
চিন্ময়ের ইতিকথা
এই গল্পের প্রত্যেকটা চরিত্র এবং ঘটনা বাস্তব। ঘটনাটি লেখকের নিজের জীবনের কিছু খন্ডসূত্র।
—————————————-
১.
গ্রীষ্মের পর বর্ষা এলো তারপর শরৎ। গ্রীষ্ম আর বর্ষা তাকে চিন্তা করেই কাটিয়ে দিলাম। শুনেছি দিন যত্তো কাটে আকর্ষন আস্তে আস্তে কমে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে কি তার বিপরীত হয়? জানি না। এসব কঠিন বিষয় আমার চিন্তা করার জন্য না।
মুবাশ্বিরেরর ধাক্কাতে চিন্তার ছেদ পড়ল।
মুবাশ্বিরঃ কি রে। কার কথা চিন্তা করস?
আমিঃ আর যার কথাই করি কি না করি তোর কথা করি না।
মুবাশ্বিরঃ ব্লাডার ফেটে যাচ্ছে রে। চল প্রসাব করি।
আমিঃ প্রসাব করলে চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে প্রসাব করতে হয়?
মুবাশ্বিরঃ প্যাচাল পরছিস কেন? আয় না…।
ড্রেনের কাছে এসে আমি দাড়িয়ে ও মুবাশ্বির বসে প্রসাব করতে লাগল।
মুবাশ্বিরঃ শালার পুত। বইসা মুত।
আমিঃ চেয়ার আন। বইসা মুতি।
মুবাশ্বিরঃ আচ্ছা তুই এত্তো আজীব কেন!
আমিঃ কারন আমি আজীব। তাই।
আমাকে তো চিনতেই পারছেন। আমি অভি। আর আমার পাশের বান্দর টার নাম মুবাশ্বির। যাই হোক আবার গল্পে চলে আসি।
আমি আর মুবাশ্বির রেল লাইন ধরে হাটছি। স্যারের প্রাইভেটে যাচ্ছি। শরৎকাল।। আর কিছুদিন পর দূর্গাপূজো শুরু হবে। সেই উপলক্ষেই যেন রেললাইনের পাশে শাদা কাশফুল গুলো যেন বেশি করেরে ফোটতে আরম্ভ করেছে। হঠাৎ করে ফোন এলো। স্কীনে নামটা দেখে মুখে একচিলতে হাসি ফোটে উঠল। শাইনিং নূর। নূরঃ হ্যালো বেবি, কেমন আছো? আমিঃ বেশ। শোন আমি এখন প্রাইভেটের কাছাকাছি আছি। প্রাইভেট শেষ করে তোমাকে ফোন দিব। পাগলটার কথা চিন্তা করেই মনে মনে হেসে উঠলাম। আবার আরেকজনের কথা চিন্তা করে মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। সবুজের নীল…….।
২.
ফোন হারিয়ে যাবার পর অনেক ঝামেলায় পড়লাম। (মনের মন্দিরে ১ দ্রষ্টব্য). তবে মুবাশ্বিরের ফোন দিয়ে আরেকটা ফেসবুক একাউন্ট খুললাম। সেখানে অনেক ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসতে লাগল। সেখানে আরেকটা বন্ধু ছিল শাইনিং নূর নামে। তার সাথে মুবাশ্বিরের ফোন দিয়ে প্রায়সমই ফেসবুকে কথাবার্তা বলতাম। একদিন বাসায় মার ফোন দিয়ে লুকিয়ে ফেসবুকে বসলাম। ঢুকেই দেখি শাইনিং নূরের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট। এক্সেপ্ট করতেই বলে: ওই আইডিটা নষ্ট হয়ে গেছে তো। তাই। আচ্ছা তোমার ফোন নাম্বার টা দাও।
আমিও চিন্তা ভাবনা না করে তাকে আমার ফোন নাম্বার টা দিলাম। আমাদের কথা চলতে থাকে। দিনে রাতে সময়ে অসময়ে কি নিয়ে যে এত্তো কথা বলতাম তা জানি না। মনে হতো কথাগুলো যেন পিয়ানোর মতো অবিরাম সুরের তালে ঢেউ দিচ্ছে আমার অন্তরে। একদিন শাইনিং নূর আমাকে প্রপোজ করে বসে। না করতে পারি নি। তবুও মনের মাঝে একটা কেমন যেন টান অন্যকারো প্রতি। সেই অজানা বালক সবুজ……। ***
আজ দূর্গাপূজোর অষ্টমী। সকালে ঢাকে কাঠি পড়ার ফলে সেই ছোটবেলার মত তড়াক করে উঠে পড়লাম। আজ নূর ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে আসছে। ভালোলাগার ডাবল ডোজ পড়ছে আমার মনে। মনে হচ্ছে যেন একগুচ্ছ রঙ বেংঙের ম্যাকাও আমায় ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। আমার সামনে সে এলো কার্তিক ঠাঁকুরের বেশে। তার হাসিটা দেখে মাথা ঘুরে যাবার মতো অবস্থা। আমাদের সাথে মুবাশ্বিরও ছিল। তিনজন মিলে নাগরদোলায় উঠলাম। নাগরদোলা নিচে নামার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে রীতিমতো চিৎকার আরম্ভ করল। আমিতো হাসতে হাসতেই শেষ। তারপর তাকে নিয়ে গেলাম নৌকায়। দুজনে নৌকায় উঠে ছই এর উপর বসে আছি।
আমিঃ নুর। পুরোটাই কেমন যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
নূরঃ তুমিতো স্বপ্নশীলা। সবসময়….
