কিছু প্রেম

অরন্যের দেবদূত

সুবিশাল নীল জলরাশির গায়ে আঁচড় কেটে এগোচ্ছে কারুকার্যখচিত ময়ুরপঙ্ক্ষী। দেখলেই বোঝা যায় কোনো ধনী সওদাগর নাহয় কোনো রাজার জলযান। তার পিছনে আরোও বেশ বড়সর একটা নৌকার বহরও দৃষ্টিগোচর হয়। দুর হতে রাজ্যের প্রজারা রাজার নৌকার বহর দেখে উচ্ছাসে ফেটে পরছে। বেশকিছুদিন পর রাজা আলভার্ট এডিসন ভ্রমণ সেরে নিজ রাজ্যে ফিরছেন। প্রজাদের প্রাণের মানুষ তিনি। তার রাজ্যে অশান্তি এতটুকুও দৃষ্টিগোচর হয়না। তবে এ কদিন রাজা ভ্রমণে থাকায় রাজ্যে বেশ অশান্তির একটা কালো আবরণ পরেছিল। দেখতে দেখতে রাজার নৌকার বহর সাগর তীরে প্রায় চলে এসেছে। অগনিত মানুষ পথের দুপাশে রাজাকে সম্মান জানাতে আছে।

রাজা এডিসন যখন যাচ্ছিলেন তখন তার সাথে কোনো এক সুদর্শন যুবকের উপস্থিতি সবাই লক্ষ্য করেছিল। সবার মনে একটাই প্রশ্ন। কে এই যুবক?? যে কিনা রাজার পাশাপাশি হাটছে। এ অধিকার তো রানী ছাড়া আর কারও হয়না। তবে এ রাজ্যের রানী নেই। রাজা কখনোই বিয়ের বিষয়ে মত প্রদান করেননি। এর কারণ সবারই অজানা। প্রাসাদে ফিরে ক্লান্ত এডিসন বিশ্রামের লক্ষ্যে শয়নকক্ষে গেলেন। তারপর এক দাসকে ডেকে বললেন প্রিন্স হ্যারন্ড কে ডেকে আনতে। প্রিন্স রাজার কক্ষে প্রবেশ করতেই তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করলেন এডিসন। অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত কোমল ওষ্ঠ্যে চুমু খেয়ে বিছানায় এলিয়ে পরলেন এডিসন আর তার বক্ষে আবদ্ধ প্রিন্স হ্যারন্ড। কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে প্রিন্সের চোখের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন করে কিছু প্রেমবাক্য উচ্চারণ করলেন এডিসন। আর মুগ্ধ হ্যারন্ড শুধু উপভোগ করছেন প্রেমসুধা। রাজা এডিসনের বাহুডোরে আবদ্ধ প্রিন্স হ্যারন্ডই সেই যুবক যিনি রাজার পাশাপাশি হেটেছিলেন সবাইকে বিস্মিত করে।

প্রিন্স হ্যারন্ড বিশাল এক দীপের যুবরাজ। রাজা এডিসন ভ্রমণে বের হয়ে যখন ওই রাজ্যে গিয়েছিলেন তখন রাজপ্রাসাদে আতিথেয়তা স্বিকার করতে যেয়ে হ্যারন্ডের সাথে পরিচিত হন। হ্যারন্ডের পিতা রাজা মিডফোর্ড খুব চিন্তিত ছিলেন তার পুত্র হ্যারন্ডকে নিয়ে। কারণ তিনি হ্যারন্ডের সমকামীতার কথা জানতেন। এডিসন দুশ্চিন্তার কারণ জানতে চাইলে সব বলেন তিনি। এডিসন হ্যারন্ডের সমকামীতার কথা জানামাত্র রাজা মিডফোর্ড কে প্রস্তাব করেন যে তিনি হ্যারন্ডকে ভালোবাসেন এবং তাকে নিয়ে যেতে চান। এতে মিডফোর্ড দ্বিমত পোষন করেননি। সেদিন থেকেই তাদের পথচলা। রাজা এডিসন আর হ্যারন্ড একে অপরকে পুলকিত করছিলেন।

