
রিয়েল ফ্রেন্ড
[আমার এই গল্পটি “মায়া” গল্পের সিক্যুয়াল। হয়তো এই গল্পের মত অনেক গল্প বা সিনেমা এর আগেও হয়ে থাকবে বা আছে। কিন্তু এই গল্পের কাহিনী একান্তই আমার নিজস্ব চিন্তা ধারা থেকে। তাই পাঠককে বিনীত অনুরোধ করবো এই গল্পকে কোন কিছুর কপি বলে আমাকে ছোট করিবেন না। এই গল্পের শুরুতেই যে কবিতাংশ দিয়ে মায়া কি বুঝানো হয়েছে তা একটি গানের অনুবাদ মাত্র। এই গল্পটি শতভাগ কাল্পনিক, বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই।]
………………
এখানে কোন রাত নেই, নেই কোন দিন
এটা কি অন্ধকার নাকি শুধুই ধোঁয়া?
চোখ যে ধোকায় আছে তা সকলেরই অজানা
এটাই যে মায়া।
……………
শম্পাঃ কোথায় তুমি? তোমার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা আছে। এখনি রবীন্দ্র সরোবরে চলে আসো।
ইরফানঃ এখনি? একটু পরে আসি?
শম্পাঃ এখনি আসতে বলছি মানে এখনি। ৩০ মিনিটের মধ্যে আমি তোমাকে দেখতে চাই।
ইরফানঃ ঠিক আছে মহারাণী, আমি এখনি আসছি।
[ইরফান আর শম্পা একজন অন্যজনকে গত দুই বছর ধরে ভালোবেসে আসছে। যাকে বলা যায় রোমিও এন্ড জুলিয়েট।]
ইরফানঃ কি ব্যাপার? এত জরুরী তলব।
শম্পাঃ আমি তোমাকে আর সময় দিতে পারবোনা।
ইরফানঃ সময় দিতে পারবেনা মানে? কি ব্যাপার? খুলে বলতো।
শম্পাঃ বাবা কখনোই তোমার মত একজন বেকার ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিবেন না। সে আমার জন্য আমেরিকা প্রবাসী পাত্র ঠিক করেছে। এই মাসের শেষেই সে দেশে আসছে।
ইরফানঃ বাবাকে বোঝাও। আর যদি না পার তাহলে চল আমরা দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।
শম্পাঃ জীবনটা খেলনার কোন পাত্র নয় যে যখন খুশী সেভাবে সিদ্ধান্ত নিব। তুমি বাস্তব কে মেনে নিতে না পার, তাই বলে আমি যে মেনে নিবনা সেটা হবেনা।
ইরফানঃ আমি যে তোমাকে ভালোবাসি, সেটার কি হবে? আর তোমাকে ছাড়া আমার জীবন কল্পনাও করতে পারিনা।
শম্পাঃ আবেগ দিয়ে জীবন চলেনা। জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে না পারলে তোমার এই ভালোবাসা দেখবে সদর দরজা দিয়ে পালাবে। আর আমিও চাইনা তোমার সাথে অনিশ্চয়তার স্রোতে গা ভাসাতে।
ইরফানঃ আমেরিকান প্রবাসীর কাছে আমি ফিকে হয়ে গেলাম!
