
রিয়েল ফ্রেন্ড
( এই গল্পের কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে এর কোন মিল নেই। আমার এই গল্পটি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের উৎসর্গ করা হল।)
[ ‘মায়া’ কথাটি আপনারা প্রায় সকলেই শুনেছেন। সাধারণতঃ কল্পনা বা কুহক বা এইরূপ কোন অর্থে মায়া-শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।]
ফজরের আযানের পরে সকালের বিশুদ্ধতা চারপাশে বিরাজমান। এই সময়ে পাখীদের কিচিরমিচির শব্দ বুঝি সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা। আকাশের রক্তিম আভা তখনও কিছুটা বিরাজমান। এমনি সময়ে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে প্রাতঃভ্রমণে যাওয়া রাফির অভ্যাস। সকালের এই সৌন্দর্য রাফিকে বেশ টানে। ঘন্টা খানেক হাটাহাটির পরে বাসায় এসে সকালের নাস্তা করেই দৈনিক পত্রিকা হাতে নিবে এক ঘন্টার জন্য। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের খবর রোবটের মত তাকে পড়তেই হবে। পুনরায় ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে গোসল করে ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে।
[রাফেদুল ইসলাম রাফি- এই গল্পের অন্যতম চরিত্র। বাবা-মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে রাফি দ্বিতীয়। শান্তশিষ্ট, ভদ্র স্বভাবের রাফি অযথা কারো সাথে কোন ঝামেলায় জড়ায় না। কারো সাথে তেমন মিশেও না একমাত্র মুহিন ছাড়া। মুহিন আর রাফি এক সাথে স্কুলে পড়েছে, উচ্চমাধ্যমিকও করেছে। আবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ তে পড়ছে। স্বভাব চরিত্রে রাফি আর মুহিন কেও কারো থেকে কম যায় না। তাদের মধ্যে তফাৎ হচ্ছে- মুহিন বহির্মুখী আর রাফি অন্তর্মুখী।]
সকাল ৯ টায় ক্লাস। রাফি সবসময় ক্লাসের আধঘন্টা আগে আসলেও পিছনের আসনে বসে মুহিনের জন্য একটা আসন রেখে দেয়। প্রতিদিনের মত আজও রাফি সবার আগেই ক্লাসে আসে। শ্রেণীকক্ষে ঢুকতেই বোর্ডে একটা লেখা দেখতে পায়। লেখা ছিল –
“ আমার হৃদয় জুড়ে তুমি থাকনা। তুমিই যে আমার ঠিকানা।
রাফি, আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষাতে আছি।’’
লেখাটি পড়েই রাফি চিন্তার জগতে পড়ে যায়। কে লিখতে পারে এমন? কেউ দেখে ফেলার ভয়ে সে দ্রুত লেখাটি মুছে ফেলে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মুহিন শ্রেণীকক্ষে আসে। রাফি এমনি অন্তর্মুখী ছিল যে ব্যাপারটি মুহিনের সাথেও আলোচনা করেনা। রাফির নীরবতা দেখে মুহিন-
- কিরে, তোর মুড অফ কেন?
- মুড অফ কই দেখলি। আমিতো সব সময় এমনি।
- মনে হচ্ছে তুই কোন বিষয় নিয়ে বেশ ভাবছিস।
- নাহ। তুই ভুল ভাবছিস। (মুহিনকে বিষয়টা জানাতে চাচ্ছিলনা বলে মিথ্যা বলল)
- আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছিস নাতো?
