
সাকির মাটি
আজ নভেম্বরের ১ তারিখ। ভোর ৬ টা বাজে এখন। আমার বয়স ১৪ বছর, নবম শ্রেণীতে পড়ি। আমি ঠিক করেছি আজ সকাল ১১ টায় আত্নহত্যা করব। দিনের শুরুতেই করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তাতে পরিচিত মানুষদের দিন শুরু হবে শোকবার্তা দিয়ে। কয়েক ঘণ্টা সময় তাই পেছালাম।
আত্নহত্যার পেছেনে কতগুলো কমন কারণ থাকে-পরীক্ষায় খারাপ করা, জোর করে বিয়ে ঠিক করা, ইভটিজিং বা তারচেও বড় কোন শারিরীক নির্যাতনের শিকার হওয়া অথবা কারও দূর্ব্যবহার। কিন্তু আমার বেলায় কিছুই হয় নি এসবের। আমার ব্যাপার ভিন্ন।
গতকালকের পত্রিকা দেখে জেনেছি পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭০০ কোটি ছাড়াচ্ছে। কী ভয়াবহ কথা! এই ছোট বৃত্তাকার জায়গায় ৭০০ কোটি মানুষ! তাদের থাকার জায়গা দরকার, খাবার উৎপাদনে জায়গা লাগবে, ব্যবসায়ের জায়গা চাই, শিল্পের প্রসারে জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু জায়গা এত কোথায়? বরং জায়গার এমন ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে পৃথিবীর আয়তন কমছে প্রতিদিন। তাহলে কেন জনসংখ্যার বৃদ্ধি এত? কেন এ নিয়ে উৎসব? ৭০০ কোটি মানুষ কেন তবুও?
আমি তাই সিদ্বান্ত নিয়েছি আত্নবিসর্জনের। যে কেউ আমার কথা শুনলেই বহুল ব্যবহৃত সেই প্রবাদ কচলাবে- আত্নহত্যা মহাপাপ। কিন্তু ৭০০ কোটি মানুষের জন্মও কি পূণ্যের কাজ?
সুতরাং আত্নহত্যা করব এবং কয়েক ঘণ্টা পরই। সমস্যা হচ্ছে কীভাবে করব তা নিয়ে। আমি গ্রামের ছেলে। এখানে ট্রাক চলে না যে ট্রাকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ব। বহুতল কোন ভবনও নেই যার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ব। পানিতে ডুবে মরাও সম্ভব নয় কারণ আমি সাঁতার জানি!
গাছে দড়ি দিয়ে ফাঁসি দেয়া যায়, কিন্তু গাছে তো উঠতে পারি না। দড়ি ঝুলাবো কী করে! এই করে করে আমি ৭ টা প্রায় বাজিয়ে ফেলেছি। সময় হাতে মাত্র ৫ ঘণ্টা। এর পরই পৃথিবী থেকে ৭০০ কোটি মানুষের একজন হারিয়ে যাবে। আর কোনদিনও সে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে হাঁটবে না। কোটি কোটি মানুষের কোলাহলে নিজের কণ্ঠ মিশিয়ে দিবে না। আহারে, দুঃখ, দুঃখ!
আমি সিফাতকে খুঁজতে বেরিয়েছি। সে প্রচণ্ড দূরন্ত। যাবতীয় সব অকর্ম ও অন্যের অনিষ্ট সাধনে নোবেল দেয়া হলে আমি নিশ্চিত ১৪ বছর বয়সেই তা সে বাগিয়ে ফেলতে পারত। এরপর বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে ড. ইউনূসের মত প্রধান অথিতির বক্তৃতাও দিত!
সিফাতের বাড়িতে গিয়েই কঠিন এক ঝাড়ি খেলাম। সিফাতের মা বললেন, ‘দিন-রাত পইপই করে ঘুরে বেড়ায়, অকর্ম করে বলে ওর বদনাম করে সবাই। কিন্তু ওকে ডেকে নেয় কারা? উসকে দেয় কারা? তোমরাই তো!’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। সিফাতের বাড়িতে এই নিয়ে ৩ বার গিয়েছি। একবার আপুর বিয়ের মিষ্টি দিতে, আজ একবার, আরেকবার কেন গিয়েছিলাম মনে নেই এখন। গ্রামে আমার সুনাম আছে। ভাল লাগে না বলে সবার সাথে মিশি না। তবুও শুনতে হয় এসব কথা।
ঈদের বন্ধ ১২ দিন। তার আজ প্রথম দিন। ছুটির শুরুই হল এভাবে? ধূর শালা! অবশ্য কী যায়-আসে। কয়েক ঘণ্টা পর তো মারাই যাচ্ছি!
