আগন্তুকের কথা 

সন্নিহিত রেনেসাঁস

বিকেল থেকে আকাশটা ভারী হয়ে আছে। এক এক করে মেঘেদের দল আমার আকাশে এসে জড়ো হচ্ছে। তাদের মনে কুটিল ফন্দি। আজকে আমার মনকে খারাপ করে দেবার ফন্দি।

জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তায় বিভিন্ন বয়সের গাড়ি অবিরাম ছুটে চলেছে।সন্ধ্যা।রাত। একা একা ঘরের ভেতর হাঁটছি।মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে ঝড়ছে।তারা আমার মনকে খারাপ করে দিতে পেরেছে।প্রায়ই নিঃসঙ্গতা মাকড়শার জালের মতো আমাকে আটকে ধরে।মাঝে মাঝে রাত জাগি।ভুল বললাম।আজকাল প্রায়ই রাত জাগি।সংগী চেয়ার,টেবিল,এলোমেলো ছড়ানো বই পত্তর,বলপয়েন্ট,কলমদানি,স্লিপপ্যাড,একটা ইয়ার ফোন, ধুলোপড়া দৈনিক,ধুমায়িত আগুনকাঠি আর রাত্রি।

এই নীলাভ গ্রহে সময় মেপে মেপে যে রাত নামে, আমি তার একনিষ্ঠ ভক্ত।দিনের প্রতিটি প্রহরের মতো রাত্রিরও ভাষা আছে।শিল্পবোধ ও চৈতন্যের আছে আলাদা মাত্রা।আমি কি তা বুঝি?বকুল ফুলের মতো কোনো ভাষায় সে গাঁথে নৈর্ব্যক্তিক প্রেমকাব্য।রাত্রি স্মৃতিকাতর।নস্টালজিক।সহস্রাব্দের ভুলো পুরান সে হাতছানি দিয়ে স্মৃতির দরজায় ডেকে আনে।

মানুষের স্মৃতিভান্ডার হাতড়ে বিদ্রুপে ঠাসা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে যে প্রহর, সে রাত্রি।রাত গভীর হয়।আর আমি আমার প্রিয় জানালাটির পাশে গিয়ে অন্তরঙ্গ হয়ে দাড়াই।অন্ধকার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি।নিস্তব্ধতার ঘ্রাণ নেই।কই নিস্তব্ধতা?বেয়াড়া ট্রাকের পাল রাত্রির বুক চিড়ে নিরন্তর ঢুকছে শহরের পেটে।তার চে’ আমার বৃষ্টির ফ্ল্যাটেই বরং রাত নিরাপদ।রাতকে উপভোগ করি।আমি আর রাত।রাত আর আমি।

দুজন দুজনের গায়ে শ্বাস ফেলি।ঠোট ছুঁয়ে দেই। উষ্ণতা মাপি।রাতের দুর্বোধ্য ভাষাটাকে বোঝার চেষ্টা করি। রাত কি জানে, তাকে আমি কত ভালোবাসি?

আধঘন্টা হলো বসে আছি।নিজেকে একটু স্বস্তি দিতে চাই।দুর্বিষহ জীবনে দুঃখকষ্টগুলো পাহাড় সমান ভারী হয়ে চাপা পড়ে আছে মনের মধ্যে।এরকম সময়ে একজনকে খুব দরকার হয় পাশে।যাকে মনের কথাগুলো, বেদনাগুলো বলে একটু হালকা হওয়া যায়।তাই বসে আছি প্রিয়ামের জন্য।ছেলেটাকে দেখলে মায়া হয়। ও বোধহয় বুঝবে আমাকে। আমার ভেতরের নিগূঢ় কথাগুলো ওকে বলে দিতে চাই।এতে নিজেকে হালকা মনে হবে। সে ও আমাকে জানতে পারবে।

একঘন্টা পর হাসি হাসি মুখ নিয়ে প্রিয়াম আসলো। কপট অভিমান দেখিয়ে বললাম-“না আসলেও তো পারতে?”

