হৃদস্পন্দন

এমডি ইসলাম

ছেলেবেলায় প্রথম যে মানুষটা; চার দেয়ালের বাইরে পৃথিবীতে, সব’চে আপন হয়, তাকে বলে বন্ধু।

“একলা ঘর, ধুলো জমা গীটার,

পড়ে আছে লেলিন, পড়ে আছে সেক্সপিয়ার।

টি-শার্ট জিন্সগুলো দেরাজে আছে,

শুধু মানুষটা তুই নেই তো,

নেই রে কাছে।

ও বন্ধু তোকে মিস করছি ভীষন।

তোকে ছাড়া কিছুই আর জমেনা এখন।”

-পৃথিবীর সকল বন্ধুদের এই গল্পটি উৎসর্গ করা হল।

———————————-

Live your life fullest.

এই লাইনটার মানে বুঝাতে তুমি সেদিন আমাকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উক্তি বলেছিলে।

“Don’t you ever get the feeling that all your life is going by and you are not taking advantage of it? Do you realize you’ve lived nearly half the time you have to live already?”

তোমার সেদিনের সেই উক্তি আর তার চমৎকার ব্যাখ্যায় আমি বুঝে গিয়েছিলাম জীবনের মানে কি?

আজ আমি জীবনের মানে কি তা বুঝি, জীবনকে উপভোগ করতেও শিখেছি।

আমার এই আমি কে যে নতুন ভাবে তৈরী করেছে, যার অনুপ্রেরণায় আমি আজ বিশ্বের অন্যতম একজন অর্থপেডিস্ট, সেই তুমি কি না সফল এই আমি থেকে কতদূরে। জীবনের এই কি নিয়ম? এত সুখ, এত সফলতার মাঝেও আমাকে না পাওয়ার এক চরম বেদনার মধ্যে নিমজ্জিত রেখেছে।

———-

অনেক বছর পর আজ পরিবার নিয়ে দেশে ফিরলাম। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার যে আমূল পরিবর্তন হচ্ছে তা ঢাকার রাস্তার ফ্লাইওভার আর প্রাইভেট কারের জ্যাম দেখে বোঝা যাচ্ছে। পথের ধারে বড় বড় দালানও এর স্বাক্ষী দিচ্ছে। ভাবতেই অবাক লাগছে ১০ বছরেই এমন পরিবর্তন! শুধু এই ট্র্যাফিক জ্যাম ছাড়া।

কারওয়ান বাজার ক্রস করে পান্থপথের এই সিগনালটায় বসে থাকা বেশ বিরক্তি কর। ট্র্যাফিক পুলিশ যেন এই সিগনালে গাড়ি আটকে রাখতে বেশ পছন্দই করে।

এত কোলাহল, এত গাড়ির জট, এত কিছুর মাঝেও আমার চোখ আটকে আছে “হৃদয়কে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন” এই ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুই তরুনের দিকে।

হৃদয়কে বাঁচানোর জন্য পথচারীদের কাছে তাদের সাহায্যের নিবেদন দেখে নিজের মনে জমে থাকা কষ্টের এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি যেন আবার সজাগ হয়ে উঠলো।

———-

জানুয়ারী মাস, ২০০০ সাল। লেদার ইন্সটিটিউটে প্রথম বর্ষের ক্লাশ শুরু হয়েছে। গ্রামের ছেলে ঢাকায় এসেছি লেখাপড়া করতে। থাকার ব্যবস্থা তো করতে হবে। রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ডঃ কুদরতে খুদা হলের নতুন ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে। এমন সময় এক বড় ভাই-

  • ফার্স্ট ইয়ার?
  • জ্বী ভাইয়া।
  • কোন ডিপার্টমেন্ট?
  • ফুটওয়্যার।
  • এই সাবজেক্টের কোন ভবিষ্যত নাই। কেন যে চালু করলো?