মন খারাপ করে বাড়ির দিকে এগোচ্ছি। বারিক স্যার মনে হয় বাড়িতে নেই। ওনার বাড়ির সামনে ক্রিকেট খেলছে সবাই। আমিও কি যুক্ত হব তাদের সাথে?
২
একটা ব্যাপার সবার কাছে খটকা লাগতে পারে। এত সকালে এই গ্রামে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে কেন? আসলে এখানে দিন শুরু হয়ে ফযরের আযানের সাথে। আযান সেই ৫ টার একটু পরই দিয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকলে বাচ্চাকাচ্চারাও ভোর বেলা থেকেই ঘুরে বেড়ায়। মা-বাবারও তেমন মাথা ব্যাথা নেই। ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, লিখতে পারে, পড়তে পারে এই তো অনেক। তারা তো তাও পারেন না!
আমি খেলার মাঠে নিজেকে যুক্ত করলাম। সব খেলাতেই আমি অপারদর্শী। তাতে দুঃখও নেই। খেলাধূলা, বন্ধুদের অস্থিরতা, দুষ্টোমি কখনও আমাকে আকৃষ্ট করে না। কখনও ইচ্ছে করে না তাদের সাথে যোগ দিয়ে সব মাথায় তুলি, সবার মাথা খারাপ করি।
খেলার মাঝখানে হঠাৎ মনে পড়ল- আজ না আত্নহত্যা দিবস আমার! কেন আমি খেলতে নেমে গেলাম! দ্রুত প্রস্থান করলাম। এক বড় ভাইকে সময় জিজ্ঞেস করার পর বললেন ৭ টা ৪০ বাজে। সর্বনাশ! হাতে সাড়ে ৩ ঘণ্টাও নেই! কাউকে তো যোগাড় করাও হয় নি এখনও।
আমি হন্তদন্ত হয়ে কমবয়সী কাউকে খুঁজছি যে গাছে উঠতে পারে। বড়রা একাজে দক্ষ। কিন্তু তাদের কে দড়ি বাঁধার কথা বললেই বলবে, ‘দড়ি দিয়ে করবি কী? অকাজে এত মনযোগী কেন তুই? আমরাও তো ছোট ছিলাম, কই এমন তো ছিলাম না! যা পড়াশোনা কর!’ পারলে কিছু উপদেশও দিয়ে দিতে পারে। জাতি হিসেবে উপদেশ দান আবার আমাদের প্রিয়।
শেষমেষ কবিরকে পেয়েছি। সে আমারচে ২ বছরের ছোট। দড়ি ঝোলানোর বিনিময়ে সে ১০০ টাকা চাইল। আমার সঞ্চিত টাকা আছে কিছু। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি আর আরও কিছু বেসরকারি বৃত্তির টাকা থেকে জমিয়েছি। কবিরের সাথে চুক্তি করলাম। আত্নবিনাশে সে আমাকে সর্বাত্নক সহায়তা করবে। এমনকি পা মাটির সাথে লেগে থাকলে গাছের উপর থেকে রশি টান দিবে, লাগলে আমাকেও টান দেবে। তাকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিব। ফাঁসির আগে টাকা তার হাতে দিয়ে ঝুলতে যাব। মারাই যখন যাব, তা থেকে বেচারাকে দিয়েই যাই ২০০ টাকা? সে গরীব ঘরের সন্তান।
আমি ঘর থেকে থেকে রশি নিয়ে আসলাম। এবার নির্জন জায়গা খুঁজতে হবে।
আচ্ছা আত্নহত্যা কেন করছি তা লিখে যাওয়া উচিত। পত্রিকায় সব আত্নহত্যার খবরে দেখি আত্নহত্যাকারী ব্যাক্তি চিঠি লিখে যান। বিষাদভরা সেই চিঠি হুবহু পত্রিকায় তুলে ধরাও হয়। আমিও লিখতে বসলাম। সবাই জানুক ৭০০ কোটি মানুষ পৃথিবীর জন্য বেশি হয়ে গেছে।
‘‘জিডি-মামলা-মর্গ এসবের সাথে আমার লাশ ও আমার পরিবারকে যেন জড়ানো না হয়। কারও উপর ক্ষোভ নেই আমার। আমি আত্নহত্যা করছি মানবকল্যাণে। ৭০০ কোটি মানুষ অতিরিক্ত হয়ে গেছে। উৎসব নয়, এটি বরং উদ্বেগের ব্যাপার। আমাদের সবার জনসংখ্যা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন এখন। ভাবার পর আমি বুঝতে পারি যে এবার এই সংখ্যা কমানো শুরু করতে হবে। নিজের আত্নত্যাগের মাধ্যমে আমি তা শুরু করে গেলাম। মানবজাতির উচিত হবে এই প্রক্রিয়া সচল রাখা।’’
এই চিঠি যদি দেশের প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলোয় ছাপা হয় তাহলে দেশের কোটি মানুষ তা জানবে। তা থেকে ৪-৫ জনও কি প্ররোচিত হবে না?
