
মাসুদ ইসলাম
আমাকে যে ধারন করে আছে তার থেকেও অনেক আগেই আমার জন্ম। আমার অস্তিত্বের সীমারেখা নির্ধারিত হয় সেই ৭ম শতকে। ৯ম শতকের আগে হিন্দু সেনদের আগে আমাকে শাসন করেছে কামাপুরা বৌদ্ধ সাম্রাজ্য। ১৬০৮ সালে মুঘল সুবেদার ইসলাম আমার নাম দেন “জাহাঙ্গীর নগর”।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কে আমি?
হ্যাঁ, আমি ঢাকা বলছি। বাংলাদেশের রাজধানী। যাকে মেগা সিটি হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।
মানুষ জাতি যেমন জন্মের সময় ছোট ও দূর্বল থাকে তেমনি ১৬০৮ সালে নতুন করে আমার যখন জন্ম হয় তখন আমার আয়তন ছিল ১৯ বাই ১৩ কিলোমিটার। সময়ের সাথে সাথে আমিও বড় হয়ে উঠেছি। এতই বড় হয়েছি যে আমাকে এখন যারা শাসন করে তারা আমাকে উত্তর আর দক্ষিণে ভাগ করে নিয়েছে। এখন আমার আয়তন ৮১৫.৮ বর্গ কিলোমিটার। কত বড় হয়েছি বুঝতেই তো পারছেন?
———-
আপনারা হাসছেন আমাকে নিয়ে। হয়তো তামাশাও করছেন। আমার সুখ-দুঃখের কথা কি কখনও আপনারা ভেবে দেখেছেন?
জানি দেখেন নাই। দেখবেনও না। আপনাদের দেখার সময় কই?
ভাইরে! আমার কষ্টের কথা আর কি বলবো? একবার বলা শুরু করলে আর শেষ করা যাইবো না। কোথা থেকে শুরু করবো সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা। কয়টা বলবো সেটাও বুঝতে পারছিনা। বেশী না প্যাচিয়ে বলা শুরু করি।
আগেই বলে নেই, এই শুদ্ধভাবে কথা বলতে আমার একটু কষ্ট হচ্ছে। কি আর করবো? আপনারাতো আমার ভাষা শুনলে হাসেন। কেউ কেউ নাকও সিটকায়। চাটগা, নোয়াখালী অন্যদের বেলায় কোন সমস্যা না। শুধু আমার ভাষায় সমস্যা। যেন বললে অভদ্রতা।
আপনাদের লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে এখন আমিও শুদ্ধভাবেই কথা বলতেছি।
———-
আমার এখন দম নিতে খুব কষ্ট হয়। দম মানে বুঝলেন না? শ্বাস আর কি। ঐ যে ভেটকি মারতাছেন। আমি দম আটকাইয়া মরলে আপনারও মরতে হবে। এটা ভুলে যাইয়েন না।
যা বলছিলাম।
জন্মের পরপর আমার মধ্যে বাস করতো আপনাদের পূর্বপুরুষদের দশ লাখ লোক। আর এখন। এই ২০১৫ তে এখন আপনি সহ কতজন বাস করছেন হিসাব আছে? প্রায় দুই কোটি।
আপনারা এত জন মিলেই যদি নিঃশ্বাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়তে থাকেন তাহলেইতো আমার দফারফা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
আপনাদের এতগুলা মানুষের জন্য কত বাড়ি ঘর, অফিস আদালত, শিল্প কারখানা গড়ে তুলছেন সেটার কি হিসাব আছে। আপনারা আপনাদের বেঁচে থাকার জন্য অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থান,শিক্ষা আর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে আমার যে বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন সেটা ভেবে দেখেছেন?
