কৃষ্ণ গহ্বর

বন্ধু ভালোবাসা

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত একটি ছোট গল্প। গোপনীয়তা রক্ষার্তে চরিত্র, যায়গা, এবং প্রতিষ্ঠানের নাম কাল্পনিক নামে উপস্থাপন করা হল।

সন্ধ্যে থেকে খুব অস্থির লাগছে, কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ কানে হেড ফোন লাগিয়ে পুরানো হিন্দি গান শুনলাম।তারপর ভাবলাম একটু ফেসবুকে ঢুকা যাক। প্রায় ১৫ জনের মত আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছে। একটা আইডির নাম দেখেই একটু অন্য রকম লাগল। তার পাঠানো বন্ধু বানানো অনুরধের ঢেকি গিলতে না গিলতেই তার খুদে বার্তা।

-হ্যালো

-হাই

-কেমন আছেন?

-ভালো। আপনি?

-এইত ভালোই আছি।

-কি করছেন?

-অফিসে আছি। আপনি?

-আমার রুমে । একা একা ভালো লাগছে না কিছুই।

-কেন কেউ নাই বাসায়?

-না একদমই একা। সন্ধ্যা পার হল এখনো অফিসে?

-এইতো এখনি যাবো। আচ্ছা আপনি কোথায় থাকেন?

-আমি ধানমণ্ডি । আপনি?

-পোস্তাগোলা।

-আচ্ছা বলুনতো আপনার ফেসবুকের নাম “কৃষ্ণ গহ্ববর” কেন ?

-সে অনেক কথা অন্য একসময় বলব। এখন বিদায়। শুভ সন্ধ্যে।

-বিদায়। শুভ সন্ধ্যে।

তাকে বিদায় দিলাম এবার ঘাটাঘটি শুরু। তার টাইম লাইনে ঢুকেই দেখলাম পুরাই ফাকা। তার সম্পর্কে তেমন কিছুই নাই। শুধু নিকষ কালো একটা প্রোফাইল ছবি। ফেক আইডি বুঝতে আর বাকি রইল না। আমি হারিয়ে গেলাম আমার এক পরিচিত বন্ধুর সাথে গাল গপ্পে।

ঠিক ২ দিন পরে একদিন বিকেলে একা একা ধানমন্ডি লেকে বসে বাদাম চিবুচ্ছি । এক পর্যায় একে একে সব বাদাম শেষ করলাম, এখন কি করব। লেকের পারে মৃদু বাতাস ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না, আবার আশে পাশে প্রেমিক প্রেমিকাদের ভীর।দুচোখ বন্ধ করে একটা জোরে নিঃশ্বাস ফেললাম।কেমন জানি প্রেম প্রেম পরিবেশ খুজে পেলাম। আমার দু কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস অনুভব করলাম।কেন যানি মুহুর্তেই  সবকিছু ফাকা ফাকা লাগল।আবার বেশ ভালই লাগছিল। অদ্ভুত ! ফেসবুক জগতের সাথে আমি যে হারে মিসে আছি তাতে বলা চলে এক প্রকার নেশায়ই পেয়েছে আমাকে। আবার সেই মুঠো ফোন। আর অপেরা শুরু করলাম ফেসবুক ডট কমে। দিয়ে দিলাম একটা ছিম ছাম স্ট্যাটাস “সময়টা অন্য রকম লাগছে, ধনমন্ডি লেকের মৃদু বাতাসে”।  ঠিক ৫ মিনিট পরে কৃষ্ণ গহ্ববরের একটা মন্তব্য পেলাম। “আমি আসলে মন্দ হত না” আমি মন্তব্যহীন । একটু পরেই সে আমাকে খুদে বার্তা পাঠালো।

-তুমি এখন লেকের কোন পাশে আছো?

-৮ নাম্বার ব্রিজের কাছে।

-ওহ আমি ৩২ নাম্বার।

-ওখানে কি করছেন?