একেই তো থাকার ব্যবস্থা না করতে পারায় রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা মাথায় কাজ করছে তার উপর সিনিয়র ভাইয়ের এমন কথায় যেন পায়ের নিচের মাটি সরে যাওয়ার মত অবস্থা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সেই ভাইয়া-

  • এত ঘাবড়ে গেলে হইবো? পুরুষ মানুষের এত ঘাবড়ালে চলে না। শক্ত হতে হবে। ওহ।। তোমার নাম জানা হল না।
  • আমি রুমন আহমেদ। আপনি?
  • সাজ্জাদ হোসেন। তা… তুমি থাক কোথায়?
  • আমি আপাতত জিগাতলায় আমার এক কাজিনের বাসায় আছি। পরিবারের সবাই থাকে শরিয়তপুরে।
  • তোমার তো তাহলে হলে সিট দরকার। এক কাজ কর। রুম নং-১১১ তে উঠে পড়। কেউ কিছু বললে আমার কথা বলবে।
  • ঠিক আছে ভাইয়া। কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দিব।

সেদিন সাজ্জাদ ভাইয়ের কথায় রুম নং-১১১ তে উঠি। এই রুমটা ছিল হলের গন রুম। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের এখানেই প্রথমে উঠানো হয়। সেও বড় ভাইদের যদি সু দৃষ্টি থাকে তবে।

———-

রুম নং-১১১ তে উঠে দেখি আমার মত আর ১০ জন আছে। আমি সহ হলাম ১১ জনের। সবার সাথেই পরিচিত হলাম। বেড শেয়ায়ারিং এর পার্টনার হল তপন। আমার ডিপার্টমেন্টেই পড়ে।

প্রথম দিন থেকেই দেখলাম সবার মুখে এক রাজ্যের চিন্তা। সবাই বেশ এক মানসিক চাপেই ছিল। আমি বিষয়টা তপনের কাছে জানতে চাইলাম।

  • ব্যাপার কি বলতো?
  • আজকে মাত্র রুমে উঠছ। সবই দেখবা। এমনও হতে পারে আজকেই তোমার বা আমার পালা হবে।
  • কিসের পালা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
  • গত রাতেও পাশের রুমের দুজনকে সেরাম র‍্যাগিং দিল।
  • ওহ মাই গড! এত ভয়াবহ ব্যাপার।

তপনের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতেই আমাদের রুমে কড়া পড়লো।

কড়ার শব্দে আমাদের সকলের ত্রাহি অবস্থা। রুমের দরজা খুলতেই কয়েকজন সিনিয়র ভাই রুমে প্রবেশ করেই-

  • ভাবছি আজকে তোদের রুমের কাউকে দিয়ে কাজ সারবো।

তারা আমাদের এগার জনের মধ্যে থেকে লেদার ডিপার্টমেন্টের সফিককে নিয়ে যেতে উদ্যত হলে আমি-

  • এসব অন্যায়। কেন এভাবে আমাদের হেনস্থা করছেন?

আমার এই কথাতে তাদের নেতা গোছের একজনের দেহে বিষের জ্বালা লাগলো মনে হয়। সে আমাকেও নিয়ে যাওয়ার জন্য আদেশ দিল। অগত্যা আমাদের দুজনকেই অনেকটা কোরবানীর গরুর মত করে টেনে হেঁচেরে নিয়ে যেতে লাগলো।

———-

আমাদের দুজনকে নিয়ে আসা হল পুরাতন হলের ছাদে। বলা হল নেচে তাদের মন ভরাতে। অস্বীকৃতি জানালে বোনাস হিসাবে জুটেছে কিল-থাপ্পর। আমার অপারগতা দেখে নেতা গোছের বড় ভাইটা এগিয়ে আসলো।

  • তোর দেখছি খুব তেজ।

আমি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই ভাই এবার গেল সফিকের কাছে।

  • কিরে? তোর চেহারা দেখে মনে হয় তুই বিশ্বপ্রেমিক। গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি।
  • (ভাইয়ের কথায় সফিক টমেটোর মত লাল হয়ে) জ্বী ভাইয়া।
  • (সবাই হো হো করে হেসে উঠলে সেই ভাইয়া আমাকে দেখিয়ে সফিককে) তুই মনে কর ঐ তোর গার্লফ্রেন্ড। তুই ওরে গিয়া সেরাম করে একটা কিস দে।

বড় ভাইয়ের বলতে দেরী নাই…. সফিক এসে আমাকে সেরাম কিস করা শুরু করলো। আর আমাদের দিয়ে মজা লুটতে থাকলো কতগুলো পশু।

আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এ কেমন নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সিনিয়রেরাও তো জুনিয়র ছিল। তারা কেন নিজেদের দিয়ে আমাদের এই দুঃখকে বোঝে না। বুঝতে চায় না। বছরের পর বছর ধরে এই নিয়ম কি চলতেই থাকবে?