আপনাদের পূর্ব পুরুষেরা আগে আমার লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, কার্জন হল এমন আরো কিছু স্থাপনা নিয়ে গর্ব করতো। এখন আপনারা করবেন কেমনে? আমার এক ইঞ্চিও কি বাদ রাখছেন? রাখেন নাই। যেখানে পারছেন, যেভাবে পারছেন ইমারত তৈরী করেছেন। করছেন।
এদের ভারে আমি এখন নুইয়ে পড়েছি।
———-
আপনাদের যেমন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আছে তেমনি আমারও। আগে সুন্দরবন আমার কিছু অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এর মধ্যেও বিস্তৃত ছিল। চোখা বন্ধ করে দেখেন তো সেই দিনগুলির কথা।
তখন লোকজন বিমানে করে যাওয়ার সময় আকাশ থেকে আমার গায়ে সবুজ জামা দেখতে পেত। আর এখন আপনারা আমার এমন বস্ত্রহরণ করছেন যে, আকাশ থেকে দেখলে শুধু কালচে ধুসর দেখায়।
আপনাদের দেহে যেমন রক্ত সঞ্চালনার জন্য শিরা-উপশিরা, হৃদপিন্ড আছে, তেমনি আমারও সেরকম অনেক খাল ছিল। সেইসব এমনভাবে ধ্বংস করছেন যে সৃষ্টিকর্তা রহমত বর্ষন করলেও তা আমি ধারন করতে পারিনা। আমার কি? তা আপনাদেরই ভাসিয়ে দেয়।
আমার হৃদপিন্ড দুইটা। বুড়িগঙ্গা আর তুরাগ। তুরাগ কে অনেক আগেই আপনারা মেরে ফেলেছেন।
বুড়িগঙ্গার এমন দুষন করছেন যে আমি নিজেই এর দূর্গন্ধে হাঁপিয়ে উঠছি। ভাবছি হৃদপিন্ডই শেষ করে দিব। কিন্তু পরক্ষনেই আপনাদের মায়ায় আর পারিনা। এর দুষিত পানিই তো আপনাদের পানির চাহিদা পূরন করে আসছে। কিন্তু আর কতদিন আমি এই ক্যানসারকে নিয়ে বেঁচে থাকবো?
এটাকেও তো ছাড়ছেন না। যে হারে দুইপাশ দিয়ে ছোট করে ফেলছেন। মাঝে মাঝে নিজেরও লজ্জা লাগে। সেদিন চট্টলা দিদি মজা করে বলে- “আমার শিরাও দেখি তোমার হৃদপিন্ডের চেয়ে বড়”।
কথাটা ভাবতেই লজ্জা লাগে।
———-
সেদিন বাগেরহাট দাদা, সাতক্ষীরা দিদি আমাকে বললেন তাদের সুন্দরবনে যে পশুরা আছে তারাও নাকি সেটার নাকি সেরাম যত্ন নেয়। আমিতো হিংসায় তাদের প্রস্তাব দিয়ে বসি-“আমার এই মেগাসিটি তকমা আপনারা নিয়ে নিন। বিনিময়ে আপনাদের সুন্দরবন আমাকে দিয়ে দিন।”
এই প্রস্তাবে তারা দুজন এমন খেপেছেন যে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন।
চিঠিতে আমাকে কি অপমানই না করলো। আমাকে বলে কি না- “তুমি থাক বাপু তোমার মেগাসিটির তকমা নিয়ে। তোমার ডিজিটাল মানুষ্য প্রাণী থেকে আমাদের সুন্দর বনের পশুরা অনেক ভাল। তারা অন্তত নিজের ভালটা বুঝে। কিছু নিলে তার আগে সঞ্চয় করে নেয়। যাতে ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে না হয়। ওদের জন্য আমরা এখনো ভাল আছি। আর তোমার আধুনিক মানুষ নামের প্রাণী তোমার এমন অবস্থা করেছে যে তোমার গায়ের কাপড়টাও খুলে নিচ্ছে।”
ইসস! এত অপমানও ছিল আমার কপালে!