-এখানে আমার অফিস

-আচ্ছা তাই বুঝি?তাহলে তো আপনি আমার একদমই পাশে আছেন।

-বলতে পারো। আচ্ছা দেখছো আমি তোমাকে তুমি করে বলছি। অথছ আমি জানি না তোমার বয়স কত?

-আমি ২২। আপনি?

-আমি ৫০। তুমি করে বলার ভুলটা তাহলে আর হল না। অবশ্য আমি জানি আমার ফেসবুকের যত জন বন্ধু আছে আমিই সবার থেকে বয়েসে বড়। যাই হোক তুমি কি আমার সাথে দেখা করতে পারবে এখন?

-না পারব না। আমি এভাবে কারো সাথে দেখা করি না।

-আচ্ছা ঠীক আছে। আমি যদি আসি?

-না না তার আর দরকার নাই। আচ্ছা আমি বাসায় ফিরব এখন, বিদায়।

-আচ্ছা বিদায়।

আমি হাটা শুরু করলাম আর মনে মনে ভাবলাম ৫০ বছর বয়স হয়েও এভাবে ফেক আইডি খুলে মজা লুটছে। আবার দেখা করতে চাচ্ছে। বুড়া বয়সে ভীমরতি। বাহ মন্দকিসে।হেটে চলছি আর কানাকানি শব্দে গান  করছি।

বাসায় ফিরে আবার ফেসবুক চালু করলাম । কি জানি না আমার কি হচ্ছে করছি। একদম নিয়মহীন জীবন যাপন। যখন তখন যেটা সেটা। ফেসবুক খুলেই কেন জানি ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় তাকে খুজতে শুরু করলাম। আছে কি সে এখনো এই অচেনা মিছে জগতে।

-হাই(আমি)

-তুমি কিন্তু আসতে পারতে।

-কোথায় আসবো?

-আমার অফিসে।

-এসে কি হবে?

-গল্প করবো।

-এখন আসবো?

-এসো

-আচ্ছা আমি ২০ মিনিট পরেই আসবো। ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিন।

-তুমি ৩২ নাম্বার এসে আমাকে ফেসবুকেই নক করো আমি অনলাইনেই থাকবো।

-সে কেমন হল না।

-কিছু হবে না তুমি আসো।

-ওকে

আমি যাব কি যাবো,যাবোনা, ভাবনায় পরে গেলাম। তারপরে ঠীক করলাম যা হয় হোক যাবো।

এসেই তার কথা মত ফেসবুকে জানালাম। সে আমাকে ২৩/ডি নামের বাড়ীর ৪ তালায় যেতে বলল। দূর এ কেমন লোক। একটূ ভয় ভয় লাগছিল। তবুও খুজে খুজে অবশেষে খুজে পেলাম।

বাড়িটা বেশ মধ্যম বয়সের হবে।হলদেটে রঙের দেয়ালের কোথাও কোথাও শ্যাওলা পরে আছে।কোন লিফট নেই, বিনে পোলিশ করা সিড়ি।সিড়ির পাশে দেয়ালে উপরের দিকে মুখ করে একটা তীর চিহ্ন তার মধ্যে“ঢাকা চ্যারিটি অফ চাইল্ড” আবার তার নিচে ছোট করে  “চার তলা” লেখা।

আমি তাকে ফেসবুকে মেসেজ করলাম আমি হলুদ টী শার্টে আপনার অফিসের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছি।

মুহুর্তের মধ্যেই একজন লোক আমাকে বলল আসুন ভিতরে আসুন। তাকে দেখেই আমি ভীমরি খাবো অবস্থা।(অফিসের ক্লার্কের মত একজন) । মনে মনে বলালাম ইয়া আল্লাহ আমি কোথায় এলাম।

সে বলল আপনি ভিতরে যান স্যার ভিতরেই আছেন। আহ বাবা বাচলাম, তাহলে উনি সে না।

-আমি কি আসতে পারি? কৃষ্ণ গহ্ববর ?