“সরি জনাব।একটু লেট হয়ে গেল।রাগ করোনা।” বলে তার আঙ্গুলগুলো আমার চুলের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল।ভালোই লাগল।আর অভিমান করে থাকতে পারলাম না।বসল সে।

একটু উঁচু ঢিবিতে বসলাম দুজনে।সামনে আমার প্রিয় নদী।আমার মন খারাপের সংগী।আকাশে রূপার থালার মতো চাঁদ। চাঁদের আলো নদীর পানির ভাজে ভাজে মোহনীয় কারুকাজ তৈরী করেছে।বাতাসে অজানা ফুলের স্নিগ্ধ গন্ধ। ঝিঁঝিঁ পোকারা অবিরাম ডেকে যাচ্ছে।নিস্তব্ধতা আমাদের সঙ্গী। এরকম একটা চমৎকার সময়ে কিনা আমি আমার নির্মম জীবনকে তার সামনে তুলে ধরবো। ভাবতেই খারাপ লাগছে।

আচ্ছা ভাই, কি যেন বলবে বলেছিলে।

বললাম, হ্যাঁ। একটা ছেলের গল্প, তার একাকীত্বের জীবনগাথা, নির্মমতার সাথে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা। করুন অভিজ্ঞতার কথা। আমার খুব কাছ থেকে দেখা একটা ছেলের জীবন যুদ্ধের কথা বলবার জন্যই ডেকেছি আজকে। তোর শুনতে অসুবিধা হবে না তো?

বলল, আচ্ছা। বলুন তবে।

নিজের জীবনকে অন্যের বলে উপস্থাপন করছি। নিজের বলতে সুবিধা হবে। ছেলেটা মোটামুটি পর্যায়ের বুদ্ধিমান। বুঝে ফেলার সম্ভাবনা আছে। বুঝলে বুঝুক। বলার জন্যই তো ওকে ডেকেছি।

বললাম- আচ্ছা তোমার কি মনে হয় আমাকে দেখে?

-“জানো ভাই, তোমার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারিনা। ওখানে কেমন যেন ভীষন কষ্ট, যন্ত্রণা আর বিধ্বস্ততার ছাপ দেখতে পাই। আমার খুব কষ্ট লাগে। মায়া হয় তোমাকে দেখে।”

ছেলেটা দেখছি আসলেই বিচক্ষণ। যাই হোক। আমি আমার কথা ওকে বলতে শুরু করি।

“একটা সুখী পরিবার। গ্রামের স্বচ্ছল পরিবার। তাদের নিত্য নৈমিত্তিকের সুখের ঘরকান্না চলে। পরিবারটিতে অভাব ছিলোনা। না সুখের, না অর্থের। বাবা,মা আর তাদের ফুটফুটে আদরের একমাত্র ছেলে। প্রথম সন্তান। বাবা মায়ের চোখের মণি। ছেলেটা বাবার আদর আর মায়ের স্নেহের আঁচলে বেড়ে উঠতে থাকে।

তবে পৃথিবীর সব সুখী পরিবারেও বোধহয় কিছু অসুখের কারন বিধাতার দেয়া থাকে। তাঁর পরিকল্পনাই মনে হয় এরকম। ছেলেটির বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবনটা হয়তো ততটা সুখী ছিলনা। তাঁর মায়ের শারীরিক দূর্বলতা ছিল। প্রায়ই তাঁর অসুখ করত।”

মায়ের কথা বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এল। পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় আমার মা। নিজের চোখে মায়ের কষ্ট দেখেছি, মৃত্যু দেখেছি। আর সেই মায়ের মৃত্যু, মায়ের কষ্টের স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে বেদনা জাগাচ্ছি। আবার বলতে শুরু করি-

“তার মায়ের প্রায়ই বিভিন্ন অসুখ করত। অসুস্থতার কারনে তাঁর গৃহস্থালি কাজে ব্যঘাত ঘটত। সারাদিন বাইরে জীবিকার জন্য ছুটে বাবার যখন ঘরে এসে শান্তিতে বিশ্রাম নেবার কথা, কিন্তু ঘরের অগোছালো অবস্থা, অসম্পুর্ণতা দেখে তার বিরক্তিবোধ হতো। প্রতিদিন বা প্রায়ই এক অবস্থা দেখার ফলে ব্যাপারটা দিনদিন খারাপ হতে থাকে। তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের আবির্ভাব ঘটে।

বাবা-মা যখন ঝগড়া করত তাদের আদরের ছেলেটা দরজার এক কোণে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। তার কষ্ট হতো। কিন্তু সে তো খুব ছোট। কাকে বলবে তার কষ্টের কথা?”

