যে জীবন পিপীলিকার (দ্বিতীয় খন্ড)

তাজিম আবরার

-দ্বিতীয় খন্ড

মোবাইলে গান চালিয়ে কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে লাগলাম । প্রায় তিন বছর আগে গত হয়ে যাওয়া আমার লাভ রিলেশনটার কথা মনে পরে গেল ,ও তো কখনো আমাকে জান পাখি ছাড়া কথাই বলতো না,আমরা একি সাথে থাকতাম , প্রতিদিন সন্ধায় আমরা ঘুরতে যেতাম, একসাথে রান্না করতাম,আমি যখন বই পড়তাম ও চুপ চাপ পাসে বসে থাকতো , কোথাও খেতে গেলে , খাওয়ার মাঝখনে দেখতাম ও হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে , দিন গুলো স্বপ্নের মত যাচ্ছিলো, ও আমাকে অনেক ভালো বুঝত , আচ্ছা আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে , আগেতো দিনের বেলায় ও আমাকে প্রতি ঘণ্টায় অন্তত একবার কল দিত , এক ঘণ্টা কথা না হলে তার সেই কি দুঃখ , এখন যে মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে এখন কি ওর একটুও কষ্ট হয় ,এখন ও কাকে বলে , জান পাখি ফোন ধরতে এত দেরি কেন , জানো না বেশী ক্ষণ থাকতে পারি না ,কথা না বলে , আমাদের বিছানায় মাত্র একটা বালিশ ছিল ,ও দুইটা বালিশ কখনই ইউজ করতে দিত না , যেন একটা বালিশেই শুইতে হবে দুজনার , কার বালিশে কে শয় , আমিতো ওঁর বুকে মাথা দেওয়া ছারা শুইতামই না,কি সুন্দর একটা রিলেসন ছিল আমাদের , অথচ সব শেষ হয়ে গেল । কতদিন হয়ে গেল ওকে দেখি না , থাক সেসব কথা , অন্য কোন একদিন বলব। আমি এখন ওকে অনেক মিস করি , অনেক খারাপ হয়ে গেছি জানি , ওর নাম মুখে আনার মত যোগ্যতা এখন আর আমার নেই , তার পরেও দিন শেষে যখন বালিশে মাথা গুজি , আমার মনুষ্যত্ববোধ জেগে উঠে তখন ওকে খুব মনে পরে , খুব খারাপ লাগে , অনেক অসহায় লাগে নিজের এসব কর্মের জন্য । হয়ত এখনো অতটা খারাপ হয়ে উঠতে পারিনি , বাধ্য হয়ে এসব কাজ করতে হলেও খুব খারাপ লাগে আমার এ জীবনটা । ভিতরের মানুষটা হয়ত এখন বেঁচে আছে তাই এরকম হয় , অমানুষ এখনো হয়ে উঠতে পারি নি । আমার কাছে আসলে আর কোন পথ খোলা ছিল না ।আর একটা বছর আছে , পড়াশুনাটা শেষ হলেই আমি বাঁচি , এসব লাইন একদমি ছেরে দিব ।পড়াশুনা শেষ করে ছোট্ট একটা চাকরি ধরবো ।আমার চাওয়া গুলো খুবই অল্প । জীবনটা একভাবে চলেই যাবে । তার পরেও এসব কাজতো আর করতে হবে না ।একটু ভালো হতে চাই , একটু আমার আমি হতে চাই । আমার আমির মত বাঁচতে চাই , এরকম একটা মেকি লাইফ আমার আর ভাল লাগে না ।

হয়ত আমার ভাগ্যে আর নেই , তার পরেও স্বপ্ন দেখি কেও একজন হয়ত আমার সব অতিত মেনে নিয়ে আমাকে আপন করবে , আমাকে বুঝবে আসলেই কি পৃথিবীতে আমার জন্য এমন কেও আছে , যে একজন অসহায় মানুষের একটা অপরাগতাময় অতীত মেনে নিবে ? কাওকে ভালোবাসার কথা বলার সাহস বা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই , কিন্তু তার পরেও মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা হয় , খুব ইচ্ছা হয় কারো গলা জড়িয়ে ধরে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে আলতো করে বলতে ইচ্ছে করে “ ভালোবাসি “ ঝুম বৃষ্টিতে কারো হাত ধরে ভিজতে ইচ্ছে করে । এত এত জনের মুখ থেকে , তুমি হট , সেক্সি শুনার থেকে শুধু একজন শুধু মাত্র একজনের মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছা করে “ বাবু তুমি অনেক কিউট , চুল গুলো কপালের উপর এসে পরে থাকলে দেখতে খুব ভালো লাগে “ আমি জানি আমার এসব সপ্ন দেখাও পাপ , কিন্তু কি করব , মন যে মানে না । হয়ত কোনদিনও এমন কাওকে পাব না , হয়ত পেতেও পারি ।