-ওহ এসে পড়েছে। হ্যা অবশ্যই কেন নয়। প্লিজ এসো।

আমি ভিতরে ঢূকলাম তারপর আমাকে সে বসতে বলল।

-কি খাবে বল। ঠান্ডা না গরম?

তার কথার কি উত্তর দিব,তার অফিস রুমের চার পাশের দেয়ালআমার চোখ আটকে ফেলেছে। দেয়ালের চারোদিক আর কিছু নেই শুধু একজনের ছবি। তাও আবার একটা ছোট্ট ছেলের ছবি। আবার তার টেবিলের উপরেও বাশের কিঞ্চি , পাথর, মাটি আরও কত রকম বাধানো ফ্রেমে সেই ছবি। যেন একজন মানুষের জন্য সব দেয়াল আর টেবিল। মনে হচ্ছে শিশুটি চারদিকে ঘুরছে আর খেলছে। মেঝে নরম কার্পেট। দুইটা জানালা সেখানে নীল রঙের পর্দা তার পাশেই সাজানো বুক সেলফ। সাদা কালো, রঙ্গিন, আশির দশক স্ট্যাইলে নানা রকম ছবি। যেন ছবি ছাড়া আর কিছু নেই এখানে। মনে মনে ভবলাম একি অবস্থা।

-না আমি কিছু খাব না। আচ্ছা আপনার দেয়াল জুরে শুধু দেখছি একটা ছোট বাচ্চার ছবি। আমার কৌতুহল হচ্ছে। আচ্ছা সে কি আপনার ছেলে?

-আচ্ছা বলছি । আমি কি চা আনতে বলল? চা খেতে খেতে বলি?

-আচ্ছা

-হুম । তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমার আইডির নাম কৃষ্ণ গহ্ববর দিয়েছি কেন?

-হ্যা বলেছিলাম। কিন্তু কেন?

-আসলে আমি নিজেই একটা ব্লাক হোল। ব্লাক হোল চিনো তো। নিশ্চই চিনো তুমি।

-হ্যা জানি, নক্ষত্রের শেষ অবস্থা হল ব্লাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্ববর। কৃষ্ণ গহ্ববরের ঘনত্ব এতই বেশি যে তার কাছ থেকে আলোও বের হতে পারে না। তাই তাকে সনাক্ত করাও কঠিন। আমাদের সুর্য যখন তার সব জ্বালানি শেষ করে ফেলবে তখন সে একটা কৃষ্ণ বিবরে পরিনত হবে। আর আমাদের পৃথিবীসহ তার চারপাশের সব গ্রহ, উপগ্রহ ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু এর সাথে আপনার সম্পর্ক কি?

-কারন আমি সব কিছু ধ্বংস করে ফেলি।

-কিন্তু কেন?আর সে কেমন করে?

-দেয়ালে যে ছবি গুলো দেখে তুমি অবাক হয়েছো। সে আমার ভাগ্নে আমার ছেলের মতই বলতে পার।আর আমি তাকে ধ্বংস করে ফেলেছি।

-ধ্বংস করেছেন মানি?

-হ্যা ধ্বংস করেছি। আমি নিজ হাতে তাকে হত্যা করেছি। একটা সময় ছিল যখন আমি মানুষিক বিকৃতির একজন মানুষ ছিলাম।কিন্তু কেন আমার মধ্যে সে আচরন ছিলো আমি নিজেও জানতাম না। তখন আমি তোমার মতই একজন ছিলাম। ছোট ছোট কচি মুখ দেখলে সব মানুষ যেমন আঙুল দিয়ে তুলতুলে গালে আদর করে দেয়, কিন্তু আমি তাদের নিয়ে অন্য কিছু ভাবতাম। আমি তাদের আমার রাতের সঙ্গি হিসেবে বেছে নিতাম।

আমি অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে যাই তার কথা শুনে।। অফিসের ক্লার্ক চা নিয়ে ঢূকল। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,“আচ্ছা তারপর কি হল?”

