মুখোশ 

অরন্য রাত্রি

শীত এর বিকেল ।সন্ধ্যা পড়বে পড়বে। খোলা বারান্দায় বসে বিকেল এর কোমল আলো তে আকাশের মেঘের রঙ খেলা দেখছে পিয়াল। পিয়ালের মন অসম্ভব খারাপ আকশের এই অপরূপ সৌন্দর্য তার মনে দাগ কাটতে পারছে না। কিছুদিন আগে সজীব এর সাথে তার ব্রেকআপ হয়েছে।এমন অবস্থায় কোন কিছুই ভাল লাগে না।জীবন কে অর্থহীন মনে হয়।কারো কাছে যে বলবে এমন বন্ধু ও তেমন নেই। এক মিশু ছাড়া।মাগরিব এর নামাজ পর মিশু আসবে। তখন সব কিছুই খুলে বলবে মিশু কে।তাতে যদি পিয়ালের বুক টা একটু হাল্কা হয়।

আকাশের লাল রঙ ধীরে ধীরে কালো তে মিশে যাচ্ছে। পিয়াল এখনো বারান্দায় বসে আছে।মহসিন সাহেব ,পিয়াল এর আব্বা বার বার নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকছেন।কিন্তু পিয়াল এর উঠতে ইচ্ছা করছে না।ইচ্ছে হচ্ছে আরো কিছুক্ষণ গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে।মিশু এখনো এলো না মনে মনে ভাবছে পিয়াল।

আঙ্কেল কেমন আছেন? মিশুর কণ্ঠ শুনা যাচ্ছে। আরে এতক্ষণে এ তোর আসার সময় হল? বারান্দা থেকে বের হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল পিয়াল। আমি তো নামাজ পড়েই সোজা তোর বাসায় এলাম বললো মিশু। ওকে বাবা, চল রুম এ যেয়ে কথা বলি বলল পিয়াল।

রুমে তো এসে দরজা বন্ধ করে দিল পিয়াল।“আরে দরজা বন্ধ করলি?আমাকে রেপ করবি নাকি?” হাসতে হাসতে বলল মিশু।“ফাজলামি ভাল লাগছে না”বিরক্ত হয়ে বলল পিয়াল । “তুই দেখি ৬০ বছরের বুড়ো হয়ে গিয়েছিস।কি হয়েছে বল তো” বললো মিশু।

“কিছু না । সজিব এর সাথে ব্রেক আপ”

হা হা করে হেসে উঠলো মিশু। “এইটা নতুন কি ।তোর তো ১২ মাসে ১৩ রিলেশন।আবার আরেকটা প্রেম কর।তোর তো প্রেমে পড়তে সময় লাগে না”

“তুই হাসছিস? আমি মরি নিজের জ্বালায়। জানিস রাতে ঘুম হয় না।ক্লাস অফ দেখে আরো কষ্ট হয়।সারা দিন একা থাকি”

“তোর আসলে ব্যস্ত থাকতে হবে।ভাল কথা তুই যেহেতু ফ্রি আমার একটা কাজ কর।আমার এক ফ্রেন্ড এই নাম্বার দিয়ে বলল একটু খোঁজ নিতে।খুব নাকি আর্জেন্ট। আমি খুব ব্যস্ত ।আমার এক্সাম, জব । তুই একটু কথা বলবি ?তুই তো ফ্রি এখন”

এমন ভাবে বলল মিশু যে পিয়াল কথা টা না শুনে পারলো না।

রাত বাজে ১২ টা ।সবাই ঘুমিয়ে পরেছে।পিয়াল মোবাইল হাতে শুয়ে আছে।ভাবছে এখুনি ফোন টা করি।এই ধরনের ফোন গুলো সে রাতে করে।কিরকম জানি একটি উত্তেজনা কাজ্ করছে।নতুন কারো সাথে কথা বলতে গেলে তার এরকম লাগে।ফোন করলো ।অপর পাশ থেকে সাথে সাথে কেউ ফোন তুলল। গলা টা ভারি মিষ্টি।

“হেলো। কে বলছেন?”