আমিঃ কি! আমি স্বপ্নশীলা! তুমি কি। তুমি তো স্বপ্নমুন্নী, স্বপ্নচামেলী….
নূরঃ হা হা হা থামো তো…..। পারোও তুমি।
ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপার থেকে কিছু কাশফুল এনে দিলাম তাকে। কাউকে কাশফুল পেয়ে এতটা খুশি হতে দেখিনি। সারাদিন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরলাম। বিদায়বেলা যে বেদনাবিধূর। বাসে উঠে গেলো সে। চেয়ে রইলাম তার পথপানে। নীরবে সবকিছু অবলোকন করছিল মুবাশ্বির।
৩.
হালকা হিমেল হাওয়ার সাথে মিস্টি কুয়াশাকে নিমন্ত্রন জানালো হেমন্ত। সদ্যস্নাত শান্ত কন্যার চোখের শুভ্রতা নিয়ে এলো এই হেমন্ত। এক হেমন্ত সকালে মুবাশ্বিরের ফোন। মুবাশ্বিরঃ কই তুই।
আমিঃ সকাল ৬ টার সময় মানুষ কই থাকে?
মুবাশ্বিরঃ টয়লেটে?
আমিঃ না, বিছানায়।
মুবাশ্বিরঃ চল একটু গা টা গরম করি।
আমিঃ হোটেলের তাওয়া কিংবা চুলার উপর ২ মিনিট বস। তাহলে গা গরম হবে। এই বলে আমি লাইন কেটে দিলাম।
তৎক্ষনাত উঠে গিয়ে জগিং এর ড্রেস পড়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। রাস্তার শেষ মোড়ে দেখি সে দাড়িয়ে আছে। আসতেই সে খুশিতে দাঁত বের করে দিল।
আমিঃ সকালে ব্রাশ করেছিস বলে সবাইকে দাঁত দেখিয়ে বেড়াতে হবে, এটা তো কথা না।
মুবাশ্বিরঃ করেছি বলেই তো দেখাব।তুই করেছিস? জানি, করিস নি।
আমিঃ আমি রাত্রে ব্রাশ করে শুই।
মুবাশ্বির যেন আরো কি কি বলতে লাগল। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে এই প্রভাতে। কত সুন্দর। যদি নূর আমার সাথে থাকত তাহলে হয়তো আরো উপভোগ্য হত এই সকাল টা। সবুজ ঘাসগুলো আরো সজীব হয়ে আছে। কিন্তু সেগুলোকে মাড়াতে ইচ্ছে করছে না।।
মুবাশ্বিরঃ কি রে। এই ঢং শুরু করেছিস কেন? পা উচিয়ে হাটছিস!
আমিঃ সবুজ ঘাস মাড়াতে ইচ্ছে করছে না…..
মুবাশ্বিরঃ তুই একটা সাধারন জিনিস ভয়াবহ রকম ভাবে নিয়ে যাস। সেটা তোর সমস্যা। তোর বাসার কমোডের রং যদি সবুজ হয় তাহলে কি তুই সেখানে টয়লেট করবি না? ওসব চিন্তা ভুলে যা। প্রকৃতি যেই জিনিসটাকে যে কাজের জন্য তৈরী করেছে তাকে সেটার জন্যই ব্যাবহার কর। নদীকে পানি ও মাছের জন্য, গাছকে ফল ও কাঠের জন্য…..
