
মাসুদ ইসলাম
এখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে অথচ মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যা সাতটা। আকাশে মেঘের ঘনঘটা।
বৃষ্টির কথা বলতে বলতেই মুষলধারে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করলো। যে হারে বৃষ্টি ঝরছে তাতে ঢাকার
রাস্তা এখন নদীতে রূপান্তরিত হবে। সাথে বোনাস হিসাবে থাকবে ট্র্যাফিক জ্যাম। এই কথা ভাবতেই
গা জ্বালা করছে।
এমন সময় শিলা(আমার স্ত্রী) চা নিয়ে এসে- “এত কি ভাবছো? প্রকৃতির সাথে সাথে মেঘের ঘনঘটা তোমার মুখেও দেখছি?”
“তুমিতো জানই আমি কাজের বেলায় কেমন ডেডিকেটেড। আজকে সকাল ১১ টায় এক পেশেন্টের ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। ক্রিটিক্যাল। যে হারে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করছে তাতে ঠিকমত পৌঁছতে পারবো কি না সেটাই ভাবছি”- স্মিত হাসি দিয়ে শিলাকে বললাম।
“আমার প্রতি তোমার এমন উদ্বিগ্নতা যদি দেখতে পেতাম”- শিলার দীর্ঘশ্বাস।
আমি শিলাকে আমার বুকে জড়িয়ে কপালে চুম্বন এঁকে দিলাম।
“বাবা তুমি অফিসে যাওয়ার পথে আমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যেও”- রাইয়ান এসে আমাকে বললো।
“বাপুনি তুমি দ্রুত তৈরী হয়ে এসো, আমি এখুনি বের হব।”
রাইয়ানকে আমি বাপুনি বলে ডাকি। ও ই এখন আমার সব। ওকে নিয়েই আমার পৃথিবী।
………………..
অপারেশন থিয়েটারে এসে রোগীর চেহারা দেখেই আমি জমে যাচ্ছিলাম। এই যে আমার অতি পরিচিত মুখ। রায়হান। যার সাথে মিলিয়ে রেখেছি আমার ছেলের নাম। আজ দীর্ঘ ২৩ বছর পর
তার চেহারা দেখতে পেলাম।
রায়হানকে দেখে যেমন আনন্দ লাগছে তেমনি কিছু প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমার মন অস্থির হয়ে উঠছে। তেমনি মনের ভিতর উকি দিয়ে যাচ্ছে না বলা অনেক মনের কথা।
কত মানুষের বুক কেটে অপারেশন করেছি কোন অনুভূতি কাজ করেনি, অথচ আজ আমার এত নার্ভাস লাগছে কেন? আমার হাত রিতিমত কাপছে।
কত ভেঙ্গে পড়েছে সুঠাম দেহের আমার রায়হান। বয়স বাড়লেও চেহারার মধ্যে সেই মায়াবী ভাবটা আজও ঠিক আগের মতই আছে।
তার হার্ট এ ৩টা ব্লক এর বাইপাস গ্রাফটিং করতে হবে। এমন কত ব্লক আমার হৃদয়ে হয়ে আছে এই রায়হানের জন্য, যার বাইপাস গ্রাফটিং পৃথিবীর কোথাও হয় কিনা কে জানে।
দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘন্টার সফল অস্ত্রোপচারের পর আমি রায়হানকে নিজে পোস্ট অপারেটিভ আই সি ইউ তে রেখে ওটি থেকে বের হয়ে আসি।
“আব্বু কেমন আছে? তিনি ঠিক হয়ে যাবেন তো?”- মুখে রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা নিয়ে আমাকে ২২-২৩ বছরের যুবকের জিজ্ঞাসা।
আব্বু ডাক শুনেই বুঝতে বাকি রইলোনা ও রায়হানের ছেলে।
“তোমার আব্বুর কিছু হবেনা। জ্ঞান ফিরে আসলে তার সাথে দেখা করতে যেও।”আমি ছেলেটির মাথায় হাত বুলালাম।
ছেলেটির চোখ বেয়ে অশ্রু বয়ে যাচ্ছিলো। আমি ওর চোখ মুছে আমার সাথে আমার রুমে নিয়ে আসলাম।
“তোমার নাম কি?”
“সিফাত আহমেদ।”
“তোমার আম্মু আসেনি?”