শম্পাঃ বেটার অপশন সবাইকে গ্রহণ করা উচিৎ।
ইরফানঃ তোমাকে তোমার বেটার অপশন মোবারক। আমি না হয় থেকে যাই এই অনিশ্চয়তায়।
……………
ইট-কাঠের এই ঢাকা শহর পরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেনি শুধু কয়েকটি অভিজাত এলাকা বাদে। এই শহরে বাড়ি বদল যে কি ঝামেলার কাজ তা এই কাজ যারা করে থাকেন তারাই বুঝেন। বাড়ি বদলের আগের দু-তিন আগে থেকে গোছগাছ শুরু করতে হয় আর তা চলে বাড়ি বদল হওয়ার পরও আরো তিন-চার দিন। নাফিজের মায়ের শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকায় সে খুব বেশী ঘনবসতি এলাকাতে থাকতে পারেন না। স্বভাবেও তিনি বেশ খুঁতখুঁতে। নাফিজের বাবা সানোফি এভেন্তিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলে সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে যায়। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়াতে নাফিসের যেমন আদরের অভাব নেই তেমনি অভাব নেই ভয়ে তটস্থ থাকা মায়ের সব বিষয়ে খেয়াল রাখা।
নাফিসের মায়ের দাবী সে অতিপ্রাকৃত বিষয় অনুভব করতে পারেন। তার এই দাবীর বিরোধিতা করার সাহস যদিও বাবা-ছেলের নেই শুধু মুখ গুঁজে হেসে যাওয়া ছাড়া। তেমনি ধানমন্ডি-৭ এর এই নতুন ফ্ল্যাটে এসেই-
মাঃ তোদের বাবা-ছেলের কি কোন পছন্দ বলতে নেই।
বাবাঃ আমরা তোমার পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েই এই ফ্ল্যাট নিলাম।
নাফিজঃ বাসার সমস্যা কি দেখলে? ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি থেকে শুরু করে সমস্ত ফিটিংস চেক করেইতো নিলাম।
মাঃ এই ফ্ল্যাটটা কেমন যেন ভূতুড়ে।
বাবাঃ সব কিছুতে দোষ খুঁজে বের করাটা তোমার একটা বদভ্যাস হয়ে গেছে। এই যুগে তাও আবার ঢাকা শহরের মতো জায়গায় ভূত থাকবেনা। যাই ছিল মানুষের ভয়ে সব পালিয়েছে। আর তোমার অস্তিত্ব পেলে আরো আগেই পালাবে।
মাঃ কি বলতে চাও?
বাবাঃ কিছুনা।(বাবা-ছেলে হাসতে থাকে)
…………
একমত্র সন্তান হওয়াতে নাফিজের উপর মায়ের খেয়াল রাখাটাই যেন একমাত্র ও প্রধান কাজ হয়ে গেছে। স্কুল জীবন থেকে শুরু করে কলেজ জীবন পর্যন্ত নাফিজের ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার মা বসেই থাকতেন, শরীর খারাপ করবে বিধায় বাহিরের খাবার খেতে দেয়নি। নাফিজ এখন বুয়েটে পড়ছে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় নিয়ে। প্রথম বর্ষ পর্যন্ত সে ক্লাসের বাইরে মায়ের উপস্থিতি মেনে নিয়েছে। এখন সে দ্বিতীয় বর্ষে আছে।
নাফিজঃ আমি এখন বেশ বড় হয়েছি। এবারতো আমাকে অন্তত ক্লাসে একা যেতে দাও। তোমার জন্য আমার সহপাঠীরা সবাই আমাকে মোমের পুতুল বলে ক্ষ্যাপায়। তুমি নিশ্চয়ই চাইবেনা তোমার খোকা কারো কাছে অপদস্থ হোক।
মাঃ আমি তোকে পাহারা দেওয়ার জন্য ক্যাম্পাসে থাকিনা। তুই আমার চোখের আড়াল হলে আমার মনের মধ্যে অজানা এক শঙ্কা কাজ করতে থাকে। তুই মায়ের মন বুঝবিনা।
নাফিজঃ তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলছিনা মা। সব সময়ই কি তুমি এভাবে আমার সাথে সাথে থাকতে পারবে? আমাকে একটু একা চলতে শিখতে দাও। তোমার দোয়া আর আল্লাহ এর রহমত থাকলে কোন বিপদ আমাকে ছুঁতে পারবেনা।
মাঃ ঠিক আছে খোকা।
নাফিজঃ এই না হলো আমার লক্ষী মামনি।
……………