“পিয়াল বলছি। আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে?”

“বলতে পারেন কিন্তু তার আগে আপনার পরিচয় বলুন”

কি পরিচয় দিবে? মিথ্যা বলবে?কেন জানি ছেলেটার কণ্ঠ শুনে খুব ভালো লাগলো।ট্রাস্ট করতে ইচ্ছে হল। আর পরিচয় বললে কি এমন ক্ষতি হবে।

“আমার নাম পিয়াল। বি বি এ পাশ করলাম । বয়স ২৪ আপনি?”

“পরিচয় না জেনেই ফোন করেছেন? বাহ ভাল তো। আমি আফ্রিকান দের মত কালো।পাহাড়ের মত মোটা আর মাথা ভর্তি টাক। কথা বলবা তো?” আপনি থেকে তুমি তে গেলো।

“কেন বলবো না? কিন্তু আমার মনে হয় আপনি এরকম না” বলল পিয়াল

“ওকে ফাইন। আমি ওতটা কুৎসিত নই।আমার নাম হিরন।থাকি বনানি তে। শখের ফ্যাশন ডিজাইনার।বয়স ২৫”

“কেনো ফোন করেছ জানতে পারি কি?জিজ্ঞেস করলো হিরন।“

“আপনার সাথে পরিচিত হতে।বন্ধু হওয়ার জন্য”চটপট উত্তর দিলো পিয়াল।

“সবাই তো তাই বলে।কিন্তু পরে সবাই সেক্স চায়”

“আমি এরকম না । নিশ্চিন্ত থাকতে পারো”

(বি দ্রঃ এটা ১০ বছর আগের কথা। তখন ইন্টারনেট এত এভেইলেবেল ছিল না।)

“তাহলে ছবি দাও”

ইতস্তত করতে লাগলো পিয়াল। “আচ্ছা আমি ফোন রেখে তোমাকে ছবি দিবো । কিন্তু তোমাকেও দিতে হবে”

“ওকে দিবো”

এরপর অনেক বিষয় নিয়ে কথা হল।কথা প্রসঙ্গে বুঝতে পারলো যে হিরন খুব রিচ ।তার বাবা মা মারা গিয়েছে।সে একাই থাকে।পাশের বাড়ি তে খালা থাকে।।তার বি এফ আছে।অনেক রিচ । দেশের বাইরে থাকে। সে অনেক ফ্যাশান সচেতন। তার ফোন রাখতেই এম এম এস টা পেলো পিয়াল ।মেসেজ খুললো। খুব সুন্দর একটা ছেলের ছবি । এটাই সেই ছেলে? এত সুন্দর! ফেক ছবি না তো?

নিজের ছবি পাঠালো পিয়াল। সাথে সাথেই জবাব আসলো ।

“বাহ । সুন্দর তো ।কাল কথা হবে”

এরপর থেকে প্রতি রাতেই কথা হতে লাগলো ।পিয়াল এর রাত আসলেই খুশি খুশি লাগতে থাকে ।একটু পরেই তো কথা হবে হিরনের সাথে। আগের প্রেম এর কথা সে ভুলে যেতে লাগলো ।ক্লাস নাই, বন্ধুরা সবাই বিজি।সারা দিন একা থাকতে হয়। তারপরো সজীব কে মোটামুটি ভুলে গেলো ।

সারা রাত কথা হয়।কিন্তু কেউ ই দেখা করার কথা বলে না। একদিন পিয়াল বললো “আসো দেখা করি”

“আমি তো দেখা করি না। আমার বি এফ জানতে পারলে আমাকে মেরেই ফেলবে।তুমি জানো না ও কত ভয়ংকর।শুধু আমাকে না তোমাকেও মারবে।এই জন্য আমি কারো সাথে দেখা করি না”

ভয় পেল পিয়াল।

একদিন হিরন বললো “পিয়াল শুনো কাল তো তোমার জন্মদিন গেলো ।তোমাকে আমি কিছু দিতে চাই। প্লিজ না করতে পারবা না”