“গত বছর মা আমাদের সবাইকে রেখে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন।”-বলেই ছেলেটি মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে থাকলো।
সিফাতকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে যেয়ে নিজেই তার কষ্টকে অনুভব করতে লাগলাম।
“তোমাদের বাসায় আর কে কে আছেন?”
“শুধু আমি আর বাবা।”-সিফাতের দীর্ঘশ্বাস।
সিফাতের দীর্ঘশ্বাস জানান দিচ্ছে তার অসহায়ত্বের কথা। নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারছি কারো জন্য বাবা-মা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত কত বড় অমূল্য সম্পদ। সব বাবা-মা ই তাদের সন্তানকে বট বৃক্ষের ন্যায় ছায়া দিয়ে আগলে রাখেন।
ভাবনার ভুবন থেকে বেরিয়ে সিফাতের সাথে আবার কথা বলতে শুরু করি।
“তুমি কি কর?”
“আমি আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। বাবার ইচ্ছা আমি ডাক্তার হব। তাঁর ইচ্ছা কে আমাকে যে পূর্ন করতেই হবে।”
সিফাতের মাঝে ওর বাবার ইচ্ছা পূরণের একান্ত চেষ্টা দেখতে পেলাম। সিফাতের মনোবল দেখে খুব ভাল লাগলো। সাথে সাথে ভাল লাগছিল এই ভেবে যে, রায়হান তার ছেলেকে সুশিক্ষায় বড় করে গড়ে তুলছে দেখে।
………………
এক সপ্তাহ পরে-
অনেকটা সাহস আর কথা বলার একান্ত ইচ্ছা নিয়ে আমি রায়হান এর কেবিনে গেলাম।
রায়হান শুয়ে আছে। এত অসুস্থতার মাঝেও তার চেহারায় সেই আগের চঞ্চল রায়হানকেই দেখতে পেলাম। খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে ২৩ বছর আগের বলতে যাওয়া না বলতে পারা সেই ভালোবাসার কথা। স্মৃতির ফ্রেমে ভেসে উঠছে সেই হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা।
ফিরে দেখা-১৯৮৬ সাল
মাকে সালাম করে বাবার পায়ে কদম্বুচি করতে যেতেই, “অত্র লৌহজং এ কোন ডাক্তার নাই। তুমি নামকরা ডাক্তার হইয়া এই গ্রামের নাম উজ্জ্বল করবা। আমি চাই তোমার নামেই আমাদের পরিবারের নাম উজ্জ্বল হোক।”
“আমি আপনার ইচ্ছা পূরণে নিজেকে নিয়োজিত করে দিব।”-বলেই বাবার পা ধরে সালাম করলাম।
“তুমি যাতে ঠিকমত পড়তে পার এই জন্য আমার বন্ধুর বাড়িতে তোমার থাকার ব্যবস্থা করেছি। ও শুধু আমার বন্ধু না, আমার ভাইও। ওরে তুমি আমার মতই পূর্ণ সম্মান করবা। ওখানে তোমার কোন অবহেলা হইবোনা।”
“আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন। আমার দ্বারা তার কোন অসম্মান হবেনা।”
………………
বাবার দেয়া ঠিকানা মত আরমানিটোলায় বাবার সেই বন্ধুর বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। দীর্ঘ ৬ ঘন্টার লঞ্চ যাত্রার পর কিছুটা ক্লান্তও লাগছিল।
একতলা পাকা বাড়ির সদর দরজায় নক করতেই আমার সমবয়সী একজন দরজা খুলেই-
“কারে চাই?”
তার কর্কশ মার্কা কথা শুনে হতবাক হয়ে বললাম- “এটা কি রাজ্জাক চাচার বাড়ি?”
“হ এডাই। তো?”
এমন সময় ভিতর থেকে ভারী কন্ঠের কেউ একজন জিজ্ঞাস করলো- “ঐ রায়হান, কে আইচে?”
বুঝতে পারলাম ছেলেটির নাম রায়হান। তখন সে উত্তরে বললো- “আব্বা এউগা মানু আইছে।”
বুঝতে পারলাম ভারী কন্ঠের সেই লোকটি রায়হানের বাবা। ভিতর থেকেই তিনি বললেন-“আল্লা যে তরে কবে বুদ্ধি সুদ্ধি দিব। মেহমানরে বাইরে খাড়া করাই রাখছস। বেটা আহাম্মক কোনহানকার!”
