সহ্য

সানমুন চৌধুরী

-খালামণি আপনি খাবার সময় আমাকে ডাক দিয়েন!

-কেন রে?

-আপনার হাতে খাবো!

-বলিস কি এসব? এখনো কি তোর মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়ার বয়স আছে?

-পেটে খুব ক্ষুধা কিন্তু খেতে বসলে খেতে পারি না!

-কেন?

-মায়ের কথা খুব মনে পরে, মা মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন তো তাই!

-শোনো তো পাগল ছেলের কথা! তোরা বাপু পারিসও! নিশিও তোর মতো বায়না ধরে সবসময়! বড় হবি কবে তোরা!

-চার দিনে দুই কেজি ওজন কমে গেছে আমার!

-আচ্ছা ঠিক আছে আয় খাইয়ে দেই।

সাইমুম গত চারদিন হলো ঢাকা এসেছে তার ছোট খালার বাসায়। উদ্দেশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবে। খালা ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে বলা যায়, কেননা বিয়ের অনেক আগে থেকেই তিনি ঢাকা থাকেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে, ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এক বড় লোকের দুলাল কে বিয়ে করে সংসার পেতেছে। আইনঙ্গ স্বামী আর একমাত্র মেয়ে নিশি কে নিয়ে সুখের সংসার তার। নিশি এবার ঢাকা মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। ছোটভাই হিসেবে সাইমুমকে সে অনেক স্নেহ করে। নিজের লেখাপড়ার হাজার চাপের মধ্যেও তিনদিন ধরে সাইমুম কে সময় দিচ্ছে মেডিক্যালে চান্স পেতে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে সেই বিষয়ে ধারণা সহ বিভিন্ন বইয়ের সংগ্রহ থেকে তাকে সাহায্য করা। নিশি একটা হিন্দু ছেলের সাথে প্রেম করে, বিষয় টা সাইমুম জানলেও তাকে বলতে সাহস পায় না তাদের ভবিষ্যৎ পরিনতি কি হতে চলেছে। কেননা একটা মুসলিম ছেলে একটা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করতে পারে কিন্তু একটা মুসলিম মেয়ে একটা হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করলে সেটা সমাজ, ধর্ম, সংসার কোনটাই মানবে না, নিশির পরিনতি চিন্তা করতে গিয়ে তার নিজের বিবেকও নাড়া দেয়! সেও তো এমনি এক নিষিদ্ধ প্রেমের জালে আটকে আছে! তার জন্য প্রতিটা মুহূর্তে অপেক্ষার প্রহর গোনে সাদমান! তাহলে কি তার জীবনের পরিনতিও নিশির মতোই?

সাদমানের কথা মনে হতেই সাইমুমের মনটা বিষাদে ভরে গেলো। এদিকে খালামণি খাবার রেডি করে বসে ডাক দিলো,

-সাইমুম?

-জ্বি খালামণি?

-খেতে আয়!

-আসছি!

সাইমুম খেতে বসে খালামণির পাশের চেয়ারে, ভাতের লোকমা মুখে তুলে দিতে দিতে তিনি বলেন,

-তোর কি মন খুব বেশি খারাপ? বুবুজানকে আসতে ফোন করবো?

-না মণি! মাকে বলো না আমার মন খারাপ তাহলে সে অনেক কষ্ট পাবে।

-তাহলে চোখের কোণে পানি জমেছে কেন?

-কই?

-শোন আমি মা, আমি সন্তানের মনের অবস্থা বুঝতে পারি!

সাইমুম মাথা নিচু করে ফেলে! কি জবাব দেবে সে? মায়ের জন্য নয় তার অন্য কোন এক গোপন রোগের ব্যাথায় কলিজা জ্বলে যাচ্ছে! এযে এমন এক ক্ষত যার ব্যাথা স্রস্টাও দেখেন না, কেননা তিনি তো এই নিষিদ্ধ প্রেমিকযুগলকে সরাসরি কোন কারণ না বর্তায় দোযখের টিকিট দিয়ে দিয়েছেন। অনুভূতি দিয়েও দেয়নি তার অনুমোদন, তাকেই বা দোষ দেবার কি আছে? পাপীদের অন্যকে দোষারোপ করার কোন অধিকার নেই। সাদমান কে ভালো লাগতো কারণ সে স্কুলের অন্য দশটা ছেলে থেকে আলাদা! নম্রভদ্র স্বভাবের লাজুক একটি ছেলে, সেই স্কুল জীবন থেকে সাইমুম তাকে বিশেষ চোখে দেখে। নিজের টিফিন ভাগ করে খাওয়া, নতুন কোন পোশাক কিনলে সবার অজান্তে তার হাত খরচের টাকা জমিয়ে সাদমানের জন্য একই পোশাক কিনে দেওয়া, এসব কোন লালসা বা কামনার উর্ধ্বে থেকেই করতো, তখন তো আর যৌবন বা প্রেমের আকর্ষণ ছিলো না, হয়তো ভালোবাসার অনুভূতি এমনি, কোন কারণ লাগে না ভালোবাসতে।