———-

সেদিনের ঘটনার পরের দিন সবাই মিলে ক্যান্টিনে নাস্তা করছিলাম। সেই সিনিয়র ভাইটাও ছিল সেখানে। এমন সময় সেখানে আমাদের বর্ষের একজন এসে উপস্থিত। তাকে সেই সিনিয়র ভাইয়ের আমন্ত্রণ। সেও ভাইয়ের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো।

  • সালাম দিতে শিখনি বুঝি।
  • সরি ভাইয়া। স্লামালিকুম। এবার ঠিক আছে।
  • (সিনিয়র ভাই ভ্রু কুচকে) নাম কি?
  • মাসুদ ইসলাম।
  • কই থাক?
  • লালবাগ।
  • তোমার হাতটা দেখি।

সে তার কথায় তার হাত বাড়িয়ে দিল। সেই ভাইটি তার হাতে বড় করে পুরুষাঙ্গের ছবি আকলো।

  • ঐ যে ওখানে যে আপু দাঁড়িয়ে আছে তাকে গিয়ে জিজ্ঞাস করবি তোর ইয়ের সাইজ তার পছন্দ হয়েছে কিনা?
  • (মাসুদের সপ্রতিভ উত্তর) জ্বী ভাইয়া।

আমরা গভীরভাবে বিষয়টা দেখছিলাম। মাসুদের করুন পরিণতির কথা ভেবে আমরা সবাই অস্থির ছিলাম। আমরা কিছুতেই ভাবতে পারিনি মাসুদ কি করতে যাচ্ছে। আমি তাকে সেইফ করার জন্য সেই আপুর কাছে গিয়ে বসলাম। মাসুদ আপুর কাছে এসেই-

  • আপু কেমন আছেন?
  • ভাল। তুমি?
  • আমিও ভাল আছি। আপু কে একটা কথা বলার ছিল?
  • কি বলবে বল?
  • আসলে কি করে যে বলি?
  • তুমি নিঃসঙ্কোচে বল।
  • আসলে বিষয়টা বলার সাথে কিছু দেখানোরও আছে।
  • ঠিক আছে সেটাই কর।
  • আসলে ঐ জাহিদ ভাইয়া (সেই ভাই) আপনাকে পছন্দ করেতো, তাই তিনি তার একটা বিশেষ ছবি আমার হাতে এঁকে আপনাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতে বলেছে সেটা আপনার চলবে কি না। এই দেখুন সেই ছবি।

মাসুদ তার হাতে আঁকা সেই ছবি আপুকে দেখিয়েই সেখান থেকে ভো দৌড়।

মাসুদের হাতে অঙ্কিত সেই ছবি দেখে তো আপুর রাগ সপ্ত আসমানে গিয়ে ঠেকলো। সে উম্মাদের মত চিৎকার দিয়ে-

  • জাহিদের বাচ্চা। তোর মত লম্পট আমি আর একটিও দেখিনি।(বলেই চড় বসিয়ে দিল) আমি যদি তোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিছি। এসব কিছু আমি একাডেমিক ইনচার্জ কে জানাবো।

আমি ভাবতেও পারিনি মাসুদ এমন চতুরতার সহিত সেই বড় ভাইকে শিক্ষা দিবে।

———-

ক্লাসে যেয়ে দেখি মাসুদ বসে আছে। আমি গিয়েই তার পাশের খালি সিটে গিয়ে বসলাম।

  • জাহিদ বেটাকে তুমি দারুন একটা শিক্ষা দিয়েছ।

বলেই আমি হেসে উঠলাম।

  • সে সিনিয়র হয়েছে তো কি হইছে? যা খুশী তাই করে বেড়াবে? তাই বেটাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছি।
  • আমি রুমন (মাসুদের দিকে হাত বাড়িয়ে), ফ্রম শরীয়তপুর, পাস্ট শসক (শরীয়তপুর সরকারী কলেজ)।
  • আমি মাসুদ, ফ্রম ঢাকা, পাস্ট নডক (নটর ডেম কলেজ)।
  • আমি রুম ন-১১১ তে থাকি, নতুন হলের। তুমি?
  • ক্যাম্পসের কাছেই আমার বাসা। লালবাগে।