আমিঃ আর সবুজকে……..
মুবাশ্বিরঃ তুই কাকে ভালোবাসিস? স্পষ্ট করে বল তো? নূর না কি সবুজের নীল……
আমি কিছুক্ষন নিশ্চুপ ছিলাম। আমার দৃষ্টি ছিল শূন্য।
মুবাশ্বিরঃ দেখ, সবুজ নামে কারো অস্তিত্ব আছ কি না তা আমরা জানি না। সেই গল্পের লেখকের নাম সবুজ নাও তো হতে পারে। এমন তো হতে পারে যে সবুজ তোর মানসপ্রতিমা।
আমি ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে চিন্তা করলাম। সবুজ নামে কি কেউ নেই? সবুজ কি শুধুই আমার মনের একটা মানসমূর্তি? কেন যেন আর কিছু চিন্তা করতে চাইলাম না। আমার ফোন বাজছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি নূরের ফোন। ফোনটা ধরলাম না। বাজতেই থাকল। হেমন্তের সোনারং রৌদ্রের হালকা আলোয় সকাল টা ছিল মনোমুগ্ধকর। কিন্তু সেই দৃশ্য অবলোকন করার মত মন মানসিকতা ছিল না।
৪.
হেমন্ত অতিরিক্ত সময় কাটানোর পর যখন দেখে প্রকৃতিতে তার থাকাটা অভদ্রতা দেখাচ্ছে, তখন এক রাত্রে কাউকে কিছু না বলে চুপি চুপি চম্পট দিল। আর সে রাত্রেই দলবল নিয়ে হামলা দিল শীতের বুড়ি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি হাড়কাঁপানো শীত। ফ্রেশ হয়ে কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার মধ্য হেটে যাচ্ছি পিঠাওয়ালার দিকে। গিয়ে দেখি মুবাশ্বির দাড়িয়ে আছে। তেমন কিছু গায়ে দেয় নি। আমি বলে ফেললাম – বাবু মরে শীতে আর ভাতে। তারপর চিন্তা করাম, সত্যিই কি বাবু শীতে মারা যায়? না মরে না।
আমাদের ক্লাসে বাবু নামের ছেলেটা খেতেও পারে আর শীতে কাপড় দ্বারা রেপিং ও হয়।
আমি আবার মুবাশ্বির কে বললামঃ কি রে ফকিন্নি, কি করস?
মুবাশ্বিরঃ কানা না কি। পিঠা খাইতেছি দেখস না। আর আমি তোর মত ফকিন্নি না। আমিঃ তাহলে তুই কার মতো ফকিন্নি?
মুবাশ্বির জবাব দিল না।
আমি পিঠা খেয়ে মুবাশ্বির কে বললামঃ বিলটা দিয়ে দে।
খাওয়াদাওয়ার পর দুজন মিলে হাটছি। সবুজ ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছি দূরে। হালকা সূর্যের আলোয় শিশিরভেজা ঘাস, ঘাসফুল ও ধানক্ষেত যেন চকচক করেছে। দুজনেই সামনের দিকে তাকালাম। সাথে সাথে মুখটা বিবর্ন হয়ে গেলো। দুজন একসাথে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলাম -ওহ মাই গড। ভদ্রা কালী! দূর্ভাগ্যবশত সে কেরানির মেয়ে এবং আমাদের বান্ধবী। তার প্রধান গুন হল এট এ স্ট্রীচ বকবক করে যাওয়ার ক্ষমতা অসাধারন এবং সে যখন কথা বলে তখন আমরা কিছুই বলতে পারি না। তাকে ইগনোর করা যেতো কিন্তু তাতে আমাদের ক্ষতি টা বেশি হতো। কারন তাহলে কলেজ কর্তৃক সুবিধাগুলো আর পেতাম না। ঝাড়া দেড়ঘন্টা আলাপের পর যখন আমদের অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি তখন সে বলে – আজ তো কথাই তো বলতে পারলাম না। কালকে এসো হাতে একটু সময় নিয়ে। আমরা অনেক গল্প করব।
হাঁফ ছেড়ে বাচার পর তাকে বললাম
-অবশ্যই। কেন নয়! কালকে আসব। তুই আসবি না মুবাশ্বির?