আমি আহাম্মক শব্দটা শুনে হেসে উঠি। আমার হাসিতে রায়হানের ইগোতে আঘাত লাগে।
“হইচে। আর ভেটকি মারন লাগবো না। ভিত্রে আহেন।”
ঢাকাবাসীর কথা শুনলে কর্কশ মনে হলেও মনের দিক থেকে তারা খুবই নরম মনের। তাদের সাথে কিছুদিন থেকেই বিষয়টা আমার বোধগম্য হয়।
…………………
আমার থাকার ব্যবস্থা হল বাড়ির চিলেকোঠায়। রাজ্জাক চাচার পরিবারের সবাই আমাকে তাদের পরিবারের সদস্য হিসাবে গ্রহন করে নেয়, কেবল রায়হান বাদে। কেন জানি আমাকে উত্যক্ত করে ও অনেক মজা পেত। রায়হানের মা-বাবা, বড়ভাই-ভাবী সবাই আমাকে অনেক স্নেহ করেন।
রায়হান আমাকে উত্যক্ত করলে কি হবে, মনের দিক থেকে সে অনেক দয়ালু। রায়হানের একটা বিশেষ গুন ছিল। ও ঢাকার ভাষায় কথা বলতো ঠিকি কিন্তু ওর পোষাক ছিল বেশ মার্জিত। টিপিক্যাল ঢাকার লোকদের মত সাদা লুঙ্গি, শার্ট এসব পড়ে বেড়াত না।
ঢাকার পরিবারের আতিথেয়তায় আসলেই একটা মোঘল ভাব আছে। এই পরিবারের মোঘলদের মত খাবার খেয়ে আমি দিনে দিনে ফুলে বেলুন হয়ে যাচ্ছিলাম।
……………….
রায়হানের কবুতর পোষার শখ। খুব ভালো ঘুড়িও উড়াতে জানে। ঘুড়ি উড়াতে আর কবুতরের জন্য সে বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বাড়ির ছাদেই থাকে। তার কবুতর পোষা আর ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে আমার বেশ ভাল লাগত।
সে খুব গান শুনতে পছন্দ করে। হিন্দী গান। বাড়ির ছাদেই তাকে গান শুনতে হবে সেও অনেক সাউন্ড দিয়ে। তার এই একটা স্বভাবই আমার অনেক বিরক্ত লাগে।
পাড়ার অসহায় থেকে শুরু করে গরীব দুঃখীর প্রতি তার দয়ার পরবশ মনোভাব আমাকে মন্ত্রের মত টানতো।
রায়হান জগন্নাথে সমাজ বিজ্ঞানে পড়ছে। তারপরেও কেন যে অসামাজিকের মত মাঝে মাঝে কাজ করে আমাকে চরম বিরক্ত করে?- সেটাই আমি বুঝিনা।
আমি যখনি পড়তে থাকি তখনি তাকে গান শুনতে হবে।
তেমনি একদিন সে সাউন্ড দিয়ে “হাম তুম এক কামড়ে মে বান্দ হো অর চাবি খো যায়ে” এই গানটা শুনছিল আর আমার দিকে ঈঙ্গিত করে নিজেও গাইতে ছিল।
সাউন্ড সিস্টেমের শব্দে এমনি আমার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তার মধ্যে ওর উস্কানি একদম অসহ্য লাগছিল।
নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ওর হাতটা ধরে এক টানে আমার ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে- “আমরা এক ঘরেই দরজা বন্ধ করে আছি। তো কি হবে?”
আমার রাগ দেখে ও একদম চুপ হয়ে গেল।
চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে মাথা নিচু করেই বের হয়ে যায়।
……………
পরের দিন সকালে আমি ক্লাসে যাওয়ার পথে, “সাব্বির শোন।”
“কি বলবে? বল?”
“আমি তোমারে খুব বিরক্ত করি, হাচা না?”
“যে উত্তর তোমার জানা তা কেন জানতে চাইছো?”