সেই থেকে মাসুদের সাথে আমার বন্ধুত্বের পথচলা শুরু। ওর মত সাদা মনের মানুষ আর বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্র আমি কমই দেখছি। যে কোন কিছুই ও খুব সহজেই বুঝতে পারতো। বেশ মজাও করতে জানতো।

———-

মাসুদকে দেখতাম ক্লাস ফাকি দিলেও ব্যাবহারিক ক্লাস ফাঁকি দিত না। মাঝে মাঝেই দেখতাম ও ক্লাস থেকে উধাও। বজ্জাতটা ক্লাসে না থাকলে কি হবে, এটেন্ডেন্সের খাতায় তার উপস্থিতি চাইই চাই। আর তার প্রক্সির ভার পড়তো বেশীরভাগ আমার উপরেই।

প্রথম বর্ষ থেকেই আমাদের লেদার প্রসেসিং এর ব্যাবহারিক ক্লাস নেওয়া হয়। আমাদের লেদারের প্রথম ব্যাবহারিক ক্লাসের দিন ভেড়ার চামড়া দেওয়া হয়। ব্যাবহারিক ক্লাসের দায়িত্বে ছিলেন মাসুদ স্যার। প্রতিষ্ঠানের সব থেকে ইয়ং এবং মেধাবী, তেমনি মজার। হবেনা কেন? তার নামও যে আমার বজ্জাত বন্ধুর নামের সাথে মিল ছিল। সেদিনের সেই ব্যাবহারিক ক্লাস ৪ জনের গ্রুপ করে দেওয়া হয়। সেই গ্রুপে ছিলাম আমি, মাসুদ, সুজন আর আমাদের বান্ধবী সাদিয়া। আমরা সবাই তখন ভেড়ার চামড়া ট্রিমিং এর কাজে ব্যস্ত। এমন সময় মাসুদ-

  • জানিস সাদিয়া। তোর শরীরের গন্ধ আর এই ভেড়ার চামড়া থেকে আসা গন্ধ একদম সেইম।
  • ঐ ফাজিল তুই কি বলতে চাস? (সাদিয়ার প্রশ্ন)
  • বোঝানোর আর কি আছে? আমি ভাবলাম তোর স্কিন ট্রিমিং করছি।
  • ওই শয়তান। তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না। (সাদিয়ার মিথ্যে রাগ দেখানো)

মাসুদ স্যার সবই খেয়াল করছিলেন। হঠাৎ তিনি মাসুদ কে বলেন-

  • বাহ! ভালই তো। তুমি দেখি আজকাল ভেড়ার গন্ধও নেওয়া শুরু করেছে। তা এ পর্যন্ত কতজনের টা নিলে?

আমরা সবাই তখন হো হো করে হেসে উঠি।

———-

মাসুদের সাথে কাটানো সময় আমার কাছে রূপকথার মত মনে হত। যতক্ষণ আমি ওর সাথে থাকতাম ততক্ষন নিজেকে অনেক সুখী ভাবতাম। বুঝতে পারতাম না কেন এই সুখানুভূতি। দিন যত যাচ্ছিল ততই আমি ওর প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম।

মাসুদের সবচেয়ে বড় বদঅভ্যাস হচ্ছে মাঝে মাঝেই কিছু না বলে উধাও হয়ে যাওয়া। বাঁদরটাকে অনেকবার বলেছি তাদের বাসায় নিতে কিন্তু কখনো আমাকে নিয়ে যায় নি। এখন বুঝতে পারি কেন সে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায় নি।