-হে হে। আমি আবার না এসে পারি। অবশ্যই আসব।
চলে যাওয়ার পর মুখ খারাপ করে দশ বারোটা গালি গালাজ করে যখন একটু রেস্ট নিব তখনই শুনি পিছন থেকে কে ডাকছে। পিছনে ঘুররে মেজাজটা আরো গরম হয়ে গেলো। জোকস সুমন। আজ আসুক। একেবারে অপমান কাকে বলে দেখিয়ে দিব।
সুমন এসেই বলছে জানো একটা জোকস শুনেছি। বলি? সে কারো উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে শুরু করল তার বোরিং জোকস বলা
– একবার আমি একটা রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম। দেখি যে একটা গাভী মাটিতে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। আমি তাকে জিগ্যেস করলামঃ কিরে হাসছিস কেন? গাভীটা বললঃনা ঐ ষাঢ়টার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমিঃ কেন? গাভীঃ না, সে বলে কি না আমার না কি নাক টিপলে দুধ পড়ে। হা হা হা……। জোকটা কেমন?
আমিঃ জোকটা ওয়াক থুয়িং টাইপ।
সুমনঃ সেটা কেমন?
আমিঃ ওয়াক থু। আর এসব গরুর জোকস শুনে গরুই মজা পাবে। কথায় আছে না “রতনে রতন চিনে, গরু চিনে ঘাস।”
সুমনের মুখটা চিমসে হয়ে গেলো। বেশ উৎফুল্ল মনে আসতে লাগলাম। ঘরের কাছাকাছি আসতেই শুনি ভুমিকম্প হচ্ছে। কে যেন রিখটার স্কেলে গান গাচ্ছে। তবে আমি তাতে আরো খুশি হয়ে ঘরে দৌড়ে ঢুকলাম। বড় মামা বলে মামার কাছে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। নিঃসন্তান মামা পিতৃস্নেহে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে বললঃ তোর জন্য একটা গিফট আছে।
আমি জ্বলজ্বল চোখে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রেপিং করা রংচঙে একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি।করে খুলে দেখি ভিতরে একটা ফোন। আমিতো ভাষাহীন হয়ে গেছি। গল্প কিংবা নাটকেই এরকম দেখা যায়। তবে জীবনটা যেহেতু রঙ্গমঞ্চ তাহলে আমাদের প্রতিটা ঘটনাই তো নাটকের অংশ। তাড়াতাড়ি ফোন খুলে ফেসবুকে ঢুকলাম। অনেকক দিন ঢুকা হয় না। ঢুকে যা দেখলাম তাতে হতভম্ব হয়ে গেলাম। মাথাটা কিছু কাজ করছিলো না। শূন্যে তাকিয়ে থাকলাম। কি হল এটা! দুজন শাইনিং নূর আমাকে ম্যাসেজ করেছে। আমি পাথর হয়ে গেলাম।
৫.
তাড়াতাড়ি গিয়ে দুজনেরর প্রোফাইল চেক করলাম। কোথায় নূরের আইডি নষ্ট! তার আইডি দিব্যি চলছে। আর আরেকজনের! সে তো ফেইক! ভন্ড! তার মানে আমি এতোদিন নকল নূরকে ভালোবেসেছি! আবেগ ও ক্রোধকে সংবরন করলাম। চিন্তা করছি কি করব আমি। কে এই নকল নূর! নূরকে ফোন দিলাম। নকল নূর ফোন ধরল। ফোন ধরে স্বাভাবিক কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগলাম। হঠাৎ করে কে যেন কেশে উঠল।
-কে কাশল নূর?