যদি হয়ই তাহলে তারাও এ পথ অনুসরণ করবে। তারা করলে এটি একটি আন্তর্জাতিক খবর, খবর থেকে একসময় ইস্যু এবং নেতাদের অ্যাজেন্ডায় পরিণত হবে। বিশ্বজুড়ে হইচই হবে। এসব দেখে মানুষও এ নিয়ে ভাববে। তত দিনে আরও বহুজন জীবন উৎসর্গ করে ফেলবে।
আহ, মানবকল্যাণ কে বলেছে কঠিন? এই যে, কী সহজ!
চিঠি পকেটে ঢুকালাম। দড়ি নিয়ে গাছ খুঁজতে বেরিয়েছি।
৩
বাড়ির সামনের দিকে সব মানুষের আনাগোনা। সেখানকার গাছগুলোর ব্যবহার তাই করা যাবে না। আমরা বাড়ির পেছনে চলে গেলাম। হ্যাঁ, প্রচুর গাছ দেখতে পাচ্ছি, দড়ি বেঁধে নেই আগে। গাছের ডাল মোটা হতে হবে। না হলে মানুষের ভারে সেটি ভেঙ্গে পড়বে। কবির একটি কাঁঠাল গাছ বাছাই করল। দক্ষতার সাথে সে গাছে উঠে গেছে। বিপত্তি এরপর। শামীম ভাইয়ের দাদি চিৎকার করে উঠল দূর থেকে, ‘‘ঔ কে রে উঠে গাছে? একটা কাঁঠালও ঘরে আনতে পারি না হারামজাদাদের জন্য! কার সাওয়াল রে এগুলা?’’
আমরা যে চোর না বরং মানবসেবাকারী সে ব্যাখ্যা দিয়ে প্রজেক্ট ভণ্ডুল করার মানে হয় না। ২ জন দৌড় লাগালাম সর্বশক্তি দিয়ে।
আবার খোঁজাখুঁজি চলছে। গিয়ে থামলাম মোটামুটি জঙ্গল টাইপ এক জায়গায়। এবার এক বড় করই গাছ নির্বাচন করেছি। যথারীতি কবির উঠে গেল। সমস্যা হল দড়ি বাঁধতে। বয়স কম বলে সে জোর দিয়ে বাঁধতে পারে না। কোনমতে বাঁধা দড়ি – পরীক্ষা করতে গিয়েই দড়ি খুলে আছাড় খেলাম।
দুনিয়ায় শান্তিতে মরার উপায়ও নেই। এত মানুষ কীভাবে তাহলে আত্নহত্যা করে? আমার চেয়েও কবিরের হতাশা বেশি – ২০০ টাকা হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে!
কবির বলল, ‘ভাই ২ বার বাঁধা এসেছে মানে এই পথে যাওয়া ঠিক হবে না’। ওর কথা সঠিক। ১১ টার মধ্যে কুলোতে পারব না। এই পদ্ধতি বাতিল। ‘কী করা যায় এখন?’ –স্বগোতক্তি আমার। তা শুনে কবির বলল, ‘ইঁদুর মারার ঔষধ খান’।
নাহ, ইঁদুরের নামটাই অরুচিকর। তবে অন্য কোন লিকুইডই খাব, যা মানবশরীর গ্রহণ করে না। স্যাভলন বা ডেটল কি খাব? না, বেঁচে যাওয়ার সুযোগ থেকে যায়। হারপিক? সেই একই অরুচিকর ব্যাপার। এনড্রিন খাওয়া যায়। কম দাম, অ্যাভেইলএভেল আর মৃত্যুও সুনিশ্চিত!