- ধ্যাত। তুই খুব বেশি বিরক্ত করছিস।
রাফির কথায় মুহিনের কিছুটা মন খারাপ হয়। এরি মধ্যে ক্লাসে শিক্ষক প্রবেশ করে রোল কল করতে থাকে। রাফির কল হলেও চুপ থাকে। এমন সময় মুহিন-
- তোর রোল কল হইছে।
- প্রেজেন্ট স্যার। ( মুহিনের কথার পর রাফি)
- এতক্ষণ কি করছিলে? ( স্যার রেগে গিয়ে) ক্লাসে মনোযোগ দাও।
- ওকে, স্যার।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এর উপর স্যারের ঘন্টা ব্যাপী লেকচার আজকে দুজনের কাছেই বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। এই এক ঘন্টা কাল কে তাদের দুজনের কাছেই এক যুগ এর মত লাগছিল। স্যার লেকচার শেষ করে যেতেই মুহিন-
- তুই আমার সাথে মিথ্যা বললি কেন? রোল কলের সময় তোর অন্যমনস্কতাই প্রমাণ করে তুই কোন কিছু নিয়ে বেশ ভাবছিস। আমার সাথে শেয়ার কর।
- আমি কিছু ভাবলে তোর সাথে অবশ্যই শেয়ার করতাম। প্লিজ এই প্রশ্ন করে আমাকে আর বিরক্ত করিস না।
- আমি তোকে বিরক্ত করছি?
- হ্যাঁ, করছিস।
রাফির কথা শেষ হতেই মুহিন রাগ করে চলে যায়। মুহিনের চলে যাওয়ার পর রাফিও ক্লাস থেকে চলে যায়। বোর্ডের লেখাটাই তার চোখে ভেসে উঠছে বার বার। চিন্তা করছে কে লিখতে পারে সেটা নিয়ে। যদি কোন মেয়ে লিখে থাকে? তাহলে? আমার যে মেয়েদের ভালোবাসার দরকার নেই। আমি যে সমপ্রেমী-এমন সব ভাবনা খেলা করছিল রাফির অবচেতন মনে। এমন সময় রাফির মোবাইলে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। দুইটা রিং হওয়ার পর রাফি রিসিভ করতেই-
- আমার উত্তর দিলেনা?
- (রাফি অবাক হয়ে) উত্তর কিভাবে দিব? আমি যে আপনাকে চিনিনা, জানিও না।
- তাহলে এখন চিনে নাও, জেনে নাও।
- কোথায় আপনি?
- পিছনে ঘুরে দেখ।
রাফি পিছনে ঘুরতেই দেখে ডিপ ব্লু জিন্স আর সাদা টিশার্ট পড়ে একজন ২৯-৩০ বছরের যুবক দাঁড়িয়ে আছে।
- আপনি?
- হ্যাঁ, আমি। আমি মোহন।
- বাহ, আপনি মোহন আর আমার সাথেই পড়ে মুহিন, আমার একমাত্র বন্ধু। দুজনেই দেখতে প্রায় কাছাকাছি , নামও প্রায় এক। আপনি কি করেন?
- সংগ্রাম।
- সংগ্রাম? এটা আবার কেমন পেশা।
- অধিকার আদায়ের পেশা।
- হুম। বুঝলাম। আমার প্রশ্ন হচ্ছে- আপনি আমাকে কিভাবে চিনলেন? আর আমার নাম্বার কিভাবে পেলেন?
- তোমাকে প্রতিদিন ভোরেই হাটাহাটি করতে দেখি। এক সময় ভালো লেগে যায়। তোমাকে ফলো করে ক্লাস অবধি যাই। তাহলেতো বুঝতেই পারছ কিভাবে তোমার নাম্বার পেলাম।
- বুঝেছি।
- আমার উত্তর দিবেনা?
- দিব। তবে আমাকে আরো সময় দিতে হবে।
- আমাকে ভাল লাগেনি, তাইনা?
