
এক মুঠো স্বপ্ন
মধ্যদুপুর, লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ফুটপাত দিয়ে হাটছি। হাতে ‘হিমুর
মধ্যদুপুর’। গন্তব্য অজানা।
এমন গন্তব্যহীনভাবে হাটায় একটা অন্যরকম ফিলিংস আসে। নিজেকে তখন হিমু
হিমু ভাবতে ইচ্ছা করে।
কিন্তু পার্থক্য একটু আছে। হিমালয় সাহেবের পরনে থাকে হলুদ পাঞ্জাবী, খালি পা, মুখে পান
কিংবা সিগারেট। আর আমার পরনে থাকে রংজ্বলা নীল পাঞ্জাবী, পায়ে ফার্মগেট থেকে কেনা প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া সস্তা সেন্ডেল।
কাঠ ফাটা রোদ গা পুড়িয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু আমার কোনো ভাবান্তর নাই।
পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠের ডাক…
‘রাজ ভাইয়া’…
পেছনে ফিরে দেখলাম।
একটা মেয়ে হনহন করে হেটে আসছে।
অপূর্ব সুন্দরি। দূর থেকেই তার সৌন্দর্য চোখ ধাঁদিয়ে দিচ্ছে। কাছে আসার পর চিনতে পারলাম। আমার খুব প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় রবিন ভাইয়ের ছোট বোন তন্নি। এবার HSC দিবে।
পরনের পাঞ্জাবীটা গত বছর জন্মদিনে ওই গিফট দিয়েছে।
-কতবার ডাকলাম!!!???
(বিরক্তির সাথে বলল। দ্রুত হাটায় কিছুটা হাঁপাচ্ছে)
-সরি, আমি খেয়াল করি নাই।
-তা করবেন কেন?? দেখে তো মনে হচ্ছে হিমু হওয়ার চেষ্টায় আছেন।
(বুঝলাম, তেনার মেজাজ সপ্তম আসমানে চড়ে আছে)
-না ঠিক তা নয়।
-কোনটা নয় আর কোনটা ছয় সেটা বোঝার বয়স আমার হয়েছে। হিমুর ভাব নিয়ে
মেয়ে পটানোর পায়তারা না!!!????
-তা নয়। এই কাঠ ফাটা রোদে দাড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছেনা। চল লাচ্ছি
খাই।
-আরে রাখেন আপনার লাচ্ছি!! হাতে কি?? হে??
-ও,,, বলেছিলাম না?? ‘হিমুর মধ্যদুপুর’।
-শুনেন,,, হিমুর বই পড়লে আর পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে হাটলেই হিমু হওয়া যায় না। সবাই সব কিছু পারে না। বোঝা গেছে???
-জ্বি।
-কি জ্বি?? হে??? কি জ্বি???
-ওকে, চেষ্টা বাদ। এখন চল লাচ্ছি খেয়ে মাথা ঠান্ডা কর।
-মাথা তো আপনার জন্যই গরম হল।
-মাথা ঠান্ডা করার দায়িত্বটা না হয় আমিই নিলাম।
-চলেন…
(কেমন অদ্ভুত একটা চাহুনি দিয়ে ও বলল)
একটা ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে দুইটা লাচ্ছির অর্ডার দিয় বসলাম।
-কেমন আছ?
-আপনি আমাদের বাসায় যান
না কেন??
-কেমন আছ বললে না, আন্টি কেমন আছেন??
-আমার প্রশ্নের উত্তর আগে দেন।
-খুব ব্যস্ত আছি। টিওশনের চাপ বেড়ে গেছে।
-আপনি মিথ্যা বলতে পারেন না। তারপরও কেন বৃথা চেষ্টা করেন??
-এমনেই।
-এটা কোনো উত্তর না।
-বললাম তো এমনিই।
-আপনি কি কিছুই বুঝেন না?? নাকি ন্যাকাম করেন???
(কষ্ট আর ক্ষোভ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল)
-যেটা সম্ভব না সেটা নিয়ে ভাবা বোকামি নয় কি??