এতদিন ভ্রমনের ক্লান্তি,, অবসাদ যেনো নিমিষেই মিলিয়ে যাচ্ছিল। সবমিলিয়ে এক প্রেমময় রাত্রি যাপন করে প্রেমিকযুগল। চারদিকে সোনালি আভা ছড়িয়ে ভোরের সূর্য উঠছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ ঢেউ খেলে দিক – বেদিক ছড়াচ্ছে। নানা বর্ণের ফুলে ভরা রাজপ্রাসাদের ফুলের বাগান থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছিল। এডিসনের কক্ষের পাশেই ছিলো বাগান টা। সে ফুল খুব ভালোবাসে। বারান্দায় দাড়িয়ে প্রতিদিন ফুল দেখা আর কাকাতুয়ার সাথে কথা বলা এডিসনের অভ্যাস।

রাজা এডিসনের কাকাতুয়া একটু ভিন্ন ধরনের ক্ষমতা সম্পন্ন। কোনো একদিন অচিন কোনো রাজ্যে থেকে উড়ে এসে এখানে ঠাই পেয়েছে পাখিটা। ভীষণ সুন্দর করে কথা বলে। সকালে রাজার ঘুম এই পাখিটাই ভাঙ্গায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ঘুম ভাঙার পর এডিসন হ্যারন্ডকে ডাক দিতে যেয়েও থেকে গেলেন। ঘুমন্ত প্রিন্স কে দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলেন তিনি। অপূর্ব সুন্দর। এক রকম ঘোর কাজ করছিল। হ্যারন্ডকে নিয়ে যখন সমুদ্র পথে রাজ্যে আসছিলেন এডিসন তখন একদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। সাথে ঝড়ো হাওয়া। নৌকা বারবার কাত হয়ে যাওয়ায় বেশ ভয় পাচ্ছিলেন প্রিন্স হ্যারন্ড। ছোট বেলা থেকেই অবশ্য তিনি খুব শান্ত। ঝড়ো হাওয়া কমার পর হালকা বৃষ্টিতে অনেকটা জোর করেই কেবিন থেকে হ্যারন্ডকে নৌকার খোলা স্থানে নিয়ে এসেছিলেন রাজা এডিসন। আর সেদিনই প্রথম চুম্বনের স্বাদ পেয়েছিলেন তারা।

এরইমধ্যে হ্যারন্ডের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তার ডাকে এডিসন সম্মতি পাওয়া মাত্র জরিয়ে ধরে চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছিলেন প্রিন্স কে। লজ্জায় মুখ ঘুড়িয়ে নেয় কাকাতুয়া। ফোটা ফুলগুলো যেনো আবার পাপড়ী গুটিয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু চুম্বনের স্বাদ আস্বাদন যেনো শেষ হবার নয়। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে গিয়েছিলেন এডিসন আর হ্যারন্ড। তবে রাজা ভ্রমণ থেকে বা যুদ্ধ থেকে ফিরলে বিশেষ মন্ত্রীগনের সাথে একবার একসাথে নাস্তা করেন রাজা। এটা রাজ্যের রীতি। তাই মহামন্ত্রীও ছিলেন সেখানে। মহামন্ত্রি খুব ধার্মিক লোক। যিশুর খুব বড় ধরনের ভক্ত। তাই তার কাছে এডিসন আর হ্যারন্ডের বিষয় মোটেই ভালোলাগছে না। কিন্তু সে কিছু বলতেও পারছে না। তাই কোনোরকম নাস্তা করে নিজ কাজে চলে গেলেন মন্ত্রী।