- খারাপও লাগেনি।
- ঠিক আছে। তুমি ভেবে আমাকে জানাও।
- আজকে আসি। অন্যসময় কথা হবে।
- ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।
- আল্লাহ হাফেজ।
রাফি মোহনের সাথে কথা শেষ করে বাড়ি ফিরে আসে। দুপুরের খাবার শেষ করে বিছানাতে যায় বিশ্রামের জন্য। এমন সময় মোহনের কথা তার মনে খেলা করতে থাকে। পাশাপাশি মুহিনের কথাও ভাবতে থাকে। মুহিন আর মোহন দেখতে প্রায় কাছাকাছি। দুজনের নামও প্রায় কাছাকাছি। এসব ভাবনা খেলা করতে থাকে। নিজের মনকেই প্রশ্ন করে- মুহিন কি আমাকে ভালোবাসে? আবার এ ভেবেও স্বান্ত্বনা দেয় যে- যদি মুহিন সমপ্রেমী হত তাহলে এত দিনে সে আমাকে প্রপোজ করতো। রাফি সিদ্ধান্ত নেয় মোহনের ভালোবাসায় সাড়া দেওয়ার আর এই বিষয়টা মুহিনের কাছে গোপন রাখার। এমন সময় রাফির মোবাইলে মোহনের ফোন আসে।
- হ্যালো।
- কিছু ভেবে পেলে?
- আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি আপনার কথা ভাবছি?
- আমি যে তোমাকে বুঝে ফেলেছি তাই।
- তাহলে আমার উত্তরটার জন্য কেন অপেক্ষা করছেন? সবি যখন বুঝেন এটা বুঝে নিতে পারেন না?
- (মোহন খুশীতে চিৎকার দিয়ে) আমি জানতাম তুমি আমাকে ফেরাতে পারবেনা। চলনা আমরা দেখা করি।
- কালকে করবো। এখন রাখছি। বাই।
রাফি ফোন রেখে চোখ মেলে তাকাতেই দেখে মোহন তার পাশে বসা।
- তুমি এখানে? কখন আসলে? আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো?
- তোমার সাথে কথা বলার সময় পাইপ বেয়ে বেলকনি দিয়ে তোমার ঘরে এসেছি।
- সদর দরজা দিয়ে আসলেই পারতে?
- এভাবে এসে দেখা করার মজাই আলাদা। যখনি তোমার বাসায় আসব এইভাবেই আসব।
- পাগল একটা। যদি কেও দেখে ফেলে তখনতো তোমাকে চোর ভাববে।
- কেউ দেখলেতো। আর কেউ দেখলে দেখুক। আমাদের কি? ( বলেই রাফির ঠোঁটে আলতো করে চুমু দেয়)
- কি করছ? কেউ দেখে ফেললে? তুমি এখন যাও।
- ঠিক আছে। ভালো থেক।
মোহন যেভাবে আসছে ঠিক সেভাবেই নেমে চলে যায়।
এভাবে কিছু দিন চলে যায়। রাফি এমনিতেই অন্তর্মুখী তার উপর মোহনের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পর মুহিনের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ হয়ে উঠেনা শুধু ক্লাসে সৌজন্যবোধ ছাড়া। এখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলাতে ক্লাস বন্ধ থাকায় মুহিনের কাছে রাফি যেন সোনার হরিণের মত হয়ে উঠেছে। একদিন রাফির মোবাইলে মুহিন কল দিতেই রিসিভ হয়ে-
- মোহন, তুমি খুব খারাপ। এতক্ষণ ধরে তোমাকে ফোন করছি আর বিজি পাচ্ছি। আর তুমি কিনা আমাকে মাত্র ফোন করলা?
- আমি মুহিন। মোহনটা কে?
- আররে আমি তোকেই মোহন বলছি। (মুহিনের কাছে মোহনের কথা গোপন করতে)
- বাহ! তুই দেখছি মিথ্যা বলা শিখে গেছিস। ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে তুই এত বদলে গেছিস।
মুহিন রাগ আর অভিমানে ফোনটা কেটে দেয়। ভাবে রাফি বুঝি এখনি কলব্যাক করবে। অনেকক্ষণ হয়ে যায়, রাফির কোন ফোন আসেনা। মুহিনের বুঝতে বাকি থাকেনা যে মোহনের সাথে রাফির সম্পর্ক চলছে। আর এই সম্পর্কের মাঝে তার মত ফ্রেন্ডের কোন অস্তিত্ত্ব নেই।
এভাবে কেটে যায় আরো কয়েক মাস। এরি মাঝে মুহিন লন্ডনে ক্রেডিট ট্র্যান্সফার করে চলে যায়। মুহিনের অনুপস্থিতি রাফি তেমন অনুভব করতে পারলোনা। সবি মোহনের কল্যাণে। একদিন-
- তোমার এই সংগ্রামের কাজ না করলেই কি নয়?