এতটুকু বলে থামলাম। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। মা-বাবার চেহারা সামনে ভাসছে। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতর। সামনে যা বলতে যাচ্ছি তার জন্য আরো মানসিক শক্তির দরকার। সে বলল, তারপর?

“তারপর যা হয় আর কি!

সুখী পরিবারটিতে একটা কালো মেঘের ছায়া পড়ে। আদরের ছেলেটি অনাদরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যে শৈশবে খোলা মাঠে দুরন্ত ঘুড়ির নাটাই হাতে তার ছোটার কথা, উদাস দুপুরে দৌড়ে নদীতে ঝাপিয়ে পড়বার কথা, দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরলে মায়ের আদর মাখা বকুনি শোনবার কথা, সেই শৈশবেই সে তার পরিবারের অশান্তি নিয়ে ভাবতে শুরু করে। মেধাবী ছাত্রটা অমনোযোগী হয়ে পড়ে।

এরকম সময়ে হঠাৎ একদিন তার মায়ের অসুস্থতার মাত্রা বেড়ে যায়। কাশির সাথে রক্ত আসে। চিকিৎসায় তার যক্ষা ধরা পড়ে। পরিবারে নেমে আসে গভীর অমানিষা। ইতিমধ্যে তার একটা ছোট ভাইয়ের আগমন ঘটে। অবুঝ সেই ভাইয়ের দায়িত্ব বর্তায় ছেলেটির উপর। যতদিন যেতে থাকে মায়ের অবস্থার অবনতি হতে থাকে।”

প্রিয়াম প্রশ্ন করল, “আচ্ছা তাদের আত্মীয়-স্বজনরা? তারা তাদের সাহায্য করত না?” কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। আত্মীয়রা ছিলো বটে। নামমাত্র। অসহায়, নিরুপায় একটা পরিবারকে যারা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল, তাদের কি আত্মীয় বলা যায়?

ও বলল, “হুম।ঠিক। তারপর কি হলো ভাই? ছেলেটার জীবনটা আসলেই কেমন যেন অদ্ভুত বেদনার মনে হচ্ছে।”

আবার আমি বলতে শুরু করি-

“মায়ের শেষ পর্যন্ত ক্যান্সার ধরা পড়ে। বাবা আর ছেলের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বাবা তার মায়ের চিকিৎসার খরচ যোগাতে ব্যস্ত। আর পুরো পরিবারের দায়িত্ব এক প্রকার সেই বারো বছরের কিশোর ছেলেটার উপর পড়ে।

মা হাসপাতালে। তার ছোট ভাই, দেড় বছরের ছোট বোনকে দেখাশোনার দায়িত্ব আসে তার উপর। গৃহস্থালি কাজগুলোতো ছিলই। দুরন্ত,চঞ্চল সেই ছেলেটির স্থান হয় বাঁশের বেড়ার চারদেয়ালের ভেতর। বাইরের প্রাণবন্ত জগতকে সে প্রায় ভুলতে বসে।

তখনকার সময়ে ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রচুর ব্যয়বহুল ছিল। তার মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাবা প্রায় নিঃস্ব হতে বসে। আত্মীয়-স্বজনরা তাদের কোনরকম অর্থনৈতিক সাহায্য করেনি। এমনকি অসুস্থ মায়ের সেবাও না। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার দারুন অবনতি হয়। এমনি সময় ছিল যে, ঘরের প্রিয় আসবাব, শখের টেলিভিশনটাকেও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল।