আমার হাতটা ধরে কিছু বলতে চেয়েও কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
সে আমার হাত ধরার সাথে সাথেই আমার দেহে কেমন যেন একটা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক পরিচিত জনের স্পর্শ আমার দেহে বয়ে যাচ্ছে।
আমিও রায়হানকে কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে আসি।
……………
সেদিন বিকালে বা সন্ধ্যায় আমি ছাদে রায়হানকে দেখতে পেলাম না।
তার সেই অনুপস্থিতি আমার মনে কেমন যেন একটা চাপা কষ্টের সৃষ্টি করছে। মনে হচ্ছে কি যেন আমার থেকেও নেই। এই কষ্ট সহ্য করা যে অনেক বড় কষ্টের।
মনের মধ্যে রায়হানের জন্য ফুলের বাগানের অস্তিত্ত্ব টের পাচ্ছি। সেই বাগানের ফুলের সুবাসে চারপাশ মনে হচ্ছে মৌ মৌ করছে।
তাই স্থির থাকতে না পেরে নিচে নেমে রায়হানের ঘরে চলে আসি।
“আজ যে ছাদে গেলেনা?”
“আমার লেইগ্যা কেউ বিরক্ত হয় এইডা আমি চাই না।”
“কিছু কিছু বিরক্ত হওয়ার মাঝেও অনেক মজা আছে।”
রায়হান কেমন যেন নিষ্ঠুরের মত বলে, “আমার লগে তামাসা কর?”
কথাটা কেমন যেন মনের মধ্যে গিয়ে বিঁধেছে।
ঢাকার ভাষায় কথা বলে আমি সেটা নিয়ে হাসি বলে হয়তো এই কারনে ও আমার এই অনুভূতিকেও তামাশা মনে করছে।
কারো কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে কটাক্ষ করা ঠিক নয়। এই কথাটা সেই সময়ে হারে হারে টের পাচ্ছিলাম।
এভাবে কেটে যায় কয়েকটি দিন। একই বাড়িতে থাকি অথচ দুজনের সাথে প্রায় দেখাই হয় না।
তার অনুপস্থিতি হৃদয়ে অনবরত রক্তক্ষরণ করে যাচ্ছে।
তার প্রতি দিনে দিনে খুব নির্ভর হয়ে যাচ্ছি। এই নির্ভরতায় লেখাপড়ায় মারাত্মক ভাটা আসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে বাবাকে দেওয়া কথা।
এখানে থাকলে সেই প্রচেষ্টা অধরা থেকে যাবে ভেবে হোস্টেলে উঠার সিদ্ধান্ত নেই।
……………….
লেখাপড়ার অযুহাতে সেই বাড়ি থেকে হোস্টেলে চলে আসি যাতে আমার বাবা যেন রাজ্জাক চাচার উপর অকারনে না রাগ করেন।
রায়হানকে কিছু না বলেই হোস্টেলে চলে আসি। ও জানার সাথে সাথেই হোস্টেলে এসে হাজির।
“আমিতো এক্কন আগের মতন গান হুনিনা। তুমি অহনেই আমার লগে বাড়িতে চল। খোদার কসম। আর কোনদিন তোমারে জ্বালামু না।”
প্রিয় মানুষের এমন আকুতি দেখে একদিকে যেমন আনন্দ হয় তেমনি সেই আকুতি রক্ষা করতে না পারলে তার চেয়ে ঢের বেশী কষ্ট হয়।
তেমনি মনে এক চাপা কষ্ট নিয়ে বললাম, “উঠে যখন পড়েছি থাকি না। এখানে থাকলে সহপাঠীদের সাথে গ্রুপ করে পড়া যাবে। আমার অনেক উপকার হবে।”
“বুজিতো। আমি সব কিছুই বুজি। তুমি সুধু নিজেরটাই বুজলা। আমি হালার কতা একবারও বুজলা না।”
রায়হানের কথা কেন যেন আমার কানে বাড়ি খেয়ে গেল। মনকেও নাড়া দিল। ওর কথা এড়িয়ে বললাম, “চা খাবে?”
আমার প্রস্তাবে ও একটা কপট রাগ দেখিয়ে চলে গেল।
…………..
পরের দিন বিকালে রায়হান কে দেখি আমার হোস্টেলের নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি নিচে গিয়ে, “আমার রুমে না এসে এভাবে নিচে কেন দাঁড়িয়ে আছ?”
“এইডা আমার ব্যাপার। ভাল্লাগতাছে তাই খাড়াই আছি। তোমার ছমস্যা হইলে যামুগা।”-বলেই হাটা শুরু করলো।
আমি রায়হানের হাত ধরে থামালাম। একটু মৃদু হাসি দিতেই রায়হানের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।
আজকের আবহাওয়াটা বেশ দারুন। খুব সুন্দর বাতাস বয়ে বেড়াচ্ছে। এমন সময়ে প্রিয় কারো সাথে ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা। আমার খুব ইচ্ছা করছে ওকে নিয়ে ঘুরতে। তাইতো ওকে বললাম, “চল। নৌকা দিয়ে ঘুরে আসি।”
“সত্যি কইতাছ?”