একদিন প্রায় পনের দিন পড় বাঁদরটা ক্লাসে আসলো। আমার মনে হল ওকে আমি পনের বছর পর দেখলাম। দেখতেও কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। ওর মাড়িও কেমন যেন ফোলা ফোলা লাগছে। টোনসেলও স্পষ্ট ফোলা দেখাচ্ছিল। শরীরের কোথাও কোথাও কাল দাগের মত দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল রক্ত জমে কাল হয়ে আছে। হাসিখুশি সেই মাসুদকে কেমন যেন একটু নিষ্প্রাণ মনে হল।

  • কি হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন?
  • আরে বলদ আমার কিছু হয় নি। এই একটু জ্বর হইছিলো। সেরে গেছে। আর তুমি তো জানই আমার ক্লাস করতে ভাল লাগে না বলে কম আসি।
  • তুমি ক্লাস না করলেও কিন্তু ব্যাবহারিক ক্লাস করতে। কিন্তু এখন সেগুলিও করছ না।
  • যেভাবে আমার খবরদারি করছো মনে হচ্ছে তুমি আমার ইয়ে।
  • ইয়ে মানে?
  • ইয়ে মানে ইয়ে।
  • ইয়েই তো। ভুল বললাম।

আমার কথায় মাসুদ কিছু বললো না। শুধু দেখলাম ওর চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু।

———-

খুব অবাক হতাম যখন ইয়ার ফাইনালের ফলাফল দিত। আমি এত পরিশ্রম করেও যেখানে প্রথম বিভাগ তুলতে রিতিমত হাপিয়ে উঠতাম সেখানে মাসুদ অল্প পরিশ্রম করেই প্রথম বিভাগে প্রথম হতো।

মাসুদ সব সময় আমাকে বলতো-“শুধু শেখার জন্য শিখনা। শিক্ষাটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করো।”

আমি সেদিন থেকেই ওর কথা আমলে নেই। আমি সত্যি শেখার জন্য আর কিছু শিখি নাই। শিখেছি সেটাকে কি করে কাজে লাগানো যায়।

তৃতীয় বর্ষ থেকে মাসুদের অনুপস্থিতির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। বিষয়টা আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলে। রেজিষ্ট্রার অফিস থেকে মাসুদের বাসার ঠিকানা যোগার করে আমি ওদের বাড়িতে যাই। সেদিন আমি এত বড় একটা সত্য জানবো তা ভাবতেও পারিনি। জানতে পারলাম মাসুদ ক্রনিক লিউকেমিয়াতে আক্রান্ত। ও আর কয়েকদিন শুধু আমাদের মাঝে মেহমান হিসাবে থাকবে।

এত বড় সত্য জানার পরে আমি সেখানে আর বেশীক্ষন থাকতে পারলাম না। থাকবো কি করে? চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষের করুন পরিণতি দেখার সাহস আমার ছিলনা।

———-

ক্যাম্পাসে ফিরে এসে সবার কাছে মাসুদের বিষয়টা বললাম। “আমরা এই ভাবে আমাদের বন্ধুকে মরতে দিতে পারি না। টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় আমাদের মাসুদ মরে যাবে তা কেমনে হয়? আমাদের সবার প্রচেষ্টায় মাসুদের চিকিৎসার খরচ যোগার সম্ভব হবে। আমরা দুজন করে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়াবো। মাসুদের পরিবারও তার চিকিৎসার জন্য সব কিছু বিক্রি করছে। আমরা কি মাসুদের জন্য এইটুকু করতে পারবো না?”

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। আমার গলা ধরে আসছিল। আমার কথা শেষে সবাই সময় নষ্ট না করে সে সময় থেকেই ঝাপিয়ে পড়লাম।

সবার অক্লান্ত চেষ্টা আর মাসুদদের পরিবার মিলে ৪০ লাখ টাকার ব্যবস্থা করে ফেললাম। এই টাকা দিয়ে অন্তত মাসুদের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন সম্ভব হবে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়ালে মাসুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল।

———-

মুম্বাইয়ে যাওয়ার পথে আমরা সবাই মাসুদকে বিদায় দিতে যাই। সেটাই ছিল ওর সাথে আমার শেষ দেখা। নিজের মনেই এক অজানা শঙ্কা কাজ করছিল মাসুদকে আর না দেখার। আমার চোখের জল দেখে-