-আমার বোন মিলির প্রথম সন্তান রিদিম। দেখেই বুজতে পারছো রিদিম দেখতে কেমন। বলতে পারো রাজ কুমার। আর তার মায়া ভরা মুখ। সেদিন ছিল ঈদের ২য় দিন।রিদিমের বয়স তখন ৬।মিলি আমাদের বাসায় বেরাতে এসেছে। সঙ্গে এসেছে ওর স্বামী। আমি রিদিমকে অনেক আদর করতাম। ও আমাকে ছাড়া কিছুই করত না। নাওয়া খাওয়া ঘুম সব কিছুতেই আমি। আমি অনেকটা জোর করেই রিদিমকে আমার কাছে ঘুমাতে নিয়েছিলেম সেদিন। আর ও তো খুসিতে আত্ত্বহারা। ঠীক রাত ১২ টা পার করেছে। আমার বিকৃতি মানুষিক যন্ত্রনা যেন আমাকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে। আমি ঝাপিয়ে পরেছিলাম রিদিমের উপর।রিদিম যেন কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু ঘুমের ঘোরে কিছু বলছে না। আমার দৈত্তের মত আচরন রিদিমকে রক্তাত্ত করে তুলল। রিতিমত রিদিমের ঘুম ভেঙে যায়। আমি কিংকর্তব্যবিমুর । আমার বিবেকের যেন এক মুহুর্তেই মৃত্যু ঘটল , নিজেকে বাচাতে আমি যথা উপযুক্ত কাজ করতে উদ্দত্ত হলাম। একটা বালিশ নিয়ে চেপে ধরলাম ওর মুখে, যেন ও চিৎকার করতে না পারে। রিদিমের প্রান  যেন যেতে চাচ্ছে না। হাত পা চাপড়াচ্ছিল আর ছটফট করছিল সে। তারপর সব শেষ।

কি শুনছি আমি এসব। আমার হাত পা কাপছে। মনে হচ্ছে আমি বোবা হয়ে গেছি। কিছু বলতে পারলাম না।তারপর সে আবার বলতে শুরু করল।

-আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম পালিয়ে যাবো। আমি দরজার খুলতে যেতেই মনে হল রিদিম আমাকে বলছে। কোথায় পালাবি তুই। আবার ছুটে এলাম। দেখলাম আবছায়া আলোর মাঝে রদিমের মুখ খানা। মনে হল হেসে হেসে ঘুমাচ্ছে। নিতম্বের নিচে রক্তাত্ত নিথর দেহখানা যেন আমাকে বলছে। তুই পাপি। তোর রেহাই নেই। আমি চিৎকার করতে করতে বললাম না না না না না না ………

তারপর পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। প্রায় ৩ বছর পরে জেলা জ্যাজ আমাকে ফাঁসি দিলো। শুনে আমি খুব খুশি হলাম। মনে মনে ঠীক এটাই আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন যেন আমার মা আমার জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করল।তারপর হল ১৪ বছর সাজা।

১৪ বছর পরে যাখন বের হই তাখন আমার বয়স ৩৮ সবাই বলল বিয়ে করতে। আমি মনে মনে ঠীক করলাম আমি আর বিয়ে করব না। ভাবলাম সুবিধা বঞ্ছিত শিশুদের নিয়ে কাজ করব। আর গড়ে তুললাম এই চ্যারিটি।

সময় যেন থমকে গিয়েছিল। আমি আর আমিতে নেই। দেয়ালের সেই ছবি গুল দেখছি আর ছবির মাঝে হারিয়ে গেছি। কি সুন্দর একটা মুখ। হেসে আছে কোথাও। আবার কোথাও মামার গালে চুমু খাচ্ছে। একটা বিশাল ফ্রেমের মাঝে যে ছবিটা আছে সেখানে সে হাত বাড়িয়ে কি জানি চাচ্ছে।

*****সমাপ্ত*****

উৎস: অন্যভুবন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.