একদিকে বিষন্ন, চিন্তিত বাবার গম্ভীর মুখ। ঘরে ভাইবোন। তাদের দেখভাল, রান্নাবান্না, গৃহস্থালি কাজ। অন্যদিকে প্রিয় মা। মৃত্যূর সাথে যার লড়াই চলছে। খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন কাটছে। যখন ছেলেটা মাকে হাসপাতালে দেখতে যেত, তখন হয়ত আধপেটা খেয়ে কিংবা না খেয়ে যেত। মাকে সান্ত্বনা দিত। পৃথিবীর এক অসহায় মা চেয়ে চেয়ে দেখত তার ছেলের মুখ। মলিন মুখ। নিরুপায় সেই মায়ের করার কিছুই ছিলনা। সে ভাবত, তাকে ছাড়া কি করে বাচ্চারা থাকছে। এত ছোট ছেলেটা কি সবকাজ করতে পারছে?

মায়ের ছোট ছেলেটা বুকে কান্না চেপে মাকে সান্ত্বনা দিত। মায়ের চোখের অবিরত জল মুছে দিত।

আর রাতে বাবা ঘরে ফিরলে সারাদিনের জমানো কান্নার বাঁধ সে ধরে রাখতে পারতো না। বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিত। বাবাও নিজেকে আর সামলাতে পারত না। বাবা-ছেলের সেই গভীর চাপা কষ্টের চাপা কান্না নীরব হাওয়ায় মিলিয়ে যেত নিশ্চুপে। গুমোট আবেগের সেই মুহুর্তগুলোর সাক্ষী ছিল ঘরের বেড়া, টিকটিক আর নির্লিপ্ত স্রষ্টা।”

আমার বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রিয়াম নিশ্চুপ হয়ে শুনছে। চোখটা একটু পর পর ভারী হয়ে যায়। খুব কষ্ট করে চোখের পানি আড়াল করতে থাকলাম। সে বলল- “কি করুন।”

বললাম-“নিয়তি’ রে ভাই।” সে হঠাৎ প্রশ্ন করল, “ছেলেটা কে?”

নিজেকে গোপনে প্রকাশ করছি। বললাম, আমার খুব কাছের একজন।

রাত দীর্ঘ হচ্ছে। আমি আমার গল্প বলে চলছি।

“এতসব কষ্টের পরও ছেলেটা আর তার বাবা পারেনি তার মাকে বাঁচাতে। ছেলেটার চোখের সামনেই পৃথিবী আর প্রিয় সন্তানদের ছেড়ে না ফেরার রাজ্যে চলে যায় সেই অসহায় মা। হাসপাতালের আকাশে তখন কান্নার করুন সুর।

মায়ের মৃত্যূক্ষনে ছেলেটা মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল-

দেখ মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার কিছু হবেনা। আমি, বাবা, ভাইবোন আর তুমি মিলে সবাই একসাথে রাতের খাবার খাব, তোমার কোলে শুয়ে তিন ভাইবোন গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ব। দেখ মা, সব ঠিক হয়ে যাবে।

মা অবাক হয়ে তাকায় ছেলের দিকে। ভাবে- আহা! আমার ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে। সে এখন আমাকেই সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু কত বড় হয়েছে সে? আমি না থাকলে তাকে, ছোটছোট বাচ্চা দুটোকে কে দেখবে? ভাবতেই মায়ের চোখ ফেটে জল আসে। মায়ের কান্না দেখে ছেলেটাও কেঁদে দেয়। ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সেই যে বিদায়ের ক্ষণ। যে আবেগ আর কান্নার হাহাকার। মা হারানো এক পিচ্চি ছেলের আর্তচিৎকার, তা দেখার বা বোঝার মতো কেউ ছিলনা। বুকের পাঁজরটা শূন্য করে তার মা তাকে একা করে চলে যায়। পৃথিবীর কোন কিছুর বিনিময়ে কি সেই শূন্যতা পূর্ণ হয়?