সাদমান যখন তার সামনে আসে সকল দুঃখ কষ্ট সব নিমিষেই হাওয়া হয়ে যায় সাইমুমের অস্তিত্ব থেকে। সাদমান যখন তার হাত ধরে স্কুল চত্তরে হেটে বেড়াতো তখন দুনিয়ার সকল সুখ তার জীবনে উপস্থিতি অনুভব করতো সে। এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের পথ চলা। স্কুল জীবন পার করে কলেজ জীবনের প্রতিটা দিন ছিলো আরও মধুর। বন্ধুত্ব ভালোবাসায় রুপান্তর! কেয়ারিং শেয়ারিং সবকিছুতেই তাদের সমতায় ভরা। মফস্বল শহর থেকে রাজধানীতে এসে আজ সাইমুম বড় একা হয়ে গেছে।

সাইমুম স্মৃতিচারণ করছিলো এমন সময় খালামণির ডাকে তার বাস্তবতায় ফিরে আসতে হলো,

-কি রে আর কতো সময় ধরে চিবোবি? গিলে ফেল, না খেতে ইচ্ছে করলে বল আমার কাজ আছে!

-না না তুমি দাও, খাচ্ছি।

সাইমুম তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয় খালামণির হাতে। ততক্ষণে নিশি বাসায় এসে গেছে। সেও এসে খাবার টেবিলে বসে। আজ কি করলো সব মা আর সাইমুমের সাথে শেয়ার করে।

দেখতে দেখতে সময় চলে যায়, সাইমুমের অস্তিত্বে নতুন করে কারও আবির্ভাব হতে যাচ্ছে হয়তো, সাদমান এখন ঢাকা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে, সাইমুম ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাইনি তবে ঢাকার একটা প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি মেডিকেলে পড়ছে। সাদমানের সাথে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয় তার। দুজনে একসাথে ঢাকার অলিগলি হেটে বেড়ায়। খালামণির বাসা ছেড়ে এখন সে মেসে থাকে। সাদমান মাঝে মাঝেই সাইমুমের মেসে আসে। সাইমুম যায় তার হোস্টেলে। দুই বন্ধুর মধ্যে এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে সবাই কেমন আড় চোখে তাকায় তাদের দিকে।

সৌরভ চট্টগ্রামের ছেলে, পরিপাটি স্বভাবের গোছালো একটি ছেলে, সে সাইমুমের মেস মেট। খুব সৌখিন আর বিলাশিও বলা যায় তাকে। চটপটে স্বভাব আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী, দুরন্তপনার জন্য সবাই তাকে খুব পছন্দ করে। খুব মিশুক স্বভাবের বলে সহজেই কাউকে আপন করে নেয়। সাইমুমের সাথে তার ভাবটা একটু বেশিই বলা যায়, সে জানে যে সাইমুম সাদমানকে অনেক ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েই সে প্রেমে পড়ে যায় সাইমুমের। সাইমুমের প্রতি প্রতিটা বিষয়ে বিশেষ যত্ন তার। ঠিক যেমনটা ছোট বেলায় সাইমুম সাদমানের জন্য করতো তেমনটাই সৌরভ সাইমুমের জন্য করছে। কোন একটা পোশাক কিনলে তার একটা সাইমুমের জন্য কিনবে! সাদমান অনেক সহজ সরল তাই এই বিষয়ে সে কখনোই সাইমুম কে কোন প্রশ্ন করে না। সাইমুম ধীরে ধীরে সৌরভের মায়ায় পরে যায়।

সেদিনের বিষয়টা হয়তো তার অস্তিত্ব নাড়িয়ে দিয়েছে, ১০৩ এর উপরে হয়তো জ্বর তার শরীরে, চোখে অন্ধকার দেখছে সাইমুম, জ্বরের ঘোরে উল্টাপাল্টা বকছে। সারাদিন রোদের মধ্যে ক্যাম্পেইন করে এই অবস্থা তার। বিকাল থেকেই শরীরটা বেশ ভাড়ী লাগছিলো সন্ধ্যার পর থেকে হঠাৎ করে জ্বরে একদম বিছানায় ফেলে দেয় তাকে। সৌরভ তার রুমে এসেছে তাকে নিয়ে নতুন প্রজেক্টের কাজ করবে বলে, এই অসময়ে তাকে বিছানায় দেখে অনেকটা চিন্তিত হয়েই তার পাশে গিয়ে বসে। সাইমুম অনেকটা জ্ঞানহীন অবস্থায়, পেটে প্রচন্ড গ্যাসও জমেছে তার । ক্যাম্পেইনের সময় সিঙ্গারা খাওয়ার ফলে হয়তো এই অবস্থা, সৌরভ সাইমুমের কাছে গিয়ে বসতেই সে তার সৌরভের হাত ধরে উঠে বসতে গিয়ে সৌরভের শরীরের মধ্যেই হরহর করে বমি করে দেয়। সাধারণত দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট শব্দ হচ্ছে বমির শব্দ, অনেকই আছে বমির শব্দ শুনলেই বমি করে দেয়। কিন্তু সৌরভের মতো এমন সৌখিন একটা ছেলে কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই উল্টো সাইমুমের কপালে হাত দিয়ে তাকে ভালো করে বমি করার সুযোগ করে দিলো। সাইমুম বমি করা শেষে অনেকটা শক্তি প্রয়োগ করেই উঠতে গেলো কিন্তু জ্বরের প্রকোপে সেটা আর সম্ভব হলো না। সৌরভের সারা শরীরে বমিতে মাখামাখি। সে সাইমুমকে শুইয়ে রেখে বাথরুমে গিয়ে পরিস্কার হয়ে একটা বালতিতে করে পানি অার ন্যাকড়া এনে সাইমুমের বিছানা ও তাকে পরিস্কার করে দিলো। সবকিছু পরিস্কার করে শুরু করলো তার সেবা করা।