-বোকামি??? কি বোকামি?? কোনটা সম্ভব আর সম্ভব না সেটা আমি ভালই বুঝি। আপনার কাছ থেকে শিখতে হবে না।
-তোমার ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্কটা কেমন তা তো তুমি জানই। ঢাকায় আমার একমাত্র
অভিভাবক। আমিও ভাইয়াকে আমার নিজের বড় ভাই মনে করি এবং শ্রদ্ধা করি। তার মানহানি হয় এমন কোন কাজ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
-তাহলে আমার দেয়া পাঞ্জাবীটা এত যত্ন করে রাখার দরকার কি?? ওটা ডাস্টবিনে ফেলে দিন। আমার কোনো মূল্যই আপনার কাছে নাই। তাহলে এই জিনিস গুলো রাখছেন কেন??
-তোমার দেয়া জিনিসগুলো সুন্দর। আর পাঞ্জাবীটা আমার পছন্দ হয়েছে।
-আর আমি??
-তোমাকে স্নেহ করি। কিন্তু তুমি আমার কাছে যা চেয়েছ তা আমি কখনই দিতে পারব না। কারণটা আমি ইতোমধ্যে বলেছি।
-আপনি,,, আপনি আসলেই একটা জড় পদার্থ!!! আপনি আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না।
তন্নি চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেল। আমি নির্বিকার ভাবে বসে রইলাম।
এক বছর পর….
আজ আমার কপালে শনি আছে!! দো’আ দরুদ পড়তে পড়তে দরজায় নক করলাম। রজনী…
আমার রজনীগন্ধা… প্লিজ দরজাটা খোলো। কথা দিচ্ছি আর জীবনেও এমন হবে না।
প্লিজ,,,প্লিজ,,,প্লিজ,,,,,,
খট করে দরজা খুলে গেল।
তন্নি আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। কান্নার দমকে ওর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। কান্না ভেজা কণ্ঠে ও বলল,,,,
-আজ আমাদের প্রথম ম্যারিজ ডে, তুমি কিভাবে ভুলে গেলে??!!!
তন্নির জন্য কিনে আনা শাড়ীটা হাতে দিলাম। খুশিতে ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
-তোমার মনে আছে??
-আমার মনের ঝাপসা আর কুয়াশাচ্ছন্ন রজনী যে অপ্সরীর আগমনে চন্দ্রোজ্জল হয়ে উঠল, তার
আসার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আমি কিভাবে ভুলি??
-হিমু আবার কবিতা লেখে নাকি??
-হুম, রূপাকে পাশে পেলে অবশ্যই লিখে।
-থাক আর রোমান্টিকতা দেখানোর দরকার নাই। ফ্রেশ হয়ে খাবে চল। তোমার ফেভারিট খাবার
রান্না করেছি।
-জো হুকুম মহারাণী।
এক বছর আগে ফিরে গেলাম।
সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে তন্নি চলে
যাবার পর পরই ভাইয়ার ফোন আসে।
তন্নি দরজা খুলছে না।
ফোন পেয়েই তন্নিদের বাসায় দৌড়ে গেলাম।
তারপরের টা তো বুঝতেই পারছেন। ভাইয়া নিজে তন্নিকে আমার হাতে তুলে দেন। পরে
জানতে পারি ভাইয়ারও নাকি এমনই ইচ্ছা ছিল। আর রেস্টুরেন্টের সব ঘটনা তিনি তার ফ্রেন্ড
নাভিদ ভাই থেকে জানতে পারেন। নাভিদ ভাইও সেদিন সেই রেস্টুরেন্টে ছিলেন।
আমরা খেয়াল করি নাই।
জীবনে এমন কিছু কখনোই চাই নি বা আশা করি নি। কিন্তু আল্লাহ আমাকে না চাইতেই দিয়েছেন। তোমার কাছে হাজার শোকর। জানি হাজার বছরেও তোমার শোকর আদায় করা হবে না।
তোমার কাছে এই প্রার্থনা, বাকি জীবন সুখ কিংবা দুঃখ যাই আসুক না কেন আমারা যেন একসাথে কাটাতে পারি।
———————
(সকল কিউট কাপলদের উৎসর্গ করলাম।)
উৎস: অন্যভুবন