আলো

হীরক রাজার দেশে

১…..

আলোর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল একটা মদের বারে । ওর আলো নামটাও আমার দেয়া । অফিসে নিত্যনতুন কাজের চাপ ,বসের ঝাড়ি রেগুলার একঘেয়ামী অফিস করা সব কেমন জানি অসহ্য লাগছিল ।কাজের চাপে অনেকটা দিশেহারা হয়ে গেছিলাম ।অফিসের কয়েকজন কলিগ বন্ধু প্রায়ই অফিস শেষে একটা বারে যেত , ড্রিংঙ্কস করত ।আমাকে প্রায় যেতে বলত ।আমি যেতে চাইতাম না । ওসব জায়গা আমার জন্য নয় । অফিস শেষে একদিন সন্ধ্যাবেলা ওরা আমাকে ধরে বসল,

-”আরে ভাই একবার চলই না । দেখবে মাথা থেকে সব কাজের চাপ কিভাবে হাওয়া হয়ে যাবে । রিলাক্সড ফিল করবে । চল একবারটি ” ।

তাদের জোড়াজুড়িতে অনিচ্ছা সত্তেও অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের সাথে গেলাম । লাইফের ফার্স্ট কোন একটা মদের বারে । সেখানেই দেখা আলোর সাথে । আলো স্টেজে একটা পিয়ানোর সামনে বসে পিয়ানো বাজিয়ে ইংলিশ গান গাইছিল । তার গানের তালে তালে একদল তরুন তরুণী ড্রিংঙ্কস করে মাতাল হয়ে নাচানাচি করছিল „একে অন্যের শরীরে ঢুলে পড়ছিল ।আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল । কেমন একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ । অফিসের কলিগ বন্ধুরা ততক্ষণে মদে বুদ হয়ে গেছে । আমি তাকিয়েছিলাম স্টেজে পিয়ানোর সামনে বসা আলোর দিকে । পিয়ানো বাজিয়ে একটার পর একটা ফরমায়েশী ইংলিশ গান গেয়ে যাচ্ছিল । সে নিজেও ড্রিংঙ্কস করেছে । ঢুলে ঢুলে গাইছিল গান ।বাঙালি নারী হিসেবে আমার মাকে সবসময় আদর্শ মনে করেছি । এই মেয়েকে দেখে তাই একপ্রকার রাগ হচ্ছিল । সবাই যখন বিভিন্ন ইংলিশ গানের অনুরোধ করছিল আমি কিছুটা জেদ করেই দাড়িয়ে আলোকে বললাম একটা রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার জন্য । সে আমার অনুরোধ শুনে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়েছিল । আমি ধরেই নিয়েছিলাম আলো রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারবে না । তাই অনেকটা বিরক্তভাব নিয়ে উঠে যাবার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে পিয়ানোতে সুর তুলে আলো গাইতে শুরু করল-

”আলো আমার আলো

ওগো, আলো ভুবন-ভরা।

আলো নয়ন-ধোওয়া

আমার ,আলো

হৃদয়-হরা ।।”

আলোর মুখে রবীন্দ্র সংগীত শুনে একমুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম । পা যেন মার্বেলের মেঝের সাথে আটকে গেছে । একটু আগে যারা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নাচানাচি হৈ হুল্লোড় করছিল তারাও থমকে দাড়িয়ে শুনছে । অসভ্য জায়গায় সভ্য গান শুনছে সবাই । আলো এতভাল গাইছিল যে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত ঠায় দাড়িয়ে একমনে শুনছিলাম ওর গান । গান শেষে পুরো বার জুড়ে পিন পতন নীরবতা । আলো গানশেষে মাথা নীচু করে পিয়ানোর সামনে বসে ছিল । আমি একাই দাড়িয়ে খুব উচ্ছসিত হয়ে হাততালি দিয়েছিলাম ।

এরপর থেকে নিয়মিত অফিস শেষে বারে যেতাম । মদের নেশায় নয় আলোর গলায় রবীন্দ্র সংগীত শোনার নেশায় ।সত্যিই নেশার মত হয়ে গিয়েছিল । আলোও আমাকে দেখে খুশি হত । শুধুমাত্র আমার জন্যই সবশেষে একটা রবীন্দ্র সংগীত গাইত । আমি মুগ্ধশ্রোতার মত শুনতাম আর ভাবতাম আলোর মধ্যে একটা অনেক ভাল মন আছে । বাইরে থেকে ওকে যতটা বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল দেখায় আসলে সে মোটেও তেমনটা নয় ।তাহলে সে কেন এমন অন্ধকার জীবনের সাথে নিজেকে জড়ালো । কেন এই নেশার জগতে পা বাড়ালো ?

একদিন পার্টি শেষে আলোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম । সে ক্লান্ত শরীরে ঢুলতে ঢুলতে আমার সামনে আসতেই বললাম-”আলো তুমি এসব ছেড়ে দাও । তুমি ফিরে এসো । “

আলো দু:খ করে হেসে বলেছিল-”সেটা সম্ভব নয় ” ।

-কেন সম্ভব নয়? ?