সাইমুমের পোশাক খুলে একটা টাওয়াল পরিয়ে দিলো, নিজের গামছা ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পর পর শরীর মুছিয়ে দিচ্ছে। সাইমুমের রুমমেট সৌরভের কথা মতো দোকান থেকে মেডিসিন নিয়ে এসেছে! সৌরভের যত্নে ঘন্টা তিনের মধ্যেই সাইমুম অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে! যদিও এর মাঝে আরও দুই বার বমি করেছে। সৌরভ বরাবরের মতোই সব পরিস্কার করেছে। সৌরভের এমন সেবা দেখে শুধু সাইমুম নয় মেসের সবাই অবাক! হঠাৎ করে আসা জ্বর সৌরভের সেবায় হঠাৎ করেই ভালো হয়ে যায়। সাইমুমের বুঝতে বাকি থাকেনা সৌরভ কতোটা ভালোবাসে তাকে। কিন্তু সাদমানের কি হবে? সেও তো সাদমানকে অনেক বেশি ভালোবাসে। বলতে গেলে ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টিতে সাদমানই। সৌরভকে তার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে গেলে যে সাদমানকে হারাতে হবে? তবে কি সৌরভ তাকে শুধু বন্ধুর মতো ভালোবাসে? সেটা কেমন করে হতে পারে? তার সেবা কি শুধু বন্ধুত্বের দৃষ্টিতেই? কিভাবে হয় সেটা? সাদমান কে তো আমিও বন্ধুই ভাবতাম, তারপর একসময় সেটা প্রেমে পরিনত হয়ে গেছে! সৌরভের সাথেও কি এমনি হবে? হাজারও প্রশ্ন সাইমুম কে অনেকটা পাগল করে তোলে! একদিকে সাদমান অন্যদিকে সৌরভ! সৌরভ আমাকে ভালোবাসে আর আমি সাদমান কে? সাদমানও তো আমাকে অনেক ভালোবাসে! ওর সামর্থ নেই তাই প্রকাশ করতে পারে না! কি হতে যাচ্ছে আমার জীবনে? সাইমুম আত্মচিন্তায় ব্যাকুল! এমন সময় সৌরভ আর সাদমান একসাথেই তার পাশে এসে বসে,

সৌরভ আর সাদমান কে একসাথে দেখে সাইমুম ভাবে হয়তো স্বপ্ন দেখছে! কিন্তু ওরা তাকে আরও অবাক করে দিয়ে যখন বলে,

-তুমি যাই ভাবো সাইমুম আমরা কিন্তু বন্ধু ছাড়া কিছুই না! তোমার জিনিসে আমি হাত লাগিয়েছি ঠিকিই কিন্তু ধরে দেখিনি!

-এটা কেমন কথা হলো? হাত দিলে আবার ধরা বাকী থাকে জানতাম না তো!

-থাকে তো! আমি হলাম ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা বুঝলে?

-মানে কি?

-আমি তোমাকে সত্যই অনেক ভালোবাসি! কতোটা ভালোবেসে ফেলেছি সেটা নিজেও জানিনা! কিন্তু সাদমান তোমার জন্য একদম ঠিক আছে! আমি তোমাদের শোভাকাঙ্খি হয়ে থাকবো।

সৌরভের মুখে এমন কথা শুনে সাদমান বলে,

– সৌরভ তুমি অকারণে হতাস হচ্ছো! শোনো সাইমুম যদি তোমাকে ভালোবাসতে না চায় তাহলে আমিই ওর জীবন থেকে সরে যাবো, কারণ হিসেবে একটা কথাই বলবো সত্যিকার ভালোবাসা যে গ্রহণ করে না সে কাউকেই ভালোবাসতে পারে না।

-তোমরা দুজনে কি শুরু করেছো বলতো? বাংলা সিনেমার ডায়ালগ বন্ধ করবে? হয়েছে আমি তোমাদের দুজনকেই চাই! এবার খুশি?

তিনজনে পাশাপাশি বসে হাসছে আর কথা বলছে! কিন্তু সাইমুমের ভিতরে একটাই চিন্তা কাজ করছে এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি কি? আমি না হয় দুজনকেই মানিয়ে নিলাম আমার জীবনে কিন্তু ওরা একসময় গিয়ে একজন অপরজনকে সহ্য করবে তো???

……………………..সমাপ্ত………………………..

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.