———-
আপনাদের এত মানুষের ভারেই আমি অতিষ্ট, তার উপর আপনাদের যানবাহনের অত্যাচার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা ছাড়া আর কিছু না। এদের থেকে নির্গত বায়ুতে আমার ত্রাহি অবস্থা। মাঝে মাঝে এই বায়ু মারাত্মক কাল হয়। আমি এই বায়ুতে শেষ। আপনারা যে কিভাবে বেঁচে আছেন? সেটা আমি নিজেই বুঝি না।
আপনাদের যানবাহন আর কলকারখানার নির্গত ধোঁয়া আমার আকাশ আর বাতাসকে বিষিয়ে দিচ্ছে।
সেদিন আমার বিদেশী বন্ধু আফ্রিকার সাথে কথা হল। ওর লোকেরা নাকি বনের পশু তারাতে একধরনের হর্ন ব্যবহার করে। কি নাম যেন? ও হ্যাঁ। ওতাকে হাইড্রোলিক হর্ন বলে। আমি তাকে গর্ব করে বলি-“আমার লোকেরা তো এইটা বাস,ট্রাক,প্রাইভেট কার এমনকি মোটরবাইকেও ব্যবহার করে।”
আমার কথা শুনে বেচারা আফ্রিকা তো অবাক। তখন বুঝতে পারিনাই কেন সে অবাক হইছিল। এখন বুঝতে পারি। আমার রাস্তায় নাকি যে হারে শব্দ দুষন হচ্ছে তাতে নাকি আপনাদের দুই মিনিট থাকলেই সমস্যা হওয়ার কথা। সেদিন দেখলাম আমার রাস্থায় সহনীয় শব্দ দুষনের মাত্রা ৫০-৮০ ডেসিবল থাকার কথা। সেখানে নাকি আছে ১৫০-১৭০ ডেসিবল।
গতকাল সেই মূর্খ আফ্রিকা আমাকে ফোনে বড়াই করে বলে-“তোদের দেশের লোকেরা কি আমার পশুদের থেকেও অধম নাকি! নাহলে এত হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করে কেন? আমার তো মনে হয় আমার পশুদের থেকেও খারাপ। দেখ না তোমার লোকেদের সহনশীলতা যে হারে কমতেছে। একটু কিছু হলেই আঘাত করে। আমার এখানকার সিংহদের মত। ওরা যেমন খুদা লাগলে নিজ বাচ্চাকে খেতে দ্বিধা করেনা, তেমনি তোমার মানুষেরা নিজেদের মেরে ফেলছে। হাহাহাহা।”
একটা মূর্খের কাছেও আপনাদের জন্য অপমান হতে হল।
———-
আর কত কষ্টের কথা আপনাদের বর্ননা করবো? আপনাদের নিয়ে আগে আমি খুব গর্ব করতাম। এখন আর পারি না। সব জায়গায় লজ্জায় পড়তে হয়। আপনাদের কথা আর কি বলবো? আপনাদের মধ্যে কত রকমের যে প্রজাতি আছে তা সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আপনাদের বেশীরভাগই হচ্ছে স্বার্থপর। নিজেদের ছাড়া কিছু বুঝেন না। কাকে মেরে কে খাবে এমন প্রতিযোগিতাই চলছে আপনাদের মাঝে। অনেক দেশের মানুষের কথা শুনেছি। আপনাদের মত না। নিজেদের স্বজাতির বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন। আমিতো নস্যি।
আমি অবাক হই যখন দেখি আপনাদের কেউ খোলা আকাশের নিচে থাকে আর কেউ আলিশান বাংলোতে থাকে। কেউ পেট পুরে খায় আর কেউ পায় না। কারো জামা কাপড়ের অভাব নাই। আর কেউ আছে আমার মত প্রায় বস্ত্রহীন।
দিনে দিনে আপনাদের মধ্যে চোর, ছেচ্চর, বাটপারে ভরে গেছে। আপনাদের যারা পরিচালনা করে তারাতো বড় মিথ্যাবাদী। কথা আর কাজে সমন্বয় নেই। রাতে বলে একটা, সকালে আরেকটা। দুপুরে বলে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়যন্ত্র, আবার সন্ধ্যায় জানায় তীব্র প্রতিবাদ।
কি যেন একটা পুরুস্কার আছে? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। একাডেমী এওয়ার্ড। জুরি বোর্ডের সদস্যরা কি এদের দেখেন না? নোবেল ওয়ালাদেরও উচিত এদের জন্য বিশেষ শাখা খোলার।
———-
আপনারা এমনই হইছেন যে গিফট না নিয়ে কোন কাজ করতে চাননা। গিফটে কি এতই মজা?