নাফিজ ভাল ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি বেশ ভাল ছবি আঁকতে পারে। নিজের ঘরে বসে আনমনে সে ছবি আঁকতে পছন্দ করে। মনের কোণে জমে থাকা ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ সে ছবি আঁকার মাধ্যমে করে থাকে। তেমনি আজ অবচেতন মনে সে তার মনের অজানা এক ভালোবাসার মানুষের ছবি আঁকতে থাকে। ছবি আঁকা শেষে সে তার নাম দেয় সাগর। ছবি আঁকা শেষে সে দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়, আর বুঝতে পারে সে একজন সমপ্রেমী। আর সবার মত সে ভালোবাসার মানুষ হিসাবে কোন নারীকে কল্পনা করতে পারেনি। খুব সময় নিয়ে সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব ইচ্ছে করছে তাকে ছুঁয়ে দেখি, একটু আদর করি- এমন সব ভাবনা তার মনে খেলা করতে থাকে।
আজ মায়ের আঁচল থেকে নাফিজ বেরিয়ে আসছে, মানে সে এই প্রথম একাই বুয়েটে যাচ্ছে ক্লাস করতে। নিজেকে আজ বেশ স্বাধীন মনে হচ্ছে। স্বাধীনতার সুখ আজ সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। সকালে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে কিছুক্ষণ আনন্দে রাস্তা দিয়ে হাটতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ একি দিক থেকে কালো রঙের একটা মাইক্রোবাস ছুটে আসছিলো যা নাফিজ খেয়াল করেনি। করবেই বা কিভাবে গাড়িটি আসছিলো ভুল দিক থেকে। গাড়িটি সজোড়ে এসে নাফিজকে ধাক্কা দিলে সে প্রায় কয়েক হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। গাড়ির চালক ভয়ে গাড়ি না থামিয়েই আরো বেশী গতিতে গাড়ি টানতে শুরু করে। এমন সময় নাফিজ দেখতে পায় তার ছবির সেই মুখটি তাকে বলছে- প্লিজ রোল অন। সে খেয়াল করলো সে কিভাবে যেন উলটে গেলো এবং গাড়ির দুটি চাকা তার নিতম্বের উপর দিয়ে গেল। সেখানেই সে জ্ঞান হারালো।
………………
দুপুরে নাফিজের বাবার মোবাইলে ফোন আসে তার ছেলে সড়ক দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে ঢাকা মেডিকেলের ক্যাজুয়াল্টি বিভাগে আছে, যত দ্রুত সম্ভব তাকে সেখানে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। নাফিজের মা এমনিতেই ছেলের জন্য সবসময় উদ্বিগ্ন থাকে, এখন যদি সে শুনে তার নাড়ী ছেড়া ধন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে সে কিভাবে এসব সহ্য করবে-এমন সব ভাবনা ছেলের চিন্তার পাশাপাশি তাকে গ্রাস করে ফেলে। সে দ্রুতই নাফিজের মাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যান। তারা সেখানে গিয়ে নাফিজের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যান। নাফিজকে একদম চেনাই যাচ্ছিলোনা। সামনের কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে গেছে, কপালে বেশ গভীরভাবে কেটে গেছে, মাথায় বেশ আঘাত পেয়েছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তার নিতম্বে। যন্ত্রনায় বেশ কাতরাচ্ছিল সে। ছেলের এমন অবস্থা দেখে মা সেখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
বাবাঃ আমার ছেলে বাঁচবে তো?
ডাক্তারঃ আল্লাহ এর উপস ভরসা করুন। আমরা আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভাগ্য ভালো যে তার ঘাড়ের উপর দিয়ে বা পেটের উপর দিয়ে গাড়ির চাকা যায়নি।
বাবাঃ আমার ছেলেকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?
ডাক্তারঃ আপনার ছেলের বন্ধু। এতক্ষণ এখানেই ছিল।
………………
দুর্ঘটনার পরে মৃত্যুর দুয়ার থেকে নাফিজ ফিরে আসলেও তার চিকিৎসার জন্যে তাকে পড়া লেখা থেকে দূরে রাখতে হয়। এখন তার সুস্থতার জন্য বেশীরভাগ সময় তাকে বিছানাতেই থাকতে হয়। নাফিজের মনে হতে থাকে তাকে জেল খানায় বন্দী করা হয়েছে। এসময়ের দিনগুলো যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। একদিন দুপুর বেলা –
মাঃ সাগর নামে তোর এক বন্ধু এসেছে।
নাফিজঃ সাগর?
