইনি।
মারুফ এখন মেয়েটিকে খানিকটা ভয় পেতে শুরু করেছে। যদিও সে খুব বেশি ব্যাথা পায়নি, কিন্তু বিস্ময় আর আতঙ্কে সে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
– কি হলো তোমার? প্লিজ ভয় পেয়ো না তুমি, বিশ্বাস করো, আমি সত্যি তোমার কোন ক্ষতি করব না।
অরিন এগিয়ে এসে মারুফের হাত ধরলো, তাকে উঠে দাড়াতে সাহায্য করল।
মারুফের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সে যা দেখছে সব কি সত্যি, নাকি তার কল্পনা। সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে না তো?
-কিছু বলছ না কেন? কি ভাবছ তুমি?
– তুমি এখানে কেন এসেছ?
– আমি পৃথিবীতে এসেছি আজ তিন মাস এগারো দিন। একটি মিশন দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে। আমার মিশন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণিটির উপর গবেষণা করা, তাদের আবেগ, অনুভুতি, কোন পরিস্থিতিতে তারা কেমন আচরন করে, এসব তথ্য সংগ্রহ করা। আমার কাজ শেষ, তাই আমাকে আজই ভ্যালেরিয়ায় ফিরে যেতে হবে। কিন্তু যাবার আগে কেন যেন তোমাকে শেষবারের মত খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই ভাবলাম পৃথিবী্তে আমার শেষ রাতটা আমি তোমার সাথে কাটাই।
– তুমি আমাকে কিভাবে চেনো?
– একটু অপেক্ষা করো এই প্রশ্নের জবাব তুমি নিজেই পেয়ে যাবে।
মারুফের চোখের সামনেই হঠাৎ করে বদলে যেতে শূরু করলো অরিনের সুন্দর শরীরটা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে গেল এক সাঙ্ঘাতিক রুপান্তর। মারুফ অবাক হয়ে দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধ মহিলা, যার শরীরের চামড়ায় ভাজ পড়ে গেছে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে শরীর। বৃদ্ধার মুখের দিকে ভাল করে তাকাতেই মারুফ চিনতে পারল তাকে। একমাস আগেই দেখেছে তাকে, মনে পড়ে গেল সেই রাতের ঘটনার কথা।
অরিন আবার তার স্বরুপে ফিরে এসেছে।
– তারমানে তুমিই ছিলে সেদিনের সেই বৃদ্ধা মহিলা! আমি সত্যি বিশ্বাস করতে পারছি না।
– নিজের চোখের সাম্নেই তো দেখলে। ভ্যালেরিয়ার প্রাণিদের জন্য দৈহিক রুপান্তর খুব সাধারণ একটি ব্যাপার। দেহের অণু পরমণুর গঠন বদলে যেকোন জীবিত প্রাণির রুপ ধারণ করতে পারি আমরা।
– কিন্তু কেন করেছ তুমি এসব?
– আসলে সেদিন রাতে যা হয়েছিল, সবই ছিল আমার গবেষণার একটি অংশ। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম গভীর রাতে একটা অসুস্থ মহিলাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলে তোমরা কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাও। সেদিন তোমার আগে আরো বাইশজন মানুষ আমার সামনে দিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ গাড়ি থামিয়ে ভেতর থেকে আমার কথা শুনেছে, কিন্তু কেউ সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেনি। আর বাকিরা গাড়ি না থামিয়েই চলে গেছে। তোমরা মানুষরা খুবই অদ্ভুত। তোমরা সবাই একই রকম ডিএনএ থেকে তৈরি, কিন্তু চিন্তা ভাবনায় তোমরা সবাই আলাদা। একই পরিস্থিতে তোমরা একেকজন একেকভাবে রিএক্ট করো।
– সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?
– হয়তো। তবে আমরা তোমাদের মত নই। আমাদের সকলের চিন্তাভাবনা এক সূত্রে গাথা। তোমরা সবাই কত স্বাধীন, অথচ আমরা কেউ চাইলেও নিয়মের বাইরে যেতে পারি না।
– ঠিক বুঝলাম না
-বাদ দাও এসব। আচ্ছা, তুমি তোমার পোশাক পরে নাও। আমার অনাকাঙ্খিত উপস্থিতিতে তুমি নিশ্চয়ই খুব অস্বস্তিবোধ করছ।
এতক্ষন সবকিছু এত জলদি ঘটে যাচ্ছিল যে মারুফ কাপড় পরার সময়ই পায়নি। বাসায় ফেরার পর থেকে একটার পর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে, কিছুটা ভড়কে গেছে বেচারা।
মারুফ যখন পোশাক পরছিল, অরিন জানালা দিয়ে মুগ্ধ চোখে বাহিরের আকাশ দেখতে লাগল। তারা ভরা পৃথিবীর রাতের অন্ধকার আকাশকে কি রহস্যময়ই না লাগছে। অরিন যেখান থেকে এসেছে সেখানে কখনো এরকম আঁধার নেমে আসে না। দিন রাত্রি আবর্তন নেই সেখানে, দুটি সূর্যের তীব্র আলোয় ভ্যালেরিয়া গ্রহ সবসময়ি আলোকিত।
বাহিরের দরজায় বেল বাজছে। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দৌড়ে এলো মারুফ। এখন কি হবে? নিশ্চয় রুদ্র এসেছে! এত রাতে এমন রুপবতী একটি মেয়েকে বাসার ভেতরে দেখলে, কি ভাববে মারুফ আল্লাহই জানে! নিশ্চয় সে খারাপ কিছু সন্দেহ করে বসবে। এদিকে মাসুদ ভাইও আজ বাসায় নাই। তিনি থাকলে নিশ্চয় এতকিছু হত না। জীবনে এই প্রথম মাসুদ ভাইকে সত্যিই মিস করছে সে! এই ভিনগ্রহের প্রাণীটার জন্য শেষপর্যন্ত না রিলেশনটাই ব্রেকাপ হয়।
উৎস: অন্যভুবন