ভন্ডামি আমি একদম সহ্য করতে পারিনা। অথচ এই আপনাদের ভন্ডামির মাত্রা চরমে পৌঁছেছে।
আপনারা সবাই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীযোগিতায় নেমেছেন সে যে ভাবেই হোক।
আরে বাবা। প্রতিযোগিতা থাকবে ভাল কথা। তাই বলে নিজেকে জাহির করার জন্য প্রতিযোগিতা!
আপনাদের সবাই ব্যস্ত নিজেকে সচেতন আধুনিক নাগরিক হিসাবে সাব্যস্ত করতে। আসলেই কি আপনারা আধুনিক? আমারতো মনে হয় আপনারা দিন দিন জংলী হচ্ছেন।
যেমন আপনারা, তেমনি আপনাদের শাসক। এরা মোটা বুদ্ধি নিয়ে এত মানুষকে যে সামাল দেয় কি করে? মোটা বুদ্ধির একটা উদাহরন দেই। দেখেন না বর্ষা আসলেই এদের আমার দেহ খুঁড়তে মজা লাগে। আরে ছাগলের দল। বর্ষায় এমনিতেই তো বৃষ্টিতে নগরবাসী নাজেহাল হয়, তারমধ্যে থাকে রাস্তা ঘাটে থাকে খানা খন্দ। যাও আমাকে প্লাস্টার করে তাতেও ভেজাল। একদিনের বৃষ্টিতেই সব খড়খড়ে হয়ে যায়।
———-
আপনারা আমার সুন্দর সুন্দর স্থানগুলা বদনাম করে ফেলছেন। আমার রমনা পার্কে ঘুরতে যাওয়ার নাম শুনলেই বিশ্ববাসী মুচকি হাসে। আপনারা কি এমন করলেন যে নিতান্ত ভদ্রলোক এখানে বেড়াতে যেতে চাননা। অথচ এই এইখানেই আগে আপনাদের কত নাটক, সিনেমার শুটিং হইছে।
এরকম আমার আরো কয়েকটা জায়গা আছে যেমন- ফার্মগেট পার্ক, মিরপুর মাজারের কাছে। এরকম একটা পবিত্র জায়গাকেও আপনারা বদনাম করতে ছাড়েন নি। আপনাদের পরিবারের কত লোকজনকে দেখেছি এখানে এসে মানত করতে, জেয়ারত করতে।
আগে আমার পথে ঘাটে নিশিকন্যা দেখা যেত। এখন নিশিবালকও দেখা যায়। যেসব জায়গার কথা বললাম সেখানে নিশিবালকদের অত্যাচারে আর কন্যাদের দেখাও যায় না।
———-
এত দুঃখ কষ্ট সয়েও কেন বেঁচে আছি জানেন? এই আপনাদের জন্য। আই আপনারাই আমাকে দিনে দিনে অতিষ্ট করে তুলছেন। আপনাদের কৃতকর্মের জন্য আমি কেন বদনামের ভাগি হব? এককালের এই বনেদী আমিকে এখন বলে কিনা বসবাসের অযোগ্য। আমাকে বসবাসের অযোগ্য কে করেছে? এই আপনারাই তো। যে পাতে খাচ্ছেন সেই পাতই ছেঁদ করছেন।
আপনাদের লজ্জা না থাকলেও আমার আছে। এত অপবাদ আর বঞ্চনা নিয়ে আমার আর বিশ্বের মাঝে বেঁচে থাকার ইচ্ছা নাই।
আপনাদের সবাইকে একটা চরম শিক্ষা দিতে হবে। খুব শীঘ্রই পাবেন। জনাব টেকটোনিক আমাকে ফোন করেছিল। সে আর আমাকে সময় দিতে চাচ্ছেনা। আমার মত সেও নাকি আপনাদের উপর অতিষ্ট। আর বোধহয় আপনাদের রক্ষা করা গেলনা!!!
*****(সমাপ্ত)****
উৎস: অন্যভুবন