মাঃ এক্সিডেন্টের পর থেকে তুই কেমন যেন হয়ে গেছিস। খুব বেশী একটা মনে করতে পারিস না। আমি সাগরকে তোর ঘরে নিয়ে আসছি।
সাগরঃ কেমন আছ নাফিজ?
নাফিজঃ (সাগরকে দেখে অবাক হয়ে) বেশ ভালো আছি। আপপপ…নি?
সাগরঃ আমাকে চিনেও কেন না চেনার ভাব করছো? তুমিই আমার ছবি আঁকলে, আবার নাম দিলে সাগর। যদি তুমি আমাকে না ই যানো তাহলে কি করে আমার ছবি আঁকলে আবার আমার নামও জানলে। (মিষ্টি হেসে)
নাফিজঃ কিন্তু আমি যে কিছু মনে করে উঠতে পারছিনা।
সাগরঃ মা ঠিকি বলেছেন। এক্সিডেন্টের পর তুমি অনেক কিছুই মনে করতে পারছোনা। আর এখন নতুন করে না হয় নাই জানলে, কি বলো?
নাফিজঃ ঠিক বলেছেন।
সাগরঃ বন্ধুকে আপনি করে বলতে নেই। বিশেষ করে খুব কাছের কাউকে।
নাফিজঃ তুমি যেভাবে বলবে ঠিক সেভাবেই হবে। (দুজনেই হাসতে থাকে)
সাগরঃ গুড বয়। খুব দ্রুতই তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। এভাবে বেশী দিন থাকতে হবেনা।
নাফিজঃ খুব ইচ্ছা করে বাহিরে যেতে। মামনি আগেই আমাকে একা কোথাও যেতে দিতনা আর এখনতো আরো দিবেনা।
সাগরঃ আমি তোমাকে রাতে রাতে বাইরে ঘুরাতে নিয়ে যাব যাতে মামনি টের না পায়।
নাফিজঃ সত্যি নিয়ে যাবে।
সাগরঃ বললাম তো নিয়ে যাব। তবে এক শর্তে।
নাফিজঃ কি শর্তে?
সাগরঃ আমার সম্পর্কে যা জেনেছ তাই জান। কখনো আমাকে আমার ব্যক্তিগত বিষয় আর তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আমাকে কোন প্রশ্ন করবেনা।
নাফিজঃ আমি রাজি।
সাগরঃ তাহলে তুমি এখন ঘুমাও। আজ রাতেই আমি এসে তোমাকে ঘুরাতে নিয়ে যাব।
………………
ঘড়ির কাঁটায় রাত ঠিক ১২ টা বাজে। নাফিজ দেখতে পায় তার মধ্যে কেমন যেন পরিবর্তন আসছে। শরীরে নেই কোন ক্লান্তিবোধ, ঠিক আগের মতই ফুরফুরে মনে হচ্ছে। এমন সময় সে দেখতে পেল সাগর তার সামনেই বসে আছে। যদিও রাজ্যের সব প্রশ্ন তার মধ্যে খেলা করছে কিন্তু শর্তের কারণে করছেনা। ভাবে প্রশ্ন না করে সাগরকে বিশ্বাস করলেই তার ভাল হবে। সে কিছুতেই চাইছেনা সাগরের মত মনের মানুষের সান্নিধ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে।
সাগরঃ কোথায় ঘুরতে যাবে?
নাফিজঃ ইচ্ছা করছে সমুদ্র পাড়ে তোমার হাতটি ধরে হাওয়ায় ভেসে বেড়াই।
সাগরঃ ঠিক আছে। তোমার চোখ দুটি বন্ধ কর, আমি যখন খুলতে বলবো তখন খুলবে।
নাফিজঃ ঠিক আছে।
সাগরঃ (মুহূর্তের মধ্যেই) এবার তোমার চোখ খুলতে পার।
নাফিজ চোখ মেলেই দেখে সামনে বিশাল সমুদ্র। আকাশে তারারা খেলা করছে। হঠাৎ নিচে তাকাতেই দেখে সে হাওয়ায় ভাসছে। ভয়ে চিৎকার দিলে-
সাগরঃ ভয় পাচ্ছ কেন? আমি আছিতো। আমাকে বিশ্বাস করোনা?