এনড্রিন কিনতে আমি কবিরকে সাথে নিয়ে উপজেলা বাজার যাচ্ছি। তাকে নিতাম না। কিন্তু রেখে গেলে সে জনে জনে ২০০ টাকা প্রাপ্তির কথা বলত। উৎসুক জনগণ কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে দিত। জনসংখ্যা হ্রাস কর্মসূচী আলো দেখার আগের অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। সে চলুক তাই আমার সঙ্গে।
আমরা দুজন কথা বলতে বলতে হাঁটছি। বহু বিষয়ে কথা বলছি। আমি তাকে জনসংখ্যা কমাও নীতির ব্যাখ্যা করলাম। এটি যে খুব গুরুত্বপূর্ণ তাও বোঝালাম। সে বুঝেছে কিন্তু প্রলুদ্ধ হয়েছে মনে হয় না। পৃথিবীর অভাব-দুঃখ-দুর্দশা-নিষ্ঠুরতা-অনাচার এসব নিয়ে সবাই ক্রমাগত বলে গেলেও, কেউই আসলে এ জায়গা ছাড়তে চায় না।
৪
২ মাইল দূরের বাজারে পৌছেছি যখন তখন ঘড়িতে প্রায় ৯ টা ছুই ছুই। হালকা নাশতা করলাম। সারা বাজার এক চক্কর ঘুরে নিলাম ১০ মিনিটে।
আমরা এবার মূল কাজে এলাম। মুদি দোকানে পাব এনড্রিন? পেলাম না, সার দোকানে গেলাম। দোকানদার জিজ্ঞেস করল কতটুকু লাগবে। আমি বললাম, দিন হাফ লিটার।
এবার বাড়িতে গিয়ে বিছানায় শুয়ে খাব এটি। দরজা খোলা থাকবে, স্বাভাবিক থাকবে সবই। কারণ এই আত্নহত্যা আর সবগুলোর মত নয়। এর পেছনে প্রচণ্ড হতাশা, অভিমান বা অপমানের কিছু নেই। আছে মানবকল্যাণের সুতীব্র ইচ্ছা।
আধা লিটার এনড্রিনের বোতল হাতে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছি। আমি শেষবারের মত পেছনে তাকালাম। আজন্ম বেড়ে ওঠা এ জায়গায় আর আসা হবে না কোন দিন। আর কোনদিনও দেখব না সূর্যের আলোর নিচে মানুষের এমন হইচই, দুনির্বার ছোটাছুটি। আত্নহত্যার মিশন হাতে নেয়ার পর প্রথমবারের মত হঠাৎ মন কেঁদে উঠল।
জীবনের শেষ সময়টা আমার কবিরের সাথে কাটছে। আমরা দ্রুত হাঁটছি। সে অভিজ্ঞের মত পরামর্শ দিতে লাগল, ‘ভাইয়া খাওয়ার পর কষ্ট হলেও চিৎকার করবেন না। সবাই টের পাইলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। মুখে নিয়ে সাথে সাথে গিলে ফেলবেন, কষ্ট কম, কাজ হবে তাড়াতাড়ি’।
আমি বললাম, ‘তুই কি ১০০ টাকার চুক্তি আগেও কয়েকবার করেছিলি? কীভাবে জানিস এসব?’ সে বলল, ‘ভাইয়া আপনি না ২০০ টাকা দিবেন বলসিলেন!’ আমি হেসে ফেললাম, না ওকে ৫০০ টাকার একটা নোটই দিয়ে যাব। জীবনের যখন ইতি টানছি, কী হবে আর জমানো টাকা দিয়ে?
আমরা বাড়ির কাছাকাছি মোটামুটি চলে এসেছি। কাজী বাড়ির কাছে আসতেই কোন মহিলার তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেলাম। আমরা দৌড়ে বাড়িতে ঢুকলাম। দফাদার চাচার বউ চিৎকার করছে, ‘ওরে তোরা কেউ গাড়ি নিয়ে আয়। আমার ছেলের বউ মারা যাচ্ছে। আল্লাহ তুমি বাঁচাও, রহমত কর। আল্লাহ…’।
আমি ও কবির দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে দৌঁড়াচ্ছি। কবির আমার চেয়েও জোরে দৌড়াচ্ছে। গত বছর তার মায়েরও হয়েছিল এমন। এখন কী সেই ঘটনাই তার চোখে দৃশ্যমান? ২ মাইল যেতে কতক্ষন লাগবে আর?