সেই সকরুন কান্না দেখলে গাছের পাতারাও কেঁদে দিত। শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনিকে মনে হতো অস্ফুট বেদনা। পানির কলকল ধ্বনিকে মনে হতো সেও যেন করুন সুরে ‘মা’ ‘মা’ বলে কাঁদছে। কি কষ্ট! কি বেদনার সেই মুহুর্ত তা শুধু সেই ছেলেই জানে।”

আর পারছিনা বলতে। পুরনো দিনগুলোকে নিজের চোখের সামনে টেনে এনেছি। মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে। কি কষ্ট নিয়ে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে! বলতে অসহ্য বেদনা। পাথরের মতো ভারী দুঃখ আমার। তবু আমি বলে চলি। আমাকে যে বলতেই হবে।

“মাত্র বারো বছরে মাকে হারিয়ে কী ভীষন শূণ্যতার অতল সাগরে পড়ে যায় সে। অবুঝ ভাই-বোন দুটো তখনো কিছু বোঝেনা। বাবা সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে কেবলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে আর দ্বিতীয় বিয়ে করেনা।

সুন্দর সংসারটা অগোছালো হয়ে পড়ে। লেখাপড়া তখন ছেলেটার কাছে স্বপ্নের মতো। ভাইবোন দুটোকে মায়ের মতো লালন পালন করতে থাকে।এতটুকু একটা ছেলে কি বিশাল দায়িত্ব বয়ে চলা শুরু করে।”

জানো প্রিয়াম, সমাজে কিছু পশু শ্রেনীর মানুষ বাস করে। মুখোশের আড়ালে তারা লুকিয়ে রাখে তাদের পশুত্ব। সুযোগ পেলেই তারা মুখোশ খুলে তাদের পশু চরিত্র চরিতার্থ করে।

“ছেলেটা ছিল ফুটফুটে দেবশিশুর মতো। কোমল, স্নিগ্ধ আর মায়াভরা মুখে সে বয়ে বেড়াত গোপন যন্ত্রণা। যদিও বা সে তখনো তার যৌনতাকে আবিষ্কার করতে পারেনি। অল্প বয়সে কি করেই বা পারবে?

কিন্তু কিছু দেহলোভী পিশাচ তাকে লালসার দৃষ্টিতে দেখত। তারা চাইত তাকে। এরকমই এক পিশাচের কাছে বিপদে পড়ে একপ্রকার অসহায়ভাবে বাধ্য হয় নিজেকে আত্মসমর্পন করতে। সেই রাতে সে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কষ্টটা পায়। সরলতা আর সুযোগে সেই পিশাচ যে কিনা তার আত্মীয় সম্পর্কীয়, তার লালসা চরিতার্থ করে ছেলেটাকে দিয়ে।

সে লাঞ্ছিত হয়।

তার যে কি অসহ্য যন্ত্রণা। একটা বিশাল দেহের তলে পিষ্ট, নিষ্পেষিত হয়ে যেতে কি দুঃসহ বেদনা!শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত হতে গিয়ে ওষ্ঠাগত তার প্রান। যে কান্নার ফোয়ারা তার চোখ দিয়ে বের হচ্ছিল, তার নিশ্চুপ আর্তনাদ, চিৎকার যে কতটা ছিল তার প্রত্যক্ষকারী ছিল ছিল একমাত্র গভীর কালো রাতের অন্ধকার। জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলে তাকে, তার সহজ শৈশব, কৈশরকে এক নিমিষেই বদলে দিয়েছিল সেই কালোপুরুষ। এই কথাগুলো সে বলতে পারেনি কেউকে!