কাকে বুঝাব , রাতের অন্ধকারে কারো গাড়ীতে করে কোন বিলাসবহুল হোটেল রুমে কারো মনোরঞ্জন করতে ইচ্ছে হয় না , আমার যে রাতের আধারে সোডিয়ামের স্ট্রিট লাইটের নীচের গাছের পাতা গুলো ভিজে যাওয়া দেখতে ইচ্ছে করে ।কে বুঝবে , আমার যে দামি চাইনিজে খেতে ইচ্ছে করে না , আমার টি এস সি তে ফুচকা খেতে ইচ্ছে করে , আমার যে রবিন্দ্র সরোবরে এলাচি চা খেয়ে রিকশায় করে প্রিয় মানুষটার সাথে বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে ।

কত স্বপ্ন আমার ,হাসি পাচ্ছে । তার পরেও আমি স্বপ্ন দেখি ।গান চলছে “ পলাতক হতে চেয়ে এখন কেন বিহঙ্গ হতে চাও “

হুট করেই মনে হল কেও যেন ডাকছে , গান শুনতে শুনতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছি ঠিকই পাই নি , কান থেকে হেডফোন টা খুললাম । আমার পাশে বসে থাকা ছেলেটি আমার থাইতে হাত রেখে আমার ডাকছে , মেজাজ টা খারাপ হল , গায়ে কারো হাত পরাই আমার সহ্য হয় না , মন চাইলো কষে একটা চড় বসিয়ে দেই , কিন্তু

পারলাম না , এত ছোট একটা বিষয় নিয়ে এভাবে সিঙ্ক্রেট করার মত , জানোয়ার নিজেকে এখনো তৈরি করতে পারি নি ।

ছেলেটিকে জিজ্ঞাস করলাম বাস এখানে থেমে আছে কেন । সে বলল সামনে অনেক জ্যাম মিনিমাম দুই ঘণ্টা লাগবে সবাই বাইরে বের হইছে চলেন আমরাও বাইরে যাই । আমি চুপচাপ ছেলেটার সাথে বাইরে চলে আসলাম , জায়গাটার নাম সনি্রআখরা ।সব বাসের যাত্রীরা বাইরে এসে চা , বিস্কুট , সিগারেট খাচ্ছে , আমরা অল্প একটু দূরে গিয়ে নিরিবিলি দারলাম , ছেলেটা হাত বারিয়ে দিল , বলল আমি “শাফিন “ । আলাপচারীতা পরিচয় ভালই কিছুক্ষন সময় কেটে গেল । কথায় কথায় জানতে পারলাম সে একটি প্রাইভেট জব করে , গুলশান থাকে , আমাকে অবাক করে দিয়ে সে আমাকে বলে বসল “ ডিড এনি ওয়ান এভার টেল ইউ থ্যাট , ইউ হ্যাভ দ্যা মোস্ট বিউটিফুল আই ? আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম ইয়েস আই নো ।

আমার যা বুঝার আমি বুঝে গেছি , সে কি বলতে চাচ্ছে , শাফিন একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছে তুমি বাসে উঠার পর থেকেই আমি তুমাকে লক্ষ্য করছিলাম । আমি খানিকটা বিব্রত ফিল করলাম , কিঞ্চিত লজ্জাও পেলাম । শাফিন আমাকে বলল তুমার গলার দিকে তাকাও , অদ্ভুত আমার গলায় একটা মাফলার , এটা কোত্থেকে আসলো আমি তো কোন মাফলার গলায় দেই নাই ।শাফিন বলল ঠাণ্ডায় তুমার খুব কষ্ট হচ্ছিল , এসিতে , তখন আমি গলায় দিয়ে দিছি ,

আমি অবাক হলাম, ঠিক ঐ মুহূর্তে অনেক কষ্টে চোখের জল আটকালাম । আমি তো এমন কাওকেই চাই । কিন্তু তারপরেও শাফিনের প্রতিটা কথা কেন আমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি । আমি বুঝতে পারছি সে কি বলতে চাচ্ছে তারপরেও আমি শুনেও না শুনার ভান করে আছি ।

কিছুই বুঝার ক্ষমতা আমার নেই । বাসে উঠার আগে ছোট একটা চিরকুট লিখলাম , শাফিনের জন্য