“কিভাবে দিবে? তোমার সাথে তো আমার দেখাই হয় না?আর কুরিয়ার করলে বাসায় নানা ধরনের কথা জিজ্ঞেস করবে”

“আরে আমি আমার পরিচিত একটি গিফট শপ আছে সেখানে আমি গিফট রেখে যাব ।সেখান থেকে রিমি নামের একজনের কাছে গিয়ে আমার মোবাইল নাম্বার টা দিলেই হবে”

গিফট টা নিয়ে আসলো পিয়াল । খুললো অনেক সুন্দর একটি শার্ট। নীল রঙের।তার প্রিয় রঙ। একটি কাগজে লিখা শার্ট টা আমার ডিজাইন করা।

তারপর প্রায় গিফট আদান প্রদান হতে লাগলো।পিয়াল গিফট রেখে আসে।হিরন তুলে নেয়। অথবা হিরন রেখে আসে। পিয়াল এসে তুলে নেয়।

কথার পরিমান দিন দিন বাড়তে লাগলো। আগে খালি রাতে কথা হতো ।এখন যখন তখন কথা হয়। যত দিন যাচ্ছে হিরনের নতুন নতুন তথ্য জানতে লাগলো ।যেমন তার বি এফ খুব হেন্ডসাম ।অনেক অনেক টাকা।অস্ট্রেলিয়া তে থাকে।যখন তখন বাংলাদেশে আসে।তার সাথে সেক্স করে।বেডে অসম্ভব ভাল।কিন্তু তাকে অত্যাচার করে। কারো সাথে মিশতে দেয় না।যখন তখন গায়ে হাত তুলে।

পিয়াল অন্ধের মত বিশ্বাস করতে থাকলো হিরন কে।

একদিন পিয়াল ফোন করলো হিরন কে। অপর পাশ থেকে একজন মহিলা ফোন ধরলো।

“কে বলছেন?”

“আমি পিয়াল। হিরনের নম্বর না?”

“হিরন নামে কেউ থাকে না এখানে।কিন্তু যাকেই ফোন করেছেন সে অসুস্থ”

“হটাত করে ফোন টা রেখে দিলো”

একটু পরে হিরন ফোন দিলো।

“কেউ আমার ফোন ধরেছিল?”

“হুম ।একজন মহিলা। বলল তুমি নাকি অসুস্থ? হিরন নাম এর কেউ থাকে না”

“বুঝেছি তুলি ফোন ধরেছিলো।আমার কাজিন। সে অনেক অসুস্থ।তাই ফোন ধরে উল্টা পাল্টা কথা বলে”

এভাবেই চলতে থাকলো। জীবনের গল্প, সাহিত্য,সংস্কৃতি নিয়ে তারা আলোচনা করে।রাতেকনফারেন্স করে মানুষ কে বিরক্ত করে। আবার মাঝে মাঝেই হিরন পিয়াল কে গান শুনায়। কিন্তু তাদের আর দেখা হয় না।

হটাত একদিন হিরন বলল আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । আমি অস্ট্রেলিয়া তে বিএফ এর কাছে চলে যাচ্ছি। ওখান থেকে আর আমি তোমাকে ফোন করতে পারব না। আমাকে ভুলে যাও।

“কবে যাচ্ছো?”

“কাল”

“কি বল?তুমি আমাকে আজ জানালে?”

“আরে আমার বিএফ আজকেই জানালো। ও যখন তখন আমার টিকেট কাটলো”

এবার আকাশ ভেঙ্গে পরল পিয়াল এর মাথায়। আর থাকতে পারলো না। কেঁদে দিলো ওর সাথে কথা না বলে থাকবে কি করে।

১ সপ্তাহ হল হিরনের সাথে কথা হয় না।খুব কষ্ট হয় পিয়ালের ।বার বার ফোন করে কিন্তু মোবাইল বন্ধ।

ক্লাস শুরু হয়ে গেলো । বিজি হয়ে গেলো। ভুলে যেতে লাগলো হিরন কে।তার জীবনে আসলো রয়ন।