দুঃখের সাগরে নোঙ্গরহীন জাহাজের জাহাজী হয়ে কেবল ভাসতে থাকে সে।”

প্রিয়াম একদম চুপ। আমার চোখে নদী। বুঝলাম বাতাসটাও থমকে আছে। গুমোট চারদিক। সেও কি তবে আমার এই জীবনকে শুনতে পাচ্ছে? সেও কি কষ্টের নির্মমতাকে উপলব্ধি করতে পারছে? ঝিঁঝিঁ পোকারাও নিশ্চুপ।

আমি বলে যাচ্ছি-

“এভাবে বছর যেতে থাকে। বছর আসতেও থাকে। সময়ে তারা অল্প অল্প করে বড় হয়। চার বছর কেটেও যায়। এক পর্যায়ে গৃহস্থালি দায়িত্ব পালন করতে করতে সেই কোমল ছেলে হাপিয়ে ওঠে। অতিষ্ঠ দুর্বিষহ চাপা কষ্টকে বইতে না পেরে সে প্রতিবাদ করে। সে পারবেনা আর রান্না করতে, পারবেনা ভাইবোনদের আর গোসল করাতে, পারবেনা তাদের পড়াশোনা করাতে। ঘরে বন্দী ছেলেটা আর বইতে পারছিলনা এই বোঝা। এত ছোট বয়সে আর কিই বা করতে পারত সে?”

কিন্তু জানো প্রিয়াম, তাকে আরো অনেক কিছু পারতে হয়েছিল।

“ঘরে বৈঠক বসে। বাবাসহ আত্মীয়রা চিন্তায় পড়ে। কথা ওঠে সংসারটাকে রক্ষা করতে হলে, বাঁচাতে হলে বাবাকে আবার বিয়ে করতে হবে। কষ্ট হলেও ছেলে মত দিয়ে বসে।

সেখানেও বিধাতা আরো একবার নির্মম পরীক্ষা নেয় তার। আকদ এর দিন বাবার স্ট্রোক হয়। তার স্থান হয় হাসপাতালে। অর্থনৈতিকভাবে অতি দূর্বল অবস্থায় বাবার এই পরিস্থিতিতে ঘর আর বাবার পরিচর্যা করতে করতে তার অবস্থা হয় বিরামহীন ট্রেনের মতো। যার কাজ শুধু ছুটে চলা। ঘরে ভাইবোন, অন্যদিকে বাবার সেবা। প্রায় অর্ধ প্যারালাইজড পিতার গোসল থেকে শুরু করে কাপড় বদলানো, খাইয়ে দেওয়া সেই ছেলেকেই করতে হয়েছিল। আত্মীয়রা সাহায্য তো দূরে থাক তারা তার বাবাকে দেখতেও আসেনি।

বাবাই যখন তার একমাত্র বেঁচে থাকার প্রেরণা, সেই বাবাকে সুস্থতা দানে সে আত্মমগ্ন হয়ে যায়। কোথায় তার খাওয়া, কোথায় তার নাওয়া। ভাইবোন দুটোকে খাইয়ে নিজে হয়তো আধপেটা কিংবা খালি পেটেই রাত কাটিয়ে দিত। রাতগুলো যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যেত। ছেলেটি তখন ফুঁপিয়ে কাঁদত আর স্রষ্টার কাছে বলত, বাবা যেন ভালো হয়ে যায়।

হতো শুকনো চিড়া আর গুড়ে কাটিয়ে দিন দিন ক্ষুধার মতো অসহনীয় কষ্টকেও সে বয়ে বেড়াত আপনার করে।”

“ধীরে ধীরে দুইমাস পর বাবা সুস্থ হয়ে ওঠে। বিয়েটাও এক পর্যায়ে হয়ে যায়। যেদিন ঘরে সৎ মায়ের প্রবেশ সে দিনটা যে তার কাছে কত অসহায়ের মত লেগেছে তা শুধু সে আর বিধাতাই জানেন। বুকের ভিতর কান্না দলা পাকিয়ে উঠে গলার কাছে আটকে থাকতো। বাবাকে নতুন মায়ের সাথে জুড়ে দেবার যে কি কষ্ট! বাসর ঘরে বাবাকে দিয়ে আসার যে কি যন্ত্রণা! কে বুঝবে তা?