নাফিজঃ আমার নিজ থেকেও বেশী আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। খুব ভালোবাসি তোমায়।
সাগরঃ আমাকে ভুলে যাবেনাতো?
নাফিজঃ শ্বাস নিতে ভুল হয়ত করতে পারি কিন্তু তোমাকে ভুলবোনা।
সাগরঃ আমি সব সময় তোমার পাশে থাকবো। সর্বাবস্থায় আমাকে তুমি পাশেই পাবে।
………………
সকালে মা ঘুম থেকে উঠেই নাফিজের রুমে আসেন দেখতে। এসে দেখেন ঘরের মেঝেতে খুব বালুর ছড়াছড়ি। নাফিজের কাছে যেতেই দেখতে পান বিছানাতেই একি অবস্থা। ভাবলেন হয়ত রাতে ঝড়ো হাওয়া বয়েছে সেই জন্য এত বালু বালু লাগছে। আবার নিজের মনেই ভাবতে থাকলেন তার ঘরের জানালাও খোলা ছিল, কিন্তু এমন বালু সেখানে দেখলেন না। কিছুই মিলাতে না পেরে চিন্তা করাই ছেড়ে দিয়ে নাফিজকে ডাক দিলেন।
মাঃ খোকা এবার ঘুম থেকে উঠো। তোমার নাস্তা করে ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।
নাফিজঃ (ঘুম থেকে জেগে জড়িয়ে ধরে) আমাকে নিয়ে এত ভাব কেন?
মাঃ এখন তোকে বললেও বুঝবিনা। যেদিন বাবা হবি সেদিন বুঝতে পারবি।
………………
আজ রাতেও যথারীতি রাত ১২ টার সময় সাগর এসে নাফিজের ঘরে হাজির।
সাগরঃ আজ কি ইচ্ছে করছে?
নাফিজঃ আজ মন চাইছে তোমার ইচ্ছায় সব কিছু করতে।
সাগরঃ আমার ইচ্ছা করছে তোমায় নিয়ে লং ড্রাইভে যেতে আর সে সময় গাড়িতে স্লো ভলিউমে বাজতে থাকবে তুম মিলে এই গানটা।
নাফিজঃ আমি চোখ বন্ধ করলাম।
সাগরঃ বন্ধ করতে হবেনা, আমরা এখন গাড়িতেই আছি।
সেই রাতে তারা কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে লং ড্রাইভ করছিলো আর গাড়িতে তখন স্লো ভলিউমে তুম মিলে এই গানটা বেজেই যাচ্ছিলো। সে সময় যেন প্রবল বাতাস বইছিলো এবং বিভিন্ন ফুলের সুবাস পরিবেশটাকে আরো মোহনিয় করে তুলছিল।
সাগরঃ কেমন লাগছে?
নাফিজঃ মনে হচ্ছে আমি স্বর্গে আছি। আমার এত ভালো লাগছে যে তোমাকে আমি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। আই লাভ ইউউউউউউউউউউউউউ।
…………………
নাফিজ আজ নাস্তার টেবিলে অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে আসে। দেখে মনে হয়না তার এত বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল।
মাঃ (চোখে জল জল) নাফিজের বাবা দেখেছো, আল্লাহ আমাদের উপর কত সহায়। নাফিজকে অনেক সুস্থ মনে হচ্ছে।
বাবাঃ তুমি ঠিকি বলেছো। সবি আল্লাহ এর রহমত। শুকুর আল হামদুলিল্লাহ।
নাফিজঃ মামনি, তুমি আমাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করোনা। আমি এখন অনেক ভালো আছি। তোমাদের দুজনের দোয়া আর সাগরের সাহচর্যে আজ আমি অনেক ভাল। যান বাবা সেদিন যখন আমি গাড়ির নিচে পড়তে যাই ঠিক সেই মুহূর্তে সাগর আমাকে বলছিল ঘুরে যেতে। আমি বুঝতে পারছিলাম না বলে হাত দিয়ে ইশারা করে বলছিলো রোল অন।
বাবাঃ সেদিন সাগর ই তোকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো , আমাকে ফোন তাহলে সেই করেছিলো।
বাবা আর ছেলেতে কথা বলে যাচ্ছে আর মা তার আপন মনে ভাবনার জগতে চলে গেছে সাগরের ভাবনাতে।
মাঃ সাগরদের বাসা কোথায় রে?