-এইতো, আমার ভাই।
তবে কেন যেন কাশের শব্দটা অতি পরিচিত লাগছিলো। যাই হোক, কথা চালিয়ে গেলাম। ফোন কাটতেই মুবাশ্বির বাসার বাইরে থেকে ডাক দিল। বের হতেই দেখি সে দাড়িয়ে আছে। তার সাথে আনমোনা হয়ে ঘুরতে থাকলাম শীতের রিক্ত গোধূলীতে। আসার সময় সে কাশতে কাশতে বলল -শীতটা ধরে ফেলেছে রে। আমার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। বুঝতে পেরেছি যে কাশিটা মুবাশ্বিরের। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বাসায় গেলাম। মুবাশ্বিরের আইডিতে তার ফ্রেন্ডদের দেখতে থাকলাম। অনেক খুঁজে খুঁজে একটা নাম দেখলাম। কায়সার হামিদ জয়। যে কি না নকল নূরের বেশে ছিল। তার আইডিতে প্রোফাইলেই পিকচার ছিল অনেকগুলো। তাই আমার আর সন্দেহ রইল না।
***
তাকে হাতেনাতে ধরার জন্য নতুন একটা আইডি খুললাম। “চিন্ময়ীর ইতিকথা” নামে। সেখান থেকে তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম। এক্সেপ্ট করল সে। তার সাথে কথা বলে যেতে থাকলাম দিনরাত্র। সে ফোনে কথা বলতে চাইতো। কিন্তু আমি তাকে সবসময় টেক্স করে রিপ্লে দিতাম। অনেক কষ্টে তাকে রাজী করালাম দেখা করাতে। সে ময়মনসিংহেই থাকত।
****
আজ শীতের শেষ দিন। শেষ দিন যেন শীত তার প্রকোপটা দেখিয়ে দিচ্ছে ইচ্ছেমতো। নিরাসক্তভাবে ট্রেনে উঠে বসলাম। আজকের শীতটাতে সবকিছু কেমন যেন নিষ্প্রান লাগছিলো। কানের কাছে হু হু করে শিষ কেটে যাচ্ছিলো হিমেল হাওয়া। যেন কারো বুক চিরে বেরুনো শেষ নিঃশ্বাস। ময়মনসিংহে যেন উড়ে চলে গেলাম। পার্কের নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
হঠাৎ করে কে এসে আমার কাধে হাত রাখল। পিছনে ফিরে তার দিকে তাকালাম। দেখি জয় দাড়ানো। আমায় দেখে ভয়াবহ রকমের চমকে গিয়ে বললঃ ত্ত…ত্ত…. ত্তুমি! আমিঃ কেন নূর? চিনতে পারছো না!
হঠাৎ করেরে ভয়াবহ রকমের ক্রোধে আমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পরে এলোপাথারি মারতে লাগলাম। অশ্রাব্য গালিগালাজও দিলাম। সে টু শব্দ করেনি। হঠাৎ যখন হুঁশ হল তখন স্থব্ধ হয়ে গেলাম।
জয় বলতে লাগল এক কাহনীঃ শোন, মুবাশ্বির আমার ভালো বন্ধু। সে সবকিছুই আমার সাথে শেয়ার করত। আমাকে সে জানিয়েছিল তোমার কথা। তোমার প্রতি তার ভালোলাগার কথা। আমি তাকে বুদ্ধিটা দিয়েছিলাম। আর তার হয়ে তোমার সাথে একবার দেখা করতে আসি আমি। সে আমাদের সব কথা শোনত। কনফারেন্সের মাধ্যমে। সেদিন কাশিতেই মনে হয় তুমি কিছু বুঝে গিয়েছিলে। মুবাশ্বির জানতো একদিন না একদিন ধরা পড়বে। তবুও সে তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসে জানাই নি। যদি বন্ধুত্ব টা নষ্ট হয়। প্লীজ যত কিছু হোক কি না হোক তার বন্ধুত্ব তুমি নষ্ট করো না।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। গাছ থেকে পাতারা ঝরে ঝরে পড়ছে। ট্রেনে উঠে দাড়ালাম। নির্জন এক শীতের শেষ গোধূলী। ট্রেন যেন চলছে উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে। বাসায় এসে সবুজের নীলাকাশ কে ফোন করলাম। (তার সাথে পরিচয় মনের মন্দিরে ১এ দেয়া আছে)।
-আচ্ছা, শাইনিং নূরকে তুমি চিন?
-হা। খুব ভালোভাবে। সে একসময় আমার বি এফ ছিল।
গড়িয়ে গড়িয়ে নির্ঘুমে পাড়ি দিলাম শীতের শেষ রাত্রটি।
৬.