অঝোরে খালি চোখের জল পড়ে। অসহায় এতিমের মতো মায়ের কথা মনে করেছে। ছোট ঘরটাতে তিন ভাইবোন মিলে হাউমাউ করেই কেঁদেছে। পৃথিবীতে নিজেকে তখন বড্ড একা মনে হচ্ছিল তার। তাদেরকে বুকে চেপে ধরে খুঁজতে চেয়েছে সান্ত্বনা। মাথায় হাত বুলিয়ে একটু সান্ত্বনা, একটু ভালোবাসার মতো কেউ ছিল না তখন।

এভাবে দিন যায়। ঘরের কাজ থেকে মুক্তি মিলে তার। নতুন মায়ের আগমনে তাদের জীবনে তেমন প্রভাব পড়ে না। কোনমতে ছেলেটা তার লেখাপড়া চালিয়ে যায়। এস.এস.সি প্রীক্ষার প্রস্তুতি নেয়।

মানুষের দঃখ যখন আসে, তখন বোধহয় দল বেধেই আসে। সহ্যের সীমাকে চরমে পৌছে সেখান থেকে অতল শূণ্যে ছুড়ে ফেলে দেয়াটা নিয়তির একটা খেয়ালী খেলা। তাই ঐ ছেলেটার জীবনকেও নিয়তি সহ্যের সীমায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে নেয়। উঁচু থেকে ফেলে দেয় অকুল দরিয়ার মাঝে।

হঠাৎ পরীক্ষার একদিন সকালে বাবাটা স্ট্রোক করে ইহলোক ত্যাগ করে। এক মহান মুক্তিযোদ্ধা, সংগ্রামী সৈনিক হঠাৎ করেই পৃথিবীর বাংলার সাধারন মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। সে তো চলে গেল। সমস্ত কিছু নিঃসীম শূণ্য আর পুরো খালি করে দিয়ে গেল ছেলেটার জগতকে। যখন বাবার মৃত্যুর খবর তার কাছে পৌছে, পায়ের নিচে মাটি আর মাথার উপর আকাশ ছাড়া কিছুই ছিলনা তার।

এবার আর চিৎকার করে কাঁদে না সে। গভীর শোক মানুষকে পাথর করে দেয়। সে স্তব্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর আগে বাবা তাকে নাম ধরে ডাকত না। ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করত। সেই প্রিয় বাবা, মাথার উপর ছায়া দেয়া একমাত্র বৃক্ষমানব আজ আর নেই। ভাবতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে প্রাণ। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় পিতাকেও সে অন্ধকার মাটির ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসে। আপন বলতে বোধহয় এখন সে নিজেই নিজের।”

একটা বাদুর উড়ে গেল মাথার উপর থেকে। জানি প্রিয়ামও আমার মতো কাঁদছে। নিজেকে সত্যিই অনেকটা হালকা হালকা লাগছে। অতি দুঃখে কাঁদতে পারার মধ্যে এক ধরনের সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যায়। বাবা-মা কে এমন করে অনেক দিন হল মনে করিনা।

আমার ঈদ নেই। ঈদে যখন সবাই আনন্দে মেতে থাকে আমি তখন নামাজ পড়ে বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করে ঘরে বসে থাকি। কাদের জন্য আমি আনন্দ করব? যার মা-বাবা নেই তার এত আনন্দ করতে নেই।

‘কি হল ভাই? এরপর? আমি নিজেকে কাঁদিয়ে ফেলেছি। আপনার কাছ থেকে দেখা ছেলেটাকে আমারো খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।’

বললাম, ‘দেখবে। তোমার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিব।’

তারপর আবার ফিরে যাই আমার জীবনে। এরপর যে আমার সংগ্রামের দিনগুলো।

“বাবার মৃত্যু তার পুরো দুনিয়াটাকে বদলে দেয়। আত্মীয়রা তার সৎ মাকে চলে যাবার প্রস্তাব দেয়। তার ভাইবোনদের বিভিন্ন দিকে কাজে লাগিয়ে দিতে চায়। পুরো সংসারটাকেই তারা বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়।

এখানে ছেলেটা দৃঢ়চিত্তের পরিচয় দেয়। সে সবাইকে সাফ জানিয়ে দেয় যে তার মা তাদের সাথেই থাকবে। ভাইবোনদেরকে সে লেখাপড়া শিখাবে। মানুষ করবে।