নাফিজঃ আমি জিজ্ঞাস করিনি।
মাঃ ও কি তোর সাথে বুয়েটে পড়ে?
নাফিজঃ মনে হয় না। আর সাগরের সাথে এক্সিডেন্টের দিনেই প্রথম দেখা।
মাঃ (চিন্তার জগত খুলে) বলিস কি? তুই ওর সম্পর্কে কিছুই জানিস না।
নাফিজঃ ও আমাকে এসব না জানার জন্য শর্ত দিয়েছে। তাছাড়া আমার এইসব জানার দরকারও নেই।
নাফিজের কথা শুনে মা বেশ চিন্তিত হয়ে পরে। সে বুঝতে পারে নিশ্চয় এখানে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে এই সাগরের মাঝে। আমাকে সাগর সম্পর্কে সব জানতেই হবে- এমন ভাবনায় তিনি অন্য মনস্ক হয়ে পড়েন।
…………………
যথারীতি রাত ১২ টায় সময় সাগর এসে নাফিজের ঘরে উপস্থিত।
সাগরঃ আজ আমার দুষ্টু বাবুটি কোথায় যাবে?
নাফিজঃ ইচ্ছে করছে তোমার বুকে মাথা রেখে হাওয়ায় ভাসতে থাকি।
সাগরঃ তবে দূরে বসে না থেকে আমার বুকে চলে আস।
নাফিজ সাগরের বুকে মাথা রাখতেই দেখতে পেল সে হাওয়ায় ভাসমান অবস্থায় সাগরের বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
সাগরের বিষয় মা কে এতই ভাবাচ্ছিলো যে আজ তার ঘুম আসছিলো না। ঘুম না আসায় ভাবলো নাফিজ কে একটু দেখে আসি। সে বিছানা থেকে উঠে নাফিজের ঘরের দিকে গেল। ঘরের দরজা খুলে বাতি জ্বালাতেই দেখে তার ছেলে শূন্যে ভেসে আছে। ছেলের এমন অবস্থা দেখে সে বিকট চিৎকার করে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
…………………
জ্ঞান ফিরে নাফিজের মা চোখ মেলে দেখলেন চারপাশ সকালের আলোয় আলোকিত। তার পাশে সে নাফিজ আর তার স্বামীকে দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হলো।
নাফিজঃ রাতে তোমার কি হয়েছিল? আমার ঘরে এসে এমন চিৎকার করে জ্ঞান হারালে?
মাঃ কিছুই হয়নি। তুই এখন তোর ঘরে ঘুমোতে যা। আমি তোর বাবার সাথে কিছু কথা বলবো।
নাফিজঃ ঠিক আছে। (ঘর থেকে চলে গেল)
মাঃ আমি বলেছিলাম না এই ফ্ল্যাটটা ভূতুড়ে। কাল রাতে তোমার ছেলের ঘরে গিয়ে দেখি সে শূন্যে ভেসে আছে।
বাবাঃ কি বলছো এসব? তুমি অতিরিক্ত টেনশনের কারনে এমন উল্টা পাল্টা দেখেছো।
মাঃ আমি জানতাম তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবেনা। আমার ছেলেকে আমি ওই অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করবোই।
বাবাঃ ঠিক আছে। যা করার তুমি পরে করো। এখন একটু বিশ্রাম নাও।
…………………
দুপুর বেলা নাফিজ আর তার মা লাঞ্চ করছিলো এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলে মা খাবার রেখে উঠে দরজা খুলে দিল।
সাগরঃ আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?