- কেন বলত? আমি কি কোন অন্যায় করছি?
- এভাবে আর কত? জীবনটাকে গুছাও।
- সংগ্রামতো করছি জীবন যাতে সুন্দর করে যাপন করতে পারি।
- তোমার সংগ্রামের পদ্ধতি যে আইনের চোখে অপরাধের। যে কোন সময় তোমার কিছু হয়ে যেতে পারে। তোমার কিছু হলে আমি কিভাবে বাঁচবো?
- আমাকে নিয়ে এত ভেবনা।
- যাই কর আমার কথা ভেবে চিন্তে কর।
- শোন তুমি এখন থেকে হুট করে আমার বাসায় চলে এসনা। প্রয়োজন হলে আমি তোমার কাছে যাব।
- ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। তুমি সাবধানে থেক।
বেশ কয়েকদিন পর-
একদিন মুহিনের লন্ডনের মোবাইল নাম্বারে রাফির বড় ভাই রাজিন ফোন করে বলে-
- হ্যালো, মুহিন! আমি রাজিন বলছি।
- ওহ। আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন ভাইয়া?
- ওয়ালাইকুম সালাম। আমি ভালই আছি। তুমি কেমন আছ?
- আমিও ভালো আছি। রাফি কেমন আছে?
- রাফি ভালো নেই। ও মৃত্যূর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। (কান্নারত অবস্থায়)
- কি হইছে? ( মুহিনের সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসছিল)
- তুমি দ্রুত দেশে আস। আসলেই সব জানতে পারবে। তুমি দেরি করলে আমার ভাইটাকে বাঁচানো যাবেনা। (বলেই হাউ মাউ করে কান্না করতে থাকে)
- ভাইয়া আমি যত দ্রুত সম্ভব দেশে আসছি। আপনারা কোন চিন্তা করবেন না।
ফোনালাপের তিনদিন পর-
মুহিন লন্ডন থেকে ফিরে সোজা সাইকো সেন্টার হাসপাতালে যায় রাফিকে দেখতে। সেখানে রাফির করুন অবস্থা দেখে মুহিন একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। অবুঝ শিশুর মত কান্না করতে থাকে। মুহিনের সাথে সাথে বিষন্নতা সবাইকে গ্রাস করে। কিভাবে কি হল জানার জন্য মুহিন ব্যাকুল হয়ে উঠে। মুহিনকে তখন রাজিন সব খুলে বলতে শুরু করল-
- আজ থেকে প্রায় মাস কয়েক মাস আগে রাফিকে হঠাৎ খেয়াল করি মোবাইল কানে দিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। প্রথমে ভাবি হয়ত সত্যি সত্যি কথা বলছে। একদিন ওর রুমে গেলে দেখতে পাই ও কথা বলছে খুব উত্তেজনার সাথে। খেয়াল করে দেখলাম ঘরে আর কেউ নেই। অথচ ও এমন ভাবে কথা বলছিল মনে হচ্ছিল কারো সাথে সম্মুখে ঝগড়া করছে। এর মিনিট পাঁচেক পরে দেখি ও মোবাইল কানে নিয়ে কথা বলছে আর কাঁদছে। আমি তখনি ওর নাম্বারে ডায়াল করি। রিং হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে রাফির খেয়াল নেই। ও কথা বলে যাচ্ছে আর অঝোর ধারায় কেঁদেই যাচ্ছে। ব্যাপারটি আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলে। বুঝতে বাকি থাকেনা রাফি মায়ার জগতে পরে আছে। আমি দ্রুত আমার পরিচিত সাইকিয়াট্রিস্ট আবুল কালামের সাথে যোগাযোগ করি। তার পরামর্শ মোতাবেক আমি রাফিকে ফলো করতে থাকি। একদিন আমি রাফিকে ফলো করতে গিয়ে দেখি ও একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে যেয়ে কার সাথে যেন চেঁচামিচি করছে। আমি কাছে গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই। রাফি শুধু বলছিল- প্লিজ তুমি সংগ্রামের পথ থেকে ফিরে এস। ওরা তোমাকে বাঁচতে দিবেনা। এই বলে কাঁদছিল। আমি কাছে যেতেই রাফি বলল- ভাইয়া তুই? আয় তোকে মোহনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আমি বলি- এখানেতো কেউ নেই। রাফি পাশে ফিরেই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে যায়। আমি সেখান থেকে রাফিকে সাইকো সেন্টারে নিয়ে আসি। জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার রাফির সাথে কথা বলে মোহনের ব্যাপারে জানতে চায়। রাফির দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিত্রশিল্পী আঁকতে থাকে। ছবি আঁকা হয়ে গেলে আমি সেটা ডাক্তারকে না জানিয়েই রাফিকে দেখাই। রাফি দেখেই বলে- তুমি এই ছবি কোথায় পেলে? ওরা তাহলে আমার মোহনকে ধরে নিয়ে গেছে? এমন সময় রাফি এমন ভাবে কানে মোবাইল ধরে মনে হয় যেন ফোন এসেছে। যদিও ওর মোবাইলে তখন কোন কল আসেনাই। মোবাইল রাখতেই- তুই পারলি মোহনকে ধরিয়ে দিতে? এই বলে রাফি পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে। তারপর থেকেই রাফি আর আগের রাফিটি নেই। দিন যত যাচ্ছে ততই ওর অবস্থা অবনতি হচ্ছে।
- আমি সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলতে চাই।
- ঠিক আছে। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।
মুহিন আর রাজিন আবুল কালামের কাছে গেলে-
- আসতে পারি?
- আসুন।
- ও হচ্ছে মুহিন, রাফির বন্ধু।
- (মুহিনকে দেখে অবাক হয়ে) আপনি দেখতে প্রায় মোহনের মত।
- (মুহিন অবাক হয়ে) আমি কি মোহনের ছবি দেখতে পারি? (মোহনের ছবি দেখার পর) ভাইয়া আমি ডাক্তারের সাথে একান্তে কথা বলতে চাচ্ছি।
- ওকে। তোমারা কথা বল। আমি রাফির কেবিনে যাচ্ছি। (বলেই রাজিন ডাক্তারের রুম থেকে চলে গেল।)
- আমি রাফির বিষয়ে জানতে চাচ্ছি।
- সেটাত আপনি তার সামনেও জানতে পারতেন। আসলে এখানে সমপ্রেমীতার বিষয়টা আছে বলে আমি……
- আপনি কি রাফিকে ভালোবাসেন?
- আমার জীবনের থেকেও বেশি।
- রাফি কি আপনাকে সব কিছু শেয়ার করত?
- সব শেয়ার করত, শুধু এই বিষয়টা বাদে।
- আপনি কখনও রাফিকে প্রপোজ করেছিলেন?
- একবার ক্লাসের হোয়াইট বোর্ডে ওকে একটা চিরকুট লিখেছিলাম।
- সেখানে কি লেখা ছিল, “ আমার হৃদয় জুড়ে তুমি থাকনা। তুমিই যে আমার ঠিকানা। রাফি, আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষাতে আছি।’’
- আপনি কি করে জানলেন?