মা ও তার সন্তানদের জন্য থেকে যায়। তার কোলেও যে ছিল নয় মাসের এক ফুটফুটে কন্যা। নতুনভাবে তাদের জীবনের সংগ্রাম শুরু হয়। ছেলেটা হয়ে ওঠে ঘরের কর্তা।

বাইরের জগতে জীবিকার জন্য সেই কিশোর পা রাখে। নুন আনতে পানতা ফুরায়। তারপরও সে হার মানে না। একটা অল্প বেতনের চাকুরি জুটিয়ে নেয়।

বিপদ কিংবা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তার পিছু ছাড়েনা। এখানেও তাকে লোভ, কাম, স্ত্রুতার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করে যেতে হয়। হয়তো কেউ কেউ তার প্রতি সহানুভূতি দেখায়। যতনা তার তার প্রতি, যতনা তার কাজের প্রতি, তারচেয়ে অনেক বেশী রাতের বিছানায়। এখানেও সে ধর্ষিত হয়। নীরবে সহ্য করা ছাড়া তার কিছুই করার থাকেনা।”

“সময় তো লাগামহীন। তাকে কি উপায়ে ধরে রাখা যায়? সে তার আপন গতিতে চলতেই থাকে। আমরা তার পিছু পিছু ছুটে চলি নিরন্তর। সেই কিশোর ছেলেটাও ছুটতে থাকে। ধীরে ধীরে নিজেকে জানতে শেখে। পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয় তা শেখে। সে কিশোর থেকে যৌবনে পা রাখে।

বাইরের পৃথিবীকে দেখতে প্রচন্ড রকমের আগ্রহী ছেলেটা আত্মশিক্ষায় শিক্ষিত হয়। যৌনতা, জীবন, কর্ম, ধর্ম, নীতি সব কিছু সম্পর্কে সে এখন ওয়াকিবহাল। যে কোন কঠিন পরিস্থিতিকে সে মোকাবেলার সাহস অর্জন করে। নির্মমতা তাকে হারাতে পারেনি। জীবনের দৌড়ে সফলতার লক্ষ্যে সেই ছোট্ট দুঃখী ছেলেটা এখন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বিচরন করে নিজস্ব জগতে।

জীবন তাকে চরম শিক্ষা দিয়েছে। এতটাই যে এখন কারো দুঃখকে তার কিছুই মনে হয় না। সে তো জানে দুঃখ কাকে বলে? কষ্টের অভিজ্ঞতা কেমন? কিভাবে সফল হতে হবে?”

শত প্রতিকূলতা ছাপিয়ে আজ আমি এই আমি। এখনও রাতে আমার ঘুম হয় না। রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করে মাথায়। বাবা-মা কে মাঝে মাঝে মনে পড়ে। দৈনন্দিনের ব্যস্ততা শেষে যখন ঘরে ফিরি, যখন খুব একা থাকি, তখন নিজের কষ্টগুলো আয়নার মতো আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।। আমার সাথে কথা বলে। হেরে যাওয়ার কথা, জিতে যাওয়ার কথা, না পাওয়ার কষ্টের কথা। কাঁদি, খুব কাঁদি। কাঁদতে আমার খুব ভাল লাগে। মনটা হালকা হয়। জীবনটা এত কঠিন কেন?

গল্প শেষে আমি নিশ্চুপ। চোখটা বেশ ব্যথা করছে।

প্রিয়াম ভারী গলায় বলল, ‘আচ্ছা ঐ ছেলেটা তুমি, তাই না?’

আমি এইবার আর থাকতে পারলাম না। প্রিয়ামকেই এখন নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে হচ্ছে।ওকে জড়িয়ে ধরেই আবার কেঁদে দিলাম। প্রিয়ামের কাছেও আমাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই। সেও কেঁদে যাচ্ছে। আমি পেরেছি নিজেকে প্রকাশ করতে। এখানেই আমার আনন্দ। এখানেই আমার সফলতা।

*****(সমাপ্ত)*****

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.