মাঃ ভালো আছি। এসো, ভিতরে এসো।
নাফিজঃ আরে কি অদ্ভুত ব্যাপার, দিনের বেলায় তুমি আমাদের বাসায়?
মাঃ তাহলে কি ও রাতে আসে নাকি?
নাফিজঃ (কথা ঘুরিয়ে) নাহ… মানে ও তো একদম আসেনা তাই।
মাঃ সাগর তুমি আমাদের সাথে খাওয়া দাওয়া কর। এসে ভালই করেছ। তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে কিছু কিনতে যাব।
সাগরঃ আমি কিছু খাবোনা। আপনি খেয়ে তৈরী হয়ে আমাকে বললেই হবে।
নাফিজে মা দ্রুত খাবার শেষ করে সব গুছিয়ে কেনাকাটার কথা বলে সাগরকে নিয়ে বেরিয়ে পরে।
মাঃ তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
সাগরঃ আমি জানি আপনি কি বলবেন। না জানলেই কি নয়?
মাঃ আমার ছেলের ভালোর জন্য যে আমাকে সব জানতেই হবে।
সাগরঃ আমি সাগর নই। আমি ইরফান, পুরো নাম ইরফান মোস্তাক। আপনারা এখন যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেই ফ্ল্যাটে আমরা থাকতাম, আর নাফিজের রুমটাই ছিল আমার। বাবা-মা, আমি আর আমার ছোট বোনকে নিয়ে ছিল আমাদের সুখী সংসার। আমি শম্পা নামের এক মেয়েকে আমার জীবন দিয়ে ভালোবেসেছিলাম, যে ভালোবাসা এক আমেরিকা প্রবাসীর শক্তির কাছে মাথা নুইয়ে পড়ে। ব্যাটার অপশনের দোহাই দিয়ে শম্পা আমার কাছ থেকে চলে যায়। খুব মনোকষ্ট নিয়ে কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শুনতে শুনতে হাটতে থাকি। নাফিজ যেখানটাতে এক্সিডেন্টের স্বীকার হয় সেখানেই আমি গাড়ি চাপা পড়ি। প্রচুর রক্ত ক্ষরণের ফলে সেখানেই আমার দেহের মৃত্যু হয়। আমার শোকে মা প্রায় পাগল হয়ে যান। বাবা মা আর ছোট বোনকে নিয়ে এই পাড়া ছেড়ে চলে যান আমার শোক ভুলে থাকতে। সবাই গেলেও আমার আত্মা এখানে ঘুরে বেরাত। নাফিজের প্রতি আপনার মায়া মমতা দেখে আমার মন মায়ের ভালোবাসা পেতে ব্যাকুল হয়ে যেত। আপনাদের মা-ছেলের ভালোবাসা আমাকে বেশী করে টেনে এনেছে। একদিন আমি দেখি নাফিজ নিজের অজান্তেই তার ভালোবাসার মানুষের ছবি আঁকে। যা কিনা দেখতে হুবুহু আমার মত, আর তার নাম দেয় সাগর। তার সেই ভালোবাসার জোর এতই প্রবল যে তা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আসে। যেদিন সে স্বাধীনভাবে একা একা চলার অনুমতি আপনার থেকে নিল সেদিন পণ করি সর্বাবস্থায় তার পাশে ছায়া হয়ে থাকবো। আমি প্রতি রাতেই তার কাছে আসি তার সমস্ত ইচ্ছা পুরণ করতে। যা আজও বর্তমান।
মাঃ (ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে) আমার ছেলেকে তুমি ছেড়ে দাও। আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি।
সাগরঃ আমি জীবিত অবস্থায় যা পাইনি তা এই অবস্থায় পাচ্ছি। আমাকে কেন বঞ্চিত করবেন? আমার সম্পর্কে যেই জানতে পারে সে যতই চেষ্টা করুক আমাকে দেখতেও পারবেনা আর শুনতেও পাবেনা। আপনিও এখন থেকে আমাকে আর দেখতেও পাবেন না আর শুনতেও পাবেন না।
নাফিজের মা ঠিকি খেয়াল করতে পারলো যে সে সাগর রূপী ইরফানকে আর দেখতেও পাচ্ছেনা বা শুনতেও পাচ্ছেনা। সে ছেলের চিন্তায় অস্থির। হঠাৎ বুদ্ধি আটে যে করেই হোক নাফিজকে দিয়ে সাগরকে প্রশ্ন করাবেই। তাহলেই সাগরের থেকে নাফিজের মুক্তি।
………………
সন্ধ্যার সাথে সাথেই নাফিজের মা বাড়িতে ফিরে আসেন। ছেলেকে বিকালের খাবার দিয়ে নিজেও হাতে চা নিয়ে বসে পড়ে ছেলের সাথে খোশ গল্পে।
মাঃ সাগর ছেলেটা বেশ ভাল। আমাকে বেশ ভালভাবেই গাইড করলো। ভাবছি ছেলেটাকে কালকে একটা সারপ্রাইজ দিব। কিভাবে দিব? ধ্যাত।
নাফিজঃ কি হল?