আমরা প্রাণপণ দৌড়ে যাচ্ছি। দৌড়ানো অবস্থাতেই পথে জিজ্ঞাসুদের জবাব দিচ্ছি। বাজারে প্রায় পৌছে গেছি। দম আটকে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মনে হয় রাস্তায় পড়ে যাব। কবির তখনও দৌড়ে যাচ্ছে। এই ছেলের এত এনার্জি কোথা থেকে আসল?
বাজারের মুখে বারিক স্যার সাইকেল চালিয়ে ফিরছিলেন। আমাদের দেখেই তিনি বিপদ অনুমান করতে পারলেন। স্যারসহ ভ্যান নিয়ে যাচ্ছি। পেছনে অতিরিক্ত একটি ভ্যান। বিপদের কোন সীমা নেই, যেকোন প্রয়োজন হতে পারে। আমি ও কবির ভ্যানে, স্যার সাইকেলে অনেক সামনে চলে গেলেন।
দফাদার চাচা মারা গেছেন অনেক আগে। তাঁর একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকে। ওনার ঘরের কাছে ভ্যান থামল। বারিক স্যার আগে এসে মনে হয় সবাইকে প্রস্তুত করেছেন। ধরাধরি করে দফাদার চাচার ছেলের বউকে উঠানো হল। প্রেগন্যান্সি সমস্যা। তাঁর শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। তীব্রভাবে গোঙ্গাচ্ছেন তিনি। বিব্রতকর অবস্থা। তার চেয়েও বেশি বিপদজনক।
স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ ব্যাথার ৩০ লেভেল পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। কিন্তু প্রেগন্যান্সির সময় মহিলাদের ৮০ লেভেলের ব্যাথা সহ্য করতে হয়। এই মহিলাকে দেখেই সে ব্যাথার তীব্রতা অনুভব করতে পারছি। তাঁর অনাগত সন্তান আমাদের মতই এই কষ্ট কোনদিন বুঝবে না। কোনদিনও বুঝবে না এমন এক সকাল তার মা পার করেছিল।
দফাদার চাচার বউয়ের সাথে তার শাশুড়ি ও আরও ২ মহিলা উঠলেন। ২ বৃদ্ধা, ১ তরুণী। অন্য ভ্যানে আমি, কবির ও আরও ৪ জন উঠেছি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের মত বয়সীদের সবাই দূরে সরিয়ে রাখেন। ভ্যান নিয়ে এসেছি বলেই হয়ত কেউ আমাদের যেতে বারণ করে নি। অথবা বিপদের মধ্যে হয়ত খেয়ালই করে নি কেউ। বারিক স্যার ইতিমধ্যে অনেক এগিয়ে গেছেন।
দুটি ভ্যান যত দ্রুত পারা যায় চলছে। মহিলা কাতরাচ্ছেন। আমরা সবাই স্রষ্টাকে ডাকছি – বিপদে পড়া ছাড়া যাকে কেউ ডাকি না।
৫
সবাই এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কমপ্লেক্সের লোকবল কম বলে দফাদার চাচার ছেলে বউকে স্ট্রেচারে করে জরুরী বিভাগে নেয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে নেয়া হল অপারেশান থিয়েটারে। ওটির বাইরে মুখগুলোতে গভীর শংকা, চোখেমুখে ভয় – সব ঠিকমত হবে তো?
দফাদার চাচার বউ কাঁদছেন ক্রমাগত। তাঁর ছেলের বউয়ের অবস্থা ভাল নয়, যথেষ্ট খারাপ বরং। তাঁর ঘরে কি আসবে নতুন কেউ? এই মেয়ের কিছু হলে কী হবে তাঁর ছেলের? কী-ই বা হবে তাঁর?
আমরা কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে আছি। এ সময় দেখি শামীম ভাইয়ের দাদিও এসেছেন ভ্যানে। তিনি বললেন, তোমরা কার ছেলে গো বাপ? এরা না থাকলে কী হইত আজ!