আলো উত্তেজিত হয়ে বলেছিল-”শুনতে চাও ? তাহলে শুনো ।আমার যখন আট বছর বয়স বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায় । মা আমেরিকায় চলে যান । সেখানেই আরেকটা বিয়ে করে সেটেল হন । আর কখনো ফেরেন নি । বাবার অনেক টাকা পয়সা, অনেক বড় ব্যবসা ,দামি গাড়ি সবই আছে শুধু আমাকে দেয়ার জন্য তার এতটুকু সময় নেই । এতটুকুও ভালবাসেন না তিনি আমাকে । কখন খেয়েছি কখন ঘুমিয়েছি কোন কিছুই তিনি জানেন না, কোন দিন খোজ রাখে নি । চাওয়ার আগেই টাকা পয়সা পেয়েছি ,কিন্তু যার জন্য শৈশব থেকে অন্তর তৃষনার্ত থাকত সেই বাবা মায়ের স্নেহ ভালবাসা কখনো পেলাম না । একসময় খুব একা লাগত । হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম । একা একা কাদতাম । বেচে থাকাটা মনে হত একধরনের বোঝা । বেচে থাকার অর্থই হারিয়ে ফেলেছিলাম ।অনেকবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলাম । নেশা নাকি মানুষের দু:খ কষ্ট ভুলিয়ে রাখে তাহলে নেশা ছাড়ব কেন বলো? ?

আলোর প্রশ্নের কোন উত্তর আমার জানা ছিল না । সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম আলো কেন রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার পর মাথা নিচু করে বসে থাকত , এলোমেলো চুলে ঢেকে ফেলত তার মুখ । সে কাদত । খুব নীরবে ,খুব আড়ালে । সেও তো এমন জীবন চায় নি কখনো ।

২……

মায়ের কাছে আলোর খুব প্রশংসা করতাম । বিশেষ করে সে যে এতভাল রবীন্দ্র সংগীত গাইত । মা নিজেও বাংলাদেশ বেতারে নিয়মিত রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন । আলোকে সাথে নিয়ে আসার জন্য খুব করে বলতেন । মায়ের ইচ্ছার কথা আলোকে বলেছিলাম । সেও আমার অনুরোধ রেখেছিল ।যেদিন আলোকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন আমি এক অন্য আলোকে দেখেছিলাম ।বরাবরের মত জিন্স প্যান্ট আর শার্ট পরা আলোকে সেদিন দেখেছিলাম নীল রঙের শাড়িতে ।সেইসাথে ম্যাচিং করে দুহাত ভর্তি চুড়ি পড়েছিল । কপালে কালো টিপ । এ যেন সত্যি আমার সেই আলো যাকে এতদিন ধরে মনে মনে খুজেছিলাম । মা আলোকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন । মায়ের আবদারে হারমোনিয়াম বাজিয়ে আলো একটার পর একটা রবীন্দ্র সংগীত গাইলো । আলোর গান শুনে মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল । মা আলোর হাতদুটোতে চুমু খেয়ে বলেছিল-”মাগো তুই সারা জীবনের জন্য আমার মেয়ে হবি? আমাকে মা বলে ডাকবি ?”

আলো সেদিন মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেদেছিল ।তার কান্নার কারন হয়ত আমি বুঝতে পেরেছিলাম ।

আলোকে নেশার অন্ধকার জগৎ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতাম । সুযোগ পেলেই সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আলোকে নিয়ে বেরিয়ে আসতাম শহরের কোলাহল ছেড়ে কিছুটা দূরে সবুজের কোলঘেষা কোন গাঁয়ের আকাবাকা পথে, নদীর ধারে গাছের নীচে বসতাম । সূর্যাস্ত দেখতাম দুজনে । আমার সাথে থাকত কবিতার বই ।কবিতা আবৃত্তি করে শুনাতাম ।

আমার চেষ্টায় ,মায়ের স্নেহ ভালবাসা পেয়ে আলোর নিজের মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল । সে ধীরে ধীরে নেশা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেছিল । কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল ।

অফিসে সে দিন পুরনো ফাইল ঘাটাঘাটি করছিলাম । হঠাৎ আলোর নম্বর থেকে ফোন আসে । আলো কান্না জড়ানো কন্ঠে বলেছিল-”একটাবার আসবে? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ।”

আমি স্থির থাকতে পারলাম না । অফিসের কাজ ফেলে দৌড়ে গেলাম আলোর বাসায় । বাসায় ঢুকে দেখি আলো অচেতন অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে । শরীরে প্রচন্ড জ্বর । বাসার কাজের ছেলেটা মিলে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে আসলাম । ডাক্তার কিছু টেস্ট করতে দিলেন । টেস্টের রিপোর্ট খুব খারাপ আসলো । ডাক্তার একেবারেই আশা ছেড়ে দিয়েছেন । ডাক্তারের পরামর্শেই আলোকে আই সি ইউ তে কৃত্তিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হল ।সেদিন মাও এসেছিলেন । আই সি ইউ এর ওয়েটিং রুমে বসে পাগলের মত কেদে আল্লাহর কাছে মেয়েটার সুস্থতার জন্য দোয়া করেছিলেন । আমি কাদতে পারি নি সেদিন ।কান্না আসছিল না আমার ।শুধু নির্বাক চোখে আই সি ইউ এর দরজার স্বচ্ছ গ্লাসের ভেতর দিয়ে আলোর নিথর শরীরটার দিকে তাকিয়েছিলাম । এটাই ছিল আলোকে শেষ বারের মত দেখা ।

{সমাপ্ত}

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.