  • কেন মরার আগেই আমাকে মেরে ফেলছ? এই পৃথিবী থেকে কে আগে বিদায় নিবে তা কেউ বলতে পারে না। এমনও হতে পারে আমি আরো অনেক বছর বেঁচে থাকবো। তাই গাধা এভাবে কেঁদে আমাকে আগে ভাগেই মেরে দিও না। আমি খুব শীঘ্রই তোমাদের মাঝে ফিরে আসবো।

———-

মাসুদের অবস্থা একদম শেষ পর্যায়ে ছিল। যার দরুন ওর কেমোথেরাপীও শুরু করা সম্ভব হয় নি। এই বিষয়টাও বাঁদরটা আমাদের কাছে লুকিয়েছে। ও যখন মুম্বাইয়ের হাসপাতালে ভর্তি তখন ইয়াহুতে ভিডিও চ্যাট করতাম। তখনো আমরা কেউ বুঝতে পারিনি ও আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে না ফেরার দেশে।

ওর লাশ দেশে আনা হলে বন্ধুরা সবাই আমাকে মাসুদের বাসায় জোর করে নিয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষের এমন করুন প্রস্থান যে নিজ চোখে দেখা খুব কষ্টের তা আমি তখন কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারিনি।

মাসুদের বাসায় যেতেই ওর বড় ভাই আমাকে একটা চিঠি হাতে দেয়। যে চিঠিটা নাকি সে মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই লিখে।

প্রিয় গাধা

একদম কাঁদবি না। আমি জানি তুই যখন এই চিঠিটা পাবি তখন আমি চলে যাব অনেক দূরে। না ফেরার দেশে। গাধা তুই কি ভাবছিস তোর বুঝি একাই কষ্ট হবে রে? আমারও যে অনেক কষ্ট হবে। তুই বুঝি আমাকে একাই ভালোবাসিস? আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি। অনেক। যার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। এবার তুই বুঝে দেখ ঐ অন্ধকার ঘরে আমার কতটুকু কষ্ট হবে? যদি কিছু বুঝেই থাকিস তাহলে একদম কষ্ট পাবিনা রে। আমি যতদূরে যেখানেই থাকিনা কেন তোর চোখের জল সহ্য করতে পারবোনা। তুই নিশ্চয়ই চাইবিনা ঐ অন্ধকার ঘরে আমি কষ্টে থাকি।

খুব শখ ছিল নামকরা একজন অর্থপেডিস্ট হব। সে ইচ্ছা আমার অপূর্ণই থেকে যাবে? এ কি করে হয়? তুই আছিস না। আমি যেটা পারিনি তোকে যে সেটা করতে হবে। আমি জানি তুই পারবি। তোর মধ্যে সেই শক্তি আমি দেখছি।

তপন,লিটন,সাদিয়া,সফিক ওরা সবাই কেমন আছেরে? ওদেরকেও বলিস আমার জন্য যেন ওরা কষ্ট না পায়। ওরাও যে আমার খুব কাছের বন্ধু। ওদের কষ্টও আমাকে বেশ খোঁচাবে।

লিউকেমিয়াতে আক্রান্ত না হলে বুঝতেই পারতাম না জীবন মানে কি? আমাদের জীবনই বা কত দিনের। আমার তো প্রায় শেষ। হয়তো তোদেরও অর্ধেক শেষ। তাই বলছি যতটুকু পারিস জীবনটাকে উপভোগ করে নে। শুধু উপভোগ করলে হবেনা। নিজেকে তৈরীও করতে হবে। সফল হতে হবে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই কথাটি নিশ্চয়ই মনে আছে। তাই গাধা তোকে আবারো বলছি, Live your life fullest.

আর হ্যাঁ, আমার কবরে প্রথম মাটিটা তুই দিস রে। খেয়াল রাখবি একদম যেন আমার কবরে তোর চোখের পানি না ঝড়ে। কি রাখবি না আমার কথা?

তোর ভাল থাকার মাঝেই হবে আমার ভাল থাকা। তোর সুখের মাঝেই নিহিত রবে আমার সুখ।

তোর বাঁদর।

———-

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.