সেদিনই অপরাহ্নে এডিসনকে মন্ত্রী অনুরোধ করলেন সমকামীতা থেকে মুক্ত হবার জন্য। যিশুর কঠোর বাণী শুনালেন তিনি এডিসনকে। এডিসন হ্যারন্ডের মতামত বুঝার লক্ষ্যে তার দিকে তাকালেন। হ্যারন্ডের চোখ ছলছল করছিল ভালোবাসা হারানোর ভয়ে। এডিসন আচমকা মন্ত্রীকে বলে উঠলেন- “এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কখনোই নিজেকে অস্বীকার করতে পারিনা। এ রাজ্যে সমকামীতা বৈধ। এটা অবশ্যই ভুলে যাবেন না। আপনি এর আগেও আমার বিরোধিতা করেছেন। আমি আপনাকে পিতার মতো সম্মান করি। হয়তো সেজন্যই আপনি এখনও মহামন্ত্রী আছেন। ” শেষের বাক্যটা শুনে প্রচন্ড অপমানিত বোধ করলেন মহামন্ত্রী। এর আগেও তিনি সমকামীতা বৈধতা করার সময় এডিসনের বিরোধিতা করেছিলেন। কারন শুধু মন্ত্রী হিসেবে নয়। তার অন্য এক ধরনের অধিকার আছে রাজা এডিসনের উপর। কারণ এডিসন ছোটবেলা থেকেই মহামন্ত্রীর আদরে বড় হয়েছেন এবং তাকে বাবা বলেও ডাকতেন। তাই এডিসনের কাছে এরকম অপমান সহ্য না হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এডিসনও সেটা বুঝতে পারলেন যে পিতার মতো মানুষটাকেই এভাবে বলা উচিত হয়নি। বারান্দায় যেয়ে নিরবে দাড়িয়েছিলেন এডিসন। – তোমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম প্রিয়। হ্যারন্ডের কথায় সম্মতি ফিরে পেলেন এডিসন। এই প্রথম হ্যারন্ড তাকে প্রিয় বলে সম্বোধন করলো। – হ্যাঁ!! বলো। – আমার জন্য কেন এতোটা কঠিন হলে?? – তোমাকে যদি কেউ বলে আমাকে ছেড়ে দিতে?? তুমি তাকে কি বলবে?? – আমি রাজা নই। – আমিও রাজত্ব চাইনা যদি তুমিই না থাকো। – কিন্তু আমি তোমাকে ভবিষ্যতের রাজা কিভাবে দেবো?? – সেটা আমার ব্যপার। কিন্তু তোমাকে হারানো সম্ভব নয়। আবেগে ধরাশায়ী হয়ে হ্যারন্ড প্রচন্ডভাবে জরিয়ে ধরলো এডিসনকে। মুখ দিয়ে শুনে অস্ফুট সুরে বের হলো ভালোবাসি তোমাকে। বাকিটুকু চোখ দিয়ে ঝরছিলো। বাগানের অপরপ্রান্তে দাড়িয়ে চাদেঁর আলোয় সবকিছুই দেখছিলেন মহামন্ত্রী। কেনো যেনো খুব ইচ্ছা হলো পিতা হয়ে তাদের আশির্বাদ করে তাদের প্রেমে পূর্নতা দিতে।

নিজের কাদের উপর একফোঁটা পানির স্পর্শ পেয়ে জিসানের বুঝতে বাকি রইলো না যে আসিফ কাঁদছে। আসিফ যখন আবেগ আপ্লুত হয়ে যায় তখনই কাদে। এতোক্ষণ কোনো এক রূপকথা বলছিলো জিসান আসিফকে ঘুম পাড়ানোর জন্য। বুঝতেই পারেনি আসিফ কখন আবেগে জিসানকে জরিয়ে ধরে কাদতে শুরু করেছে। – কাঁদছো কেনো বাবু?? আসিফ কিছু বলতে পারছে না। আরেকটু শক্ত করে জরিয়ে ধরে অস্ফুট সুরে শুরু বললো ভালোবাসি। আজও আকাশে চাদ উঠেছে পূর্নভাবে। বারান্দায় বসা কাকাতুয়া আসিফ আর জিসানের থেকে মুখ ঘুড়িয়ে নিলো লজ্জা পেয়ে। কিছু ফুলও ছিলো বারান্দায় ছোট ছোট গাছে।

*****(সমাপ্ত)*****

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.