“সত্যি বলছি। আর আমি যেভাবে কথা বলছি এভাবে কথা বলবে। বুঝেছ?”
“হ, বুঝবার পারছি।”
“কি?”- কপট রাগ দেখিয়ে চোখ বড় করে রায়হানের দিকে তাকালাম।
ও আমার হাত ধরে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে-“এতদিনের অভ্যাস, একটু সময়তো লাগবোই।”
দুজনেই একসাথে হেসে উঠি।
মিটফোর্ডের নাদু ব্যাপারী ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে দুজনে ঘুরলাম। রায়হান সাঁতার জানেনা শুনে নৌকা দুলিয়ে ভয় দেখাতে চেষ্টা করলাম।
রায়হান ভয় না পেয়ে বলে, “তুমিতো আছই। আমার ভয় কিসের?”
মনে মনে ভালোবাসার আবেগে বললাম, “আমার উপর তোমার এত ভরসা?”
…………..
সময় তার আপন গতিতেই চলতে থাকে। এরি মাঝে আমি আর রায়হান আরো বেশী ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। সময় করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই। এরি মধ্যে রায়হান আমার মত করে বলতেও শিখে যায়।
আজকে বিকালে একটা খাম পাই। যাতে ছোট একটা চিরকুট পাই। তাতে লেখা-
“আমি একদিন তোমায় না দেখিলে,
তোমার মুখের কথা না শুনিলে,
পরান আমার রয়না পরানে।”
পড়ে বুঝতে বাকি থাকে না কে দিয়েছে। নিচে তাকাতেই দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি রায়হানের কাছে যেয়েই, “আজ তোমাকে দেখতে নায়ক জাফর ইকবালের মত লাগছে।”
“তুমিও কম কিসের? একদম আলমগীরের মত”- হাসতে হাসতে রায়হান বলতে থাকে।
তখন রায়হানের হাত ধরে আমি-“দেখতে দেখতে আমার শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেল। সামনে আমার কয়েকদিনের ছুটি আছে। ভাবছি এই ছুটিতে তোমাকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে যাব। তুমি যাবে আমার সাথে?”
ও খুশীতে বাচ্চাদের মত, “হুররে! দারুন হবে। কবে যাচ্ছি আমরা?”
“আগামীকাল রাতের ট্রেনে আমরা চট্টগ্রাম যাব। সেখান থেকে কক্সবাজার। কি বল?”
“ওকে। আমি যাব। তুমি কমলাপুরে গিয়ে টিকেট কেটে রেখ, আমি যথা সময়ে চলে আসব।”
…………..
আজকে আমি আমার পছন্দের মানুষকে নিয়ে সমুদ্রে দর্শনে যাব, ভাবতেই আমার এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে যাচ্ছে। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছেনা। আমি সন্ধ্যার মধ্যেই কমলাপুর যেয়ে টিকেট কেটে রায়হানের অপেক্ষায় থাকি।
অপেক্ষা করা আসলেই খুব কঠিন কাজ। অপেক্ষার সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না।
আমি রায়হানের অপেক্ষায় থেকে অস্থির হয়ে যাচ্ছি। ট্রেন ছাড়বে সেই রাত ১১ টায়।
এখন বাজে রাত সাড়ে ১০ টা। এখনো রায়হানের কোন খবর নেই। ট্রেন এর সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে ছুটে যাচ্ছে। আমি ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছি রায়হান এসেছে কিনা।
ট্রেন চলতে চলতে কখন যে বিমান বন্দর ষ্টেশনে এসে পড়েছে তা বলতেও পারবো না। খুব রাগ হচ্ছিল নিজের উপর। সাথে সাথে রায়হানের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। রাগ করা ছাড়া তখন আর কিছুই করার ছিলনা।
আমি একাই চলে গেলাম সমুদ্র দর্শনে। একা একা ঘুরে এলাম সাতটি দিন।
কক্সবাজার থেকে ফিরে আসার ৩ দিন পর জানতে পারি রায়হান বিয়ে করেছে। রায়হানের বিয়ে করার কথা শুনে নিজেকে অসাড় মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার চারপাশের সব কিছু থেমে গিয়েছে। মনে হচ্ছিল আমার অক্সিজেন কেউ নিয়ে নিয়েছে, এখন শ্বাস নিব কি করে?