প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবত শাফিনের সাথে অনেক কথা হল , জানতে পারলাম সে নিজেও ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট ।ওর আগে একটা রিলেসন ছিল , এখন আর নেই , সে আমার কারো সাথে নিজেকে জরাতে চায় ,এই এত্ত ক্ষনে অনেক আলাপ হল , আমি বুঝতে পারছিলাম না যে আমি এই জীবনে ঢুকার পর থেকে নিজের ভালোলাগা লাগা গুলো কে হত্যা করেছি্‌,কারন আমি কাওকে ঠকাতে চাই না , ,সেই আমার মনের মধ্যেই শাফিনের প্রতিটা কথা , প্রতিটা চাহনি , ঝর তুলে দিচ্ছে , আমি কষ্ট পাচ্ছি , ভালোও লাগছে , ক্ষত বিক্ষত হচ্ছি , শাফিন একবার আমার হাতটি স্পর্শ করতে চাইলো , আমি সুকৌশলে এরিয়ে গেলাম, কষ্টও হচ্ছিল , এত মানুষ শরীর টাতে স্পর্শ করলো আর সেখানে ও একটু হাত ধরতে চাচ্ছিল , কি এমন হত ধরতে দিলে , কিন্তু আমি পারলাম না , আমার এই পাপে জর্জরিত হাতে ওর মত একটা নিষ্পাপ ছেলেকে স্পর্শ করি কি ভাবে , বেদনায় নীল হলাম , কিন্তু তার পরেও এরিয়ে গেলাম । শাফিন বার বার বলছিল , আমাদের কি আর কোনদিন দেখা হবে ? কোনদিন ? আমি একটু নির্লিপ্ত হাসি দিয়ে বললাম হবে হয়ত যদি ভাগ্যে থাকে , কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম , কিভাবে যে তাকে বুঝাই , তোমার মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে , ঠিক সেই ঝড় আমাকেও উলট পালট করে দিচ্ছে , কিন্তু আমি যে অসহায় । শাফিন অনেক বক বক করতেছিল , বিরক্ত হলেও ভালই লাগছিল , ওর কথা , ওর তাকানো , আলাদা একটা সরলতা আছে , আমি বার বার হারিয়ে যাচ্ছিলাম ।

কত শত স্বপ্ন তার , আমি শুধু দীর্ঘ শ্বাস ছারছিলাম । আমি যে কিভাবে তুমাকে বুঝাই কারো স্বপ্নের সঙ্গি হবার যোগ্যতা আমার নেই , আমার যে অন্য একটা জীবন , বাকি আট দশ জন মানুষের মত আমার জীবন নয় ।শাফিন আমার মোবাইল নাম্বার , ফেসবুক আইডি নিতে চাইল খুব করে , কিন্তু আমি দেই নি , আমি বুঝতে পারছিলাম তার মনের মধ্যে কি ঘটছে .। যার কাজ হচ্ছে শরীর বিক্রি করা , তার মনের আর দাম কোথায় , বেশ্যাদের দিয়ে আর যাইহোক ভালোবাসা হয় না ।আমার একটা নোংরা জীবন , প্রেম ভালোবাসা এখন আর এই জীবনের সাথে শোভা পায় না ।আমি চাই না আমার এই যন্ত্রণাময় জিবনের সাথে ওর মত একটা স্বপ্নময় জীবন কে জ্বালিয়ে নস্ত করতে , আজকে কষ্ট পাক , তারপরেও ওর স্বপ্ন বেঁচে থাক ।

আর কথা বাড়াতে চাইলাম না । বাস ছেড়ে দিচ্ছে দুজন গিয়ে বাসে বসলাম । আর একটা কোথাও বলি নি শাফিনের সাথে ,একবার তাকাইও নি ।

বাস সায়দাবাদ চলে এসেছে , সবাই যার যার পথে চলে যাচ্ছে , আমি চিরকুট টা শাফিনের হাতে দিয়ে , একটা রিকশা নিয়ে চলে আসলাম ।

তাতে লিখা ছিল “” সব ফুলে মালা হয় না , যার জীবনটাই পিপীলিকার মত , তাকে দিয়ে আর যাই হোক ঘর বাঁধা সম্ভবনয় “তুমার জন্য অনেক শুভ কামনা , আমি জানি আমার চোখ সুন্দর , কিন্তু জানো সেই আমার চোখে দেখা পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর চোখ তুমার এবং সব চেয়ে স্বপ্নময় মানুষ তুমি , ভালো থেকো স্বপ্ন গুলো বাঁচিয়ে রেখো , পূরণ কর পৃথিবী অনেক ছোট ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হতেও পারে , ঠিক এমনি কোন বাসে , ট্রেনে বা রাস্তার পাশ দিয়ে চলার সময় , সেদিন না হয় আমার হাতটা একবার স্পর্শ করার আবদার করো , আমি স্পর্শ করতে দিব , কথা দিলাম । যে আবদার টা তুমি চা খেতে খেতে করেছিলে ।তোমাকে মিস করব , জীবনে যতবার এসি বাসে উঠবো নাহয় সারাক্ষণ ……কিছুকিছু মানুষের জীবনটা কেন এমন হয় বলতে পারো? আর হ্যাঁ মাফলারটা কিন্তু আমি ফেরত দেইনি , থাকুকনা কিছু একটা তবুও আমার কাছে…আবার যখন এসি বাসে উঠবো , ঠাণ্ডা লাগলে এটা গলায় জড়াবো ,আমায় ক্ষমা করে দিও। বলতে গেলে নিজেই নিজের জীবন থেকে পালিয়ে গেলাম । “ভগ্ন মনরত পষ্ট তেরাখিয়া পলাতক“

রিকশা কিছু দূর এগিয়ে এসেছে । আমি পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখি শাফিন আমার রিকশার দিকে তাকিয়ে আছে । কি আজব আমার চোখের কোনে জল কেন ……………..

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.