আমি জবাব দেয়ার আগেই বারিক স্যার বললেন, ‘ও তানিম। বাবুল ভাইয়ের ছেলে। খুবই মেধাবী। জেএসসি পরীক্ষায় গত বছর গোটা জেলাতে প্রথম হয়েছে। আর ও কবির – রফিকের ছেলে। পড়াশোনায় মন কম। সারা দিন বাঁদরামি। ওরা যখন ছিল, কিছু যখন হয় নি – এই চিন্তা করে কী লাভ এখন? দোয়া চান আল্লাহর কাছে’।
শামীম ভাইয়ের দাদি হঠাৎ বললেন, ‘আজ সকালে তোমরা কি আমার কাঁঠাল গাছে উঠসিলা? বাবারা, পেটে বিদ্যা থাকলেই তো হইব না শুধু। কুঅভ্যাস বাদ দিতে হইব’।
আমি পুরো থ হয়ে গেলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম এ প্রসঙ্গ। এখন এই মুহূর্তে কি তা মনে থাকার কথাও?
প্রায় আধা ঘণ্টা পর নবজাতকের কান্নার শব্দ ভেসে এল। সবাই রোমাঞ্চিত, সাথে শংকিত ও ভীত – নবজাতকের মা সুস্থ তো?
গর্ভবতী এই মহিলাকে কখনো দেখি নি আমি। অথচ তাঁর জন্য কী শংকিত চিত্তেই না আছি এতক্ষণ, কত প্রার্থনাই না করছি এখন!
নার্স বের হলেন। বললেন, ‘মেয়ে হয়েছে। মায়ের বিপদ এখনও কাটে নি, ৭ মাস ২৩ দিনেই ডেলিভারি হয়েছে। অ্যাবনর্মাল ডেলাভারির কারণে শরীরে রক্তচাপ কম। জ্ঞান ফিরে নি এখনও। স্যার বলেছেন আরও আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরতে পারে। কী হয় এখনও বলা যায় না’।
দফাদার চাচার বউ চিৎকার করে প্রলাপ বকে যাচ্ছেন। বারিক স্যার বললেন, মেয়ের জন্মক্ষণ ১১ টা ১৪ মিনিট।
আমি স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। ১১ টা বেজে গেছে! জনসংখ্যা না ১ জন কমার কথা? কী আশ্চর্য, আরও ১ জন বুঝি বেড়ে গেল!
কবির বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। ১ বছর আগে এমনই এক দিন তার মায়েরও হয় এমন, তার নতুন এক ভাই আসে–যার নামা রাখা হয় সাগর। সেদিন না ফেরার দেশে যেতে যেতেও তার মা ফিরে এসেছেন। এই মহিলা কি আজ ফিরে আসবেন?
নবজাতকের কান্নায় সাস্থ্য কমপ্লেক্সের ছোট ভবন প্রকম্পিত হচ্ছে। আমি কবিরের কাঁধে হাত রাখলাম। এক কোণায় ডাস্টবিনে লেখা – ‘আমাকে ব্যবহার করুন’।
পকেট থেকে ঘণ্টা দুয়েক আগে লেখা চিঠি ফেললাম তাতে। যেখানে মানুষের জন্ম ও বেঁচে থাকা এত অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ, বেঁচে থাকতে সবাই যেখানে এমন অদৃশ্য সংগ্রামে লিপ্ত – কেন সেখানে আত্নহত্যা করে মানবজাতিকে অবমাননা করা?
সবাই অপারেশান থিয়েটারের সামনে। আমি ও কবির চলে যাচ্ছি। আচ্ছা এন্ড্রিনের বোতলটা কী করেছি? ছোটাছুটির সময় পড়ে গেছে হয়ত।
মা ও নবজাতকের খবর পরে নেব। দুজন-ই চূড়ান্ত মাত্রায় ক্লান্ত। এত অনিশ্চয়তা-চাপ আর সহ্য হচ্ছে না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গেইট থেকে থেকে ডাব কিনে খেলাম। রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে যাব।
রিকশায় উঠতে যাব এমন সময় নবজাতকের কান্নার সাথ তরুণী ও বৃদ্ধাদের কান্নার বিকট শব্দ যুক্ত হল। পৃথিবীর জনসংখ্যা ১ জন বোধহয় কমে গেছে।
উৎস: অন্যভুবন