মাঃ আমি যে ওর কিছুই জিজ্ঞাস করিনি মানে কি করে, কোথায় থাকে এসব।
নাফিজঃ এটা ব্যাপার হল, আমি জেনে তোমাকে জানিয়ে দিব।
মাঃ প্রমিজ কর।
নাফিজঃ প্রমিজ করলাম।
………………
রাতে যথারীতি সাগর নাফিজের ঘরে আসে। এসেই নিজের বুকের সাথে নাফিজকে জড়িয়ে নেয়।
সাগরঃ মা কে ভালোবাসনা?
নাফিজঃ অনেক।
সাগরঃ মায়ের সাথে যে প্রমিজ করলে আমার সম্পর্কে জেনে তাকে জানাবে।
নাফিজঃ করেছি…… কিন্তু।
সাগরঃ কিন্তু কি?
নাফিজঃ তুমি আমাকে তোমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাস করতে না করেছ, এখন আমি যদি তোমাকে সেগুলি জিজ্ঞাস করি তাহলে যে তোমাকে আমি দেখতে পারবোনা বা শুনতেও পারবোনা। আমি যে তোমাকে হারাতে চাইনা। তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
সাগরঃ মায়ের ভালোবাসা অনেক প্রবল। তোমার ভালোবাসার জোর যেমন আমার মত এই অতৃপ্তকে তোমার কাছে টেনে এনেছিল, ঠিক তেমনি মায়ের সে ভালোবাসার জোর আমাকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে। সত্যি বলছি আমি সর্বাবস্থায় তোমার পাশেই থাকবো। মা কে কখনো কষ্ট দিও না। তোমার ভাল থাকার উপর নির্ভর করছে আমার এই অতৃপ্ততা থেকে মুক্তির পথ। তুমি আমাকে সেই মুক্তি দিবেনা?
নাফিজঃ অবশ্যই। আমি কিভাবে তোমাকে খুঁজে পাব?
সাগরঃ যখন তুমি খুব ভালো থাকবে তখন তুমি আমার পরশ অনুভব করতে পারবে। আর যখনি তুমি কষ্টে থাকবে তখন তুমি আমার কষ্ট খুঁজে পাবে।
…………………
লোকচক্ষুর অন্তরালে এমন সব ঘটনা ঘটে থাকে যা কেবল হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না। যার ব্যাখ্যা কেউ দিতেও পারেনা। নাফিজের মা বলতেন এক্সিডেন্টের পর নাফিজের স্মরণশক্তি কিছুটা কমে গেছে, তাই তার বাবা তাকে মনোবিদের কাছেও তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। ডাক্তার নাফিজের সমস্ত ঘটনা শুনে সম্পূর্ণ ঘটনাকে তার ওই সময়কার বিষন্নতার ফল বলেই মনে করেন। নাফিজের মা কেও চিকিৎসক এর ব্যাখ্যা দেন। তিনি সেটা মেনেও নেন। কিন্তু নাফিজ, সে যে আজও সাগরকে উপলব্ধি করতে পারে। সাগর যে তার অন্তরেই বিদ্যমান।
*****(সমাপ্ত)*****
উৎস: অন্যভুবন