- রাফি বলেছে, মোহন নাকি তাকে এটা লিখে প্রপোজ করেছিল।
- কিন্তু, এটাত আমি লিখেছিলাম। অনেক বার জানতে চেয়েছিলাম ও কিছু নিয়ে ভাবছে কিনা।
- বুঝতে পেরেছি। আসলে রাফি আপনাকে অনেক আগে থেকেই অবচেতন মনে ভালবাসত। সমপ্রেমীতার ভয়ে হয়ত ও সাহস করে উঠতে পারেনি। হয়ত ভেবেছে যদি আপনি ওকে সমপ্রেমী ভেবে ঘৃনা করে দূরে ঠেলে দেন। হয়ত এর ফলেই ওর মধ্যে মোহনের মায়ার জগত সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে ওর ভালোবাসার মানুষটি দেখতে প্রায় আপনার মত এবং নামও প্রায় কাছাকাছি।
- এই রোগটা আসলে কি?
- এটাকে সিজোফ্রেনিয়া বলে। এর দ্বারা আক্রান্তরা নিজের মধ্যে একটা মায়ার জগত তৈরি করে ফেলে। শব্দ শুনতে পায়, কাল্পনিক অবয়বের সৃষ্টি করে, বিষন্নতায় ভুগে, অযথা রেগে যায়।
- এটাই কি স্প্লিট পারসোনালিটি?
- নাহ। এটা স্প্লিট এক্টিভিটি অফ মেন্টালিটি।
- এর থেকে পরিত্রাণের উপায়?
- প্রথমেই রাফির কাছে মোহনকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তারপর লম্বা সময় ধরে মেডিকেশন আর থেরাপিতে রাখতে হবে। রাফিকে গত কয়েকদিন ধরে স্লিপিং ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। এভাবে খুব বেশিদিন রোগিকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
- মানে কি? রাফি কি আর কখনও ভালো হবেনা?
- রাফির প্রথম আর প্রধান ওষুধ হচ্ছে মোহন। কোথায় পাব তাকে?
- আমার জন্যেই আজ রাফির এই অবস্থা। আমি বুঝতে পারিনি। আমি বোর্ডে না লিখে সাহস করে রাফিকে বললে আজ এই অবস্থা দেখতে হতোনা। তাই আমাকেই এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
- কিভাবে করবেন?
- আমি মোহন হব।
- আপনি…।
- হ্যাঁ। আমি কসমেটিক সার্জারি করিয়ে মোহনে রুপান্তরিত হব।
- আপনাকে যে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, সেটা ভেবে দেখেছেন।
- আমার রাফিকে বাঁচাতে আমি নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত।
মুহিনের আত্মত্যাগের ফলে দ্রুত কসমেটিক সার্জারির ব্যবস্থা করা হয়। সার্জারি করিয়ে মুহিন, মোহন রূপে দেশে ফিরে আসে। সেদিন রাফিকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়নি মোহনের সাথে স্বাক্ষাতের জন্য। ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক রাজিন মুহিনকে নিয়ে রাফির কেবিনে ঢুকেই-
- আমার লক্ষ্মী ভাই। শান্ত হউ। দেখ, আমিই তোর মোহনকে ফিরিয়ে এনেছি।
রাফি একদৃষ্টিতে মোহনকে দেখছিল। মোহনকে দেখে শান্ত হয়ে-
- কোথায় ছিলা এতদিন? আমাকে খুব বেশি যন্ত্রণা দিয়েছ। তোমার জন্য আমি মরেই যাচ্ছিলাম।(কান্নারত অবস্থায়)
- তোমার কিছু হবেনা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। তোমাকে ছেরে আর কোথাও যাবনা।
- কথা দাও তুমি আর সংগ্রামের কাজ করবেনা।
- কথা দিলাম। তোমাকে নিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাব। আমরা লন্ডনে চলে যাব।
- সত্যি?
- হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
মোহন রূপী মুহিনকে পেয়ে ধীরে ধীরে রাফি অনেক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। প্রোপার মেডিকেশন এবং থেরাপির ফলে রাফি প্রায় মাস খানেকের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যায়।
(সমাপ্ত)
উৎস: অন্যভুবন