কেমন করে একজন মানুষ অন্যজনের মন নিয়ে খেলা করতে পারে, সেই চিন্তা করে রায়হানের প্রতি আমার প্রচুর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
কেন সে আমার সাথে এমন করলো? তা থেকে গেল অজানা।
…………..
বর্তমান সময়ে-
রায়হানের ঘুম ভাঙ্গা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করছিলাম। অল্প কিছুক্ষণ পরেই সে চোখ মেলে তাকায়।
আমাকে দেখে, “সাব্বির, তুমি?”
রায়হানের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি ওর চোখ মুছে দেই।
“অনেক দিন পর তোমার দেখা।”- কাঁপা কন্ঠে রায়হান বলছে।
আমি রায়হানের হাত ধরে-“সেই ৯২ তে তোমার সাথে আমার শেষ দেখা। দীর্ঘ ২৩ বছর পর অপারেশন টেবিলে আবার তোমাকে দেখলাম।”
“হার্টের ডাক্তার হয়ে পেরেছ কি আমার হৃদয়ের সব ক্ষত দূর করতে?”- অভিমানী সুরে রায়হান।
“যে ক্ষত তোমার নিজের তৈরী তার জন্য আমি কি করতে পারি?”- প্রতি উত্তরে আমি।
“আমাকে একটি বার সেদিনের সেই কারন বলার সুযোগ না দিয়ে তুমি চলে গিয়ে আমাকে এত কঠিন শাস্তি দিলে?”
আমি রেগে গিয়ে-“তোমাকে শাস্তি দিলাম মানে? তুমি নিজেই তো আমার সাথে প্রতারণা করেছ। বিয়ে করে সংসারী হয়েছ। আবার বলছ, তোমাকে আমি শাস্তি দিয়েছি। শাস্তি আমি আমাকে প্রতিদিন দিয়েছি। বঞ্চিত করেছি আমার স্ত্রী কে। তোমার জন্য কখনো আমি তাকে মন দিয়ে গ্রহণ করতে পারিনি। অথচ স্বামী এই ট্যাগ লাগিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি ২১ টি বছর। জানিনা আমার ছেলের জন্য প্রকৃত বাবার দায়িত্ব টুকুও আমি ঠিকমত পালন করতে পারছি কিনা?”
আমার কথা শুনে রায়হান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুমিতো সব কিছুই পেলে। দায়িত্ব পালন করতে না পারলেও তুমি কারো স্বামী হতে পেরেছ, নিজের ঔরসজাত সন্তানের পিতার দায়িত্ব পালন করতে পাড়ছ। বলতে পারো আমি কি পেলাম?”
রায়হানের কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে, “তুমি কি পেয়েছ- মানে?”
…………..
২৩ বছর পূর্বে-
আজ রায়হান অনেক খুশী। কেননা আজকে সে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে সমুদ্র দর্শনে যাবে। সে ঠিক করে সমুদ্রের কাছে গিয়ে তার ভালোবাসার মানুষকে “আমি তোমাকে ভালোবাসি” বলবে।
রায়হানের খুশীর চঞ্চলতা দেখে মা বলেন, “এত বেশী অস্থির হইস না। খোদা না করুক কোন ছমস্যা অইলে তহন বহুত জ্বালা লাগব।”
মায়ের মন নাকি আগে থেকেই অনেক কিছু বুঝতে পারে, তাই হয়ত তিনি এমন বলেছিলেন।
দুপুরে যখন রায়হান খাবার খেতে বসে তখন সে তার বড় ভাইয়ের দূর্ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে ছুটে যায়।
দূর্ঘটনায় রায়হানের ভাই রানা মারাত্মক আহত হয়। ডাক্তারেরা তার বাঁচার আশা ছেড়ে দেয়।
রায়হান হাসপাতালে পৌঁছালে তার ভাই তার ছেলেকে রায়হানের হাতে সোপর্দ করে যায়।
রানা গত হওয়ার পরে হাসি-খুশী সেই পরিবারটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাজ্জাক সাহেব ছেলের শোকে একদম ভেঙ্গে পড়েন। কেনই বা পড়বে না? পিতার কাঁধে ছেলের লাশ- এর চেয়ে বড় কষ্ট পৃথিবীতে কোন পিতার জন্য নেই।