রয়ন এর জন্য জন্মদিনের উপহার কিনতে হবে।মনে পড়লো সেই গিফট শপ এর কথা। অনেক দিন যায় না। ভাবলো দেখে আসি। রিমির সাথেও তার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো।

“আরে ভাইয়া অনেক দিন পরে আসলেন? গিফট দেয়া নেয়া শেষ ?ঝগড়া হলো নাকি?আপু তো প্রায় ই আসে। আরেকটা ভাইয়ার জন্য গিফট রেখে যায়”

আপু? মাথা চক্কোর দিতে লাগলো। কিন্তু যার সাথে কথা বলতো সে তো ছেলে। এটা কোন মতেই হতে পারে না।

“আপু আজকেও আসবে ৪ টার দিকে। ভাইয়ার গিফট দিতে” কথা বলেই যাচ্ছে রিমি।

বিকেল ৪ টা ।এখুনি আসবে সেই মহিলা রিমির ভাষ্যমতে ।অনেকেই দোকানে ঢুকছে বের হচ্ছে। কিন্তু কেউ ই অপ্ল বয়স্ক মহিলা নয়। হটাত একটি গাড়ি এসে থামলো। একজন মহিলা একটি প্যাকেট নিয়ে দোকানে ঢুকলো।

পিয়াল বুঝলো এর কথাই বলেছে রিমি।মহিলা বের হতেই তাকে আটকালো পিয়াল।

“আপনি কে?”

“আমি পিয়াল । হিরনের বন্ধু”

এই কথা শুনে মহিলার মুখ সাদা হয়ে গেল। মহিলা বলল “আসুন একটি কফি শপে বসে কথা বলি”

অনেক কথাই বলল মহিলা । সে সব শুনে পিয়াল একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেলো ।এমনো হয়।

মহিলা বলল “আমি জেসমিন । আমি হিরনের ওয়াইফ।হিরনের মানসিক সমস্যা আছে।সে স্রিজফ্রেনিয়া তে আক্রান্ত।প্রায় ই হসপিটাল ভর্তি থাকে। যখন সুস্থ থাকে তখন সে এরকম ফোন এ মানুষের সাথে কথা বলে। মিথ্যা বলে। গিফট দেয়। আর সব গিফট পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমার।আমি না করলে আমাকে মারধোর করে।আবার যখন সে বেশি অসুস্থ হতে থাকে তখন সে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তারপর ক্লিনিকে ভর্তি হয়।ভাল হয়ে ফিরলে আবার ফোন। আমি জানতাম না।আমাকে এসব গোপন করে বিয়ে দিয়েছে।আমি গরীব ঘরের মেয়ে।ইচ্ছা করলেও ডিভোর্স দিতে পারি না।আমাদের ফুলশয্যাও হয় নাই।সে তো গে। কিভাবে হবে।আমার একটা বাচ্ছাও হবে না। কি নিয়ে বাঁচবো?এই যে আপনার সাথে কথা বললাম এটা সে জানতে পারবে। আমাকে অনেক অনেক মারবে”তারপর মেয়েটি কাঁদতে লাগলো ।বহুদিনের চাপা কষ্ট বের হয়ে এলো।

মেয়ে টি হেঁটে যাচ্ছে গাড়ি টার দিকে। একটি পরাজিত মানুষের মত হাঁটছে।পিয়ালের খুব কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য।

পরের দিন

নাস্তার টেবিলে নাস্তা খাচ্ছে আর পেপার পড়ছে পিয়াল।

“আরে আগে নাস্তা খা।পরে পেপার পর” মা ধমকে উঠলো ।

একটি খবরে চোখ পড়লো পিয়াল এর

স্রিজফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগির অত্যাচারে জেসমিন নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু।

কোন কিছুই থামলো না।শুধু জেসমিন এর যায়গায় আরেক জন আসলো ।জীবন তার নিজের মত চলতে থাকে। কোন শূন্য স্থান ফেলে রাখে না।

*****(সমাপ্ত)*****

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.