আজ বসন্তবরন অনুষ্ঠান। উপজেলায় বসন্তবরন উৎসব শুরু হবে। বিছানা থেকে একটা প্রানহীন দেহ উঠে বাথরুমের দিকে গেলো।
স্যার ফোন করলঃ -অর্কমার ধাড়ি সব। কখন আসবে তোমরা। তাড়াতাড়ি এসো। পারফর্ম করতে হবে। মুবাশ্বির কে আসার সময় নিয়ে এসো। তোমার পারফর্মের পরে তার পারফর্ম টা।
নাস্তা করলাম না। মা রবীন্দ্রসংগীত গুনগুনিয়ে ভজছে -আহা, আজি এ বসন্তে, এতো ফুল ফোটে….. রাস্তায় নেমে পড়লাম।
চারদিকে সবুজের আগুনে জ্বলে গেছে। নতুন নতুন সব কচিপাতা যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে অনাবিল আনন্দ। কিন্তু আমার মন আজ নিষ্প্রান। ক্লান্ত, শ্রান্ত, ক্ষত, বিক্ষত। প্রকৃতি আপন রঙে সেজেছে। আকাশ সাজিয়েছে নীলে আর পাতারা সেজেছো সবুজে। চারদিকে যেন সবুজের নীলাকাশের এক সপ্রাভ আভা। নীল নীলিমার চুঁয়ে পড়া নীল রং সবুজ পাতাতে পড়ে সৃষ্টি করছে এক মোহ। আমি মোহমুক্ত।
অনুষ্ঠানে পৌছুলাম। পিছনে একটা বিশাল পুকুর ও তার পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছ। গুড়িতে বসে পা ডুবিয়ে আছি পানিতে। আমার মনটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। আমার মনের যে মন্দিরটাতে দেবতা হিসেবে কাউকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলাম তা কি হয়েছে? হা, মন্দিরটাতে দেবতার বিগ্রহ বসিয়েছিলাম কিন্তু প্রান প্রতিষ্ঠা করা হয় নি। পূজার সেই নৈবেদ্য হাতেই রয়ে গেলো। পতিত হয়ে আছে আমার মনের মন্দিরটা। পেছন থেকে কম্পিত স্বরে আমাকে ডাকল মুবাশ্বির। তার চোখ দুটো জলাসিক্ত। তার কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম।
মুবাশ্বিরঃ তোকে একটা কথা বলতে চাই।
মুবাশ্বির কিছু বলার আগেই আমি তার গালে একটা চড় বসালাম। কড়া স্বরে বললাম
-উত্তরটা পেয়েছিস?? ভালো বন্ধু হয়ে তুই এটা কেন করলি! কখনো কারো আশ্রয় ছাড়া নিজে বলে দেখতি। তুই আমার মন ভেঙে দিয়েছিস। তুই চলে যা। চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে। দূর হ তুই।
মুবাশ্বিরের চোখে সেদিন দেখেছিলাম ভালোবাসার বাঁধন। এক অব্যাক্ত আকুতি। তাকে তার পছন্দের কথাটাও বলতে দেইনি। হয়তো সে বয়ে বেড়াবে এক বুক ভরা কষ্ট। এক নীল কুয়াশা। সূর্য ক্রমেই উজ্জ্বল হচ্ছে। দখিনা বাতাস ও মহুয়া ফুলের ঘ্রানে আমার বুক দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। চোখ ছিল ভাষাহীন। সেই গাছের গুড়িতে বসে পা ডুবিয়ে আছি পানিতে। পানিতে ভাসছে কিছু কৃষ্ণচূড়া। দূর থেকে আওয়াজ শোনতে পাচ্ছি। এবার স্টেজে আসবে অভি। দুঃখিত অভি এখন উপস্থিত নেই। স্টেজে গান গাইতে আসছে মুবাশ্বির। মুবাশ্বিরের গলায় সেই গানে যেন বসন্তও বিলাপ করছিলো। মহুয়ার সেই ঘ্রান থেমে গিয়েছিল। বইছিলো না সেই দখিনা মালঞ্চের হাওয়া। কোকিল পর্যন্ত তার গান তন্ময় হয়ে শোনছিলো। নিঃস্থব্ধ সেই দুপুরে মুবাশ্বিরের গানে আমার ভাষাহীন চোখে জমছে মেঘ। দুঃখগুলো গুমড়ে গুমড়ে থেকে এখন যেন গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে গেছে। দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল মুবাশ্বিরের গানে।
মুবাশ্বির গাইছেঃ ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখ তোমার মনের মন্দিরে………….
উৎস: অন্যভুবন