একমাত্র ভাইকে হারিয়ে রায়হানও শোকে পাথর হয়ে যায়। ভুলে যায় সাব্বিরের কথা।
রানা মারা যাওয়ার সপ্তাহ না যেতেই রানার স্ত্রী কে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার বাবা আসেন। রায়হানের বাবা-মা তারা তাদের নাতী এর কথা চিন্তা করে রানার স্ত্রী কে নিয়ে না যেতে অনুরোধ করলে রানার শ্বশুর-“বিয়াই সাব। এই অল্প বয়সে মাইয়াডারে সারাজীবন বিধবা হিসাবে দেখি কেমতে। সারা জীবন মাইয়াডা আমার সামনে সাদা শাড়ী পইড়া থাকবো, এইডা আমি সহ্য করবার পারুম না।”
“ঠিক আছে প্রয়োজনে রায়হানের লগে বিয়া দিয়া অরে এই বাড়িতেই রাখুম।”
বাবা-মা অনেকটা জোর করেই রায়হানের সাথে তার বিয়ে দেয়।
এর মাঝেই রায়হান ছুটে যায় সাব্বিরের হোস্টেলে। সেখানে গিয়ে সে জানতে পারে সাব্বির সেখান থেকে চলে গেছে। তার জন্য রেখে গেছে একটা চিঠি। যাতে শুধু তাকে ভুল বুঝেই কিছু উপমা লেখা।
সাব্বিরের চলে যাওয়া রায়হানকে পাগলের মত করে তুলে। অনেক চেষ্টা করে সাব্বিরের ঠিকানা পাওয়ার। কিন্তু সব গুড়ে বালি।
রায়হান তার ভাবীকে বিয়ে করলেও কখনো তার সংস্পর্শে যায় নি। এমনকি তার ভাবীও তাকে কখনো এই বিষয়ে আপত্তি তুলেনি।
রায়হান তার ভাতিজা সিফাতকে নিজের ছেলের চেয়েও বেশী করে বড় করতে থাকে। আদরের এতটুকুও কমতি রাখেনি।
দিনের পর দিন রায়হান সমাজ-সংসারের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছে। অনবরত নিজের চাওয়া-পাওয়াকে বলি দিয়েছে।
সমাজের চোখে হয়েছে একজন সফল স্বামী, একজন গর্বিত পিতা।
…………….
বর্তমানে-
রায়হানের কাছে সব কিছু শুনে আমি নির্বাক হয়ে যাই। অনবরত আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে। ভালোবাসার মানুষের প্রতি বিশ্বাসের বদলে তাকে প্রতারক বলে বিষোদগারের যন্ত্রণা হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করছে।
আমার চোখের পানি দেখে রায়হান উতলা হয়ে উঠে। তার এই উতলা হয়ে উঠা সেই আগের রায়হানের মত। তার ভালোবাসার কাছে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে।
অনুশোচনার কাঁটা হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করছে এই ভেবে যে, কেন তাকে ভুল বুঝে কপট অভিমান দেখিয়ে সেদিন দূরে চলে গিয়েছিলাম।
রায়হানের চোখও জল জল করছে। এই জল ভালোবাসার। এই জল ভালোবাসার মানুষের ভুলকে ভাঙ্গাতে পাড়ার।
আজ নিজেকে অবুঝ শিশুর মত লাগছে। রায়হানের বুকে নিজেকে সোপর্দ করে নিজের কষ্টকে ভুলার চেষ্টা করছি। দুজনেই কেঁদে নিজেদের হালকা করছি।
কিছুক্ষণ পর রায়হান আমাকে বলে, “সেই দিনটায় যদি আজকের মত এত প্রযুক্তি নির্ভর হতো! তখনকার দিনে যদি এখনকার মত মোবাইল ফোন, ফেইসবুক এসব থাকতো! তাহলে কি তুমি আমাকে ভুল বুঝে চলে যেতে পারতে? আমাদের দুজনের জীবন অন্যরকম হলেও হতে পারতো। তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটা যখন আমার ২৬ ছিল তখন বলতে চেয়েছিলাম। সেটাই এখন ২৩ বছর পরে ঊনপঞ্চাশে এসে তোমাকে বলতে হচ্ছে- I Love You Sabbir।”
*****(সমাপ্ত)*****
উৎস: অন্যভুবন